#ইংলিশ_মিডিয়াম
৪র্থ_পর্ব
~মিহি
মিত্তিম ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। গা গুলাচ্ছে তার। মাথা ঘোরানো খানিকটা কমেছে ঠিকই কিন্তু শৈশবকে চুমু খাওয়ার ভয়ানক স্মৃতিটা তাকে নিজের দৃষ্টিতেই হেয় করে ফেলেছে। পারলে সে এখন নিজের ঠোঁট কেটে রক্তাক্ত করে ফেলতো। বাড়িভর্তি মানুষ, একটু শান্তিতে চোখের জল ফেলার সুযোগটুকুও নেই। কেন এসেছিল সে এখানে? শৈশবের প্রেমিকার নোংরা কথাগুলো শুনতে? তার আত্মসম্মানবোধ কি মরে গেছে ইদানিং? মিত্তিম তাকালো নিচের দিকে। মাথাটা ঘুরছে ফের, তাল সামলাতে পারলো না আর সে কোনোভাবেই।
রেলিং ঘেঁষে সামনের দিকে আগাতে ধরেছে সবে, তৎক্ষণাৎ একজোড়া বাহু তার হাত আঁকড়ে ধরলো। মিত্তিম নিজেকে সামলাতে পারলো না। হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো ছাদের মেঝেতে। ফায়ায কোনোরকম মিত্তিমকে ধরে একপাশে সিমেন্টের আসনে বসালো। মিত্তিমের তখনো পৃথিবীটা ঘুরছে, সব অন্ধকার দেখছে সে। ফায়ায দু’বাহু ধরে ঝাঁকাচ্ছে তার।
-“মিত্তিম! কী হয়েছে তোর? চোখ খোলা রাখ, কথা বল আমার সাথে।”
ফায়ায কথা বলা অব্যাহত রেখেছে। খানিক বাদে মিত্তিম একটু স্থির হলো। মাথা ঘোরানো কমলো। ফায়াযকে হাত সরিয়ে নিতে ইশারা করে ধাতস্থ হয়ে বসলো সে। ফায়াযও খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো তখন।
-“তোর কি মাথা গেছে? তুই কত বড় বেআক্কেল রে? তোর মাথা ঘুরতেছে আর তুই ছাদে এসে দাঁড়ায়ে আছিস? গাধা কোথাকার! তুই এক্ষুনি নিচে চল, আমি বাসায় রেখে আসবো তোকে। তোর রেস্ট দরকার। এই হইচইয়ের মধ্যে তোর থাকার দরকার নাই।”
-“হুহ চল!”
মিত্তিমও মনে মনে চাইছিল এখান থেকে চলে যেতে। মন টিকছে না তার এখানে কোনোভাবেই। ফায়ায ধরে নামাতে চাইলো, মিত্তিম নিষেধ করলো। এখন স্বাভাবিক সে। সিঁড়ি বেয়ে নামলো ধীরে ধীরে। ফায়ায পেছন পেছন নামলো। নিচে আসতেই ফের হইচইয়ের মাঝে পড়লো মিত্তিম। ফায়াযের ডাক পড়লো। বিরক্তির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো সে। তৎক্ষণাৎ শৈশব এসে দাঁড়ালো ফায়াযের পাশেই।
-“কী রে? ডাকতেছে তো তোকে!”
-“ভাই, আমি একটু মিত্তিমকে রাখতে যাবো। ও অসুস্থ, তুমি একটু দেখো তো।”
-“আমি বাইরে যাচ্ছি কাজে, আমি রেখে আসতেছি। তুই শোন কেন ডাকতেছে!”
ফায়ায মিত্তিমের দিকে তাকালো। মিত্তিম কিছু বলছে না। শৈশবকে না করার মতো কোনো কারণও ছিল না ফায়াযের তাই সেও রাজি হলো। মাঝখান থেকে মিত্তিম পড়লো মুসিবতে। যার থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছে, তার নাগালেই এসে পড়েছে সে। কী অদ্ভুত এ অদৃষ্টের পরিহাস! মিত্তিম দ্রুত পায়ে আগে আগে বের হলো। সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব। রাস্তা সচরাচর ফাঁকাই থাকে। দুর্বল শরীরে বেশি জোরে হাঁটতেও পারলো না মিত্তিম। শৈশব দ্রুতই তার পাশাপাশি আসলো। মিত্তিমের হাত আঁকড়ে ধরলো। পরমুহূর্তটুকু কল্পনাতীত! শৈশব খানিকটা জোর করেই মিত্তিমকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মিত্তিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিক মিত্তিমের হাত পা অসাড় হয়ে আসলো। অল্পক্ষণ পরেই মিত্তিমকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে নিজের সামনে দাঁড় করালো শৈশব।
-“একটু স্থির হও মিত্তি, আমার কথাটুকু শোনো। তিথি আমার প্রেমিকা না, ও আমার প্রাক্তন। আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম এটা সত্যি কিন্তু ও আমাকে ছেড়েছে! ও নিজে থেকে আমার কাছে এসেছিল, নিজে থেকেই সরে গেছে। আমি ভালোবেসেছিলাম এটাই আমার ভুল। তুমি যখন আমার জীবনে এসেছো, তখন আমি পুরনো সবকিছু ভুলতে চেয়েছি মিত্তি!”
-“আপনার কোনো ভুল নেই, আমি পাগলামি করে ফেলেছি। প্লিজ আপনি বাদ দিন এসব। আপনার জীবনে অযথা সমস্যা বাড়াতে চাইনা আমি।”
মিত্তিম পিছু ফিরে তাকালো না। দ্রুত পায়ে এগোলো। শৈশব পিছু পিছু আসলো। মিত্তিমের বাড়ির দরজা অবধি এলো। আশ্বস্ত হলো যে মেয়েটা ঠিকঠাক পৌঁছেছে, অতঃপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অবশ্য এটাই প্রথম আসা নয়, গতদিনও লুকিয়ে মিত্তিমের পিছু করেছে সে। মেয়েটা একাকী বেরিয়ে যাবে ধারণা ছিল না তার সেজন্য আড়াল থেকেই আগলে রেখেছে পথটুকু।
শৈশব ধীর পায়ে হাঁটছে ফাঁকা রাস্তায়। কী অদ্ভুত সবকিছু! মাত্র সে মিত্তিমের প্রতি নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে শুরু করেছিল অথচ কিছু শুরু হওয়ার পূর্বেই সব শেষ হয়ে গেল। একটা দিনের ব্যবধানে সব ধুলিসাৎ হওয়ার উপক্রম। এতটা ভালো ভাগ্য কেন তার? একটু খুশিও কেন তার জীবনে স্থায়ী হয়না? নিয়তির কি ভালো লাগে তার ফাথে খেলতে? শৈশবের সমস্ত রাগ তিথির উপর বর্তাচ্ছে। মেয়েটার প্রতি তার ভালোবাসা একরকম পাগলামি ধরনের ছিল অথচ প্রচণ্ড অসহায় মুহূর্তে মেয়েটা তাকে ছেড়ে দিল। এখন তবে ফেরার অহেতুক প্রচেষ্টা চালানোর অর্থ কী? এক বোকামি আর কতবারই বা করবে শৈশব?
____________________
মিত্তিমের ঘুম হলো না রাতে। অনুতাপ ঘিরে ধরলো ক্রমশ। শরীরের অসুখ সারলো ঠিকই কিন্তু মনের সাথে চলতে থাকা ভয়াবহ যুদ্ধটা তাকে কী ভীষণ ক্ষত করছে তা দেখার সাধ্য তো কারো নেই। বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার দুঃসাহসটুকু দেখাবে সে। শৈশবকে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। একটা চুমু খাওয়া নিয়েই বোধহয় শৈশবেরও অনুতাপ কিন্তু এই কারণে শৈশবকে সমস্যায় ফেলবে না সে। তিথি মেয়েটার মতো না সে সুন্দরী, না তার মধ্যে কোনো গুণ আছে, সে কাউকে ডিসার্ভ করে না নিজের জীবনে। ভয়ানক অতীত তো মিত্তিমের জীবনেও কম নয়। ছোটবেলায় এক ভাইয়ের অকস্মাৎ ছুঁয়ে ফেলার মানসিক যন্ত্রণা! ছয় বছর বয়সের ঐ লালসার শিকার হওয়ার স্মৃতিটুকু বড্ড সময় কুঁড়ে খেয়েছে তাকে তিক্ত বিষাদে। অতঃপর এক প্রেমের বসন্ত এসেছিল জীবনে। মাত্রাতিরিক্ত ভালোবেসে ফেলেছিল মিত্তিম তাকে সেজন্যই বোধহয় ছেলেটা হারিয়ে গেল। ফায়ায নিষেধ করার পরেও গাধার মতো ঐ ছেলেটার কাছে অনুনয় করেছে সে। এই যন্ত্রণা ভুলে শৈশবের মুখোমুখি হলো বছর খানেক বাদে। পুরনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিল। শৈশবের কাছে আসা প্রচণ্ড দুর্বল করে ফেললো তাকে। মিত্তিমের নিজেকে মারতে ইচ্ছে করছে। এত দুর্বল কেন হয়ে উঠলো সে? যেখানে একবার এই ভালোবাসা তার অর্ধেক জীবন শেষ করতে বসেছিল, ফের সেই মায়ায় জড়ানোর প্রত্যাশা কী করে রাখতে পারলো সে? মাথাটা চিনচিন করছে যন্ত্রণায়। চোখ বন্ধ করলো সে। নিদ্রারা বোধহয় প্রতীক্ষায় ছিল। চোখ বন্ধ করামাত্র মিত্তিমের চোখে এসে বসলো।
___________
তিথি বেশ কিছুক্ষণ ধরে শৈশবের ঘরের আশপাশটা খেয়াল করলো। এখন মাঝরাত। শৈশবের সাথে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলার উপযুক্ত সময়। কারো দেখার সুযোগ নেই, বিয়েবাড়ি নিয়ে উদগ্রীব সবাই আর যদি দেখেও ফেলে তবে তা তিথির জন্যই ভালো। একসাথে একজোড়া ছেলে মেয়েকে এক ঘরে দেখলে পরবর্তী ঘটনা কী ঘটবে তা তো জানার অপেক্ষা রাখে না। তিথি তো সেটাই চায়, শৈশবকে বোঝাতে হবে এখন। ছোট ছিল, ভুল করে ফেলেছে একটা। এখন যথেষ্ট ম্যাচিউর দুজন, এখন অন্তত ভুলটা শুধরে নিয়ে আবার এক হয়ে যাওয়া উচিত তাদের। শৈশব যে তিথিকে কতটা পাগলের মতো ভালোবাসে তা তো তিথির অজানা নয়। শৈশবের দরজায় নক করলো তিথি বেশ কয়েকবার। শৈশব ভেতর থেকে জিজ্ঞাসা করলো কে কিন্তু তিথি উত্তর করলো না। দরজায় নক করতেই থাকলো। ফায়ায দুষ্টুমি করছে ভেবে শৈশব দরজা খুললো। দরজা খোলামাত্র তিথি চটজলদি ভেতরে ঢুকলো। শৈশব সেদিকে খেয়ালটুকুও করলো না। তিথি ঘরে ঢুকেছে দেখামাত্র সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তিথির একটা কথাও শুনলো না, এভনকি তাকে কিছু বলার সুযোগটাও দিল না। শৈশব জানে তিথির উদ্দেশ্য। কম বোকামি তো করেনি এই মেয়ের চক্করে। এখন উচিত শিক্ষা হয়েছে তার। আদতেও কি সে চিনেছে তিথিকে? তিথির ষড়যন্ত্রের একটুও বুঝতে পেরেছে? তিথি কী করবে তার ধারণাটুকুও যে সে রাখেনি। বোধহয় এটাই তার জন্য কাল হবে শীঘ্রই।
চলবে…