❤ #ইচ্ছে_ডানা
#পঞ্চম_পর্ব ❤
সৌরিতা অফিসের একদম ভিতর অবধি পৌঁছে একটু থমকে দাঁড়াল। রিসেপশনের সিটে বসে থাকা মহিলাটা ওর দিকে একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। বোধহয় অনেকক্ষণ ধরে ওকে এখানের চারিপাশে পায়চারি করতে দেখে, অমন চোখে তাকিয়ে আছে। আজ সৌরিতা নিজের বেশভূষাও সামান্য বদলে এসেছে, ওকে দেখে কেউ বিবাহিতা কিনা সেটাও বুঝতে পারছেনা, আর যেহেতু ও বেশিবার এখানে আসেনি কখনো তাই কেউ বিশেষ চেনেও না তাকে। একদিক থেকে এতে সুবিধাই হলো সৌরিতার। সানগ্লাসটা ঠিকঠাক করে রিসেপশনের মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়ে সৌরিতা বিশ একটু কঠিন গলায় বলল,
-” হ্যালো, মিস্টার রাজীব এর দেখা করা যাবে এখন একবার? উনিই আমাকে আসতে বলেছিলেন। ”
-” লেটার এনেছেন?”
-” হ্যাঁ লেটার এনেছি, ওয়েট। ”
এই বলে ব্যাগ থেকে মোহরের বানিয়ে দেওয়া অ্যাপয়নমেন্ট লেটারটা বের করে টেবিলে রাখল সৌরিতা। এই বুদ্ধিটাও ওকে মোহরই দিয়েছিল। মেয়েটা সত্যিই বুদ্ধিমতী। প্ল্যানে যাতে কোনো ফাঁক না থাকে, তাই কীভাবে যেন একটা নকল অ্যাপয়নমেন্ট লেটার জোগাড় করে ফেলেছিল ও। এখানে সৌরিতার নামটাও পরিবর্তন করে রাখা আছে । যাই হোক, সেই চিঠি টাই কাজে লেগে গেল এখন, এই মুহূর্তে। দুরু দুরু বুকে সৌরিতা অপেক্ষা করতে লাগল, এই ভয়ে যাতে মহিলাটি কোনো ভাবেই বুঝতে না পারে যে এই লেটারটা নকল। কিছুক্ষণ এইভাবে কাটার পর, তেমন কিছুই গন্ডগোল হল না। মহিলাটি মিষ্টি করে হেসে সৌরিতাকে চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল,
-” স্যার এখন একটা মিটিং এ আছেন, আপনি যান ওয়েট করুন ওনার রুমের পাশে। স্যার ফ্রি হলে কথা বলে নেবেন। থ্যাংক ইউ”
-” ওকে। ওয়েলকাম”
তাড়াতাড়ি করে চিঠিটা নিয়ে, রাজীবের রুমের দিকে এগিয়ে গেল সৌরিতা। আড়াল থেকেই ওকে দেখতে হবে, তবেই তো ওর পরিকল্পনা সফল হবে। মনে একরাশ আগ্রহ, কৌতুহল নিয়ে হাঁটতে শুরু করল সৌরিতা। তবে খানিকদূর হেঁটেই ও থমকে গেল, দূরে দেওয়ালের পাশে রাজীব দাঁড়িয়ে আছে। কারো একজনের সাথে কথা বলছে হেসে হেসে। কে হতে পারে?? উৎসুক হয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে, সৌরিতা দমবন্ধ করে সেদিকে চেয়ে রইল। রিসেপশনে মহিলাটি তো বলল, রাজীব মিটিং এ আছে। তাহলে?? রাজীব এখানে কী করছে? আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কি সেই মেয়েটা? যার সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছে রাজীব?
তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলনা। সৌরিতাকে চমকে দিয়ে হঠাৎই রাজীব পেছনে ফিরে তাকালো। ঘটনার আকস্মিকতায় সৌরিতা এমন চমকে গেল, যে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ও পেলনা। ওর বুকের ভিতরটায় কেউ যেন হাতুড়ি পিটতে থাকল, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে রাজীব সৌরিতাকে দেখেও খুব বেশী অবাক হলনা, হাসি মুখে খুব স্বাভাবিকভাবেই ও এগিয়ে গেল সৌরিতার দিকে। মুখে হাসি রেখেই ও বলল,
-” তুমি এখানে? কি ব্যাপার? বলবে তো আসবে? আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম তাহলে।”
রাজীবের এত স্বাভাবিক কথা শুনে পুরো অবাক হয়ে সৌরিতা। বাড়িতে থাকাকালীন তো একটা কথাও ওর মুখ থেকে বেরোয়না। আর এখানে এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে যেন কত সুখী দম্পতি ওরা। রাজীবের পাশে বর্তমানে কোনো মেয়ে নয়, একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, যাঁকে আড়াল থেকে এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিলনা। তবে কি মিছিমিছিই রাজীবকে সন্দেহ করছিল এতদিন সে?? কিন্তু রাজীবের হাসিমুখে দেখে কেন না জানি সৌরিতার মনে হচ্ছে, যে ওর আসার ব্যাপারটা নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল সে। এই হাসির মুখোশটা আদৌ যে আসল নয়, তা বেশ বুঝতে পারছে সৌরিতা। বাড়ি গেলেই এই মুখের আদলটা পরিবর্তন হয়ে যাবে। না জানি, আবার কোন নতুন অশান্তি শুরু হয়ে যাবে বাড়িতে।
সৌরিতাকে চুপ থাকতে দেখে, রাজীব আবার বলল,
-” কী হল? বলো?”
-” আসলে আমি এইদিক থেকেই যাচ্ছিলাম। তো ভাবলাম একবার দেখা করেই যাই। সেইজন্যই”
-” ওহ্। ওকে রেস্ট করো বসে, কিছু খাবে কি?”
-” নাহ্, আমি এখনি বেরিয়ে যাব। বাড়িতে কাজ আছে। আমি আসি। কেমন?”
-” হুমম। আসো। বাড়ি গিয়ে না হয় সব কথা হবে”
একটা অন্যরকম সুরে কথাটা বলল রাজীব। ওর কথার বাঁকা অর্থটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারল সৌরিতা। নতুন বিপদের আশঙ্কা আঁচ করাটা ওর পক্ষে খুব একটা অসুবিধার হলনা। কিন্তু এত চিন্তাভাবনার মধ্যে হঠাৎ করেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো। মাথা নীচু করে, সেখান থেকে চলে আসতে আসতেই সৌরিতার হঠাৎ রাস্তায় দেখা হওয়া সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। কী যেন নাম ছিল ছেলেটার! সৌরদীপ। হ্যাঁ, সৌরদীপই তো! বেশ বড়ো বড়ো চোখ, ভদ্রভাবে কথা বলা, সবকিছুই সেই মুহূর্তে নজর কেড়েছিল সৌরিতার। তখন কিছু বলার অবকাশ ছিলনা, ঠিকই। তবে এখন যেন, বারবার করে ওর মুখটা মনে পড়ে যেতে লাগল। ছেলেটার মুখটা বেশ মনে রাখার মত, মানে খুব সুন্দর দেখতে, খুব হ্যান্ডসাম এরকম না, কিন্তু কে না জানি ওর মুখটা বিশেষ করে সৌরিতাকে অ্যাকসিডেন্ট থেকে বাঁচানোর পরে যেভাবে তাকিয়ে ছিল ঐ চাহনিটা আরো বেশী করে ভোলা যাচ্ছেনা যেন! অদ্ভুত একটা অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল সৌরিতার মনের মধ্যে…..
***************
খাওয়া দাওয়া শেষে তৃষিতা আর সৌরদীপ দুজনেই চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। কেউই বুঝে পেলনা কী দিয়ে বলা শুরু করবে! এমনি সময় কখনো এত সমস্যা হয়না ওদের মধ্যে! হইচই, আনন্দ করেই কেটে যায় সবসময়। কিন্তু আজ কী যে হল, কোনো আড্ডাই যেন জমছে না। আজকের ভালো দিনে কত প্ল্যান করেছিল তৃষিতা, সবকিছু কেমন যেন এক নিমেষে ভেস্তে গেল । আর বাইরের পরিবেশটাও হয়েছে তেমনি, পুজোর আগে এই শরতে কোথায় নীল, ঝকঝকে আকাশ থাকবে, তা নয়… গুমোট, কালচে মনখারাপ করা আকাশ।
এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পরে, হঠাৎ করেই সৌরদীপ তৃষিতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-” আচ্ছা, মানুষ কি দ্বিতীয়বার ভালোবাসতে পারে? মানে জানি, প্রেমে পড়তে পারে, ভালোলাগতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা??? তার প্রতি সেই অনুভূতিটা আবার আসে? যেটা প্রথমজনের প্রতি এসেছিল?”
-” আমার তো এ ব্যাপারে,কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তুই তবু প্রেম করেছিস, জানিস। আমি কী বলব বল?”
সৌরদীপের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কথাটা বলল তৃষিতা। ও বেশ বুঝতে পারছে পারছে, রাস্তায় দেখা সেই মেয়েটা, কী যেন নাম….. হ্যাঁ সৌরিতা, ঐ মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই এরকম ভাবনা চিন্তা গুলো আসছে সৌরদীপের মাথায়। নিশ্চয় তার সাথে পুরোনো প্রেমের কথাটাও মনে পড়ে যাচ্ছে ওর….। উফফ, যত বেশি করে এসবের থেকে সৌরদীপকে দূরে রাখতে চায় তৃষিতা, তত বেশি করেই যেন পরিস্থিতি বিপরীতে চলে যায়। এতদিন ধরে বন্ধুত্বের খাতিরের সম্পর্কটা টেনে নিয়ে এসে, এতটা এগিয়ে গিয়ে এখন ফিরে আসাটা কি খুব সহজ? না তৃষিতা এর আগে কখনো প্রেমে পড়েনি, ভালোবাসেনি। কিন্তু সৌরদীপের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকেই ওর প্রতি একটা আলাদা দুর্বলতা কাজ করতে শুরু করে। সেটা শুধুই ভালোলাগা, নাকি ভালোবাসা তার পার্থক্য কিছুতেই বুঝতে পারেনা তৃষিতা। কিন্তু সেই পার্থক্যটা বুঝতে পারার আগেই সৌরদীপের জীবনে যদি নতুন কেউ এসে যায়, তাহলে সেখানে কী করার থাকতে পারে ওর??
সৌরদীপ, যেন তৃষিতার কথাটা শুনতেই পেলনা। উদাস হয়ে টেবিলের মেনুকার্ডটার দিকে তাকিয়ে ও বলল,
-” মাঝে মাঝে অর্পিতাকে ভুলে অন্য কাউকে ভালো লাগলে, নিজেকে খুব অপরাধী লাগে। মনে আমি ওকে ঠকাচ্ছি । ও মারা যাওয়ার সময়ে, আমি কথা দিয়েছিলাম, এমনকি নিজের কাছেও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে জীবনে দ্বিতীয় কাউকে কখনো জায়গা দেবনা। কোনোদিনও না। কিন্তু তাও, কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়না বলবি?”
-” থাক না এসব পুরোনো কথা। আজকের দিনে….”
-” প্লিজ তৃষিতা, একটু বলতে দে আমায়। আর চেপে রাখতে পারিনা, সবকিছু। দমবন্ধ লাগে নিজের। তুই আগে একটা কথা বল, আমি যদি দ্বিতীয় বারের জন্য কাউকে পছন্দ করি তাহলে সেটা কি অপরাধ হবে?”
সৌরদীপের কথার উত্তর দেওয়ার আগে একটু থমকে দাঁড়াল তৃষিতা। কী উত্তর দেবে ও? কিছুতেই সঠিক কোনো কথা ওর মুখের কাছে এলনা এই মুহূর্তে।
অবশ্যই নিজের জীবনকে নতুন করে শুরু করার অধিকার সবার আছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া কি এতটাই সহজ? এতটাই কম সময়সাপেক্ষ?
(ক্রমশ)