#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা:সালসাবিল সারা
২৫.
দুপুরের খাবার হ্যারির সাথে খেয়েছে তূর্যয়। খাওয়া শেষে হ্যারি তার অ্যাপার্টমেন্টে চলে গিয়েছে।এরপর তূর্যয় আবারও ঘুমিয়ে পড়েছিলো।তার ঘুম ভাঙলো একটু আগেই। হাতে আর পিঠে সামান্য ব্যাথা অনুভব করছে তূর্যয়।গতকালের তাদের মিশনটা ছিল প্রচন্ড ভয়াবহ।তাদের গতকালের বিপক্ষ দল ছিল দেশের অন্যতম হিংস্র দল।যার কারণে তাদের সাথে লড়াইয়ে টক্কর দিতে নিজেও কিছুটা আঘাত পেয়েছে তূর্যয়।তার ডান চোখের পাশে ছুরির হালকা খোঁচা লেগেছিলো।সেখানে হ্যারি গতকাল তারা ফেরার সময়, ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছিলো।যেটা এখন তূর্যয় উঠানোর চেষ্টা করছে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।হালকা জোরে টান দিতেই ব্যান্ডেজ উঠে গেলো। কিন্তু, সেখান থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো রক্ত।তীব্র জ্বলার কারণে তূর্যয় নিজের চোখ বন্ধ করে অস্ফুট কন্ঠে বললো,
–“আহহ!”
কিন্তু পরক্ষণে তূর্যয় বেসিনের পানি ছেড়ে তার মুখ সেখানেই ডুবিয়ে দিলো।যার কারণে রক্ত সেই বেসিনের পানির সাথে মিশে যাচ্ছে।প্রচন্ড জ্বালা সহ্য করে নিচ্ছে তূর্যয় সেই পানির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে।একটু পরেই মুখ তুলে সে দেখলো রক্ত পড়া অনেকটাই কমেছে।তূর্যয় সেদিকে আর পাত্তা না দিয়ে ঝর্ণার নিচে এসে দাঁড়ালো।পিঠে,
পেটের পাশে ছোপ ছোপ কেটে যাওয়া স্থানে প্রচন্ড জ্বলছে ,তূর্যয়ের।ডান হাতের উপরিভাগে অনেকটাই চামড়া উঠে গিয়েছে তূর্যয়ের,কাউকে অতিরিক্ত ঘুষি দেওয়ার কারণে। কাল রাতে কতজনের নাক, দাঁত ফাটিয়েছে তূর্যয়, সে নিজেও তা জানে না।জনবেই বা কিভাবে?হিংস্র হয়ে উঠলে সে তার নিজের মধ্যেই থাকে না।দেওয়ালে দুই হাত ঠেকিয়ে তূর্যয় ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে নিজের মাথা আর শরীর ভালো করে ভিজিয়ে নিচ্ছে।সবকিছুর যন্ত্রনা তূর্যয় চুপ করে সহ্য করে নিচ্ছে।এইসব যন্ত্রনা যেনো তূর্যয়ের বড্ড আপন।
গোসল করার মধ্যেই বাথরুমে থাকা বড় সেল্ফের উপর তূর্যয়ের মোবাইল বেজে উঠলো।তূর্যয় ঝর্ণা বন্ধ করে তাওয়ালে নিজের হাত মুছে ফোন রিসিভ করলো।রাণীর জন্যে ঠিক করা লোকটির ফোন দেখে তূর্যয়ের ভ্রু কুঁচকে এলো। অপর পাশ থেকে লোকটি তাড়াহুড়ো করে বলতে লাগলো,
–“বস,ম্যাডাম কার সাথে যেনো কোথাও যাচ্ছে।”
তূর্যয় রেগে লোকটিকে বলে উঠলো,
–“ফলো কর।আর ছবি পাঠা।”
ফোনের লোকটি ফোন কেটে,একহাতে বাইকের হ্যান্ডেল ধরে অন্য হাতে রাণী আর মোল্লা সাহেবের ছবি তুললো।বাইকের গতি অনেক কম হওয়ায় লোকটির বেশি অসুবিধে হয়নি ছবি তুলতে।লোকটি তাদের দুইজনের ছবি দ্রুত পাঠালো তূর্যয়কে।
তূর্যয় বেশ অবাক হলো রাণী আর মোল্লা সাহেবকে একসাথে দেখে।তূর্যয় বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
–“সেদিনের রাগটা আজও যায়নি, আমার রৌদ্রের মন থেকে।এখন নিশ্চয় মোল্লা সাহেবের কাছে আমার নামে নালিশ করবে?এই মেয়েটা এমন কেনো?যার সাথে মিশে, তাকে তার জন্যে অনেক যত্নশীল বানিয়ে ফেলে।”
তূর্যয় ফোন করলো রাণীর জন্য ঠিক করা লোক,
ফরহাদকে।
–“চোখে চোখে রাখ তাদের।কোনো গন্ডগোল হলে সাথে সাথেই আমাকে ফোন দিবি।”
–“জ্বী, বস।”
ফরহাদের জবাব পেয়ে তূর্যয় ফোন কেটে দিলো।গোসল শেষ করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো তূর্যয়।তাওয়াল দিয়ে ভালো করে মাথা মুছে তূর্যয় রুমের ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে নিলো।নিজের শরীরে পাওয়া আঘাতে অয়েনমেন্ট লাগিয়ে নিচ্ছে তূর্যয়।অয়েন্টমেন্ট লাগানো শেষে হাতের উপর আঘাত পাওয়া স্থানে ওষুধ লাগিয়ে সাদা রঙের একটা ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে নিলো সে।রুমে থাকা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে সে ব্যালকনিতে চলে গেলো। অসম্ভব সুন্দর সমুদ্রের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে তার ব্যালকনি থেকে।বিকালের শেষ ভাগের কমলা রোদ সমুদ্রের পানিতে পড়ার কারণে সমুদ্রের পানিকেও কমলা রঙের দেখাচ্ছে।তূর্যয় সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়ে সেটি ঠোঁটের মাঝে দিলো।এক হাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে অন্যহাতে সিগারেট ফুঁকতে লাগলো তূর্যয়।সমুদ্রের জ্বলজ্বল পানি দেখে তূর্যয়ের চোখে রাণীর ছবি ভেসে উঠছে।তূর্যয় সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে চোখ বুজে সমুদ্রের এই রোমাঞ্চকর পরিবেশ উপভোগ করছে রাণীর ছবি কল্পনা করে।তূর্যয় চোখ খুলে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলতে লাগলো,
–“সূর্যের কিরণে যেভাবে সমুদ্রের বুকে জ্বলজ্বল আলোর সৃষ্টি করেছে, ঠিক সেভাবে আমার জীবনে তোর আগমনে, আমার আঁধার জীবনে আলোর মেলা বসেছে।অনেক ধন্যবাদ রৌদ্র,আমার জীবনে আসার জন্যে।অতীতের কষ্ট আমাকে এখন এতো নাড়িয়ে তুলে না।কারণ,আমার সব কষ্ট তোমার সেই হাসি মাখা মুখ দেখলে নিমিষেই গায়েব হয়ে যায়।অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে,রৌদ্র।খুব শীঘ্রই আমার কাছে নিয়ে আসবো তোমায়।”
বুকে রাণীর জন্যে তীব্র ভালবাসার পাহাড় গড়ে,তূর্যয় বেশ মনোযোগ দিয়ে সমুদ্র আর সূর্যের কিরণের লীলাখেলা দেখছে।
‘
রাণী আর মোল্লা সাহেব এতিম খানা থেকে অনেকটাই দূরে চলে এলো।রাণী একটা খালি ভ্যানের উপর উঠে বসেছে।মোল্লা সাহেব তার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো।মোল্লা সাহেব রাণীর সাথে কুশল বিনিময় করতে লাগলো।আর রাণী হাসিমুখে সবটা উত্তর দিচ্ছে।একটু পরে রাণী ভ্যান থেকে নেমে মোল্লা সাহেবকে বসতে বললো সেখানে।
রাণীদের থেকে একটু দূরেই কালো গাড়িতে বসা সাবিনার লোক বুঝতে পারছে না,এতো মানুষের ভিড়ে রাণী কোনটা।তাই সবার কয়েকটা ছবি তুলে সে সাবিনাকে পাঠালো।সাবিনা রাণীকে চিহ্নিত করে ফোন করলো সেই লোককে,
–“আরে বালের বেডা,তোকে না কালকেই রাণীর ছবি দিলাম?এইযে ছবিতে গোল করে দিয়েছি। দেখছিস?বেগুনি রঙের কাপড় পড়া লম্বা মেয়েটাই হলো,রাণী। একেই তুলে আনবি।”
লোকটা এক হাতে ফোনের মধ্যে রাণীকে দেখে বাহিরে তাকালো আবার।এরপর কানে লাগানো ফোনে সে সাবিনাকে বলে উঠলো,
–“এই মাইয়্যা?এই মাইয়্যারে কাইল্লার ছবিতে তো একেবারেই অন্যরকম লাগতাছিল।ছবির থেইকা এই মাইয়্যা বাস্তবে বেশি সুন্দর।কইছিলাম কি মালকিন,এই মাইয়্যারে আগে আমি নাহয়..!”
লোকটা কিছু বলার আগেই সাবিনা খেঁকিয়ে উঠলো,
–“ঐ হারামজাদা, চুপ একদম।আমার ছেলের জন্যে ফ্রেশ মাল লাগবে।একেবারে অক্ষত অবস্থায় মেয়েটাকে আমার চাই।একটুও যেনো দাগ না লাগে তার গায়ে।নাহলে,তোকে কেটে কুত্তারে খাওয়াবো।”
সাবিনার কথায় লোকটা গাল চুলকালো।এরপর মুখ শক্ত করে বলতে লাগলো,
–“আইচ্ছা,আমি কিছু করমু না। টেকা রেডি রাইখেন।মালটা দেওয়ার আগে টেকা নিমু আমি।”
–“আচ্ছা,ফকিন্নি।”
সাবিনা কথাটা বলে ফোন রেখে দিল।আর ঐ লোকটা সাথে তার দুইজন সাথী রাণীর দিকে চেয়ে রইলো তাকে শিকার করার জন্যে।
‘
মোল্লা সাহেবকে চুপ থাকতে দেখে রাণী মোল্লা সাহেবকে বলে উঠলো,
–“বলুন না, মোল্লা সাহেব।আপনি আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন।আমি তূর্যয়কে তার অতীত থেকে বের করার চেষ্টা করবো সর্বোচ্চ। অতীতকে ঘিরে উনার আর কোনো ক্ষতি,আমি হতে দিবো না।”
মোল্লা সাহেব রাণীর মাথায় হাত রেখে বলতে লাগলো,
–“জানি, মা।তাইতো আজ এতো বছর পর, তোকেই আমার তূর্যয়ের অতীত সম্পর্কে বলতে ইচ্ছা জাগলো।আমি জানি,আমার তূর্যয়ের জীবনে তুই তার এক ঝাঁক আলো।”
রাণী মুচকি হাসলো মোল্লা সাহেবের কথায়।রাণী প্রস্তুতি নিচ্ছে,তার ভালোবাসার মানুষের সেই ভয়ংকর অতীত শোনার জন্যে।তূর্যয়ের অতীতের কথা শোনার জন্যে রাণীর মন ব্যাকুল হয়ে আছে।অতঃপর মোল্লা সাহেব বলতে শুরু করলেন,
–“আমার সাথে তূর্যয়ের দেখা হয় এইখানের এক স্থানীয় মাদ্রাসায়।ছেলেটা একদম সহজ সরল ছিলো।আমি পড়াতাম তাদের দিনের বেলায়।যতক্ষণ পড়তাম ছেলেটাকে,ছেলেটার আরবী পড়া শুনে আমার মন জুড়ে যেতো।সব সময় আমাকে দেখলে সালাম দিয়ে মুচকি হাসতো।আমিও যতটুক পারতাম তাকে আদর করতাম।তবে,তূর্যয়ের চোখে আমি বড্ড কষ্ট দেখতে পেতাম।ছেলেটা চুপচাপ থাকায়,আমার কখনো ইচ্ছা হয়নি তাকে জিজ্ঞেস করতে; তার চোখে কিসের এতো কষ্ট?আমিও ভাবতাম,হাসান সাহেব অনেক বিত্তবান মানুষ।তার ছেলের তো কোনো জিনিস নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কথা না।ছোট মানুষ তার উপর তার মা নেই,তাই হয়তো মন খারাপ করতো সে।এমনটাই আমি ভাবতাম তখন।কিছুদিন পর পর দেখতাম,তূর্যয়ের চোখ মুখ লাল।বেশ ফোলা থাকতো তার চোখ মুখ।কিন্তু,আমাকে দেখলেই সে সালাম দিতো, মুচকি হাসতো।আমি ধরতে পারতাম না কিছু,তার সেই হাসি মুখ দেখে।মাদ্রাসায় তখন সব ছাত্ররা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থাকতো। কেউ কেউ পড়া শেষ করতে না পারলে তাদের রাতভর মাদ্রাসায় কাটিয়ে দিতে হতো।একদিন এক হুজুরের অসুস্থতায়, আমাকে তার হয়ে দায়িত্ত্ব পালন করতে হয়েছিল। সব ছাত্ররা তাদের রাতের পড়া পড়ছিল আমার কাছে।তখন তাদের মাঝে চোখ বুলিয়ে দেখলাম,তূর্যয় নেই।আমি একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,’তূর্যয় কোথায়!’ আমার কথায় ছেলেটা চুপ হয়ে যায়।আমি তখনই বুঝতে পারলাম, কোনো একটা কিছু গন্ডগোল হয়েছে।আমি ছাত্রদের পড়তে বলে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম।মাদ্রাসার শেষ একটা রুমে কিছু চেঁচামেচির শব্দ পাচ্ছিলাম।মনে মনে দোয়া পড়ে আমি সেদিকেই যাচ্ছিলাম এগিয়ে।দরজায় কান পাততেই,একটা হুজুরের বেশ রাগী কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলাম আমি;’তোর বাপ বলেছে তোকে পিটিয়েই মেরে ফেলতে।’ এমন কথা শুনে আমি জোরে দরজায় কড়া নাড়লাম।দরজা খুলতেই আমাকে দেখে চমকে উঠলো মাদ্রাসার এক হুজুর, হামজা।উনি হয়তো আমাকে আশা করেননি সেদিন।আমাকে দেখে দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলে আমি এক লাথি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।ভেতরে ঢুকতেই আমার চোখে পানি চলে এলো।তূর্যয় রক্তাক্ত হয়ে পড়ে ছিল ফ্লোরে।তূর্যয়ের পাঞ্জাবি ছিড়ে তার ক্ষত দেখা যাচ্ছিল।হামজার হাতে ছিল একটা লাঠি যার গায়ে ধারালো কিছু পেঁচানো ছিল।আমাকে দেখে তূর্যয়ের মুখের রং পরিবর্তন হতে শুরু করলো।ব্যাথায় কাতরানো অবস্থায় তূর্যয় দাঁড়িয়ে পড়লো শোয়া থেকে।হামজা নানান কথা বলে যাচ্ছে।শেষে হামজা স্বিকার করলো,হাসান সাহেবের জন্যেই সে তূর্যয়কে রোজ পেটাতো।শুধু পেটাতোই না,রাতভর অনাহারে রাখতো সে।এইসব শুনে আমার মেজাজ অনেক বেশি খারাপ হয়েছিল।জোয়ান ছিলাম তখন,
রক্ত বেশ গরম ছিল।তূর্যয়কে তখন বলেছিলাম,
‘পৃথিবীতে নিজে বাঁচতে অন্যকে মারতে হয়;যদি সে তোর জীবনেরই কাঁটা হয়ে থাকে।হিংস্র হতে শিখ।এই দুনিয়ায় ভোলা ভালো মানুষের দাম নেই।’ আমাকে দেখতে পেয়ে তূর্যয়ের চোখের সেই রাগী ভাব অনেক আগেই আমি দেখতে পেয়েছিলাম।আর আমার অমন কথা শুনে তূর্যয় তার পাশে পড়ে থাকা লম্বা ছুরি দিয়ে কোপ দিলো হামজা হুজুরের হাতে।এই নিয়ে হামজা হুজুরের চিৎকারে সবাই জড়ো হলো।হামজা হুজুরকে শাসানো হলো।আমি এরপর থেকে তূর্যয়ের কাছাকছি যেতে লাগলাম।অল্প সময়ে আমি তার বেশ প্রিয় একজনে পরিণত হয়েছি।হাসান সাহেবের কাছে একটা বন্ড সাইন করিয়েছি,ভবিষৎ এ তূর্যয়ের কিছু হলে সর্ব প্রথম তাকেই পুলিশে দেওয়া হবে।এটা এখনো আমার কাছেই আছে।তখন,সবার চাপে এসে সাইন করেছিলেন উনি।তবে, তূর্যয়ের সেইসব দুঃসময়ের কথা ভাবতেই তার শরীর খারাপ হতে শুরু করেছিল। যার কারণে তার পড়ালেখার গ্যাপ সৃষ্টি হয়।কিছুদিন পর তূর্যয় আমাকে তার সব বললো।কিভাবে তার মা মারা যাওয়ার পর, রাত দিন হাসান সাহেব তাকে মেরেছিল।খাবার দেয়নি খেতে।দিনের আলো দেখতে দেয়নি।এরপর মাদ্রাসায় মার খাইয়েছে হামজার দ্বারা।তূর্যয়ের গায়ে এখনো সেই মাইরের নিশান রয়েছে।এতো মাইর খেয়ে কিভাবে ছেলেটা বেঁচে ছিল,এটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলে।এইভাবেই চলার পর ধীরে ধীরে তূর্যয়ের পরিবর্তন হতে শুরু করলো।সে গম্ভীরতাকে আপন করতে থাকলো।তূর্যয় স্বাভাবিক হতেই তাকে আমি আবারও স্কুলে ভর্তি করায়।অনেক মার খেয়েছিল আমার ছেলেটাকে।অনেক বছর হামজার অত্যাচার সহ্য করেছিল সে।সেই অত্যাচারের কথা ভেবে,হাসান সাহেবের অত্যাচারের কথা ভেবে, ছেলেটা হয়ে উঠলো হিংস্র।
মাঝখানে আরো অনেক কাহিনী আছে।তূর্যয়ের মায়ের বান্ধবী হলো,সালেহা;তোদের এতিম খানার মালকিন।সাথে সে আমার বউ।”
এতটুক বলে থামলো মোল্লা সাহেব।নিজের হাতে থাকা পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে নিলেন উনি।আর রাণী এতটুক শুনেই কান্না করে নাক মুখ লাল করে নিয়েছে।শেষের কথা শুনে রাণী অবাক হয়ে মোল্লা সাহেবকে বললো,
–“এইসব কিভাবে সম্ভব?আপনারা তো এখন আলাদা থাকেন।আলাদা হয়েছিলেন কেনো আপনারা?”
মোল্লা সাহেব পানির বোতল নিজের কোলে রেখে আবারও বলতে লাগলো,
–“তূর্যয়ের মা আর সালেহার সাথে কি হয়েছিল আমার জানা নেই।তবে হাসান সাহেবকে তূর্যয়ের মা বিয়ে করার পরই তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভেঙে যায়,এমনটাই শুনেছিলাম।একদিন তূর্যয়কে আমার বাড়ি নিতেই সালেহা জানলো আমি তূর্যয়ের অনেক বেশি আপন একজন।তূর্যয়কে দেখে সালেহার চোখে পানি ছিল।কিন্তু সেদিন আমাকে সে বলেছিল,’এই ছেলেকে আমার বাড়ি কেনো এনেছো?এই ছেলে নিশ্চয় হাসানের মতোই শয়তান হয়েছে।আপনি এই ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখবেন,নাহলে আমার সাথে সম্পর্ক রাখবেন।ঐ কাল নাগিনীর ছেলেকে আমি আপনার সাথে কোনো সম্পর্কই সহ্য করে নিবো না।’
মা মরা ছেলেটার চোখে আমি সেদিন সালেহার জন্যে প্রচন্ড ঘৃণা দেখেছিলাম।তূর্যয় কিছু না বলে চুপ করে ছিল।কিন্তু আমি চুপ থাকিনি।মা মরা ছেলেটার সাথে বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিন নিজের ভিটে বাড়ি ছেড়ে।আমাদের ছেলে কাফিফ কিছুদিন সালেহার সাথে থাকে, তো কিছুদিন আমার সাথে থাকে।সেদিন সালেহাকে আমার অনেক নিকৃষ্ট মনে হয়েছিল।তার চোখে পানি দেখা সত্বেও তার কারণ জিজ্ঞেস করিনি আমি তাকে।পরে মাদ্রাসায় থাকতে লাগলাম। সময় চলে যাচ্ছিল অনেক দ্রুত।হাসান সাহেবের ছেলে বলে তূর্যয়ের অনেক প্রভাব ছিল।কিন্তু কেউ তো আসল কথা জানতো না, হাসান সাহেব কি কি করেছেন।কলেজ থেকেই তূর্যয়ের হিংস্রতা বাড়তে লাগলো।ধীরে ধীরে নানান লোকের সাথে মিশে তূর্যয় পরিণত হলো কালো বাজারের সেরা ব্যবসায়ী,সাথে বড় একজন মাফিয়া।মাঝে আমি সালেহার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম,কিন্তু সে সুযোগ দেয়নি। দুইজনই যৌবনের চাপে নিজেদের দাপট দেখিয়ে সমাধান করিনি কিছুই।এখনো সেটা সব এলোমেলো হয়ে আছে।ধীরে ধীরে শহর জুড়ে তূর্যয়ের নাম ছড়িয়ে গেলো। যা এখন পর্যন্ত কেউ থামাতে পারেনি।তূর্যয়ের বাবার পুরান বাড়ি তূর্যয় এতিম খানায় পরিণত করেছে।এরপর সেখানেই আমি প্রধান হিসেবে আছি।সব কিছু সময়ের সাথে পরিবর্তন হলেও তূর্যয়ের এই খারাপ অতীত তার পিছু ছাড়ে না।তার দুর্বলতা হলো,তার মায়ের মৃত্যু।মায়া এতিম খানায় ঢুকতেই, সে নাকি তার মা,বাবাকে দেখতে পায়।তূর্যয়ের অ্যাটাক উঠে যায়।সাথে তূর্যয় সালেহাকে দেখলেও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না।তূর্যয়ের মায়ের সাথে সালেহার কি হয়েছিল সেটা আল্লাহ্ জানেন।কিন্তু,এখন হয়তো সালেহা তার ভুলটা বুঝতে পেরেছে।তূর্যয়ের জন্যে আমার মায়া হয়,প্রচুর মায়া।সেই মায়ায় আমি আমার সংসার ত্যাগ করেছি।তূর্যয়ের মনে অনেক কষ্ট।বেঁচে থেকে সে মরণের স্বাদ নিয়েছিল।আল্লাহ্ সহায় হোন ছেলেটার।”
মোল্লা সাহেব নিজের চোখের পানি মুছলেন।আর রাণীর ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কান্না করতে।চারদিকে অন্ধকার নেমেছে।মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। মোল্লা সাহেব রাণীকে বলে উঠলেন,
–“আসি মা।আযান দিচ্ছে।যেতে পারবি তো একা?আর আমার তূর্যয়কে যদি ভালোবেসে থাকিস,তাহলে ছেলেটাকে তার অতীত থেকে বেরুতে সাহায্য কর।ছেলেটার বড্ড প্রয়োজন তোকে।”
রাণী মাথা দুলিয়ে কান্না চেপে মোল্লা সাহেবকে উত্তর দিলো,
–“পারবো যেতে।”
মোল্লা সাহেব দ্রুত হেঁটে মসজিদের দিকে যাচ্ছে।রাণী ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো ভ্যানের সাথে।এতক্ষণের জমানো চোখের পানি এইবার গাল বেয়ে পড়ছে তার।রাণী চোখের পানি মুছতেই আবারও ঢুকরে কেঁদে উঠলো।মনে মনে সে বলতে লাগলো,
–“তূর্যয়ও এতিম!আমার মতো এতিম।আর আমি কিনা কিসব বলেছি উনাকে?আল্লাহ্!আমাকে ক্ষমা করো।তূর্যয়ের অতীতের রহস্য এতো হিংস্রতায় ঘেরা হবে এটা আমি কখনো ভাবিনি।আমি আমার জান দিয়ে হলেও,
তূর্যয়ের সেই ভয়ংকর অতীত ভোলানোর চেষ্টা করবো আমি।ইস,ছোট্ট তূর্যয় কতো না কষ্ট সহ্য করেছেন?এতো নির্যাতনের পরেও বেঁচে ছিলেন কিভাবে উনি!হয়তো আমার জন্যে,আল্লাহ্ উনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।নিজের এতো দরদ ভরা জীবনের কাহিনী তূর্যয়কে এতটা হিংস্র বানিয়ে ফেলেছে!”
রাণীর সব এলোমেলো লাগছে।মাথার কাপড় ঠিক করে রাণী নিজের মুখের উপর চলে আসা চুল ঠিক করে সামনে হাঁটতে লাগলো।তূর্যয়ের অতীতের কথা ভাবতেই রাণীর চোখে পানি জমছে।
কিছুদূর যেতেই সেই কালো রঙের গাড়ি এসে দাঁড়ালো রাণীর সামনে।রাণী চিৎকার দেওয়ার আগেই রাণীর মুখ চেপে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো সাবিনার ঠিক করা লোকেরা।রাণীর মুখ,চোখ,হাত কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলো তারা।রাণী আতঙ্কে বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হতে যাচ্ছে। ভয়ে রাণীর জান বেরিয়ে যাচ্ছে।অনেক চিৎকার করছে সে। কিন্তু শব্দ বেরুচ্ছে না, তার মুখ বাঁধা থাকার কারণে।প্রধান লোকটা মেসেজ করে দিলো সাবিনাকে,
–“শিকার কইরা ফেলাইছি।টেকা রেডি রাখবেন।”
মেসেজ দেখেই সাবিনা মমতা এতিম খানার সেই মানুষকে ফোন করে বললো,
–“মিষ্টি পাঠা।আজ রাণীর বিনাশ হবে।”
সাবিনার এমন কথা শুনে “হাহা” করে হেসে উঠলো সাবিনা আর অজানা সেই মানুষটি।
‘
তূর্যয় ঘর থেকে মাত্রই বের হয়েছে।সাদা রঙের শার্টের উপর তূর্যয় কালো রঙের কোটটি কাধেঁর উপর ঝুলিয়ে রাখলো।গাড়িতে বসে নিজের সাদা রঙের শার্টের হাতা বটতে শুরু করলো সে।নিজের পাশের সিটে রাখা পিস্তল, হাতে তুলে বুলেট আরেকবার চেক করে নিয়ে নিজের কোমরের পিছে রাখলো।আজ তূর্যয় নরমাল সু পড়েছে।তাই তার ধারালো ছুরিটি সেটার কোটার মধ্যে রেখে পেটের ডান দিকে গুঁজে নিলো তূর্যয়। ঘাড় ডানে বামে ঘুরিয়ে নিয়ে তূর্যয় নিজের ঘাড়ে হাত ঘষতে লাগলো।শার্টের কলার ঠিক করেই তূর্যয় নিজের হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকালো। হাতটা একটু নাড়াতেই তূর্যয় ব্যাথা অনুভব করলো অল্প।যদিও তূর্যয় ভাবলো এখন ব্যান্ডেজ খুলে ফেলবে।কিন্তু ব্যাথার কথা তার মাথায় আসতেই সাদা রঙের ব্যান্ডেজটা আর খুললো না সে।ডান চোখের পাশে হাত দিতেই তূর্যয় অনুভব করতে পারলো তার চোখের পাশে একটু লম্বা হয়ে রক্ত জমাট বেঁধেছে।তূর্যয় এইসবে না ভেবে গাড়িতে গা এলিয়ে বসতেই তার মোবাইলে ফোন এলো। ফরহাদের ফোন দেখে তূর্যয় সোজা হয়ে বসলো।ফোন রিসিভ করার আগে তূর্যয় বলে উঠলো,
–“এই মেয়ে আমাকে পাগল করে ছাড়বে।”
কথাটা বলে ফোন ধরতেই,তূর্যয় ফরহাদের চিন্তিত কণ্ঠ শুনতে পেলো,
–“বস,রাণী ম্যাডামকে কেউ উঠিয়ে নিয়েছে।আমি ফলো করছি তাদের।”
তূর্যয়ের মনে হচ্ছে সে ভুল শুনেছে।তূর্যয় বেশ জোরে চিল্লিয়ে ফরহাদকে বললো,
–“তোর লোকেশন শেয়ার কর আমাকে।দ্রুত।”
ফরহাদের ফোন কেটে তূর্যয় তার ড্রাইভারকে চিল্লিয়ে বললো,
–“গাড়ি থামা।”
গাড়ি থামতেই তূর্যয় গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে নামিয়ে সে নিজেই গাড়ি চালাতে শুরু করলো।ফরহাদের লোকেশন ফলো করে তূর্যয় গাড়ি চালাচ্ছে।যতটুক শর্টকাট নেওয়া যায়,তূর্যয় সেটাই নেওয়ার চেষ্টা করছে।তূর্যয়ের মেজাজ এখন সাত আসমানে।রাগে তূর্যয়ের দাঁত ঠকঠক করছে।এরমধ্যেই তূর্যয়ের মোবাইলে ফোন এলো হ্যারির।তূর্যয় গাড়ি চালানো অবস্থায় ফোন ধরতেই হ্যারি চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
–“ব্রো,মিটিং শুরু হতে চললো। কাম ফাস্ট।”
–“তুমি সামলাও আজ মিটিং। কারো বিনাশ হতে চলেছে আজ।”
তূর্যয়ের রাগ মাখা কণ্ঠ।
–“কার?অ্যান্ড ব্রো,এটা অনেক টাকার ডিল।আমি না পারলে?”
হ্যারি প্রশ্ন করলো তূর্যয়কে।
–“সব পারবে তুমি।রাণীকে কেউ তুলে নিয়েছে।”
তূর্যয়ের কথা শুনে হ্যারির মাথা ঘুরে উঠলো।সহজ সরল এই মেয়েকে কে কিডন্যাপ করেছে, এটা হারির মাথায় আসছে না।সে বেশ অবাক হয়ে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“যে এই কাজ করেছে,জাস্ট কিল হিম।অ্যান্ড মিটিং আমি হ্যান্ডেল করছি।জাস্ট;সেভ মাই সিস, ব্রো।”
–“ফোকাস করো মিটিং এ।তূর্যয়ের দেহে প্রাণ থাকতে, কেউ রাণীর কিছু করা তো দূরের কথা,তার দিকে চোখ তুলে দেখেলেই; সেই মানুষটিকে তার প্রাণ হারাতে হবে।”
তূর্যয়ের রাগী কণ্ঠ।
ফোন কেটে দিয়ে তূর্যয় আবারও ফরহাদের লোকেশন দেখে শর্টকাট নিয়ে এগুচ্ছে।তূর্যয় এমন একটা পরিকল্পনা করলো,যেটাতে তূর্যয়ের গাড়িকে রাণীর অপহরণকারীদের গাড়ি টপকিয়ে যেতে হবে।তূর্যয় গাড়ি থামালো একটু আঁধারের দিকে।মোবাইল বের করে ফরহাদের পাঠানো গাড়ির ডিজাইন দেখে নিলো সে।ধীরে ধীরে ফরহাদের লোকেশন কাছাকাছি আসছে তূর্যয়ের।তূর্যয় নিজের কোমরের পেছন থেকে পিস্তল বের করে নিলো। ঘাড় বাঁকিয়ে তূর্যয় সামনের দিকে এগিয়ে গেলো অল্প।পিস্তলের নিশানা ঠিক করে নিলো সে।তূর্যয়ের শরীর রাগে গজগজ করছে।তূর্যয়ের চোখমুখে হিংস্রতা ফুটে উঠেছে।মনে হচ্ছে,এখনই তূর্যয় সব কিছুতে তাণ্ডব চালিয়ে দিবে।তূর্যয় তার ডান চোখের পাশে আঘাত পাওয়া স্থানে হালকা চুলকিয়ে তূর্যয় বলে উঠলো,
–“আমার সাথে শত্রুতায় আমার রৌদ্রকে কেনো টেনেছিস?যে এইকাজ করেছিস,তারা আর বেঁচে ফিরতে পারবি না।আমার শত্রুতায় আমার রৌদ্রকে টেনে নেওয়াটা তোদের সবচেয়ে বড় ভুল।আমার প্রাণে হাত দিয়ে এতোই ভুল করেছিস, তোদের শুধু এখন একটা আফসোসই থাকবে;তোরা কেনো এই পৃথিবীতে এসেছিস!”
তূর্যয় হিংস্রমাখা চোখে অপেক্ষা করছে তার শিকারের।
চলবে….