আলো-আঁধার পর্ব-২৩+২৪

0
1167

#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা:সালসাবিল সারা

২৩.
অফিসে নিজের কেবিনে বসে কাজ করছে রাণী।অন্যসব স্টাফদের সাথে রাণীর আলাদা কেবিন দিয়েছে হ্যারি।তূর্যয়ের পাঠানো অনেকগুলো ফাইল বেশ মন দিয়ে চেক করছে সে।কিন্তু ফাইলে কোনো ভুল পাচ্ছেই না রাণী।রাণী এক ফাইল বারবার উল্টিয়ে দেখছে।কিন্তু নাহ,একটা ফাইলেও কোনো কিছু ভুল নেই।রাণী নিজের মাথায় হাত রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।এতো ফাইল বারবার চেক করার কারণে রাণীর চোখ ব্যথা করছে।নিজের চোখ কয়েকবার কঁচলিয়ে নিয়ে রাণী চেয়ার থেকে উঠে পড়লো। কেবিনে থাকা কাঁচের জানালার পর্দা সরিয়ে রাণী উঁকি দিলো অফিসের মধ্যখানের অবস্থা কেমন দেখার জন্য! সবাই যে যার যার কাজে ব্যস্ত।অবশ্য সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হবে নাই বা কেনো?তূর্যয় কারো ভুল মাফ করে না,এটা এই অফিসের সবারই জানা আছে।তাই তূর্যয়ের হিংস্রতা থেকে বাঁচতে সবাই যে যার যার কাজে লেগে আছে।রাণী পর্দা ঠিক করে আবারও নিজের চেয়ারে বসে পড়লো।রাণীর মন এই অফিস থেকে বের হওয়ার জন্যে আনচান করছে।তাছাড়া রাণীর এই মুহূর্তে ব্যাপক ক্ষিদে পেয়েছে।যদিও সকালের নাস্তায় সে ভালই খাবার খেয়েছে, তাও রাণীর পেটে ক্ষিদা ডাক ঢোল বাজাচ্ছে।রাণী পেটে হাত দিয়ে মিন মিন করে বলতে লাগলো,
–“কবে সেই সন্ত্রাসী আর ভিনদেশী ভাইয়ের সাথে নাস্তা করেছি,আর কিছুই পেটে পড়েনি আমার।ক্ষিদায় আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে।দুপুরের খাবার খেতে আরো এক ঘন্টা বাকি আছে।এই এক ঘণ্টায় ক্ষিদায় না মরে যায় আমি?”
রাণী নিজের মাথা চুলকালো কথাগুলো ভেবে।পরক্ষণে সে খুশি হয়ে বলতে লাগলো,
–“আরে,হ্যারি ভাই তো বলেছেই;যখনই ক্ষিদা লাগে তখনই ক্যান্টিনে চলে যেতে।চল চল রাণী,ক্যান্টিনে চল।কখনোই তো এমন মরার মতো ক্ষিধা লাগেনি আমার।আর আজ এই ক্ষিধা আমার সহ্যই হচ্ছে না।এই অফিসে আমি কি খিচুড়ি পাকাবো আজ,আল্লাহ্ ভালো জানে। হে আল্লাহ্,আমার দানব সন্ত্রাসীর ধমক থেকে আমাকে রক্ষা করবেন প্লিজ!”
রাণী নিজের বুকে ফুঁ দিয়ে নিজের কেবিন থেকে বের হলো।তূর্যয়,হ্যারি দুইজনই মিটিং রুমে।রাণীর মনে তাই তূর্যয়ের ভয়টা কমেছে এখন।আগে অফিসের সবাই রাণীকে দেখলেই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো।কিন্তু, একদিন রাণী তূর্যয়কে এই ব্যাপারে নালিশ করলে, তূর্যয়ের ধমকে অফিসের সবাই সতর্ক হয়ে গেলো রাণী থেকে।রাণীর দিকে এখন কেউ চোখ তুলেও তাকায় না। এতে রাণী বেশ খুশি।সবার সামনে রাণী বেশ ভাব নিয়ে হাঁটাচলা করে।এতো বড় বড় পালোয়ান কর্মচারীদের ভেতর হাঁটতে রাণীর বেশ অস্বস্থি হচ্ছে।কিন্তু তাও,
নিজের পেটের ক্ষুদার জন্যে রাণীর এই অস্বস্থিকে কাটিয়ে সামনের দিকে যেতে লাগলো।এই অফিসের সবাই নিজের কাজ নিজে করে।শুধু তূর্যয়ের জন্যেই তার কেবিনে খাবার নিয়ে যায় ক্যান্টিনের প্রধান।আর বাকি সবাইকে নিজের খাবার নিজে গিয়ে আনতে হয়।রাণীর দুপুরের খাবার হ্যারি নিয়ে যায়।তাই রাণীর আর কষ্ট করে ক্যান্টিনে আসা লাগে না।হ্যারি যখন যা খায়,তখনই একই খাবার সে রাণীর জন্যে দিয়ে যায়।রাণী তার জীবনে হ্যারির মতো এমন পাতানো ভাই পেয়ে আল্লাহ্ এর কাছে বারবার শোকরিয়া করে।ক্যান্টিনের সামনে গিয়ে রাণী একটু থামলো।বাম পাশে ফিরতেই রাণী একটা বড় ছবি দেখতে পেলো,যেখানে তূর্যয় একটা সোফায় বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে।তূর্যয়ের হাতে একটা পিস্তল।তূর্যয় না হাসলেও তার এই গম্ভীর ছবিটা দেখে মুহূর্তেই রাণীর মনে ভালোবাসার প্রজাপতি উড়াল দিলো।রাণী হেঁটে সেই ছবির সামনে গিয়ে সেই ছবির উপর হাত রাখলো।রাণী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তূর্যয়ের ছবিটা।রাণীর সাথে তূর্যয়ের দেখা হয়েছে পর্যন্ত প্রত্যেকটা দিন রাণী তূর্যয়ের ধমক শুনেই এসেছে।কিন্তু, রাণী এখনও তূর্যয়ের ধমকে অভ্যস্ত হয়নি।তূর্যয়ের ধমকে প্রত্যেকদিনই রাণীর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে।রাণী তূর্যয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে তূর্যয়ের ছবির বুক বরাবর হাত রেখে বলতে শুরু করলো,
–“আপনার এই বুকে অনেক জিদ,হিংস্রতা;তাই না?কিসের জিদ আপনার এতো?আর আমাকে এতো বকেন কেনো?মাঝে মাঝে মনে হয় আপনার এই ধমকের মাঝে আপনি আমার যত্ন নিন।কিন্তু,কেউ কি ধমক দিয়ে অন্যের যত্ন করে নাকি?যত্ন করতে হয় ভালোবেসে।এইযে দেখুন আমাকে।মন ভরে দেখুন।আমি আপনাকে ভালোবেসে কতো সুন্দর করে আপনার যত্ন নিই!আপনার এতো ধমক সহ্য করে,আপনার সাথে অভিমান করেও আমি আপনার যত্ন করে যায় আপনাকে ভালোবেসে।আর আপনি! আস্ত এক দানব।সারাদিন শুধু আমার দিকে চোখ লাল করে তাকাতে পারেন আর আমাকে চঞ্চল মেয়ে,চুপ,কামড়িয়ে ছিড়ে ফেলবো,খেয়ে ফেলবো এইসব বলেন। হু,সন্ত্রাসী একটা।কিন্তু,যায় করুন আপনি।এই রাণী তো সারাজীবন তার দানব সন্ত্রাসীকে ভালোবেসে যাবে।”

ছবিতে তূর্যয়ের চোখের গভীরতায় তাকিয়ে রাণী অস্ফুট কন্ঠে বললো,”ভালোবাসি”।

রাণীর পেটে গুড়গুড় করে উঠলে রাণী মুচকি হেসে তূর্যয়ের ছবির সামনে থেকে সরে ক্যান্টিনে চলে গেলো।রাণী মনে মনে ভাবছে,
–“আপনার ছবির সামনে কি সুন্দর নিজের মনের সব কথা বলে ফেললাম,তাই না?আমার মনের সেই চুপ কথাগুলো যদি আপনাকে জানাতে পারতাম?”
রাণী আফসোস করতে লাগলো কথাগুলো ভেবে।

ক্যান্টিনে বেশ তাড়াহুড়ো করছে ক্যান্টিনের প্রধান।এতো বড় ক্যান্টিন এই প্রবীণ লোক একা সামলায় ভেবে অবাক হলো রাণী।কফি মেশিন থেকে কফি নিয়ে,রাণী সেই ব্যস্ত প্রবীণ লোক থেকে একটা চকলেট কেক নিয়ে নিলো।রাণী ক্ষিধা মেটাতে দ্রুত কেক খেতে শুরু করলো।কেক খাওয়া শেষ করে রাণী কফির প্লাস্টিকের কাপে চুমুক দিলো।অল্প কফি থাকায় রাণী বেশ জলদি শেষ করে নিলো কফি।ক্যান্টিন থেকে বেরুনোর সময় রাণী দেখলো সেই প্রবীণ লোকটি একসাথে দুই হাতে ট্রে ভর্তি নাস্তা নিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছে। রানী দ্রুত লোকটির কাছে গিয়ে এক হাত থেকে ট্রে নিয়ে তাকে বললো,
–“চাচা কই নিবেন এগুলো?আসুন আমি আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি।”
প্রবীণ লোকটা নিজের মাথা ঝাঁকিয়ে রাণীকে জবাব দিলো,
–“বড় সাহেবের মিটিং রুমে দিতে হবে। আপনি সেখানে গেলে হয়তো উনি রাগ করতে পারে।”
রাণী হাসলো লোকটার কথায়,
–“আমরা তো মিটিং রুমে উনাদের সাথে মিটিং করতে যাচ্ছি না। শুধুমাত্র ট্রে, মিটিং রুমে রাখবো আর চলে আসবো। ট্রেতে অনেক পরিমান নাস্তা রাখা আছে।আপনি একসাথে নিতে গেলে,দুর্ভাগ্যবশত যদি ফেলে দিন; তাহলে আরো বেশি ক্ষতি হতে পারে।চলুন চলুন।”
লোকটা তার এক হাতে থাকা ট্রে দুই হাতে ভালোভাবে শক্ত করে ধরলো। রাণীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লোকটি রানী কে বলল,
–“স্যারের মিটিংয়ে কেউ বারবার গেলে স্যার খুবই রাগ করে। তাই দুইবার না গিয়ে আমি একবারে দুইবার যাওয়ার কাজটি করতে চেয়েছিলাম।প্রত্যেকদিন আমার সাথে একটা ছোট ছেলে থাকে।আজ সে আসেনি বিধায় কাজে একটু ব্যাঘাত ঘটেছে।”
রাণী প্রবীণ লোকটির সাথে লিফটে উঠে জবাব দিলো,
–“সবার দিন প্রত্যেক দিনের মতো এক‌ই কাটে না চাচা। মানুষের একেক দিন একেক রকম ভাবে কাটে। তবে দেখুন আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছে আপনার সাহায্য করার জন্য।আর আপনিও বেঁচে গিয়েছেন সেই রাক্ষসের হাত থেকে।”
কথাটা বলে রাণী চোখ বড় করলো।প্রবীণ লোকটি মুচকি হেসে রাণীকে উত্তর দিলো,
–“ভয় পাওয়ার দরকার নেই।আমি কিছুই বলবো না কাউকে।”
রাণী ফিক করে হেসে প্রবীণ লোকটিকে বলে উঠলো,
–“ধন্যবাদ চাচা,এই রাণীর মুখটা না বেশি চলে।”
–“ঠিকই চলে। রাণীরা সবাইকে অর্ডার করে চলে তাই,
মুখটা তো বেশি চলবেই।নামটা সুন্দর তোমার।”
এইভাবে টুকটাক কথা বলে রাণী আর প্রবীণ লোকটি মিটিং রুমের সামনে চলে আসলো।
মিটিং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বডিগার্ড তাদের দেখে দরজা খুলে দিলো।রাণী আর প্রবীণ লোকটা নাস্তার বড় ট্রে নিয়ে ঢুকে পড়লো মিটিং রুমে।ভেতরে ঢুকতেই রাণীর নিঃশ্বাস আটকে এলো।এতো এতো লোক,রাণী কখনোই আশা করেনি এইখানে।আর সবার চেহারা একেবারেই রাগান্বিত।সামনে চোখ তুলে তাকাতেই রাণীর গলা শুকিয়ে এসেছে।কারণ,তূর্যয়ের মুখটা দেখে রাণী বুঝতে পারছে,তূর্যয় এখন ভয়ংকর রেগে আছে।তূর্যয়ের অফিসে মেয়ে স্টাফ দেখে সবাই কানাঘুষা করছে।তূর্যয়ের হাত মুঠ হয়ে এলো।সবাই মিটিং ছেড়ে রাণীর নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।এটা লক্ষ করতেই তূর্যয় বেশ জোরে চিল্লিয়ে উঠলো,
–“দরজার সামনে কি আমরা মিটিং করছি?”
তূর্যয়ের রেগে যাওয়া দেখে সবাই আবারও সোজা হয়ে বসলো।

রাণী দরজার সামনে থেকে নড়লো না।সে ভীত হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।প্রবীণ লোকটা দ্রুত নিজের হাতে থাকা ট্রে মিটিং টেবিলে রেখে রাণীর হাত থেকে নাস্তার ট্রে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে রাখলো টেবিলে।তূর্যয় চোখের ইশারায় রাণীকে চলে যেতে বললো।রাণী তূর্যয়ের ইশারা বুঝতে পেয়ে প্রবীণ লোকটি আসার আগেই বেরিয়ে গেলো সেই রুম থেকে।সে আর প্রবীণ লোক আবারও লিফটে উঠে পড়লো।লিফটে উঠে রাণী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

কিন্তু,তূর্যয়ের মনে শান্তি নেই।রাণী মিটিং রুমে এসেছিল এটা ভাবতেই তূর্যয়ের মাথা রাগে গজগজ করছে।তূর্যয় রাণীর ব্যাপারে অফিসের সবাইকে সাবধান করেছিল।কিন্তু,মিটিং এ যারা উপস্থিত আছে তারা রাণী সম্বন্ধে কিছুই জানে না।তাই এইভাবে রাণীর উপস্থিতি মিটিংয়ে থাকা মানুষের মনে কি প্রশ্ন তৈরি করেছে এটা তূর্যয়ের অজানা।রাণী অফিসে থাকলে তূর্যয়ের এতো সমস্যা হয় না।সমস্যা হয়েছে,রাণী যাদের সামনে এসেছে তারা কেউ ভালো মানুষ না।সবাই একেকটা দানব।আর তূর্যয় চায় না,রাণী সে ছাড়া অন্য কোনো দানবের সামনে আসুক।তূর্যয়ের এখন ঠিক কি পরিমাণ রাগ লাগছে সে নিজেও জানে না।খুবই রাগ নিয়ে তূর্যয় নিজের মিটিং শেষ করলো। হ্যারিও বেরিয়ে গেলো মিটিং রুম থেকে।তূর্যয় চেয়ারে হেলান দিয়ে নিজের চুল টেনে যাচ্ছে।মিটিং এ উপস্থিত জনাব সোহেল তখনো মিটিং রুমে ছিলো।তূর্যয়ের অস্থিরতা দেখে সোহেল শয়তানি হাসি দিয়ে তূর্যয়কে প্রশ্ন করলো,
–“সেই মেয়েটি এইখানে যখন এসেছে তখন থেকেই আপনার মুখটা অন্যরকম দেখাচ্ছে।কি হয়েছে?মেয়েটি কে?”
তূর্যয়ের মেজাজ অনেক খারাপ ছিলো আগে থেকেই।আর সোহেলের কথা শুনে তূর্যয় বেশ গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো,
–“সে যেই হোক।তোমার কি সমস্যা?যাও এইবার। মিটিং শেষ আমাদের।”
–“মেয়েটার উপর আমার এতো ইন্টারেস্ট নেই।তবে,মনে হয় না এখানে উপস্থিত অন্য কেউ মেয়েটিকে ভালো নজরে দেখছে।সাবধানে রাখবেন তাকে।সুন্দরী মেয়েদের চোখে চোখে রাখতে হয়।”
সোহেল কথাটা বলে চলে গেলো।তূর্যয় গভীর চিন্তায় পড়লো।সে মনে মনে ভাবছে,
–“রাণীর সাহস কি করে হয়,আমার কথা অমান্য করে অফিসের যেখানে সেখানে ঘুরা ফেরা করার?বেশি যত্নে রাখায় মাথায় উঠেছে সে।যায় করুক রাণী আমার সমস্যা নেই।কিন্তু,এইসব দানবের সামনে আসা রাণীর জন্যে মোটেও ঠিক না।রাণীর উপর আমার কঠিন নজর রাখতে হবে।আমার রৌদ্রের কোনো ক্ষতি আমি হতে দিবো না। আমাদের দুইজনের মাঝে যে আসবে,তাকেই আমি বাঁচিয়ে রাখবো না।তবে রাণী,আমার কথা অমান্য করার শাস্তি তুমি ঠিকই পাবে।”
তূর্যয় মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।প্যান্টের দুই পকেটে হাত দিয়ে বেশ রাগী ভাবে হাঁটতে লাগলো সে।

রাণী নিজের মনের সুখে কেক খাচ্ছে।চকলেট কেক রাণীর অতি প্রিয় খাবার।এই কেকটা তাকে ক্যান্টিনের প্রবীণ লোকটা দিয়েছে,উনাকে সাহায্য করার কারণে।কেকের ভেতরে চকলেটে ঠাসানো থাকায় রাণী আরো বেশি মজা করে কেক খাচ্ছে।আরেকটা বড় কামড় দিয়ে কেক মুখে দিবে রাণী, অমনি সে তূর্যয়ের চিৎকার শুনে কেঁপে উঠলো।যার কারণে কেকে থাকা চকলেট রাণীর মুখে লেপ্টে গেলো।রাণী তূর্যয়ের চিৎকার শুনে হাতে থাকা কেক ফেলে দিলো।তূর্যয় দ্রুত পায়ে এসে রাণীকে চেয়ারে বসা অবস্থায় চেপে ধরলো।রাণী ঠিক বুঝতে পারছে মিটিং রুমে যাওয়ার কারণে তাকে আজ শাস্তি ভোগ করতে হবে।রাণী তূর্যয়ের ভয়ে নিজের কামিজ খামচে ধরে রাখলো।তূর্যয় রাণীর চেয়ারের উপর হাত রেখে তাকে চিল্লিয়ে বললো,
–“মিটিং রুমে ঢোকার জন্যে কার থেকে অনুমতি নিয়েছিস?নিজের চেহারা সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে তোর বেশি ভালো লাগে?এই মেয়ে এই?তখন তো ধুম করে মিটিং রুমে ঢুকে পড়েছিলি।এখন আমার সামনে মুখ বন্ধ কেনো?নিষেধ করেছিলাম না, যেখানে সেখানে না যেতে?আমার কথা অমান্য করার সাহস কোথা থেকে পাস?”
রাণী নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে তো আর সহজ সরল কোম্পানিতে চাকরি করে না!সে তো চাকরি করে কালো বাজারের ব্যবসায়ীর অফিসে।এইখানে ভালো মানুষের আশা করা মোটেও ঠিক না।রাণী নিজের ভুল মেনে নিয়ে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“সরি।”
তূর্যয় খপ করে রাণীর বাহু চেপে ধরলো।
–“কিসের সরি হ্যাঁ?মিটিং রুমে যাওয়ার কারণ কি?”
তূর্যয়ের জোরে ধমকে হালকা নড়ে উঠলো রাণী।বুকে সাহস জুগিয়ে সে বলতে লাগলো,
–“ক্যান্টিনের চাচাকে সাহায্য করছিলাম।আজকে উনার সহকারী আসেনি তাই।”
এই কথা শুনে তূর্যয়ের মেজাজ আরো খারাপ হলো।সে একটানে রাণীকে দাঁড় করিয়ে দিলো।রাণীর কোমর চেপে ধরে তূর্যয় রাণীকে বলতে লাগলো,
–“ওহ,দরদ?নিজের চিন্তা না করে সবসময় অন্যর চিন্তা করলে নিজের ক্ষতি হয়।এইযে এখন?কে বাঁচাবে তোকে আমার হাত থেকে?তোর ক্যান্টিনের চাচা?”
রাণীর এবার রাগ লাগতে শুরু করলো।ভয়ের পাশাপাশি রাণীর মনে তূর্যয়ের কথা শুনে রাগ লাগলো।রাণী ভারী গলায় তূর্যয়কে বললো,
–“উনি একজন প্রবীণ লোক ছিলেন।তাই উনাকে সাহায্য করেছি। এতে আমার কি দোষ?আমি কি জানতাম ঐখানে সব দানবেরা থাকবে?”
রাণীর মুখে লেগে থাকা চকলেট দেখে তূর্যয়ের রাগ গলে গেলো।এতক্ষণ রাণী মুখ নিচে করে রাখার কারণে তূর্যয় রাণীর মুখে লেগে থাকা চকলেট দেখেনি। রাণীকে দেখে তূর্যয়ের বেশ হাসি আসছে।কিন্তু, এই তূর্যয় দানব তো হাসতেই জানে না।রাণীর মুখে লেগে থাকা চকলেট নিজের আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিলো সে।এরপর সেই আঙুল নিজের মুখে দিলো তূর্যয়।এমনটা দেখে রাণীর চোখ রসগোল্লা হয়ে গেলো।রাণী নিজের ওড়না দিয়ে তার মুখে তূর্যয়ের আঙ্গুল লাগানো স্থানে ঘষতে লাগলো।তূর্যয়ের এমন কান্ড কিছুতেই রাণী বিশ্বাস করতে পারছে না। রাণী তূর্যয়কে ধাক্কা দিলো সরে যাওয়ার জন্যে।কিন্তু,
তূর্যয় নড়লো না।তূর্যয় রাণীর গালে নিজের আঙ্গুল দিয়ে হালকা ঘষে বললো,
–“তোর জন্যে শুধু আমিই দানব।অন্য কাউকে যেনো তুই দানব না বলিস।”
রাণী চোখ বড় করে তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছে।রাণীর চুপ থাকা দেখে তূর্যয় আবারও রাণীকে বলে উঠলো,
–“আমি চায় না,তুই কারো চোখে পড়িস।তুই যার চোখে পড়বি তার চোখ উঠিয়ে নিবো আমি।সাথে আমি তোকে খেয়ে ফেলবো।বুঝতে পেরেছিস?আজকে থেকে যেখানে সেখানে ঘোরা ফেরা করা বন্ধ তোর।”
তূর্যয় কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলে রাণী তাকে বলে উঠলো,
–“খেয়ে ফেলবেন মানে কি?আপনি কি রাক্ষস?”
রাণীর কথায় তূর্যয় আবারও ফিরে এসে রাণীর মুখ ধরলো।সে সাবলীল ভাবে রাণীকে প্রশ্ন করলো,
–“দেখবি কিভাবে খেয়ে ফেলবো?”
কথাটা বলে তূর্যয় রাণীর গালের দিকে নিজের মুখ এগিয়ে নিলো। ভয়ে আর অদ্ভুত অনুভূতিতে রাণীর মনে ধুকধুক করছে।রাণী তূর্যয়ের বুকের দিকে শার্ট খামচে ধরলো চোখ বন্ধ করে।
এরমধ্যেই হ্যারি রাণীর কেবিনে এসে বলে উঠলো,
–“সিস, লাঞ্চ এনেছি।”
তূর্যয় আর রাণীকে কাছাকাছি দেখে হ্যারির মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো।হ্যারি হাসিমুখে আবারও বললো,
–“ক্যারি অন।”
রাণী ধাক্কা দিলো তূর্যয়কে, হ্যারির উপস্থিতিতে।তবে এইবারও তূর্যয় নড়লো না।রাণীর কোমর জড়িয়ে ধরা অবস্থায় তূর্যয় হ্যারিকে বলে উঠলো,
–“খাওয়া শেষ করে গাড়ি রেডি করতে বলবে।একটা ছোট্ট মিশন আছে আজ।”
হ্যারি হেসে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“অফকোর্স ব্রো।”

তূর্যয় রাণীর দিকে তাকিয়ে চলে গেলো নিজের কেবিনে।হ্যারি রাণীকে লজ্জা দেওয়ার আগেই রাণী হ্যারিকে বললো,
–“আপনার ব্রো কেনো এমন করেছিলেন আমি জানি না।এই ব্যাপারে কিছু বলবেন না আমাকে।চলুন খেতে বসি।”
রাণীর কথায় হ্যারি রাণীকে কিছু না বলে খেতে বসে পড়লো।তবে হ্যারি মনে মনে ভাবছে,
–“আমার ব্রো তোমার উপর ফ্ল্যাট হয়ে গিয়েছে, এটা আমি অনেক আগে থেকেই জানি।সিস,তুমিই পারবে আমার ব্রো এর জীবনটা ব্রাইট করতে।মে গড ব্লেস ইউ বোথ।”

খাওয়া শেষে তিনজন মিলে বেরিয়ে পড়লো তূর্যয়ের গাড়ি করে।মায়া এতিম খানার সামনে গাড়ি আসতেই গাড়ি থামিয়ে প্রত্যেক বারের মতো তূর্যয় গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।সাথে নামলো হ্যারি আর রাণী।গেইট দিয়ে ভেতরের ছোট বাচ্চাদের দেখতে পেয়ে রাণীর মন তাদের সাথে খেলা করার জন্যে আনচান করছে।রাণী তূর্যয়ের শার্টের হাতা ধরে তাকে বলে উঠলো,
–“আমি ভেতরে যায়?”
তূর্যয় নিচু হয়ে তাকালো রাণীর দিকে।তার অতীতের কোনো কিছুতেই তূর্যয় রাণীকে শামিল করতে চায় না।তাই সে রাণীকে কড়া ভাষায় বললো,
–“একদমই না।”
রাণী কিছু বলার আগেই মোল্লা সাহেব বেরিয়ে এসেছে।উনি এসেই বলতে আরম্ভ করলেন,
–“ভেতরে আয় তূর্যয়।সাথে তো রাণী মা এসেছে।কেমন আছিস তুই, মা?”
তূর্যয় কিছু বলার আগেই রাণী হাসিমুখে বলল,
–“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালই আছি।আপনি কেমন আছেন?”
–“রেখেছে আল্লাহ্ ভালই।”
মোল্লা সাহেব জবাব দিলেন। তূর্যয় মোল্লা সাহেবের সাথে কথা বলে চলে যেতে নিলেই রাণী আবারও তূর্যয়ের শার্ট ধরে বলতে লাগলো,
–“দেখুন না,বাচ্চাগুলো আমাকে ডাকছে।আমি যায় ভেতরে? প্লিজ?”
তূর্যয় নিজের শার্ট থেকে রাণীর হাত ছাড়িয়ে রাণীর হাত ধরে বললো,
–“গাড়িতে উঠ।”
মোল্লা সাহেব তূর্যয়কে রাণীর হাত ধরতে দেখে মুহূর্তেই বুঝে গেলো রাণী তূর্যয়ের জীবনে বেশ জরুরি একজন মানুষ।নাহলে,তূর্যয় হাত ধরে এমন মানুষ মোল্লা সাহেব আজ পর্যন্ত দেখেননি।কিছু একটা ভেবে মোল্লা সাহেব তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“থাক না মেয়েটা।যাওয়ার সময় নিয়ে যাস।”
রাণী নিজের হাত তূর্যয়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
–“যায় না।”
রাণীর ঠোঁট উল্টে কথা বলাতে তূর্যয় মুহূর্তেই রাণীর মাঝে হারিয়ে গেলো।এই সুযোগ নিয়ে রাণী মোল্লা সাহেবের কাছে গিয়ে তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“দেখলেন মোল্লা সাহেব,এই জলহস্তীকে রাজি করানো কতো কষ্ট?আমি যাচ্ছি।”
রাণী ভেতরে ঢুকে পড়লো।মোল্লা সাহেব আর হ্যারি “হাহা” করে হেসে উঠলো রাণীর কথায়।

–“ব্রো,কুইন পারেই তোমাকে এইসব বলতে।”
হ্যারি হেসে উঠে বললো।

তূর্যয় ভ্রু কুঁচকালো হ্যারির কথায়।যাওয়ার আগে তূর্যয় মোল্লা সাহেবকে নির্দেশ দিলো,
–“বেশি চঞ্চল মেয়েটা।একটু দেখে রাখবেন।বাহিরে কেউ তার সাথে দেখা করতে চাইলে অনুমতি দিবেন না।আমি আসবো সন্ধ্যার পরই।হ্যারি,গাড়িতে বসো।”
রাণীর প্রতি তূর্যয়ের টান দেখে হ্যারির বুঝতে দেরি হলো না,তূর্যয় রাণীকে ভালোবাসে।হ্যারি চলে এলো গাড়িতে।তূর্যয় আসার পূর্বে রাণীকে আবারও দেখে নিলো বাহির থেকে।রাণীর বাচ্চাদের সাথে খেলায় মগ্ন হয়ে আছে। রাণীর হাসি দেখে তূর্যয়ের মন প্রশান্তিতে ভরে গেলো।তূর্যয় নিজের ঠোঁট বাঁকা করলো রাণীকে দেখে।এর মধ্যেই হঠাৎ তার কানে এলো মোল্লা সাহেবের কথা,
–“ভালোবাসিস এই ছোট মেয়েটাকে?”
তূর্যয় বেশ শান্ত হয়ে জবাব দিলো,
–“অনেক।”
–“আগলিয়ে রাখতে পারবি তো?তার কিন্তু কেউ নেই।তোকেই তার পৃথিবী হতে হবে।”
মোল্লা সাহেব হেসে বললো তূর্যয়কে।
–“যেদিন বুঝেছি ভালোবাসি তাকে, সেদিনই হয়ে গিয়েছি তার পৃথিবী।শুধু আমার অতীত যেনো না জানে সে।আসছি আমি।দেখে রাখবেন তাকে।”
তূর্যয় কথাগুলো বলে ধপ ধপ পা ফেলে গাড়িতে উঠে পড়লো।

–“দুঃখিত তূর্যয়,তোর এই কথা রাখতে পারলাম না।তোর অতীত জানা এই মেয়ের জন্যে খুবই জরুরি।এই মেয়েই পারবে সালেহা,তোর,আমার সবার মাঝের ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে।আল্লাহ্, সব যেনো এইবার ঠিক হয়ে যায়।”
মোল্লা সাহেব আপনমনে কথাগুলো ভেবে ভেতরে চলে এলো।

অন্যদিকে সাবিনা বেশ রেগে ফোন করলো মমতা এতিম খানার সেই গোপন মানুষটিকে,
–“আরে এই রাহেলা কই হাওয়া হলো?কিছুই তো বুঝছি না।”
–“কি আর হবে,পুলিশের ভয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে হয়তো?আমাদের এইবার ভালো একটা প্ল্যান করতে হবে রাণীর জন্যে।”
সেই মানুষটি বললো।
–“এতো কিছু জানি না।আহেমদ এর বিছানায় আনার ব্যবস্থা করে দে।সবটা সে সামলিয়ে নিবে।কোনো প্ল্যান তৈরি করলে ফোন দিস।”
সাবিনা ফোন কেটে দিলো।
–“চিন্তা কর ভালো করে,কিভাবে রাণীকে আহমেদের কাছে পাঠানো যায়?এরপরই রাণীর বিনাশ হবে।”
মানুষটি কথাটা ভাবতেই নিজের ফোন হাতে মুঠ করে নিলো।

চলবে….

#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা:সালসাবিল সারা

২৪.
বাচ্চাদের সাথে খেলায় ডুবে আছে রাণী।বাচ্চাদের খিলখিল হাসি আর রাণীর অট্টহাসিতে মায়া এতিম খানা একেবারে মুখরিত হয়ে আছে।বাচ্চাগুলোর বয়স চার বছর থেকে নয় বছরের মধ্যে।সবাই রাণীর সাথে মুহূর্তেই ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছে।রাণীর খুশির শেষ নেই।এই বাচ্চাদের সাথে কখনো সে বল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে,তো কখনো সে বলটা তাদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে।আবার কখনো কখনো বাচ্চাদের আদর সানন্দে গ্রহণ করছে।মোল্লা সাহেব অবাক হয়ে দেখে রাণীকে।এমন একটা চঞ্চল আর হাস্যোজ্বল মেয়েকে তূর্যয় কিভাবে খুঁজে পেলো এটাই উনি বুঝছেন না।তূর্যয় বেশ রাগী আর চুপচাপ স্বভাবের সাথে সে অন্যদেরও চুপচাপ দেখতে পছন্দ করে।কিন্তু, রাণী একেবারেই ঠোঁট কাঁটা,সবার সাথেই মিশে যায় মুহূর্তেই।তাই মোল্লা সাহেব বুঝে উঠতে পারছে না তূর্যয়ের রাণীর প্রতি ভালোবাসা কিভাবে সৃষ্টি হলো।কিন্তু তূর্যয়ের আঁধার মাখা জীবনে এমন একটা আলোকিত মেয়ের আগমন দেখে মোল্লা সাহেব আকাশের দিকে তাকিয়ে মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত উঠিয়ে বলতে লাগলো,
–“সারাজীবন যেনো এই মেয়েটা তূর্যয়ের জীবনটাকে আলোকিত করে রাখে, আল্লাহ্।ছেলেটার মনে অনেক কষ্ট।উপরে হিংস্রতা দেখায় সে,কিন্তু তার ভেতরটা কেমন আমি তো জানি!এই ছোট মেয়েটা আর তূর্যয়ের জীবনটা একেবারে সহজ করে দাও,আল্লাহ্।তারা যেনো সুখে শান্তিতে থাকতে পারে সারাজীবন।আমিন।”
মোল্লা সাহেব মোনাজাত শেষ করলেন।অনেক্ষণ যাবত উনি রাণীর সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন।কিন্তু, রাণী বাচ্চাদের মাঝে এতোই ডুবে গিয়েছে, যা দেখে মোল্লা সাহেবের একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না রাণীকে তূর্যয়ের খারাপ অতীতের কথা বলে তার মন খারাপ করে দিতে।কিন্তু,
এখন না বললে মোল্লা সাহেব আর কখন রাণীকে এইভাবে একা পাবেন;এই কথাটি ভাবতেই মোল্লা সাহেব বাচ্চাদের ও রাণীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।মোল্লা সাহেবকে দেখে আট বছরের একটা বাচ্চা, ওয়ানিয়া বলে উঠলো,
–“এই আন্টিকে আমাদের কাছে রেখে দিবো, হুজুর।আন্টি খুব ভালো।”
মোল্লা সাহেব হাসলেন ওয়ানিয়ার কথায়।এরপর ওয়ানিয়ার মাথায় হাত রেখে মোল্লা সাহেব হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন,
–“আন্টি থাকবে নাকি,তাকে জিজ্ঞেস তো কর?”
ওয়ানিয়া হাত নাড়িয়ে রাণীকে জিজ্ঞেস করলো,
–“আন্টি তুমি থাকবে আমাদের সাথে?”
রাণী ওয়ানিয়ার গাল টানলো।রাণী বেশ সুখময় হাসি দিয়ে বললো,
–“এইখানে তো থাকা যাবে না।তবে আমি এইখানে এসে তোমাদের সাথে খেলার চেষ্টা করবো।একটা দানব আছে বুঝতে পেরেছো?সেই দানবটা আমাকে এইখানে আসার নির্দেশ দিলে, তবেই আমি আসতে পারবো এইখানে।”
রাণীর কথায় সব বাচ্চারা চিল্লিয়ে উঠলো,
–“কে দানব?কার্টুনে থাকা কুৎসিত ভূতের মতো দেখতে দানব উনি?আমাদের খেয়ে ফেললে?”
রাণীর হাসির শেষ নেই। সে নিজের মুখে হাত রেখে হাসি থামানোর চেষ্টা করলো।
–“আরে না না,তোমাদের খেয়ে ফেলবে না উনি।এই দানবটার ব্যবহার বুঝা বড় দায়।তবে উনি তোমাদের অনেক ভালোবাসা দিবেন।উনি শুধুই খারাপ মানুষদের শাস্তি দেন।যদিও একটু বেশি গম্ভীর উনি, তবে আমরা সবাই মিলিয়ে উনার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলবো।কেমন?”
রাণীর কথায় সব বাচ্চারা “ইয়াহু” বলে উঠলো।মোল্লা সাহেব রাণী আর বাচ্চাদের এতো সুখের মুহূর্ত একটুও নষ্ট করতে চাইছেন না।উনি রাণীকে যতো দেখছেন ততোই অবাক হচ্ছেন।মোল্লা সাহেব আপন মনে ভাবছে,
–“এতদিন ভেবেছিলাম আমি ছাড়া তূর্যয়ের মনের কথা কেউ বুঝে না।কিন্তু,এই মেয়েটা আমাকে আজ ভুল প্রমাণ করলো।আমি মোটেও ভুল করবো না রাণীকে তূর্যয়ের অতীত জানিয়ে।একমাত্র রাণী পারবে সবটা ঠিক করতে।”
মোল্লা সাহেব রাণীকে কিছু বলতে যাবেন এর আগেই,
মোল্লা সাহেবের ছেলে; কাফিফ এসে সব বাচ্চাদের বলতে শুরু করলো,
–“বিকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে।খেলার ছলে কি নাস্তা করা ভুলে গিয়েছো সবাই?”
কাফিফ বাচ্চাদের থেকে নজর সরিয়ে রাণীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“আপনিও আসুন, আপু।”
রাণী মাথা নাড়ালো কাফিফের কথায়,
–“নাহ,আমার ক্ষিধে নেই।আর তুমি আমাকে রাণী বলেই ডাকতে পারো,ভাইয়া।বাচ্চারা যাও, নাস্তা করতে যাও।”
বাচ্চারা রাণীর হাত ধরে তাকে দাঁড় করালো।ছোট্ট একটা ছেলে, মাহি রাণীর ওড়না টেনে বলে উঠলো,
–“আপনাকেও যেতে হবে, রাণী আন্টি।নাহলে আমরা কেউ নাস্তা করবো না।”
রাণী মোল্লা সাহেবের দিকে তাকাতেই মোল্লা সাহেব ইশারায় যেতে বললো তাকে।অতঃপর সবাই মিলে চলে গেলো খাওয়ার রুমে।রাণী ভেতরে এসে অবাক হয়।এই এতিম খানায় আগেও একবার এসেছিল সে। তবে, এইসব জায়গায় আসা হয়নি তার।এই এতিম খানার দেওয়ালে নানান কার্টুনের ছবি।সাথে অনেক উন্নত লাইট,ফ্যান,ফার্নিচার আছে।এইখানকার বাচ্চাদের পোশাক,আচার আচরণ সবটাই অনেক সুন্দর।রাণী মনে মনে ভাবতে থাকে,
–“টাকা থাকলে কি না হয়?এই এতিম খানা তূর্যয়ের।উনার তো টাকার অভাব নেই।এইখানের ডেকোরেশন দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনি অনেক টাকা খরচ করেন এইখানের জন্যে,এইখানের বাচ্চাদের জন্যে।যাক,ভালই হলো।আমার দানব সন্ত্রাসীর জন্যে এই বাচ্চাগুলো একটা সুন্দর জীবন পাচ্ছে।সুন্দর ব্যবহার শিখছে।আল্লাহ্,আমার দানবের জীবনটাও যেনো এইখানের বাচ্চাদের মতো প্রাণবন্ত করে দেয়।”
রাণী চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো।বাচ্চাদের সাথে নাস্তা করতে বসে রাণী গল্পের পাহাড় গড়েছে বাচ্চাদের সাথে।অগত্য প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় তারা নাস্তার টেবিলে কাটিয়ে দিলো।

নাস্তা সেরে রাণী অন্য সব ছোট বাচ্চাদের সাথে আবারও বাহিরে চলে এলো।যেসব বাচ্চা এতিম খানায় লেখা পড়া করছে, তারা রাণীকে বিদায় জানিয়ে পড়ার রুমে চলে গেলো।এটা দেখে রাণীর বেশ ভালো লেগেছে।ছোট কিছু বাচ্চাদের মাঝে বসে রাণী তাদের সাথে গল্পে মত্ত হয়ে আছে।মোল্লা সাহেব রাণীকে ডাকলেন।কিন্তু বাচ্চারা কিছুতেই রাণীকে ছাড়ছে না।তাই মোল্লা সাহেব সেখানেই চলে আসলেন।রাণী উঠে দাঁড়ালো মোল্লা সাহেবকে দেখে।বাচ্চারা রাণীর পায়ের চারপাশে খেলছে।

মোল্লা সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,
–“তোকে কিছু বলার আছে, মা।”
রাণী হাসিমুখেই মোল্লা সাহেবকে বললো,
–“জ্বী, বলুন।”
–“আসলে তূর্যয়ের এমন হিংস্র হওয়ার পেছনে তার অনেক বড় অতীত লুকিয়ে আছে।”
মোল্লা সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন।
রাণীর হাসিমুখ নিমিষেই অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।রাণী মোল্লা সাহেবকে উত্তর দিলো,
–“আমি জানি।কিন্তু, কি সেই উনার অন্ধকার অতীত?উনার জীবনের রহস্য জানতে আমার অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল।তবে এখন মনে হচ্ছে আমার সব অপেক্ষা শেষ হয়ে যাবে।”
মোল্লা সাহেব রাণীর মাথায় হাত রাখলো।
–“হ্যাঁ,মা।আমি বলবো তোকে সব।”
রাণী মাথা নাড়ালো হালকা হেসে।তূর্যয়ের জীবনের রহস্য জানার জন্যে রাণীর মনটা ব্যাকুল হয়ে ছিল।আজ সে সত্যিটা জানবে,এটা ভাবতেই রাণীর মনে শান্তি লাগছে।মোল্লা সাহেব কিছু বলার আগেই,বাচ্চারা চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,
–“হুজুর দেখুন,একটা আঙ্কেল দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে।”
রাণী আর মোল্লা সাহেব দুইজনই এতিম খানার বড় গেইটে দিকে তাকালো।এতিম খানার বড় দরজায় লোহার বড় বড় নকশা করা আছে।আর সেই নকশার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তূর্যয়কে। রাণীরা বেশি দূরে ছিলো না দরজা থেকে।তাই রাণী পরিষ্কারভাবে তূর্যয়কে দেখতে পাচ্ছে।তূর্যয়ের চুল একটু এলোমেলো হয়ে আছে।তূর্যয় তার হাত চালিয়ে সেগুলো ঠিক করে নিচ্ছে।তূর্যয়ের শার্টের বোতাম খোলা তিনটা।সাথে বাতাসের কারণে তূর্যয়ের শার্টের কলার উড়ছে।রাণীর নজর আটকে যায় তূর্যয়কে দেখে।তূর্যয় হাতের ইশারায় রাণীকে চলে আসতে বলছে।এই দেখে মোল্লা সাহেব রাণীকে বললো,
–“দেখেছিস মা?এই সবকিছুর মালিক সে।কিন্তু অতীতের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করতেই এই ছেলে এইখানে আসে না।এই এতিম খানাটা এক সময় তূর্যয়ের আসল বাড়ী ছিল।”
রাণী বেশ অবাক হলো মোল্লা সাহেবের কথায়।রাণী মোল্লা সাহেবকে কিছু বলার আগেই তার কানে ভেসে এলো তূর্যয়ের কণ্ঠ,
–“চলে আয়,রাণী।”
তূর্যয়ের কথা শুনে মোল্লা সাহেব রাণীকে বলে উঠলো,
–“দেখলি তো!আসেই না ছেলেটা ভেতরে।অথচ তারই বাড়ি,তারই সাম্রাজ্য।”
–“আমি চেষ্টা করে দেখি।এই দানবকে আল্লাহ্ কি দিয়ে বানিয়েছেন আল্লাহ্ জানেন।”
রাণী মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে কথাগুলো মুখে বলে উঠলো মোল্লা সাহেবকে।

মোল্লা সাহেব মাথা নাড়ালো।

রাণী হেলেদুলে গিয়ে তূর্যয়ের সামনে দাঁড়ালো।তূর্যয় রাণীকে ইশারা করলো গাড়িতে বসতে।কিন্তু রাণী দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে “না” বললো।তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে রাণীর দিকে তাকাতেই রাণী তূর্যয়কে বললো,
–“ভেতরে চলুন।বাচ্চাদের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই।তারা আপনার সাথে দেখা করলে আপনার বেশ ভালো লাগবে।”
রাণীর কথায় তূর্যয়ের মেজাজ খারাপ হলো।একবারে তূর্যয়ের কথা না শুনলে তূর্যয়ের মেজাজ সাথে সাথেই বিগড়ে যায়।তূর্যয়ের কোনো জবাব না পেয়ে রাণী তূর্যয়কে আবারও বলে উঠলো,
–“আরে কি হলো?আমি আজ অনেক মজা করেছি বাচ্চাদের সাথে।আপনিও আসুন।”
তূর্যয় এইবার মুখ খুললো,
–“আমি আজ অনেক বছর ধরে এই জায়গার ভেতরে যায় না।তাই আমাকে ভেতরে ঢুকতে বলা, তোর এনার্জি লস ছাড়া আর কিছুই না।যেটা আমি করি না,সেটা করতে আমাকে কেউ বাধ্য করতে পারে না।দেরী হচ্ছে চল।”
তূর্যয় গাড়িতে উঠতে গেলে রাণী তূর্যয়ের হাত ধরে তাকে বলে উঠলো,
–“শুরু হয়ে গেলো আপনার এই গাম্ভীর্যতা?আরে চলুন তো!”
রাণীর এমন নাছোড়বান্দা ভাব দেখে তূর্যয়ের মাথায় সাথে সাথে রাগ চেপে বসলো।তূর্যয় নিজের হাত টান দিতেই রাণী তূর্যয়ের কাছে চলে এলো।কারণ,রাণী তূর্যয়ের হাত ধরা অবস্থায় ছিলো।রাণী অবাক হয়ে তূর্যয়ের দিকে তাকাতেই তূর্যয় রাণীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চিল্লিয়ে উঠলো রাণীকে,
–“কি সমস্যা?আমার না মানে না!কেনো অহেতুক জিদ করছিস?তোর কদর করি, তাই বলে মাথায় উঠে বসবি?আসলেই, যোগ্যতা থেকে বেশি পেয়ে গেলে মানুষ নিজেকে অনেক কিছুই ভাবতে শুরু করে।তোকে নিয়ে বেশি ভাবছি দেখে,এটা ভাববি না; তুই যা বলবি আমার তাই করতে হবে।তাশরীফ তূর্যয় কারো কথা শুনে কাজ করে না।আমার যা মন চাই আমি তাই করি।এখন চল আমার সাথে।”
তূর্যয় রাণীর হাত ধরতে চাইলে রাণী সরে যায় পেছনের দিকে।রাণীর চোখে পানি চিকচিক করছে।তূর্যয়ের এতো অহংকারী ভাব রাণীর মোটেও ভালো লাগেনি।রাণী পেছনে ঘুরে মায়া এতিম খানার গেইটে গিয়ে থামলো।মোল্লা সাহেব এতক্ষণ তাদের কর্মকাণ্ড দেখছিল।তূর্যয়ের ব্যবহারে মোল্লা সাহেব নিজেও বেশ আহত হয়েছেন।তাই উনি আর গেলেন না তূর্যয়ের কাছে।রাণী গেইট থেকেই বাচ্চাদের আর মোল্লা সাহেবকে বিদায় দিলো।রাণীর চোখের পানি গাল বেয়ে পড়লো।তূর্যয়ের দিকে আগানোর আগেই রাণী নিজের চোখ মুছে নিলো।তবে, তার চোখ আবারও পানিতে ভিজে উঠলো।রাণী পেছনে ফিরতেই তূর্যয় ভাবলো রাণী গাড়িতে উঠবে।তাই তূর্যয় গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।কিন্তু, তা আর হলো না।রাণী তূর্যয়ের গাড়ির পাশ কাটিয়ে বেশ জোরে হাঁটতে লাগলো।এইদিক একটু মানবশূন্য হওয়ার কারণে গাড়ির বেশ অভাব।রাণী তাও মনে মনে ঠিক করেছে,
–“হেঁটেই মেইন রোডে উঠবো।এরপর টেম্পু ধরে চলে যাবো।কোনো অঘটন হয়ে মরে গেলেও আমি এই অহংকারী তূর্যয়ের গাড়িতে যাবো না।কি ভাবে নিজেকে সে?আমি এতিম বলে আমার কোনো মর্যাদা নেই নাকি?আমায় নিয়ে নাকি সে বেশি ভাবে।কি ভাবে?আমাকে অপমান করা ছাড়া কিই বা পারেন উনি?মাঝে মাঝে একটু দরদ দেখান এই আরকি।এমন দরদ উনি সবাইকেই দেখান।কেমন এক দানবকে ভালোবেসেছিস রাণী তুই!যে তোর কথার কোনো দাম দেয় না।”

রাণী একটু পরেই খেয়াল করলো তার হাত কেউ চেপে ধরেছে।যার কারণে তার হাঁটা বন্ধ হয়ে গেলো।রাণী ছলছল চোখে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে ফিরতেই তূর্যয়ের বুকের সাথে লেপ্টানো চেইনটি দেখতে পেলো সে।রাণীর ইচ্ছা করলো না নিজের মাথা উঁচিয়ে তূর্যয়কে দেখতে।তবে, রাণী দেখলো তূর্যয়ের গাড়ি তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।রাণী তূর্যয়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভাঙ্গা কণ্ঠে তূর্যয়কে বললো,
–“এই এতিম মেয়েটার সাথেই আপনার যতো সমস্যা।তাহলে তার হাত ধরেছেন কেনো?ছাড়ুন,আপনার হাত নোংরা হয়ে যাবে।”
রাণীর অভিমান মাখা কথায় তূর্যয় ঠোঁট বাঁকা করলো।রাণীর মুখ চেপে ধরে তূর্যয় রাণীকে তার দিকে ফিরিয়ে নিলো।রাণী সাথে সাথে নিজের চোখ বুজে নিয়েছে।যার কারণে রাণীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো চোখের জল।তূর্যয় জোরে নিঃশ্বাস নিলো।একটু ঝুঁকে রাণীর মুখে লেগে থাকা পানি তূর্যয় নিজের গাল দিয়ে ঘষে দিলো।রাণী নড়ে উঠে হালকা।দ্রুত চোখ খুলতেই রাণী তূর্যয়কে নিজের বেশ কাছে দেখতে পেলো।রাণী দুই কদম পিছিয়ে যেতেই তূর্যয় রাণীর পিঠে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো।রাণী বিরক্ত নিয়ে বললো,
–“আমি আমার এতিম খানায় যাবো।ছাড়ুন।”
–“আমিও সেখানে যাবো।চল।”
তূর্যয়ের সোজা জবাব।
–“আমি কি আপনাকে ধরে রেখেছি?আপনার যেখানে ইচ্ছা সেখানে যান।দানব একটা!কিভাবে মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে হয়, এটা আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।এক কাজ করুন এইসব সন্ত্রাসীগিরি ছেড়ে মানুষের মনে কষ্ট দেওয়ার জন্যে একটা কোচিং খুলুন।আপনার মত মানুষেরা এসে শিক্ষা নিবে আপনার কাছে, কিভাবে অন্যের মনে কষ্ট দিতে হয়।”
তূর্যয় চোখ ছোট ছোট করে রাণীর কথা শুনে যাচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে।রাণীর দিকে তাকিয়ে থাকতে তূর্যয়ের সবচেয়ে ভালো লাগে।রাণী বকবক করার তালে এটাই খেয়াল করছে না,তূর্যয় ঠিক কতটা ভালোবাসার নজরে চেয়ে আছে রাণীর দিকে।রাণী নিজের বকবক শেষ করতে শেষ বাক্যে বললো,
–“শুনেছেন কি কি বলেছি?”
–“হুম,গাড়িতে উঠো।”
তূর্যয়ের শান্ত জবাব।
–“আমার মাথা শুনেছেন।আপনার মাথাটাও তো গেলো দেখছি।আমার সাথে ভালো আচরণ করছেন কিভাবে? সত্যিই কি আমাকে তুমি করে বলেছেন? নাকি আমার কানের সমস্যা?নিজেই যান নিজের গাড়ি করে।”
রাণীর কথায় তূর্যয় গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো,
–“রাণী!”
রাণী হঠাৎ কেঁপে উঠলো নিজের নাম শুনে।সারাগায়ে যেনো কাঁটা দিয়ে উঠছে তার।রাণী চুপ করে গেলো।কিন্তু তূর্যয় চুপ নেই। সে রাণীকে নিজের আরো কাছে এনে বললো,
–“গাড়িতে উঠ নাহলে!”
–“কি করবেন?খেয়ে ফেলবেন এই তো?”
রাণীর সহজ প্রশ্ন।
তূর্যয়ের হাসি পেলো খুব।নিজের ঠোঁট দুটো হালকা প্রশস্ত করলো সে।রাণীর গাল চেপে তূর্যয় তাকে বললো,
–“হ্যাঁ,খেয়ে ফেলবো।”
রাণী তূর্যয়ের ঠোঁট প্রশস্ত করা দেখে মুহূর্তেই গলে গেলো।তার বুকে হানা দিলো এক তীব্র ব্যাথা। কারো চাপা হাসি দেখে বুকে ব্যাথা হয়,এমনটা রাণীর নিজের ক্ষেত্রে না ঘটলে কখনোই বিশ্বাস করতো না।রাণী শান্ত হয়ে এলো তূর্যয়ের সেই চাপা প্রশস্থ ঠোঁট দেখে।দুই জনের চোখের গভীরতায় দুইজনের চেহারাটা এখন তাদের সবচেয়ে বেশি আবেদনময়ী লাগছে।সোডিয়াম লাইটের আলোয় রাণীর চকচক করা চোখ যেনো আরো বেশি পাগল করছে তূর্যয়কে।তূর্যয় আরো কাছাকাছি গেলো রাণীর।রাণী নড়লো না।অপলক তাকিয়ে আছে তূর্যয়ের দিকে।রাণী‌ আটকে আছে তূর্যয়ের সেই মায়া মাখানো চাপা হাসির মায়াজালে।তূর্যয় রাণীর কাছাকাছি এসে কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
–“গাড়িতে যখন উঠবি না,তাহলে খাওয়া শুরু করছি তোকে।”
তূর্যয় হালকা করে মুখ হাঁ করলো।রাণীর গলার বরাবর এসে তার গলায় দাঁত বসাতেই রাণীর হুঁশ ফিরেছে।রাণী তূর্যয়ের বুকে ধাক্কা দিলো,তূর্যয় সরেনি। তবে রাণী দুইপা পিছে চলে গেলো।তূর্যয় রাণীর গলায় শুধু দাঁত বসিয়েছিল কামড় দেয়নি।রাণী আতংকিত হয়ে গলায় হালকা হাত ঘষে বলে উঠলো,
–“এই তো দেখি সত্যিকারের রাক্ষস।”
তূর্যয় ভ্রু উচুঁ করলো রাণীর কথায়।রাণীর হাত চেপে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো সে।এরপর বেশ কড়া ভাষায় বললো,
–“শুধু তোর জন্যে রাক্ষস আমি।”

রাণী কিছু বললো না।চুপ করে রইলো। একটু আগের তূর্যয়ের ব্যবহারের কথা ভাবছে সে।তূর্যয় রাণীর গলায় দাঁত বসিয়েছে ব্যাপারটা ভাবতেই রাণী নিজের গলায় আবারও হাত দিলো।চোখ বন্ধ করতেই তূর্যয়ের সেই চাপা প্রশস্ত ঠোঁটের ছবি আর তূর্যয়ের চেহারা মনে আসতেই রাণী হালকা হেসে উঠলো।রাণী মনে মনে ভাবছে,
–” সন্ত্রাসী লোকটার প্রশস্ত ঠোঁট জোড়া আমার মনে উনার জন্যে জমানো রাগ নিমিষেই কিভাবে গায়েব করে দিলো!ভালোবাসার মানুষের হাসির কাছে কি সত্যিই সকল রাগ হার মানে? হ্যাঁ,তাই হবে।নাহলে আমি এই দানবের সাথে রাগ করে টেম্পু দিয়ে যাওয়ার কথা।কিন্তু না!আমি যাচ্ছি সেই দানবের গাড়ি চড়ে।”
রাণীর মনের ভাবনা কাটলো তূর্যয়ের ধমক শুনে।তূর্যয় ফোনে কথা বলার মাঝে ধমক দিয়ে বললো,
–“হ্যারি,কথা শুনবে আমার।বারবার বলেছি ঐ এলাকায় আমি ছাড়া যাবে না।তাহলে কেনো সেই কথা অমান্য করেছো?তোমাকে শুধু বলেছিলাম,সেই এলাকার পাশে আজিন নামের একজন আছে তাকে মেরে দিতে।তুমি তাকে মেরে সেই এলাকায় ঢুকলে কেনো?ইকরামের সাথে জলদি গাড়িতে উঠো।আমরা একসাথে যাবো সেই এলাকায়।কথা না শুনলে,আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
অপর পাশ থেকে হ্যারি বিনয়ের সাথে জবাব দিলো,
–“ফাইন,আম কামিং ব্যাক।”
তূর্যয় এবার শান্ত হলো। সে শান্ত কণ্ঠে বললো,
–“ওকে, গুড।”

রাণী এই দুই জনের এমন বন্ধন দেখে সবসময় অবাকই হয়ে থাকে।রাণীর মনে হয়,তূর্যয় আর হ্যারি দুইজন দুইজনের জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।রাণী নিজের মনে নানা কিছু ভেবে চলছে।

তূর্যয় অনেক্ষণ ধরে রাণীকে লক্ষ্য করছে।রাণীর বকবক বন্ধ দেখে তূর্যয় বুঝতে পারলো রাণী এখনো তূর্যয়ের সাথে রেগে আছে।তূর্যয় রাণীকে ডেকে উঠলো,
–“রৌদ্র?”
রাণী মাথা ঘুরিয়ে তাকালো তূর্যয়ের দিকে।রাণীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে তূর্যয় রাণীকে বললো,
–“রেগে আছো?”
–“এতিমদের রাগ দুই মিনিটের।তাদের রাগ ভাঙ্গানোর কেউ নেই।তাই তারা রেগে যায় আবার নিজে নিজে ঠিক হয়ে যায়।”
রাণী নিজেকে বারবার এতিম বলা তূর্যয়ের মোটেও ভালো লাগে না।তূর্যয় নিজের হাত দিয়ে রাণীর কাঁধ চেপে ধরলো।রাণী নড়চড় করছে,তূর্যয়ের হাত ছাড়াতে ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু রাণী মুখে কিছুই বলছে না।

–“পৃথিবীতে শুধু তুই একা এতিম না।আরো অনেকেই আছে যাদের এই দুনিয়ায় আপন কেউ নেই।তারাও এতিম।”
তূর্যয়ের কথা শুনে রাণী কিছু বলছে না দেখে তূর্যয় রাণীকে আরো কাছে টেনে নিল নিজের দিকে।এরপর ধীরে ধীরে বলতে লাগলো,
–“রাগ উঠে যায় মাথায় হুটহাট।ছোটকালে যখন একা একা থাকতাম,তখন থেকেই এই রাগের সৃষ্টি হয়।নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না রাগ।মাথায় রাগ উঠলে সব এলোমেলো লাগে।হাত,মুখ বেশি চলে।এই রাগের মাথায় কয় জনের জান নিয়েছি আমি জানিনা।যদিও তাদের দোষ থাকতো,তারপরও মেরে ফেলার মতো ছিলো না তারা। আমি ক্ষমা করতে পারতাম তাদের।কিন্তু,তোর কথা মতো,আমি অনেক হিংস্র,রাগী।তাই হিংস্রতা ঘিরে ধরে আমায় বারবার।মেরে দিতাম সবাইকে।এখনো মেরে দিই।হিংস্রতা আমাকে পিছু ছাড়ে না।অন্যায় সহ্য হয় না।দোষীদের ক্ষমা করতে পারি না।আর আমি এই হিংস্রতা কখনো কমাতে চাই না।তবে, এই হিংস্রতা থেকে শুধু একজন রেহায় পাবে,রৌদ্র।”
রাণী অবাক হয় তূর্যয়ের কথা শুনে।রাণী জানে সেই একজন,রাণী।তূর্যয় যতোই রাণীর সাথে হিংস্রতা দেখাক না কেনো,তূর্যয়ের মনে রাণীর জন্যে একটা মায়াময়ী জায়গা আছে,যেটা রাণী এখন আন্দাজ করতে পারে।রাণী তূর্যয়ের হাঁটুর উপর রাখা হাতে হাত রাখে।রাণীর অনেক মায়া হচ্ছে তূর্যয়ের জন্যে।তূর্যয়ের এমন হিংস্র হওয়ার পেছনে নিশ্চয় কোনো বড় কারণ আছে।যেটা আজ সে চেয়েও জানতে পারলো না।রাণীর আফসোস হচ্ছে।রাণীর হাতে তূর্যয় শব্দ করে চুমু খেতেই রাণী নিজের জগতে ফিরে এলো।রাণী কিছু বলতে যাবে এর আগেই গাড়ি থামলো।এতিম খানায় চলে এসেছে রাণী।তূর্যয়কে ডিঙিয়ে যেতে যেতে রাণী তূর্যয়কে বললো,
–“অতিরিক্ত হিংস্রতা ভালো না।আপনার এই হিংস্রতায় আপনার আপন কোনো মানুষের প্রাণ না চলে যায়!”
রাণীর পেটে এক হাত পেঁচিয়ে গাড়ি থেকে নামতে বাঁধা দেয় তূর্যয়।রাণী সমতা হারিয়ে বসে পড়লো তূর্যয়ের হাঁটুর উপর।তূর্যয় রাণীর কানে জোরে একটা কামড় দিলো।রাণী কান চেপে ধরলো ব্যথায়।
–“আমার আপন মানুষের দিকে হাত লাগানো তো দূরের কথা,চোখ তুলে তাকানো নিষেধ সবার।”
রাণীর আর কিছু শুনলো না।রাণী তূর্যয়ের হাত ঠেলে দ্রুত নেমে পড়লো গাড়ি থেকে।কানে বড্ড জ্বালা করছে রাণীর।কানে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে রাণী ভেতরে চলে যাচ্ছে এতিমখানার।আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
–“আসলেই রাক্ষস একটা।কিভাবে কামড়ায়?ভাগ্যিস গলায় এমন কামড় দেয়নি।নাহলে তো এতক্ষণে…”
রাণী আর কিছু ভাবলো না।তূর্যয়ের এমন পাগলামি দেখে রাণী মিষ্টি করে হেসে উঠলো।


তূর্যয়ের মনে চিন্তার শেষ নেই। আকবর নিজের বেশ পাল্টিয়ে শহরে ঘোরা ফেরা করছে।তূর্যয়ের সবকিছুতে নজর রাখছে সে।এই খবর পেয়ে তূর্যয়ের মেজাজ চরম খারাপ।রাণী আর মোল্লা সাহেবের সিকিউরিটির জন্যে একজন করে লোক রেখেছে সে।নিজের ডার্ক হাউজের সেই সিক্রেট ঘরে তূর্যয় আটকে রেখেছে আকবরের ভাইপোকে।ছেলেটার মুখ বাঁধা ছিলো এতক্ষণ।তূর্যয়কে দেখতে পেয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করলো ছেলেটা।রাগে তূর্যয়ের মেজাজ এতো বিগড়ে গেলো,
তূর্যয় নিজের বুটে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে ছেলেটির মুখে আঘাত করলো।ছেলেটি জোরে আর্তনাদ করছে ব্যথায়।নিজের শার্টের হাতা কুনুই পর্যন্ত বটে তূর্যয় ছেলেটির গালের কাটা অংশে জোরে চেপে ধরলো।ব্যথায় ছেলেটির প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
–“হুঁশ,কোনো শব্দ না।তিনটা মার্ডার কেসেরে আসামি তুই।সাথে চারজন কিশোরীকে রেপ করেছিস।আর তুই কিনা এতো সামান্য ব্যথায় কু্ঁকিয়ে উঠছিস?তুই জাহান্নামে যা,আমার কিছু যায় আসে না এতে। তোকে এইখানে তুলে আনার কারণ হলো,আমার কিছু উত্তর চাই।”
ছেলেটি তূর্যয়ের হাত সরাতে আকুতি করে বলে উঠলো,
–“সব বলবো।মুখ ছাড়ুন।”
তূর্যয়ের চোখ আরো লাল হয়ে এলো।সে ছেলেটির মুখ সেই একই অবস্থায় ধরে বলতে লাগলো,
–“তূর্যয় কারো শর্তে চলে না।আমাকে উত্তর দে,আকবর কই?”
ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
–“জানিনা,তূর্যয়।”
তূর্যয় ঘাড় কাত করলো।অন্য হাতে নিজের কপালের চুল মাথায় উঠিয়ে ইকরামকে বলে উঠলো,
–“ইকরাম, ব্লেড আর ফিঙ্গার কাটার দে।”
মুহূর্তেই বুঝে গেলো ছেলেটি তার সাথে কি হতে যাচ্ছে এখন।তূর্যয় ফিঙ্গার কাটার হাতে নিতেই ছেলেটি চিৎকার দিয়ে উঠলো,
–“বলছি, বলছি।”
তূর্যয় শয়তানি চোখে তাকালো ছেলেটির দিকে।ফিঙ্গার কাটার হাতে নিয়েই তূর্যয় চেয়ার টেনে বসে পড়লো ছেলেটির সামনে।
.
গত রাতে হ্যারি আর তূর্যয় একটা মিশনে গিয়েছিল। হ্যারি থেকে রাণী শুনলো, তারা ফিরেছে দুপুর বারোটায়।তূর্যয় এসেই ঘুম দিয়েছে।তাই রাণীর আজ কাজে যাওয়া হয়নি।তবে রাণী হ্যারিকে বলে দিয়েছে দুইজন যেনো দুপুরের খাবার ঠিক মতো খেয়ে নেয়।

রাণী ভাবলো,আজই সে কাজ থেকে ছুটি পেয়েছে।তাই মোল্লা সাহেব থেকে সব সত্যি জানা আজ তার জন্যে বেশ সহজ হবে।রাণী তাদের মোবাইল থেকে ফোন করতে চাইলো মোল্লা সাহেবকে।কিন্তু, সিমি জানালো তাদের ফোনে টাকা নেই।আর রাণীর অফিস থেকে দেওয়া ফোন থেকে তো বাহিরের কাউকে ফোন দেওয়া যাবে না।তাই রাণী সালেহার অফিসে ঢুকে সেখানের টেলিফোন থেকে মোল্লা সাহেবকে ফোন করে এতিম খানা থেকে একটু দূরে দেখা করতে বললো।মোল্লা সাহেব খুশি হয়ে রাণীকে আশ্বাস দিলো উনি পাঁচটার দিকে পৌঁছে যাবেন। রাণী মোল্লা সাহেবের বলা সময়টি উল্লেখ করে উনাকে উত্তর দিলো,
–“ঠিক আছে মোল্লা সাহেব,আমি পাঁচটার আগেই তৈরি থাকবো।”

রাণীর এইসব কথা কেউ একজন আড়ালে শুনে নিয়েছে।সেই মানুষটি সঙ্গে সঙ্গে এক পাশে গিয়ে ফোন লাগায় সাবিনাকে,
–“হ্যালো?আজ আমাদের কাজ একেবারে একশো ভাগ সম্পূর্ণ হবে।দ্রুত মানুষ পাঠিয়ে দিবেন এতিম খানার পূর্ব পাশে জিয়াদ হোটেলের পিছনে পাঁচটার দিকে।রাণী সেই হোটেলেই থাকবে। সেখান থেকে রাণীকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেলে কেউ টের পাবে না।আমাদের আর রাহেলার সাহায্যের প্রয়োজন হবে না।”
–“মা* রাহেলার নাম নিবি না।পুরো কাহিনী বল।”
সাবিনার ঘৃণিত কণ্ঠ।
ফোনের পাশের মানুষটি সব খুলে বললো।এরপর সাবিনা হেসে জবাব দিলো,
–“ঐ মোল্লা বুড়ার সাথে কথা শেষ,এরপর রাণী শেষ।”
ফোনের পাশের মানুষটি আর সাবিনা দুইজনই হেসে উঠলো বিশ্রীভাবে।

মোল্লা সাহেবকে এতিম খানার নিচে দেখতে পেয়ে রাণী দ্রুত নিচে নামলো।এরপর মোল্লা সাহেবের সাথে হাঁটতে লাগলো রাণী।আর দূর থেকে একটা কালো রঙের গাড়ি রাণী আর মোল্লা সাহেবকে ফলো করতে লাগলো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে