ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১৭

0
73

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১৭তম_পর্ব
~মিহি

-“দেখো শৈশব, তোমাদের এ প্রেম যে হঠাৎ তা আমিও বুঝেছি। আমি চাচ্ছি তোমার কথাই রাখতে। মিত্তিমের এডমিশন অবধি অপেক্ষা করো তোমরা। আমি তোমার মায়ের সামনেই এসব বলছি যেন কোনো সমস্যা না ঘটে।”

শৈশব মিত্তিমের মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখ বর্ষার ঘন কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো দেখাচ্ছে কেন? মেয়েটার মন খারাপ? কেন? মিত্তিমের কি এ সিদ্ধান্তে আপত্তি আছে? শৈশবের মাথায় প্রশ্নরা ঘুরপাক খাচ্ছে একাধারে।

-“আমার আপত্তি নেই আন্টি তবে মিত্তিমের মতামতটাও জানা উচিত আমাদের।”

-“তোমাদের কিছুক্ষণ একা কথা বলা উচিত। ভাবী, আপনার আপত্তি না থাকলে…”

আহসিনা বেগম এতক্ষণ চুপ ছিলেন। এবার সায় দিলেন। তিনিও চাচ্ছেন বাচ্চা দুটো নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিক। শৈশব ইশারা করলো। মিত্তিম মায়ের দিকে তাকিয়ে সম্মতি পেয়ে ধীরে ধীরে এগোলো। শৈশব তার পেছন পেছন গেল। ছাদটা ইদানিং মিত্তিমের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে। ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। শৈশবের শরীরের চিরচেনা গন্ধটা ভেসে আসছে। শৈশব তার অতি সন্নিকটে। এ নিকটবর্তী থাকাটাও মিত্তিমকে পোড়াচ্ছে এখন। তাকে যে প্রতীক্ষার পরীক্ষায় বসতে হবে এখন। মায়ের কথার অর্থ মিত্তিম বুঝেছে। তিনি মিত্তিমের ভালোর জন্যই বলেছেন তবে এ ভালো মিত্তিমের ভালো লাগছে না।

-“আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে মিত্তি?”

মিত্তিম চোখ মেললো। শৈশবের চোখে অদ্ভুত আকুতি। শৈশব অনুমতির অপেক্ষা করলো না। মিত্তিমের মাথা চেপে ধরলো নিজের বুকে। শৈশব অনুভব করতে পারছে মিত্তিম কাঁদছে। শৈশবের শার্ট খামচে ধরে ক্রমাগত কাঁদছে মেয়েটা। শৈশব মিত্তিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

-“মিত্তি! আমি হারিয়ে যাচ্ছি না তো, তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? এমন করলে কিন্তু এখনি বিয়ে করে নিয়ে যাবো।”

-“চলো।”

-“তাই? এখন নিয়ে গিয়ে বউকে কী খাওয়াবো?”

-“আমি কি হাতির সমান খাই নাকি যে কী খাওয়াবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো!”

-“না জান, আমি আমার বউকে সমস্ত কিছু প্রভাইড করতে চাই। তোমার কোনো কিছূতে যেন কমতি না থাকে সেই ব্যবস্থা করে তবেই আমি একেবারে তোমাকে নিজের করে নিব। ততদিন আমার হাতটা ধরে আমার পাশে থাকবে না?”

-“থাকবো। তুমি রাখলেই থাকবো!”

মিত্তিমের কথার ভাঁজে প্রচণ্ড অভিমানের উপস্থিতি দিব্যি টের পেল শৈশব। সে আসলেই একটা বাচ্চার প্রেমে পড়েছে, অভিমানী বাচ্চা।

-“মিত্তি!”

-“হু!”

-“আমাকে বিশ্বাস করো তুমি?”

-“নিজের চেয়েও বেশি।”

-“তবে এটুকু জেনে রাখো আমি তোমারই থাকবো, শুধুই তোমার। তোমার অপেক্ষা করবো আমি, তোমাকে কাছে পাওয়ার অপেক্ষা করবো, তোমার কণ্ঠে কবুল শোনার অপেক্ষা করবো।”

-“আমি তো এই অপেক্ষা চাইনি শৈশব! আমি এই অপেক্ষার যন্ত্রণা নিতে চাইনি। আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি, তোমাকে পাশে রেখেই স্বপ্ন পূরণে ছুটতে চেয়েছি। আমি তোমাকে অপেক্ষায় রেখে থাকতে পারবো না শৈশব।”

-“থাপ্পড় লাগাবো এখন! আমার চক্করে পড়াশোনার বারোটা বাজাবা? আমি তো তোমারই পাগল, এখন পড়াশোনায় মন দাও। সঠিক সময়ের জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে কেবল। ভালো সবকিছুই দেরিতেই আসে, বুঝছো জান?”

-“না! আমি কিচ্ছু বুঝিনি। আমি কিছু বুঝতে চাইনা। তোমাকে কিভাবে বোঝাবো আমি যে তোমাকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না! আমি চাইলেও তোমার সাথে হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে পড়ায় মন বসাতে পারবো না। তুমি আমার অভ্যেস শৈশব! যে অভ্যেসটা আমি ছাড়তে চাইনা।”

শৈশব মিত্তিম দু’গালে হাত রেখে কপালে আলতো করে চুমু খেল। মিত্তিম ফের কান্নায় ভেঙে পড়লো। এ ক্ষণিকের বিচ্ছেদটাও যে বড্ড যন্ত্রণার! শৈশবের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না মিত্তিম, তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। শৈশবের চোখেও তো নিশ্চিত সে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করবে। এ যন্ত্রণা তার সহ্য হবে? কোনোভাবে না! মিত্তিমের কান্না থামছে না, চেয়েও থামাতে পারছে না সে।

___________________________

-“আজ হঠাৎ এত চুপচাপ?”

-“ফাইজা, কখনো যদি আমাদের অপেক্ষা করতে হয় সঠিক সময়ের জন্য, আমরা পারবো?”

-“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”

-“এমনি মনে হলো। বাদ দাও, আপু কোথায়?”

-“ভাইয়ার সাথে বেরিয়েছে ভাবী।”

-“ওহ! তুমি কী করছো?”

-“বসে বসে একটা গাধার কথা শুনছি।”

-“ওহ!”

ফায়াযের এমন নিষ্ক্রিয় জবাবে আশাহত হলো ফাইজা। সে তো ভেবেছিল ছেলেটা রীতিমতো ঝগড়া বাঁধাবে অথচ শুধু ওহ বললো? ফায়াযের মন কি মারাত্মক খারাপ? বোধহয়! নাহলে এত নিষ্প্রভ আচরণ তো করার কথা নয়।

-“তোমার কি মন খারাপ ফায়ায?”

-“জানিনা। তুমি আমায় ভালোবাসো ফাইজা?”

ফাইজা বরাবরের মতো উত্তর দিল না। সে ফায়াযকে ভালোবাসে কিন্তু বলতে চায় না। তার বদ্ধমূল ধারণা পুরুষ মানুষ ভালোবাসি শোনার আগ অবধিই এফোর্ট দেয়, ঐ শব্দটুকু উচ্চারণের পর পুরুষের আবেগ কমে যায় কয়েকগুণ হোক সেটা হাজারগুণ সত্যিকারে ভালোবাসা।

-“ফাইজা, পরে কথা বলি আমরা?”

-“আচ্ছা।”

ফায়াযের কণ্ঠের শীতল অভিমান ঠিকই টের পেল সে। ফাইজার কি বলে দেওয়া উচিত সেও ফায়াযকে মারাত্মক ভালোবাসে?

-“ফায়ায শোনো…”

-“বলো!”

-“ভালোবাসি।”

ফায়াযের বোধহয় হৃদয় থেমে গেল। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারলো না।

-“কী বললে? আবার বলো!”

ফাইজা এবার খানিকটা উৎসাহেই বলে বসলো,

-“ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি…”

তৎক্ষণাৎ তার মা হোসনে আরা দরজা ধাক্কালেন। ভয়ে ফোন হাত থেকে পড়ে গেল ফাইজার। হোসনে আরা ওপাশ থেকে চেঁচাচ্ছেন।

-“কী রে তুই কাকে ভালোবাসি বলিস? দরজা খোল তো! দিনদাহারে দরজা লাগাইছোস ক্যান তুই?”

ফাইজা দ্রুত ফায়াযের কল কেটে নম্বর ডিলিট করে দরজা খুলে দিল। হোসনে আরা সন্দিহান চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

-“কীরে কী করছিলি?”

-“গানের কলি খেলছিলাম।”

-“কার সাথে?”

-“ঐ তো একটা রেডিও স্টেশন থেকে কল আসছিল। বললো আমি নাকি একটা লটারি জিতছি, তার জন্য আমার একটা গান গেয়ে শোনানো লাগবে।”

-“গাধার বাচ্চা বলদ হইছে একটা! বুদ্ধিশুদ্ধি কবে যে হবে! পড়তে বস যা, এইসব ভং ছেড়ে বই ধর।”

ফাইজার মাথায় চাটি মেরে হোসনে আরা বেগম বেরিয়ে গেলেন। ফাইজা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। একটুর জন্য ধরা খায়নি। একবার যদি মা খালি জানতে পারতো, তবে তার আর রক্ষে নেই। পৃথিবীতে হিটলারের পুনর্জন্ম হলে বোধহয় তার মায়ের মধ্য দিয়েই হতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনে ফায়াযের নম্বর ফারিয়া দিয়ে সেভ করলো সে। অতঃপর টেক্সট করে জানান দিল মায়ের উপস্থিতি। ফায়ায খানিকটা হাসলো টেক্সট পড়ে, সেও অবশেষে লুকোচুরি প্রেমে ফারাতে চলেছে। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে তার।

__________________________

-“আমাদের জীবনে সব ঠিক হয়ে যাবে তো শৈশব? নতুন কোনো ঝামেলা আসবে না তো?”

-“না মিত্তি, আমি আর কোনো ঝামেলা আমাদের জীবনে আসতে দিব না। বুঝেছো তুমি? তুমি এত চিন্তা কোরো না রে, সব ঠিক করে দিব আমি। আমি আছি তো! বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”

-“আমি তোমাকে কী পরিমাণ বিশ্বাস করি তা তুমি আন্দাজও করতে পারবে না শৈশব। তোমাকে আমি যথেষ্টের অতিরিক্ত বিশ্বাস করি।”

শৈশব মুচকি হাসলো। পকেটে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে তার। এ মুহূর্তে প্রচণ্ড বিরক্তবোধ হচ্ছে ফোনের ভাইব্রেশনে তবুও সে কলটা রিসিভ করলো। অপরপাশ থেকে কান্নারত একটা কণ্ঠ এসে ভেসে এলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কেবল লোকটা বললো,”আমার মেয়েটা বিষ খেয়েছে। বাবা তুমি দয়া করে একটু আসো।” শৈশব স্পষ্ট শুনতে পারছে না কিছু তবে কণ্ঠটা ঠিক চিনতে পারলো। মুহূর্তেই তার মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে আসলো। মেয়েটা এমন পাগলামি করতে পারে শৈশব ভুলেও ভাবেনি। এতটা পাগলামি! মানুষ হারানোর পর হাজার চেষ্টা করলেও কি হারানো মানুষ ফিরে পায়? পায় না!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে