আলো অন্ধকারে পর্ব-১০

0
463

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ১০)

১.
জহির মন দিয়ে “সেলিম আল দীনের নাটক ও চরিত্রের মনস্তত্ত্ব” এর উপর শাহাদৎ রুমনের লেখা একটা বই পড়ছিল। ঠিক এমন সময় কেউ এসে পাশে দাঁড়ায়। মুখ তুলতেই অবাক হয়ে দেখে সেই মেয়েটা।

নওরনি একটা চেয়ার টেনে পাশে বসতে বসতে বলে, ‘কেমন আছেন?’

জহির মাথা নেড়ে বলে, ‘ভালো আছি। আপনার জুতো ভালো আছে তো?’

নওরিন আজ রাগ হয় না, ফিক করে হেসে বলে, ‘আমি ভালো আছি, আমার জুতোও ভালো আছে।’

জহির মাথা নেড়ে বলে, ‘বলুন, আজ কোন কবিতা বুঝিয়ে দিতে হবে।’

নওরিন রহস্যের গলায় বলে, ‘পুরো একটা বই বুঝিয়ে দিতে হবে। আমাকে না, আমার ছোট ভাইকে।’

জহির বুঝতে না পেরে বলে, ‘সেটা কী রকম?’

নওরিন ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘আমার ছোট ভাই এতদিন ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ত। এবারই প্রথম বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ও আমার মতোই বরাবরই বাংলায় খারাপ। ক্লাশ এইটে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষায় ফেল করেছে। আপনি তো টিউশন করান, যদি পড়াতেন।’

জহির জিজ্ঞেস করতে যেয়েও করে না, কেন ইংরেজি মিডিয়াম থেকে বাংলা মিডিয়ামে এল। নিশ্চয়ই আর্থিক কোন একটা ব্যাপার।

ও মাথা নেড়ে বলে, ‘এটা তো সুখবর। আসুন মিষ্টি খাই।’

কথা শেষ করেই পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে। নওরিন এই চকলেটটা দেখেছে, দুই টাকা দাম। ও ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই জহির ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘এই চকলেটটা পকেটে রাখি। খুব ক্ষুধা পেলে মাথা ঘোরায়। আমার বিজ্ঞান বিভাগের বন্ধুরা বলেছে ব্রেনে গ্লুকোজের অভাব হলেই নাকি এমন হয়। তার পর থেকে এই চকলেটটা পকেটে রাখি। নিন, মুখ মিঠা করুন।’

নওরিন একবার চকলেটের দিকে তাকায়, তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘লাগবে না। আচ্ছা, একটা কথা জানার ছিল। ইয়ে মানে আপনি পড়াতে কত করে নেন?’

জহির ওর বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নেয়। চকলেট পকেটে পুরতে পুরতে বলে, ‘শ্রেণিভেদে আমার সম্মানী আলাদা আলাদ হয়।’

নওরিন ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘সেটা কী রকম?’

জহির একটু ঝুঁকে এসে বলে, ‘ধরুন, শিল্পপতি অথবা বড়ো সরকারি কর্মকর্তা যাদের অবস্থান অভিজাত এলাকায়, তাদের জন্য উঁচু দর হাঁকি। আবার মধ্যবিত্তের জন্য আরেকরকম। আর যারা একেবারেই আর্থিকভাবে পিছিয়ে তাদের কাছ থেকে না নেবার চেষ্টা করি। আমি নিজেও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ তাই চাইলেও ওদের সবাইকে ফ্রি তে পড়াতে পারিনা। আপনি যে শ্রেণীতে পড়েন সেভাবেই আমার পড়ানোর সম্মানীটুকু দেবেন।’

নওরিন অস্ফুটে বলে, ‘আমাদেরও খুব বেশি একটা সামর্থ্য নেই। আমি একটা টিউশন পেয়েছি তাই সাহস করলাম আমার ভাই আরুশের জন্য একজন শিক্ষক রাখতে। অন্য বিষয়গুলো আমিই দেখিয়ে দেই। কিন্তু বাংলাতে এসেই গোলমাল হয়ে যায়।’

জহিরের মন খারাপ হয়ে যায়। কিছুটা হয়তো আঁচ করতে পারে কেন ওর ভাইকে হঠাৎ করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ছাড়িয়ে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করাল।

ও গাঢ় গলায় বলে, ‘আপনি ভাববেন না। আমি আপনার সব গোলমাল ঠিক করে দেব।’

নওরিন কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর বিদায় নেবার গলায় বলে, ‘এই যে এটা আমাদের বাসার ঠিকানা। আর এটা আমার ফোন নম্বর। আপনি কাল থেকে আসবেন?’

জহির ওর ফোন নম্বর সেভ করে বলে, ‘হ্যাঁ, কাল বিকেলে আসব। আপনি থাকবেন তো?’

নওরিন মাথা চুলকে অসহায় গলায় বলে, ‘এই রে, ঝামেলা হয়ে গেল। আমার তো কাল টিউশনে যেতে হবে। আচ্ছা আমি আম্মুকে বলে যাব, সমস্যা হবে না।’

কথাটা বলে নওরিনের হঠাৎ করে মনে হয় আম্মুকে তো কিছু বলা হয়নি। ভেবেছিল টিউশনের বেতন পেয়ে তারপর বলবে। নাহ এবার আম্মুকে সব খুলে বলতেই হবে, আর দেরি করা যাবে না।

নওরিন উঠতে উঠতে বলে, ‘আপনি বেরোবেন না?’

জহির হঠাৎ করেই বইটা বন্ধ করে বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো কথা বলেছেন। আমার একটা জায়গায় যেতে হবে, খুব জরুরী। চলুন আমিও নামছি।’

নামতে নামতে নওরিন হালকা গলায় বলে, ‘কোন সমস্যা হয়েছে? বললেন যে খুব জরুরী?’

জহির গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনার আমার জুতোর কুশলী কারিগর নাকি খুব অসুস্থ। যাই দেখে আসি, আর কয়টা টাকা দিয়ে আসি।’

নওরিন অবাক গলায় বলে, ‘আপনি সেই নিমাই মুচীকে দেখতে যাচ্ছেন?’

জহির মাথা নাড়ে, তারপর সাইকেলে উঠে ওর দিকে হাত নেড়ে জোর প্যাডেল চেপে রাস্তায় মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতে থাকে। নওরিন সেই হারিয়ে যাওয়া ভীড়ের ভেতর নীল শার্ট পরা অদ্ভুত ছেলেটাকে খুঁজতে থাকে।

নওরিন বাসায় ফিরতেই দেখে আম্মু মন খারাপ করে জানালার পাশে বসে আছে। আম্মু আগে কত সুন্দর পরিপাটি হয়ে থাকত। এখন গায়ের জামাটা এলোমেলো হয়ে আছে। চুলগুলো ঠিক করে সেট করা নেই। আম্মুকে কখনও ও এলোমেলো দেখেনি। কিন্তু দিন দিন সব আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর্থিক সংগতি ওদের সবকিছু এলোমেলো করে দিল।

আম্মু ওকে দেখতে পেতেই আকুল গলায় বলে, ‘নওরিন, তুই এসেছিস! আচ্ছা, আরুশ যে বাংলায় ফেল করেছে তুই জানিস?’

নওরিন মনে মনে থমকায়। আম্মু জেনে গেছে? ও সামলে নেবার গলায় বলে, ‘আম্মু, এটা কোনো ব্যাপার না। ও তো সবে নতুন একটা স্কুলে এল। আর বাংলায় আমিও দূর্বল ছিলাম তো। তবে তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ওর জন্য একজন বাংলার টিচার ঠিক করেছি। উনি কাল বিকেল থেকে আসবেন।’

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘টিচার রেখেছিস? মাসে তো অনেকগুলো টাকা যাবে।’

নওরিন সান্ত্বনা দেবার গলায় বলে, ‘ওর টিউশনের বেতন আমি দিয়ে দেব।’

দিলশাদ থমকানো গলায় বলে, ‘তুই দিবি কী করে?’

নওরিন এবার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আগে বলো তুমি রাগ করবে না?’

দিলশাদ নরম গলায় বলে, ‘আচ্ছা, রাগ করব না। বল তো এবার।’

নওরিন নিচু গলায় বলে, ‘আম্মু, আমি একটা টিউশন পেয়েছি। আমাদের এই বাসা থেকে কাছেই। কাল বিকেল থেকে পড়াতে যাব। জানো ওরা কত দেবে? বিশ হাজার টাকা!’

দিলশাদ কেমন হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকেন। নওরিন টিউশনি করাবে! ওদের আদরের মেয়ে সংসারের খরচ চালাতে টিউশনি করাতে যাবে? কষ্টে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। যে মেয়েকে এত আদরে এত যত্নে বড়ো করেছেন আজ তাকে এমন জীবন যুদ্ধে নামতে হলো?

চোখ ভিজে আসে। ধরা গলায় বলেন, ‘মাগো, আমাদের ক্ষমা করে দিস। আমাদের জন্য তোকে এমন টিউশনি করতে হচ্ছে।’

নওরিন এবার কৃত্রিম রাগের গলায় বলে, ‘আম্মু, টিউশনি করা খারাপ কিছু না। আমার ইউনিভার্সিটির অনেক ছেলেমেয়েই টিউশনি করে মাস খরচ চালায়। অনেকের চেয়ে আমরা এখনও অনেক ভালো আছি। আসলে এতদিন যে আভিজাত্য আমরা ভোগ করেছি সেখান থেকে এখন এই পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। না হলে কিন্তু কখনোই জীবনটা এমন করে বুঝতে পারতাম না। জানো মা, যেদিন টিউশনটা পেলাম সেদিনই বাবার চাকরি হলো। তুমি খেয়াল করেছ কি-না জানি না, বাবার চোখেমুখে একটা যুদ্ধজয়ের আনন্দ ছিল। আমারও সেদিন আনন্দ হয়েছিল খুব। আরুশের জন্য একজন টিচার রাখতে পারব, এটা খুব স্বস্তি দিয়েছিল। এই যে আমরা পরিবারের সবাই একসাথে যুদ্ধটা করছি তাতে কিন্তু দারুণ একটা তৃপ্তি কাজ করছে। এমন বিপদে না পড়লে কখনও বুঝি এমন করে পরিবারের এই মায়ার বন্ধনগুলো বুঝতেই পারতাম না। ভালোবাসি আম্মু তোমাকে, বাবাকে।’

দিলশাদ আর পারেন না, দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন, ‘আমার সোনা মা, আমার জানসোনা। তুই ঠিক বলেছিস। তোর বাবার মতো মানুষ নিজের সব ইগো বিসর্জন দিয়ে শুধু আমাদের জন্যই চাকরি করছে। ভাবতে পারিস একবার? যে মানুষটা একটা সময় ক্ষমতার টেবিলের যেপাশে মালিকপক্ষ বসে সে পাশে ছিল। আজ সেই মানুষটা শুধু আমাদের জন্যই করজোড়ে টেবিলের অন্যপাশটায় কর্মচারীদের সারিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব কষ্ট হয় তোর বাবার জন্য, তোদের জন্য। কিন্তু সেইসাথে এই ঘটনাগুলো সংসারের হারিয়ে যাওয়া মায়ার নতুন করে সন্ধান দিয়ে যায়।’

অনেকদিন পর একটা চেপে রাখা কষ্ট বের হবার পথ পায়। দিলশাদের মন হালকা হয়ে যায়। জীবনের মায়ার স্বাদ যে এত মধুর সেটা আজকের আগে কখনও এমন করে বোঝা হয়নি।

২.
নেস্ট বায়িং হাউজের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এহতেশামুল হক বিরক্তির সংগে সামনে রাখা একটা কোটেশন পেপারের দিকে তাকিয়ে আছেন।

মুখ তুলে ক্ষিপ্ত গলায় বলেন, ‘জাফর সাহেব, আপনি তো দেখি আমাদের বায়িং হাউজের বিজনেসটা আপনার গার্মেন্টস এর মতো ধ্বংস করে দেবেন। আপনাকে না দুইটা ফ্যাক্টরির নাম বলে দিলাম। ওদের কাছ থেকে এবার টি-শার্ট বানিয়ে নেব। আপনি সেই দু’টো ফ্যাক্টরি বাদ দিয়ে নতুন যে নাম দিয়েছেন তার কোটেশন প্রাইসও তো বেশি।’

জাফর বুঝতে পারছে না ইনি এত ক্ষেপে গেল কেন? ও তো কোম্পানির ভালোর জন্যই এটা করেছে। জাফর বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘স্যার, আপনি যে দু’টো নাম দিয়েছিলেন ওগুলোর কাজের মান অতটা ভালো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি।’

এহতেশামুল মুখ খিঁচিয়ে বলে, ‘আপনি তো সব জানেন। ভাববেন না আপনি এমডি স্যারের কাছের লোক বলে আপনি আমার অর্ডার ভায়োলেট করবেন। যান, এটা ঠিক করে নিয়ে আসুন।’

কথাটা শেষ করে কোটেশন পেপারটা বিরক্তির সাথে ঠেলে দেন।

জাফর একটা রাগ টের পায়। এই লোকটা সেই প্রথম থেকেই ওকে সহ্য করতে পারে না। এই যে এতক্ষণ ধরে রুমে এসেছে একবারও বসতে বলেনি। ইচ্ছে করেই দাঁড় করিয়ে রেখেছে। জীবনে কখনও এমন হয়নি যে কারও সামনে এমন কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়াতে হয়েছে। উলটো সবাই ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। দিন কেমন করে পালটে যায়!

জাফর অপমানটা হজম করে। রাগ করলে যে চলবে না। এই চাকরিটা যে অনেক মূল্যবান এখন।
কাগজটা নিয়ে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে যেয়ে বসে। তারপর ওর টিমের একটা ছেলেকে ডেকে বলে, ‘সুমন, আগের কোটেশনটাই দাও। স্যার তাই চাচ্ছেন।’

সুমন ছেলেটা অনেকদিন ধরেই এই অফিসে আছে। জাফর নামে এই মানুষটাকে ও চেনে। কাজের সূত্রে এর আগে এক দু’বার ওনার গার্মেন্টসে যেতে হয়েছিল। এমন শিল্পপতি একজন মানুষ এখন এখানে চাকরি করছে, এটা ভাবতেই মায়া হয়।

সুমন বিনয়ের সংগে বলে, ‘স্যার, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।’

বিকেলে যখন এমডি এর সাথে মিটিং শুরু হয় তখন তামজিদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এহতেশাম সাহেব, এই ফ্যাক্টরি থেকেই কাজ করাবেন এবার? কোন ঝামেলা নেই তো?’

এহতেশাম তেলতেলে গলায় বলে, ‘না, স্যার কোনো ঝামেলা নেই।’

তানজিম এবার জাফরের দিকে ফিরে বলেন, ‘জাফর ভাই, আপনার কী মত?’

জাফর একবার এহতেশামের দিকে তাকায়, তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘স্যার, এই দুটো ফ্যাক্টরি সবচেয়ে কম প্রাইস কোটেশন করেছে, কিন্তু আমি জানি এদের কাজের মান ভালো না। এর নিচে যে দুটো ফ্যাক্টরি আছে ওরা এক সেন্ট বেশি দিলেও ওদের কাজের মান অনেক ভালো৷ আর আমি চেষ্টা করলে এই এক সেন্টও কমাতে পারব। কারণ ওরা যে ফ্যাক্টরি ওভারহেডের হিসেব দিয়েছে ওখানে ইচ্ছে করলেই কমানো যাবে।’

তানজিম মনোযোগ দিয়ে সবগুলো কোটেশন দেখে, তারপর বলে, ‘আমারও তাই মনে হয়। জাফর ভাই, আপনি ওদের সাথে বসে ওই এক সেন্ট কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। এই দায়িত্ব আমি আপনাকেই দিলাম। ফ্যাক্টরির ফাঁকফোকর আপনিই ভালো জানেন।’

এহতেশামুল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে জাফরের দিকে তাকায়। এই লোকটা ওর সব প্ল্যান ভেস্তে দিল। আগের দু’টো ফ্যাক্টরি ওর আত্মীয়ের ছিল। ওরা ভালো একটা কমিশনও দিত ওকে। এই লোকটার জন্য পারা গেল না।

মিটিং শেষে সবাই চলে গেলে তানজিম অভিযোগের সুরে বলে, ‘জাফর ভাই আপনি আমাকে স্যার কেন বলেন?’

জাফর এবার স্নেহের সুরে বলে, ‘চাকরির পেশাদারিত্বটা আমি মেনে চলি। যে সম্বোধন তোমার শোনা উচিত সেটাই বলি। খুব ভালো কাজ করেছ আজ। প্রথমে যে দুটো ফ্যাক্টরির নাম ছিল, ওদের কাজের মান ভালো না।’

তানজিম হেসে বলে, ‘জাফর ভাই আমি সব জানতাম। আমার কাছে একটা খবর আছে, এই ফ্যাক্টরি দুটো এহতেশামুল হকের আত্মীয়দের। তাই উনি চাচ্ছিলেন ওরা কাজ পাক। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জাফর ভাই। আপনি তখন বলাতে সিদ্ধান্ত নিতে আমার সুবিধা হয়েছে। আপনি থাকলে আমি অনেক ভরসা পাই। কিন্তু আপনাকে যে সম্মান দেওয়ার কথা সেটা আমি দিতে পারছি না। একটা বছর যাক, আপনার স্যালারিটা আমি ঠিকঠাক করে দেব। আপাতত আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনাকে প্রতিমাসে গাড়ির ফুয়েল বাবদ ১৫ হাজার টাকা বাড়তি দেব। আর সেটা আজ থেকেই পাবেন।’

জাফর মৃদু হেসে মাথা নাড়ে। তারপর বিদায় নিয়ে ওর ডেস্কে ফিরে আসতেই দেখে একাউন্টসের ছেলেটা একটা খাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে। খামটা হাতে দিয়ে বলে, ‘স্যার, আপনার এ মাসের ফুয়েল এলাউন্স।’

হঠাৎ করে এতগুলো টাকা হাতে পেয়ে জাফরের মন ভালো হয়ে যায়৷ সেই সাথে একটা কথা ভেবে হেসেও ফেলেন। আগে হলে মাত্র এই ক’টা টাকা পেলে কখনও কি খুশি হতেন? মানুষের চাহিদা তার অবস্থার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, ভাবেন জাফর।

সেদিন বাড়ি ফেরার পথে একবার আড়ঙয়ে ঢোকেন। শাড়ির সেকশনে এসে একটা মসলিন শাড়ি পছন্দ করেন। হালকা পেঁয়াজ কালারের জমিন, পাড়ে গাঢ় খয়েরী কাজ করা। ওর শেষ জন্মদিনে একটা দামী শাড়ি কিনতে যেয়েও পারেননি। আজ এই হঠাৎ করে পাওয়া টাকার পুরোটা দিয়ে শাড়ি কিনে ফেলেন।

বাসায় ফিরতেই দিলশাদ হইচই শুরু করে দেন, ‘এত দাম দিয়ে শাড়ি কিনেছ! ইশ, টাকাগুলো নষ্ট করলে। আমাদের কি আগেরমতো অঢেল টাকা আছে? কবে যে তুমি বুঝবে। এই শাড়ি আমি পরব না। কাল আমি এটার বদলে এই টাকায় আমদের সবার জন্য জামা কাপড় কিনে নিয়ে আসব।’

জাফর দূর্বল গলায় বলার চেষ্টা করেন, ‘এবারের মতো এটা থাকুক না। একবারই তো কিনে দিলাম।’

নওরিনও বাবাকে সমর্থন করার ভঙ্গিতে বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু। এটা দয়া করে ফেরত দিও না। শাড়িটা কী সুন্দর!’

দিলশাদ তবুও গজগজ করতে থাকেন।

রাতে জাফর যখন ঘুমোতে যান তখন অবাক চোখে দেখেন দিলশাদ নতুন শাড়িটা পরে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে বলে, ‘দেখো তো কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?’

বহুদিন পর আগের সেই দিলশাদকে যেন ফিরে পান। সেই আভিজাত্য, পরিপাটি একজন মানুষ। ও কাছে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলেন, ‘খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।’

দিলশাদ ওর বুকে মুখ গুঁজে বলে, ‘তুমি এমন পাগলামো করো। ছেলে মেয়ের জন্য কিছু না এনে আমার জন্য নিয়ে এলে। এটা কিছু হলো।’

জাফর ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘ওদের জন্য আগামী মাসে নিয়ে আসব। হঠাৎ করেই কিছু টাকা বাড়তি পেলাম, তাই নিয়ে এলাম।’

দিলশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখন ইচ্ছে করলেই একবারে সবার জন্য ভালো কিছু কেনা যায় না।

দিলশাদ সে রাতে জাফরের বুকের ভেতর মুখ রেখে ঘুমিয়ে থাকেন। একটা কথা হঠাৎ করেই মনে হয়, এই যে জাফর হঠাৎ করে ওর জন্য একটা শাড়ি নিয়ে এল তাতে যে সুখটা পেলেন সেই সুখ আগে কখনও পাননি। দামি শাড়ি আগেও পরেছেন কিন্তু এমন করে ভালো কখনোই লাগেনি।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে