#ইচ্ছে_ডানা
#তৃতীয়_পর্ব
মোহরের দেখা করার পর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। মেয়েটার উপর ভরসা করে যে সৌরিতা এতটুকু ভুল করিনি তা এই মুহূর্তে বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে সে। এই কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকটা তথ্য জোগাড় করে ফেলেছে মোহর,তবে সেগুলো সবই অফিসের নানান রকম ঝামেলা সংক্রান্ত বিষয়। রাজীবের কোনো অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারে সেরকম কিছু এখনও জানতে পারেনি মোহর। তবে সৌরিতাকে একদিন হঠাৎ করেই রাজীবের অফিসে চলে যাওয়ার একটা আইডিয়া দিয়েছে ও। কারণ কাজের চাপে মোহর নিজেও সবসময় অফিসে থাকতে পারেনা। তাই হঠাৎ করে কোনো একদিন যদি যাওয়া যায় অফিসে, রাজীব প্রস্তুত থাকবেনা। সেক্ষেত্রে গোপন কোনো ব্যাপার থাকলে সৌরিতার আশাকরি বুঝতে খুব একটা সমস্যা হবেনা। আর সেই হঠাৎ যাওয়ার দিনটা সৌরিতা আজকেই ঠিক করেছে। কয়েকদিন পরে পুজোর ছুটি পড়ে যাবে, অফিসে লোকজনের সংখ্যা কমতে থাকবে। তখন আর কিছু করা যাবেনা। তাই যা করার এখনি, এই মুহূর্তে করতে হবে।
দুপুরের দিকে বেলা গড়াতে গড়াতেই সৌরিতা তৈরী হয়ে নিল। অন্যসময় ও কোথাও গেলে চুড়িদারই পরে, শাড়ি যতটা পারে এড়িয়েই চলে নিজের সুবিধার জন্য। তবে আজকে ও শাড়িই পরল, যাতে বাইরের কেউ বিশেষ করে, রাজীব তাকে চট করে দেখে চিনতে না পারে। শাড়ির সাথে ফুলহাতা ব্লাউজ আর সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিল সৌরিতা। বেশ অন্যরকমই লাগছে তাকে। হাতের ছোটো ব্যাগটা নিয়ে, ঘরে তালা দিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল সে। বুকের ভিতরটা একটা অদ্ভুত ভয়ে ধড়ফড় করতে লাগল তার। যদি রাজীব বুঝতে পেরে যায়? রাজীব যদি সবার সামনে তাকে অপমান করে দেয় তখন? তখন কী করবে সে? এত বড়ো একটা ঝুঁকি না নিলেও তো চলছিলনা। পুজো আসছে, মা দুর্গার আগমনে সবার মনে কত আনন্দ …. সবাই যে যার মত করে সুখী। আর সে?? সে নিজের সংসার বাঁচাতে, সম্পর্ক বাঁচাতে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সন্দেহ করে একা হেঁটে চলেছে রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে সৌরিতার চোখ দুটো আচমকাই ঝাপসা হয়ে এল। পাশ থেকে প্রচন্ড গতিবেগে বাস, গাড়ি সব চলে যাচ্ছে । চোখে স্পষ্ট কিছু দেখতে না পেলেও হাঁটা থামালো না সৌরিতা। ওর মনের চিন্তাভাবনা আর এই মুহূর্তে বর্তমানে আটকে নেই। মাত্র এক বছর আগের কথা মনে পড়লেও, ওর গলার কাছটায় একটা দলাপাকানো কষ্ট চেপে বসে যেন…
সেই রাজীব! কলেজে পড়াকালীন সিনিয়র ব্যাচের রাজীবদা থেকে রাজীব পরিচয়টুকুতে আসতে যেটুকু সময় লেগেছিল, তাতে রাজীবের থেকে সৌরিতার চেষ্টাই বেশী ছিল। কলেজের ফ্রেশারস এর অনুষ্ঠানে রাজীব প্রথমবার দেখেছিল সৌরিতাকে। তখন ও ছিল ফাইনাল ইয়ারে। সেদিন চোখাচোখির প্রথম পর্যায়ে শুধু রাজীব একা নয়, সৌরিতার দিক থেকেও সায় ছিল অনেকটাই। ফলে,খুব স্বাভাবিক ভাবেই এরপর সৌরিতার প্রতি রাজীবের ভালোলাগাটা বাড়তে থাকে,এবং সেটা সৌরিতার দিক থেকেও। মাঝে মাঝে কলেজের ক্যান্টিনে, লাইব্রেরীতে, দেখে হতে থাকে ওদের। এই দেখা হওয়া নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে ইয়ার্কি, ঠাট্টাও বাড়তে থাকে উত্তরোত্তর। দুজনেই যে দুজনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে তা ওরা বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারে। কিন্তু কেউই কাউকে নিজেদের ভালোলাগার কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনা, সদ্য তৈরী হওয়া বন্ধুত্বটা ভেঙে যাওয়ার ভয়ে। অবশ্য খুব বেশিদিন এসব কিছু চাপা থাকেওনি। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে কলেজের একদম শেষদিকে এসে, ফেয়ারওয়েল এর দিনে রাজীব ওর মনের কথাটা আচমকাই বলে বসে সৌরিতাকে। ব্যাপারটা এতটাই আচমকা ছিল যে, সৌরিতার নিজেকে গুছিয়ে ওঠারও সময় পায়নি।
অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শেষে ক্লাসের পাশের ব্যালকনির কাছটাতে তখন সবে এসে বসেছে সৌরিতা। ও বুঝতেও পারেনি, কখন পিছনে রাজীব এসে দাঁড়িয়েছে। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ করেই একটা চেনা গলার আওয়াজ শুনে পিছনে ফিরে তাকালো সৌরিতা, অবাক হয়ে ও দেখল ঠিক তার পিছনেই একদৃষ্টে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজীবদা। নীল রঙের একটা পাঞ্জাবিতে কি দারুণ লাগছে রাজীবদাকে। সৌরিতা নিজেও একভাবে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। দুজনে কতক্ষণ এভাবে চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল, তা কারোরই খেয়াল নেই। শেষে উপায় না দেখে, নীরবতা ভেঙে রাজীবই প্রথম বলে উঠল,
-“সৌরিতা, তোমাকে আমার একটা কথা বলার আছে। মানে তুমি এখন ফ্রি আছো তো? তাহলে বলতাম”
-“হ্যাঁ বলো। আমি ফাঁকাই তো আছি”
-” না মানে, আসলে… আজকেই তো আমার শেষ কলেজে, এরপরে আর তেমন দেখাও হবেনা তোমার সাথে”
-” হুমমম সে তো জানি। কিন্তু ……”
-” আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। সেই জন্যই এখানে আসা”
-” আরে বলো না কী বলবে”
-” সৌরিতা আমি তোমাকে ভালোবাসি’
এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলেই চুপ করে গেল রাজীব। এই মুহূর্তে ও একদম চুপ করে সৌরিতার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিটখানেকের নীরবতাও যেন অনন্তকাল মনে হত লাগল তার।
সৌরিতা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
-” মন থেকে ভেবে একথা বলছ তো?”
-” হ্যাঁ। মন থেকে ভেবেই তো বলছি। কেন তোমার কী মনে হয় আমি এটা এমনিই বলছি ?
-” না সেটা না, পরে যদি তোমার কখনো মন পরিবর্তন হয়? তখন আমি কী করব?”
-” মন পরিবর্তন হয়ে গেলে তখন??? তখন কি করব আমি??”
-” কেন হবে মন পরিবর্তন? আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি… তুমি আমাকে পছন্দ করো তো??? আমি জানি সেটা,তুমি চাইলেও অস্বীকার করতে পারবেনা।”
-” না অস্বীকার আমি করব না। কিন্তু রাজীবদা আমার খুব ভয় লাগে এসবে। আমি সম্পর্ক ভাঙতে ভয় পাই, বিশ্বাস ভেঙে গেলে কী নিয়ে বাঁচব সেটাকেই ভয় পাই। ”
-” আমি ভাঙবনা তোমার বিশ্বাস। কথা দিলাম, একবার ভরসা করে দেখো আমাকে”
সেই ভাবতে, বিভোর হয়ে গিয়েছিল সৌরিতা। কখন যে হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাত থেকে রাস্তার দিকে চলে এসেছে ও তা বুঝতেও পারেনি। হঠাৎ করেই একটা বলিষ্ঠ হাতের টান ওকে টেনে ধরল। সৌরিতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ একজন ওকে রাস্তার ধারে টেনে এনে জোর গলায় বলে উঠল,
-” দেখে হাঁটবেন তো, একটু হলেই তো গাড়ি ধাক্কা মারত”
কোনো রকমে চোখটা খুলে সৌরিতা দেখল, একটা অল্পবয়সী ছেলে, বয়স বড়োজোর তার থেকে একটু বেশী হবে। ছেলেটা বড়ো বড়ো চোখে,ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে….
(ক্রমশ)