#ইংলিশ_মিডিয়াম
২য়_পর্ব
~মিহি
“ইউ কিসড অন মাই লিপস! জানাবো এটা ফায়াযকে?” শৈশব ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্ন করলো। মিত্তিম রাগে কটমট করছে। শৈশব যেভাবে তাকিয়েছিল তাতে সে মনে করেছিল বোধহয় ফায়ায দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। আদতে তেমন কিছুই না। কেউ নেই সেখানে। এখন আবার ফায়াযকে জানানোর কথা বলে জ্বালানো হচ্ছে। বেয়াদব-ইতর লোক একটা!
-“বলবো মিত্তি?”
-“আপনি একটা আস্ত ইংলিশ মিডিয়াম বাঁদর। রাস্তা ছাড়েন।”
-“আচ্ছা যাও। আমি বাঁদর আর তুমি একটা নিষ্পাপ বাচ্চা হু স্টোল মাই ফার্স্ট কিস!”
মিত্তিম আর দাঁড়ালোই না সেখানে। সরে আসার প্রয়াস করলো। পেছন থেকে ফের একবার চেঁচালো শৈশব,”আফিয়া রুশতাহানা মিত্তিম, আই উইল ওয়েট ফর ইউ!” মিত্তিমের ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুললো না চাইতেও। সেখান থেকে সরে গেল সে ঠিকই কিন্তু চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো ছোটবেলার দুষ্টুমি। ইশস! শৈশব তাকে বড্ড লজ্জায় ফেলেছে সেসব মনে করিয়ে দিয়ে। ফায়াযকে খুঁজতে লাগলো সে আশেপাশে। এই ছেলেটা কোথায় হারিয়েছে কে জানে।
________
গান বাজছে। মিত্তিম ব্যস্ত চোখে ফায়াযকে খুঁজছে। ব্যস্ততার সর্বোচ্চ রেকর্ড বোধহয় ঐ ধারণ করে রেখেছে আজ। আচমকা আলো এসে পড়লো মিত্তিমের দিকে। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে মিত্তিম তাকালো এদিক-সেদিক। ফায়ায সেন্টারে এসে দাঁড়ালো, মিত্তিমকেও ইশারা করলো আসতে। আফরাও ততক্ষণে এসে পড়েছে। তিনজনের একটা ডান্স পারফরমেন্সের কথা ছিল কিন্তু এই ইংলিশ মিডিয়াম বাঁদরটা সব ভুলিয়ে দিয়েছে মিত্তিমকে। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজলো যথারীতি। মিত্তিম নাচলো প্রচণ্ড আনমনে। ফায়ায বারবার তাকিয়ে দেখলো মিত্তিমের উদাসীনতা। গান শেষ হতেই মিত্তিম সেন্টার থেকে সরে ছাদের দিকে এগোলো। সবকিছুই অস্বস্তিতে ফেলছে তাকে। ফায়ায, ফায়াযের বাবা-মা তাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করে, সে কিভাবে শৈশবের দিকে হাত বাড়াতে পারে? শৈশবকে নিয়ে কল্পনাটুকুও তার করা অনুচিত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছু ফিরতেই মিত্তিম দেখলো ছাদের দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শৈশব। আশেপাশে কেউ নেই। মিত্তিম দ্রুত ছাদ থেকে নামার চেষ্টা করলো। শৈশব মিত্তিমের হাত আটকে ধরলো। শান্তভাবে প্রশ্ন করলো,
-“আমাকে ইগনোর কেন করছো তুমি?”
-“আমার হাত ছাড়েন ভাইয়া। কেউ দেখলে উল্টাপাল্টা ভাববে।”
-“ভাবুক, আই ডোন্ট কেয়ার! তুমি আমার কথা বোঝোনি? আমি যখন বলছি আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, তাহলে সমস্যা কোথায়? তোমার এডমিশন টাইমে তোমার সামনে এসেই ভুল করলাম মেইবি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আসতে হতো। মিত্তি শোনো…”
-“আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না। প্লিজ, আমার ঘুম পাচ্ছে। আমাখে যেতে দিন।”
শৈশব হাত ছেড়ে দিল। এমন আচমকা হাত ছেড়ে দেওয়াতে মিত্তিমের মন আরো খানিকটা খারাপ হলো। এত সহজে ছেড়ে দিল? মিত্তিম মনে মনে নিজেকে গালি দিল। বেহায়া মন এত কেন তার? হাত ছেড়েছে ভালোই তো করেছে! তড়িঘড়ি করে নিচে নামলো সে। আফরার সাথেই ঘুমোয় রাতে মিত্তিম কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে ঘুম আর কার চোখেই বা আছে? ফায়ায থাকলে সারাটা রাত আড্ডা দিতেই যাবে কিন্তু এখন মিত্তিমের প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুম না পেলেও ঘুমোতে ইচ্ছে করছে তার। মন প্রচণ্ড খারাপ লাগছে বিধায় মিত্তিম কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হলো। ফায়াযের বাসার একটু সামনেই মিত্তিমদের বাসা। বড়জোর পাঁচ মিনিট হাঁটতে হয় তবে রাস্তাটা খানিকটা শুনশান। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে সতর্ক পায়ে মিত্তিম এগোলো বাড়ির দিকে। দুয়েকবার মনে হলো কেউ বোধহয় পিছু করছে। প্রচণ্ড ভয়ে ঘাড় ঘোরানোর সাহস হলো না তার। একছুটে বাড়ির দরজায় এসে বেল দিল। মিত্তিমের মা আঞ্জুমান আরা দরজা খুলেই মেয়েকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হলেন।
-“কী রে? তুই একা এসেছিস নাকি?”
-“না না মা, ফায়ায এগিয়ে দিয়ে গেল দরজা অবধি।”
-“ওহ! তা আসতে বললি না কেন ওকে?”
-“ওর তাড়া আছে। আমি ঘুমোবো, মাথা ধরেছে।”
-“আচ্ছা আয়।”
মিত্তিম ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতেই অনুভব করলো বাসার সামনের মূল রাস্তাটা থেকে কোনো একটা অবয়বের সরে যাওয়া। বুকের অভ্যন্তরে ধক করে উঠলো তার। কেউ কি পিছু নিয়েছিল? কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে না তো?
রাতে ভয়ানক জ্বর আসলো মিত্তিমের। প্রেমের জ্বর? বোধহয়! দুঃস্বপ্নও দেখলো কতক। শৈশব এগোচ্ছে ক্রমশ তার দিকে, এসবকে দুঃস্বপ্ন বলা যাবে কি?
____________
সকাল সকাল মিত্তিমকে নিতে ফায়ায এলো। জ্বরে কাঁবু মেয়েটা বিছানায় হেলান দিয়ে টম এণ্ড জেরী দেখতে দেখতে খিচুড়ি মুখে তুলছে। ফায়ায এসেই বসলো তার আর টিভির মাঝখানে। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললো মিত্তিম। খিচুড়ির প্লেটটা সজোরে সরিয়ে রাখলো মিত্তিম।
-“মুখের সামনে থেকে সর!”
-“চড়ুইপাখি আমার, রাগ করিস না তো! তুই কাউকে না বলে এভাবে চলে আসবি তাই বলে? রাতে তোকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না দেখে কত টেনশনে ছিলাম জানিস? পরে তুই টেক্সট করে বললি যে বাসায় এসেছিস। ফোন করলাম, ফোন অফ করে রেখেছিস। কী হয়েছে বলবি তো আমাকে। কেউ কিছু বলেছে তোকে?”
-“তোর প্যাঁচাল শেষ হলে সামনে থেকে সর। শরীর ভালো লাগছিল না তাই বাসায় আসছি। আমার বাসা কয়েক ক্রোশ দূরে না যে একা আসতে পারবো না।”
-“তুই জানাবি না কেন? একা কেন বের হবি তুই?”
-“সব তোকে জানায়ে করতে হবে আমার?”
ফায়ায তাকালো মিত্তিমের দিকে। মিত্তিম তো কখনো এভাবে কথা বলে না। রাগ করলেও তা স্বাভাবিক রাগ, এই রাগের ঝাঁঝ অন্যরকম ঠেকছে ফায়াযের। অসুস্থ শরীর বলে কি এমন করছে মেয়েটা?
-“চড়ুই, তোকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগবে না রে। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হ। তুই বিয়েতে না থাকলে আমিও আপুর বিয়েতে থাকবো না।”
-“মেয়েদের মতো ঢঙ করিস না তো! তোরে চিনি না আমি? খুব তো বিয়ানের পেছনে ঘুরছিলেন আপনি ভাইয়া, দেখিনি আমি? লুচ্চা শালা! যাই হোক, চয়েস ভালো আছে। চালায়ে যা, প্রেম হলে তোর কপাল!”
ফায়ায মুখ কাঁচুমাচু করতে লাগলো। ফাইজার কথা ধরতে পেরেছে মিত্তিম? ফাইজা আরফার ননদ। নামের মিল থাকায় দুজনকে তো ভাইবোন বানিয়ে ফেলার ছক কষছে কিছু আত্মীয়। ফায়াযের সেসবে গা জ্বলে যায়। নাম কাছাকাছি হলেই ভাইবোন হতে হবে নাকি? ফাইজার দিক থেকেও অবশ্য একটু আধটু ইটিশপিটিশ আছে বোধহয়। ফায়াযের দিকে মেয়েটার তাকানোর চাহনিটা অনেক কিছুই ব্যক্ত করে। ফায়াযকে অন্যমনস্ক দেখে মিত্তিম চুপচাপ বিছানার অন্যপাশে সরে কার্টুন দেখতে লাগলো। খানিক পরে ঘোর ভাঙলো ফায়াযের। ফের সামনে গিয়ে বসলো।
-“তুই কি চাইতেছিস তোরে আমি লাত্থি দিয়ে বের করি শালা?”
-“দেখ বোন, তোর পা ধরি আমি। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হ, কয়দিন পর তো শৈশব ভাইয়ার বিয়েটাও খাওয়া বাকি। এখনি তোর ক্যান অসুস্থ হওয়া লাগলো?”
-“শৈশব ভাইয়ার বিয়ে? কবে?”
-“জানিনা। ভাইয়ার তো প্রেমিকা আছে, কি সুন্দর সে মেয়ে ভাই! ভাইয়ার সেইম এইজ আর কী, ভাইয়ার কলেজের ক্লাসমেট ছিল। মেয়েটা আবার আমার ছোট ফুপুর ফ্রেন্ড। ফুপু তো ভাইয়ার এইজেরই। বিয়েতে আসবে বলছিল। আজ সকালেই আসছে, পুরাই আগুন সুন্দরী মেয়ে!”
-“শৈশব ভাইয়ার প্রেমিকা? ওহ আচ্ছা…”
শৈশবের জীবনে আরেকটা মেয়ে আছে! শুধু মেয়েই না, প্রেমিকা! মিত্তিমের শরীর ঘামতে লাগলো। প্রেমের জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে বোধহয়। শৈশবকে নিয়ে সবে একটু স্বপ্ন ঘিরেছিল তার মনে, আদতে তা দুঃস্বপ্নই রইলো। নিজের পছন্দের মানুষের জীবনে অন্য নারীর উপস্থিতি এবং সেই নারীরই রাজত্বের গল্প শুনতে কেমন লাগে? নিশ্চয়ই খুব খারাপ? মিত্তিমের প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। অযাচিত একটা আশা সে বাঁধতে গিয়েছিল। শৈশবের ঠোঁট অবধি স্পর্শ করেছে সে! ছিঃ, নিজেকে ধিক্কার দিল মিত্তিম।
চলবে…