আড়ালের সুখ দুঃখ

0
1837
দীপা প্রেগন্যান্ট,কথাটা জানার পর আসিফ মোটেও খুশি হয় নি।প্রেমবিহীন শারীরিক সম্পর্কের ফলে গর্ভধারন,এটা যদি অখুশী হবার কারন হয়,তবে দীপা কী করবে?দীপার সুদর্শন,রাজপুত্রের মতন চেহারার স্বামী আসিফের অখুশি হওয়ার সত্যি কারনটা দীপার কাছে অজানা।একটা আবছা রহস্য। বিয়ের দু বছরে দীপা অবশ্য এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে আসিফ ছেলেটা তাকে নিয়ে সুখী নয় তেমন।সকালে আসিফকে যখন প্রেগনোটেস্টটা দেখায় সে,বলে, -“দেখো তো একটু,পজিটিভ মনে হচ্ছে!” আসিফ চোখ কুঁচকে বলল,”সরাও,সরাও।নিজে বুঝতে পারো না!তুমি মূর্খ নাকি!” আসলে সেই যন্ত্রে খানিকটা মূত্র দিতে হয় টেস্টের জন্যে।আসিফের তাতে একটু ঘেন্না লেগেছে।কিন্তু সন্তান ধারনের আভাসে দীপা এতোটাই উত্তেজিতা ছিল,এসব মাথায় আসে নি তার। সন্তান ধারনের খবরে আসিফ তেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করলেও দীপার ভাসুর,মানে আসিফের বড়ভাই আসলাম খুব খুশি হয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় দীপার ভাসুর পিজ্জা এনেছিলেন বাসায়।দীপাকে একটা বাক্স দিয়ে বলেছিলেন,”তুমি খাবে।” দীপা খায় নি।বাক্সটা দেরাজে রেখে দিয়েছিল,আসিফ খাওয়ার পর একটু মুখে দিয়ে দেখবে কেমন।খুব সাধারন পরিবারের মেয়ে হওয়াতে দীপা জানে না দামী রেঁস্তোরার পিজ্জার স্বাদ। রাতে আসিফ এলে,দীপার মনে হল মানুষটাকে একটা সারপ্রাইজ দেয়া যাক।সারাদিন অফিস করে এসে ক্লান্ত হয়ে ফেরে। সেই একঘেঁয়ে খাবারই তো খেতে হয়।দীপা আয়নার সামনে বসে সাজার ভান করে বলল,”দেরাজে আছে মনেহয় খোঁপাটা,একটু এনে দেবে?” আসিফ বিরক্তি নিয়ে খুলল,তারপর অবাক হয়ে বলল,”এ কি!এই অবস্থা কেন!” দীপা আসিফের মুখের ভাব দেখে দেরাজের কাছে গেল।দেখল, কাগজের বাক্স কুটিকুটি করে কাটা,পিজ্জার অবশিষ্ট পড়ে আছে!এটা যে সেই ধেড়ে ইঁদুরটার কাজ,তাতে কোনো সন্দেহ নেই!দীপা বলেছিল,”তোমার জন্য রেখেছিলাম।” আসিফ বলল,”তা তো দেখতেই পাচ্ছি।নিজে খেয়ে দেয়ে এখন মজা নিলে।” দীপা ভালো করেই জানে আসিফ বোঝা সত্ত্বেও তাকে একটু ঠেস দেবার জন্য কথাটা বলেছে।আজকাল দীপাকে একটু তুচ্ছ করতে পারলে বেচারা বিমলানন্দ পায়।আর হতচ্ছাড়া ইঁদুরটার আজকেই দেরাজে ঢুকতে হল।ব্যাটা দীপাকে অনেক ভুগিয়েছে,আর না।দীপা ভাবলো একে দুর্দান্ত একটা মৃত্যু দন্ডাদেশ দিতে হবে। দীপার বুকে মাঝে মাঝে একটা মন খারাপের ভুরভুরি কাটে।সে বুঝতে পারে না,সুদর্শন চাকরী করা স্বামী,ভালো মনের ভাসুর,শিক্ষিতা শ্বাশুড়ি,শ্বশুরের দেয়া ফ্ল্যাট এসব সত্ত্বেও সে আসলে সুখী কিনা। দীপা দেখতে খুব সাধারন।শ্যামবর্ণা,টানা চোখ।কিন্তু কেউ তাকে সুন্দরী বলে না।রাস্তা ঘাটে দীপার মতন বাড়িয়ে চাড়িয়ে সুশ্রী বলা মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।বাপে পোস্টাপিসের হেড ক্লার্ক,বড় ভাইটা দোকানদার।তার মত অতি সাধারন মেয়ের একটা আটপৌরে কেরানী বরের বেশি তো জুটার কথা না।কিন্তু জুটে গেছে।খোদার রহম কিনা কে জানে,দীপার ভাসুরের সঙ্গে নিজের বড়ভাই রায়হানের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল সেই ছোটোবেলা থেকে।আসলাম ভাই প্রায়ই দীপাদের বাসায় গিয়ে রায়হানের সঙ্গে আড্ডা দিতেন।তাদের দুই বোনকে মাঝে মাঝে ডেকে হাস্যমুখে বিলাতেন উপহার ।সুন্দর ডায়েরী,ফাউন্টেন পেন,একটা দুটা বিদেশি সেন্ট,ব্রেসলেট এইসব।সেই আসলাম ভাই যখন দেখলেন নিজের জানের দোস্ত রায়হান বোনকে নিয়ে টেনসন করছে,বিয়ের বয়স হল,উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান মিলছে না-তখন নিজের অপদার্থ ছোটোভাইয়ের কথা মনে এল তার।একটা নতুন কোম্পানীতে তিনি কিছু ঘুষ দিয়ে চলনসই একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছেন ছেলেটাকে।এবার তো আসিফের বিয়ে দিতে হয়।আসলামের মনে হল নিজের বন্ধুর সঙ্গে আজীবনের আত্মীয়তা করার এ এক সুবর্ণ সুযোগ।সুতরাং বাসায় ফিরে নিজের বি.এ পাস মা আর এম.এ পাস ভাইকে বুঝিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করলেন।বুদ্ধিমতী মা অমত দেন নি।বুঝলেন বড়ছেলের কথা মানাটা জরুরি।সংসারের জন্য এতো কিছু করছে মানুষটা।কিন্তু দীপার ছবি দেখে বেঁকে বসেছিল আসিফ।তার সাবেক প্রেমিকা মিস প্রাপ্তির কাছে এ কিছুই না।তাছাড়া আসিফ ভালো করেই জানে সে দেখতে ঝকঝকে সুপুরুষ।নায়িকা চেহারার মেয়ে ছাড়া অন্য সাধারন কোনো সুন্দরীও যে তার উপযুক্ত নয়!যুবক বয়সের একটা আত্ম অহংকার তো আছেই।পরে দুই ভাইয়ের বেশ মন কষাকষি,মায়ের আহারে বিহারে অনুরোধ উপরোধে আসিফ মত দেয় বিয়ের।সে ভেবে দেখলো যে,এই ফ্ল্যাটের কাগজ পত্র সব দাদাভাইর নামে করা,বাবা মারা গিয়ে ছোটো ছেলেকে বিপদে ফেললেন।আসলাম ভাই রেগে গেলে তো সমস্যা। যাই হোক,অনাড়ম্বরে দীপার বিয়ে হয়ে গেছিল।যৌতুকের ঝামেলা ছিল না।কিন্তু নতুন নতুন আত্মীয় স্বজনরা,খালা ফুফু শ্রেণির মহিলারা কেউ কেউ দীপাকে দেখে বলেছিলেন-“কী গো নিসু আপা!আসলামের কি চোখে ছানি পড়লো নাকি তাবিজ করলো!এ যে মুক্তার মত ছেলেকে বাঁদরের কোলে তুলে দেয়া!আমাগো আসিফের এই বউ!জিনিস পত্তরও তো কিছু দেয় নাই শুনলাম।” শিক্ষিতা শ্বাশুড়ি মুখ কালো করে বলেছিলেন,”জিনিস দিয়ে কী করবো রে ফুলি?বরং আরো আবর্জনা জমতো বাড়ীতে।” . গর্ভে সন্তান ধারনের সময়টুকুতে যত কষ্টই হোক,একটা নারীর পক্ষে তা মেনে নেয়া যায়।কিন্তু ঐ সময়ে চারপাশের মানুষের থেকে অবহেলা পেলে,এর যে মানসিক কষ্ট,তা শব্দে বন্দী করা সম্ভব না।এই যেমন রাত্রে যখন আসিফ শরীরের চাহিদা মিটিয়ে পাশে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিল,দীপা একটু আহ্লাদি স্বরে বলে,”হ্যা গো,কী চাও তুমি?ছেলে নাকি মেয়ে?” আসিফ বিরক্তি নিয়ে বলল,”প্রেগন্যান্সির এখনো দু মাস যায় নি।তোমার এতো আহ্লাদ কিসের?আর আগে যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়?” দীপা তবুও কোমল গলায় বলতে থাকে, -“মেয়েই ভালো হবে গো।কী সুন্দর পুতুলের মত সাজানো যায় !ছোট্ট টলোমলো পায়ে হাঁটবে আমার মেয়ে,কী মায়াবী দেখতে লাগবে!” আসিফ মুখ ভার করে বলে,”আমার কিন্তু ইচ্ছা ছিল না এতো তাড়াতাড়ি বাবা হবার!” দীপা যেন শুনতে পায় না আসিফের কথা।আপন মনে বলে,”জানো আমার মেয়েটা একটু বড়ো হলে নূপুর পড়াবো,চুলে লাল ঝুঁটি,সারা ঘর আলো করে দৌড়ে খেলে আমাকে জ্বালাবে।পুতুলের বিয়ের জন্যে তোমাকে ঘটক ধরবে,আহ!” আসিফ পাশ ফিরে শোয়।দীপাকে পাত্তা দেবার পাত্র সে না।সে ভাবে তার প্রাক্তন প্রেমিক প্রাপ্তির কথা।বড়লোকের হুলুস্থূল সুন্দর মেয়ে।খুব ন্যাকা ন্যাকা কথা বলতো আসিফের সাথে।তখন আসিফই তো প্রাপ্তিকে একদিন বলেছিল,’এই আমাদের মেয়ে হলে কী নাম রাখবে গো?বিয়ের পরপরই একটা কিউট বেবি দেয়া হবে তোমায়।আমার ছেলে অতো পছন্দ না।ছেলেরা দস্যি।পরে দেখবে আমার আদরটুকু তুমি তোমার ছেলেকে দিয়ে দেবে!’ প্রাপ্তি কপট রাগে হাস্য কলরবে বলেছিল,’কি অসভ্য তুমি!’ দীপার কোনো প্রাক্তন ট্রাক্তনের ঝামেলা নেই।তার রাত জুড়ে দিন জুড়ে খালি অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত ভাবনা। তখন বেশ কয়েক মাস হলেও সকাল সকাল উঠে ঘর সংসারের সমস্ত কাজ সামলাতে হয় দীপাকে।বড়জা কলেজে পড়ায়,সংসারের কুটোও নাড়তে নারাজ।আগে রান্নার লোক ছিল।বুয়া ছিল।দীপা আসার পর কাজের লোক বিদায় করে দেয়া হয়।অন্য কিছুতে কোনো অসাধারণত্ব না থাকলেও,গৃহকর্মে বেশ নিপুণা মেয়ে দীপা।চমৎকার রাঁধতে পারে।ঘর গোছানো,কাপড় চোপড় পরিষ্কার করা,সব তাতেই সে নাম্বার ওয়ান।যদিও আজকাল তার রাঁধতে ভালো লাগে না।মাছ রাঁধতে বমি পায়,মারাত্মক আঁশটে গন্ধ তখন তার নাকে লাগে।তবু নাকে আঁচল দিয়ে কাজটা করে।বড়ভাবীকে বলেছিল।ভাবী বললেন,পেটে সন্তান আসলে এরকম হয়। মাতৃত্বের ভার আর জ্বালা যন্ত্রনা কোনো বিষয় না এই পরিবারে, ঘর মোছা পর্যন্ত করে যেতে হয়। আসলাম ভাই ইদানীং ফল টল আনেন।মাকে দিয়ে বলেন,”কালো আঙ্গুরে পুষ্টি বেশি।ফ্রুক্টোজ আছে।দীপা যেন খায় বেশিটা।” মা ফ্রিজে আঙ্গুর আর নাসপাতির প্যাকেট রাখতে রাখতে বললেন,”কত নিল রে?এইসব ফলে তো মেডিসিন মেশায়।” আসলাম বললেন,”আটশো টাকা পড়লো।গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ফর্মালিন থাকবে না।প্রসূতির জন্য ফ্রুক্টোজ সমৃদ্ধ ফল ফলাদি বেশ উপকারী।” ফল কেটে নিজের জন্য এক বাটি নিয়ে,বাকীটা শ্বাশুড়িকে দিলে,শ্বাশুড়ি মাতা বললেন,”এই সব বেশি খাওয়া ভালো না তোমার।আসুর যতো ভুল কথা!আমরাও তো গর্ভবতী ছিলাম,সন্তান জন্ম দিছি,কই এই সব বিদেশি ফল,হরলিক্স তো খাই নাই।আমাদের ছেলে পিলে কি তাগড়া হয় নাই!” দীপার ফল খেয়ে পেটের সন্তানের পুষ্টি বাড়ানোর ইচ্ছে মরে যায়। একদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে যায় সে,খুব খারাপ স্বপ্নএকটা দেখেছিল।কিন্তু সেই স্বপ্নের রেশ ধরে সে অনুভব করে তার সঙ্গে আরো বড়ো খারাপ কিছু ঘটবে। দীপা দেখতে পায়,বারান্দায় আসিফের দীর্ঘদেহ।চাঁদের আলোয় আসিফ হয়ে যায় দেবদূত।কথা বলছে মোবাইলে।বার কয়েক শুনতে পায় প্রাপ্তি নামটা।-‘শুনো প্রাপ্তি,আমি আমি এখনো তোমাকে ভুলতে পারছি না…না,না এইসব বিয়ে টিয়ে আমি মানি না,কী বললে!…তোমার হাসব্যান্ড লন্ডন থেকে ফিরবে কবে?কাল দেখা হচ্ছে তো…আচ্ছা সুইটহার্ট রাখি কেমন…ওহ সিওর আমি বিকেল চারটার মধ্যেই ওয়েস্টিনে থাকবো।’ দীপার মাথার মধ্যে একটা নর্তকী ঝুমঝুম নাঁচতে থাকে যেন।মাথা গরম হয়ে উঠতে থাকে।তারপর হঠাৎ মনে পড়ে তার,আরে!এতো ভাবনা কি আমার,আমার পেটের মধ্যে যে বড়ো হচ্ছে সেই তো আমার একমাত্র আরাধ্য।আসিফ যদি ছেড়ে চলে যায় আমাকে,তো যাক না। দীপা সাধারন মেয়ে হলেও,আর সবার মত তার অতো দুঃখবোধ নেই।এইসব তো তার কাছে এখন বিলাসিতার নামান্তর! . দীপার আজকাল খুব খিদে পায়।ঘরে যে খাবার নেই এমন না,খাবার আছে ফ্রিজ ভর্তি।কিন্তু ফ্রিজটা শ্বাশুড়ি মার ঘর থেকে দেখা যায়।উনি ইজিচেয়ারে দুলতে দুলতে ধর্মগ্রন্থ পড়েন।দীপা কিছুর জন্যে ফ্রিজ খুললে ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলেন,”বউমা,তুমি দুপুরে ভাত এঁটো করেছো।আজে বাজে খেলে পরে পেটের বাচ্চাটার সমস্যা হবে।” দীপা একটু লাজুক আছে।একটু হীনমন্যতাও আছে নিজে ঝকঝকে সুন্দরী না বলে।তাই পেটের ক্ষুধাটা পর্যাপ্ত পানি খেয়ে নিভাতে নিভাতে ভাবে,তাই হবে হয়তো।আমি তো পাড়ার কলেজের নর্মাল গ্রাজুয়েট,কত কিছু জানি না।ভাত-মাছ-ডাল গলা দিয়ে না নামতে চাইলেও তাকে খেয়ে যেতে হয়।দীপার খেতে ইচ্ছে করে ডিম,মাখন,সেদ্ধ মাংস দেয়া স্যান্ডউইচ।কম মসলার চিকেন স্টু।ফলের রস।এর সবই কমবেশি আসলাম ভাই নিজের বউ এবং দীপার জন্য এনে রেখেছেন।কিন্তু শ্বাশুড়ি মার এক কথা,”এসব বিদেশি খাবার বড় বউ খেলে খাক।তুমি খেও না।তাছাড়া নিজের বউয়ের খোরাক জোগাতে আসুর হিমশিম খেতে হয় আর তোমার…” দীপার আরাম করতে ইচ্ছে হয়।মাতৃত্বের ভার বাড়ছে।পেটের ভেতরের শিশুটা খুব পাঁজি।মাঝেমাঝেই নড়া চড়া করে।লাথি মারে পেটের দেয়ালে।কষ্ট হয়।দীপা তখন আপন মনে নিজের অপত্যের সঙ্গে কথা বলে-“এই ছুড়ি,এতো বদমাইশি করছিস কেন রে?এই তো আর কটা দিন,পেট ফুড়ে বেরিয়ে এলে দেখবি কত্ত সুন্দর এই পৃথিবী,কত্ত সুন্দর একটা বাবা পাবি,তখন বাবার সাথে খুঁনশুটি করিস নাহয়।অসুন্দরী মাকে আর কত জ্বালাবি!” . এখন রাতে বেশ দেরী করে ফেরে আসিফ।দীপা বোকা একটা মেয়ে হলেও বুঝতে পারে আসিফের দেরী হবার কারন।সে কিছু বলে না।তার সাহস হয় না।কিসের ভিত্তিতে স্বামীকে অভিযুক্ত করবে?সে তো সত্যিই আসিফের উপযুক্ত না।স্বামী কখনো তার গায়ে হাত তোলে নি,শ্বাশুড়ী বাপের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র আনার চাপ দেন নি।যা বাড়ীর কাজ টাজ সব করায়,এটা যে কোনো অভিযোগ হতে পারে,তা দীপার মাথায় কাজ করে না।দীপার মনে পড়ে যায় জামিলের কথা।দীপার কী দেখে যে জামিল তাকে পাগলের মত ভালোবেসেছিল,তা সে জানে না।দীপার কলেজের গেটে দাড়িয়ে থাকতো।বাসার সামনে দাড়িয়ে থাকতো।শুধু এক নজর দেখবে বলে।মুখে হালকা দাড়ি,শুকনো ঢ্যাঙা ছেলেটা একদিন খুব কাকুতি মিনতি করে বলেছিল-‘দীপি,তোমার সাথে একটু কথা বলবো।প্লীজ।’ দীপা সংস্কারগ্রস্ত পরিবারের মেয়ে।ভয়ে ভয়ে বলেছিল-‘কী কথা?’ কলেজ গেইটে তখন মেয়েরা কলকল করছে। দীপার সাথে দু তিনজন বান্ধবী। জামিল বলল,’এখানে বলা যাবে না।আমার সাথে একটু চলো না,এই সাধনদার ক্যান্টিনে একটু বসে কথা বলি।’ সূর্য তখন পাটে বসছে। নরম আলোয় জামিলকে দেখে দীপার খুব মায়া হয়।সেই সকাল থেকে দাড়িয়ে আছে নিশ্চয়।চোখ মুখ চিন্তায় বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে ছেলেটার। দীপা ছেলেটার সঙ্গে প্রচুর সাহস নিয়ে সাধনদার ক্যান্টিনে এসেছিল।একটা জায়গায় মুখোমুখি বসেছিল তারা।ছেলেটা কাঁদো কাঁদো গলায় দীপার হাত দুটো মুঠো নিয়ে বলেছিল,’তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি দীপি।’ দীপা অস্ফুটে বলে,’জানি।’ ‘তোমাকেই ভাবি সব সময়।তোমার ঐ সুন্দর মুখ একদিন না দেখলে…দীপি তোমাকে বিয়ে করবো আমি,আজীবন ভালোবাসবো তোমায়…’ সেই প্রথম একটা ছেলের কাছে সে বড়ো সুন্দরী ছিল।অনেক দামী ছিল।যদিও ছেলেটার চেহারায় আসিফের মত রাজপুত্র নয়। আর বেশি কথা হয়নি।বড় ভাইয়ার দোকানে কাজ করা হাবুলকে দেখে দীপা উঠে পড়ে।ভালো করে পরিচয় হবার আগেই সেই একপাক্ষিক প্রেমের সমাপ্তি ঘটে।হাবুল গিয়ে বড়দাকে বলে দেয়।দীপাকে জবরদস্ত একটা বকা খেতে হয় সেদিন।তারপর বেশকিছু দিন ঘরের থেকে বের হতে দেয়া হয় না তাকে।আসলাম ভাইও ওই সময় প্রস্তাবটা নিয়ে আসেন।পরীক্ষার পরই বিয়ে হয়ে যায় দীপার।শুধু জানতো জামিল নামের ছেলেটা সেলসে ছোটো চাকরী করে।দোকানে বাতচিত করতে যাওয়ায় ছেলেটাকে মারে বড়দা।এই… দীপা গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যখন দেখে তার স্বামী বারান্দায় আয়েশ করে সিগারেট টানতে টানতে কোনো এক প্রাপ্তির সাথে সুখগল্প করছে,তখন তার নিজেকে মনহয় একটা নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের মত।আশেপাশে বহু মানুষ আছে,কিন্তু মনের দূরত্ব লক্ষ আলোক বর্ষ।আচ্ছা সে যদি ভালো মেয়ে না সেজে জামিলের হাত ধরে পালিয়ে যেত,তবে আজ তাকে কি এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো?না বোধহয়।তখন জামিল আদর্শ প্রেমিক স্বামীর মতই গর্ভবতী দীপার পেটে কান রেখে শুনতে চেষ্টা করতে অপরিপক্ব সন্তানের স্পন্দন। . দীপার পেটে বাচ্চাটা যতো বড়ো হচ্ছে,ততো তার কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে।আগের মত কাজ করতে পারে না আর,অনেক কষ্ট হয়।বড়জার মায়া হয় বলে এখন একটু আকটু হাত লাগায়।শ্বাশুড়ি মা অবশ্য বলেন,”শুয়ে বসে থেকো না।হাঁটা চলা করো।কাম কাজ করলে ব্যায়াম হয়।বেশি আরাম করলে মোটা হয়ে যাবে।পরে পেট কেটে টাকা একরাশ লাগিয়ে বাচ্চা বের করতে হবে বলে দিলাম।সিজার করানোর টাকা কে দিবে শুনি?বাপের বাড়ি তো ঢু ঢু।” নির্জন বিকেলে সময় করে দীপা ওর পেটের বাচ্চাটার সাথে প্রচুর খেঁজুরে আলাপ করছে আজকাল-“মাকে ভুলে যাবার জন্যই পৃথিবীতে আসবি সোনামণি?নাড়ি ছাড়া হলেই তো দেখবি বাপকে,দাদীকে,খুব ভালো একটা জেঠুকে।সবার আদর খেতে খেতে আমার আদর খাবার টাইম পাবি নারে!” “আদরের খনি আমার,তুই কার মতো দেখতে হবি রে?মার মতো নিশ্চয়ই হবি না…” “হ্যা রে,আমার এখন আর আগের মত খিদে লাগে না।তোর খুব লাগে,না?” “এই নানুবাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে তোর?কিন্তু নানুরা পঁচা,তোর মামা কে বলেছিলাম কিছু দিনের জন্যে নিয়ে যেতে,তোর পঁচা মামাটা আসবে আসবে করে আর আসলো না।বাড়িতে নাকি জায়গা কম।” “হ্যা রে তুই বড়ো হলে নিজের মনের মানুষকে বিয়ে করিস,যে তোকে প্রচ্চুর ভালোবাসবে,তোর আম্মুটা কিচ্ছু বলবে না,বিশ্বাস কর।” . ধেড়ে ইঁদুরটা এখনো আছে।গতকাল আসিফ আলমারি খুলে দেখে তার অনেকগুলো দামি শার্ট নালায়েকটা কেটেকুটে ছাড় খার করে দিয়েছে।দীপার সন্তান জন্মদানের ডেট ঘনিয়ে আসছে।সাড়ে আটমাসে পড়েছে সে।আসিফ খেকিয়ে উঠে-“মরার মত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ।ইঁদুরটা মারার জন্য কি আমি ভাড়াটে গুন্ডা ঠিক করবো?” দীপা বলে,”ইঁদুর মারার বিষ দিয়েছিলাম সেদিন।তোমার ঐ বিষে ভেজাল আছে।”
তারপর সুর পাল্টে বলে,”হ্যা গো,বাচ্চাটা হওয়ার সময় যদি আমি মরে টরে যাই,তখন আমার খুকুমণিকে তুমি দেখবে তো?” আসিফ রেগে যায়,”এইসব ছাগলা কথা রাখো।এইটা ছাগলা কথা বলার সময় না।আন্ডারস্টান্ড?” তারপর বলল,”ইস্,আমার ইজি ব্রান্ডের শার্টটার কি অবস্থা করেছে!প্রাপ্তির খুব পছন্দের—“ বেফাঁস কথা বলে ফেলায় সে মনেমনে নিজে প্রচুর ধমকায়।দীপার মুখ নির্বিকার দেখে একটু আশ্বস্ত হয়। তারপর ইঁদুরটার সদগতি করতে দোকানে অরিজিনাল দামী বিষ আনতে যায়। . দীপাকে চেক আপ করে ডাক্তার শাহরিয়ার আসিফকে ধমকায়,”মেয়েটার অবস্হা এ কি করেছেন আপনারা!ওজন আগের চেয়ে কমে গেল কেন!পুষ্টিকর খাবার দাবার মনে হচ্ছে খেতে দেন না।এখন যা খাবে সব বাচ্চার জন্য,নিজের জন্য না,এইটা বুঝেন না আপনারা?” বাসায় ফিরে দীপা গোসল করে।আসিফ অফিসে যাবার আগে বলেছিল,”মাকে বলার দরকার নাই।হোয়াইট হাউজ থেকে তোমার জন্যে খাবার আসছে—“ দীপা গোসল টোসল করে এসে দেখে খাটের নীচে একটা বড়ো পিজ্জার প্যাকেট।কৃতজ্ঞতায় দীপার মন ভরে যায়।আজ আর ঝোল ভাত খেতে ইচ্ছে করছিলো না,এই খাবার এখন পেটের সন্তানটাকে একটু শান্ত করবে,কিছুক্ষন ধরে হাত পা ছুঁড়ছে বেচারা!
দীপা পিজ্জা খেতে থাকে।একটা অদ্ভূত ঘ্রাণ টের পেলেও তার ভালোই লাগে।খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে আসার পর দেখে,আলমারির কোনা থেকে ধেড়ে ইঁদুরটা তার দিকে ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে আছে।চোখ দুটি কেমন যেনো বিষন্ন।হয়তো দীপার বিরাট পেটের দিকে তাকিয়ে তার মায়া লাগছে।দীপা ভাবতে থাকে। এমন সময় তীব্র চিনচিনে একটা ব্যথায় দীপা অনুভব করে একটা তরল তার উরু বেয়ে নামছে।বাথরুমে যাবার শক্তি পায় না সে।বসে পড়ে মেঝেয়।কালচে লাল রক্তে সব ছেয়ে যেত থাকে।একটা পিন্ড,কালচে লাল পিন্ড বের হলে সে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায়।বড়জা আর মা ছুটে আসেন…তারপর হাসপাতালে নেবার তোড়জোড় চলতে থাকে আর অফিসের কাজে মগ্ন থাকার অভিনয় করা আসিফ নিজের মনকে প্রশ্ন করতে থাকে, -“দুইটা পিজ্জার একটা দেরাজে।একটা বাথরুমের সামনে খাটের নীচে।একটা নিরাপদ,আরেকটায় বিষ দেয়া।এক্ষেত্রে চান্স ফিফটি ফিফটি।বোকা মেয়েটা মরলেও আমার ঘাড়ে দায় আসার চান্স আছে?” -“না নেই।” -“কেন?” -“ইঁদুর মারার জন্যই খাটের নীচে পিজ্জা রেখেছিলাম।ধেড়ে ইঁদুরটা পিজ্জা ভালোবাসে,সবাইয়র জানা।আর বিষ ছাড়াটা তো দেরাজে,আমি কিন্তু আস্তে বলে গেছিলাম,দেরাজেরটা খেও,হে হে,আমার মনে পাপ ছিল না।” -নাসরুল্লাহ রুহী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে