ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০৬

0
35

#ইংলিশ_মিডিয়াম
ষষ্ঠ_পর্ব
~মিহি

“মিত্তি…” কণ্ঠটা চিনতে অসুবিধে হলো না মিত্তিমের। শৈশবের কণ্ঠ এটা তবে গম্ভীর নয়, খানিকটা ম্লান। গতকাল রাতেও এই নম্বর থেকেই কল এসেছিল, হঠাৎ মায়ের উপস্থিতিতে রিসিভ করতে পারেনি সে। সকালে ফের কল?মিত্তিম ভাবলো তৎক্ষণাৎ কলটা কেটে দিবে কিন্তু শৈশবের কণ্ঠের কাতরতা তাকে যথেষ্ট মায়ায় জড়ালো। কলটা কাটতে পারলো না সে।

-“বলুন।”

-“মিত্তি, তিথির সাথে আমার বর্তমানে কোনো সম্পর্ক নেই! ওকে আমি কেন বিয়ে করতে যাবো?”

-“আপনার যাকে ইচ্ছা হয়, করুন বিয়ে! আমার কী?”

-“তোমার কিছু না?”

-“নাহ!”

-“মিত্তিম, বাচ্চামি কোরো না। আমি তোমার কথাই ভাবছি, সামনে তোমার এডমিশন। এই সময়টা শেষ হোক, তারপর আমি ঐ তিনটা গোল্ডেন ওয়ার্ডস তোমাকে হাজারবার বলবো। প্লিজ অপেক্ষা করো আমার জন্য!”

-“আমি অযাচিত কোনো আশা মনে রেখে কষ্ট পেতে চাই না। ভালো এটাই হবে যে আপনিও আমাকে শীঘ্রই ভুলে নিজের আগের জীবনে ফিরে যান। দুইদিনের একটা মেয়েকে নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি প্রয়োজন?”

-“তুমি এক্ষুণি বাসায় আসো, উই নিড টু টক!”

-“এই যে মি.ইংলিশ মিডিয়াম, আমার আপনার সাথে আর কোনো কথা বাকি নেই! খবরদার আমাকে যদি আর কল দিছেন।”

মিত্তিম খট করে কলটা কেটে দিল। শৈশবকে কিছু বলার সুযোগটাও দিল না। কল কাটার পর মিত্তিম মুচকি হাসলো। শৈশবের প্রতি তার অনুভূতি ইদানিং প্রখর হতে শুরু করেছে। ছেলেটা আস্ত একটা গ্রিন ফ্ল্যাগের বাগান! সুইট, ইনোসেন্ট, হট এণ্ড কিউট জেন্টলম্যান! মিত্তিম নিজের ধ্যানধারণা দেখে নিজেই লজ্জা পেল! কী পরিমাণ বেহায়া হয়ে পড়েছে সে! ইশসস! বড্ড বেহায়াপনা দেখাচ্ছে তার মনটা ইদানিং!

-“এই মিত্তিম! আমি স্কুলে যাচ্ছি, দরজাটা লাগিয়ে দে।”

মিত্তিম বিছানা ছেড়ে উঠে দরজাটা লাগিয়ে দিল। মিত্তিমের বাবা চাকরিসূত্রে ভিন্ন শহরে থাকেন, বাড়িতে মিত্তিম ও তার মা থাকে। মিত্তিমের মাও বিকেল অবধি স্কুলে থাকেন, একটা প্রাইমারি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা তিনি। দরজা বন্ধ করে টিভির সামনে বসতেই কলিং বেল বাজলো। মিত্তিম ভাবলো তার মা কিছু ফেলে গেছে, সেটাই নিতে এসেছে বোধহয়। টিভি অফ করে দরজা খুলতেই চমকালো সে। শৈশব দাঁড়িয়ে সামনে। চোখ কচলে পুনরায় তাকিয়ে একই দৃশ্য দেখে খানিকটা ভড়কালো সে।

-“ভেতরে আসতে বলবে না?”

-“আপনি এখানে কেন আসছেন?”

-“তুমি আসোনি তাই! বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো এভাবে? একটু কথা ছিল!”

মিত্তিম আশেপাশে তাকিয়ে শৈশবকে ভেতরে আসতে বলবো। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে কেউ দেখে নিলে বিপদ হবে, যদিও ওদের বাড়ির কাছাকাছি তেমন কোনো বাড়ি নেই। শৈশবকে হলে বসালো মিত্তিম।

-“বলেন কী বলবেন।”

-“একটু চা-কফি অফার করলেও পারতে!”

-“দরকার আপনার, আসছেন আপনি, চা-কফি খাওয়ানোর বাধ্যবাধকতা আমার নাই। কী বলবেন বলে ফেলুন। আপনার এখানে বেশিক্ষণ থাকা উচিত না।”

-“আমার কাছে এসে বসো। শান্তিমতো কথা বলতে দাও!”

-“আমাকে কোলে বসায়ে কথা বলা লাগবে আপনার? মুখ নাই? মুখ দিয়ে বলেন, শুনতেছি!”

শৈশবের হঠাৎ কী হলো কে জানে! সে সত্যিই মিত্তিমের হাত টেনে ধরে তাকে কোলে বসালো। মিত্তিম ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ঠিকই কিন্তু শৈশবের শক্ত বাঁধনে ঝাপটাঝাপটি করে বিশেষ কোনো লাভ হলো না।

-“আমি কিন্তু চিল্লাবো!”

-“চিল্লাও!”

-“আপনি একটা বদমাশ লোক! আপনার সাহস কিভাবে হয় একটা মেয়ের বাড়িতে ঢুকে জোরজবরদস্তি করার? আমি পুলিশকে কল দিব!”

-“মিত্তি আই লাভ ইউ!”

মিত্তিমের হাত দুর্বল হয়ে আসলো। এতক্ষণ ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও ক্ষণিকের জন্য হাতজোড়া যেন অবশ হয়ে গেল। শৈশব তাকে আই লাভ ইউ বললো? কেন? সে তো অপেক্ষা করতে চেয়েছিল! তবে এখনি কেন বললো? মিত্তিমের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো অশ্রুজলে। চোখ বেয়ে দু ফোঁটা নোনজল জড়ালো। শৈশবের কনিষ্ঠ আঙুল সে অশ্রুজল বেশি দূর গড়াতে দিল না।

-“মিস.আফিয়া রুশতাহানা মিত্তিম, আমি ভালোবাসি তোমাকে। বুঝেছো?”

মিত্তিম যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। শৈশবের কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে ঠিকই কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখানোর নিউরন বোধহয় কাজ করছে না। মিত্তিমের হাত কাঁপছে রীতিমতো। শৈশব মিত্তিমের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল।

-“মিত্তি, ভেবেছিলাম আরো পরে বলবো। আই ওয়াজ রেডি টু ওয়েট কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবো না আমি। আমার তোমাকেই চাই আর সারাজীবনের জন্য চাই। তাই অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করেনি, বলে দিলাম মনের কথা। তুমি উত্তর দিও ভেবেচিন্তে, কোনো তাড়াহুড়োয় ফেলছি না তোমায়।”

মিত্তিম কিছু বলার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। ভয়ে লাফ দিয়ে উঠলো মিত্তিম। এই অসময়ে কে আসলো? কেউ এসে যদি শৈশবকে ভেতরে দেখে তবে তো কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে!

-“উঠুন তাড়াতাড়ি! আপনি আসলে একটা বলদ, এভাবে আমার বাসায় আসছেন হুট করে! এখন বাইরে কে আসলো কে জানে, আপনি তাড়াতাড়ি আমার ঘরে গিয়ে লুকান। আমি দেখি কে আসলো।”

-“লুকাবো মানে?”

-“হাইড এন্ড সিক খেলবো! আরে ভাই, মাইর না খাইতে চাইলে লুকান।”

শৈশবকে ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দরজা লাগালো মিত্তিম। অতঃপর দরজা খুললো বাড়ির। মিত্তিমের খালা আসমা বাইরে দাঁড়িয়ে, সাথে তার মেয়ে অনি। মিত্তিম মনে মনে বলে উঠলো,”পড়ছি আজ মাইনকার চিপায়!” খালার আসার কথা ছিল বিকেলে, তিনি আসছে সকালে। মিত্তিম কী করে বুঝে উঠতে পারলো না। আসমা তাকে খানিকটা সরিয়েই হলের সোফায় এসে বসলো। অনি দৌড় দিল মিত্তিমের ঘরে ঢোকার জন্য। মিত্তিম কোনোরকম তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে টিভির সামনে বসিয়ে দিল। কিন্তু ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। তার খালা যদি কোনোভাবে শৈশবের উপস্থিতি টের পায় তবে এ বাড়িতে আজ ভূমিকম্প, সাইক্লোন, টর্নেডো সব আসবে আর এই সবকিছু যাবে তার উপর দিয়েই। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়? অনি চুপচাপ মিত্তিমের ঘরের দরজা খুলে কখন ভেতরে ঢুকেছে টেরই পায়নি মিত্তিম। যখন খেয়াল হলো ততক্ষণে যথেষ্ট দেরি হয়ে গিয়েছে। অনি মিত্তিমের বিছানায় উঠে খেলছে, আর আসমা মিত্তিমের বইখাতা দেখছে। মিত্তিমের হৃদস্পন্দন ক্রমেই থেমে গেল। শৈশব কোথায় গেল? কোথায় লুকালো ছেলেটা? ঘণ্টা তিনেক মারাত্মক দুশ্চিন্তায় কাটার পর খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ পেল মিত্তিম। আসমা মার্কেটে যাবেন, অনিকে মিত্তিমের কাছে রেখে। আসমা বের হতেই অনিকে টিভি এবং ফোন দিয়ে মিত্তিম ঘরে ঢুকলো। ধীরস্বরে শৈশবকে ডাকলো। খাটের নিচ থেকে উঁকি দিল শৈশব। সারা মুখ ঘেমে একাকার। শৈশব বের হয়ে মিত্তিমের সামনে দাঁড়াতেই মিত্তিম শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বোকা বনে গেল শৈশব। নিজের ওড়না দিয়ে শৈশবের ঘর্মাক্ত মুখ মুছে দিল মিত্তিম। প্রচণ্ড মায়ামাখানো সে চাহনিতে ফের একবার ঘায়েল হলো শৈশব। মিত্তিমের স্নেহে নাকি যত্নে গললো নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না।

-“আপনাকে না দেখে আমি টেনশন করতেছিলাম! আপনি গাধা? আপনি কেন আসতে গেলেন বাসায়?”

-“মিত্তি..জান আমার, আস্তে! তোমার খালাতো বোন বাসায় সোনাপাখি! আস্তে বলো।”

-“আপনি..আপনি একটা গরু, ছাগল, ভেড়া, বলদ…ইংলিশ মিডিয়ামের গাধা একটা!”

-“এতক্ষণ ধরে এই গরমে সিদ্ধ হলাম এসব শোনার জন্য?”

-“আমি ভালোবাসি আপনাকে শৈশব!”

মিত্তিম প্রচণ্ড শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো শৈশবকে। আলতো করে শৈশবের গালে চুমু খেল। শৈশবের মৃদু মুচকি হাসিতে লজ্জা ঘিরে ফেললো তাকে।

-“মিত্তি, যাই এখন? আজ আপুর বৌভাত অথচ এতক্ষণ ধরে আমি এখানে।”

-“হ্যাঁ, আমি অনিকে সামলাচ্ছি। আপনি চুপচাপ চলে যাবেন। আর আশেপাশে তাকাবেন একটু।”

-“ঠিক আছে।”

মিত্তিম শৈশবের সাথে কথা শেষ করে পিছু ফিরতেই শৈশব পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। মিত্তিমের কানে কানে আলতো করে বলে উঠলো,”মিসেস.ফারহায ইফতেখার শৈশব, আই লাভ ইউ আ লট!” মিত্তিম কেঁপে উঠলো। হৃদস্পন্দনের ঊর্ধ্বগতি অনুভব করলো ঠিকই। মুচকি হেসে শৈশবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরে এসে অনিকে পর্যবেক্ষণ করলো। অনিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাবে ঠিক সে মুহূর্তে আবার অশুভ কলিং বেলটা বেজে উঠলো।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে