#আলো অন্ধকারে (পর্ব ৮)
১.
গোলাম দস্তগীর স্যার প্রিন্সিপাল অফ মার্কেটিং কোর্সের ক্লাশ নিচ্ছিলেন। নওরিন মনোযোগ দিয়ে নোট নিচ্ছিল। ঠিক এমন সময় পেছন থেকে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো ওর সামনে এসে পড়ে। এখানে ভর্তি হবার পর থেকেই কেন যেন ছেলেরা ওর পিছু নিয়েছে। সবাই প্রেম করতে চায়। এমন কি সিনিয়র ভাইয়ারাও যেচে এসে কথা বলে। তাতে করে ক্লাশের মেয়েরা উলটো ওর শত্রু হয়ে গেছে। ও খেয়াল করে দেখেছে বেশিরভাগ মেয়ে ওকে সহ্য করতে পারে না। কাছের বন্ধু বলতে এখন পর্যন্ত একজনই। রেণু নাম মেয়েটার। ও খুব আফসোস করে, ইশ, তোর মতো যদি গায়ের রঙ আমার থাকত। বেচারি ওর গায়ের রঙ নিয়ে খুব চিন্তিত থাকে। বলে আমার তো চেহারা সুন্দর না আবার গরীব, আমার কোনোদিন বিয়েই হবে না। সেদিন নওরিন কষে ধমক দিয়েছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে সেটাই বুঝিয়েছিল ওকে।
পেছন থেকে এবার আরেকটা ছোট্ট কাগজের টুকরো এসে পড়ে। নওরিন এবার কাগজের টুকরো দুটো নিয়ে খোলে। একটাতে লেখা ‘হেই মুডি, কেন এত রুডি?’
আরেকটাতে লেখা, ‘হেই ক্লিওপেট্রা, একটু সময় দেবে এক্সট্রা?’
মাসখানেক ধরে এই নামগুলোতেই ওকে ডাকে ছেলেগুলো। মুডি অথবা ক্লিওপেট্রা। সত্যি বলতে ওর কারও সাথে কথা বলতেই ভালো লাগে না। বিশেষ করে ছেলেদের সাথে। আহনাফের সাথে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তার পরে ও হয়তো আর কারও সাথে সহজ হতে পারবে না। বিশেষ করে ছেলেদের সাথে। কিন্তু তাতে করে যে ও দিন দিন বড্ড একাকী হয়ে যাচ্ছে। ওরও ইচ্ছে হয় ক্লাশের সবার সাথে মজা করতে। সহজ একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
আচ্ছা, এদের এই দুষ্টুমিগুলো ও সিরিয়াসলি না নিলেই তো হয়। ওরা যেমন মজা করছে ও-ও তেমন মজা করবে। কী মনে হতে ও চিরকুটগুলোর পেছনে নীল বলপেন দিয়ে উত্তর লিখে।
‘হাতের লেখা জঘন্য, আগে হ্যান্ড রাইটিং ঠিক করো।’
দুটো চিরকুটেই একই লেখা লিখে। তারপর একবার সামনে ডায়াসে স্যারের দিকে তাকায়। স্যার এখন বোর্ডে লিখছেন। নওরিন পেছন দিকে না ঘুরে চিরকুট দুটো উল্টো দিকে ছুড়ে মারে। পেছন থেকে একটা বিস্ময় ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। তাতে করে গোলাম দস্তগীর স্যার পর্যন্ত ঘুরে তাকান, গম্ভীরমুখে বলেন, ‘এনি প্রবলেম?’
পুরো ক্লাশ চুপ, কারও মুখে কোনো কথা নেই। শুধু পেছনের ছেলেগুলো মিটিমিটি হাসছে। স্যার ঘুরে আবার পড়াতে শুরু করতেই পেছন থেকে ফিসফাস শোনা যায়।
ক্লাশ শেষে স্যার বেরিয়ে যেতেই পেছন থেকে একটা কোরাস শোনা যায়, ‘আমার লাইন হইয়া যায় আঁকা বাঁকা, ভালো না হাতের লেখা, আসো যদি মধুর ক্যান্টিনে আবার হবে দেখা গো বন্ধু, আবার হবে দেখা।’
নওরিন পেছনে ফিরে ওদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। এমন অদ্ভুত গান ও জীবনে প্রথম শুনল। এবার ছেলেগুলোও হেসে ফেলে। ওরা কাছে এসে যার যার নাম বলে৷ তমাল, সেলিম, রনি। তারপর আবদারের গলায় বলে, ‘আজ থেকে তুই আমাদের বন্ধু। ঠিক আছে?’
নওরিনের কেন যেন খুব ভালো লাগে। ও হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, বন্ধু তো। কিন্তু তোমরা যা দুষ্ট!’
ওরা হা হা করে হাসে। তারপর তমাল ছেলেটা বলে, ‘বন্ধুকে তুমি না, তুই বলতে হয়। আচ্ছা, আজ আমরা ক্লাশে শেষে এটা সেলিব্রেট করব। টিএসসিতে যেয়ে লাঞ্চ করব।’
নওরিন মাথা নেড়ে সায় দেয়।
ক্লাশের অন্য মেয়েরা অবাক হয়ে আজকের কান্ডটা দেখছিল। এই মেয়ে এই ক’টা মাস কথাই বলেনি। আজ একদম ঢলে ঢলে পড়ছে। তাও ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটার সাথে।
রেণু কাছে এসে মিটিমিটি হাসে, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘দারুণ কাজ করেছিস আজ। বাঁদরগুলোকে কী সুন্দর ঠিক করে ফেললি!’
নওরিন হাসে, ‘হঠাৎ করেই মনে হলো ওরা যা করে আমিও তাই করব ওদের সাথে।’
রেণু ওকে সমর্থন দেবার গলায় বলে, ‘একদম ঠিক করেছিস।’
সেদিন সবগুলো ক্লাশ শেষে তমাল ওরা এসে আবদার ধরে, ‘চল, টিএসসি যাই। খেয়ে দেয়ে আড্ডা দেব।’
নওরিন বেজার গলায় বলে, ‘আজ একটু বাসায় যেতে হবে। কাল খাব, ঠিক আছে? তোরা এই ফাঁকে হাতের লেখা প্রাকটিস কর।’
ওরা আরেকদফা হাসে। নওরিনও হাসে। কেন যেন আজ অনেকদিন পর একটু মন খুলে হাসল। ওদের সেই বাড়িটা ছেড়ে আসার পর এই ছোট্ট বাসায় ভীষণ অসুবিধে হচ্ছিল সবার। বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। আম্মু কোনো অভিযোগ না করলেও নওরিন বুঝতে পারে কষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে চারদিকে একটা দমবন্ধ অবস্থা।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নওরিন এবার হাঁটতে থাকে। ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে হাঁটতে ভালোই লাগে ওর। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি। ঠিক এমন সময় একটা “ট্রিং ট্রিং” আওয়াজ পেতেই ও ঘুরে তাকায়, চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় ওর। একটা সাইকেল হুড়মুড় করে ওর গায়ে পড়ল বলে। তড়িৎবেগে লাফ দিয়ে পাশে সরে যেতেই ছেলেটা সাইকেলসমেত পড়ে যায়। আশপাশ থেকে একটা হাসির রোল ওঠে।
সাইকেল চালানো ছেলেটা একটা বিরক্তির শব্দ করে। টেনে সাইকেলটা তুলে দাঁড় করায়। তারপর ওর সামনে এসে চোখমুখ কুঁচকে বলে, ‘আপনার লাগেনি তো?’
নওরিন ছেলেটার দিকে তাকায়, লম্বাটে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুলগুলো হয়তো এখনই এলোমেলো হলো। পরনের কালো প্যান্টে ধুলো লেগে আছে।
নওরিন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, ‘না, আমি ঠিক আছি।’
ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ঠিক নেই তো। আপনার ডান পায়ের জুতোর ফিতে ছিঁড়ে গেছে।’
নওরিন চমকে এবার পায়ের সাদা রঙের জুতোটার দিকে তাকায়। আরে তাই তো, এটার তো ফিতে ছিঁড়ে গেছে। হায় হায়, এখন হাঁটবে কী করে!
ছেলেটা ওর মুখের অসহায়ত্বটা টের পায়।
গম্ভীরমুখে বলে, ‘জুতো খুলে ফেলুন। সামনেই একজন কুশলী মুচী আছেন, খুব ভালো সেলাই করেন।’
নওরিন অবাক গলায় বলে, ‘জুতো খুলে খালি পায়ে যাব কী করে?’
ছেলেটা এবার একটা রিক্সা দাঁড় করায়, তারপর বলে, ‘নিন, জুতো হাতে নিয়ে উঠে পড়ুন। আমার সাইকেল অনুসরণ করে পিছু পিছু আসতে থাকুন।’
নওরিন অসহায় চোখে ওর ছেঁড়া জুতোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সব দ্বিধা ঝেড়ে জুতো হাতে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসে। তাও ভালো ছেলেটা ওর সাইকেলে উঠে বসতে বলেনি। কিন্তু ছেলেটা অমন বইয়ের ভাষায় কথা বলছে কেন, অনুসরণ করে?
নীল সাদা চেক শার্ট পরা ছেলেটা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সাইকেল চালাচ্ছে আর একটু পর পর ফিরে দেখছে ও ঠিকঠাক আসছে কি-না।
অল্প কিছুদূর এগোতেই সাইকেলটা থামে। রিক্সাওয়ালাকে থামতে বলে ও ভাড়া বের করে। তারপর খালি পায়ে জুতো হাতে নেমে দাঁড়ায়। কেমন অদ্ভুত লাগছে।
একজন ছোটোখাটো বয়স্ক মানুষ রঙ চটে যাওয়া সবুজ শার্ট পরে ধ্যানীর মতো একটা জুতো পালিশ করছিল। লোকটার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা উঁচু গলায় বলে, ‘নিমাই দাদা, এক জোড়া ভালো স্যান্ডেল দাও। আর ওনার ছিঁড়ে যাওয়া জুতোটা ভালো করে সেলাই করে দাও যাতে কিছু বোঝা না যায়।’
মুচী লোকটা মুখ তুলে তাকিয়ে হাসে। তারপর এক জোড়া হলুদ রঙের স্যান্ডেল এগিয়ে দেয়। নওরিন নাক কুঁচকে একবার দেখে। ইশ! কেমন ময়লা জুতোটা। কিন্তু আর কোনো উপায়ও নেই। ও জুতোটা দিয়ে স্যান্ডেল পায়ে দাঁড়ায়। তখন হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, জীবনে কখনও ও ভাবেনি জুতো ছিঁড়ে গেলে সেটা আবার সেলাই করে পরবে। তাও রাস্তার মুচীর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। একটা সংকোচ ঘিরে ধরে ওকে।
ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই ছায়ার নিচে এসে দাঁড়ান। ওর সময় লাগবে। কিন্তু এমন করে সেলাই করে দেবে যে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না এটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। এই যে দেখেন আমার এই পাদুকা জোড়া। কম করে চার বার নানান জায়গায় সেলানো হয়েছে, বোঝা যায়?’
নওরিন ছেলেটার বাড়িয়ে দেওয়া পায়ের দিকে তাকায়। বাটা কোম্পানির সেই আদি ডিজাইনের লালচে খয়েরী স্যান্ডেল। বার বার পালিশ করাতে আগের রঙটা নেই। পরিবর্তে একটা ক্যাটকেটে রঙ। তবে এটা সত্যি, কোথাও সেলাইয়ের চিহ্ন নেই।
নওরিন এবার সরে এসে গাছের ছায়ায় দাঁড়ায়। বেশ ভালো গরম পড়েছে। ও মুখ মুছে বলে, ‘হ্যাঁ, তাই তো। একদমই বোঝা যায় না। আচ্ছা, এই সাইকেলটা আপনার?’
ছেলেটা এবার মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আমার। কেন বলুন তো?’
নওরিন একটু সংকোচ নিয়ে বলে, ‘ক্যাম্পাসে কেউ এমন সাইকেল চালিয়ে ঘুরে আমার ধারণা ছিল না। আপনি কি স্টুডেন্ট?’
ছেলেটা বিস্মিত গলায় বলে, ‘হ্যাঁ! আমি বাংলা বিভাগে পড়ি, দ্বিতীয় বর্ষ। আমার নাম জহির রায়হান। আর সাইকেল থাকলে খুব সুবিধে। পরিবেশ বান্ধব বাহন। এই দ্বিচক্রযানে চড়ে আমি পুরো ঢাকা শহর চক্কর কেটে বেড়াই।’
নওরিন বুঝদারের মতো মাথা নাড়ে, ‘এজন্যই বুঝি তখন কুশলী মুচী শব্দ ব্যবহার করেছেন। আর স্যান্ডেলকে পাদুকা বলছেন।’
জহির এবার হো হো করে হাসে। তারপর বলে, ‘আপনাকে উচ্চারণ শুনে কেমন বিদেশি বিদেশি মনে হচ্ছিল। তাই ইচ্ছে করেই কঠিন বাংলা শব্দগুলো বলছিলাম। আপনার নাম কী? কোন ডিপার্টমেন্ট?’
নওরিন সপ্রতিভ গলায় বলে, ‘আমি নওরিন। আইবিএ তে, ফার্স্ট সেমিস্টার।’
জহির চোখ গোল গোল করে বলে, ‘আপনি তো তাহলে দারুণ মেধাসম্পন্ন মানুষ। আপনার পাদুকা সেবা করতে পেরে আমি ধন্য।’
নওরিন হাসতে যেয়েও থেমে যায়। তারপর মুখ গম্ভীর করে জুতো সেলাই দেখতে থাকে।
জহির একটু থমকায়। মেয়েটা কিছু মনে করল?
একটু পর ও সাইকেলের স্ট্যান্ড উঠিয়ে বলে, ‘আমার একটা টিউশনি আছে। আপনি জুতো সেলাই হয়ে গেলে ওকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দেবেন।’
জহির এবার মুচীর দিকে ফিরে বলে, ‘ও নিমাই দাদা, এর কাছে থেকে বেশি নিও না। আমার খুব পরিচিত মানুষ।’
কথাটা বলে জহির আর দাঁড়ায় না। প্যাডেলে জোর চাপ দিয়ে ঘুরঘুর করে চাকা ঘুরিয়ে চলে যায়। নওরিন অবাক চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষ কথাটা কী বলল? ওর খুব পরিচিত মানুষ?
জুতোটা সেলাইয়ের পর ওর হাতে যখন দেয় তখন ও দেখে একদম ঠিকঠাক। সুতোটা জুতোর রঙের সঙ্গে মিশে বোঝা যাচ্ছে না। টাকাটা দিয়ে ও রিক্সা নেয়। ছেলেটা অমন হুট করে চলে গেল। ওর শেষ কথায় না হেসে মুখ গম্ভীর করে রেখেছিল সেজন্য হয়তো মন খারাপ করেছে। বলল টিউশনি আছে, তাই চলে গেল। টিউশনির কথা মনে হতেই ও একটু চঞ্চলতা অনুভব করে। একটা টিউশন ওরও দরকার। কিন্তু কী করে সেটা করতে হয় জানা নেই। ওদের এই নতুন ভাড়া বাসাটার গলিতে কয়েকটা ‘পড়াতে চাই’ বিজ্ঞপ্তি ও দেখেছে। এমন কিছু কাগজ চুপিচুপি লাগিয়ে দেবে নাকি?
২.
দিলশাদ একটা চপিং বোর্ডে কুচিকুচি করে পেঁয়াজ কাটছিলেন। কিছুক্ষণ কাটতেই চোখ দুটো পেঁয়াজের ঝাঁজে বন্ধ হয়ে আসে। একটু সরে চোখ দুটো টেনে ঝাঁজ সামলান। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কতদিন পর এসব করছেন ঠিক মনে নেই। এই নতুন বাসায় এসে একটা ছুটা বুয়া খুব সহজেই অল্প বেতনে পাওয়া গেছে। কিন্তু রান্নার লোক খুঁজতে গিয়ে দেখেন কম করে ছয়-সাত হাজার টাকা খরচ করতে হবে। এই টাকাটা হিসেবে ধরা ছিল না। ভেবেছিলেন রান্নার কাজটা নিজেই করে ফেলবেন। কিন্তু এখন করতে যেয়ে টের পাচ্ছেন কাজটা ভীষণ কষ্টের। তিনবেলা রান্না করতে গিয়ে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন যে কারও সাথে ভালো করে কথাই বলতে পারছেন না।
ঠিক এই সময় জাফর একটা ভাত রান্নার হাড়িতে পানি ভরে চুলোয় চাপান। তা দেখে দিলশাদ একটু মেজাজ খারাপ গলায় বলে, ‘এই গরমের দিনেও তোমার গরম পানি লাগে? গরম পানি নিতে গিয়ে তো একটা দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে। আর এই সকাল সকাল তুমি গোসল করছ কেন? দুপুরে গোসল করো, তখন এমনিতেই সূর্যের তাপে পানি গরম থাকে।’
আগে সুইচ টিপলেই গরম পানি বেরোত৷ এই নতুন বাসায় এসে গিজার লাগানো হয়নি এখনও। এই সামান্য বিলাসিতাটুকুও ছাড়তে হয়েছে। হায়রে জীবন!
জাফর সংকুচিত হয়ে যায়। স্ট্রোকটা করার পর কেন জানি ওর শীত লাগে বেশি। ঠান্ডা পানি গায়ে পড়লেই শরীর ছনছন করে। কিন্তু সেটা আর বুঝিয়ে বলা হয় না দিলশাদকে। বেচারা এত কষ্ট করছে যে রান্নাটাও ওকে করতে হচ্ছে।
জাফর কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘আজ একটু বেরোব ভাবছিলাম। যে বায়িং হাউজটার সাথে সবচেয়ে বেশি কাজ হতো ওদের অফিসে যাব। দেখি কোন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি কি-না।’
দিলশাদ থমকে তাকায়। খারাপ হয়ে যায়। জাফর চাকরি করবে!! কথাটা কেমন যেন বেমানান শোনায় কানে। একটু আগে কড়া গলায় কথা বলার জন্য কষ্ট লাগে।
ও কাছে এসে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, ‘আরেকটু সুস্থ হয়ে নাও, তারপর না হয় বেরিও।’
জাফর মাথা নাড়ে, ‘আমি এখন একদম ফিট। গোসল করেই বেরোব।’
দিলশাদ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আচ্ছা, তুমি বাথরুমে যাও। আমি গরম পানি দিচ্ছি।’
গোসল সেরে জাফর বহুদিন পর অফিস যাবার জামা কাপড় পরেন। শেষ যে ব্লেজারটা কিনেছিলেন সেটা চাপিয়ে বের হন। দিলশাদ কেমন একটা চোখে চেয়ে থাকে। আজ কতদিন পর মানুষটা এমন অফিস যাবার জামা কাপড় পরল। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ওদের সব কিছু আগেরমতোই আছে। হয়তো একটা দু:স্বপ্ন দেখছেন এতদিন।
এমন সময় নাকে ভাতের পোড়া গন্ধ আসতেই ছুটে গিয়ে চুলা অফ করেন। সব পুড়ে যায় ওর!
জাফর গোসল সেরে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়ে। দিলশাদ খেয়ে যেতে বলেন কিন্তু এত সকালে দুপুরের খাবার খেতে ইচ্ছে হয় না।
জাফর যখন ‘নেস্ট বায়িং হাউজ’ এ এসে পৌঁছান ততক্ষণে দুপুর একটা। অসময়ে চলে এলেন। এখন লাঞ্চের সময়। এই অফিসটায় এর আগে অনেকবারই এসেছেন।
গাড়িটা গেটে থামতেই সিকিউরিটি গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কার কাছে যাবেন?’
জাফর স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় বলেন, ‘তামজিদ হাসান সাহেবের কাছে যাব।’
সিকিউরিটি সালাম দিয়ে গেট খুলে দেয়। এই সিকিউরিটি মনে হয় নতুন এসেছে। না হলে ওকে দেখেই চেনার কথা ছিল।
রিসেপশনের মেয়েটা অবশ্য ওকে দেখেই চিনতে পারে। দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বসায়। তারপর ইন্টারকমে ফোন দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে, তারপর বলে, ‘স্যার তো লাঞ্চে আছেন। এলেই আপনার আসার কথা বলব। আপাতত যে একটু অপেক্ষা করতে হয়।’
জাফর মাথা নেড়ে সায় দেয়। অন্য সময় হলে ভেতরে ওদের এমডির রুমে নিয়েই বসাত।
ঘণ্টাখানেক পর যখন ডাক পড়ে ততক্ষণে জাফরের ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। দিলশাদ বার বার খেয়ে আসতে বলেছিল। ভেবেছিল খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু ঢাকা শহরে আজ যেন ট্রাফিক জ্যামটা বেশি ছিল।
জাফর একটু কুঁজো হয়ে হাঁটেন। তাতে ক্ষুধাটা একটু কমে। দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকতেই তামজিদ চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়ায়।
আন্তরিক গলায় বলেন, ‘জাফর ভাই, কতদিন পর আপনাকে দেখলাম। আপনি এখন সুস্থ আছেন দেখে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আপনি এতক্ষণ বাইরে বসেছিলেন কেন? আমাকে একটা বার মোবাইলে ফোন করতেন। নিশ্চয়ই লাঞ্চ করেননি। দাঁড়ান আমি লাঞ্চের কথা বলছি। আপনি আগে খেয়ে নিন।’
জাফর হেসে বলে, ‘অসুবিধে নেই তামজিদ। পরে খাব। তোমার কাছে জরুরি একটা দরকারে এসেছি।’
তামজিদের নিখুঁত কামানো গালের মাংসপেশি একটু শক্ত হয়। ওকে বসতে বলে বলেন, ‘হ্যাঁ, বলুন না জাফর ভাই।’
জাফর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘তামজিদ, তুমি তো জানোই আমি এক রাতে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। বাড়িটা ছিল সেটাও দিয়ে দিতে হলো। একটা ভাড়া বাসায় ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠেছি। অল্প যা ইন্টারেস্ট পাই তাই দিয়ে কোনোমতে চলে। নতুন করে বিজনেস শুরু করব সেই টাকা নেই, মনের সাহসও নেই। একটা চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল।’
তামজিদ ভেবেছিল জাফর ভাই হয়তো টাকা ধার চাইতে এসেছেন। কিন্তু উনি যে চাকরি চাইতে পারেন এটা ওর ধারণাতেই ছিল না। একটু ভেবে বলে, ‘জাফর ভাই, আমাকে ক’টা দিন সময় দিন। আপনাকে তো হাবিজাবি কাজ দেওয়া যায় না।’
জাফর ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে৷ এগুলো কথার কথা। ও সামনে ঝুঁকে এসে বলে, ‘তামজিদ, হাবিজাবি চাকরি হলেও আমি করব। এই আমার সিভি।’
তামজিদ একটু অপ্রস্তুত হয়, লজ্জিত গলায় বলে, ‘ভাই, এমন লজ্জা দিয়েন না। আপনার মতো মানুষ চাকরির জন্য সিভি দিচ্ছে এটা যেমন কষ্টের তেমন ভয়েরও। আমারও তো এমন হতে পারত! জাফর ভাই আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি খুব শীঘ্রি আপনাকে একটা সুসংবাদ দেব।’
জাফর ওর হাত চেপে ধরে, কৃতজ্ঞ গলায় বলে, ‘একটু তাড়াতাড়ি কোরো।’
সেদিন তামজিদের অফিস থেকে লাঞ্চ করেই ও বেরোয়।
গাড়িতে উঠতেই শরীর কেমন ছেড়ে দেয়। খুব ক্লান্ত লাগছে। আজ নিজের সাথে একটা যুদ্ধে জিতেছেন। আর সেটা হলো নিজের মনের ইগোটাকে পায়ের তলায় চেপে ধরে ভিখিরির মতো চাকরি চাইতে এসেছেন। পরিবারের প্রিয় মানুষদের আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে, ওদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর