ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১২

0
66

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১২তম_পর্ব
~মিহি

শৈশব ব্যস্ত থাকবে আন্দাজ করেছিল মিত্তিম কিন্তু ব্যস্ততার মাত্রা তাকে এখন পীড়া দিচ্ছে। সারাদিন ক্লাস, তারপর অ্যাসাইনমেন্ট, ছেলেটার উপর দিয়ে সারাদিন রীতিমতো ঝড় চলে। সেই ঝড় শেষ করে মিত্তিমের সাথে কথা হলে মিত্তিম অনুভব করে শৈশবের ক্লান্ত কণ্ঠের নিষ্ক্রিয়তার মাঝের তীব্র ভালোবাসা। আজ বৃহস্পতিবার। শৈশবের ক্লাস শেষ সাড়ে ছয়টায়। ফিরতে ফিরতে বোধহয় আটটা বাজবে। মিত্তিম অপেক্ষা করে শৈশবের ফেরার। অপেক্ষা? বড্ড যন্ত্রণাদায়ক শব্দ না? কিন্তু মিত্তিমের ভালো লাগে। শৈশবের প্রতীক্ষায় ক্ষণ গুণতে সে প্রশান্তি অনুভব করে। শৈশব যথাসময়ে না ফিরলে মিত্তিমের হৃদস্পন্দন ধীরগতিতে নেমে আসে। সম্ভবত সর্বোচ্চ স্বল্প সময়ে সে শৈশবকে তীব্রভাবে ভালোবেসে ফেলেছে। পরক্ষণেই একটু আধটু ভয় করে তার। ভালোবাসা শব্দটা সুখ অপেক্ষা বিষাদই বেশি তার নিকট। নিলয়ের স্মৃতি খানিকটা পোড়ায় এখনো। প্রথম প্রথম সম্পর্কই কেমন যেন পার্ফেক্ট থাকে। যত সময় গড়ায়, পারফেকশনের মরীচিকায় মোড়ানো কমতিগুলোও প্রকট আকার ধারণ করে। শৈশব কখনো মিত্তিমের প্রতি এমন কোনো আচরণ করেনি যার দরুন মিত্তিমের মনে একটুও ভয় বাসা বাঁধে কিন্তু মিত্তিম চাইলেই সব ভুলে বসতে পারে না। তার প্রতিমুহূর্ত ভয় হয়। মানুষ অবশ্য ভয় পাওয়ারই বস্তু। আর মানুষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য হলো এরা বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়। নিলয়ও তো একসময়ে মিত্তিমের খুব কাছের মানুষ ছিল। মিত্তিমের প্রথম ভালোবাসা! বেপরোয়াভাবে মিত্তিমকে চাইতো ছেলেটা, দিনশেষে সেও বদলেছে, তার অনুভূতিও ফিকে হয়েছে। দ্বিতীয়বার ফের এমন এক সম্পর্কে মিত্তিমের ভয় হওয়া অস্বাভাবিক মোটেও নয় কিন্তু শৈশবের প্রতি মিত্তিমের বিশ্বাস খানিকটা বেশিই। মিত্তিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সাড়ে আটটা বাজে, শৈশব এখনো বাসায় আসেনি? আসলে একবার জানাবে না? মিত্তিম ফোন হাতেই বসে ছিল। আকলিমা বেগম এসে ঝাড়ি দিলেন। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ফোন হাতে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। মিত্তিমের মন খারাপ হলো। এখন কেন যেন অল্পতেই মন খারাপ হয়ে আসে, চোখ বেয়ে জল গড়ায় সহজেই। মিত্তিম আবার দুর্বল হয়ে পড়ছে? বাড়তি চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে ফোন সাইডে রেখে বই নিয়ে বসে মিত্তিম। যদিও পড়ায় তার বিন্দুমাত্র মন নেই, শৈশবের সাথে কথা না হওয়া অবধি একটুও স্বস্তি পাবে না সে।

শৈশব মেসেজ দিলো সোয়া দশটা নাগাদ। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে বাড়িতে ঢুকেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। না গোসল করেছে আর না কিছু খেয়েছে। উঠেই খেয়াল হলো মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। মিত্তিম নিশ্চিত অপেক্ষা করছে। তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিয়ে মিত্তিমকে টেক্সট করলো।

-“মিত্তি, আ’ম স্যরি জান! খুব ক্লান্ত ছিলাম, এসে ফ্রেশ হওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছি। মাত্র উঠলাম। রাগ কোরো না জান প্লিজ!”

মিত্তিম তখন ছিল টিভির ঘরে। ইদানিং দশটা নাগাদ মায়ের পাথে কী এক সিরিয়াল দেখতে বসে। নায়িকাটা মানবতার দেবী সাজে আর নায়ক শালা টক্সিক! এই দুটোকে গালি দিতে দিতেই মিত্তিমের সারাদিনের ফ্রাস্ট্রেশন কেটে যায়। সাড়ে দশটায় নাটক দেখে ডিনার করে ফোনের কাছে আসতে আসতে পৌনে এগারোটা বাজলো। মিত্তিমের মন মারাত্মক খারাপ ছিল। শৈশবের টেক্সটে মন গললো মিত্তিমের। বড্ড মায়া লাগলো। সারাদিন ভার্সিটি থেকে এসে এখন আবার নিজে রান্না করে খাওয়া, বাসার সমস্ত কিছু নিজে গোছানো আবার এসাইনমেন্ট- সব মিলিয়ে শৈশবের উপর বড্ড চাপ হয়ে যায়। স্বভাবতই সে চাইলেই মিত্তিমকে সারাটাদিন সময় দিতে পারবে না। যেদিন ভার্সিটি থাকে না সেদিন দিব্যি সারাদিন মিত্তিমের বকবক শোনে সে বিন্দুমাত্রিক অভিযোগ না করেই। শৈশবকে কল করলো মিত্তিম। শৈশব কল ধরতেই কল কেটে দিয়ে টেক্সটের রিপ্লাই করলো।

-“আমাকে অপেক্ষা করিয়েছেন কতগুলো!”

-“ইশস জান! স্যরি সোনাপাখি।”

মিত্তিম মুচকি হাসে। শৈশবকে দেখে বড্ড কাঠখোট্টা মনে হতো অথচ এই লোকটা যখন এত মিষ্টি করে জান, সোনাপাখি এসব বলে তখন মিত্তিমের রাগ আর কোথায়ই বা থাকে!

-“আচ্ছা জান শোনো, আমার একটু কাজ আছে। আমি শেষ করে নিই। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো তাড়াতাড়ি।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি ঘুমাবেন। টা টা!”

-“টা টা!”

শৈশব অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বসলো। এক সপ্তাহ ধরে জমিয়েছে। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। সবকিছু সামলাতে গিয়ে মারাত্মক হিমশিম খাচ্ছে সে। মিত্তিমকে সময়ই দেওয়া হচ্ছে না এসবের চক্করে। একে তো ইতটা দূরে থাকে তার উপর একটু সময় না দিতে পারার অনুতাপ শৈশবকেও পোড়াচ্ছে ভীষণভাবে।

________________

ফাইজা ঘরের দরজা বন্ধ করে বারান্দায় এসে বসলো। ফায়ায কল করেছে। এ বাড়িতে প্রাইভেসি শব্দ নেই বললেই চলে। কে কোত্থেকে কী যে বলে ওঠে! ফাইজা ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলো। ফায়ায সালাম।দিল তাকে। প্রত্যুত্তর করলো ফাইজা, কণ্ঠ কাঁপছে তার।

-“তুমি কি ভয় পাচ্ছো ফাইজা? সমস্যা হলে কল রেখে দিই?”

-“না না…”

-“তো কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে আমার সাথে?”

-“না আসলে…”

-“ইচ্ছে করছে না?”

-“ধূর!”

ফাইজা বিরক্ত হলো। এই ছেলেটা এমন কথা প্যাঁচাচ্ছে কেন? ইচ্ছে করে বিরক্ত করছে ফাইজাকে।

-“আচ্ছা ফাইজা শোনো, রাগ টাগ করো না বুঝলে? তুমি রাগ করলে তোমার নাক টমেটোর মতো লাল হয়ে যায়। ঐ লাল নাকের উপর তোমার গোলাপি ফ্রেমের চশমা কি বিচ্ছিরি লাগবে ভাবো!”

-“তুমি একটা বজ্জাত! বেয়াদব ছেলে কোথাকার, ইতর, অসভ্য, রামছাগল, বলদ, গরু, ভে…”

-“ফাইজা আই লাভ ইউ!”

ফাইজার কথা গলাতেই আটকে গেল। কী বললো ছেলেটা? ডিড হি প্রপোজ? ফাইজার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বাড়তে লাগলো। হাত কাঁপছে তার, ফোনটা কখন যে হাত থেকে পড়ে যাবে আল্লাহ মালুম।

-“কী হলো? উত্তর তো দাও! কিছুই বলবে না?”

ফাইজা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঠোঁটে হাসি ঝুলছে তার। অবশেষে বলদটা প্রপোজ করেছে। এই সময়টার জন্য যথেষ্ট প্রতীক্ষা করেছে ফাইজা। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে আসছে। ফাইজা মাত্রই কিছু বলতে যাবে এর আগেই তার মা চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই ফাইজু, তোর গ্যাস ভালো হইছে নাকি ওষুধ আনতে দিব?” কথাটা এতটাই চেঁচিয়ে বলেছেন তিনি যে ফাইজাও বুঝলো কথা ফোনের অপর প্রান্ত অবধিও পৌঁছেছে। মারাত্মক অপ্রস্তুত মুহূর্তে পড়ে কল কেটে রাগে গজগজ করতে করতে বাইরে আসলো সে। তার মা ফারহানা মাত্র মুখে পান পুরেছেন। ফাইজা এসে কটমট করে তাকালো।

-“মা! এত চেঁচিয়ে বলা লাগে তোমার?”

-“ক্যান? কী রাজকার্য করতেছিলি?”

-“না মানে অনলাইন ক্লাস করতেছিলাম। স্যার পড়া ধরছিল, এর মধ্যে তুমি এইসব বলে চেঁচায়ে উঠছো! সবাই হাসতেছে আমার উপর।”

-“ও! তাইলে তো বাঁচায়ে দিছি। তুই এমনেও পড়া পারতি না, আরো বেশি হাসতো। তার চেয়ে এই অপমান ভালো আছে নে!”

ফাইজা মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। এই মহিলা রোস্টিংয়ে ক্যারিমিনাতিকেও ছাড়ায়ে যাবে। মুখ গোমড়া করে আফরার ঘরের দিকে এগোলো সে।

_______________________

মিত্তিমের ফোনে প্রায় মাঝরাতে কিছু টেক্সট এসেছে। মিত্তিম সেসব দেখেছে ভোরবেলা। প্যারাগ্রাফের সমান একটা টেক্সট,

-“মিত্তিম, আমার তোমাকে কিছু বলার আছে। বিশ্বাস খুব দুর্লভ বস্তু! আর অপাত্রে তা দান করলে জীবন বরবাদ যেমন আমি করেছিলাম। শৈশবকে খুব ভালো মনে হচ্ছে না এখন? আমারো হতো! তার এই ভালোমানুষির ছল কখনো বুঝিনি আমি। যা চেয়েছে সবটাই দিয়েছে তাকে। সব বলতে কী বুঝিয়েছি তা আশা করে তোমাকে এক্সপ্লেইন করতে হবে না। আমি ভাবিনি দুনিয়ার সব ছেলের মতো শৈশবও এসবের উদ্দেশ্যেই আমার সাথে জড়িয়েছিল। যাই হোক, আমি প্রেগন্যান্ট মিত্তিম! শৈশবকে এখনো জানাইনি কারণ ও আমার কল ধরবে না কখনো। তোমাকে জানাচ্ছি যেন আমার মতো ভুল তুমি না করো। পৃথিবীর সব ছেলের মতো শৈশবও একটা ভালোমানুষির মুখোশ পড়ে আছে মিত্তিম! উদ্দেশ্য হাসিল হলেই তোমাকে রাস্তায় ফেলে দিবে।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে