#ইংলিশ_মিডিয়াম
৫ম_পর্ব
~মিহি
“আমার মনে হচ্ছে আপুর পর ভাইয়াও বিয়ে সেরেই ফেলবে। কাল দেখলাম তিথি আপুকে ভাইয়ার রুমে।” ফায়ায ফোন চালাতে চালাতে মিত্তিমকে কথাগুলো বলছে। মিত্তিমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো তৎক্ষণাৎ। ফায়ায খেয়াল করার আগেই চোখ মুছে ঘুরে দাঁড়ালো মিত্তিম। হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা আছে না, আমরা সবসময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি? মিত্তিমও বেসেছে। অবশ্য এটা ভালোবাসা? গুণে গুণে কয়টা দিনই বা সে শৈশবের সাথে একটু ভালো থেকেছে? দু’দিনে কি ভালোবাসা হয়? একটু আধটু ভালোবেসেছিল তো ছোটবেলায়। তখন সে অনুভূতি ছিল বেনামী। শৈশবের সংস্পর্শে থাকতে ভালো লাগতো তার। শৈশব যে সেসব মনে রেখেছে এটা জেনেই বোধহয় মিত্তিম দুর্বল হয়েছে তার প্রতি। এটা ভালোবাসা নয়, কোনোক্রমেই এটা ভালোবাসা নয়।
-“কী রে তুই এমন মুখ গোমড়া করে আছিস যে? আপুর বিয়ের দিনও তুই এমন করে বসে আছিস কেন? তোর কী হইছে বল তো। ওয়েট, তুই আবার তোর ঐ বলদ এক্সটারে নক দিছিস নাকি?”
-“না, ওর চিন্তা আমি বাদ দিছি। ও আমারে চিট করছে না কী করছে আমার আর জানার শখ নাই। রেড ফ্ল্যাগ কোলে নিয়ে ঘোরার শখ নাই আমার।”
-“হুহ! আবার উনি নক দিলেই গলে যাস না যেন।”
-“তোর মনে হয় যে আমি ওর এত টক্সিসিটির পর আবার গলে যাবো?”
-“এক বছর হয়ে গেছে তোর ব্রেকআপের। তুই নিজেকে ভালো রাখার ট্রাই করছিস একটুও? প্রেম করার টাইমে তো এই বন্ধুরেও মনে ছিল না। প্রেমে অন্ধ হইছিলি!”
মিত্তিম ফায়াযের পাশ থেকে সরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফায়াযের কথার আঘাত ঠিক কতটা ক্ষত করেছে তাকে তা বোঝানোর সামর্থ্যও তার নেই। ছেলেটা বাচ্চা স্বভাবের ঠিক আছে কিন্তু কিছু কথা তো বুঝেশুনে বলতেই পারে। মিত্তিমেরও তো খারাপ লাগে, সবসময় হাসি মুখে মেনে নেয় মানে তো এই না যে তার কোনোকিছুতেই খারাপ লাগে না। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলো মিত্তিম। ছাদ ছাড়া পুরো বাড়িই লোকে লোকারণ্য। নিরিবিলি বলতে এটুকুই আছে স্রেফ। মিত্তিমেরও প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। একে তো শৈশবের ঘটনা, তার উপর ফায়াযের কথাগুলো। নিজেকে প্রচণ্ড ভঙ্গুর একটা সত্তা মনে হচ্ছে মিত্তিমের। নিজেকে সামলানো বোধহয় ভুলেই গেছে সে। ছাদে পা রাখতেই একজোড়া হাত আঁকড়ে ধরলো তাকে। শৈশব? স্পর্শটা বড্ড বেশি চিনে ফেলেছে কি মিত্তিম? এই অল্প সময়ের ব্যবধানে চিনলো সে এই স্পর্শ নাকি ছোটবেলার অনুভূতিগুলো এখনো প্রখর? মিত্তিম শৈশবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। শৈশব কেন তাকে আঁকড়ে ধরছে বারবার? ঐ একটা চুমুর খাতিরে? ঐ একটা স্পর্শের অনুতাপে? আজ সাফ সাফ বলে দিবে মিত্তিম। ঐটা শুধুই একটা ঘটনা কেবল, ভুলক্রমে ঘটিত ঘটনা। তার দায় শৈশবকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে না। কথাগুলো ভাবতেই মিত্তিমের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে আসে, সব শুন্য মনে হচ্ছে তার। পায়ের নিচ থেকে জমিনটাও যেন সরে যাচ্ছে। ভালোবাসা? আদতেই কি এটা ভালোবাসা নাকি অন্য কোনো অনুভূতি?
_______________________________________________________
-“মিত্তিম? তুই ওয়াশরুমে?”
মিত্তিম চোখ মুখে পানি দিল। মেকআপ করেনি ভাগ্যিস! ছাদ থেকে এসে ফায়াযের রুমটা ফাঁকা ছিল, অন্যথায় ফায়ায হাজারটা প্রশ্ন করতো তার চোখে পানি দেখে। ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলো মিত্তিম। মিত্তিমের মুখটা দেখে ফায়ায আন্দাজ করতে পারলো নিশ্চিত কিছু হয়েছে। মিত্তিমকে এখন কিছু জিজ্ঞাসা করলো না সে। হুটহাট কান্না করে ফেলতে পারে মেয়েটা।
-“মিত্তিম, চল আপু ডাকছে তোকে। তোর শরীর খারাপ লাগছে? আপু চলে যাচ্ছে। দেখা করে নে, তোকে আমি রেখে আসছি।”
-“ঠিক আছে। তোর রেখে আসতে হবে না, সবে তো বিকাল। আমি যেতে পারবো।”
ফায়াযকে কিছু বলার সুযোগ দিল না মিত্তিম। কবুল বলার সময়টুকু বাদে মিত্তিমের দেখা পায়নি আফরা। শ্বশুরবাড়ির ননদ, খালা শাশুড়ি, চাচি শাশুড়ি সবাই তাকে ঘিরে রেখেছিল। একটু যে খোঁজ নিবে সে সুযোগটাও পায়নি। বিদায়টাও তাড়াতাড়ি হচ্ছে। আফরা মিত্তিমের সাথে দেখা না করে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। মিত্তিমকে দেখেই মন কেমন করে উঠলো আফরার। এই মেয়েটাকে সে ছোটবোনের মতো স্নেহ করেছে, বড্ড মায়া মেয়েটার চোখে। মিত্তিমকে জড়িয়ে ধরতেই চোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু ঝরতে লাগলো আফরার। মিত্তিম আফরাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেও খানিকটা কান্নাই করে বসলো। আফরাকে ছেড়ে দাঁড়াতেই চোখ পড়লো অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শৈশবের দিকে। শৈশবের চোখ মারাত্মক লাল। ছেলেটা কান্না করেছে? ওহ হ্যাঁ! বোনের বিদায় বলে কথা, একটু তো কান্না করাই স্বাভাবিক।
আফরার বিদায়ের পরপরই বাসায় ফিরেছে মিত্তিম। ফায়ায আসতে চেয়েছিল কিন্তু মিত্তিম জোর করেছে না আসার জন্য। ফায়ায জোর করতে পারেনি বিপরীতে। মিত্তিমের মন খারাপ বিষয়টা সেও বুঝেছে, এখন জোর করলে মেয়েটা কিছু বলবে না। উল্টো হিতে বিপরীত হবে। বাধ্য হয়েই মিত্তিমকে একাই যেতে দিল সে। মিত্তিম বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ করলেই শৈশবের মুখটা বারবার ভেসে উঠছে, ঐ রক্তিম দৃষ্টি! নিজের উপর বিরক্ত হয় মিত্তিম। শৈশবকে ঠিকঠাক চেনেও না সে, আগের শৈশব আর এখনকার শৈশবের মধ্যে তফাত কতটুকু তাও তো সে জানেনা। ফোনটা হাতে নিল মিত্তিম। ফেসবুকে ঢুকতেই শৈশবের আইডিটা আসলো পিপল ইউ মে নো’তে। মিত্তিম আইডিতে ঢুকলো। ছবিগুলো দেখলো এক এক করে। শৈশবের আগের চেহারা আর এখনকার চেহারার মাঝে মিল খোঁজার চেষ্টা করলো, মিল পেল না। স্বভাবে মিল আছে কি? হয়তো! চোখটা তো এখনো আগের মতোই মায়াকাড়া! এ চোখের মায়ায় সে পড়েছিল ছোটতেই, এখনো ফের সে চোখের মায়াতেই পড়েছে। শৈশবের ছবি দেখতে দেখতে মন খারাপ কমলো খানিকটা। ফায়াযের বলা বাক্যগুলো মাথায় ঘুরলো না আর। তিথির প্রতি শৈশবের ভালোবাসা এখনো আছে? থাকলে সে মিত্তিমকে কেন কাছে টানতো? প্রশ্নে নিজেকে জর্জরিত করলো সে। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেললো অকস্মাৎ! ফেইক আইডি থেকে শৈশবের আইডিতে রিকোয়েস্ট দিল। আজ তো ব্যস্ত ছেলেটা, নির্ঘাত ফেসবুকে ঢুকবে না। মিত্তিম শৈশবের ছবিগুলোই দেখতে লাগলো বারেবারে। শৈশবের চোখটা! অপরিবর্তনশীল চোখ! এখনো বড্ড মায়া চোখটাতে। মিত্তিম চোখ বন্ধ করলো। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো আবছা আবছা সামনে আসলো তার। শৈশবকে সে জড়িয়ে ধরতো পেছন থেকে, হুটহাট, অকস্মাৎ সে জড়িয়ে ধরা! শৈশব মুচকি হাসতো মাঝে মাঝে, কখনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। মিত্তিম শৈশবের গালে চুমু খাওয়ার পর সে কেবল হা করেছিল একটু। ঐ প্রতিক্রিয়া মনে করতেই মিত্তিমের হাসি পেল। তখন বুঝ থাকলে নিশ্চিত বলতো মুখ বন্ধ করতে অন্যথায় আস্ত একটা হাতি ঢুকে যাবে ঐ মুখে। ছোটবেলা! বড্ড রঙিনই ঠিল ছোটবেলা! তারপর শৈশব চলে গেল, ফায়াযের সাথে বন্ধুত্ব ভালোই চললো। শৈশবকে একটু আধটু মনে করা চলতোই কিন্তু ছেলেটার সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎ আর হলো না। ঠিক সেসময় জীবনে একটা আস্ত আগুন পেল যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়লো স্বেচ্ছায়। আগুনের নাম নিলয়। এই আগুন তার এক জীবনের অর্ধেকাংশ ইতোমধ্যে বিষাক্ত করে ফেলেছে। মারাত্মক রকমের একটা আঘাত মিত্তিম পেল, তবুও অনুভূতিগুলো বড্ড বেহায়া ছিল নিলয়ের বেলায় কিন্তু ধৈর্য আর কতদিনই বা টিকতো? নিলয়ের আঘাত তাকে বাধ্য করলো জীবনে এগোতে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিত্তিম। শৈশবের মনে কি তার জন্য একটুও ভালোবাসা আছে? বোধহয় না! যা করছে সেসব শুধুই অনুশোচনা থেকে হয়তো। মিত্তিম হয়তো ভালোবেসেছিল তাকে সেই ছোট্টবেলায় কিন্তু শৈশব তো বাসেনি। সে বরাবরই নিষ্ক্রিয় ছিল মিত্তিমের অনুভূতিগুলোর বিপরীতে। হাতে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। মিত্তিম স্ক্রিনের দিকে খেয়াল করলো, আননোন নম্বর? আননোন নম্বর থেকে তাকে কে কল করছে এখন?
চলবে…