#ইংলিশ_মিডিয়াম
শেষ_পর্ব
~মিহি
তিথি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। শৈশবের পাশে মিত্তিম দাঁড়িয়ে। মেয়েটাকে শৈশবের পাশে দেখে এই মুহূর্তে তিথির আর খারাপ লাগছে না। যে শৈশবকে পাওয়ার জন্য সব করতে রাজি ছিল তিথি, সে অনুভব করতে পেরেছে আদতে সে শৈশবকে ভালোবাসেনি। মিত্তিমের শৈশবের প্রতি যে বিশ্বাস তার তিল পরিমাণও সে কখনো করতে পারেনি শৈশবকে। মিত্তিম কিভাবে শৈশবকে এতটা বিশ্বাস করে? মাত্র ক’দিনের ভালোবাসায় এমন বিশ্বাস কী করে জন্মায়? তিথির চোখের কোণা বেয়ে জল গড়ালো। সে শৈশবকে হারিয়েছে, নিজের দোষেই হারিয়েছে। অথচ এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছিল সে শুধু শৈশবকে পাওয়ার আশায়। এভাবে কখনো কাউকে পাওয়া যায়? ভালোবাসা ব্যতীত এক ষড়যন্ত্রে নেমে ভালোবাসা পাওয়ার আশা ঠিক কতটা অনর্থক তা বুঝেছে সে।
-“শৈশব, তোমার কাছে স্যরি বলার মুখটুকুও নেই আমার। তবুও বলতে চাই। যে অন্যায় তোমাদের সাথে আমি করেছি, তা ক্ষমার অযোগ্য। আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা। মিত্তিম তোমাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে শৈশব। ওর মতো করে তোমাকে কখনো কেউ ভালোবাসতে পারবে না। এই মেয়েটার হাতটা ধরে রেখো সবসময়।”
শৈশব কোনো কথা বললো না। তিথিকে সে ক্ষমা করতে পারবে না। মুখে বললেও সেটা মিথ্যেই রয়ে যাবে, মনের সায় কখনোই আসবে না। তার চেয়ে বরং চুপ থাকাটাই শ্রেয়। শৈশব কেবল একটা কাজ করলো। মিত্তিমের হাতটা শক্ত করে নিজের হাতের মাঝে মেশালো। মিত্তিম অবাক চোখে তাকালো শৈশবের দিকে। তিথির চোখ নোনাজলে ভিজে উঠলো, কণ্ঠে টের পাওয়া গেল মনের আর্তনাদের বিষাদ।
-“জানি আমার বলাতে কিছু যায় আসে না, তবুও চাইবো তোমরা ভালো থেকো সবসময়। আমি তোমাদের সামনে আর কখনো আসবো না তাই ক্ষমা চেয়ে নিলাম। এখন তোমরা এসো। আমার আর কিছু বলার নেই।”
শৈশব তৎক্ষণাৎ মিত্তিমের হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে এলো। এ মুহূর্তে শৈশবকে প্রচণ্ড অমানবিক মনে হলেও শৈশবের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে সে।
শৈশব মিত্তিম ফিরলো একটু পরেই। আকলিমা বেগম মিত্তিমকে ভেতরে বসতে বললেন একটু। তিনি শৈশবের সাথে সাথে আলাদা কথা বলবেন। মিত্তিম মাথা নাড়লো। শৈশবের খানিকটা নার্ভাস লাগছে। সে জানেও না কোন প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হবে এখন।
-“ভয় পাচ্ছো শৈশব?”
-“একটু।”
-“আমি তোমাদের অপেক্ষা করতে বলেছি ঠিকই কিন্তু আমি কখনোই বলিনি তোমাদের যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করতে। আমি জানি এটা সম্ভব না। মিত্তিম তোমার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল। তোমাদের কথা বন্ধ হলে মেয়েটা নিজেকে কখনো সামলাতে পারবে না তবুও অপেক্ষা করতে বলেছি কেন জানো?”
-“কেন?”
-“সহজে পেয়ে গেলে মানুষ প্রায়শই মূল্য দিতে ভুলে যায়। ও তোমাকে একটু অপেক্ষা করেই অর্জন করুক। মাঝেমধ্যে ওকে কল কোরো, ও একটু জানুক যে সব পরিস্থিতিতেই তুমি তাকে একই রকম ভাবে ভালোবাসবে। বুঝেছো?”
-“জ্বী।”
-“আসি তবে, সাবধানে থেকো।”
শৈশব আর কিছু বললো না। তার মনের আনন্দ সে ব্যক্ত করার অবস্থায়ও নেই। মিত্তিম তার মায়ের সাথে চলে গেল। শৈশব দূর থেকে দেখলো তাকে। এই দেখাটাই বোধহয় দূর থেকে শেষ দেখা হবে, পরেরবার শৈশব খুব কাছ থেকে দেখবে মিত্তিমকে। মিত্তিমের মাঝে মিশে অনুভব করবে তাকে। শৈশব মাথা নিচু করলো। চোখ ছলছল করছে তার, মিত্তিমকে পেয়ে যাওয়ার খুশি!
___________________________________________________________________________________________
মিত্তিমের পরীক্ষা আগামীকাল। শৈশব এ সপ্তাহে ফোন করেনি তাকে। মেয়েটা একটুও ডিসট্র্যাক্ট হোক চায়নি সে। তবে আজ প্রচণ্ড অসহায় লাগছে। মন অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। শৈশব মিত্তিমের মায়ের নম্বর ডায়াল করলো। রাত এগারোটা পেরিয়েছে। কল কাটবে কাটবে করেও কাটা হলো না। আকলিমা বেগম ফোন ধরলেন। শৈশব সালাম দিল। আকলিমা বেগম উত্তর দিলেন। শৈশব আকলিমা বেগমের কণ্ঠে আরো দুশ্চিন্তায় পড়লো।
-“আন্টি মিত্তিম? ও কি পড়ছে এখন? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
-“ঘুমোচ্ছে।”
-“আচ্ছা আন্টি। সকালে আমার তরফ থেকে বেস্ট অফ লাক জানায়েন।”
-“ঠিক আছে।”
-“আন্টি কিছু হয়েছে?”
-“না শৈশব। সব ঠিক আছে। তোমার পরীক্ষা চলছে না?”
-“হ্যাঁ এইতো চলছে আর কী।”
-“ভালোভাবে পরীক্ষা দাও।”
ব্যস! এটুকু খোঁজখবর নিয়েই কথার সমাপ্তি ঘটলো। শৈশব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। প্রায় পাঁচ মাস হচ্ছে মিত্তিমকে দেখেনা সে, এতটা অস্থির আগে তো লাগেনি। আজ হঠাৎ এ অস্থিরতা কেন? মিত্তিমের পরীক্ষার জন্য কি তার টেনশন হচ্ছে? বোধহয়! শৈশবের খানিক বাদেই মাথা ধরলো। একটু ঘুমোনো দরকার কিন্তু ঘুম আসছে না। শৈশব ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো।
শৈশবের ঘুম ভাঙলো দুপুর বারোটার পর। লাফ দিয়ে উঠলো সে। ওষুধের প্রভাব এতক্ষণ থাকবে বুঝে উঠতে পারেনি। ভাগ্যিস দুদিন বাদে পরীক্ষা। শৈশব উঠে ফোন হাতে নিতেই দেখলো ফায়াযের নম্বর থেকে সাতান্নটা মিসড কল। শৈশব হাতমুখ ধুয়ে ফায়াযের নম্বরে কল করলো। ফোন সুইচড অফ বলছে। শৈশব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শৈশব মায়ের নম্বরে কল করলো। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। ঘণ্টা দেড়েক পর ফায়াযই কল ব্যাক করলো। শৈশব তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলো কল।
-“কী সমস্যা? কল করে ফোন অফ ক্যান তোর? মাও কল ধরছে না।”
-“ভা..ভাইয়া তুই একটু আসবি?”
-“ফায়ায কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই? সবাই ঠিক আছে তো?”
-“তুই প্লিজ একটু আয় ভাইয়া!”
ফায়াযের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসলো। সে আর কথা বলতে পারলো না। শৈশব প্রচণ্ড চিন্তায় পড়লো। দ্রুতই বাসের টিকিট কাটলো। প্রথম যে বাসটা পেল সেটারই। আজ মিত্তিমের পরীক্ষা, ফায়াযেরও তো পরীক্ষা ছিল। কী এমন হলো! শৈশব চিন্তায় ঠিকমতো বসতেও পারলো না। সবকিছুই দোদুল্যমান লাগছে তার নিকট। জ্যাম না থাকায় খুব একটা দেরি হলো না শৈশবের পৌঁছাতে। বাস থেকে নেমে প্রথম ফায়াযকেই কল করলো সে। ফায়ায হাসপাতালের ঠিকানা দিল। শৈশবের হৃদস্পন্দন কমে আসছে। হাসপাতাল? কে অসুস্থ? মা? শৈশবের মাথায় চিন্তাগুলো যত ঘুরপাক খাচ্ছে, তত তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে। প্রচণ্ড টেনশনে কোনোরকম সে হাসপাতালে পৌঁছালো। আকলিমা বেগম বসে আছেন এককোণে, তার পাশে মিত্তিমের বাবা। ফায়ায এবং আহসিনা বেগমও একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। শৈশব অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চাইছে। মন বারবার বলছে যা সে ভাবছে তেমন কিছু না হোক। শৈশবকে দেখামাত্র ফায়ায প্রচণ্ড দুর্বল অনুভব করলো। ভাইকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো সে ক্রমাগত। শৈশবের সেটুকু শক্তিও অবশিষ্ট নেই যে সে ফায়াযকে সামলাবে তবু ভাইয়ের বাহু আঁকড়ে স্তব্ধ গলায় সে প্রশ্ন করলো,”কী হয়েছে?”
ভাইয়ের প্রশ্নের কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারলো না সে। আইসিইউ এর দিকে তাকালো শুধু। শৈশব ছুটে গেল সেদিকে। বন্ধ দরজার কাঁচঢাকা অংশে মিত্তিমের ক্ষতবিক্ষত শরীরে অজস্র ব্যান্ডেজ দেখে দাঁড়ানোর ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো সে।
-“মিত্তিমকে কোচিংয়ের সামনে থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এক সপ্তাহ আগে। ড্রাগস দিয়ে পরপর…”
-“পরপর কী ফায়ায?”
-“ধর্ষণ করা হয়। সাতদিনের মাথায় পুলিশ ট্রেস করে ঐ চারজনকে ধরে। মিত্তিমের অবস্থা খুব খারাপ, ইন্টার্নাল ইঞ্জুরি অনেক বেশি। সবাই নিষেধ করেছিল তোকে হঠাৎ করে জানাতে। কিন্তু কাল রাত থেকে মিত্তিমের অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ ছিল। আমি তোকে কল করেছিলাম, তুই রিসিভ করিসনি।”
শৈশবের নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সে কেন ঘুমের ওষুধ গেল? এত অস্থির লাগার পরেও কেন একবার মিত্তিমকে দেখার আকুতি জানাতে পারলো না? প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে শৈশবের নিজের উপর! সব তো ঠিক ছিল। ভালোবাসা, বিশ্বাস, পরিবার! সবকিছু ঠিক ছিল ওদের মধ্যে তবে ভাগ্য এমন নিষ্ঠুর পরিহাস কেন করলো?
_____________
মিত্তিমের হালকা একটু জ্ঞান ফেরার পর শৈশব দেখতে চাইলো তাকে। শৈশবের সে আকুতি ফেলবার মতো নির্দয় সেখানে কেউ ছিলেন না। শৈশব এসে পাশে বসলো মিত্তিমের। মেয়েটার হাতে অজস্র ক্ষত। মিত্তিম শৈশবকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিল, মাথা নিচু করে ফেললো। শৈশব মিত্তিমের হাত ধরার চেষ্টা করলো। মিত্তিম হাত সরিয়ে নিল।
-“মিত্তি! এমন কোরো না প্লিজ, আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিও না এভাবে।”
-“আ..আপনি আ..আমার কাছে আ..আসিয়েন না। আমার গা..গায়ে যথেষ্ট নোংরা লেগে আছে। ছুঁয়েন না আমাকে।”
শৈশব পাগলের মতো মিত্তিমের হাতটা আলতো করে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ক্ষত হাতটা অজস্র চুমু খেল। তার প্রিয় মানুষটাকে এ অবস্থায় দেখার ক্ষমতা তো বিধাতা তাকে দেননি! শৈশবের বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। পাঁচ মাস আগে মিত্তিমকে যখন সে দেখেছিল, তখন সে বলেছিল পরেরবার মিত্তিমকে খুব কাছ থেকে দেখবে। এভাবে দেখার প্রত্যাশা তো সে করেনি! তবে কেন এত নিষ্ঠুরতা তার সাথেই? কেন মিত্তিমের উপর দিয়ে এত বড় নৃশংসতা চালালো নিয়তি? মিত্তিম কথা বললো না আর। শৈশবকে চলে যেতে ইশারা করলো। শৈশব অসহায়ের মতো উঠে যেতে নিল। মিত্তিম কাঁপা হাতে কেবল আওড়ালো,”ভালোবাসি!” শৈশব পাশে বসে মিত্তিমের হাত ছুঁয়ে ভালোবাসি বললো বারবার। সে কি জানতো এটাই শেষবার নিজের প্রিয়তমাকে ভালোবাসি বলার?
রাত বারোটা নাগাদ মিত্তিম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। ড্রাগের ওভারডোজ আর ইন্টার্নাল ক্ষত- সব মিলিয়ে তার শরীর আর টিকে থাকতে পারেনি বেঁচে থাকার যুদ্ধে। শৈশব মিত্তিমের লাশ দূর থেকে দেখেছে। একটু কাছে গিয়ে দেখার সাহস পায়নি। মিত্তিমকে সাদা কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় দেখার শক্তিটুকু সে পায়নি।
______________________________
মিত্তিম চলে যাওয়ার পর থেকে শৈশবের অদ্ভুত একটা রোগ হয়েছে। সে এটাকে ঠিক রোগ বলতে চায় না। সে মিত্তিমকে দেখতে পায়, সবসময় দেখতে পায়। অন্যকেউ দেখতে পারে না কিন্তু শৈশব মিত্তিমকে সবসময় নিজের কাছে দেখে, কথা শোনে। শৈশব পরিবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে চেয়েছিলেন তাকে। শৈশব যায়নি। শৈশব মিত্তিমকে হারিয়ে ফেলতে চায় না। সে মিত্তিমকে হাসতে দেখছে, ছুঁতে নাই বা পারলো! একটু কথা বলতে তো পারছে, জড়িয়ে নাই বা ধরতে পারলো! অস্বাভাবিক আচরণ তো করছে না সে, একটা মানুষের উপস্থিতি তাকে শান্তি দিচ্ছে। মানুষটা অন্য কারো নজরে না পড়ুক, সে দেখতে পারছে তার ভালোবাসাকে। এটুকু খুশি তার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না!
শৈশব গলার টাই ঠিক করছে। ইন্টারভিউ আছে আজ তার। সময়গুলো বড্ড দ্রুত পেরিয়েছে। মিত্তিম ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। শৈশব তাকালো সেদিকে। মিত্তিম মুচকি হেসে বললো,”বেস্ট অফ লাক, মি.ইংলিশ মিডিয়াম।”
শৈশব মুচকি হাসলো। একটা কথা মাথায় ঘুরতে লাগলো তার,”তুমি আমার সবকিছুতেই ছিলে, কেবল ভাগ্যে ছিলে না!”
সমাপ্ত