ইচ্ছে ডানা পর্ব-০৬

0
1046

❤#ইচ্ছে_ডানা
#ষষ্ঠ_পর্ব ❤
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তৃষিতা সৌরদীপের চোখে চোখ রেখে বলল,

-” দেখ সৌর, তুই ভুল ভাবছিস। হয়তো তোর ভাবনাটা স্বাভাবিক, কোথাও গিয়ে অর্পিতার স্মৃতি মাথায় এলে তোর মধ্যে এই অপরাধবোধ, একটা খারাপ লাগা চলেই আসে। তবু আমি বলব, সময় তো কখনো থেমে থাকেনা, জীবনও থেমে থাকেনা। তোর জীবন তো এখনও শুরুই হলনা। তাই তোর যদি নতুন করে আবার কিছু শুরু করার ইচ্ছে থাকে, তবে তা তুই অবশ্যই করতে পারিস। এতে কোনো ভুল নেই। বুঝলি??”

-” কিন্তু হসপিটালের বেডে যে অর্পিতার হাত ধরে আমি কথা দিয়েছিলাম, যে কখনো…… ”

-” হ্যাঁ তখন বলেছিলি। সেই সময়ে সেটাই সত্যি ছিল, ঐ মুহূর্ত টুকু। কিন্তু এখনও ঐ মুহূর্তটাকে আঁকড়ে ধরে রাখলে কী করে হবে? এটা বলে নিজেকে সান্ত্বনা দে, যে অর্পিতা নিজেও খুশি হবে, তুই ভালো থাকলে। তোর জীবনটা একটাই, আর কখনো ফিরে পাবিনা। সারাটা জীবন এরকম আফশোস নিয়ে বাঁচিস না, বোঝার চেষ্টা কর সৌর”

-” হুম, তোর কথাটাও ঠিক। আমি মানছি। তবে মাঝে মাঝে কী যে হয়! মনে হয়, নতুন জীবনসঙ্গীর সাথে জীবন কাটানোর সময়, যদি পুরোনো স্মৃতি কখনো জেগে ওঠে? তখন?? ”

-” পুরোনো স্মৃতিকে তুই ভুলবিই বা কেন সৌর? চেষ্টাও করিসনা, এতে আরও বেশি মনে পড়বে সেসব। তুই বর্তমানকে নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা কর, দেখবি পুরোনো স্মৃতি এমনিতেই ফিকে হয়ে আসবে ধীরে ধীরে। আর যদি কখনো মনে পড়ে, তো মনে কর, একটু কেঁদে নে, আড়ালে বসে। মন হালকা করে নে, সব ঠিক হয়ে যাবে”

-” সত্যি ঠিক হয়ে যাবে? কে জানে! যাই হোক বাদ দে, একটু সময় দিলি আমাকে, এটাই অনেক আমার জন্য। তুই কিছু মাইন্ড করলি না তো, আবার এসব পুরোনো কথা বললাম বলে?”

-” না না, মাইন্ড কেন করব? তোর মনটা হালকা হলেই হল। তুই ভালো ভাবে জীবনটাকে বাঁচ, ভালো থাক, এটাই অনেক।”

-” হুমমম। চল উঠি, এবার। তুই এখন বাড়ি যাবি কি?? তাহলে চল ছেড়ে দিয়ে আসছি।”

-” না, আমি একটু লাইব্রেরি যাব। তুই চলে যা। ”

-” ওকে, যা বলবি। চল টাটা”

গাড়ির চাবিটা নিয়ে, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো সৌরদীপ। আকাশের ধরন দেখে মনে হচ্ছে খুব জোরে বৃষ্টি আসবে এখনি। এই সময়টা বাড়ি না গিয়ে একটু অন্য জায়গায় গিয়ে বসলে বেশ হয়। সামনেই কাছাকাছি একটা লেক আছে। খুব বেশী লোকজন আসেনা ঐ দিকে….একটু বনজঙ্গল বেশি বলে। কিন্তু সৌরদীপের ঐ অগোছালো লেকের ধারটাই ভীষণ ভালো লাগে, এত অসাধারণের মাঝে সাধারণ লাগে বড্ড , আর সেখান থেকেই এতটা ভালোলাগা।

তৃষিতাকে অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু বললনা সৌরদীপ। ও শুনলে এখনি যাওয়ার বায়না ধরবে। আর সেটা ঠিক এই মুহূর্তে চাইছেনা সে। একটু একা থাকার প্রয়োজন এখন, বড্ড প্রয়োজন। জীবনে সে সবকিছু পেয়েছে, টাকা পয়সা, ভালো চাকরি, বন্ধুবান্ধব, মা বাবার ভালোবাসা সব। কিন্তু এই এত পূর্ণতার মাঝখানে ঐ একটা শূন্যতাই মাঝে মাঝে ওর পুরো জীবনটাকে ফাঁকা করে দেয় এক নিমেষে। পৃথিবীতে এত শত শত মানুষ থাকতে ভগবান তার সাথেই কেন এরকম করল? আর কয়েকটা মাস পরেই ওদের বিয়েটা হওয়ার কথা ছিল। তা সত্ত্বেও, কেন ভগবান জীবনের এই অংশটাকে এভাবে অসম্পূর্ণ রেখে দিল? কেন? …… এই কেন এর উত্তর আজ চার বছর ধরে খুঁজে আসছে সৌরদীপ, কিন্তু আজও সেই সন্ধান থামাতে পারেনি….

****************

যে ভয়টা এতক্ষণ করছিল সৌরিতা সেটাই হল, বাড়ি পৌঁছানোর আগেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টিটা চলে এল। সাথে করে ছাতাও আনেনি, আর আশেপাশে একটা দাঁড়ানোর জায়গাও নেই ঠিকঠাক। মাথায় আঁচলটা চাপা দিয়ে নিজের মাথাটাকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর একটা বৃথা প্রচেষ্টা করতে লাগল সৌরিতা। বৃষ্টির ছাঁটে ইতিমধ্যেই ও পুরোপুরি ভিজে গেছে। ঠিক এমন সময়েই সৌরিতার চোখে পড়ল রাস্তার ওপারে একটা ছোটো পার্কের মতো জায়গাটা। বেশ গাছপালা দিয়ে একটা এলাকা, তারমানে একটু ছাউনি তো নিশ্চয় হবে। সেই আশাতেই জোরে পা চালিয়ে সেদিকে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল সৌরিতা, বৃষ্টির সাথে সাথে ঝোড়ো হাওয়ার বেগ যেন ওকে বাধা দিতে লাগল প্রতি পদে পদে। পুরোপুরি কাকভেজা হয়ে পার্কের মুখের কাছে গিয়ে পৌঁছে দেখল, গেটের সামনেই একটা গাড়ি দাঁড় করানো। তারমানে ভেতরে আরো কেউ হয়তো আছে। কীরকম মানুষ রে বাবা, এই বৃষ্টিতে গাড়ি থাকতে ভিতরে ভিজতে গেছে! সৌরিতা মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেশ সুন্দর গাছপালায় ঢাকা জায়গাটা, সামনে আবার একটা ছোট্ট লেকের মতও আছে। নিমেষের মধ্যেই এতক্ষণের বিরক্তি, মনখারাপ গুলো যেন উধাও হয়ে গেল সৌরিতার মনের থেকে। বৃষ্টির প্রত্যেকটা ফোঁটা কি সুন্দর ভাবে লেকের জলে পড়ছে অনবরত। যেন ওদেরকে কেউ একজন একই ছন্দে বেঁধে দিয়েছে কোনোভাবে …..। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, সৌরিতা ভুলেই গেল ওর জীবনের সব সমস্যার কথা, রাজীবের কথা, বাড়ির লোকের কথা, ও ভুলে গেল যে এই মুহূর্তে পুরো বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছে….

-” আপনি এদিকে এসে দাঁড়ান না, পুরো ভিজে গেছেন তো!”

পিছন থেকে আচমকা একটা পুরুষকন্ঠ শুনতে পেয়ে চমকে গেল সৌরিতা। তাড়াতাড়ি করে ও পেছনে ঘাড় ঘোরাতেই সেই ব্যক্তি আর ও নিজে, দু’জনেই ভীষণরকম ভাবে অবাক হয়ে গেল। ওদের দু’জনের মুখ থেকেই একসাথে একটাই শব্দ বেরিয়ে এল….

-” আরেহ্ আপনি??”

সৌরদীপ প্রচন্ড অবাক হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সৌরিতার দিকে। এটাও কি সম্ভব?? আজ এই লেকের ধারে আসা অবধি ওর এই মেয়েটার কথাই সবথেকে বেশি বার মনে পড়ছিল। কেন মনে পড়ছিল, কীসের উদ্দেশ্যে তা জানেনা সৌরদীপ, কিন্তু ভাবনা চিন্তা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেও বার বার সকালের ঘটনাটাই মনে পড়ে যাচ্ছিল। আর আজকেই আবার এর সাথে দেখা হয়ে গেল?? অদ্ভুত!

সৌরিতা নিজেও কম অবাক হয়নি। এরকম একটা পরিস্থিতিতে এর সাথে আবার দেখা হয়ে যাবে তা তো ভাবতেই পারেনি সে। মিনিটখানেক দু’জনেই চুপচাপ থাকার পর, সৌরদীপই প্রথম বলে উঠল,

-” আপনি তো একদম ভিজে গেছেন, সাথে ছাতা নিয়ে বেরোননি কেন? ওয়েদার এখন এমনিতেই খারাপ। ”

-” হ্যাঁ আসলে, খেয়াল ছিলনা ঠিক”

-” আপনি আগে এদিকে এসে দাঁড়ান তো, তারপর কথা হবে। একেই ভিজে গেছেন, তার উপর আরো ভিজছেন। নিউমোনিয়া হয়ে যাবে তো এবার”

বৃষ্টির জলে ভিজে, পরনের শাড়ি একদম গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে সৌরিতার। সৌরদীপের সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণ একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল ও। সামনের ছাউনির দিকে এগিয়ে গিয়ে আঁচল দিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল সৌরিতা। ওর অস্বস্তিটা নজর এড়ালোনা সৌরদীপের, কিন্তু পরিস্থিতিটা এমনই যে কিছু কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলনা ও। ওর নিজের সাথেও তেমন কিছু শুকনো জামাকাপড় নেই, যে সেটা সৌরিতাকে দেওয়া যাবে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অনেক ভাবে সৌরদীপ আবার খানিকটা আমতা আমতা করেই বলল,

-” বলছি কি, আমি কি আপনাকে আপনার বাড়ি অবধি ছেড়ে আসব? এভাবে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতেও আপনার বোধহয় অস্বস্তি হবে। মানে আপনি যদি রাজি থাকেন”

-” আপনি শুধু শুধু আমার জন্য …..”

-“না না,তেমন কিছু ব্যাপার না।এটুকু হেল্প তো করাই যায়। আপনি আসুন আমার সাথে”

সৌরিতা কিছুক্ষণ ঠিক করতে পারলনা, যে কোন কাজটা করা উচিত হবে। সৌরদীপের কথাটাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়, আবার কোথাও গিয়ে একটা অস্বস্তি হচ্ছে মনের মধ্যে। আর সবথেকে বড়ো অদ্ভুত ব্যাপার হল, সৌরদীপের সাথে এই আচমকা দেখা হওয়ার ঘটনাটায় মনের মধ্যে যেন আলাদা একটা খুশির অনুভূতি কাজ করছে সৌরিতার। হঠাৎ করেই ওর ভালো লাগছে, এই মুহুর্ত গুলোকে ভালোলাগছে, এই পরিবেশটাকে, এই হঠাৎ সিনেমার মতো ঘটে যাওয়া ঘটনাটাকে , সব কিছুকে ভীষণ ভাবে উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে। এটা কি অন্যায় আবদার মনের?? এটা কি ভীষণই অপরাধ করে ফেলছে সৌরিতা? কিন্তু অপরাধের কথা মাথায় থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা কিছুতেই, কেন? কেন এমনটা হচ্ছে? প্রথম দিন কাউকে দেখেই এরকম অনুভূতি হওয়াটা কি একটু বেশিই অস্বাভাবিক নয়? …

(ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে