বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এমন একজন বন্ধু থাকে যে কোন কারন ছাড়াই ক্লাসের মেয়েদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় থাকে। ক্লাসে মেয়েদের পাশে বসে; একসাথে গ্রুপ স্টাডি করে, টি এস সি-তে আড্ডা মারে, নীরব হোটেলে খেতে যায়, পহেলা বৈশাখে পাঞ্জাবী পড়ে শাড়ি পড়া মেয়েদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। তাকে দেখে ক্লাসের অন্যান্য ছেলেদের জ্বালা ধরে। হিংসে লাগে, ঈর্ষান্বিত হয়।
রাজুকে দেখলে আমাদের গায়ে জ্বালা ধরতো। প্রথম দিকে রাজু আমাদের ভালো বন্ধু ছিল; ছেলেটাকে দেখে আমাদের সবার মায়া হতো। ইশ বেচারার পূর্বপুরুষ হয়তো আফ্রিকা থেকে এসেছে। একদম কালামানিক। ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ার। আমরা সবাই জীবনে প্রথমবার মেয়েদের পাশে বসে ক্লাস করছি। কিছুক্ষন পর পর চুলের স্টাইল ঠিক করছি। আড়চোখে লক্ষ্য করছি মেয়েরা কি করে। সেই সময় রাজুর জন্য আমাদের কষ্ট হতো। বেচারা এত কালো এত কালো যে আমরা ভাবতাম কে ওর সাথে কথা বলবে, কে মিশবে ওর সাথে। আমরা সবাই মনে মনে ঠিক করে রাখতাম যদি মেয়দের সাথে কথা বলতে যাই তাহলে রাজুকে নিয়ে যাবো তাহলে কোন বিপদ নাই। অন্য কোন ছেলেকে নিয়ে গেলে আমাকে বাদ দিয়ে যদি সেই ছেলেকে পছন্দ করে ফেলে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের ভুল ভাঙলো। যখন আমরা বুঝতেই পারছিলাম না আসলে মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করতে হলে আমাদের কি করা উচিত। মেয়েদের সাথে হ্যাংলার মত আগ বাড়িয়ে কথা বলা উচিত নাকি ভাব নিয়ে থাকা উচিত। সেই সময় আমরা প্রথম লক্ষ্য করলাম রাজু রীতিমত মেয়েদের সাথে আড্ডা জমিয়ে বসেছে। আমরা বন্ধুরা যখন কার্জন হলের মাঠে বসে কোন মেয়ের রুপ নিয়ে, চোখ নিয়ে, হাসি নিয়ে, কথার স্টাইল নিয়ে আলোচনা করছি; একে অপরকে সাবধান করে দিচ্ছি তুই ওর দিকে তাকাবি না আমি ওকে আগে পছন্দ করেছি; তখন আমাদের চোখের সামনে দিয়ে রাজু সেই মেয়ের সাথে রিকশা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবচাইতে দুঃখের দিন; যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট। আমরা ক্লাস বন্ধ দেখে সবাই আলোচনা করছিলাম কি করা যায়। তখন দেখি রাজু বান্ধবীদের নিয়ে কোথায় জানি যাচ্ছে। ১০ টা মেয়ে ১ টা ছেলে। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম
দোস্ত কই যাস?
আজকেতো ক্লাস হবে না। আমরা সিনেমা দেখতে যাই। মনের মাঝে তুমি।
তখন আমাদের মনের মাঝে রীতিমত ঘূর্ণিঝড়। শালা রাজু ব্যাটা অন্ধকারে মেয়েদের কোলে বসে সিনেমা দেখবে আর আমরা আঙ্গুল চুষছি। সারাটা বচ্ছর কার্জন হলের মাঠে প্ল্যানই করে গেছি কিভাবে কথা বলবো, কিভাবে ঘুরবো, কোথায় ঘুরবো। আর শালা রাজু সারাদিন মেয়েদের সাথে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একসাথে ক্লাস, খাওয়া, দাওয়া, গ্রুপ স্টাডি, সিনেমা দেখা; আমরা হিংসার আমাদের মাথার চুল ছিঁড়ছি। এক জ্ঞানী বন্ধু ছিল। আমরা যখন রাজুর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছি সে তখন বলল দোস্ত রাজু আমাদের জন্য কোন থ্রেট না।
কি কস? ও সবার সাথে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাস্তি করছে। সিনেমা দেখছে। কোন কিছু কি বাকি রাখছে?
দোস্ত রাজু শুধু কাউয়া ফিলিংস পাচ্ছে। আর কিছু না।
জ্ঞানী বন্ধুর জ্ঞানী কথা আমাদের বোধগম্য হল না। কাউয়া ফিলিংস ব্যাপারটা কি? জীবনেও শুনি নাই।
শালা গাড়ল। কাউয়া ফিলিংস হচ্ছে রাজু মেয়েদের পাশে বসবে, সারাদিন গল্প করবে, সিনেমা দেখবে, একসাথে ঘুরবে, কনসার্টে যাবে, নদীর পারে যাবে; কিন্তু অতটুকুই তার দৌড়। সে শুধু দেখে যাবে কিন্তু ছুতে পারবে না। মুখ দিয়ে লালা ঝড়বে কিন্তু খেতে পারবে না। এটা হচ্ছে বাবুর্চির মত রান্না করবে কিন্তু খাবে অন্য লোক। এটাকেই কাউয়া ফিলিংস বলে।
ব্যাটা বাবুর্চি টেস্ট করে দেখে না। মাঝে মাঝে আঙ্গুল চুবিয়ে।
দোস্ত এই বাবুর্চি সেটাও পারবে না। অনলি কাউয়া ফিলিংস রিয়েল আর বাকি সব মিথ্যা।
তখন থেকে আমরা যতই হিংসে করি রাজুকে দেখলেই আমরা বত্রিশ দন্ত বের করে বলতাম কিরে কাউয়া ফিলিংস কেমন চলছে।
রাজু প্রথমে বুঝতো না। আমাদের দিকে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিতো। উচ্চস্বরে হো হো করে হাসতো। হুম আঙ্গুর ফল টক। পাই না তো খাই না।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। রাজু বারন করেছে কিনা জানি না মেয়েরা আমাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতো। আমাদের ব্যক্তিত্ব পানির সাথে ধুয়ে গেলো। আর রাজুর সাথে দেখা হলেই ও একটা অট্টহাসি হাসি দিয়ে বলতো; হয় নারে দোস্ত। সবাই কি জীবনে সব কিছু পায়।
আমরাও ছেড়ে কথা বলতাম না। শালা পাসতো শুধু কাউয়া ফিলিংস। এটা নিয়ে এত লাফালাফি করার কি আছে।
একসময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ইতি হলো। কনভোকেশনের দিন আসলো। সেদিনও মেয়েদের সাথে রাজু যে কয় হাযার ছবি আর সেলফি তুললো আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। আমরাও যে দুই একটা তুলি নাই, তা না। সেটাও রাজুর ভাব ছিল আমাদের সুযোগ দিয়ে সে ধন্য করেছে।
আমরা যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু আমাদের জীবনে দুঃখ থেকে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মেয়েদের সাথে না মিশতে পারার দুঃখ। একসাথে সিনেমা না দেখতে পারার দুঃখ আর রাজুর সেই অট্টহাসি। আমরা নিশ্চিত ছিলাম আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা কোথাও দেখা করতাম ঠিক সেই সময় রাজু আমাদের কোন বান্ধবীকে নিয়ে রিকশা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজুকে আমাদের আড্ডায় ডাকতাম না এবং আমাদের আড্ডায় নিয়মিত রাজুর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার হতো।
এর মধ্যে আমরা খবর পেলাম রাজু একটা গার্লস কলেজের টিচার হয়েছে। আমাদের দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ হল। একসময় সে ছিল ফাস্টফুডের দোকানে, আইটেম ছিল লিমিটেড। এখন তার স্থান হয়েছে ফাইভ স্টার হোটেলে। আনলিমিটেড অফার।
পৃথিবীতে ন্যায়বিচার বলে যে একটা ব্যাপার আছে তার উপর আমাদের বিশ্বাস এবং আস্থা দুটোই উঠে গেলো। ততদিনে আমরা বিয়ে শাদি করে ঘর সংসার করছি।
হটাত একদিন আমার সাথে রাজুর দেখা। রাজুর চেহার বিমর্ষ। ভাবলাম অতি সুখ যে শুধু মানুষকে আনন্দিত করে তা না বিমর্ষও করে। বললাম বন্ধু খবর কি।
বলে দোস্ত খবর ভালো না।
কেন? গার্লস কলেজের টিচার; এর থেকে ভালো চাকরী কি হতে পারে? মেয়েদের নয়নের মনি।
দোস্ত তোরা যে আমাকে তখন বলতি আমি শুধু কাউয়া ফিলিংস নেই। বিশ্বাস কর আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু তোদের অভিশাপ লেগে গেছে।
কেমনে?
দোস্ত আমার বিয়ে হয় নাই। আমার সামনে সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা ঘুরাফেরা করে; কথা বলি, ক্লাস নেই, পড়া দেখিয়ে দেই; গল্প করি; কিন্তু অতটুকুই; এর বেশী আর আগায় না। আমি যে চেষ্টার কোন ত্রুটি রেখেছি তা না। কিছুদিন আগে একটা মেয়েকে ডাইরেক্ট অফারও দিয়েছিলাম। সেই মেয়ে গিয়ে কলেজের চেয়ারম্যানেকে জানিয়ে দিয়েছে। কোনরকম ইজ্জত বাচিয়েছে। জীবনে এত সুন্দরী সুন্দরী মেয়ের সাথে মিশছি এখন সাধারন কাউকে ভালোও লাগে না। আমি দিনে দিনে আরো হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছি। কাউয়া ফিলিংসের চক্র থেকে বের হতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় এই জীবন রেখে লাভ কি? অবস্থা বুঝ তুই বিয়ে বাড়িতে গেছিস, সামনে রোস্ট, রেজালা, কাচ্চী, গ্রিল, বোরহানি, জর্দা, পায়েস; মৌ মৌ গন্ধ। কিন্তু তুই খেতে পারছিস না। এবং সেটা আজ থেকে না সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে। দোস্ত তোরা আমার জন্য খাস দিলে দোয়া করিস যেন এই চক্র থেকে বের হতে পারি।
আমি রাজুর হেঁটে যাওয়া দেখছি। না পৃথিবীতে এখনো ন্যায়বিচার শেষ হয়ে যায়নি। মনটা হটাত বেশ ফুরফুরা লাগছে। রাজুর জন্য দুঃখও হচ্ছে। থাক বেচারা কিছুদিন কষ্ট পাক। এরপর আমরা সবাই মিলাদ দিয়ে ওর শনির চক্র কাটিয়ে দিবো। গুনগুন করে গান গাইছি; অনেকদিন পর বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেলো।
মৌসুমী কারে ভালোবাস তুমি
মৌসুমী বল কারে খোঁজ তুমি
মৌসুমী আছি একা এই আমি
ভূলে অভিমান হও সঙ্গীনি।
তুমি আছ প্রান স্পন্দনে
তুমি আছ হাসি ক্রন্দনে
অপরাজিতা নন্দিনী
চেয়ে দেখ তুমি ঐ চোখে
তুমি আছ সুখ আর দুঃখে
এঁকে যাই শুধু তোমার মুখছবি।
#আমিনুলের গল্প সমগ্র