#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ৯)
১.
বিলকিস ম্যাডাম অস্টম শ্রেণির ক্লাশে ঢুকেই হুংকার ছাড়েন, ‘ Boys, no talk in bangla in my class.’
অষ্টম শ্রেণির এই শাখাটা ইংরেজি ভার্সন ছাত্রদের জন্য। বিলকিস ম্যাডাম সাইন্স পড়ান। খুব কড়া শিক্ষক। ওনাকে দেখলেই আরুশের ভয় লাগে। অবশ্য শুধু ওনাকে না, এই স্কুলের সব শিক্ষকরা যেন কেমন। কথায় কথায় ধমক দেন। অথচ আগের স্কুলে এমন ছিল না। আরুশ তাই ইচ্ছে করে পেছনের বেঞ্চে বসে। সেই নিলয় নামের যে দুষ্ট ছেলেটা ভর্তি পরীক্ষার সময় ওকে পটলা বলেছিল, ওরও এই স্কুলে ভর্তির সুযোগ হয়েছে। ওর সাথেই বেশি খাতির আরুশের। একসাথে দু’জনে পেছনের বেঞ্চে বসে। আজও বসেছিল।
বিলকিস ম্যাডামের হুংকার শুনে নিলয় দুষ্ট হাসি হেসে মুখ ভেংচে বলে, ‘নো বাংলা টক টক।’
ওর বলার ভঙ্গিতে আরুশ হেসে ফেলে। আর তখনই বিপত্তিটা হয়।
বিলকিস ম্যাডাম কড়া চোখে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলেন, ‘You, why laugh? Tell me in English.’
গত কয়েক মাসে এই প্রথম ম্যাডাম ওকে দাঁড় করাল। আরুশ একটা ঢোঁক গিলে দাঁড়ায়, তারপর আমেরিকান একসেন্টে বলে, ‘Nothing serious, madam. We are discussing the cartoon we watched last night.’
বিলকিস ম্যাডাম থমকান। ক্লাশের সবাই ওর দিকে ঘুরে তাকায়। ম্যাডাম কাছে এসে সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, তারপর গম্ভীরমুখে বলেন, ‘Your English is better. Sit down and be attentive in the class.’
আরুশ বসে পড়ে। ম্যাডাম টেবিলে ফিরে যেয়ে ক্লাশ শুরু করেন। নিলয় হিহি করে হেসে বলে, ‘একদম থোতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেছে। তুই এত ভালো ইংরেজি কোথায় শিখলি?’
আরুশের হঠাৎ করেই আগের স্কুলের কথা মনে পড়ে যায়। ওখানে মিসরা খুব আদর করত। আর ওনাদের ইংরেজি উচ্চারণও খুব সুন্দর ছিল। আরুশের তাই এখানে এসে সব সোজাই লাগে। কিন্তু বাংলা ক্লাশ এলেই সব কেমন গোলমেলে হয়ে যায়। আজ সকালেই বাংলা পরীক্ষার খাতা দিয়েছে। আর যথারীতি ও ফেল করেছে। সেই তখন থেকেই ওর মন খারাপ। আম্মুকে কথাটা বলবে কী করে?
সেদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই আরুশ বাংলা নিয়ে পড়তে বসে। কিন্তু অনেকগুলো শব্দের অর্থ ও বোঝেই না। এই যে কবিতাটা –
“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে”
এটার মানে কী? ধানসিঁড়, শঙ্খচিল, কার্তিক, নবান্ন – কোনটাই ও বোঝে না। অসহায় চোখে আপাত এই কঠিন কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকে।
এমন সময় নওরিন পেছন থেকে ওকে এমন হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকতে দেখে বলে, ‘এই আরুশ, কী হয়েছে রে? বাংলা বই বের করে বসে আছিস কেন?’
আরুশ একবার দরজার দিকে তাকায়, কেউ নেই। ও নওরিনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘আপু, আমি হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় বাংলায় ফেল করেছি।’
নওরিন চমকে বলে, ‘কীহ! বাংলায় ফেল করেছিস?’
আরুশ মাথা নিচু করে থাকে। নওরিন ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ‘আম্মু জানে?’
আরুশ মাথা নাড়ে, ‘বলিনি আম্মুকে।’
নওরিন চিন্তিত গলায় বলে, ‘বাংলা তোর জন্য কঠিন হবে এটা ঠিক আছে। তুই পড়েছিস ইংরেজি মিডিয়ামে। আমারও খুব ঝামেলা হতো বাংলা নিয়ে। মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতাম। কিন্তু তাই বলে ফেল করিনি কখনও। তুই তো একদম গাড্ডায় গেছিস। আচ্ছা, আমি যতটুকু পারি দেখিয়ে দেব। দেখি কী পড়ছিস, নিয়ে আয়।’
আরুশ এবার আগ্রহের সংগে বাংলা বইটা নিয়ে আসে। তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপু, এই পয়েমটা বুঝতে পারছি না। ধানসিঁড়ি মিনিং কী?’
নওরিন চোখমুখ কুঁচকে বলে, ‘ধান মানে রাইস আর সিঁড়ি মানে স্টেয়ার। বুঝেছিস?’
আরুশ চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছ এটা হলো a stair of rice? বাংলা এই poet এর এমন অদ্ভুত ইচ্ছে হয় কেন?’
নওরিনের হঠাৎ করেই সেই বাংলায় পড়া ছেলেটার কথা মনে পড়ে যায়। ওই ছেলেটাও অদ্ভুত ছিল। আচ্ছা, আরুশের জন্য ওকে রাখা যায়? ও তো টিউশন করায়। কিন্তু ওকে রাখতে গেলে বাড়তি যে টাকাটা লাগবে সেটা নেই। নওরিন ভেবেছিল খুব সহজেই টিউশন পেয়ে যাবে, কিন্তু এখনও তেমন কোনো ব্যবস্থা হয়নি। নাহ, একটা টিউশন যোগাড় করতেই হবে। আর সেই টাকা দিয়ে জহির ছেলেটাকে আরুশের জন্য রাখতে হবে।
কথাটা মনে হতেই নওরিনের আফসোস হয়, ছেলেটার ফোন নম্বর রাখা হয়নি। অবশ্য বাংলা ডিপার্টমেন্টে গেলেই খুঁজে বের করা যাবে। বলেছিল তো সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। অবশ্য আরেকটা জায়গায় সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। নওরিন প্রায়ই লাইব্রেরিতে যায় বই তুলতে। মাঝে মাঝে ওখানে বসে পড়ে। ও খেয়াল করেছে জহির লাইব্রেরির দক্ষিন পাশটায় একটা নির্দিষ্ট টেবিলে প্রায়ই বসে বসে কী যেন পড়ে। নওরিন ইচ্ছে করেই এতদিন কাছে যায়নি। দেখা যাবে আবার আলাপ জুড়ে দেবে। কিন্তু এখন তো বিপদ। আরুশ যেমন করে ফেল করল মা জানলে ভীষণ কষ্ট পাবে।
পরদিন ইউনিভার্সিটি যেয়ে নওরিন ক্লাশ শেষে সরাসরি লাইব্রেরিতে চলে আসে। এখন দুপুরের খাবারের সময়। ভেতরটা তাই ফাঁকা। নওরিন একটু খুঁজতেই জহিরকে পেয়ে যায়। সেই জানালার পাশে চেয়ারে বসে আছে। জানালা দিয়ে ঝুঁকে বাইরে কী যেন দেখছে।
নওরিন কাছে গিয়ে ছোট করে একটা কাশি দেয়। জহির ঘুরে তাকিয়ে অবাক গলায় বলে, ‘আরে, আপনি। আপনার জুতো ভালো আছে তো? ওটা আর ছিঁড়ে যায়নি তো?’
নওরিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মানুষ কাউকে সে কেমন আছে সেটা জিজ্ঞেস না করে জুতোর কথা জানতে চাইতে পারে? অবিশ্বাস্য।
ও একটা চেয়ার টেনে বসে। তারপর ডান পা মেলে দিয়ে বলে, ‘আপনার মুচী আসলেই কুশলী। একদম ঠিকঠাক আছে।’
জহির দাঁত বের করে হাসে, ‘খুব টেনশনে ছিলাম। অত বড়ো মুখ করে নিমাই দাদার কাছে নিয়ে গেলাম আর যদি জুতো ছিঁড়ে যেত তাতে যে ভারী নিন্দে হতো।’
নওরিন ওর কথা বলার ধরণ দেখে হাসে। তারপর বলে, ‘আপনি প্রায়ই এই সিটটায় বসে থাকেন কেন?’
জহির চোখ কুঁচকে বলে, ‘আপনি খেয়াল করেছেন? কই আমি তো আপনাকে দেখিনি।’
নওরিন হেসে বলে, ‘আমিই ইচ্ছে করে আসিনি। আপনি যেমন ধ্যানীর মতো বসে থাকেন, আপনার ধ্যানভঙ্গ করলে দেখা যাবে মুনি ঋষিদের মতো অভিশাপ দিয়ে দেবেন।’
জহির চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘আপনি আবার এসব জানেন নাকি? যেমন বিদেশীদের মত বাংলা বলেন দেখে মনে হয় আপনি এগুলো জানেন না।’
নওরিন লাজুক হেসে বলে, ‘আসলে জানিনা, মুখস্ত বলি। আচ্ছা বলুন তো আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই ধানসিঁড়ি মানে কী? ধানের সিঁড়ি? সিঁড়িতে ধান বিছিয়ে রাখা?’
জহির হো হো করে হেসে ওঠে। তাতে করে আশেপাশের গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে যারা ছিল তারা ফিরে তাকায়। এমন মজার কথা এর আগে কখনও শোনেনি ও।
জহির এবার নিচু শব্দে হাসতে থাকে। কিছুতেই হাসি থামে না। আর এদিকে নওরিনের ফর্সা গালটা লাল হতে থাকে। সেই সাথে রাগ লাগতে থাকে। ইশ, কেন যে এই ছেলেকে এটা জিজ্ঞেস করতে গেল। এখন পন্ডিতি ফলাবে।
জহির হাসি থামিয়ে একবার জানালা দিয়ে নিচে তাকায়, তারপর ওর দিকে ফিরে বলে, ‘এই সিটটায় বসলে আমার নিচে রাখা সাইকেলটা দেখতে সুবিধা হয়। চোরে নেবে না, তাও একটু পর পর চেয়ে দেখি। এই সাইকেল আমার কাছে মহামূল্যবান।’
নওরিন মাথা নাড়ে, ‘আচ্ছা এবার বুঝেছি কেন এই একটা কোণে আপনি প্রতিদিন বসেন।’
তারপর সংকোচ নিয়ে বলে, ‘কবিতার লাইনটা বুঝিয়ে দেবেন না?’
জহিরের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে, তারপর বলে, ‘এটার মানে জেনে আপনি কী করবেন? পরীক্ষায় তো আসবে না।’
নওরিনের রাগ উঠে যায়, ঝাঁঝালো গলায় বলে, ‘সামান্য একটা লাইন জানতে চাইলাম আর আপনি এত পেঁচাচ্ছেন। নাহ, আমারই ভুল হয়েছে আপনাকে জিজ্ঞেস করা।’
কথাটা বলে ও উঠে যেতে নিতেই জহির নরম গলায় বলে, ‘ধানসিঁড়ি হলো একটা নদীর নাম, ঝালকাঠি জেলায় অবস্থিত। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর বিখ্যাত রূপসী বাংলা কবিতায় এই নদীটির কথা বলেছেন। ধানসিঁড়ি নদী প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীক। তাই কবি বার বার এই নদীর তীরে ফিরে আসতে চেয়েছেন।’
নওরিন মনের অজান্তে কখন বসে পড়েছে ও নিজেও জানে না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো জহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। জহির এখন যেন কোন সুদূরে হারিয়ে গেছে। গলায় আবেগ নিয়ে পুরো কবিতাটা আবৃত্তি করে যায়। আর ফাঁকে ফাঁকে ওকে বুঝিয়ে দেয়। নওরিনের হঠাৎ করেই মনে হয় ও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ধানসিঁড়ি নদীর তীরে, অথবা শঙ্খচিল হয়ে, অথবা শালিক হয়ে। এত মায়া থাকতে পারে কবিতায়!
২.
‘তুমি এর আগে কখনও ‘ও লেভেলে’ পড়িয়েছ?’, জিজ্ঞাসু গলায় বলেন ইফতেখার আহমেদ। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার।
নওরিন দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘না, এটাই প্রথম।’
ইফতেখার হতাশ গলায় বলেন, ‘কিন্তু আমি তো একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক চেয়েছিলাম। আর ইচ্ছে করলেও ‘ও লেভেলের’ ম্যাথগুলো করানো যায় না। যারা স্কুল, কলেজ দুটোই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে তারাই ভালো পারে। তুমি স্কুল, কলেজে কোথায় পড়েছ?’
নওরিন নিচু গলায় ওর স্কুল আর কলেজের নাম বলতেই ইফতেখার আহমেদ চমকে তাকান। মুখ দিয়ে বিস্ময় ধ্বনি বের হয়ে আসে। চোখের চশমা খুলে অবাক গলায় বলেন, ‘কী বললে! তুমি এমন বিখ্যাত স্কুল, কলেজে পড়েছ?’
নওরিনের কেন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। ওর স্কুল, কলেজের নাম শুনে অনেকেই চমকায়।
ইফতেখার আন্তরিক গলায় বলেন, ‘খুব খুশি হলাম শুনে। তুমি খুবই ব্রাইট একটা মেয়ে। তুমি আমার মেয়েকে পড়ালে আমি খুব খুশি হব। ম্যাথের পাশাপাশি আরেকটা সাবজেক্টও যদি পড়াতে খুব ভালো হতো। টাকা নিও ভেব না, আমি তোমাকে বিশ হাজার টাকা দেব।’
নওরিন মনে মনে চমকে ওঠে। ক’দিন আগেই এই এলাকার দেয়ালে কয়েকটা ‘পড়াতে চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে এমন করে পেয়ে যাবে ভাবেনি। আর এতগুলো টাকা দেবে এরা এটা কল্পনাতীত। এখন আরুশের জন্য একটা বাংলা শিক্ষক রাখা যাবে। এতদিন টাকার জন্যই জহিরকে পড়াতে বলেনি। আম্মুকে একটা রান্নার বুয়া রেখে দিতে হবে। এক লহমায় ও অনেককিছু ভেবে ফেলে। পরিবারের জন্য একটা কিছু করতে পারার আনন্দ ওর চোখেমুখে ফুটে ওঠে।
নওরিন কৃতজ্ঞ গলায় বলে, ‘থ্যাংকিউ আংকেল। আমি কাল থেকে পড়াতে আসব।’
নওরিন উঠে দাঁড়াতেই ইফতেখার কৌতুহলী গলায় বলেন, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
নওরিন থমকায়, সম্মতির গলায় বলে, ‘জ্বি বলুন।’
ইফতেখার আহমেদ কপাল কুঁচকে বলেন, ‘তুমি যে স্কুল কলেজের নাম বললে সেসব জায়গায় পড়তে অনেক টাকা লাগে। আর যারা ওখানে পড়ে তারা আর্থিকভাবে বেশ ভালোরকম সচ্ছল হয়। আমি ধরেই নিচ্ছি তোমার পরিবার সচ্ছল। তাহলে তুমি টিউশন করতে চাচ্ছ কেন?’
নওরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘হ্যাঁ আংকেল, আপনি ঠিক ধরেছেন। একটা সময় আমাদের সব ছিল। একটা অসম্ভব দূর্ঘটনা আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। তাই সব আর আগেরমতো নেই। তাই টিউশন করতে আসা। আমি কাল বিকেলে আসব।’
কথাটা বলে ও আর দাঁড়ায় না। চলে যায়। ইফতেখার আহমেদ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকেন। এমনও হতে পারে মানুষের!
নওরিনের মন খারাপ লাগছে। একটা সময় কতটা বিত্ত বৈভবে বড়ো হয়েছে। আর আজ টিউশনের জন্য মানুষের দ্বারে দাঁড়াতে হচ্ছে। জীবন কতটা কঠিন এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
বাসায় ফিরতেই দেখে বাবা আর আরুশ ড্রয়িং রুমে বসে আছে। টেবিলে মিষ্টির প্যাকেট। আজ কোনো বিশেষ দিন? ও জিজ্ঞাসু গলায় মাকে মিষ্টির কথা জিজ্ঞেস করতেই দিলশাদ ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর। আমার কথা তো শুনবে না।’
নওরিন বাবার পাশে যেয়ে বসে। বাবার মুখটা এখন দুষ্টুমি করে ধরা পড়ে যাওয়া বাচ্চার মতো। বাবা আবার কী করল?
নওরিন ফিসফিস করে বলে, ‘বাবা, মিষ্টি এনেছ কেন?’
জাফর খান একবার দিলশাদকে দেখে নেয়। তারপর ওর দিকে ঘুরে নিচু গলায় বলে, ‘আমার একটা নতুন চাকরি হয়েছে। ভালো বেতন দেবে। আমাদের আর টানাটানি থাকবে না।’
বাবার চোখেমুখে একটা উচ্ছ্বাস। নওরিন টের পায় কোথায় যেন একটা কষ্ট হচ্ছে। বাবা চাকরি করবে! এখন বুঝতে পারে আম্মু কেন মন খারাপ করে আছে।
নওরিন বাবার হাতটা ধরে বলে, ‘বাবা, আর ক’টা দিন পরে চাকরি করতে। তোমার শরীর তো এখনও ভালো না।’
দিলশাদ এবার উঁচু গলায় বলে, ‘আমিও সে কথাই বলছিলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা।’
জাফর মিনমিন গলায় বলে, ‘খুব একটা ঝক্কির চাকরি না। তানজিমের অফিসেই বসতে হবে। ওদের আমার অভিজ্ঞতাটা দরকার। আমি বেছে দেব কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে ভালো মানের প্রোডাক্ট পাওয়া যাবে। আর ওগুলোর তদারিকও আমিই করব। ছেলেটা খুব ভালো, এখনও আমাকে সম্মান করেই কথা বলে। আর একটা ব্যাপার, আমি বাসায় বসে থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যাব। কাজের মধ্যে থাকলে বরং ভালো থাকব।’
এটা অবশ্য ঠিক কথা বলেছে জাফর। বেতনটা যদিও আগেরকার সময়ের সাথে তুলনা করলে কিছুই না। তবে এখনকার জন্য অনেক। মাসে সত্তুর হাজার টাকা দেবে ওরা। এই টাকাট যে কী সাহায্য হবে! না হলে গাড়িটা বিক্রি করে দিতে হতো। গাড়িটা থাকলে একটু হলেও ভরসা পান।
দিলশাদ এবার পাশে যেয়ে বসেন, তারপর নরম গলায় বলে, ‘তুমি যদি মনে করো ভালো থাকবে তাহলে যাও, আমি না করব না। তুমি সুস্থ থাকলেই আমরা খুশি। এত বড়ো একটা বিপদ গেল কাছের কেউই এগিয়ে আসেনি। অথচ একটা সময় সবাই কোনো না কোনো ছুতোয় সাহায্য নিয়েছে। মানুষের কাছে শেষ পর্যন্ত টাকাই সব।’
জাফর ওর হাতের উপর আলতো করে চাপ দিয়ে বলেন, ‘এগুলো নিয়ে মন খারাপ কোরো না। আসলে একেকজনের যুদ্ধ একেকরকম। আমাদের যুদ্ধটা আমরা সবাই মিলে লড়ে জীবনযুদ্ধে জিতে যাব।’
নওরিনের ভীষণ ইচ্ছে করে ওর নতুন টিউশন পাবার কথাটা বলে। জীবন যুদ্ধে আম্মু বাবার সাথে ও-ও যে দাঁড়িয়েছে সেটা বলে।
কিন্তু বাবার জন্য এমনিতেই আম্মুর মন খারাপ। ওর টিউশনি পাবার কথা শুনলে হয়তো আরও মন খারাপ হবে। তার চেয়ে একেবারে মাস শেষে আম্মুর হাতে টাকা দিয়ে তারপর বলবে। দৃশ্যটা ভাবতেই ওর কেমন যেন লাগে।
আচ্ছা, ওই জহির ছেলেটাকে বাংলা পড়াতে বললে পড়াবে তো? কী সুন্দর করে সেদিন কবিতা পড়ছিল!
সেদিন রাতে নওরিন ঘুমিয়ে যাবার আগে জীবনানন্দের কবিতাটা আবার পড়ে। ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখে ও খুব সুন্দর একটা নদীর পাড়ে চুল খুলে শাড়ি পরে বসে আছে। একটা শঙ্খচিল উড়ে উড়ে ওকে চক্কর কাটছে। ও হাত বাড়াতেই পাখিটা হাতে এসে বসে। আর পাখিটার মুখ কেমন করে যেন সেই জহির ছেলেটার মুখের মতো হয়ে যায়।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর