#ইংলিশ_মিডিয়াম
১১তম_পর্ব
~মিহি
-“তিথি তোর মাথা গেছে? শৈশব খুন করে ফেলবে যদি তুই এমন কিছু করিস!”
-“ও কী করতে পারে সেটাই আমি দেখবো। আমি যা প্ল্যান করছি সেটাতে আমাকে সাহায্য করবি শুধু। বুঝেছিস?”
-“এটা ঠিক না ভাই, আমি রিস্কে পড়ে যাবো। কেউ যদি জানতে পারে…”
-“কেউ জানবে না…তুই শুধু তোর কাজটা কর!”
তিথি হাসলো। কী ভয়ানক ষড়যন্ত্র যে তার মস্তিষ্কে চলছে তা এখনো কেউ আন্দাজটুকুও করতে পারেনি। শৈশব? সে তো মোটেও না! এই ষড়যন্ত্রের মায়াজালে বাঁধা তো তাকেই পড়তে হবে। রাইমার থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে তিথি নিজের বাড়িতে ফিরলো। গোলমালটা শুরু কোত্থেকে করবে তা চিন্তা করতে লাগলো গভীরভাবে। পরক্ষণেই মাথায় আসলো প্ল্যান! শৈশব তাকে বিয়ে কখনোই করবেনা, তাই আঘাতটা শৈশবের দুর্বল জায়গাতেই আনতে হবে।
_____________________
-“ঢাকা ফিরে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়বেন আপনি, তাই না?”
-“একটু তো ব্যস্ত হবোই, জান! ভার্সিটি তিনদিন। আর বাকি চাযদিন পুরোটা সময় আপনার জন্য কিন্তু তুমি মোটেও সারাদিন আমার সাথে কথা বলবা না। পড়াশোনায় মন দাও। এইচএসসিতে অটোপাশ পাইছো, এডমিশনে কোনো অটো নাই। বুঝছো? বুয়েট ইজি না!”
-“ধূর! বুয়েটই লাগবে কে বলছে? যেকোনো একটা ভার্সিটি হলেই হবে আমার।”
-“ঢাকার যেটাতেই পড়ো তুমি, আমার সমস্যা নেই জান কিন্তু তোমার সাথে লং ডিসট্যান্সে থাকার যন্ত্রণা আমার সহ্য হবেনা মিত্তি।”
-“আহারে! নিজে যখন আমাকে না বলে চলে গিয়েছিলেন?”
-“আ’ম স্যরি মিত্তি! ছোট থেকে তোমার কাছে থাকলে আমাদের জীবনটা কত সুন্দর থাকতো। আমাদের জীবনে অন্য কেউ কখনোই আসতো না।”
-“বাদ দিন তো। বাস কয়টায় কাল?”
-“সকালেই।”
-“ওহ তার মানে আজই শেষ দেখা হলো? একটাবার বলেনও নি যে কাল চলে যাবেন!”
-“বললে মন খারাপ করে থাকতা এণ্ড আই কান্ট বিয়ার দ্যাট!”
-“হইছে হইছে! কথায় কথায় ইংলিশ ঝাড়েন কেন? ইংলিশ মিডিয়াম বাঁদর একটা!”
-“এই তুমি আমাকে বাঁদর বললা?”
-“ইশস! ভুল হইছে স্যরি, আপনি তো বাঁদর না সোনা। আপনি মানকি, ইংলিশ মিডিয়াম মানকি একটা!”
মিত্তিম হেসে কুটিকুটি হলো। শৈশব ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সে হাসি শুনে মুগ্ধতার চাদর বুনলো নিজের চারিধারে। শৈশবের নীরবতাই খানিকটা অবাক হলো মিত্তিম।
-“চুপ কেন এত?”
-“তোমাকে শুনতে ভালো লাগছে।”
-“এত ভালো লাগার কারণ?”
-“ভালোবাসি যে! আই লাভ ইউ মিত্তি, আই লাভ ইউ আ লট, মোর দ্যান এনিথিং ইন দিজ ইউনিভার্স!”
-“এণ্ড আই লাভ ইউ ইন এভরি ইউনিভার্স!”
-“ইশসস! তোমার মুখে ইংলিশ শুনতে ভালোই লাগতেছে। আরেকটু বলো তো জান।”
-“বাটারিং করতেছেন জান নাকি টন্ট করতেছেন?”
-“আরে আসলেই সুন্দর লাগতেছে জানপাখি।”
-“ধূরর! এমন একটা ইংলিশ মিডিয়াম ছেলেরে ডেট করতেছি আল্লাহ! সারাজীবনেও ইংলিশ নিয়ে একটু ফ্লেক্স নিতে পারবো না। এই শোপেন, আপনার ইংলিশ শুনলে না আমার নিজের স্কিল নিয়ে ট্রাস্ট ইস্যুজ হয়। আপনি ভুল করে বাংলাদেশে জন্মাইছেন।”
-“ভুল করে আর কোথায়? তোমাকে পাওয়ার ছিল বলেই এ ধরিত্রীতে জন্মানো।”
-“বাপ রে! বাংলাতেও ভারী শব্দ বলেন দেখি, নাইস! আচ্ছা শোনেন আমি ফোন রাখি। দরজা বন্ধ অনেকক্ষণ। আম্মু ডাকবে যেকোনো সময়।”
-“আচ্ছা জান।”
-“আপনার বাস কয়টায়?”
-“সকাল আটটা।”
-“সাথে কে যাবে?”
-“কে আবার যাবে? বাচ্চা নাকি আমি?”
-“ওহ আচ্ছা টাটা!”
-“টাটা!”
মিত্তিম ফোন রেখে মুচকি হাসলো। ছেলেটা বাচ্চা না কে বললো? সব আচার আচরণ তো বাচ্চাদের মতোই। শৈশবের দিকে তাকিয়ে মিত্তিমের মাঝেমাঝেই মনে হয় ছেলেটা কেবল উচ্চতায় বড় হয়েছে এই যাহ! এখনো তেমনই লাজুক আর ইনোসেন্ট রয়ে গেছে। যদিও খুব রাফ এণ্ড টাফ সাজার ট্রাই করে কিন্তু মিত্তিমের সামনে তা পারে না। মিত্তিম ধরে ফেলে এ চতুরতা কিন্তু শৈশবের এই গাম্ভীর্য তার ভালো লাগে। কী সুন্দর কপালে ভাঁজ পড়ে! মিত্তিমের ইচ্ছে করে ভাঁজ পড়া সে কপালে একটু চুমু খেতে। শৈশবকে জড়িয়ে রাখতে নিজের মাঝে। এই ছেলেটা তার জীবনে শান্তি ফিরিয়েছে, তাকে ভালোবাসা শব্দটার ভয় থেকে বের করেছে। আচ্ছা, শৈশব কেন আগে আসলো না তার জীবনে? তাহলেই তো সমস্ত সমস্যা মিটে যেত। শৈশবই থাকতো তার জীবনজুড়ে। মিত্তিমের জীবনটা কত সুন্দর হতো তখন! পাস্ট লাইফ ট্রমা ডিল করতে হতো না তাকে। সবকিছু কত্ত স্বাভাবিক থাকতো। একটা স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন তো সেও দেখেছিল। মিত্তিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখন এসব ভেবে লাভ নেই। শৈশব তার জীবনে আসার সুন্দর মুহূর্তটুকু সুন্দরভাবেই রাখতে চায় সে। এ মুহূর্তে পুরোনো কোনো কথা তুলে নিজের ক্ষত হৃদয়কে ফের দগ্ধ করতে চায় না সে মোটেও।
________________
ঘড়ির কাঁটায় সাতটা দশ। বাসস্ট্যান্ডে হেঁটে গেলেও বড়জোর দশ মিনিট লাগবে। শৈশব সবার থেকে বিদায় নিল। মিত্তিম বোধহয় ঘুম এখনো, সকাল থেকে টেক্সট করেনি। শৈশবও নিজ থেকে কল করলো না এখন। ঘুমোক মেয়েটা, বাসে উঠে বরং কল করবে। এখন কথা বললেই মিত্তিমের মনটা খারাপ হবে। শৈশব চাইলেও তার মন ভালো করতে পারবে না এখন। বাসস্ট্যান্ডের রাস্তা মিত্তিমের বাসার উল্টোদিকে। মেইন রোডে আসতেই চমকালো শৈশব। মিত্তিম দাঁড়িয়ে আছে, বাঁকা চোখে শৈশবের দিকে তাকিয়ে আছে। শৈশবকে দেখতেই এগিয়ে আসলো সে।
-“লুকিয়ে লুকিয়ে চলে যাচ্ছে। চোর একটা!”
-“তোমাকে জানালে তো তুমি মন খারাপ করতা জান, সেজন্যই তো জানাইনি। আমি তোমার মন খারাপ কীভাবে সহ্য করতাম?”
-“লুকিয়ে গেলে বুঝি মন খারাপ কম হতো? আপনি বাটপার! এখনি আমাকে লুকানো শিখছেন, ঢাকায় গিয়ে কী না কী করে বেড়াবেন। ছিঃ!”
-“আহারে জানপাখি আমার। পরেরবার আসলে আমাকে ধরে বেঁধে রেখে বিয়ে করে নিও। তারপর আমি তোমার বর হয়ে যাবো। তখন তো কেউ আমার দিকে নজরও দিতে পারবে না।”
-“ততদিন নজর দিক সবাই সেটা চাচ্ছেন? লুচ্চা কোথাকার! আপনার সাথে আমার কথাই নাই সরেন।”
-“আচ্ছা সোনাপাখি, আসো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। রাগ করেনা কলিজা। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, বুঝছো জান? আমার জীবনে মেয়েমানুষের উপস্থিতি খুব কম। আম্মু, আপু আর তুমি ছাড়া এখন আমার জীবনে অন্য কোনো নারী নেই। আর তোমরাই পার্মানেন্ট, বুঝছো আমার জান?”
-“সরেন সরেন পাম দিয়েন না!”
শৈশব হাসলো। বাসস্ট্যান্ডে আসতে বেশিক্ষণ লাগলো না। শৈশব বাসে ওঠা অবধি মিত্তিম অপেক্ষা করলো। নোট ফটোকপি করার বাহানায় বেরিয়েছিল সে সকাল সকাল। শৈশবকে আরেকবার দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। ঢাকা যাওয়ার পর তো আর চাইলেও দু’চোখ ভরে দেখতে পারবে না তাকে। মিত্তিমের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে আসে। সে কি মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়েছে শৈশবের প্রতি? বোধহয়!
__________
তিথি ফোন হাতে নিয়ে মুচকি হাসছে। ফোনে কিছু মেডিকেল রিপোর্টের ছবি। বস্তুত এসব তিথির প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট যা দিয়ে সে শৈশবকে ফাঁসাতে চেয়েছিল কিন্তু শৈশব যে এসব মানবে না তা তিথির বোঝার বাইরে না। তাই তিথি জানে শৈশবকে আঘাত কোনদিক থেকে করতে হবে। মিত্তিমের নম্বর তিথির ফোনে ইতোমধ্যে সেভড করা। নম্বর যোগাড় করা মোটেও কঠিন ছিল না যদিও তবে এখনকার কাজটা কঠিন। শৈশব এখনো ঢাকা ফেরেনি, আজ ফিরবে। এ তথ্য তিথি জেনেছে। শৈশব এখানে থাকতে মিত্তিমকে কিছু জানানো যাবে না। শৈশব ব্যস একবার ঢাকা পৌঁছাক। তারপর মিত্তিমকে নিয়ে খেলবে তিথি। সশব্দে হেসে ওঠে তিথি। এ নিষ্ঠুর হাসির শব্দ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার তার কানেই ফিরে আসে। তিথির হাসি থামে না, যে ভয়ানক খেলায় সে নেমেছে তাতে শৈশবের জীবনটা বোধহয় বরবাদ হতে বাকি নেই! আদৌ কি সে কখনো একটুও ভালোবেসেছিল শৈশবকে? ভালোবাসলে এভাবে কষ্ট দেওয়া যায়?
চলবে…