💓#ইচ্ছে_ডানা
#চতুর্থ_পর্ব💓
সৌরিতা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারল না। বর্তমানে ঘটে যাওয়া ঘটনার চাপে সবকিছুই ওর মাথার মধ্যে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। নিজেকে একটু সামলে ছেলেটার সাহায্যে ভালোভাবে উঠে দাঁড়ালো সৌরিতা। ছেলেটা তখনও একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। আশেপাশের রাস্তার কয়েকটা লোকজনও ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সেইসব লক্ষ্য করে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি চেপে ধরল সৌরিতাকে। তাড়াতাড়ি করে ছেলেটার হাতটা ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল ও। মাথাটা নীচু করে, ধীরে ধীরে ও বলল,
-” থ্যাংকস ফর সেভিং মাই লাইফ। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি, আসলে একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই…”
-” এতে ধন্যবাদের তো কিছুই নেই, আমি দেখলাম আপনি নিজের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় রাস্তার ধারে চলে এসেছেন। আরেকটু হলেই আপনার ধাক্কা লেগে যেত ঐ মারুতি টার সাথে। আমি দেখতে পেয়ে ছুটে এলাম সে কারণে”
-” হুমম আমারই উচিত ছিল সাবধানে হাঁটার”
-” আপনার শরীর ঠিক আছে তো?”
-” হ্যাঁ আমি ঠিক আছি, যেতে পারব একা একা”
-“বেশ, তাহলে সাবধানে যাবেন। আসছি তাহলে”
একটা মিষ্টি হাসি হেসে ছেলেটা বলল কথাটা। সৌরিতা ভেবে পেলনা ওর প্রাণ বাঁচানোর জন্য এই ধন্যবাদ টুকুই কি যথেষ্ট হল? নাকি আরো কিছু বলার প্রয়োজন? ছেলেটির নামও তো জানা হলনা। কিন্তু নাম জিজ্ঞেস করাটা কি বাড়াবাড়ি হবে, নাকি স্বাভাবিকই হবে, সেটা বুঝতে পারলনা। খানিকক্ষণ মনে মনে ইতস্তত করল সৌরিতা। তারপর ছেলেটা পেছনে ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হতেই ও ব্যস্ত গলায় হঠাৎই বলে উঠল,
-” আচ্ছা বলছি আপনার নামটা কী? জানতে পারি?”
-” ওহ, হ্যাঁ নিশ্চয়। আমি সৌরদীপ। সৌরদীপ চৌধুরী। আপনার নাম?”
-” সৌরিতা।”
-” বাহ্ সুন্দর তো! বেশ মিল ও আছে দেখছি আমার নামের সাথে। তো আপনি কতদূর যাবেন ? আমার সাথেই আসুন, গাড়ি আছে নামিয়ে দিচ্ছি। আমি আসলে কিছু ওষুধ কিনব বলে নেমেছিলাম”
-” ওহ আচ্ছা। কিন্তু আমি একাই চলে যেতে পারব । একটু তাড়া আছে আমার। ওকে, আসছি কেমন?”
-” বেশ, তাহলে তো আর কিছু বলা যাবেনা। আসুন আপনি”
-” হুমম”
সংক্ষেপে উত্তর দিয়েই হাঁটা শুরু করল সৌরিতা। আজকে রাজীবের অফিসে যাওয়ার ঘটনাটা কথা ওর মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল কিছুমূহুর্তের জন্য। এখন মনে পড়তেই ভীষণ একটা তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে গেল যেন মনের মধ্যে। একবারও আর ও পিছন ফিরে তাকালো না। তবে সৌরিতা যদি একমুহূর্তের জন্য তখন পিছনে ফিরে তাকাতো তাহলে দেখতে পেত, জানতে পারত সদ্য পরিচয় হওয়া সেই ছেলেটা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছিল বহুক্ষণ ……
*************
ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে সৌরদীপ। ওর সামনের টেবিলে রাখা খাবারগুলো প্রায় ঠান্ডা হয়ে এসেছেই বলা যায়। তাও ওর সেদিকে কোনো হুঁশ নেই। ওর উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকা তৃষিতা এবার বাধ্য হয়েই বিরক্ত গলায় বলে উঠল,
-” এইই সৌর, তুই কোনো কথা বলবি কি? নাকি এভাবেই চুপ করে বসে থাকবি? তখন থেকে কী এত ভাবছিস বলবি??”
-” আরেহ্ কিছু না। বল ”
-” কী কিছু না? কী হয়েছে সেটা বল, এত নাটক করিস না। ”
-” বলতেই হবে??’
-” হুমম বলতেই হবে, বলে ফেল জলদি। কী হল হঠাৎ করে তোর? সারাদিন এত বকবক করে যাস, মাথা খেয়ে নিস, আর আজকে এতবড়ো একটা ভালো দিনে, তোর নিজের জন্মদিনে এরকম চুপ করে বসে আছিস?”
-” আসলে আজ আসার সময় একজনের সাথে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল বুঝলি? মানে একদম ঐ সিনেমার মতো বলতে পারিস, সেই ব্যাপারটাই মাথায় ঘুরছে তখন থেকে”
-” মানে???? কার সাথে, কোথায়, কখন দেখা হল? সিরিয়াসলি? আর তুই অমনি প্রেমে পড়ে গেলি তার?”
-” আরেহ্ না না, ওরকম কিছু না। আসলে মেয়েটা রাস্তার মাঝখান দিয়ে অদ্ভুত ভাবে হাঁটছিল বুঝলি ? মানে আরেকটু হলেই একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেত। তো আমি গিয়ে ওকে বাঁচাই। এটাই ঘটনা”
-” আরিব্বাস! এতো একদম হিরো হিরো ব্যাপার! তারপর কী হল? মেয়েটাকে প্রপোজাল দিয়ে দিলি?”
-” আরেহ্ না রে বাবা। জাস্ট নাম টুকুই জেনেছি। ওর নাম সৌরিতা। ব্যস, তারপর ও ওর পথে আর আমি আমার পথে। গল্প শেষ”
-” শেষ?? যাহ্! তা ও তোর নাম জানে?”
-” হুম বললাম তো নামটা। আসলে কী বলত একটু চিন্তা হচ্ছে, যে ওরকম ভাবে হাঁটছিল মেয়েটা, নিশ্চয় কোনো গভীর সমস্যার মধ্যে ছিল। পরে সাবধানে পৌঁছাল কিনা কে জানে!”
সৌরদীপ চিন্তিত সুরে জানালা দিয়ে বাইরে দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল। তৃষিতাও সৌরদীপের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে রইল। ওর বুকের ভিতরে এই মুহূর্তে অদ্ভুত এক ওঠাপড়া যেন শুরু হয়ে গেছে। মুখে হাসির ভাব আনলেও সৌরদীপের মুখে এই নতুন মেয়েটার কথা শুনে ওর মনে মনে একটু আগের সেই আনন্দটা এক নিমেষে শেষ হয়ে গেছে। কে সেই মেয়েটা, যাকে একবার দেখেই এতটা বিচলিত হয়ে পড়ছে সৌর? ওদের এতদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্কের সমীকরণটা যখন ও বদলে সবে আরেকটু গভীরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ঠিক তখনই এরকম একটা ঘটনা ঘটতে হল?
খানিকক্ষণ চুপ থেকে সৌরদীপ জানালা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার বলল,
-” বাদ দে। চল কেক টা কাটি। আয় তুই এদিকে এসে বস”
-” হুমম। দাঁড়া আসছি”
চেয়ার থেকে উঠে তৃষিতা সৌরদীপের পাশে গিয়ে বসল। ওর মুখটা দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, যে আনন্দের লেশ টুকু উপস্থিত নেই। সৌরিতা নামক নতুন এই চরিত্রটা ওর জীবনটাকে এক অদ্ভুত দোলাচলে এনে দাঁড় করিয়ে দিল।
***************
রাজীবের অফিসে পৌঁছে চারিদিকটা একবার ভালো করে দেখে নিল সৌরিতা। এর আগেও একবার এখানে এসেছিল ও, একটা অফিসেরই গেট টুগেদার পার্টিতে। তখন এত ঝাঁ চকচকে ছিলনা এলাকাটা। কিন্তু এখন একদমই পরিবর্তন হয়ে গেছে জায়গাটা। সৌরিতা দুরু দুরু বুকে অফিসের গেটের দিকে পা বাড়ালো। এগারোতলা বিশাল বিল্ডিং টার দিকে তাকিয়ে ওর বুকটা সামান্য কেঁপে উঠল। ওর আজকের এই অভিযানটা কি আদৌ সফল হবে? নাকি রাজীবের ব্যাপারে নিছকই একটা ভুল ভাবনার, পিছনে ছুটে চলেছে সে? রাজীবের ব্যাপারে নতুন কী তথ্য পাবে সে! তবু মোহর বলে মেয়েটা সাহায্য করেছিল বলে আজ এতদূর আসতে পারল সৌরিতা, নাহলে তো এতটুকুও হত না। বিভিন্নরকম ভাবনাচিন্তার জালে সৌরিতার মাথাটা ভার হয়ে এল ……
(ক্রমশ)