ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০১

0
114

#ইংলিশ_মিডিয়াম
সূচনা_পর্ব
~মিহি

“একটা চুমু খেলেই যে আপনার আমাকে বিয়ে করতে হবে এমন কোনো শর্ত আমি আপনাকে দিইনি, শৈশব। আপনার জীবনে যে প্রথম এসেছে, আপনার প্রথম ভালোবাসা, হোক সে আপনার প্রাক্তন, তাকেই বিয়ে করুন আপনি। আমি আটকাতে যাবো না।” মিত্তিমের কথার ঝাঁঝ শৈশব টের পেল না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা স্বরে শৈশবকে অপর একজন নারীর সাথে মেনে নিল মিত্তিম? বিয়েও করে নিতে বললো? একটুও কি ভালোবাসেনি মেয়েটা তাকে? ঐ চুমুটা স্রেফ শরীরের তাড়নায় এগিয়ে আসা?

বিয়েবাড়ির ব্যস্ততায় কারো আশেপাশে দেখার সময় নেই। মিত্তিম এবং শৈশব যে একসাথে নিখোঁজ এ খোঁজটাও কারো নেই। প্রচণ্ড চঞ্চল মিত্তিমের হুট করে হিমশীতল হয়ে যাওয়া শৈশবের বুকে আঘাত করলো। ইচ্ছে করলো মিত্তিমকে ফের বাহুতে জড়িয়ে নেওয়ার দুঃসাহস দেখাতে। কিন্তু প্রচণ্ড অভিমান তারও এখন।

-“মিত্তি, আমি তিথিকে বিয়ে করবো? এটা চাও তুমি?”

-“হ্যাঁ।”

-“কেন? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করলে তোমার অসুবিধা কোথায়? তুমি ছাড়া আমার লাইফে আর কাউকে আমি আসতে দিব না। যতদিন অপেক্ষা করতে হয় আমি করবো। তুমি শুধু বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”

-“আমার ভাগ্যের উপর আমি বিশ্বাস রাখি। আমার যা ভাগ্য তাতে আপনাকে নিয়ে প্রত্যাশা করার দুঃসাহস দেখিয়ে আমি নিজেকে আঘাত করতে পারবো না শৈশব। আমাদের মিল হওয়ার থাকলে সেটাও ভাগ্যের উপরেই ছেড়ে দিলাম আমি।”

মিত্তিম শাড়ির কুঁচি সামলে শৈশবের সামনে থেকে সরে গেল। শৈশব, ফারহায ইফতেখার শৈশব! আর্কিটেকচারে থার্ড সেমিস্টারে পড়া এক সুদর্শন, নারীজাতির আরাধ্য প্রেমিক-পুরুষ। মিত্তিমের বাল্যকালের বন্ধু ফায়াযের একমাত্র জৈষ্ঠ ভ্রাতা। ফায়ায অবশ্য এখনো জানেনা তার ছোটবেলার একমাত্র বান্ধবীটি তারই বড় ভাইয়ের প্রেমপিপাসায় মরিয়া। মিত্তিম শৈশবের কাছ থেকে সরে ফায়াযের ঘরের ওয়াশরুমে আসলো। আজ ফায়াযের বড় বোন আফরার বিয়ে। বাড়িভর্তি মেহমান। ওয়াশরুমের ট্যাপ চালু করে মুখে হাত গুঁজে কান্না করে বসলো সে। শৈশবকে সে কতদিনই বা চিনেছে? তিনদিন বড়জোর? হতে পারে ছোট থেকে দেখে এসেছে কিন্তু খুব কাছে আসার মুহূর্ত তো ঐ তিনটা দিনই। আফরার বিয়ে উপলক্ষে ফায়ায ধরে-বেঁধে সাতদিন আগেই আনিয়েছে মিত্তিমকে। বাসা কাছাকাছি হওয়ায় অসুবিধেয় পড়তে হয়নি। তাছাড়া আফরার সাথে মিত্তিমের ভাব খানিকটা বেশিই। আফরার বিবাহপূর্ব অনুষ্ঠানে এসেই দীর্ঘসময় পর শৈশবকে দেখা মিত্তিমের। গায়ে হলুদের দিন সাদা টি-শার্ট আর ক্যাজুয়াল ট্রাউজারে মারাত্মক এলোমেলো চুলে শৈশব এসে দাঁড়িয়েছিল মিত্তিমের সামনে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট? বোধহয়! চঞ্চল মিত্তিম কেমন শান্ত হয়ে গেল শৈশবের সামনে। হাজারটা গল্পের মাঝেও তার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অবশ্য তার চোখের চাহনি যে শৈশবে মত্ত তা খেয়াল করার দৃষ্টি তখন কারোই ছিল না। সন্ধ্যে নাগাদ আফরা মিত্তিমকে সাজিয়ে দিল। সংগীতের অনুষ্ঠান তখন। ফায়াযকে খুঁজতে খুঁজতে তার ঘরে ঢুকলো মিত্তিম। শৈশব তখন সবে গোসল করে বেরিয়েছে ওয়াশরুম থেকে। গায়ে জড়ানো টি-শার্টে পানির ছিটেফোঁটা, চুল থেকে পানি ঝরছে টপটপ করে। মিত্তিম দাঁড়াবে নাকি বের হয়ে যাবে এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে তার পা বোধহয় পাথরের মতো জমে গেল।

-“ফায়াযকে খুঁজছো? ও বোধহয় ছাদে গেল।”

-“ও..আচ্ছা ভা…ভাইয়া।”

-“তোতলাচ্ছো কেন? আমি কি দেখতে এতই ভয়ঙ্কর নাকি? তুমি মিত্তিম তাই না? ছোটবেলায় আমি ঘুমালে তুমি আমার বুকের উপর উঠে আমার চুল নাড়তে!”

মিত্তিম প্রচণ্ড লজ্জা পেল। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়া একটা মেয়েকে লোকটা ছোটবেলার এমন অকওয়ার্ড কাহিনী শোনাচ্ছে? লজ্জা নেই? আরে ছোট ছিল সে, একটু আধটু দুষ্টুমি তো করতেই পারে। মিত্তিম কিছু বলে ওঠার আগেই বিদ্যুৎ চলে গেল। অনুষ্ঠান বাইরে, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় সবাই সেদিকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শৈশব ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখলো। সামান্য আলো আঁধারিতে শৈশবকে আরেকটু বেশিই আকর্ষণীয় লাগছে মিত্তিমের। শৈশব চুলে হাত চালাতে চালাতে ফের এক তীক্ষ্ম বাণ ছুঁড়লো মিত্তিমের দিকে।

-“তুমি ছোটবেলায় আমাকে হাগ করতে, মনে আছে তোমার?”

মিত্তিম বোধহয় জমে গেল এবার। শৈশবকে জড়িয়ে ধরতো সে, অনেকটা দুষ্টুমিই করতো শৈশবের সাথে। ফায়াযের সাথে মারামারি চলতো কিন্তু শৈশবের বেলায় যেটুকু ছিল সব আদর। শৈশবের গায়ের সাথে মিশে টম এণ্ড জেরী দেখতে দেখতে কখনো শৈশবের বুকের উপর চড়াও হতো সে। ইয়া মাবুদ! এসব কী করেছে সে ছোটবেলায়? কেন করেছে?

-“আই ইউজড টু লাভ ইওর টাচ, মিত্তি!”

শৈশবের এ কথায় জমে গেল মিত্তিম। শৈশব এগোলো। মিত্তিম প্রচণ্ড ঘামছে, কপালের একপাশে চুল অনেকখানি জায়গা দখল করে ফেলেছে। শৈশব একহাতে চুলগুলো সরিয়ে দিল। মিত্তিমের খানিকটা কাছে এসেই ফিসফিস করলো,”তোমার মনে আছে তুমি আমার গালে চুমু খেয়েছো একবার?” ব্যস! মিত্তিমের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। মিত্তিম ভেবেছিল শৈশবের বোধহয় ছোটবেলার কিছু মনে নেই। এ ছেলে তো তাকে গুণে গুণে তার কীর্তিকলাপ মনে করাচ্ছে। পরক্ষণেই শৈশব একটা ভয়াবহ কাজ করে বসলো। মিত্তিমের গালে চুমু খেয়ে বসলো। অতঃপর বিড়বিড় করে আওড়ালো,”তুমি আমার ফার্স্ট কিস নিয়ে নিয়েছিলে, আই রিটার্নড ইট। মাই ফার্স্ট কিস শ্যুড বি স্পেশাল, ইট শ্যুড বি অন মাই লিপস! বুঝছো মিত্তি?” শৈশব আগুনে ঘি ঢাললো বোধহয়। কেননা পরক্ষণেই মিত্তিম আলতো করে শৈশবের ঠোঁট ছুঁলো। অতঃপর অনুভব করলো তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কী করে ফেললো সে? শৈশব নিশ্চুপ তখনো। মিত্তিমকে কাছে টেনে ফের মিত্তিমের ঠোঁটের কাছে আসতেই মিত্তিম চোখ বন্ধ করে শৈশবের চুল টেনে ধরলো। ব্যথায় উফ করে উঠলো শৈশব। ঘোর ভাঙলো মিত্তিমের। বিদ্যুৎ এসেছে। চারদিক আলো জ্বলে উঠতেই নিজেকে শৈশবের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ পেয়ে প্রচণ্ড লজ্জায় কুঁকড়ে আসলো সে। তৎক্ষণাৎ ও ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করতেই শুনতে পেল শৈশবের কণ্ঠ। গুনগুন করছে ছেলেটা,

“We were just kids when we fell in love
Not knowing what it was
I will not give you up
This time…”

লিরিক্স বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো মিত্তিমের কিন্তু বোঝার পরক্ষণের অনুভূতিটা হলো ভয়াবহ। শৈশব কি বোঝানোর চেষ্টা করছে তাকে? মিত্তিম ও শৈশবের বয়সের পার্থক্য বড়জোর তিন বছরের। আর মিত্তিম খুব ছোটবেলায় শৈশবকে জড়িয়ে ধরে রাখতো, তার সাথে অনেকটা সময় কাটাতো এসব মিথ্যে না। তবে সে অনুভূতির নাম কি ভালোবাসা? যদি এসব ভালোবাসা হয়ে থাকে তবে মিত্তিমের এখন প্রচণ্ড অভিমান করা উচিত। মিত্তিমকে না জানিয়ে ছেলেটা বয়েস স্কুলে চলে গিয়েছিল। ঐ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটার প্রতি মিত্তিমের এখনো বিতৃষ্ণা থাকা উচিত যা শৈশবকে তার থেকে দূরে সরিয়েছিল ছোটবেলায়। মিত্তিম দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরোলো। কানের কাছে শোঁ শোঁ করছে তার। সবকিছু যেন ঝাপসা লাগছে। প্রচণ্ড উদভ্রান্ত সে ফায়াযের সামনে পড়লো।

-“কী রে? তোকে এমন শ্যাওড়াগাছের পেত্নীর মতো লাগছে কেন? এত হাঁপাচ্ছিস? কী চুরি করে আসছিস?”

-“কি…কিছু না।”

-“ভাই! তুই মিত্তিম তো? তোরে পেত্নী বলছি আমি আর তুই এত শান্ত? কেউ তোরে জাদু করছে, তুই আয় তো। আম্মুর কাছে চল তো, তোরে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিবে।”

-“সর তো তুই। দূর হ চোখের সামনে থেকে।”

ফায়ায কিছু না বলে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। মিত্তিম তখনো হাঁপাচ্ছে। খানিক বাদে শৈশব এলো তার সামনে। সাদা পাঞ্জাবী গায়ে জড়ানো। মিত্তিম কয়েকটা হৃদস্পন্দন মিস করলো বোধহয়। এ ছেলেকে দেখলেই এখন তার নিঃশ্বাস থেমে আসবে। যে মারাত্মক ঝটকা সে খেয়েছে তাতে আপাতত তার মস্তিষ্ক স্থির হচ্ছে না। ফায়ায একটু পরেই তার জন্য গ্লাসভর্তি লেবুর শরবত আনলো। মিত্তিমের হাতে ধরিয়ে দিতেই ডাক পড়লো তার। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আবার ছুটলো সে। মিত্তিম মাত্র গ্লাসটা ঠোঁটে ঠেকানোর প্রস্তুতি নিয়েছে, শৈশব ডেকে উঠে!

-“মিত্তি! সাবধানে, তোমার ঠোঁটে এখনো আমার স্পর্শ। শরবতের সাথে সেটুকুও ধুয়ে খেয়ে ফেলো না কিন্তু!”

-“সমস্যা কী আপনার? ফ্লার্ট করছেন আমার সাথে? আপনার ছোট ভাইয়ের বন্ধু আমি! আপনার ছোট বোনের…”

-“তুমি আমাকে বড় ভাই ভাবো?”

মিত্তিম পড়লো মুসিবতে। না বলতে পারছে না সে, হ্যাঁ তো মুখ দিয়ে বেরোবে না।

-“তুমি আমাকে ভাই মনে করে হাগ করতা? ভাই ভেবে গালে কিস করছিলা? আর একটু আগে ভাই মনে করে আমার ঠোঁটে…”

মিত্তিম শৈশবের মুখ চেপে ধরলো। এই লোকটা আস্ত ঠোঁটকাটা। ইংলিশ মিডিয়ামের বাঁদর একটা! আচমকা মিত্তিমের মনে হলো তার পিছনে কেউ আছে এবং তাদেরকেই দেখছে। শৈশব বড় বড় করে চোখ করে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। ভয়ে কুঁকড়ে পেছনে ফিরলো মিত্তিম। ফায়ায না তো? সর্বনাশ!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে