#ইংলিশ_মিডিয়াম
৩য়_পর্ব
~মিহি
শৈশবের জীবনে আরেকটা মেয়ে আছে! শুধু মেয়েই না, প্রেমিকা! মিত্তিমের শরীর ঘামতে লাগলো। প্রেমের জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে বোধহয়। শৈশবকে নিয়ে সবে একটু স্বপ্ন ঘিরেছিল তার মনে, আদতে তা দুঃস্বপ্নই রইলো। নিজের পছন্দের মানুষের জীবনে অন্য নারীর উপস্থিতি এবং সেই নারীরই রাজত্বের গল্প শুনতে কেমন লাগে? নিশ্চয়ই খুব খারাপ? মিত্তিমের প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। অযাচিত একটা আশা সে বাঁধতে গিয়েছিল। শৈশবের ঠোঁট অবধি স্পর্শ করেছে সে! ছিঃ, নিজেকে ধিক্কার দিল মিত্তিম।
ফায়াযের জোরাজুরিতে মন গললো না মিত্তিমের, শরীরটাও সায় দিচ্ছে না। আজ মেহেন্দীর অনুষ্ঠান, মিত্তিমের মোটেও ইচ্ছে করছে না ফের শৈশবের মুখোমুখি হতে। ফায়াযকে যা তা বুঝিয়ে দূর করলো সে, পারলো না আফরা আপুকে। বিকেল গড়ানোর আগে শরীরটা সারলো তার, আফরাও পেয়ে বসলো তাকে। সোজা বাড়িতে এসে জোরজবরদস্তি করেই তুলে নিয়ে গেল ও বাড়ি। মিত্তিমের পড়নে সাধারণ একটা কুর্তি, বিয়েবাড়ির জাঁকজমকে নিজেকে বড্ড ফিকে লাগছে তার। আগে কিছু মনে হতো না তবে ইদানিং নিজেকে বড্ড পর মনে হচ্ছে মিত্তিমের। শৈশবের সামনে না পড়ার সর্বোচ্চ প্রয়াস করলো মিত্তিম কিন্তু কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়? মিত্তিম অনুষ্ঠান থেকে সরে থাকার জন্য মাথা ঘোরার বাহানা করছিল কিন্তু আফরা তাকে বিশ্রামের জন্য শৈশবের ঘরেই পাঠালো। ঐ একটা ঘরই একমাত্র খালি এখন, শৈশব অনুষ্ঠানে ব্যস্ত আর কী। যদিও মেহেন্দীর অনুষ্ঠানে পুরুষদের আনাগোনা একটু কমই।
শৈশবের বিছানায় বসতেও দ্বিধা হচ্ছে মিত্তিমের। কোনোরকম বিছানায় বসে দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো সে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। গাধার মতো একটা কাজ করে বসেছে সে। চোখ ছলছল করছে মিত্তিমের। আচমকা কারো পায়ের শব্দে চমকে উঠলো সে। ঝাপসা চোখে সামনে তাকাতেই খেয়াল করলো একটা মেয়ে, ভয়াবহ সুন্দরী মেয়েটা। মিত্তিমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে এই মেয়েটা শৈশবের প্রেমিকা। মিত্তিম বোকার মতো তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। মেয়েটা এগিয়ে এসে খানিকটা দূরত্বে রাখা শৈশবের স্টাডি টেবিলের কমফোর্ট চেয়ারটাতে বসলো। মিত্তিম চেয়ে চেয়ে দেখছে কেবল। চুলে হাত নাড়তে নাড়তে মেয়েটা ফের মিত্তিমের দিকে তাকালো।
-“তুমি এ ঘরে কী করছো? কে তুমি? আফরা আপুর সাথে দেখলাম একবার, এখন শৈশবের ঘরে। শৈশবকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছো বুঝি?”
মিত্তিম কিছু বলতে পারলো না। মেয়েটার কথার সুর বড্ড অপমানজনক ঠেকছে তার কাছে। অন্য সময় হলে মিত্তিম দশটা কথা শুনিয়ে দিত কিন্তু নিজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মেছে তার এখন। তাছাড়া মেয়েটা শৈশবের প্রেমিকা, তাকে কিছু বলার অধিকার মিত্তিমের নেই। বরং মিত্তিমের উচিত ক্ষমা চাওয়া। অনুমতিবিহীন মিত্তিম তার প্রেমিকের ওষ্ঠ দখলের দুঃসাহস দেখিয়েছে। মিত্তিমের নিশ্চুপ থাকা মেয়েটাকে আরো রাগান্বিত করলো।
-“এই মেয়ে? তিথি শিকদারের কথা ইগনোর করে বসে আছো? তোমার এত সাহস? শৈশবের ঘরে কেন ঢুকেছো? উদ্দেশ্য কী তোমার? তাও আবার এমন অবলা সেজে ঢুকেছো! লোক ডেকে বিয়ে করিয়ে নিতে চাও নাকি ফাঁসিয়ে? চেহারা দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে কোন জায়গার মেয়ে তুমি!”
‘কোন জায়গার মেয়ে’ কথাটার ইঙ্গিত মিত্তিম বোঝেনি। কিন্তু পরক্ষণেই সজোরে শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালো সে। কাচের একটা পানিভর্তি বোতল ভেঙে চুরমার হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শৈশব দরজায় দাঁড়িয়ে। বোতলটা প্রচণ্ড জোরে আছাড় মারা হয়েছে মেঝেতে। কাজটা যে শৈশবকে তা বুঝতে বাকি নেই মিত্তিমের কিন্তু শৈশব এমন কেন করলো? সে এ ঘরে এসেছে বলে নাকি শৈশবের বিছানায় বসার অপরাধে? শৈশব এগিয়ে এসে তিথির মুখোমুখি দাঁড়ালো।
-“কার পারমিশন নিয়ে তুমি এই চেয়ারে বসছো? আমার ঘরে ঢোকার সাহস তোমায় কে দিছে?”
মিত্তিম ভ্রু কুঁচকালো। কথাগুলো শৈশব তিথিকে বলছে? নাকি তাকে পরোক্ষভাবে অপমানের চেষ্টা করছে প্রেমিকার সামনে? তিথি অবশ্য উঠে দাঁড়ালো। “তুমি তো আবার মেয়েঝাতির আরাধ্য পুরুষ! তোমাকে দেখামাত্র মেয়েরা শুয়ে পড়ে। থাকো নিয়ে!” তিথি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মিত্তিমের এতক্ষণ মাথা ব্যথা না করলেও এখন প্রচণ্ড মাথা ধরলো। কান্না কোনোরকম গিলে সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। শৈশব মিত্তিমকে তৎক্ষণাৎ ধরলো। মিত্তিম সরে দাঁড়ালো খানিকটা।
-“খবরদার আমার গায়ে হাত দিবেন না আপনি! আমায় ক্ষমা করুন, আমি প্রচণ্ড গাধা তাই আপনাকে ছোটবেলার মানুষটা ভেবে ভুল করে ফেলেছি।”
-“মিত্তি প্লিজ, ভুল বুঝো না আমাকে।”
-“আপনাকে আমি ভুল কিংবা ঠিক কিছুই বুঝতে চাই না, আপনি সামনে থেকে সরেন। আপনার প্রেমিকা রাগ করেছে, তাকে মানান গিয়ে!”
মিত্তিম নিজেকে সামলে শৈশবের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শৈশব পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো নীরবে। মিত্তিমের কথা বোঝার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছে সে।
________________
ফায়ায মিত্তিমকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মেয়েটা আসার পর বলেওনি তাকে। কী যে হয়েছে তাও বলছে না। আচমকা ফাইজা এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো তার। হঠাৎ ফাইজার উপস্থিতিতে খানিকটা ভড়কালো ফায়ায।
-“কী অবস্থা ভাইয়া? ভালো আছো?”
-“আছি, এত ঢঙ করে ভাইয়া ডাকা লাগবে না নাও।”
-“আমাদের নামের কত্ত মিল দেখছো? একদম ভাই-বোনের মতো!”
-“ফাইজা মজা কোরো না, মজা শোনার মুডে আমি নাই!”
ফায়ায বিরক্ত হয়ে সরে যেতে নিল। ফাইজা পেছন থেকে ফায়াযের হাতটা ধরলো, বেশ শক্ত করেই। ফায়াযের হাতটা ধরে রেখেই তার সামনে আসলো। মুখোমুখি এসে নিজের হাতটা মেলে ধরলো ফায়াযের সামনে। হাতে মেহেদী দিয়ে খুব ছোট করে ডিজাইন করে ‘ফায়ায’ লেখা। ফায়ায নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। লাভ এট ফার্স্ট সাইটের এপ্লিকেশন ঘটলো তবে তার জীবনে? সে তো ভেবেছিল সব অনুভূতি একতরফা! ফায়ায ঘোরের মধ্যে চলে গেল যেন মুহূর্তেই।
-“আমি মজা করবো তোমার সাথে, সবসময় করবো। তুমি শুনবা, সহ্য করবা! সারাজীবন! বুঝছো ভাইয়াআআ?”
ফায়ায হেসে ফেললো। মেয়েটা মন গলানোতে বড্ড পারদর্শী যে। ফাইজার হাতের তালুতে আলতো করে চুমু খেল সে। ফাইজা কেঁপে উঠে হাত সরিয়ে নিল লজ্জায়। ফায়াযের চোখে চোখ রাখার সাহসটুকুও আর পেল না। মাথা নিচু করে পালালো সেখান থেকে। ফায়ায আড়চোখে ফাইজার পালানো দেখলো। অল্প সময়েই বড্ড মায়া জন্মেছে তার মেয়েটার প্রতি। মিত্তিমের কথা ভুলতেই বসেছিল ফায়ায, তৎক্ষণাৎ মনে পড়ায় দ্রুত মিত্তিমকে খুঁজতে লাগলো সে।
মিত্তিম ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। গা গুলাচ্ছে তার। মাথা ঘোরানো খানিকটা কমেছে ঠিকই কিন্তু শৈশবকে চুমু খাওয়ার ভয়ানক স্মৃতিটা তাকে নিজের দৃষ্টিতেই হেয় করে ফেলেছে। পারলে সে এখন নিজের ঠোঁট কেটে রক্তাক্ত করে ফেলতো। বাড়িভর্তি মানুষ, একটু শান্তিতে চোখের জল ফেলার সুযোগটুকুও নেই। কেন এসেছিল সে এখানে? শৈশবের প্রেমিকার নোংরা কথাগুলো শুনতে? তার আত্মসম্মানবোধ কি মরে গেছে ইদানিং? মিত্তিম তাকালো নিচের দিকে। মাথাটা ঘুরছে ফের, তাল সামলাতে পারলো না আর সে কোনোভাবেই।
চলবে…