#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা:সালসাবিল সারা
(৪২+৪৩)
হাসান এক অজপাড়া গায়ে আত্মগোপন করে আছে গত চার মাস যাবত।নিজের বেশভূষায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে হাসান।দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না,এই লোকটাই সে।তূর্যয় নিজের আলাদা লোক লাগিয়েছে হাসানকে খোজার জন্যে।গত দুইমাস যাবত তূর্যয়ের লোকেরা তাকে খুঁজে চলেছে।কিন্তু,হাসানের বিচক্ষণতাময় আত্মগোপনের কারণে কেউ তার সন্ধান পাচ্ছে না।
এক দুর্ঘটনা জনিত কারণে রাণীর পা পিছলে রাণী সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে হায়ার জন্যে রাণী বেঁচে যায়।এরপর রাণীর ভেতরে নিজের বাচ্চা হারানোর একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল।যার দরুণ রাণী অতিরিক্ত চিন্তা করতে শুরু করলো তার বাচ্চার জন্যে। এতে রাণী এতোই দূর্বল আর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো,
ডাক্তার রাণীকে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট করতে বলেছিলো।রাণীর এইসব নানান খারাপ প্রভাবে দিন কেটে যায়।তার মাথা থেকে হাসানের কথা সম্পূর্ণ বের হয়ে গিয়েছিলো। তূর্যয় রাণীর অনেক ভালো যত্ন করেছে এই চারমাস।রাণী এখন প্রায় সুস্থ।তার মনের ভয়,
দুর্বলতা সব এখন অনেকটাই কমেছে।হায়া তূর্যয়কে হাসানের সব সত্যি বলে দিয়েছিল অনেক আগেই।হায়া রাণীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে আর কিছুই জানায়নি হাসানের কথা।তবে হায়া সুযোগ বুঝে তূর্যয়কে হাসানের ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছিল।হায়ার ধারণা,তূর্যয়ের জন্যে হাসানের এই ব্যাপারটা জানা বেশ জরুরি।নাহলে হাসান তূর্যয় এবং রাণীর জন্যে বেশ ভয়ংকর এবং বিপদজনক হতে পারে।অতঃপর তূর্যয় সব শুনে রাগে একেবারে অতিরিক্ত হিংস্র হয়ে পড়লো।তার একটাই আফসোস,তার মায়ের খুনি তার সামনে থাকলেও তাকে সে কোনোরূপ শাস্তি দিতে পারেনি।সাথে সাথেই হাসানকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বেশ সংখ্যক লোক লাগিয়েছে তূর্যয়।তূর্যয় শুধু অপেক্ষা করে আছে হাসানের খোঁজার জন্যে।হাসানের পাপের শাস্তি যেনো তূর্যয় লিখে রেখেছে অত্যন্ত কঠোর ভাবে।এইসবের কিছুই তূর্যয় রাণীকে জানায়নি।রাণীর এমন গর্ভবতী অবস্থায় বাড়তি কোনো চিন্তা সে রাণীকে করাতে চাই না।অতঃপর তূর্যয় সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু গোপন রেখে রাণীকে সব কিছু থেকেই আগলিয়ে রেখেছে।
তূর্যয়ের লোকদের সাথেও আলাদা ভাবে আহমেদের লোকেরা তার সন্ধান করছে।তবে ফলাফল তাও শূন্য।আহমেদের লোকেরা সেই কবে থেকেই খুঁজে চলেছে তাকে।
হাসান তার সত্তাকে বাঁচাতে নিজের ব্যক্তিগত সহকারীর সাহায্যে ব্যক্তিগত সকল খরচ বহন করছে।হাসানের এই সহকারীও একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি।যার খবর তূর্যয় বা আহমেদ কেউ আজ পর্যন্ত জানে না।কিন্তু তাদের লোকেরা থেমে নেই,তারা তাদের বসের নির্দেশে হাসানকে খুঁজে যাচ্ছে নানান শহর,মাঠ,গ্রাম,
অলি-গলিতে।
________
রাণী ক্লান্ত।প্রচুর ক্লান্ত।ছয় মাস শেষ হতে চলেছে তার।ভারী পেট নিয়ে রাণীর যেনো অস্বস্থির শেষ নেই।এইযে ডাক্তারের আদেশমত তার রুমে একটু হাঁটতে গিয়েই হাঁপিয়ে উঠেছে সে।হায়া রাণীর রুটিন মাফিক রান্না করতে গেলো মাত্রই।এতক্ষণ সে রাণীর সাথেই ছিলো।আর রাণী কোমরের পিছে এক হাত ঠেকে অন্য হাত পেটের উপর রেখে ধীরে ধীরে হাঁটার চেষ্টা করছে। এতেই যেনো একে বারে ক্লান্ত হয়ে পড়লো সে।রাণীর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলে রাণী ধীরে সোফায় বসে পড়লো।মাথার চুল গুছিয়ে তাতে খোঁপা সাজিয়ে নিলো রাণী।সোফার সামনেই রাখা টেবিলের উপর থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে স্বস্থির শ্বাস ফেললো।পাশ থেকে মোবাইল বেজে উঠলে রাণীর নজর সেদিকে চলে গেলো আপনাআপনি।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো রিয়া ফোন দিয়েছে।রাণীর বান্ধবি রিয়া আর কলি প্রায়শই ফোন করে রাণীর স্বাস্থের খবর নিতে।এর ফাঁকে ফাঁকে দোকানের খবরটাও দিয়ে দেয় তারা রাণীকে।রাণী ফোন ধরে “হ্যালো” বলতেই রিয়া হেসে তাকে জবাব দিলো,
–“কিরে বাচ্চার মা,খবর নেই কেনো তোর?”
রাণী দুর্বল কণ্ঠে তাকে বলে উঠলো,
–“আরে বলিস না।প্রচুর ক্লান্ত লাগছে।সামান্য হাঁটতেই যেনো দম ফুরিয়ে যাচ্ছে।আমার খবর কি আর বমি করতে করতেই দিন যায়।তুই বল,কেমন আছিস তোরা?”
–“ভালো আছি সবাই।নাজিম ভাইকে দিয়ে টাকা পাঠিয়েছি দোকানের।এটা বলার জন্যেই ফোন দিয়েছি।”
–“আরে,এখন পাঠানোর কি দরকার ছিলো!তোরা সবকিছুর দাম মিটমাট করে তারপর না হয় দিতি টাকা।”
রাণী বলে উঠলো রিয়াকে তার কথায়।
–“সব কিছু ঠিকঠাক করেই তোকে টাকা পাঠিয়েছি।এতো ভাবিস না তো।তোর এই দোকানের প্ল্যানটা ছিল সবচেয়ে ভালো প্ল্যান।এর জন্যে আমরা সাবলম্বী হতে পেরেছি। উম,তোকে না;তূর্যয় ভাইকেই সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ জানায়।”
রাণী নিঃশব্দ হাসলো।রিয়া পরক্ষণে তাড়াহুড়োয় রাণীকে বলে উঠলো,
–“আচ্ছা রাখছি এখন।কাজ আছে দোকানে।সময় পেলে এসে দেখে যাবো।”
রাণী হেসে উত্তর দিলো,
–“হ্যাঁ,আসিস বোন।”
রিয়ার সাথে কথা শেষে রাণী সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে রইলো।এতো এতো পাওয়ারি ওষুধ খেয়েছে রাণী,
এতেই তার মন থেকে যেনো “ওষুধ” নামক শব্দটা বিষে পরিণত হয়েছে।রাণী চোখ বুঁজে রইলো।তার ক্লান্ত অক্ষি জোড়া যেনো কিছুতেই মেলতে চায় না। কারো শীতল পায়ের প্রবেশ রাণী লক্ষ্য করলো।এই ঘরে কোনো বাইরের মানুষ প্রবেশ করবে না, এতে রাণী বড্ড নিশ্চিত।অতঃপর রাণী তার অক্ষি মেললো না।তার পাশেই সোফায় কেউ বসলো,এমনটাই আন্দাজ করতে পারছে রাণী।কেউ একজন তার কাঁধ জড়িয়ে ধরতেই রাণী ঠান্ডা হাতের স্পর্শে একটু নড়ে উঠলো।এই মানুষটার হাতের স্পর্শ রাণীর যেনো বহু সময়কাল ধরে চেনা।রাণীর অধরে মৃদু হাসির আভাস দেখা যাচ্ছে।রাণীর ক্লান্ত দেহটা যেনো তার পাশের অতি শীতল দেহের সাথে মিশতেই তার সকল ক্লান্তি নিমিষেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে।রাণী সেই দেহের দিকে আরো মিশে গিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“গোসল করে নিয়েছেন?”
–“বাহ্,চোখ বন্ধ করেই আমাকে চিনে নিয়েছো?হুম, গোসল সেরে এসেছি।শরীরে রক্ত লেগে ছিলো।”
রাণী আরো গভীরে চলে গেলো তূর্যয়ের দেহের ভাঁজে।রাণী ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
–“ওহহ।”
তূর্যয় নিজের অধর ছোঁয়ালো রাণীর মাথায়।এরপর একটা খাম এগিয়ে দিয়ে রাণীকে বললো,
–“গার্ড দিয়েছে এই খামটা।নাজিম দিয়ে গেলো বললো।”
রাণী এইবার চোখ খুললো।তার চোখজোড়া খামের দিকে না গিয়ে সোজাসুজি চলে গেলো তার প্রাণপ্রিয় সন্ত্রাসীর দিকে।যার কপালের দুই ধারে এখন চুপচুপ করে পানি পড়ছে।তূর্যয়ের উদোম শরীরের সবটুকুই বিন্দু বিন্দু পানি দেখা যাচ্ছে।তূর্যয়ের মুখে প্রশান্তির হাসি।এই হাসিতেই যেনো রাণীর মৃত্যু নিশ্চিত।রাণী পরম যত্নে হাত রাখলো তূর্যয়ের মুখে।তূর্যয় দ্রুত রাণী ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে আবারও সোজা হয়ে বসলো।কিন্তু,রাণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয় নিজের নিচের ঠোঁট চেপে বসে রাণীর পানে চেয়ে আছে মায়ার নজরে।রাণী চোখ ছোট করে তূর্যয়কে দূর্বল কণ্ঠে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
–“আপনি নিজের শরীর দেখিয়ে দেখিয়ে সারা ঘরে হেঁটে বেড়িয়েছেন?বাসায় হায়া আর খালা আছে,এটা আপনার মগজে ছিলো না?নাকি নিজের শরীর অন্যদের দেখাতে আপনার বেশ ভালো লাগে!”
–“রৌদ্র!মাথা ঠিক আছে তোমার?আমি পাশের রুম থেকে গোসল সেরে এসেছি।আমি জানি বাসার খবর।এতো হিংসুক কেনো তুমি?”
রাণী যেনো এখন শান্ত হলো।কিন্তু রাণী তার হিংসুক ভাব চেহারায় ফুটিয়ে রইলো এখনো।তূর্যয় রাণীর দুই গাল টেনে দিলো।রাণী বিরক্ত দেখিয়ে তূর্যয়কে বললো,
–“হ্যাঁ,আমি আপনার জন্যে হিংসুক।”
রাণী তূর্যয়ের হাত থেকে খাম নিয়ে নিলো।তূর্যয় হাহা করে হেসে উঠলো।রাণীর কোমর চেপে ধরে তূর্যয় রাণীকে জবাব দিলো,
–“আহা,আমার হিংসুক রাণী।”
রাণী কিছু বলার পূর্বেই তাদের রুমের কাঁচের জানালায় বৃষ্টির আঘাত করার শব্দ পেলো।রাণী আর তূর্যয় দুইজনই তাকালো জানালার দিকে।ইতিমধ্যে তীব্র বৃষ্টির ঝাপটা জানালায় হামলে পড়ছে।রাণী চিন্তিত কন্ঠে তূর্যয়কে নির্দেশ দিলো,
–“ব্যালকনির দরজা বন্ধ করুন। বৃষ্টির পানি চলে আসবে রুমে।এরপর আবারও আমি পা পিছলে…!”
তূর্যয় রাণীর মুখে হাত রাখলো।চোখের ইশারায় রাণীকে “চুপ” করতে বলে তূর্যয় তার লম্বা পায়ের লম্বা কদমে কয়েক সেকেন্ডেই ব্যালকনির দরজায় পৌঁছে গেলো।রাণী সোফা থেকে উঠে জানালার ধারে গেলো। বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ শোনা যাচ্ছে অল্প।কাঁচের এই মোটা আবরণের জানালা ভেদ করে বৃষ্টির মনোরম শব্দটা সম্পূর্ণ প্রবেশ করছে না।রাণী জানালায় হাত রাখলো।তার দৃষ্টি বাহিরের বর্ষণরত দৃশ্য দেখছে। এরমধ্যেই রাণীকে নিজের হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো তূর্যয়।রাণী নিজের মাথা ঠেকালো তূর্যয়ের বুকে।তূর্যয় ফিসফিস করে রাণীকে বলে উঠলো,
–“বৃষ্টিতে ভিজবি,রৌদ্র?”
–“আমি ভিজতে পারবো একা।আপনাকে ভিজতে হবে না।বৃষ্টিতে ভিজে এরপর বিছানায় পড়ে থাকবেন তিনদিন।এমনি নিজের জ্বালায় বাঁচি না,তার উপর আপনার কিছু হলে আমি কিভাবে তা সহ্য করে নিবো?”
রাণীর শান্ত জবাব।
তূর্যয় রাণীর ঘাড়ে আলতো কামড় দিলো।রাণী বিড়বিড় করে বললো,”রাক্ষস”।
তূর্যয়ের কানে রাণীর কথা প্রবেশ করলো না।তূর্যয় শয়তানি হাসি দিয়ে রাণীকে জবাব দিলো,
–“আমার বাচ্চাকে আমি কিছুতেই অসুস্থ হতে দিতে পারি না।এমনিই বললাম বৃষ্টিতে ভেজার কথা আর এই মেয়ে তো আমার উপরেই ক্ষেপেছে।না তুই ভিজবি বৃষ্টিতে,না আমি।একটু লোভ দেখালাম বৃষ্টির আর এই মেয়ে তো একেবারেই লোভে টইটুম্বর হয়ে গেলো।”
রাণী বুঝতে পারছে,এতক্ষণ সে তূর্যয়ের মশকরার শিকার হয়েছে।রাণী নিজের পেটে রাখা তূর্যয়ের হাতে জোরে চিমটি কেটে বললো,
–“দানব কোথাকার!”
রাণী রাগী মুখের অভিব্যক্তি দেখে তূর্যয়ের বুকটা ধ্বক করে উঠলো।রাণীর এই রূপটা যেনো তূর্যয়কে মুহূর্তেই তার উপর বশ করে নিয়েছে।রাণী নানান কথা বলে যাচ্ছে তূর্যয়কে।কিন্তু তূর্যয়ের কোনো হেলদুল নেই।এক পর্যায়ে তূর্যয় ধুম করে নিজের অধরের সাহায্যে রাণীর মুখটা চুপ করিয়ে দিলো।
—-
রাণী গাল ফুলিয়ে বসে আছে।হায়া রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাণীর দিকে ওষুধ এগিয়ে দিয়ে।রাণী চুপ করে রইলো।সে বড্ড ক্ষেপেছে তূর্যয়ের উপর।তূর্যয় আর তার আজ একসাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা ছিলো।তাই তো আজ তূর্যয় অনেক পূর্বেই এসেছিলো ঘরে।কিন্তু,রাণী আর তূর্যয়ের এই মনের আশা পূরণ হলো না।হ্যারি তূর্যয়কে ফোন করে কোনো এক জরুরি কাজের খবর জানিয়েছে।এতেই তূর্যয় শার্ট গায়ে জড়িয়ে নেওয়ার আগেই কোনো মতে বুটজোড়া পায়ে জড়িয়ে শার্ট পড়ে কোট হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলো।রাণী ভেবে পায় না,এই লোকের এতো কাজ কেনো থাকে।রাণীর মন প্রচুর খারাপ হলো।হ্যারি গতমাসে তার দেশে গিয়েছিল,সে এখনো সেখানে আছে। এতে তার কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ একটুও কমেনি।সেইখান থেকেই হ্যারি কাজে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
হায়া রাণীর মুখে ওষুধ পুরে দিয়ে দিয়ে পানি এগিয়ে দিলো।রাণী রাগী মুখে হায়ার পানে চেয়ে পানি নিয়ে ওষুধ গিললো।এরপর রাগী কণ্ঠে হায়াকে বললো,
–“তোমার ঐ বড় স্যারের মতোই অসভ্য তুমি।”
হায়া পানির গ্লাস রাণীর হাত থেকে নিয়ে তাকে জবাব দিলো,
–“বড় স্যার বলেছে,আপনার ওষুধ যেনো মিস না যায়।যদি তা হয়,তবে আমার চাকরি শেষ।আর ভাবী,আমি আপনাকে এতো জলদি ছেড়ে যাচ্ছি না।”
হায়ার কথায় রাণী চোখ বাঁকা করলো,
–“এতো সহজে তোমার বড় স্যার তোমাকে যেতে দিবে না এইখান থেকে,তুমি বিশ্বস্ত মানুষ তাই।আর তুমি যে আমার ব্যাপারে উনার প্রত্যেকটা আদেশ পালন করো,
সেই কারণেও তোমার বড় স্যার তোমাকে চাকরিচ্যুত করবে না।তাছাড়া আমি আমার হায়া চৌধুরীনিকে ছাড়া কিভাবে থাকবো?আমার এতো আরাম আয়েশ শুধুমাত্র তোমার জন্যেই সম্ভব হচ্ছে।”
হায়া এসে রাণীর পাশে বসলো।রাণীর হাত ধরে হায়া বলে উঠলো,
–“আপনি আমার আপন না ভাবী,তাও কতো ভালোবাসেন আপনি আমাকে।বড় স্যার এই দুনিয়ায় শুধুমাত্র আপনাকেই অতিরিক্ত ভালোবাসে।তাই আমিও চেষ্টা করি আমার ভাই সমান বড় স্যারের সবকিছুকে অর্থাৎ আপনাকে আমার সর্বোচ্চ দিয়ে সেবা করার।আপনারা দুইজন খুশি তো আমি খুশি।”
হায়া তৃপ্তির হাসি হাসলো।রাণী আলতো করে জড়িয়ে ধরলো হায়াকে।এই মেয়েকে রাণী তার নিজের বোনের মতোই স্নেহ করে।রাণী আর হায়া বসে টুকটাক কথা বলছিলো এরমধ্যেই রুসা খালা এসে রাণীকে বলে উঠলো,
–“সালেহা ম্যাডাম আইছে, বৌমণি।”
রাণীর প্রফুল্লত মন যেনো আরো বেশি প্রফুল্ল হয়ে উঠলো।সে প্রফুল্লতার সুরে রুসাকে নির্দেশ দিলো,
–“এইখানে পাঠিয়ে দিন উনাকে।”
–“আইচ্ছা,বউমণি।”
রুসা চলে গেলো।মিনিট তিনেক পরে সালেহা এসে হাজির হলো রুমে।সালেহা,হায়া এবং রাণী মিলে জুড়ে দিলো এক রাজ্যর আলোচনা।
.
সিমি রুমে নিজেকে বন্ধী করে রেখেছে।তার মাথার এলোমেলো চুলে বারবার হাত বুলাচ্ছে সে।চার মাস খুব কম সময় না।অনেকটাই লম্বা সময়।এই চার মাসে রাণীকে মারার হাজারটা চেষ্টা করেছে সিমি।কিন্তু, একটাতেও সফল হয়নি সে।এমনকি রাণীর বাসার ভেতরেও প্রবেশ করেছে বহুবার,তারপরও সে রাণীর কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।হায়া রাণীর সাথে ঢাল হিসেবে ছিলো সারাক্ষণ।রাণীর ক্ষতি করার হাজার চেষ্টা বারবার বিফলে যাওয়াতে সিমির মনে রাণীকে নিয়ে ক্ষোভটা যেনো আরো হাজারগুণ বেড়েছে।বুকের সাথে হাঁটু জড়িয়ে বসে সিমি এলোমেলো ভাবে বলতে লাগলো,
–“তোকে মারার জন্যে আমার গায়ে রক্ত কিলবিল করছে,রাণী।একবার শুধু একবার সুযোগ পায় তোকে মারার!তোকে আমি কুত্তার মতো মারবো।খুবই তো নিজের অনাগত সন্তানকে দুনিয়ায় আনতে চাচ্ছিস।কিন্তু,আমার নিজের কসম;আমি তোকে এই বাচ্চা দুনিয়ায় আনতে দিবো না,রাণী।তোকে আমি মেরেই দম নিবো।”
কথাগুলো বলার এক পর্যায়ে সিমি পাগলের মতো রুমে হাঁটতে লাগলো।তখনই খট করে দরজা খুললো কেউ।সিমির ভয়ের অন্ত নেই।সে হুইল চেয়ারে বসার পূর্বেই রুমে আসলো নাজিম।নাজিমকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সিমি।নাজিম যেনো আকাশ থেকে পড়লো সিমিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।সাথে নাজিমের কানে বাজছে সিমির প্রত্যেকটা কথা।সিমিদের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নাজিমের কানে সিমির প্রত্যেকটা কথা প্রবেশ করলো।নাজিম আমতা আমতা করে সিমিকে বলে উঠলো,
–“তুই,তুই হাঁটতে পারিস!”
সিমির মনে কু ডাকছে। সে মনে মনে ভাবছে,
–“দরজায় তো খিলি লাগিয়েছি মনে হয়েছে।তাহলে এই বলদ আসলো কিভাবে?এই বলদ কিছু শুনেনি তো?”
সিমির উত্তর না পেয়ে,নাজিম আবারও সিমিকে বললো,
–“তুই,রাণীকে মারতে চাস কেনো?”
সিমি ভয় পেলো নাজিমের কথা শুনে।সিমির কাছে নাজিমের কথার কোনো জবাব নেই।সিমির মাথায় অন্য এক খারাপ কথা ঘুরছে।সে মনে মনে চিন্তা করছে,
–“এই বলদকে এখনই আমার জালে ফাঁসাতে হবে।নাহলে আমার বিপদ।আর তূর্যয় একবার এইসব জানলে আমাকে মেরেই দম নিবে।”
নাজিম কিছু বলার আগেই সিমি বিছানা থেকে তার মোবাইল নিয়ে এক দৌড়ে এলো নাজিমের কাছে।নাজিমের শার্টের কলার ধরে জোরপূর্বক নাজিমের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করলো সিমি।নাজিমের টগবগে যৌবনে সিমির এমন স্পর্শ যেনো নাজিমের সহ্য হচ্ছে না।বারবার “না” বলতে গিয়েও নাজিম থেমে যাচ্ছে। নাজিমও এক পর্যায়ে সিমির এমন স্পর্শে সাড়া দেওয়া শুরু করলো।এই সুযোগে সিমি মোবাইলের ভিডিও চালু করে সেইসব দৃশ্য নিজের মুঠোফোনে রেকর্ড করে নিচ্ছে।যেখানে নাজিমের মুখটাই দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।দুইজনের ঘনিষ্ঠতার মুহূর্ত শেষ হতেই নাজিমের যেনো হুঁশ ফিরে এলো।মুখে এক রাশ অনুশোচনা নিয়ে শোয়া থেকে দ্রুত উঠে পড়লো নাজিম।নিজের চুল টেনে ধরলো সে।নাজিম যে এক মস্ত বড় ভুল করেছে,এটা সে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ভীত নজরে সে সিমির দিকে তাকালে সিমি নিজের গায়ে চাদর টেনে আড়মোড়া ভেঙে নাজিমকে বললো,
–“মুখ খুলবে তো,এই ভিডিও সবার কাছে চলে যাবে।দেখো,তোমার মুখটাই বেশি দেখা যাচ্ছে।তোমার মান সম্মান সব চাঁন্দে যাবে,নাজিম ভাই।আর এখন থেকে তুমিও আমার দলে থাকবে।নাহলে,এই ভিডিও চলে যাবে দূর দূরান্তে।রাস্তা ঘাটে মানুষ তোমাকে দেখলে ছি ছি করবে।তাছাড়া রাণীর মৃত্যু হোক বা না হোক,এই নিয়ে তোমার মাথা ব্যাথা থাকার কথা না।”
নাজিম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।নিজের যৌবনের তাড়নায় এই যেনো এক মহা ভুল করে বসেছে সে।সিমি নামক মেয়েটা যে এতো বেশি খারাপ হবে এটা নাজিমের যেনো কল্পনার বাইরে।নাজিম সহজ সরল ছেলে।সিমির এইসব হুমকিতে সে একেবারে নুইয়ে গেলো। ভয়ে রীতিমত কাঁপছে সে।যেখানে মান সম্মান হারানোর ভয় সিমির থাকার কথা,সেখানে মান সম্মান হারানোর ভয়ে নাজিমের কাঁপাকাঁপি ছুটে গেলো।নাজিম হাত জোর করলো সিমির দিকে,
–“এইসব করিস না,সিমি।আমার সম্মানটা আমার সবকিছু।যদিও আমি মুখ খুলবো না,কিন্তু তূর্যয় স্যার যদি জানে তুই রাণীর ক্ষতি করতে চাস তাহলে তোর মৃত্যু নিশ্চিত।”
–“আরে নাজিম ভাই,তুমি ভেবো না এইসব নিয়ে।কেউ কিছু জানবে না।আর তোমার যদি ইচ্ছা হয়,আবারও আমার দেহ ভোগ করার; তবে আমাকে জানাবে।বেশ উপভোগ করেছি আমি তোমার সঙ্গ।এইবার যাও।কেউ এসে যাবে।”
নাজিমের মুখে আঁধার ছেয়ে এলো।এলোমেলো শার্টের বোতাম লাগিয়ে নাজিম রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।সামান্য সামনে আগাতেই নাজিমের গালে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু।নাজিম শার্টের হাতায় নিজের চোখের পানি মুছে মনে মনে বলতে লাগলো,
–“মাফ করে দিস আমাকে,রাণী।এখন যদি আমি তোকে বা তূর্যয় স্যারকে এইসব বলতে যায়;তবে সিমি আমাকে শেষ করে ছাড়বে।এই মেয়ে বিষধর সাপ থেকেও বিষাক্ত।নিজের সম্মান হারিয়ে আমি তোকে বাঁচাতে পারবো না,রাণী।তূর্যয় স্যার এইসব জানলে এখন সিমি বুঝে যাবে,আমি তাকে জানিয়েছি।কারণ,
সিমির সত্যি আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা।”
নাজিমের চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।
সিমি নিজের গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে শয়তানি হাসি হাসছে,
–“বেচারা নাজিম ভাই।সত্যি জেনেও চুপ থাকতে বাধ্য সে।সিমি এমনই এক কড়া জিনিস,যাকে কেউ কখনোই চিনবে না।আমার পথে যে আসবে আমি তাকে সর্বহারা করবো।রাণী,তোর তো মরণ একেবারেই নিশ্চিত। ঐ বলদ নাজিম,তোকে কিছুই জানাবে না তার মান সম্মান হারানোর ভয়ে।”
রাণীর ক্ষতি কিভাবে করা যায়,এই নিয়ে সিমি নিজের মনে হাজারো কল্পনা আঁকতে ব্যস্ত।
.
আকাশ ধূসর রঙ ধারণ করেছে।আকাশের বুকে মেঘমালা জমে তুলোর স্তূপের মতো দেখাচ্ছে।চারদিকের ঘন জঙ্গলের পাতা স্বচ্ছ দেখাচ্ছে,একেবারে যেনো চির সবুজ রঙ। খানিকক্ষণ পূর্বে বৃষ্টি হয়েছিল প্রচুর।এই বৃষ্টিতে প্রকৃতি ধুয়ে একেবারে নতুন চকচকে রূপ ধারণ করেছে।জঙ্গলের এই রাস্তায় কিছু কিছু স্থানে পানি জমে আছে।সেখানে পায়ের কদম পড়ায় ছপছপ শব্দ হচ্ছে।তূর্যয় আর তার সঙ্গীরা এগিয়ে যাচ্ছে সামনে।বৃষ্টি পড়াকালীন সময়ে তূর্যয় ছাতার নিচে ছিলো।সেই ছাতার নিচ থেকেই আটজনকে খুন করেছে সে নিখুঁত ভাবে।বৃষ্টি থামার পর,তূর্যয় যেনো আরো হিংস্র হয়ে উঠেছে।পুলিশ সুপারের মেয়ে অন্তিকাকে বাঁচানোই আজ তূর্যয়ের জন্যে বড় মিশন।বেশ কুখ্যাত সন্ত্রাসী তাকে অপহরন করেছিল গতকাল।সারারাত খুঁজেও কোনো হাদিস মিললো না অন্তিকার।পরবর্তীতে কমিশনারের আদেশে পুলিশ সুপার তূর্যয়ের কাছে গিয়েছিল। মোটা অংকের টাকার মাধ্যমে তূর্যয় এই মিশন গ্রহণ করলো।তূর্যয় তার চতুর ডিটেকটিভ এর সাহায্যে বেশ দ্রুত অন্তিকার লোকেশন বের করে নিলো।এই জায়গায় এসেই প্রথম থেকে সন্ত্রাসী দলের অনেক লোককে খুন করেছে তূর্যয়।
আরেকটু সামনে যেতেই তূর্যয় দেখলো,সন্ত্রাসী দলের প্রধান অন্তিকাকে একটা গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে।আর বাকি সবাই তাদের চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে।তূর্যয়কে দেখে হেসে উঠলো সন্ত্রাসী দলের প্রধান মিঠুন,
–“আরে,পুলিশ সুপারের মেয়েকে বাঁচাইতে কে আইলো?তাশরীফ তূর্যয় আইছে?পুলিশ কই?হাহাহা।”
নিজের কথায় নিজেই হেসে লুটে পড়ছে মিঠুন।গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায় ছটফট করছে দশ বারো বছরের অন্তিকা।তার দিকে ইশারা করে তূর্যয় মিঠুনকে বললো,
–“বাচ্চা মেয়েটাকে ছেড়ে দে।তোর টাকার দরকার আমি জানি।আমার হাতে মরতে না চাইলে টাকা নিয়ে বিদেয় হো।”
–“না না বস,শুধু টাকা লাইগবো না।পুলিশ সুপারের লাশও লাইগবো।আমার ভাই মরছিলো এই মাইয়্যার বাপের লাইগা।তাই,এই মাইয়ারে বাঁচাইতে তার বাপরে আইতে কন।এই মাইয়ারে ছাড়লেও এর বাপরে আমি ছাড়মু না।”
মিঠুন কিছু ইশারা করলো তার লোককে।এর সাথে সাথেই লোকটা গিয়ে অন্তিকার পায়ে বেশ জোরে আঘাত করলো লাঠি দিয়ে।এক বারিতেই যেনো অন্তিকার পা ভেঙে গেলো।আর্তনাদ করে কান্না করছে অন্তিকা।মুখে কাপড় বেঁধে রাখার কারণে তার আর্তনাদ এর মিহি সুর শোনা যাচ্ছে শুধু।তূর্যয়ের মাথায় রক্ত চড়ে গেল।তার ইশারায় মুহূর্তেই তার লোকেদের গুলির বর্ষন হলো।চারপাশ থেকে পুলিশও এগিয়ে এলো।তূর্যয় মিঠুনকে কথায় ভুলিয়ে রাখায় মিঠুন বুঝতেই পারেনি তূর্যয় এমন কিছু করবে।পুলিশ সুপার তার মেয়েকে বাঁধন মুক্ত করছে।আর তূর্যয় মিঠুনের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে বলে উঠলো,
–“মানুষ কেনো আমার দেওয়া সুযোগ হাত ছাড়া করে আমি বুঝি না।এইযে এখন তুই মরবি,এটার দায় একমাত্র তুই হবি।”
–“তূর্যয় বস!”
তূর্যয় আর কিছু শুনলো না।এর আগেই তূর্যয়ের বুলেট প্রবেশ করলো মিঠুনের মাথায়। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।মিঠুন মৃত।তূর্যয়ের আচমকা আক্রমন যেনো কেউই উপলব্ধি করতে পারে না।তাই তো তূর্যয়কে কাবু আজ পর্যন্ত কেউ করতে পারলো না।পুলিশ সুপার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেলো।তূর্যয় নিজেও রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিলো তূর্যয়।ঘড়িতে সন্ধ্যা ছয়টা বাজে এখন।তূর্যয় ছোট্ট করে বলে উঠলো,
–“শিট।”
পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো হ্যারি আর রাণীর বেশ কিছু কল।তূর্যয় কাউকেই ফোন ব্যাক করলো না।কারণ তূর্যয় ভালো জানে,এরা কেউই আর ফোন ধরবে না।হ্যারিকে তূর্যয় ম্যানেজ করে নিতে পারলেও রাণী রেগে বোম্ব হয়ে আছে এটা তূর্যয়ের অজানা নয়।আজ হ্যারির বিয়ে ছিলো।রাণীর প্রেগন্যান্সির কারণে যেতে পারেনি তূর্যয় আর রাণী, হ্যারির বিয়েতে।হ্যারির বিয়ে তার মায়ের বাঙালি এক বান্ধবীর মেয়ের সাথেই হয়েছে।হ্যারির বউ ছোট কাল থেকে বিলেতে থাকলেও,মেয়েটা বাংলাদেশী।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই অ্যাঞ্জেলা আর রাণীর খাতির হলো।বিয়ের পর হ্যারির সাথে বাংলাদেশে পাড়ি জমাবে অ্যাঞ্জেলা।
রাণী দুপুর থেকেই সেজেগুজে বসে পড়েছিলো হ্যারিদের সাথে ভিডিও কলে।তাদের সম্পূর্ণ বিয়ে রাণী এবং তূর্যয়ের একসাথে দেখার কথা হলেও রাণী একাই দেখেছে বিয়ের সব অনুষ্ঠান।কারণ,তূর্যয়ের তো কোনো খবরই ছিলো না। ইকরামকে রাণী ফোন করেছিলো, তূর্যয় ফোন তুলছিল না তাই।ইকরাম জানিয়েছিল রাণীকে,তূর্যয় মিশনে ব্যস্ত। ব্যস,রাণী রেগে বোম্ব হয়ে গিয়েছে।এখনো সে তার পরিহিত সুন্দর কারুকার্যের শাড়ি আর গয়না খুলেনি।সোফায় চুপ করে ঝিমুচ্ছে সে।হায়া এতো বললো তাকে,রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।কিন্তু,রাণী অনড়।
তূর্যয় ঘরে ঢুকে উঁকি দিয়ে দেখলো রাণী সোগায় বসে আছে।তার পাশে হায়া।নিজেকে জীবাণুমুক্ত করতে তূর্যয় ঢুকে পড়লো ওয়াশরুমে।গোসল সেরে টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে লিভিংরুমে গেলো সে।তূর্যয় গলা খাকারি দিতেই হায়া দ্রুত উঠে পড়লো রাণীর পাশ থেকে।রাণী রাগী চোখে তাকিয়ে আছে তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয় রাণীর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে হালকা ঝুঁকলে রাণী মুখ কুঁচকে একটু সরে গেলো।এইদিকে রাণীর এমন বেশভূষায় তূর্যয়ের মনটা ধুকধুক করছে।রাণীর মুখে যেনো আলাদা এক আভা লক্ষণীয়।তূর্যয় রাণীর পাশে বসে তার নিজের আঙ্গুল ঘষে রাণীর অধরে লাল রঙা লিপস্টিক নিয়ে রাণীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“এতো সাজগোজ কি ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে?”
রাণী মুখ বাঁকালো।তূর্যয় রাণীর আরো কাছে গিয়ে তার কোমরে হাত জড়িয়ে তাকে নরম কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমার, বউ।তোমার এই সাজ আমার প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।কি যে আদুরে লাগছে!”
রাণীর মাথায় এলো অন্য প্রশ্ন।সে মাথা ঘুরিয়ে তূর্যয়কে বললো,
–“ওহহ,আমি আজ সেজেছি তাই আমাকে সুন্দর লাগছে।আর সাজ ছাড়া আমি দেখতে পেত্নীর মতো।বাহ বাহ,ভালই।তো আপনার দ্বিতীয় বিয়ে কবে হচ্ছে শুনি?কোন সুন্দরী রমণীকে বিয়ে করছেন?”
তূর্যয় রাণীর একদম কাছে চলে এলো।রাণীর কপালের সামনের চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে রাণীর নাক টেনে তাকে জবাব দিলো,
–“রাণী নামক রমণীকে।যে আমার জন্যে সারাজীবন সুন্দর।সে মেকাপ দিলেও সুন্দর,না দিলেও আরো বেশি সুন্দর।”
–“হয়েছে হয়েছে আর কাহিনী করা লাগবে না।মানুষের মনের কথা প্রথমেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।এখন বলুন,কি করবেন আমাকে নিয়ে?আমি বিয়েতে একটুও মজা করতে পারিনি আপনাকে ছাড়া।হ্যারি ভাই,অনেক রেগে আছে আপনার সাথে।এখন আপনি আমাকে বাহিরে নিয়ে যাবেন,ঘুরতে।আমি কিছুই জানি না।”
রাণী অন্য দিকে ঘুরে বসলো।তূর্যয় রাণীর মুখ চেপে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
–“তোমার এখন সাত মাস চলছে,রৌদ্র।এই অবস্থায় বাহিরে যাওয়া একেবারে ঠিক হবে না।”
–“ইন্না।আমি যাবোই যাবো।আপনি থাকবেন আমার সাথে আমার কোনো ভয় নেই আর।প্লিজ,তূর্যয় আমি যাবো বাহিরে।আমার দম বন্ধ লাগছে বাসায়।এই সাজগোজ করে আমি কি বাসায় বসে থাকবো?আমি যাবো বাহিরে।”
রাণী চিল্লিয়ে বললো।
–“আচ্ছা,আচ্ছা জান।আমি আসছি কাপড় বদলে।”
রাণীর মুখে হাসির চিলিক ফুটে উঠলো।খুশিমনে রাণী তূর্যয়ের গালে নিজের অধর ছোঁয়ালো।তূর্যয়ের ঠোঁট প্রশস্ত হলো।রাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে তূর্যয় তাকে নির্দেশ দিলো,
–“ফ্রেশ হয়ে নাও।আমি আসছি।”
রাণী মাথা নাড়ালো।তূর্যয় যেতেই রাণী হায়াকে ডাকলো,
–“হায়া!”
হায়া আসলে রাণী উঠে হায়াকে আবারও বললো,
–“চলো,রেডি হয়ে নাও।তোমার স্যার আর আমি বের হচ্ছি।”
হায়া মাথা নাড়ালো,
–“উহু,আমি বাসায় ঠিক আছি। বড় স্যার আপনে সাথে থাকলে,আমার আর কোনো চিন্তা নেই।উনার চেয়ে আপনার ভালো খেয়াল আর কেউ রাখতে পারবে না।আর দুই লাভ বার্ডের মাঝে আমি কাঁটা হয়ে থাকতে চাই না।এখন কোনো কথা না বলে চলুন,একটু ফ্রেশ হবেন।”
রাণী আর জোর করলো না হায়াকে।সে মনে মনে ভাবছে,
–“আসলেই তো আমার দানবের চেয়ে আমার ভালো খেয়াল আর কেউ রাখতে পারবে না।”
রাণী আর তূর্যয় দুইজনই বেরিয়ে পড়লো। তাদের পিছু পিছু তূর্যয়ের গার্ডের গাড়ি আছে।রাণী জানেনা তারা কোথায় যাচ্ছে।রাণী আড় চোখে তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।নিজের ভারী পেটে হাত রেখে রাণী বলতে লাগলো,
–“এই বাচ্চা,তোর বাবাকে দেখেছিস আজকে?কি সুন্দর লাগছে তাকে খয়েরী রঙের শার্টে,তাই না?”
–“বাচ্চাকে না বলে সরাসরি আমাকেই বলতে পারিস,
রৌদ্র।আমি জানি আমি সুদর্শন।”
রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকালে,তূর্যয় রাণীর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো।
–“ইস,ঠিক ভাবে গাড়ি চালান।আজকে ড্রাইভার নেই।তাই আমার দিকে না তাকিয়ে রাস্তার দিকে তাকান।”
তূর্যয় কিছু বললো না বৈকি হাসলো মৃদু।তারা দুইজন পৌঁছালো একটা সুন্দর নদীর পাড়ে।রাণীর চোখ জ্বলজ্বল করছে নদী দেখে।তূর্যয় তার গার্ডদের অনেক দূরে দাঁড় করিয়ে রাখলো।রাণীকে ধীরে নামালো তূর্যয় গাড়ি থেকে।তূর্যয়ের হাত আঁকড়ে ধরে রাণী হেঁটে যাচ্ছে।বৃষ্টি হওয়াতে পরিবেশ পরিষ্কার।নদীর পানিও চিকচিক করছে।ঝিরিঝিরি বাতাসে রাণীর শাড়ির আঁচল উড়ছে।তূর্যয় সেথায় নাক ডুবিয়ে রাণীর চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে।ধীরে ধীরে রাণীর উচুঁ হয়ে থাকা পেটেও হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে সে।চারপাশে কিছু মানুষ লক্ষণীয়।সেই হিসেব রেখেই তূর্যয় তার অর্ধাঙ্গীর সাথে এই মনোরম পরিবেশ উপভোগ করছে।একটু পরেই তূর্যয়কে একজন লোক এসে কিছু জানালে,রাণীকে নিয়ে সে একটা কুঠিরে প্রবেশ করলো।সেখানে তারা বেশকিছু ছবি তুললো,নদীর মনোরম পরিবেশ দেখলো এবং পরিশেষে তারা খাবার সেরে উঠে পড়লো গাড়িতে।গার্ডরা আরেকটু দূরে আছে।
উপরের ব্রীজে থাকা একটা নীল গাড়ির পাশে দাঁড়ানো লোক তূর্যয়ের গাড়ির চাকা বরাবর শুট করলো।এই লোকটা সিমির ঠিক করা লোক।এই লোককে সিমি নাজিমের সাহায্যে ঠিক করেছে।যে চব্বিশ ঘন্টা তূর্যয় আর রাণীর খবরা খবর দেয়।তূর্যয়দের বাসার একটু দূরেই ভিক্ষুক সেজে লোকটা বসে থাকে।সিমি নিজের টাকা আর নাজিমের টাকা জোগাড় করে এই লোককে ঠিক করেছে।
টায়ারে লিক হয়ে জোরে শব্দ হলো।রাণী হাত রাখলো তার দুই কানে।তূর্যয় বুঝেছে এখন এইখানে থাকা নিরাপদ নয়।তূর্যয় ইকরামকে ফোন দিয়ে বললো,
–” দ্রুত সামনের দিকে আয়।টায়ার পাংচার করেছে কেউ শুট করে।”
রাণী ভয়ে কাবু হয়ে আছে।সে ভীত কণ্ঠে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“কি হবে এখন?আমার বাবু?”
তূর্যয় রাণীর দুইগালে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললো,
–“আমি আছি তো জান।ভয় পেও না।”
রাণীকে তূর্যয় গাড়ি থেকে নামালো।পরপরই গুলির শব্দ হলো।তূর্যয় রাণীকে নিজের শরীর দিয়ে আঁকড়ে ধরলো।কোমরের পেছন থেকে আগেই পিস্তল নিয়ে ফেলেছিল সে।সেটার সাহায্যেই পেছনের দিকে শুট করলো তূর্যয়।রাণী তূর্যয়ের শার্ট চেপে ধরলো শক্ত করে।
–“বউ!আমরা ঠিক আছে।ইকরাম চলে আসবে সামনে।”
–“বাবু।”
–“বাবু ঠিক থাকবে।আমার বাবু আমার মতো স্ট্রং।”
দূর থেকে ইকরামের গাড়ি দেখতেই তূর্যয় রাণীকে কোলে তুলে নিলো।তূর্যয় রাণীকে নিয়ে মাঝ রাস্তায় না হেঁটে ঝোপঝাড়ের ভেতরে চলে গিয়েছিলো।যার দরুণ,রাণী আর তূর্যয়কে উপর থেকে লক্ষ্য করতে পারেনি সেই লোকটি। অতঃপর সিমির এই পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হলো।
ইকরামের গাড়ি কাছাকাছি আসতেই রাণীকে নিয়ে বের হলো তূর্যয়।ইকরাম দ্রুত গাড়ি থামিয়ে দিলো।রাণীকে গাড়িতে বসিয়ে তূর্যয় গাড়ি থেকে বের হতে নিলে রাণী তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“আপনি আমার সাথে থাকুন না,প্লিজ।আমার ভয় করছে।”
রাণীর ভীত কণ্ঠে তূর্যয় আর গাড়ি থেকে নামলো না।ইকরামের দিকে তাকিয়ে সে ইকরামকে নির্দেশ দিলো,
–“সে যেনো বেঁচে না থাকে।”
–“থাকবে না বস।”
ইকরাম মাথা নেড়ে বললো।
গাড়ি চলতেই রাণীকে শক্ত করে নিজে সাথে মিশিয়ে নিলো তূর্যয়।রাণীর বুকটা এখনো ধুকধুক করছে।
–“রৌদ্র?ঠিক আছো?”
–“হুম।”
–“সরি।”
তূর্যয়ের মলিন কণ্ঠ।
রাণী সেই অবস্থায়ই তূর্যয়কে জিজ্ঞেস করলো,
–“কেনো,দানব?”
–“এইযে আমার জন্যে তুমি একটা স্বাভাবিক জীবন পাচ্ছো না তাই।অনেক অভিমান আমার উপর তোমার,
তাই না?”
রাণী এইবার মুখ তুলে তাকালো তূর্যয়ের দিকে,
–“একদমই না।আপনি আমার জন্যে একটা সুখের ফোয়ারা।আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনার এই জীবনটাকেও আমি ভালোবাসি।এইসব চিন্তা করছেন কেনো হঠাৎ?”
–“এমনি।ঘুমানোর চেষ্টা করো।বাসায় যেতে সময় লাগবে।”
তূর্যয়ের শীতল কণ্ঠ।
–“পেটে হালকা ব্যাথা করছে।আমি আপনার কোলে শুয়ে থাকতে চাই।”
তূর্যয় ধীরে রাণীকে নিজের কোলে শুয়ে দিলো।আলতো হাতে রাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে,
–“চলে যাবে ব্যাথা।চোখ বন্ধ করো।ঘুমাও, জান।”
রাণী চোখ বন্ধ করলো। তূর্যয়ও চুপ হয়ে আছে।
শুধুমাত্র তার বউ আর বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় আজ তার একটু আফসোস হচ্ছে তার মাফিয়া হওয়ার কারণে।পরক্ষণে তূর্যয় নিজের মনে মনে ভাবতে লাগলো,
–“একেকটাকে আমি হাজার টুকরো করবো।আমার এই হিংস্রতা থেকে কোনো দোষী বাঁচবে না।আর আমার বউ,বাবুর ক্ষতি করার যে চিন্তা করবে;তাকে আমি জীবন্ত কবর দিবো।আমি থাকতে কেউ তাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না।তাশরীফ তূর্যয় তার পরিবারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সতর্ক।”
ঘুমন্ত রাণীর দিকে তাকিয়ে আবারও সে বলে উঠলো,
–“তোমার দানব সন্ত্রাসী কিছুতেই তোমার আর বাবুর ক্ষতি হতে দিবে না।”
তূর্যয় রাণীর গালে হাত বুলালো।
গাড়ি চলেছে।রাণী ঘুম।একটু পরেই মোবাইল বেজে উঠলে তূর্যয় মোবাইল বের করলো।সালেহার নাম্বার দেখে তূর্যয় ফোন রিসিভ করলে সালেহা বললো,
–“বাবা,রাণী কোথায়?একটা অঘটন ঘটে গেলো।”
–“রৌদ্র,অসুস্থ।কেনো কি হয়েছে?”
তূর্যয়ের থমথমে কণ্ঠ।
ওপাশ থেকে কান্না মাখা কণ্ঠে সালেহা বলে উঠলো,
–“রাণীর বান্ধুবী রিয়া আত্মহত্যা করেছে।একটু আগেই তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।তাকে সিলিংয়ে ঝুলে থাকতে সর্বপ্রথম দেখেছিল,সিমি।কেনো এই মেয়ে এমন করলো,আমার তো মাথায় আসছে না।রাণী সুস্থবোধ করলে তাকে একবার তার বান্ধুবির শেষ যাত্রাটা দেখিয়ে নিও।রাখছি বাবা।”
–“কি বলছেন!”
–“হুম,বাবা।এসো তুমি,রাণীকে নিয়ে।”
সালেহা ফোন কেটে দিলো।রাণীর বান্ধুবি রিয়াকে তূর্যয় বেশি চিনে।কারণ,এই রিয়ায় রাণীর সাথে দেখা করতে প্রায়ই আসতো।এই মেয়ে কেনো আত্মহত্যা করেছে এটাই তূর্যয়ের মাথায় আসছে না।অতঃপর তূর্যয়ের মুখটা প্রশ্নে ছেয়ে গেলো।
চলবে….