❤#ইচ্ছে_ডানা
#সপ্তম_পর্ব❤
গাড়িতে উঠে প্রায় সারাটা রাস্তাই সৌরিতা আড়ষ্ট হয়ে চুপ করে বসে রইল। ওর মাথায় নানান চিন্তাভাবনার জটগুলো যেন কিছুতেই ওকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেনা। সৌরদীপ গাড়ি চালাতে চালাতে মুখে কিছু না বললেও, মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই আড়চোখে ওর নজর চলে যাচ্ছিল সামনের আয়নার দিকে, যেখানে সৌরিতার মুখের প্রতিবিম্বটা দেখা যাচ্ছিল। আধভেজা ওর মুখটা সেই সকালের থেকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। সকালে মুখটা যেরকম ভয় পাওয়া, বিধ্বস্ত লাগছিল, সেই ভাবটা এখন আর একেবারেই নেই। বরং তার বদলে একটা আলাদা স্নিগ্ধতা ফুটে উঠেছে যেন। তবে মেয়েটা প্রচন্ড চুপচাপ, বা হয়তো অচেনা কারোর সাথে তেমন ভাবে মিশতে পারেনা। বা আগে হয়তো এরকম চুপচাপ ছিলনা, হয়তো এমন কোনো ব্যাপার হয়েছে ওর সাথে যার জন্য পুরো জীবনটাই বদলে গেছে ওর। মানুষের জীবনে এমন এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যার কোনো ব্যখ্যা বাইরের মানুষের কাছে করা যায়না। নিজের মনের কথা গুলো মেলে ধরাই যায়না, কোনো মানুষের সামনে, যদি না সেই মানুষটা সেরকম হয়। আর পৃথিবীতে এমন মানুষেরই প্রচন্ড অভাব, যে মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে বুঝতে পারে, পাশে থাকতে পারে। হয়তো আমরা নিজেরা কারো জীবনে সেই মানুষটা হয়ে উঠতে পারিনা বলেই, আমাদের জীবনে সেরকম কিছু মানুষ আসেনা কখনো।….
রাস্তায় সামনে একটা বাঁক দেখে, গাড়িটা থামাল সৌরদীপ। সৌরিতার দিকে জিজ্ঞাসাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও বলল,
-” এবার কোন দিকে যাব? বাঁদিকে না ডানদিকে??”
-” ডানদিকে চলুন, সামনে আরেকটা বাঁক পরবে, ওখান থেকেও ডানদিকে যেতে হবে। ব্যস অতটুকু গেলেই হবে, তারপর আমি চলে যেতে পারব একা। ”
-” না না সেকি, বৃষ্টি তো পড়ছে এখনো, আর এতটা যখন এলামই তখন আরো কিছুটা যেতেই পারি, অসুবিধা কী?”
-” আমার একটু অসুবিধা আছে, প্লিজ কিছু মনে করবেন না, বুঝতেই তো পারছেন, ওই বাঁক থেকে আমার বাড়ি আর জাস্ট মিনিটদুয়েক। কিছু অসুবিধা হবেনা”
-” বেশ,তাই করুন। আপনি যখন চাইছেন না, তখন আমি তো আর জোর করতে পারিনা।”
-” হুমম ”
আর কোনো কথা না বলে, গাড়িটা ডানদিকে ঘোরালো সৌরদীপ। পাশে বসে থাকা এই সৌরিতা নামের মেয়েটাকে ও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা।
কখনো মনে হচ্ছে ভীষণ নরম প্রকৃতির কোনো মেয়ে, আবার কখনো মনে হচ্ছে যে ভীষণ কঠিন কেউ, যাকে সহজে ভেঙে ফেলা যায় না কিছুতেই, শত চেষ্টাতেও না।
কিন্তু এই মুহূর্তে অদ্ভুত আরো একটা অনুভূতি কাজ করছে সৌরদীপের মনের ভিতর। ওর খালি মনে হচ্ছে যে, আজ এই মুহুর্তের পর হয়তো সৌরিতার সাথে আর দেখা হবেনা, আজ ভাগ্যের ফেরে হঠাৎ দু’বার দেখা হয়ে গেছে, কিন্তু প্রতিদিন তো এরকম কাকতালীয় ভাবে দেখা হবেনা। হয়তো আজকের পর আর কোনোদিন দেখাই হবেনা। কিন্তু এত দেখা হওয়া নিয়ে সে ভাবেই বি কেন? যদি কখনো আর দেখা না হয়েই থাকে, তাহলেই বা কী? তাতে কী এমন অসুবিধা হবে?? কিন্তু মনকে বোঝানোর পরেও কিছুতেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে পারলনা সৌরদীপ।
বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে ওরা তা খেয়ালই করেনি সৌরদীপ। ওর হুঁশ ফিরল সৌরিতার মৃদু চিৎকারে,
-” আরেহ্, আর এগোতে হবেনা। এখানেই নামব আমি।”
-” ওহ হ্যাঁ, সরি সরি।”
তাড়াতাড়ি করে ব্রেক কষে গাড়িটা থামাল সৌরদীপ। ও দেখল গাড়ি থামার পরেই, দ্রুত পায়ে ব্যস্ত হয়ে নেমে গেল সৌরিতা। যেন কোনো একটা ভয়ে ভয়ে আছে ও। কীসের ভয়? বাড়ির লোক, বাবা মা, খুব বেশি কড়া স্বভাবের? নাকি আরো কোনো অন্য কারণ আছে?
সৌরিতা গাড়ি থেকে নেমে যেতে যেতে হঠাৎই কী মনে হতে, আবার একবার পিছন ফিরে গাড়ির সামনে এসে, সৌরদীপের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
-” আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আজ দু’বার আপনি আমার এত সাহায্য করলেন, আপনাকে বাড়ি অবধি আসতে বলতে পারলে খুব ভালো লাগত, কিন্তু সত্যি আমি নিরুপায়, তো তাই সেটা কিছুতেই সম্ভব হলনা। প্লিজ কিছু মনে করবেননা”
-” না না, ইটস্ ওকে। আমি কিছু মনে করিনি। তবে একটা কথা , আপনার পুরো নামটা জানতে পারি? মানে যদি আপনার কোনো অসুবিধা না থাকে তো।”
সৌরদীপের কথার উত্তরে খানিকটা থমকে গিয়ে সৌরিতা বলল,
-” সৌরিতা বোস।”
-‘ ওহ্। বেশ। সাবধানে যান তবে। আবার কখনো দেখা হবে।”
আর কোনো উত্তর না দিয়ে একটু মুচকি হেসে চলে গেল সৌরিতা। ও নিজেও জানেনা, ওদের আর কখনো দেখা হবে কিনা, হয়তো দেখা না হওয়াটাই মঙ্গল, আবার হয়তো আবার দেখা হওয়াটাই ভাগ্যে রয়েছে। কোন টা ঠিক কোনটা ভুল সেসবের বোধবুদ্ধি এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে ওর। তবে এই রঙিন সৌরদীপ নামক কল্পনার থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করেই সৌরিতার মনে পড়ল, রাজীবের কথা। রাজীব আজ বাড়ি ফিরলে কী হবে এটা ফিরলে ওর মনের সব আনন্দ এক নিমেষে কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল।
***********
ফেসবুকে অনেক খোঁজার পরেও সৌরদীপ সৌরিতা বোস নামের ঐ মেয়েটাকে আর খুঁজে পেল না কিছুতেই। ওর মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে, আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে, হয়তো কোনো না কোনো ভাবে, সৌরিতাকে ফের খুঁজে পাওয়া যাবে, একটা যোগাযোগের অল্প হলেও রাস্তা খোলা থাকবে। কিন্তু এখন ফেসবুকে ওর নামের কাউকে না পেয়ে একটু হতাশই হল সৌরদীপ। তবে কি কোনো ভাবে ওকে মেয়েটা ভুল নাম বলল? নাকি সত্যিই ও ফেসবুকে অ্যাক্টিভ নয়?….. যে কোনো কারণই সত্যি হতে পারে।
যাক গে, ভাগ্যে থাকলে হয়তো ওদের আবার কখনো দেখা হবে, এই কথা ভেবেই আশাহত হয়ে ফোনটা অফ করে শুতে যাবে সৌরদীপ, ঠিক এমন সময়েই ভুল করে হাতে চাপ লেগে ওর ফোনের গ্যালারিটা খুলে গেল। তাড়তাড়ি করে সেটা বন্ধ করতে গিয়ে ঘটল আরেক বিপত্তি । না চাইতেও, সৌরদীপ দেখল, হঠাৎ করেই ওর আর অর্পিতার সমস্ত ছবিগুলোর অ্যালবাম খুলে গেল চোখের সামনে। অপ্রস্তুত হয়ে সৌরদীপ তাড়াতাড়ি করে বন্ধ করতে গেল, কিন্তু সেটা কিছুতেই সম্ভব হলনা অনেক চেষ্টাতেও। ছবিগুলোর থেকে অনেক দূরে থাকতে চায় সৌরদীপ সবসময়, পালিয়ে বাঁচতে চায়, অর্পিতার স্মৃতি গুলো থেকে। তাই ফোনের গ্যালারি তে ছবি গুলো সেভ করে রাখলেও, অনেক গভীরে লুকিয়ে রাখত সে যাতে চোখে না পড়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আছ এমন একটা পরিস্থিতি হয়ে গেল, যে না চাইলেও অতীতের সেই স্মৃতি গুলো তাজা হয়ে উঠল সৌরদীপের মনে। সৌরিতার কথাটা সাময়িক ভাবে ভুলে গিয়ে সৌরদীপ অর্পিতার সাথে ওর ছবিগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল……
(ক্রমশ)