#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ১১)
১.
নভেম্বর মাসে এমন ঘোর বর্ষাকালের মতো বৃষ্টি নামবে কে জানত। জহির তীরবেগে সাইকেল চালায়, তাও শেষ রক্ষা হয় না। নওরিনের বাসায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভিজে এক সা হয়ে যায়। প্রথম এই বাসায় যখন আসে তখন নওরিনের আম্মুকে দেখে ও খুব অবাক হয়েছিল। ওদের পুরো পরিবারটা যেন এই বাসার সাথে যায় না। মনে হচ্ছিল একটা গোলাপ বাগান ভুল করে রুক্ষ মরুভূমিতে এসে পড়েছে। বোঝায় যায় এরা একসময় ভীষণ বড়োলোক ছিল। যেদিনই পড়াতে আসে সেদিনই নওরিনের আম্মু যত্নের সাথে নাস্তা দেন। কথাবার্তাও মার্জিত। নওরিনের ভাই আরুশ ছেলেটাও খুব ভালো। দারুণ ইংরেজি বলে।
সাইকেলটা গ্যারেজে রেখে ও এবার ভেজা চুলে আঙুল চালায়। এহ, ভিজে একেবারে চুপচুপে হয়ে গেছে। শার্টটাও ভিজে গেছে। এ অবস্থায় উপরে যায় কী করে?
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শরীর শুকানোর চেষ্টা করে। তারপর লিফট চেপে নওরিনদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে কলিং বেল চাপে।
নওরিনের আজ হঠাৎ করেই তলপেটে খুব ব্যথা করছিল। অনেক দিন পর ব্যথাটা ফিরে এল। পিরিয়ড হবার আগে ব্যথা হয় কিন্তু এতটা হয় না যেটা আজ হচ্ছে। হঠাৎ করেই ওর অনেক দিন আগের সেই দিনের কথা মনে পড়ে যায়। আহনাফের দেওয়া ওষুধ খাবার পর এমন তীব্র পেট ব্যথা হয়েছিল। ভাবতেই একবার গা শিউরে ওঠে। নওরিন হাঁটু দুটো পেটের কাছে ভাঁজ করে কুঁজো হয়ে শুয়ে পড়ে। বাইরে আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি হচ্ছে।
ঠিক এমন সময় কলিং বেল বাজার শব্দ হয়। নওরিন বিরক্ত হতে যেয়েও থমকায়। জহির ভাই আসার কথা। ইশ, ও একদমই ভুলে গিয়েছিল। কোনোমতে শরীরটা টেনে ওঠে। তারপর ঠোঁট চেপে ব্যথাটা সামলায়। দরজা খুলেতেই অবাক চোখে চেয়ে দেখে জহির ভাই কাকভেজা।
ও চঞ্চল গলায় বলে, ‘ইশ! আপনি একদম ভিজে গেছেন। ভেতরে আসুন, আমি একটা টাওয়েল দিচ্ছি।’
জহির একটা অপ্রস্তুত হাসি দেয়। সোফায় বসতে যেয়েও বসে না, ভিজে যাবে। একটু পর নওরিন একটা শুকনো টাওয়েল দিতেই জহির ভালো করে মাথা মুছে ফেলে। তারপর গলা, ঘাড় মুছে টাওয়েলটা ফেরত দিতেই নওরিন দুঃখিত গলায় বলে, ‘আপনাকে বলতে ভুলেই গেছিলাম আরুশ আজ বাসায় নেই। হঠাৎ ওকে নিয়ে আম্মু ডাক্তারের কাছে গেছে। আপনি বসুন একটু। চা খাবেন তো?’
জহির মাথা নাড়ে, ‘চা খাব।’
নওরিন রান্নাঘরে যেয়ে চুলো জ্বালে। তারপর হাড়িতে পানি চাপিয়ে চুলার আগুন বাড়িয়ে দেয়। দ্রুত হাতে চা পাতা, চিনি আর গুড়ো দুধের কাচের বয়ামগুলো নিচে নামায়। কেমন টগবগ করে পানি ফুটছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা কথা মনে হয়। আর সেটা মনে হতেই একটা অস্বস্তি ওকে ঘিরে ধরে। বাসায় কেউ নেই। সেদিনও আহনাফের বাসায় কেউ ছিল না। আর ও ওকে….। কথাটা মনে হতেই ওর পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। একটা ভয়, আতংক ওকে গ্রাস করতে থাকে। চুলোয় পানি টগবগিয়ে ফুটছে। সেদিকে ওর বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।
নওরিন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বেডরুমে যায়, তারপর দরজা বন্ধ করে থরথর করে কাঁপতে থাকে। একটা সময় দরজায় হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে, হাঁটু দুটো পায়ের কাছে ভাঁজ করে নিয়ে আসে৷ বাইরে সশব্দে বাজ পড়তেই ও চমকে ওঠে দু হাঁটুতে মুখ ঢাকে।
জহির ভ্রু কুঁচকে ভাবে, চা বানাতে এতক্ষণ লাগে! একবার গলাখাঁকারি দিয়ে নওরিনের নাম ধরে ডাকে। কিন্তু কোন সাড়া মেলে না। কোনো ঝামেলা হলো না তো?
কথাটা মনে হতেই জহির উঠে দাঁড়ায়, তারপর দূর থেকে রান্নাঘরে একবার উঁকি দেয়। কেউ নেই! উলটো একটা পোড়া গন্ধ আসছে। ধক করে ওঠে বুকটা। দৌড়ে ও রান্নাঘরে গিয়ে দেখে চুলোয় একটা হাড়ির পানি শুকিয়ে পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে। দ্রুত ও চুলোটা বন্ধ করে। তারপর বেরিয়ে এসে উঁচু গলায় ডাকে, ‘নওরিন, তুমি ঠিক আছ তো?’
আশেপাশে তাকাতেই একটা রুমের দরজা বন্ধ দেখতে পায়। কী মনে হতে ও দরজায় একটা টোকা দেয়, ‘নওরিন, তুমি ভেতরে? ঠিক আছ তো?’
নওরিন মুখ নিচু করে বসেছিল। হঠাৎ দরজায় টোকা দেবার সাথে নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে। জহির ভাইও আহনাফের মতো!!
জহির আবার ডাকতে যেয়ে থমকে যায়। হঠাৎ করেই ওর একটা কথা মনে হয়, মেয়েটা বাসায় একা। আচ্ছা মেয়েটা ওকে ভয় পেয়ে বেডরুমে দরজা বন্ধ করে বসে রয়নি তো? কথাটা মনে হতেই নিজের গালে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করে। এই সামন্য জ্ঞানটুকু ওর নেই কেন? ও এবার দ্রুত বাসা থেকে বের হয়। আসার সময় দরজার অটোলক টেনে বের হয়ে পড়ে। তারপর নওরিনকে একটা মেসেজ করে, ‘আমি চলে যাচ্ছি। রান্নাঘরে হাড়িটা পুড়ে গেছে। আমি সরি, বুঝতে পারিনি তুমি ভয় পাচ্ছিলে। বাসায় কেউ নেই জেনেও আমার ভেতরে যাওয়া উচিত হয়নি।’
মোবাইলে মেসেজ আসার শব্দ হতেই নওরিন মুখ তোলে। বাইরের ঘরে থেকে কোনো শব্দ আসছে না। জহির কি এখনও ওঁত পেতে বসে আছে? কথাটা মনে হতেই শিউরে ওঠে। আম্মুকে একবার ফোন দেবে? কথাটা মনে হতেই হামাগুড়ি দিয়ে উঠে যেয়ে মোবাইলটা হাতে নেয়। মোবাইলটা খুলতেই দেখে জহিরের মেসেজ। মেসেজটা পড়ে, পড়তেই থাকে। চোখ ভিজে আসে নওরিনের। একটা অনুশোচনা ঘিরে ধরতে থাকে। ছি:! কী ভুল ভাবনা ও ভাবছিল এতক্ষণ! মনটা কদর্য হয়ে গেছে।
ঠিক এমন সময় বাইরে কলিংবেলের শব্দ হয়। নওরিন দ্রুত চোখমুখ মুছে বেডরুমের দরজা খুলতে খুলতেই আরেকবার কলিংবেল বেজে ওঠে।
নওরিন দরজা খুলতেই আরুশকে নিয়ে দিলশাদ ভেতরে ঢোকেন। তারপর বিরক্ত গলায় বলেন, ‘কী রে, এতক্ষণ লাগল দরজা খুলতে? জহির ছেলেটাকে দেখলাম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। ও কি বাসায় এসেছিল?’
নওরিন নিচু গলায় বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু, এসেছিল। আরুশ নেই শুনে চলে গেল।’
দিলশাদ অবাক গলায় বলে, ‘ওকে এই বৃষ্টির মধ্যে চলে যেতে দিলি? বসতে বলতি। আশ্চর্য মানুষ তো তুই। দিন দিন বড়ো হচ্ছিস আর ভদ্রতা জ্ঞান কমছে।’
আম্মুর এই বকাটা কেন যেন খুব ভালো লাগতে থাকে নওরিনের। সেই সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাইকেল চালিয়ে চলে যাওয়া ছেলেটার জন্য বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা মায়া হতে থাকে। ঠিক এমন করে আর কারও জন্য কখনও মায়া হয়নি।
পরের দু’দিন ও কিছুতেই জহিরকে খুঁজে পায় না। লাইব্রেরির সেই সিটটা খালিই পড়ে থাকে। নওরিন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বসে থাকে। একবার মনে হয় ফোন দেই, কিন্তু সেদিনের ওর অমন নিচু মনের চিন্তার জন্য একটা সংকোচ হতে থাকে। কিন্তু তৃতীয় দিনও যখন জহিরের দেখা পায় না তখন বাধ্য হয়েই ও ফোন দেয়৷
ওপাশ থেকে জহিরের দূর্বল গলা পাওয়া যায়, ‘কেমন আছেন আপনি? ভালো তো?’
নওরিন উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনার কী হয়েছে? এই ক’দিন ক্যাম্পাসে আসেননি কেন?’
জহির একটা কাশি দিয়ে বলে, ‘আপনাদের বাসা থেকে আসার পর থেকেই ভীষণ জ্বরে পড়লাম। সেইসাথে কাশি। ভালো হলেই আরুশকে পড়াতে যাব।’
নওরিন অনুশোচনায় মরে যেতে থাকে। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজেই এমন হলো। ও নরম গলায় বলে, ‘আপনি কোন হলে থাকেন? আমি একটু আসি? নামতে পারবেন?’
জহির হলের নামটা বলতেই নওরিন আর এক মুহুর্ত দেরি করে না। একটা রিক্সা নিয়ে চলে যায় ওর হলে। কিন্তু কাছে এসেই থমকে দাঁড়ায়। এর আগে কখনও ছেলেদের হলে আসেনি। ও জড়তা নিয়ে ফোন দিতেই জহির বলে, ‘আপনি ওয়েটিং রুমে একটু বসুন, আমি নামছি।’
একটু পর জহির আসে। গালে ক’দিনের না কামানো দাড়ি, গায়ে একটা কালো শাল পেঁচানো। কাছে আসতেই ও উঠে দাঁড়ায়, নির্নিমেষ চেয়ে থাকে ওর দিকে। তারপর নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বুকের ভেতর আবেগের ঢেউটা সামলায়। নরম গলায় বলে, ‘আমার জন্য আপনার এমন জ্বর হলো। সরি।’
জহির তাকিয়ে দেখে পরির মতো একটা মেয়ে কী একটা আকুলতা নিয়ে ওর মুখের পানে তাকিয়ে আছে। ও লজ্জিত গলায় বলে, ‘আরে না, আপনি সরি হবেন কেন। ওইদিন আমিই বোকার মতো কাজ করেছি। তবে আপনার কাছে কিন্তু এক কাপ চা পাওনা।’
নওরিন ফিক করে হেসে ফেলে, তারপর বলে, ‘আপনি একটু কষ্ট করে হেঁটে ওই চায়ের দোকানটায় যেতে পারবেন? একটু আদা লেবু চা খেলে ভালো লাগত।’
জহির উঠে দাঁড়ায়, ‘চলুন, আমারও খুব চা খেতে ইচ্ছে করছিল। আপনি এসে ভালো হয়েছে।’
নওরিন ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি সুস্থ হয়ে উঠলে আপনার সাইকেলে করে একদিন আমাকে ঘোরাবেন?’
জহির হাসে, ‘আচ্ছা। আবার কখনও আপনার পায়ের স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে গেলে আমাকে ফোন দেবেন। সেদিন আপনাকে সাইকেলে উঠিয়ে নিমাইয়ের কাছে নিয়ে যাব।’
নওরিন এবার হাসে, ‘তাহলে তো একদিন ইচ্ছে করেই জুতোর ফিতে ছিড়তে হয়। আচ্ছা, আপনি আমাকে জীবনানন্দের একটা কবিতার বই কিনে দিয়েন তো।’
জহির মাথা নাড়ে। কেন যেন ওর খুব ভালো লাগছে আজ।
নভেম্বরের মাসের মাঝামাঝি এক সকালে পিঠে নরম রোদ্দুর মেখে ওরা চায়ে চুমুক দিতে থাকে। না, তেমন করে আর কোনো কথা হয় না। জহির টের পায় ওর জ্বরটা সেরে যাচ্ছে, সেটা আদা চায়ের কারণে নাকি নওরিন এমন করে পাশে বসে থাকাতে সেটা ঠিক বোঝা যায় না। আর নওরিনের মনে হয়, অনেক দিন পর একটা অসুখ সারল ওর। আহনাফের কারণে যে বিশ্বাস একবার ভঙ্গ হয়েছিল সেই বিশ্বাসটা আজ ও জহিরের কারণে আবার নতুন করে ফিরে পেল। পৃথিবীতে সব মানুষ পশু না, কিছু মানুষ সত্যিকারেরই মানুষ।
২.
আরুশ রেজাল্ট কার্ড হাতে হতভম্ব হয়ে বসে আছে। বিলকিস ম্যাডাম যখন প্রথম দশজনের পরই ওর নাম ধরে ডাকল তখনও ও বসে ছিল। পরে নিলয়ের কনুইয়ের খোঁচায় ও উঠে দাঁড়িয়েছিল। ম্যাডাম ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হাফ ইয়ারলিতে ভালো করলে তো তুমিই ফার্স্ট হতে। বাসায় ভালো করে পড়বে।’
সেই থেকে রেজাল্ট কার্ড হাতে ও বসে আছে। যে বাংলায় ও গতবার ফেল করেছিল সেই বাংলায় ও সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। অন্যান্য বিষয়গুলোতেও ভালো হয়েছে। ইশ, আম্মু এবার অনেক খুশি হবে। আর আপু? আপু নিশ্চয়ই আজ চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে।
স্কুল ছুটি হতেই ও বেরিয়ে পড়ে। তারপর বাসায় এসে প্রথমে আম্মুর হাতে রেজাল্ট কার্ড দেয়।
দিলশাদ রান্না করছিলেন। আজ আরুশকে স্কুল থেকে আনতে যেতে পারেননি। ওর হাতে রেজাল্ট কার্ড দেখেই বুক ধুকপুক করছে।
তারপর দ্রুত চোখ বোলাতেই থমকে যান। অবিশ্বাসের গলায় বলেন, ‘তুই এগারোতম হয়েছিস? কী করে? গতবার না বাংলায় ফেল করলি?’
কথাটা বলে এবারের বাংলার নম্বর দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান, বিস্মিত গলায় বলেন, ‘তুই বাংলায় ৯১ পেয়েছিস!! জহির ছেলেটা দেখি জাদু জানে।’
দিলশাদ এবার দুই হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। কপালে চুমু খান। ইশ, কী যে ভালো লাগছে! গতবার যখন ফেল করল তখন ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। মনে হয়েছিল আল্লাহ বুঝি শুধু কষ্টই লিখে রেখেছেন কপালে। আজ কোনো কষ্ট নেই।
বিকেলে নওরিন বাসায় ফিরতেই আরুশ চুপিচুপি আপুর কানে কানে বলে, ‘আপুউউউ, আমি বাংলায় একানব্বই পেয়েছি, ক্লাশের সর্বোচ্চ নম্বর এটাই।’
নওরিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তারপর চিৎকার করে বলে, ‘কী বললি! তুই সত্যিই বাংলায় এত ভালো করেছিস?’
আরুশ এবার মিটিমিটি হেসে পেছন থেকে রেজাল্ট কার্ড বের করে আপুর হাতে দেয়। এই সময় দিলশাদও নাস্তা নিয়ে রুমে ঢোকেন।
নওরিন রেজাল্ট কার্ড দেখে চিৎকার করে বলে, ‘তুই তো অসম্ভব কাজ করেছিস আরুশ।’
দিলশাদ নাস্তা নামিয়ে বলেন, ‘জহির ছেলেটা খুব ভালো। ওকে একদিন রাতে আমাদের সাথে খেতে বলিস।’
নওরিন কৃত্রিম রাগের গলায় বলে, ‘আর আমি যে কষ্ট করে ওকে অন্যান্য সাবজেক্ট পড়ালাম তার বুঝি কোনো দাম নেই?’
দিলশাদ এবার হেসে বলেন, ‘আগে তো কোনোদিন ভাইকে নিয়ে পড়াতে বসতি না। সারাক্ষণ নিজের রুমে মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকতি। অথচ দেখ, এবার তুই আর জহির ওকে পড়ালি বলেই না ও কত ভালো করল।’
নওরিনের হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়ে যায়। আগে এমনই ছিল। আরুশের জন্য আলাদা করে টিচার রাখা থাকত। ওর জন্য আলাদা। তখন ওর পড়া নিয়ে ও ভাবতই না। কিন্তু এখন তো ওদের আলাদা করে প্রাইভেট টিচার রাখার অত পয়সা নেই। তাই বাধ্য হয়েই নিজে পড়িয়েছে। আর আরুশ এমন ভালো একটা রেজাল্ট করল! এই আনন্দের দেখা ও আগে কখনও পায়নি।
নওরিন আরুশকে কাছে টেনে বলে, ‘এখন তো তুই ক্লাশ নাইনে। এই দুটো বছর ভালো করে পড়তে হবে। তোর ফিজিক্স আর ম্যাথ আমিই পড়াব। অন্য সাবজেক্টে টিচার লাগতে পারে। তুই ভাবিস না, আমিই ব্যবস্থা করব সব।’
দিলশাদ স্নেহের চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কী লক্ষ্মী একটা মেয়ে হয়েছে। অথচ এই মেয়েটা একটা সময় ওই আহনাফের সাথে…। কথাটা ভাবতেই বুক মোচড় দিয়ে ওঠে।
উঠে যাবার সময় বলে, ‘নওরিন, জহিরকে ওর রেজাল্টের কথা জানিয়ে দিস। বড্ড ভালো ছেলে।’
নওরিন বুকের ভেতর একটা মায়া টের পায়। আর সেটা জহিরের জন্য। ওর কথা মনে পড়লেই মন কেমন নরম হয়ে আসে। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই নওরিন থমকে যায়। আচ্ছা, ও যে জহিরের দিকে এমন করে ঝুঁকে পড়ছে সেটা কি ঠিক হচ্ছে? হ্যাঁ, জহিরের চোখেও ও মায়া দেখেছে। কিন্তু জহির যখন জানবে ওর একটা অন্ধকার অতীত আছে তখন কি এই মায়াটা ঘৃণায় পরিবর্তিত হয়ে যাবে না? সেটা হলে যে ভীষণ কষ্ট পাবে ও। মিছেমিছি কষ্ট পাবার কোনো মানে নেই। নিজের ভালো লাগাটুকু নিয়ে ও দূরে সরে যাবে, মনের দিক থেকে।
ক’দিন পর এক রাতে জহিরকে যখন খেতে বলে, ও উচ্ছ্বসিত হয়ে রাজি হয়। জহির ভাই সেদিন পাঞ্জাবি পরে দাওয়াতে আসে। আরুশের জন্য একটা গল্পের বই উপহার এনে ওর হাতে দেয়, তারপর বলে, ‘স্কুলের পড়ার পাশাপাশি গল্পের বইও পড়তে হবে, বুঝেছ?’
জাফর হেসে বলে, ‘হ্যাঁ জহির, এটা ঠিক বলেছ। আমাদের সময়টাতে তো আমরা গল্পের বইই বেশি পড়তাম। আহা কী নেশা ছিল।’
জহির উৎসাহের সংগে বলে, ‘আংকেল, আপনাকে আমি ভালো ভালো বই এনে দেব।’
জাফর প্রাণ খুলে হাসেন, তারপর বলেন, ‘নিয়ে এসো। এখন তো রাতে সময় পাই। ছুটির দিনগুলোতেও সারাদিনই বিছানায় গড়াগড়ি। বই পড়ার কথা বলে ভালো করেছ। সময়টা কাজে লাগবে।’
আজ টেবিলে ওরা সবাই একসাথে খেতে বসেছে। দিলশাদ পাশ থেকে একটু পোলাও আর মাংস তুলে দিতে দিতে বলে, ‘তোমার বাবা মা, ভাই বোন কারা কারা আছে? এতদিন পড়াতে আসো জানাই হয়নি।’
জহির পোলাও মুখে দিতে দিতে বলে, ‘আমি এতিমখানায় বড়ো হয়েছি। আমার কেউ নেই আন্টি।’
নওরিন ওর উলটো পাশের চেয়ারে বসে খাচ্ছিল। ও আসা অবধি একবারও সামনে যায়নি। এই এখন খেতে বসার আগে হালকা করে একটু কথা হয়েছে। এখন ওর মুখে এই কথাটুকু শুনে ওর হাত থেমে যায়। জহিরের কেউ নেই! এটা তো জানত না ও। সেভাবে কোনোদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। একটা কষ্ট টের পায় বুকের ভেতর।
দিলশাদ ব্যথিত গলায় বলে, ‘আহারে! কেউ নেই তোমার! একদম একা তুমি?’
জহির হাসে, ‘এই যে আপনারা আছেন। আমি এজন্যই মানুষের সাথে বেশি করে মিশি। এই পৃথিবীর সবাই আমার আপনজন। আমি হয়তো সেভাবে কারও আপনজন হয়ে উঠতে পারব না। কিন্তু অন্যরা সবাই আমার আপন।’
কথাটা বলে নওরিনের দিকে একবার ও তাকায়। মেয়েটার আজ কী হয়েছে? বাসায় আসা অবধি ওর দিকে তাকায়নি তেমন করে। কথাও বলেনি। কেমন যেন একটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো? বাবা মা সামনে তাই এমন?
নওরিনের কেন যেন কান্না পাচ্ছে। ও প্রাণপণ চেষ্টা করে কান্না আটকানোর। একটা সময় সেটা না পেরে ও উঠে দাঁড়ায়। দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ও কোনোমতে বলে, ‘আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি পরে খাব।’
জহির মন খারাপ করে মুখ নিচু করে খেতে থাকে। নওরিন ওর এতিমখানায় বড় হওয়ার কথা শুনে উঠে চলে গেল? যে মেয়েটা এক বুক মায়া নিয়ে সেদিন জ্বরের সময় ওকে দেখতে গেল সেই মেয়েটা এমন হৃদয়হীন হতে পারে? বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু এটাই হয়তো বাস্তবতা। এতিমখানায় বড়ো হওয়া ছেলেকে মায়া করা যায়, কিন্তু ভালোবাসা যায় না।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর