ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০৯

0
102

#ইংলিশ_মিডিয়াম
৯ম_পর্ব
~মিহি

-“মিত্তিম, ফায়ায বেশ কয়েকবার কল করেছে। আফরাও আসছে। পাঁচদিন ধরে তুমি ঘর থেকে বের হচ্ছো না। এটা কোনোভাবে স্বাভাবিক আচরণ না! তোমার খালামণির কথা এখন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত তোমার।”

-“আমি একটু একা থাকতে চাই আম্মু। তাছাড়া পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে। এডমিশনে তো খুব বেশি সময়ও নেই।”

-“পড়াশোনার জন্য স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে যাওয়া কোনো সমাধান না। আফরা ডেকেছে, তোমার যাওয়া উচিত।”

মিত্তিমের মা আকলিমা বেগম আর কিছু বললেন না। চুপচাপ স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হলেন। মিত্তিম বুঝলো তার হাতে আর কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু ও বাড়িতে গেলেই শৈশবের মুখোমুখি হতে হবে। পাঁচদিন ধরে শৈশব অজস্রবার তাকে কল আর টেক্সট করেছে। মিত্তিম উত্তর দিতে পারেনি। কোন মুখ নিয়ে উত্তর দিবে সে? তার মায়ের বিশ্বাস নিয়ে খেলার অনুশোচনা প্রতিমুহূর্তে তাকে কুঁড়ে খাচ্ছে। শৈশবকে সে কষ্ট দিতে চায় না অথচ সবচেয়ে বেশি কষ্ট শৈশবকেই দিয়ে ফেলেছে সে। শৈশবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু বলার সাহসটুকু আর সে পাচ্ছে না। মিত্তিম কষ্ট পাচ্ছে বলে শৈশব নিজের সমস্ত অনুভূতি মিত্তিমকে জানিয়েছে অথচ এখন মিত্তিম কোন মুখে শৈশবকে বলবে তার জন্য অপেক্ষা করতে? শৈশব তো চেয়েছিলই অপেক্ষা করতে! মিত্তিমই মানতে পারেনি দূরত্ব। তবে এখন এ অনুতাপ, এ অনুশোচনা, এসবের কী মানে? নিজের সাথে এক ঘোরতর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে মিত্তিম আর সেই দ্বন্দ্বে বারংবার কষ্টের শিকার হচ্ছে শৈশব।

______________

ফায়াযের বাড়িতে ঢুকেই আশেপাশে খেয়াল করলো মিত্তিম। শৈশব কোথায়? চোখে পড়ছে না! ঢাকা ফিরে গেছে ছেলেটা? বোধহয়! মিত্তিম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জেনেবুঝে একটা মানুষকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার অধিকার তার নেই, কোনোক্রমেই নেই! মিত্তিমকে দেখে ফায়ায স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে এলো। চোখেমুখে তীব্র রাগ তবে তা আড়াল করার চেষ্টা করছে সে।

-“কী অবস্থা ম্যাম? ভালো আছেন? আপনার তো এপয়েন্টমেন্টই পাওয়া যায় না!”

-“এমনি ভালো লাগতেছিল না।”

-“তুই কবে থেকে এসব করা শুরু করলি? ভালো লাগতেছে না সেটা তুই আমার সাথে শেয়ার করতি সবসময় অথচ এখন আমার থেকেই সরে গেছিস! তুই আবার প্রেমে পড়িসনি তো? বাই এনি চান্স তুই তোর ঐ বলদ এক্সটার কাছে ব্যাক…”

-“ধূর নাহ! কী সব বলিস? এসব কুফা কথা মুখেও আনবি না!”

-“আচ্ছা তুই এক মিনিট বস। আব্বু আম্মু আপুকে আনতে গেছে। তো মেইন রাস্তায় গাড়িতে সমস্যা হইছে। সাথে অনেক জিনিসপত্র। আমি পাঁচ মিনিটে আসতেছি।”

-“হুহ যা! আমি বসে বসে বাড়ি পাহারা দিই তোর!”

ফায়ায হাসতে হাসতে চলে গেল। মিত্তিম এ বাড়িতে অসংখ্যবার এসে ঘুরেছে, ফিরেছে অথচ আজ বড্ড দম বন্ধ লাগছে। বাড়ির প্রত্যেকটা জিনিস তাকে শৈশবের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। শৈশবের কথা বলা, শৈশবের তাকানো, শৈশবের ছোঁয়া সবকিছু! মিত্তিম হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। শৈশবের ঘরের দরজা লাগানো। মিত্তিমের ইচ্ছে করছে ভেতরে গিয়ে একটু বসে থাকতে। মিত্তিম তা করলো না। শৈশবের অনুপস্থিতিতে তার ঘরে ঢোকা ব্যাড ম্যানারস হবে! শৈশবের ঘরের সামনে থেকে এগোতে নিবে এমন সময় একজোড়া হাত আঁকড়ে ধরলো তাকে। মিত্তিম হকচকিয়ে গেল। হাতজোড়া মিত্তিমকে ধরে ঘরে টেনে নিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেকালো। শৈশব! মিত্তিমকে শেষমেশ শৈশবের মুখোমুখি হতেই হলো! মিত্তিম চোখ ফিরিয়ে নিল। শৈশব মিত্তিমের গালে আলতো করে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে ফেরালো। শৈশবের চোখের দিকে তাকাতেই মিত্তিম কেঁপে উঠলো। অসম্ভব লাল চোখ! রক্তিম সে বর্ণ মিত্তিমের অন্তঃপুরে তাণ্ডব চালালো! মিত্তিমের চোখের সামনে অন্ধকার ছেঁয়ে আসলো। শৈশবের চোখের দিকে তাকিয়ে মিত্তিমের প্রচণ্ড কান্না পেল। নিজের ভালোবাসার মানুষকে ঠিক কতটা কষ্ট দিয়েছে সে তা অনুভব করতে বাকি রইলো না তার। শৈশব জাপটে ধরলো মিত্তিমকে। মিত্তিম নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। চোখ বেয়ে অবিরত অশ্রু গড়াচ্ছে তার। মিত্তিমের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাটুকুও জানা নেই। কী বলবে সে? সবকিছুই তো তার জন্য! নিজেকে সামলে শৈশব মিত্তিমের সামনে দাঁড়ালো। মিত্তিমের গালে দু’হাত রাখলো। মিত্তিম এবার খেয়াল করলো শৈশবের ডানহাতে ব্যান্ডেজ করা। মিত্তিম শৈশবের হাত নিজের মুঠোয় নিলো।

-“হাতে কী হয়েছে আপনার?”

শৈশব কিছু বললো না। মিত্তিম খেয়াল করলো শৈশবের ঘরের দেয়ালের এক অংশে প্লাস্টার ভেঙে নিচে পড়ে আছে। মিত্তিম ঢোক গিললো। শৈশবের ক্ষত হাতটাতে বারংবার চুমু খেতে খেতে শেষমেশ কান্না করে ফেললো মিত্তিম।

-“আ’ম স্যরি! আমি আসলে গাধা, আমি আপনার যোগ্যই না। আমি কারোরই যোগ্য না। আমি শুধু সবাইকে কষ্ট দিই। আমি..আমি….”

-“এক থাপ্পড় দিয়ে সব কয়টা দাঁত ফেলে দিব! চুপচাপ আমার বুকে মাথা রেখে কান্না করো।”

মিত্তিমকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল শৈশব। মিত্তিম নীরবে কাঁদলো কিছুক্ষণ। এই মানুষটা তার আশ্রয় হয়ে উঠছে দিনদিন। শৈশবের বুকে মাথা রাখার পর মিত্তিম অনুভব করছে এই মানুষটা তার কমফোর্ট জোন, এই মানুষটা তার সমস্ত মন খারাপের ওষুধ, তাকে ছেড়ে সে কোনোভাবেই নিজেকে ভালো রাখতে পারবে না। শৈশব মিত্তিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

-“ছাড়ুন, সবাই চলে আসবে।”

-“আসুক!”

-“এভাবে দেখলে কী ভাববে?”

-“ভাববে আমাদের মধ্যে কিছু আছে এবং আমাদের বিয়ে দিয়ে দিবে।”

-“যদি আলাদা হয়ে যেতে বলে?”

-“শুনবো না। বিয়ের পর সারাজীবন আমার থাকা লাগবে, সো সিদ্ধান্তটাও আমারই হবে। বুঝছো জান?”

-“বুঝলাম।”

-“মিত্তি, অনেক ভালোবাসি তোমাকে আমি।”

-“কতটা?”

-“অনেকটা। তোমার একটু কষ্টও আমি সহ্য করতে পারবো না মিত্তি। তোমাকে কখনো হার্ট হতে দেখতে পারবো না আমি। আমি অনেক বেশি ভালোবাসবো তোমাকে, অনেক বেশি!”

-“ছাড়ুন এখন।”

-“উহু! বলো আগে।”

-“কী বলবো?”

-“না বলা অবধি ছাড়বো না।”

-“আমিও আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি শৈশব, অনেকগুলো ভালোবাসি।”

-“এখন বলো কেন মন খারাপ, কেন আমাকে ইগনোর করছো?”

-“বাসায় একটু সমস্যা আর কী! আম্মু আমাকে অনেক বিশ্বাস করে শৈশব। আমি আবার আম্মু আব্বুর বিশ্বাস নিয়ে খেলছি!”

-“তুমি কি কোনোভাবে রিগ্রেট করতেছো আমাদের নিয়ে? তোমার মনে হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ সার্টেইন না?”

-“তেমন না শৈশব, আমার একটু সময় দরকার।”

শৈশব মাথা নেড়ে সায় জানালো। নিজের মনের দহনের একভাগও মিত্তিমকে বুঝতে দিল না। মিত্তিম ঠিকই বলছে। সবকিছুর একটা উপযুক্ত সময় আছে, শৈশবের ভাবা উচিত ছিল আগে। সেও কেমন আবেগে গা ভাসিয়েছে!

_______________

ফায়ায বারবার মিত্তিমের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। শৈশব খেয়াল করেছে। যদিও সে জানে তার ভাইয়ের মনে মিত্তিমের প্রতি কোনো অনুভূতি নেই তবুও তার প্রচণ্ড জ্বলন অনুভব হচ্ছে। অধিকারবোধ দেখাতে ইচ্ছে করছে মিত্তিমের উপর। কোনোরকম নিজেকে সামলালো শৈশব। মিত্তিম এখন এসব চায় না। তার উচিত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। আফরা আসাতে মিত্তিম ভালোই আনন্দে আছে। দুজনের গল্প ফুরাচ্ছে না। আফরা আসার পর থেকেই গল্প জুড়েছে দুজন। আফরার বর ফ্রেশ হয়ে এসে বসে আছে অথচ আফরা এখনো গল্প করেই যাচ্ছে। শেষে মিত্তিমই জোর করে আফরাকে ফ্রেশ হতে পাঠালো। সুযোগ বুঝে ফায়ায মিত্তিমের পাশে এসে বসলো।

-“ঘটনা কী রে?”

-“কিসের ঘটনা?”

-“না মানে ভাইয়ার চাহনি কেমন যেন বদলানো বদলানো লাগতেছে বুঝলি?”

-“তো সেটা আমাকে বলছিস কেন? তোর ভাই ট্যারা হচ্ছে সেটা তারে গিয়ে বল!”

-“আরে বেকুব! আমার মনে হচ্ছে ভাইয়া তোর প্রেমে পড়তেছে। বলছিলাম না ভাইয়ার জিএফ আছে? ঐটার সাথে তো ব্রেকআপ অনেক আগেই হইছে। আই গেস মাই ব্রো ইজ ফলিং ইন লাভ ফর দ্য সেকেন্ড টাইম!”

মিত্তিমের মন ফের খারাপ হলো। দ্বিতীয় ভালোবাসা! দ্বিতীয় ভালোবাসা কি কখনো প্রথম ভালোবাসার মতো হতে পারে? নিলয়কে সে যতটা ভালোবেসেছিল, ততটা কি শৈশবকে ভালোবাসতে পারবে? ছিঃ! মিত্তিম কিভাবে দুজনকে কম্পেয়ার করছে! মিত্তিমের আবার নিজের প্রতি হতাশা জন্মাচ্ছে মনে। সে আসলেই কারো যোগ্য না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে