❤#ইচ্ছে_ডানা
#অষ্টম_পর্ব ❤
সৌরদীপ অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, অর্পিতার ব্যাপারে ওর প্রত্যেকটা কথা, প্রতিটা মুহূর্ত আজও, এতদিন পরও স্পষ্ট ভাবে মনে রয়েছে। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা তো ও কম করেনি এতদিনে! বিভিন্ন ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে, অনেক কাজে, তা সত্ত্বেও কেন একফোঁটাও এতটুকু স্মৃতি মন মুছে ফেলতে পারেনি? মনে রাখাও তো এত কষ্টের নয়, যতটা ভুলে যেতে গেলে হয়। নিজেকে আটকে রাখা সত্ত্বেও অজান্তেই সৌরদীপের হাত চলে গেল গ্যালারির ছবিগুলোর দিকে। শেষ ছবিটা অর্পিতা হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকাকালীন তোলা। কেমোথেরাপি নিয়ে যখন ওর মাথার সেই সুন্দর চুলের আর অবশিষ্ট কিছুই নেই। ক্যান্সারের থাবায় চোখের তলায় গভীর কালির ছাপ স্পষ্ট। এই ছবিটা তোলার প্রায় একসপ্তাহ পরেই অর্পিতা মারা যায়। ওর সাথে কোনৌ ছবি তুলে স্মৃতি করে রাখার মতো সুযোগ সারাজীবনের মতো শেষ হয়ে যায়। অর্পিতা চলে যাওয়ার পরে অদ্ভুত ভাবে সৌরদীপ এতটুকু চোখের জল ফেলতে পারেনি। কাঁদতেই পারেনি, কোনো কষ্টে মানুষ যে চোখের জল ফেলে সেটাই যেন ভুলতে বসেছিল। চোখের জল ফেলতে না পেরে, সেই চাপা কষ্টের কান্না যে কতটা অদ্ভুত, অসহ্যকর যা বোধহয় যারা এ পরিস্থিতিতে পড়েনি তারা কোনোদিনই বুঝবে না। এই কষ্ট, অসহায় অবস্থা বলে বোঝানোর মতই নয় হয়তো …..
ক্লাস ইলেভেন পড়ার সময় অর্পিতার সাথে প্রথম পরিচয় হয় সৌরদীপের। রোগা চেহারার লাজুক একটা মেয়ে, কারোর সাথে সেভাবে মিশতেই পারত না কিছুতেই। আর এদিকে সৌরদীপ বরাবরই ভীষণ মিশুকে,প্রাণোচ্ছল একটা ছেলে। সবার সাথে কথা বলে বেড়ানোটা ওর অন্য সব দরকারি কাজের মধ্যেই পড়তো বলা যায়। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই অর্পিতার সাথে কথা শুরু হয়েই গিয়েছিল বন্ধুত্বের খাতিরে। ধীরে ধীরে একসাথে পড়াশোনা করা, লাইব্রেরি তে সময় কাটানো, টিউশনি পড়তে যাওয়া, এসব করতে করতে শুধু বন্ধু থেকে কখন যে বিশেষ বন্ধু হয়ে উঠেছিল ওরা, তা বোধহয় ওরা কেউই নিজেরাও বুঝতে পারেনি। একসাথে এতটা সময় কাটানোর পরে, এত কাছে থাকার পরে ওদের মনে সেই বিশেষ অনুভূতিটা ওরা তখন বুঝল যখন উচ্চমাধ্যমিকের পরে পড়ার জন্যই সৌরদীপের হায়দ্রাবাদ যাওয়ার কথা ঠিক হল। অন্য সবার মত কোনো সরস্বতী পুজো, বা ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে নয়, সৌরদীপের বাইরে চলে যাওয়ার কথাটা শুনে যেদিন কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছিল অর্পিতা, সেই দিনটাই ছিল ওদের কাছে বিশেষ দিন। আর বোধহয় মরে গেলেও কখনো ঐ দিনটা মাথা থেকে মুছে ফেলতে পারবেনা সৌরদীপ, হাজার চেষ্টাতেও না…..
বাড়ি , নিজের চেনা বৃত্ত, আর বিশেষ করে অর্পিতাকে ছেড়ে এতদূর চলে যাওয়ার কষ্টে সকাল থেকেই সেদিন মন খারাপ ছিল সৌরদীপের। মাঝে মাঝে ওর মনে হচ্ছিল যে উচ্চমাধ্যমিকে এত ভালো রেজাল্ট না করলেই বোধহয় ভালো হত। কিন্তু কেরিয়ারকে তো এগিয়ে নিতে যেতেই হবে, বাবার সিদ্ধান্ত এটা, অবশ্যই ওর ভালোর জন্যই, তাই এটাও মেনে নিতেই হত। তবে সবথেকে যে ব্যাপারটা সৌরদীপকে ভাবাচ্ছে সেটা হল, ওর চলে যাওয়ার কথা শুনে ও কোনো প্রতিক্রিয়াই এখনো জানালো না অর্পিতা। অদ্ভুত তো! তাহলে কি ওর এতটুকু কষ্টই হচ্ছেনা? সব কষ্ট কেবল তার নিজেরই হচ্ছে? এরকম বিভিন্ন রকম ভাবনা চিন্তা করতে করতে গাড়িতে ওঠার সময় এগিয়ে এল। শেষবারের মত আরেকবার সবকিছু গুছিয়ে, নিজের বাড়িটাকে দেখছিল সৌরদীপ, বাবা তখনও ভেতরে কোনো একটা কাজ করছিল বোধহয়। হঠাৎ করেই ও দেখল অর্পিতা ফোন করছে, আনন্দে চোখে প্রায় জল চলে এল সৌরদীপের । ওর ভাবনা তাহলে ভুল ছিল, অর্পিতা ওকে ভুলে যায়নি, ওকে ভুলতেই পারেনা। তাড়াতাড়ি করে ফোনটি রিসিভ করে ও বলল,
-‘হ্যাঁ বল, আমি তো ভাবলাম তুই ভুলেই গেছিস আমাকে। ‘
-” তুই একবার গেটের বাইরে আসবি?”
খুব ধীর, ধরা গলায় কথাটা বলল অর্পিতা। ওর কথা বলার ধরন প্রথমটায় শুনে চমকে উঠল সৌরদীপ। গেটের বাইরে আসতে বলছে মানে? কোথায় আছে মেয়েটা? তাড়াতাড়ি করে ওর কথা মত বাইরে বেরিয়ে বাগানের কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল সৌরদীপ। এদিকে ওদিকে তাকাতেই ওর চোখে পড়ল বাগানের একপাশে নীল রঙের সেই চিরপরিচিত কুর্তিটা পরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্পিতা। পরিচিত ঐ মুখটা এভাবে চোখের সামনে এত কাছে দেখে, মনের ভিতরটা যেন কীরকম একটা করে উঠল সৌরদীপের। অর্পিতার মুখের হাসিটা যে এই মুহূর্তে একেবারেই মিথ্যে, জোর করে আনা হাসি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ঠোঁট হাসি দিয়ে অভিমান আড়াল করলেও, চোখ বড়ো অবুঝ আচরণ করে। ওর কান্নাভেজা চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে সৌরদীপ খুব ভালো করেই বুঝতে পারল, মেয়েটার মনের মধ্যে কী ঝড় বয়ে চলেছে। ধীরপায়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে সৌরদীপ নরম গলায় বলল,
-” কী হয়েছে তোর? এরকম মুখচোখ কেন?”
-” কই কিছু না তো, বাদ দে, তাহলে তুই ভালোভাবে থাকিস, মন দিয়ে পড়াশোনা করিস। বুঝলি??”
-” ওসব পরে হবে, আগে বল তোর কী হয়েছে? কষ্ট পাচ্ছিস? আমি চলে যাচ্ছি বলে?”
-” কীসের কষ্ট?”
-” সত্যি বলবি অর্পিতা? আমার দিকে তাকিয়ে বল, তোর কষ্ট হচ্ছেনা?”
এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলনা অর্পিতা। চোখের যেটুকু জল ও থামিয়ে রেখেছিল, সেই জলের প্রত্যেকটা ফোঁটা যেন একসাথে প্রচন্ড বেগে বেরিয়ে আসতে চাইল, একেবারে বুকের গভীর থেকে। যে চুপচাপ মেয়েটা কারো সামনে কাঁদা তো দূর, কথাই বলতে পারতনা, সে আজ একটা ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে, এভাবে অঝোরে কেঁদে চলেছে অনবরত। সৌরদীপ প্রথমে বুঝে পেলনা ওর এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত। বাইরে বাবা হয়তো এতক্ষণে তৈরী হয়ে গেছেন। যদি হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে আসেন, তাহলেও ব্যাপারটা কীরকম একটা অস্বস্তিকর হয়ে যাবে। কিন্তু অর্পিতার এরকম কান্নাও তো সহ্য হলনা ওর। থাকতে না পেরেই এবার অর্পিতার হাতটা চেপে ধরে সৌরদীপ বলল,
-” প্লিজ কাঁদিসনা, কেন কাঁদছিস? আমি তো চলে আসব, তিন বছর তো মাত্র। আর মাঝে মাঝেও তো আসব, তাহলে কেন কাঁদছিস?”
-” তিন ব-ছ-র?”
-” হুম বললাম তো তোকে, সেদিন। মনে নেই?”
-” হ্যাঁ মনে আছে।”
-” তাহলে? আর কাঁদবি না বল?”
-‘ না”
খুব সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল অর্পিতা। হঠাৎ করেই এবার ওর নিজেরই লজ্জা লাগছে,
এভাবে না বলে, সৌরদীপের বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করা, ব্যাপারটা কি বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল?? ও কি কিছু মনে করে করল? এই সব চিন্তাতেই আরো বেশি মাথায় জট পড়ে গেল অর্পিতার। কোনো কথা আর না বলে ও পিছনে ফিরে চলে যেতে উদ্যত হল। কিন্তু তার আগেই একটা শক্ত হাত ওর হাতটা চেপে ধরল। অর্পিতা অবাক হয়ে সৌরদীপের তাকিয়ে বলল,
-” কী হল? এটা তোর বাড়ি সৌর”
-” কয়েকবছর পর এটা তোরও বাড়ি হবে”
-” মানে??!”
-” মানে টা তুই কি সত্যিই বুঝিসনি? তুই সত্যি করে বল, এতটা ছুটে ছুটে এলি তুই আমার জন্য, এটা এমনি এমনি? কোনো বিশেষ কারণ নেই এর পিছনে?”
-” মা-মানে? হ্যাঁ দেখ….আসলে …”
কথার জালে নিজেই আটকে পড়ে আমতা আমতা করতে লাগল অর্পিতা। সৌরদীপ সেসবে গুরুত্ব দিলনা। ও একইভাবে আগের মতোই কঠিন চোখে অর্পিতার চোখের দিকে বলল,
-” বল, ভালোবাসিস আমাকে? আর সময় নিলে কিন্তু সত্যিই দেরী হয়ে যাবে, আমার গাড়ির সময় হয়ে গেছে অলরেডি। ”
-” হ্যাঁ। আমি- ভালোবাসি তোকে”
লজ্জায় মাথা নীচু করে কোনো রকমে উত্তরটা দিল অর্পিতা। আর ঠিক তারপরেই ওদের কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সৌরদীপের বাবা সেখানে হাজির হলেন। বাগানের মধ্যে ওদেরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি একটু থমকে দাঁড়ালেন, প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সৌরদীপের দিকে তাকালেন একবার। সৌরদীপ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল,
-” বাবা ও আমার স্কুলফ্রেন্ড, আমি চলে যাচ্ছি তাই দেখা করতে এসেছে।”
-” ওহ, কিন্তু এবার আয়, টাইম হয়ে গেছে। মা তুমি পরে আবার কখনো এসো, দেখা করে যেও বন্ধুর সাথে, ও যখন আসবে, কেমন?? আসি এখন আমরা? আসলে দেরী হয়ে যাচ্ছে সত্যিই”
অর্পিতার দিকে তাকিয়ে সৌরদীপের বাবা কথাটা বললেন। এরপর তো আর কিছুই বলার অবকাশ থাকেনা। মাথাটা একটু নেড়ে, মুখে সামান্য হাসি আনার চেষ্টা করতে লাগল অর্পিতা। ওর চোখের সামনে দিয়েই সৌরদীপ ওর বাবার সাথে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। ধীরে ধীরে সেই গাড়ি চলতে চলতে, চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল। পথের ধুলো ছড়িয়ে গেল চারিদিকে, আর একা একপাশে চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অর্পিতা…..হাওয়ায় ওর অবিন্যস্ত চুলগুলো উড়তে লাগল….হাতে তখনো লেগে আছে সৌরদীপের হাতের ছোঁয়া…..
(ক্রমশ)