#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা:সালসাবিল সারা
৪৫ এবং শেষ…
রাণী পিছু হটলো।সিমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।রাণীর বুকের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।সিমির হাতের লাঠি কেড়ে নিলো নাজিম।সে বর্তমানে অশ্রু বিসর্জন করছে।সিমির গায়ে প্রতিহিংসার তেজ বাড়লো হাজারগুণ।নাজিম লাঠি দিয়ে পুনরায় আঘাত করলো সিমির গায়ে।সিমি নড়লো না।কেমন যেনো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।রাণী চেয়ারে বসে হাঁপাচ্ছে।মিনিট চারেক আগে যদি নাজিম না আসতো,তাহলে আজ রাণী আর তার অনাগত সন্তানের শেষ দিন হতো এই দুনিয়ায়।রাণী কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।নাজিমকে ফেলে সে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করতেও নারাজ।মনে মনে রাণী আল্লাহ্ এবং তূর্যয়কে স্মরণ করছে।নাজিম সিমির গায়ে আঘাত করে চিল্লিয়ে উঠলো,
—“অনেক পাপ করিয়েছিস তুই আমাকে দিয়ে।আর না।এই অনাগত বাচ্চা আর রাণীকে আমি কিছুই হতে দিবো না।আগে একটা ভয়ে ছিলাম তুই কিছু করবি বলে।তবে আমার মনে হয়,আজই তোর ইহকালের শেষ দিন।”
সিমি নাজিমের হাতের লাঠি ধরে ফেললো।নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে সিমি নাজিমের হাত থেকে লাঠি নিয়ে সেই লাঠির মাধ্যমেই নাজিমের মাথায় জোরে আঘাত করলো,
–“বিশ্বাসঘাতক!তুই একটা হারামজাদা,নাজিম।কি ভেবেছিস তুই,আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পার পেয়ে যাবি?আজ এই রাণীর সাথে তুইও মরবি।”
নাজিমের মাথায় আবারও আঘাত করলে নাজিম জোরে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।রক্তে মেঝে ভিজে যাচ্ছে।আবছা আলোয় সবটা যেনো একেবারে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।রাণীর শরীরের কম্পনের হার বাড়তে লাগলো।সিমি বিশ্রীভাবে হেসে রাণীর দিকে এগিয়ে আসছে।রাণী হাত জোড় করে অনুনয় করলো,
–“দোস্ত,আমাকে মারিস না।আমার বাচ্চার কথাটাও তো একবার ভাব।এতো মানুষকে খুন করছিস তুই,
পরকালে আল্লাহ্ এর কাছে কি জবাব দিবি?”
সিমির রাণীর কাছাকাছি এসে তার চুলের মুঠি টেনে ধরলো।পরপর দুইটা ঘুষি দিলো রাণীর মুখে।এতেই রাণীর নাকে আঘাত পেয়ে তাজা রক্তের সমাহার বয়ে গেলো। নাকের এই চিনচিন ব্যাথাটা রাণীর সম্পূর্ণ শরীরকে নাড়িয়ে তুলছে।
–“ব্যাথা লাগছে, রৌ… দ্র! আহহহ,কই?আজ তোর দানব সন্ত্রাসী কই?তার বউ আর বাচ্চা নিখোঁজ,এটা সে টের পেলো না! আহহহহা,তোর দানব সন্ত্রাসীর অতি প্রেম আজ ফুঁস হয়ে যাবে রে,রাণী সুন্দরী।কই যে তোর বাচ্চার বাপ!”
কথাটা বলে রাণীর গলা চেপে ধরলো সিমি।রাণী হাঁসফাঁস করছে।খুব সাহস জুগিয়ে সে সিমির পেটের ডানদিকে জোরে একটা আঘাত করলো।সিমির পেট যেনো এখনই ছিঁড়ে যাবে।রাণীর এহেন আচরণে সিমি দাঁতে দাঁত চেপে আবারও তেড়ে এলো রাণীর দিকে।রাণীর গালে জোরে চড় দিয়ে সিমি চেঁচিয়ে উঠলো,
–“শয়তানের বাচ্চা,এখনো তোর তেজ কমে না?বাচ্চা পেটে নিয়ে এতো শক্তি কিভাবে পাচ্ছিস!কি ভেবেছিস,
এইসব করে সময় নষ্ট করবি আর তোর দানব এসে আমাকে মেরে ফেল…”
–“ঠিক তাই। রৌদ্রের দানব এসেছে,এখন তোকে মারবে সে।”
এমন কণ্ঠস্বর শুনে রাণীর যেনো প্রাণ ফিরে এলো।আর সিমির যেনো প্রাণ ভোমরা এখনই দেহ ত্যাগ করবে।সিমি নিজের প্যান্টের মধ্যভাগ থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করে রাণীর গলায় রাখলো।এরপর সে তূর্যয়কে শাসিয়ে বলে উঠলো,
–“আমি মরে গেলেও এই মেয়েকে মেরে এরপর মরবো।অনেক অনেক বছরের সাধনা এটা আমার।এতো সহজে আমি এই মেয়েকে বাঁচতে দিবো না।”
তূর্যয় নিজের ঠোঁট বাঁকা করলো,
–“ওহ! ভয় পেয়েছি আমি তোর ধমকে।”
কথাটা বলে তূর্যয় এক কদম সামনে পা বাড়াতেই রাণী অনুরোধ করলো তূর্যয়কে,
–“প্লিজ,কাছে আসবেন না।এই মেয়ের মাথা ঠিক নেই।আপনার কিছু হয়ে যাবে।”
–“রৌদ্র!চোখ বন্ধ করে রাখো।এখন যা ঘটবে সেটা সহ্য করতে পারবে না তুমি।”
তূর্যয়ের কথায় রাণী কিছু একটা আন্দাজ করলো।রাণী চোখ বন্ধ করতেই খুব জোরে পিস্তলের শব্দ শুনতে পেলো।সাথে রাণীর নিজের গলায় থাকা সিমির হাতটার বাঁধনও হালকা লাগতে লাগলো।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সিমি ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলো।তূর্যয় সিমির কাঁধ বরাবর দুইটা গুলি করেছে।সিমির দেহে এখনো প্রাণ আছে।কেমন যেনো আর্তনাদ করছে সে।তূর্যয় দ্রুত এগিয়ে এলো রাণীর দিকে।রাণীর নাকে মুখে লেগে থাকা রক্ত তূর্যয় নিজের শার্টের হাতা দিয়ে মুছে দিচ্ছে।তূর্যয়ের ভেতরে উথাল পাথাল ঝড় বইছে রাণীর এই অবস্থা দেখে।তূর্যয় নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখতে চেষ্টা করছে। কারণ,এখন তূর্যয়কে বিচলিত হতে দেখলে, রাণী নিজেই ভেঙে পড়বে।তূর্যয় ধীরে রাণীর নাক থেকে রক্ত পরিষ্কার করছে নিঃশব্দে।রাণী তূর্যয়ের হাতে হাত রাখলো।তূর্যয়ের গার্ডরা ভেতরে আসতেই প্রধান গার্ডকে উদ্দেশ্য করে তূর্যয় তাকে বলে উঠলো,
–“নাজিম বেঁচে আছে নাকি দেখো।যদি বেঁচে থাকে তাহলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।সুস্থ হলে তার সাথে আমার বেশ কিছু কথা বলতে হবে।আর এই মেয়েকে আস্তানায় নিয়ে যাও।চিকিৎসার দরকার নেই।এই মেয়ের জন্যে বরাদ্দ শাস্তি ফরহাদ দিবে।”
তূর্যয়ের কথায় কিছু গার্ড নাজিমকে নিয়ে গেলো।আর ফরহাদ এসে সিমিকে উঠিয়ে নেওয়া অবস্থায় তাকে বলে উঠলো,
–“বস,শাস্তি কিভাবে দিবো?ফিঙ্গার কাটার নাকি অন্য ব্যবস্থা?”
–“তুমি তো জানোই,আমি মেয়েদের খুন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না।প্রথমে তার আঙ্গুলগুলো কাটবে।এরপর তার দুই পা ভেঙে দিবে,যেমনটা সে এতদিন অভিনয় করে এসেছে পঙ্গু হওয়ার।গরম পানির শাস্তিটা আর বলে দিতে হবে তোমাকে?”
তূর্যয়ের হিংস্রতা মাখা কণ্ঠ।
–“নাহ বস,বুঝেছি।এইভাবেই আটকে রাখবো তাকে রুমে যতদিন না সে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করে!”
–“হুম। যাও এখন।”
তূর্যয়ের কথায় ফরহাদ এসে নিয়ে যাচ্ছে সিমিকে।সাথে আরো দুইজন গার্ড সিমিকে আঁকড়ে ধরেছে।ব্যাথায় সিমির জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।তূর্যয়ের মুখে এমন হিংস্রতার নমুনা শুনে সিমি অর্ধমৃত হয়ে গেলো।নিজের পাপের শাস্তি সে ইহকালে পেয়ে যাবে এটা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। পরকালের শাস্তি কথা ভাবতেই সিমির দুনিয়া ঘুরতে লাগলো।সিমি ধীরে ধীরে নিজের চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো।তার জীবনটা এখন আর জীবনে নয় নরকে পরিণত হবে,যতক্ষণ না সে মৃত্যুবরণ করছে।
————–
রাণীর চোখ বর্ষণমুখর।সে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছে, এই নিয়ে বারবার শোকরিয়া প্রকাশ করছে আল্লাহ্ এর দরবারে।তূর্যয় রাণীর নাকের রক্ত একেবারে সাফ করে দিয়েছে।সিমির প্রতি তূর্যয়ের রাগ যেনো আকাশ সমান হয়েছে।সিমিকে যতো কষ্ট দিয়ে খুন করা যায় সেইসব ব্যবস্থা করে নিয়েছে তূর্যয়।রাণীর গালে হাত রেখে তূর্যয় নরম কণ্ঠে রাণীকে বলে উঠলো,
–“ডিভাইস টের পেয়েও বন্ধ না করার জন্যে ধন্যবাদ।এই ডিভাইসের জন্যেই সেই শয়তানকে ধরতে পেরেছি।বেশ ভয় পেয়েছিলাম তোমাদের জন্যে।”
রাণী নিজ হাতে নিজের চোখের পানি মুছে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“আমিও।আমি ভে… ভেবেছি আজ আমার দুনিয়ায় শেষ দিন।বাবুর জন্যে বেশি ভয় পেয়েছি আমি।সে তো এখনো পৃথিবী দেখলো না।”
তূর্যয় রাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো,
–“বাবুর বাবা থাকতে তার কি কোনো ক্ষতি হতে পারে?তাছাড়া রৌদ্রের দানব সন্ত্রাসী তার রৌদ্রকে সর্বদা আগলিয়ে রাখবে।চিন্তার কারণ নেই কোনো।বন্ধুমুখী শত্রুটার পতন ঘটেছে।ঘরের যতো শত্রু ছিলো সবারই চিরবিদায় হয়েছে।আর কোনো ভয় নেই।বাহিরের শত্রুর জন্যে আমি একাই যথেষ্ট। বাহিরের শত্রু থেকে আপনজনের মধ্যে কেউ শত্রু হলে সেটা বেশি ভয়ংকর।বাহিরের শত্রুকে চিহ্নিত করা যায়,আপনজনদের মধ্যে থাকা শত্রুকে না।”
রাণী কিছু বললো না।তার গায়ে ব্যাথা করছে।রাণীর জবাব না পেয়ে তূর্যয় রাণীকে ধীরে দাঁড় করালো।এরপর রাণীকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগলো তূর্যয়।গাড়িতে বসেও রাণীকে নিজের কোল থেকে নামালো না সে।একজন গার্ডকে গাড়ি চালানোর জন্যে আহ্বান জানালো তূর্যয়।গাড়ি চলতেই ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে রাণীর নাকের ক্ষতে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছে সে।ইতিমধ্যে তূর্যয় রাণীকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে তার সম্পূর্ণ শরীর চেক আপ করে নিয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক দেখে তূর্যয় আর রাণী হাসপাতাল থেকে বের হলো।
গাড়ি বাসার কাছাকাছি যেতেই রাণী নরম কণ্ঠে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“বাসায় যাবো না।সমুদ্র দেখবো।”
তূর্যয়ের ওষ্ঠদয় রাণীর কপালের কিনারায় স্পর্শ করলো,
–“আচ্ছা।”
জনমানবহীন সমুদ্রের একধারে বসে রইলো রাণী আর তূর্যয়।রাণীর দৃষ্টি সমুদ্রের উথাল পাথাল ঢেউয়ের দিকে।রাণী ভাবছে,তার জীবনটাও ঠিক এমন উথাল পাথাল ঢেউয়ের মতো ছিলো আজ পর্যন্ত।সিমির আসল সত্যিটা জানার পর এই উথাল পাথাল ঢেউয়ের বদলে রাণী নিজের জীবনকে ঠিক স্থির সমুদ্রের মতো কল্পনা করছে।যেই জীবনে শুধু তার দানব সন্ত্রাসী,
অনাগত সন্তান আর কিছু আপন মানুষজন আছে।রাণীর চোখে জ্বালা করছে।অতীতের কথা ভাবতেই টুপ করে তার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।তূর্যয় রাণীকে লক্ষ্য করছে এতক্ষণ যাবত।রাণীর মনের অবস্থা তূর্যয়ের অজানা নয়।তূর্যয় রাণীর কাঁধে হাত রাখলো।তারা এইখানে এসেছে অনেক্ষণ হলো।তূর্যয় রাণীকে ধীর গলায় নির্দেশ দিলো,
–“অকারণে চোখের পানি ফেললে কিন্তু একেবারেই গিলে নিবো তোমাকে।”
রাণী কান্নার মাঝেও হেসে উঠলো,
–“আপনি কি রাক্ষস নাকি, যে আমাকে গিলে নিবেন?আমাকে কি বাচ্চা মনে হয়!”
তূর্যয় রাণীর গাল টেনে দিয়ে তাকে বললো,
–” শুনেছি,কান্নার মাঝে হাসা মানুষগুলো নাকি বেশি আদুরে হয়।কথাটা একেবারে ষোলো আনা সত্যি।এইযে তোর নাক মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে আবার তুই হাসছিস,তোর এই রূপ দেখে নতুনভাবে প্রেমে পড়েছি আমি।”
রাণী লজ্জায় গাল গরম হয়ে এলো।রাণী তূর্যয়ের কাঁধে মাথা রাখলো।নরম কণ্ঠে সে মাথা নিচু করে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“আমি সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে চাই,তূর্যয়।আপনার বাহুডোরে থাকতে চাই সর্বক্ষণ।”
তূর্যয়ের হাত পেঁচালো রাণীর কোমরে।সে বেশ আবেগমাখা গলায় বলে উঠলো,
–“সারাজীবনই তো থাকবি তুই আমার সাথে,আমার বাহুডোরে।আমার ভালোবাসার জোয়ারে তোকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবো দূর দূরান্তে।সারাজীবন আমার এই কঠোর আবেগ,ভালোবাসা,তীব্র স্নেহ সবই তোকে সহ্য করতে হবে।কখনো যদি ভালবাসতে বাঁধা দিস তো, জোর করে সেই ভালোবাসা আমি আদায় করবো। শাস্তিস্বরূপ তোকে ভোগ করতে হবে আমার হিংস্রতাময় রোমান্টিকতা।বুঝছিস তো আমি কি বলতে চেয়েছি!”
–“আপনার বাচ্চা আপনার এইসব আমল করছে।আপনার কি লজ্জা শরম নেই?”
–“উম, চল বাসায়।একেবারে দেখিয়ে দিবো তোকে আমার লজ্জা শরমের বর্তমান অবস্থা।”
রাণী চোখ বড় করে তূর্যয়কে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে উঠলো,
–“ছি!কিসব বাজে কথা বলছেন।আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
–“যেতে তো হবে সুন্দরী।বাচ্চার সামনে এখন এটা আমার প্রেস্টিজের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ালো।আর ছাড় দিচ্ছি না আমি তোমাকে।তোর দানবের ভালোবাসার মাত্রা আমাদের বাবুকেও তো বুঝতে হবে।”
রাণী লজ্জায় মুখে হাত রাখলো।তূর্যয় সেদিকে তোয়াক্কা করলো না। সে রাণীর হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ির দিকে।আজ তূর্যয়ের মুখে গুনগুন গান শুনতে পাচ্ছে রাণী।সে বুঝতে পারছে,আজ তূর্যয়ের ভালোবাসার মাত্রা হবে অন্যরকম,একেবারেই ব্যতিক্রম।আবেশে রাণীর হাত পা যেনো ঠান্ডা হয়ে আসছে।
————
হ্যারি আর অ্যাঞ্জেলা তাদের বিয়ের দুইমাসের মধ্যে বাংলাদেশে চলে এসেছে।অ্যাঞ্জেলা হ্যারির কাজকর্মের উপরই ফিদা হয়ে হ্যারিকে বিয়ে করেছে।হ্যারির এই মাফিয়াগীরি অ্যাঞ্জেলার সবচেয়ে বেশি পছন্দ।বাংলাদেশে আছে তারা প্রায় চার বছর হলো।কিন্তু তূর্যয় আর হ্যারির কাজের চাপ থাকায় আজ পর্যন্ত তারা কোথাও ঘুরতে গেলো না।তাই সবাই মিলে ঠিক করেছে আজ তারা কোথাও ঘুরতে যাবে।সবশেষ তারা ঠিক করলো সবাই মিলে হ্যারি আর তূর্যয়ের যৌথভাবে কেনা ফার্ম হাউজে যাবে।বাংলাদেশের মধ্যে তাদের দুইজনের কেনা এই ফার্ম হাউজ সুন্দরের ও আলিশানের দিক দিয়ে অন্যতম।এই ফার্ম হাউজ সব বড় বড় লিডার তাদের পার্টি,অনুষ্ঠান,ব্যাক্তিগত কাজে বা হ্যারি ও তূর্যয়ের ব্যাবসায়িক কাজে ব্যবহার করা হয়।
সবাই আজ বেজায় খুশি।সেই খুশিতে শামিল হয়েছে রাণী আর তূর্যয়ের একমাত্র ছেলে “আদ্রিব”।যে এখন তূর্যয়ের সারা ঘর মাতিয়ে রাখে।
তূর্যয়ের রোমাঞ্চকর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছিলো রাণী।সকালের দিকেই তার ঘুম যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।কিন্তু তা আর হলো না আদ্রিবের জন্যে। আদ্রিব ঘুম থেকে উঠেই রাণীর রুমে চলে এসে তাকে ডাকাডাকি করছে,আদ্রিবকে তৈরি করে দিতে। হায়াও নাড়াতে অক্ষম আদ্রিবকে।আদ্রিব রাণীর গায়ের উপর উঠে তার ছোট হাতের স্পর্শে রাণীর মুখে কয়েকবার হালকা চড় দিয়ে তাকে বলতে লাগলো,
–“মা মা মা,আমাকে রেডি করিয়ে দাও।আমি বেড়াতে যাবো তো।”
–“হায়া,আদ্রিবকে রেডি করিয়ে দাও প্লিজ।আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে।”
রাণীর ঘুমমাখা কণ্ঠ।
–“ভাবী,আদ্রিব আমার কোনো কথা শুনছে না।আমি কী করবো বলুন!”
রাণী না পারতে উঠে বসলো।ঘুমন্ত চোখজোড়া বেশ কষ্ট করে খুলে আদ্রিবকে দেখলো রাণী।আদ্রিবের চোখ, নাক,মুখের গঠন একেবারেই তূর্যয়ের মতো।শুধুমাত্র রাণীর গায়ের রং পেয়েছে আদ্রিব। গত রাতে আদ্রিব হায়ার সাথে ঘুমানোর জিদ করেছিল।আদ্রিব জিদ করলে সেটা আর কেউ থামাতে পারে না।অগত্য সে হায়ার সাথেই ছিলো রাতে।এখন ছেলেকে দেখে রাণীর বুকটা ভরে উঠলো।ছেলেকে কোলে নিয়ে মাথায় তিন চারটা চুমু দিয়ে আদ্রিবকে রাণী বলে উঠলো,
–“আমার আদ্র।আমার বাবাকে আমি অনেক মিস করেছি। আজও কি তুমি হায়া ফুফুর সাথে থাকবে?”
আদ্রিব মাথা নাড়ালো দুই দিকে,
–“নাহ,মা।আমি প্রত্যেকদিনের মতো তোমার আর বাবার সাথে থাকবো।”
রাণী হেসে জড়িয়ে ধরলো আদ্রিবকে। আদ্রিবও তার ছোট হাত দিয়ে রাণীকে জড়িয়ে ধরলো।
ঘরের সবাই মোটামুটি তৈরি হয়ে গিয়েছে।শুধু একজন ছাড়া,মনি।নিজের শত জামা থাকার পরও কাপড় খুঁজে পাচ্ছে না সে।অগত্য রাণীর রুমে প্রবেশ করলো সে হাতে দুই ভিন্ন রঙের কামিজ সেট নিয়ে,
–“ভাবী,বলে দাও প্লিজ কোনটা পড়বো?”
রাণী নিজের শাড়ির আঁচলে পিন লাগিয়ে মনিকে বললো,
–“গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা মেয়ে যদি এখনো ড্রেস সিলেক্ট করতে না পারে,তাহলে এই মেয়েকে আমি বিয়ে দিবো কিভাবে?মেয়েটা সংসার করবে কিভাবে?”
মনির মুখের রং বদলে গেলো।সে থমথমে গলায় বলে উঠলো,
–“ভাবী!আমি এখন বিয়ে করবো না।এইসব বিয়ের কথা বাদ দাও।ড্রেস বলো,কোনটা পড়বো?ঘুরে ফিরে শুধু বিয়েতে তোমার কথা শেষ হয়।”
রাণী হাসলো মৃদু।মনির কাছে গিয়ে বেগুনি রঙের কামিজকে ইশারা করে রাণী তাকে বললো,
–“মেয়েদের তো একদিন বিয়ে করতেই হয়,মনি সাহেবা।আচ্ছা ছাড়ো,এখন দ্রুত এই ড্রেস পড়ে নাও।অ্যাঞ্জেলা আসলে কিন্তু তাড়া লাগাবে প্রচুর।”
–“ধন্যবাদ ভাবী।”
রাণীকে হালকা জড়িয়ে ধরে মনি হাসিখুশি মনে বেরিয়ে পড়লো।
রাণী আয়নায় তাকালো নিজের দিকে।কালো রঙের শাড়ি পড়েছে সে।তার দানব সন্ত্রাসীর বেশ পছন্দের রঙ এটা।রাণীর স্পষ্ট মনে আছে,সকালে যাওয়ার পূর্বে রাণীকে তূর্যয় কালো রঙের শাড়ি পড়তে বলেছিলো।রাণীর কাঁচা ঘুমের মাঝে শোনা তূর্যয়ের কথাটা এখনো রাণীর কানে বাজছে।এতো বছরের তাদের সম্পর্কে এখনো রাণী তূর্যয়ের কাছাকাছি এলে পূর্বের ন্যায় লজ্জায় কাবু হয়ে থাকে। আগে থেকে তূর্যয়ের এইসব কাছে আসা হয়েছে আরো গভীর থেকে গভীরতর।রাণীর তূর্যয়ের এইসব মাত্রারিক্ত রোমান্টিকতার কথা মনে আসতেই চোখ মুখ লাল হয়ে যায়।এখনো ঠিক তাই।নিজের লজ্জা মাখা মুখ আয়নায় দেখে নিজেই হতবিম্ভল হলো সে।নিজের মাথায় চড় দিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে নিয়ে রাণী রুম থেকে বের হলো।হায়া আর আদ্রিব নিচে বসে আছে।রাণী তাদের সাথে যোগ দিলো। একটু পরে অ্যাঞ্জেলার প্রবেশ ঘটলো লিভিংরুমে,
–“হ্যালো,কেমন আছো সবাই?”
আদ্রিব চেঁচিয়ে উঠলো খুশিতে,
–“অ্যাঞ্জেলা আন্টি!”
–“আদ্রিব বাবা।”
কথাটা বলে অ্যাঞ্জেলা আদ্রিবকে কোলে নিয়ে নিলো।
–“খুব সুন্দর লাগছে তোমায়,অ্যাঞ্জেলা আপু।”
রাণীর হাসিমাখা কণ্ঠ।
–“ধন্যবাদ,রৌদ্র।তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে দেখতে।”
রাণী হাসলো তার কথায়।মনি আসলে সবাই রওনা দিলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে।হ্যারি আর তূর্যয় সেই ফার্ম হাউজে আছে।
গাড়ি থেকে আদ্রিব প্রথমে নেমে দৌড় দিলো।তার পিছে দ্রুত হাঁটছে হায়া।তূর্যয় তার ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই আদ্রিব এক লাফে নিজের বাবার কোলে উঠে পড়লো।আদ্রিবের গালে তূর্যয় ভালোবাসার পরশ দিলো।হ্যারি গাল ভেংচি দিয়ে আদ্রিবকে বলে উঠলো,
–“তোমার বাবা ব্যাড বয়। সে শুধু তোমাকে কিস দেয় আমাকে দেয় না।”
আদ্রিব তূর্যয়ের কোল থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে হ্যারির গালে একটা চুমু দিলো,
–“আমার বাবা গুড বয়।বাবা,শুধু আমাকে না মাকেও কিসি দেয়।”
তূর্যয় চোখ রাঙিয়ে আদ্রিবকে বলে উঠলো,
–“আদ্র! পঁচা কথা বলে কেউ?”
হ্যারি হেসে উঠলো কিটকিটিয়ে,
–“পঁচা কথা বলবে না হুয়াই?বাবা যেমন ছেলেও তেমন।হাহা,কুল।”
হ্যারিকে কিছু বলার আগেই রাণীকে দেখে তূর্যয়ের মুখ বন্ধ হয়ে গেলো।এই মেয়েকে তূর্যয় যতো দেখুক না কেনো,তার দেখার কোনো অন্ত নেই।হ্যারি অ্যাঞ্জেলার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো,
–“ডার্লিং,চলে আসো।”
প্রত্যুত্তরে অ্যাঞ্জেলা হ্যারিকে চড় দেখালো।অ্যাঞ্জেলা তূর্যয়কে নিজের বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করে।তাই,
হ্যারির আচরনে অ্যাঞ্জেলা বেশ লজ্জায় পড়লো তূর্যয়ের সামনে।
রাণী আর আদ্রিবকে নিয়ে তূর্যয় এক পাশে গেলো।সবাই এইখানে যার যার মতো করে ঘুরা ঘুরি করছে।তূর্যয় তার অংশবিশেষ আলোচনা করছে আর নানান জিনিস দেখাচ্ছে রাণীকে।মাঝে মাঝে এটা সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করছে তারা।এরমধ্যে হঠাৎ রাণীকে তূর্যয় প্রশ্ন করলো,
–“সালেহা মা,কলি আর মোল্লা সাহেব এলেন না কেনো?”
–“সালেহা মা এতিম খানায় কাজে ব্যস্ত,আর কলি আমার দোকানে আছে।নাজিম ভাইও আছে সেখানে।এতবছর জেল কেটে এসে একেবারে ভেঙে পড়েছে নাজিম ভাই।তাই কলি সেখানেই আছে। একসাথে দুই দিক সামলাচ্ছে আমার সই। মোল্লা সাহেব তো উনার এতিম খানায়।উনারা বলেছেন এখানে পরে আসবেন একদিন ঘুরতে।”
–“ভালোই তো।সবাই ব্যস্ত সবার মতো।আর আমি ব্যস্ত আমার মহারাণীকে দেখতে।”
আদ্রিব নিজের মতো খেলছে।এই সুযোগে তূর্যয় রাণীকে পেছন দিকে থেকে নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ করে তার কানে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
–“নজরকাড়া সুন্দর লাগছে,রৌদ্র।”
–“আরে,ছাড়ুন,আদ্রিব আছে সামনে।দেখলেই সমস্যা হবে কিন্তু।”
–“দেখবে না।”
কথাটা বলে তূর্যয় রাণীর কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়ালো।রাণী কাঁধ ঝাঁকি দিলো।কিন্তু তূর্যয় তাও সরলো না।আদ্রিবের আড়ালে নিজের অর্ধাঙ্গীকে নিজের সাধ্যমতো ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে তূর্যয়।রাণী চেয়েও সরতে পারছে না। পারবেই বা কিভাবে তূর্যয়ের এইসব ভালোবাসাময় স্পর্শ উপেক্ষা করা রাণীর জন্যে অসম্ভব।হঠাৎ কিছুর শব্দ হলে রাণী তূর্যয় থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আদ্রিবকে কোলে তুলে নিলো।তাদের সেখানে দাঁড়াতে বলে তূর্যয় তাদের আড়ালে গিয়ে নিজের পিস্তল বের করলো কোটের অন্তরাল থেকে।আদ্রিবকে সবসময় তূর্যয় আর রাণী এইসব থেকে দূরে রাখে।আদ্রিব এখনো জানেনা তার বাবা কি কাজ করে।তূর্যয়দের বাড়ি থেকেও আস্তানা সরিয়ে ফেলেছে সে আদ্রিবের জন্মের পরেই।
হ্যারি দৌড়ে আসলো রাণী আর আদ্রিবের দিকে।আদ্রিবকে নিজের কোলে নিয়ে রাণীকে সে বলে উঠলো,
–“সিস, নিচে আসো।”
–“ভিনদেশী ভাই,কি হয়েছে?আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? উনি কোথায়?”
হ্যারি রাণীর কাঁধে হাত চেপে তাকে বলতে লাগলো,
–“ভেতরকার শত্রু।ব্রো মেরে দিবে এখন তাকে।তুমি চলো নিচে।”
রাণীর বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে।মনে মনে সে তূর্যয়ের সুস্থতা কামনা করছে।রাণীর মনে আল্লাহ্ এর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে।তাই,রাণী তূর্যয়ের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করছে মনের অন্তরালে।তাছাড়া তূর্যয়ের হিংস্রতার থেকে আজ পর্যন্ত কেউ ই রক্ষা পায়নি।রাণী মনে কিঞ্চিৎ আশঙ্কা নিয়ে হ্যারির সাথে এগিয়ে যাচ্ছে।
তূর্যয় দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছে,তারই গার্ডের কাপড় পড়া একজন বন্দুকের সেটআপ ঠিক করেছে।তূর্যয়ের ভেতরকার কল্পনায় সে বুঝতে পারছে,এই জানালা দিয়েই তার পরিবারের সবাইকে বন্দুকের টার্গেট করা হয়েছে।তূর্যয় নিজের কোটের দুইটা বোতাম খুলে দিলো।এক লাথি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই সেই গার্ডটি চমকে উঠলো।তূর্যয়ের মুখে হিংস্রতা বিদ্যমান।তূর্যয়কে দেখে গার্ডটি তূর্যয়ের দিকে বন্দুক তাক করতেই তূর্যয় ঠোঁট বাঁকা করে তাকে বলে উঠলো,
–“আহ্,ভেতরকার শত্রু!এই ভেতরকার শত্রু নামক কথাকে আমি ভীষন ঘৃণা করি,ভীষন।আমার পরিবারের সবাইকে মারার প্ল্যান করছিস?হুম?এর আগে যে তোকেই মরতে হবে!তূর্যয় তার পরিবারের উপর কোনো আঁচড় লাগতেই দিবে না।”
তূর্যয় ভয়ংকর ভাবে হেসে উঠলো।তার এই হাসি শুধু মৃত্যুর পূর্বে তার শিকাররা দেখতে পায়।লোকটা ভয়ে তূর্যয়ের দিকে গুলি ছুড়তে গেলে তূর্যয় লাথি দিয়ে লোকটাকে ফেলে দেয় মেঝেতে।তূর্যয় হাঁটু গেড়ে বসে।লোকটা উঠে আবারও তূর্যয়কে শুট করতে গেলেই,
তূর্যয়ের পরিহিত বুটের মধ্যখান থেকে ধারালো ছুরি বের করে লোকটার পেট বরাবর ঢুকিয়ে দিলো।লোকটা বুঝে উঠার আগেই ছুরিটা প্রশস্ত করে টান দিলো তূর্যয়।এতেই লোকটার পেট থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এলো।
–“শালা,আমার ফ্যামিলির ক্ষতি করবি!এতো সাহস?ভাগ্যিস গুলি চালায়নি।নাহলে সবাই আতংকে থাকতো।”
তূর্যয় কিছু আন্দাজ করে পেছনে ফিরতেই দেখলো তার দিকে অন্য এক গার্ড তাকে মারতে আসতেই হ্যারি তার পিঠে ছুরি ঢুকিয়ে তার মুখ চেপে ধরলো।হ্যারি মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে তাকে বলে উঠলো,
–“আমি আছি তো,ব্রো।তোমাকে সেভ করে নিলাম।”
–“ধন্যবাদ,হ্যারি।”
তূর্যয়ের মুখে প্রশান্তির আভাস দেখা যাচ্ছে।
–“ডোন্ট ওয়ারি।এদের খবরই দিয়েছিল আজ সকালে,
ইকরাম।সকালে নিউজ পেয়েছি আর এখন এদের হেলে পাঠিয়েছি।”
–“হ্যাঁ,ভেতরকার শত্রু আমার মোটেও পছন্দ না।”
তূর্যয়ের থমথম কণ্ঠ।
–“চিল ব্রো,আমরা দুই ব্রো সবাইকে ফিনিশ করে দিবো।”
–“একদম ঠিক।কোনো শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখবো না আমি।আমার পরিবারের সুরক্ষা আমার জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
–“আই লাভ ইউ,ব্রো।তুমি আছো বলেই আমি এতো সাহসী হতে পেরেছি।”
তূর্যয় নিজের হাত মুছে নিলো রুমালে।হ্যারির কথায় নাক কুঁচকে তূর্যয় বলে উঠলো,
–“উফফ,আবারও এইসব!অ্যাঞ্জেলা এইসব জানলে তোমাকে ছেড়ে পালাবে।”
হ্যারি হাহা করে হেসে উঠলো,
–“অ্যাঞ্জেলা জানে,আমি তোমাকে কতো লাভ করি ব্রো।”
–“আমিও হ্যারি।”
–“ওহ মাই গড!ব্রো তুমি আমাকে বলেছো এটা?
আই কান্ট বিলিভ!”
হ্যারি নাচতে নাচতে দৌড়াতে লাগলো।তূর্যয় নিজের ঠোঁট প্রশস্থ করে বলতে লাগলো,
–“পুরোই নাট্যকার এই হ্যারি।ধন্যবাদ সব সময় আমার পাশে থাকার জন্যে,হ্যারি।”
তূর্যয় নিজে পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে লাগলো।
নিচে সবাই পিকনিকের আয়োজন করে নিয়েছে।আদ্রিবের খুশি যেনো আজ আকাশ ছুঁয়েছে।সে চারদিকে দৌড় ঝাঁপ করছে।রাণী,অ্যাঞ্জেলা,মনি নানান কাজ করছে।তূর্যয়ের নজর তো তার রৌদ্রের দিকেই আটকে আছে।সবাই সম্পূর্ণ ফার্ম হাউজ ঘুরে ঘুরে দেখছে।আদ্রিব খাবার খেয়ে হায়ার কোলেই ঘুম।রাণী তূর্যয়ের হাত ধরে হাঁটছে।বাড়ির পেছনের দিকে সুন্দর একটা লেক আছে।সেখানের সামনে পাতানো চেয়ারে রাণী আর তূর্যয় বসে পড়লো।রাণী মুখে হাত দিয়ে হেসে উঠলো।তূর্যয় রাণীর হাসি দেখে নিজেও হেসে উঠে রাণীকে বললো,
–“হাসছো কেনো?”
–“এইযে নিজেকে অতি চালাক ভাবা তূর্যয় সাহেব নিজের কোটে লেগে থাকা রক্তের দাগ মুছলো না।আপনার ছেলে দেখলে কিন্তু হাজারটা প্রশ্ন করে ভরিয়ে তুলতো আপনাকে।”
রাণী আবারও মুখ চেপে হাসলো।
তূর্যয় নিজের কোটের দিকে তাকিয়ে আবারও মৃদু হাসলো।কোটের উপর রক্তের দাগ থাকায় সে কোট খুলে তার পাশে রাখলো।
–“এইখানে এসেও খুন করা লাগে আপনার?”
–“আমার পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই এটা করতে হলো।আমি জেনে শুনে নিজের পরিবারকে বিপদে ফেলতে পারি?”
–“নাহ,একদমই না।একটা জিনিস খুব অদ্ভুত তাই না?”
রাণীর কথায় তূর্যয় রাণীর হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের আঙ্গুল গুঁজে দিলো,
–“কি জিনিস?”
–“এইযে আমি আর আপনি,আমাদের কোনো পরিবার ছিলো না।প্রথমে আপনার পরিবার থাকলেও,আপনি বড় হয়েছেন একেবারে আঁধারময় এক পরিবেশে।আর আমি তো পরিবারহীন ছিলাম ছোট থেকেই।আমি সেই কষ্টের জীবনে নিজেকেই নিজের আলো বানিয়েছিলাম।এক পর্যায়ে আপনার সাথে আমার দেখা হয়,
ভালোবাসা হয়।আপনার জীবনে আমি আলো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হই।এরপর আমাদের নিজেদের এক পরিবার হলো।এই পরিবার একান্তই আমাদের পরিবার।আদ্রিব কতো ভাগ্যবান,সে একটা পরিবার পেয়েছে।আমাদের জীবনটা আসলেই একটা আলো আঁধারের খেলা।”
রাণী কথাগুলো বলার সময় তূর্যয় অপলক তাকিয়ে ছিলো রাণীর দিকে।রাণীর হাতের উল্টো পিঠে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে তাকে জবাব দিলো,
–“আসলেই, আমাদের জীবনটা এক আলো আঁধারের খেলা।কেউ কেউ আমার মতো আঁধার জীবনে তোর মতো আলোর সন্ধান পেয়ে নিজের অস্তিত্বের টের পায়।আবার কেউ কেউ সে আঁধারেই দেবে যায়।আমার আঁধার জীবনের একরাশ স্বচ্ছ আলো তুই,রৌদ্র।আমার সারা সত্তায় শুধু তোর আলোর ছড়াছড়ি।”
তূর্যয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে দিলো রাণী।ভালোবাসার সুরে সে তূর্যয়েকে বলে উঠলো,
–“আলো আঁধারের এই মায়ায়,আমি শুধু আপনাকে চাই,দানব।আপনি আমার জীবনে এসে আমার জীবনকে পরিপূর্ণ করেছেন,দানব সন্ত্রাসী।আমার এই সন্ত্রাসীকে আমি সারাজীবন আমার আলোতে মাতিয়ে রাখবো।”
–“জীবনটায় এমন, আলো আঁধারের সমন্বয়ে তৈরি।আমার জীবনের আলো হয়ে থাকতে সর্বদায় তোমাকে চাই আমার।আমার রৌদ্রের এই আলো আমার সারা সত্তাকে রাঙিয়ে তুলেছে তার পরম ভালোবাসায়।আমাদের মাঝে কেউ আসতে চাইলে,তার পরিণতি হবে মৃত্যু,খুবই করুণ মৃত্যু।তুই তো জানিস আমি কেমন!”
–“হ্যাঁ,কেনো জানবো না?আপনি তো একটা হিংস্র দানব সন্ত্রাসী।”
তূর্যয় হেসে উঠলো।সে বেশ শব্দ করেই রাণীকে জবাব দিলো,
–“শুধু তোমার দানব সন্ত্রাসী আমি।”
রাণী ছোট্ট করে বললো,
–“জানি।”
সন্ধ্যা নেমেছে আকাশে।রাণীর কোলে আদ্রিব ঘুমন্ত
অবস্থায় শুয়ে আছে।আকাশের বুকে চাঁদটাও হালকা উঁকি দিচ্ছে।এই চাঁদ যেনো তূর্যয় রাণীর ভালোবাসার অস্তিত্বের মতো, সেও আকাশের বুকে নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশ করার অপেক্ষায় আছে।লেকের হালকা ঝিরঝির বাতাসে রাণী আর তূর্যয় চোখ বন্ধ করে এই মুহূর্তটা উপভোগ করছে।তাদের স্মৃতিতে তাদের জীবনের আলো আঁধারের অধ্যায়গুলো একে একে ভেসে উঠছে।এই আলো আঁধারের সমন্বয়েই তো এতো এতো স্মৃতি জমা করেছে তারা।সুখময় স্মৃতিটা বেশি ঘুরছে তাদের মস্তিষ্কে।এই যেনো এক চরম সুখকর মুহূর্ত।
আপনজনদের সঙ্গ পেলে জীবনটা যেনো সত্যিই তার আঁধার কেটে আলোতে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে পারে।
সমাপ্ত