#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ৪)
১.
মে মাসের প্রথমেই আজ কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে। তাতে করে আশেপাশের গাছের এক দুটো শাখা এসে লনের উপর কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে। জাফর খান জানালা দিয়ে চেয়ে আছেন। পড়ে থাকা গাছের ভাঙা ডালটা যেন নিজেই। হঠাৎ করে কালবৈশাখী ঝড়ের মতোই ওর সবকিছু ভেঙেচুরে অবহেলায় মাটিতে ফেলে দিয়েছে। গত মাসে ফ্যাক্টরিটা বিক্রি করে দিতে হলো। আজ প্রিয় মার্সিডিজ গাড়িটা নিতে লোক আসবে। ড্রাইভারের বেতন, তেল খরচ, মেইনটেন্যান্স – সব মিলিয়ে লাখ টাকার মতো খরচ মাসে। এখন এটা পোষা মানে হাতি পোষার মতো।
জাফর গভীর আগ্রহ নিয়ে লনের এককোণে পার্ক করে রাখা প্রিয় গাড়িটা দেখতে থাকেন। আজ গাড়িটা ঝকঝক করছে। ড্রাইভার জামাল কেমন মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জাফরের অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হচ্ছে। শেষবারের মতো গাড়িটায় চড়তে ইচ্ছে করছে। দিলশাদকে ডেকে বলবেন?
এমন সময় দিলশাদ কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রাখে। তারপর সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘মন খারাপ কোরো না। প্রিমিও গাড়িটা তো রয়েই গেল। মার্সিডিজ গাড়িটা বিক্রি করার দরকার ছিল। এখন একটা গাড়ি থাকলেই চলবে। আমাদের এখন অনেক ভেবেচিন্তে চলতে হবে। তুমি সুস্থ হও এটাই এখন বড়ো চাওয়া।’
একটু পর গাড়ি নিয়ে যাবার জন্য একজন আসেন। এরা গাড়ির দাম আগেই মিটিয়েছেন। একজন নতুন ড্রাইভার জামালের কাছ থেকে চাবি বুঝে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। তারপর স্টার্ট দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে বের হয়ে যায়। পেছনে জামাল শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। জাফরের মনে হয় উনি জানালা দিয়ে একটা সিনেমা দেখছেন। টাইটানিক ডুবছে, আর সেটা খুব দ্রুতই ডুবছে।
দিলশাদ সেদিন হিসেব করতে বসেন। সঞ্চয়পত্র, গাড়ি বিক্রির টাকা সব মিলিয়ে দু’কোটি টাকার মতো ব্যাংকে আছে। তাতে করে সব কেটেকুটে মাসে দেড় লাখ টাকা পাওয়া যাবে। এর মধ্যেই সব খরচ সামাল দিতে হবে। বড়ো খরচের মাঝে এখন আরুশের স্কুলের খরচ। ওর তিনটা টিউশনের মাঝে ম্যাথটা রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। নওরিনকে বলতে হবে এখন থেকে আরুশের পড়াটা দেখিয়ে দিতে। এটা হলে মাসে বিশ হাজার টাকা খরচ বেঁচে যায়। এরপর নিচের দারোয়ান এর বেতন, খাওয়া-দাওয়া মিলে হাজার বিশেক টাকা খরচ আছে। একে বাদ দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আপাতত ক’টা দিন থাকুক। সেদিনের অমন শ্রমিকদের আক্রমণ ওকে সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। এখন অবশ্য সেই সমস্যা নেই।
রান্নার বুয়াটা নিয়েও ভাবতে হবে। এর বেতন পনের হাজার টাকা। আর অন্যান্য খরচ তো আছেই। কিন্তু এতদিক সামলে রান্নার কাজ কি পারবেন? নাহ, হাজেরাকে রাখতেই হবে।
এরপর জাফরের ফিজিওথেরাপির খরচ। এটাও অনেক। আচ্ছা, ও কি আর আগেরমতো উঠে দাঁড়াতে পারবে না?
দিলশাদ চিন্তিত মুখে ক্যালকুলেটর চেপে অংকটা দেখেন। সব মিলিয়ে এক লাখ উনচল্লিশ হাজার টাকা খরচ মাসে। একদম টায়টায়। কোনো মাসে একটু বেশি খরচ হলেই লোন করতে হবে। কেমন যেন দিশেহারা লাগে দিলশাদের। দমবন্ধ হয়ে আসে। হঠাৎ করেই মনে পড়ে ব্যাংকের ভল্টে পঞ্চাশ থেকে ষাট ভরির মতো স্বর্ণ আছে। ওখান থেকে অল্প কিছু স্বর্ণ বিক্রি করবে? একটু ভাবে দিলশাদ। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
নওরিনকে ডেকে রেডি হতে বলে। তারপর জাফরের কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘আরুশ বাসায় রইল। আমি নওরিনকে নিয়ে একটু ব্যাংকে যাই।’
জাফর মাথা নাড়ে। নিজেকে কেমন অসহায় লাগে। অক্ষম রাগে দাঁতে দাঁত ঘষেন। এই দুঃসময়ে ওর অসুস্থতাটা অভিশাপ মনে হয়। ওরা চলে যায়। বাড়িটা কেমন নিঝুম এখন।
একটু পর আরুশ একটা ছোট লাল বল নিয়ে এসে ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘বাবা, এটা ছুড়ে মারতে পারবে?’
কিছুদিন ধরে এই খেলাটা শুরু করেছে আরুশ। হয়তো দিলশাদ ছেলেকে বুঝিয়েছে বাবা এটা ছুড়ে মারতে পারলেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু জাফর একবারও বলটা ছুড়ে মারতে সফল হয়নি।
আজ আবার বলটা বাম হাতের মুঠোতে পুরেন। তারপর শরীরের সব শক্তি এক করে হাতটা তোলার চেষ্টা করেন। টের পান শরীর কাঁপছে, ঘেমে যাচ্ছেন। দাঁতে দাঁত চেপে বাম হাতটা একটু তুলে ধরেন। তারপর বলটা ছুড়ে মারতেই পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ে যায়।
আরুশ ছুটে এসে বলটা হাতে নেয়। চোখমুখ খুশিতে ঝলমল করছে। ও চিৎকার করে বলে, ‘বাবা! আজ পেরেছ তো! নাও, আবার মারো।’
ছেলের উত্তেজনা দেখে জাফরের মনটা ভালো হয়ে যায়। ইশ, যদি খুব জোরে বলটা ছুড়ে মারতে পারতেন। তাতে করে বুঝি ওর সব আগেরমতো হয়ে যেত।
জাফর এবার বলটা শক্ত করে ধরার চেষ্টা করেন। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে হাতটা উঁচু করার চেষ্টা করেন। হাতটা কেমন কাঁপছে। এবার আর দেরি না করে বলটা মুঠো ছাড়া করেন। বলটা এক সেকেন্ডের কম সময় বাতাসে ভাসে, তারপর পা থেকে এক ফুট দূরে গিয়ে বলটা পড়ে।
আরুশ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, ‘ওয়েল ডান বাবা।’
জাফর মনের ভেতর বাচ্চাদের মতো একটা আনন্দ টের পান। পারছে ও, একটু একটু করে পারছে। নাহ, এতদিন ও তেমন করে চেষ্টাই করেনি। এখন থেকে ও সুস্থ হবার চেষ্টা করবে। তারপর আবার আগেরমতো সব ঠিকঠাক করে ফেলবে। দিলশাদের উপর ভীষণ চাপ যাচ্ছে। এত কিছু ও এক হাতে সামলাতে পারবে তো?
২.
‘সেনকো’ জুয়েলার্সের ম্যানেজার আলমাস আজ সকাল থেকেই অলস বসেছিলেন। এখন পর্যন্ত তেমন করে বেচাকেনা হয়নি। স্বর্নের যে দাম বেড়েছে তাতে করে মানুষজন বুঝি গহনা বানানো কমিয়ে দিয়েছে।
এই যখন ভাবছে ঠিক তখন দিলশাদ খান সাথে নওরিনকে ভেতরে ঢুকতে দেখে। আলমাসের মুখে হাসি ফোটে। উঠে সামনে এগিয়ে যান, আন্তরিক গলায় বলেন, ‘ম্যাডাম, অনেক দিন পর আসলেন আমাদের এখানে। আপনি আমাদের ভি আই পি কাস্টমার। আপনারা না এলে যে আমরা না খেয়ে মারা যাব। এই বাবলু, দুইটা কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে আয়। আর কিছু খাবেন ম্যাডাম? আর মামণি তুমি অন্য কিছু খাবে?’
দিলশাদ মনে মনে সংকুচিত হয়ে যান। এখান থেকেই প্রায় সব গহনা নেওয়া। এরা তাই খুব খাতির করে। দিলশাদের মনে পড়ে না এখান থেকে কখনও খালি হাতে গিয়েছেন। ছোট্ট একটা আংটি হলেও নিয়েছেন। অথচ আজ!
দিলশাদ একবার নওরিনকে জিজ্ঞেস করে অন্য কিছু খাবে কি-না। ও মাথা নেড়ে না করে। মেয়েটা ইদানিং কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে। খেতে চায় না। সারাক্ষণ নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। নিজেদের হঠাৎ এই বিপর্যয় হয়তো ও মেনে নিতে পারছে না, ভাবেন দিলশাদ।
দিলশাদ এবার ম্যানেজার আলমাসের দিকে তাকিয়ে সংকুচিত গলায় বলে, ‘আসলে এবার কিনতে আসিনি। আমার হঠাৎ করে একটা জরুরি প্রয়োজনে এই গহনাগুলো বিক্রি করতে হবে। আমি রশিদ নিয়ে এসেছি। আপনি কি একটু দেখবেন এখানে ঠিক কতটুকু গহনা আছে?’
আলমাস অবাক হয়ে দিলশাদ ম্যাডামের বাড়িয়ে দেওয়া গহনার বক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ইনি এর আগে যতবারই এসেছেন ততবারই দামি গহনা কিনে নিয়ে গেছেন। অন্য কাস্টমারদের মতো গহনার মজুরি নিয়ে ঝোলাঝুলি করেননি। সেই মানুষ আজ গহনা বিক্রি করতে এসেছেন?
নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘কোনো সমস্যা নেই ম্যাডাম। আমরা তো এই সার্ভিসটা দেই। আমাদের এখান থেকে কেনা গহনা আমরা ন্যায্যমূল্যেই কিনে নেই। আমি ওজন দিয়ে দেখছি।’
দিলশাদ ছোট্ট করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। ব্যাপারটা এত সহজ হবে ভাবেননি।
ওজন দেওয়া শেষ হতেই আলমাস হাসিমুখে জানান, ‘ম্যাডাম, পাঁচ ভরি আট আনা। একটু কম আছে অবশ্য। আট আনা ধরেই হিসেব করছি।’
সব মিলিয়ে আলমাস যখন সাড়ে চার লক্ষের কাছাকাছি টাকা ওর হাতে দেয় তখন ও অবাক হয়ে যায়। ভেবেছিল ওরা অর্ধেক দাম দেবে।
দিলশাদ কৃতজ্ঞ গলায় বলে, ‘থ্যাংকিউ, আলমাস সাহেব।’
আলমাস হাত কচলে বলে, ‘ম্যাডাম, এরপর যদি বাকি গহনাগুলো বিক্রি করেন তাহলে আমার কাছেই এসেন। আমি আপনাকে সর্বোচ্চ দামটাই দেব।’
দিলশদ মাথা নেড়ে নওরিনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গাড়িতে উঠে বলেন, ‘কী রে, তুই তো আজ সকালেও কিছু খাস নি। কিছু খাবি?’
নওরিন মাথা নেড়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে থাকে। একটা দুশ্চিন্তা ক’দিন ধরেই ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তিন দিন আগেই ওর পিরিয়ডের ডেট ছিল। এবার হয়নি। বার বার ও ওয়াশরুমে যেয়ে দেখেছে, কোনো লক্ষণই নেই এবার। দিন যত গড়াচ্ছে ওর বুকের ভেতর কেমন শুকিয়ে আসছে। ও কী তবে কনসিভ করে ফেলল! ভাবনাটা ভাবতেই শরীর হিম হয়ে আসে। এসি গাড়ির ঠান্ডা বাতাসে ও আরও গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে।
৩.
ভোরের আলো এখনও ফোটেনি। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই হয়তো সূর্য উঠবে। নওরিন বিছানা ছেড়ে উঠে প্রথমে রুমের দরজাটা বন্ধ করে। তারপর ওয়ারড্রব এর ভেতর কাপড়ের নিচ থেকে একটা প্রেগন্যান্সি ডায়াগনস্টিক কিট বের করে। একবার তাকায়। কাল আহনাফ এটা কিনে দিয়েছে। বলেছে আগে পরীক্ষা করে দেখতে।
নওরিন ওয়াশরুমে যেয়ে ইউরিন স্যাম্পল নিয়ে কাঁপা হাতে কিটটা ডোবায়। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। একটা দাগ ওঠেছে। মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে আরেকটা দাগ যেন না ওঠে। নিচের ঠোঁট জোরে কামড়ে ধরে ও নির্নিমেষে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। ঝাপসা চোখে দেখে আরেকটা দাগ স্পষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও জ্ঞান হারাব। পুরো পৃথিবী যেন দুলে উঠছে। দ্রুত ও সামনের দেয়াল ধরে বাথরুমের ফ্লোরে বসে পড়ে। কেমন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ওর।
বুক কাঁপিয়ে কান্না আসছে। ফিসফিস করে ও বলে, ‘আম্মু তুমি কোথায়, আমার ভীষণ ভয় করছে।’
বেড রুমের দরজায় শব্দ হচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। নওরিন উঠে বসে। খেয়াল করে ঘড়িতে সকাল আটটা। এতক্ষণ এই বাথরুমের ফ্লোরেই ঘুমিয়েছিল ও!
দ্রুত উঠে পড়ে। গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘আম্মু, খুলছি।’
দরজা খুলতেই যেতেই হঠাৎ হাতে থাকা প্রেগন্যান্সি কিটটার দিকে চোখ পড়তেই ও থমকায়। দ্রুত ওয়ারড্রব খুলে কাপড়ের ভাঁজে জিনিসটা লুকিয়ে ফেলে। তারপর কুঁচকে যাওয়া জামাটা দু’হাতে ঠিক করে নিয়ে এবার ও দরজা খোলে।
দিলশাদ বিরক্ত গলায় বলে, ‘সেই কখন থেকে দরজা ধাক্কাছি, খুলছিস না কেন। তোর বাবার একটা ওষুধ রেখেছিলাম তোর রুমে। আর তোকে বলেছি না দরজা বন্ধ করে ঘুমাবি না?’
গজগজ করতে করতে দিলশাদ ওর রুমে টেবিলের উপর থেকে একটা ওষুধের প্যাকেট নিয়ে বের হয়ে যান।
নওরিন বিছানায় এসে বসে। কী করবে ও এখন? আহনাফ কী ঘুম থেকে উঠেছে? কাল ও বলেছিল টেস্ট করেই ওকে জানাতে। একবার ফোন করে, রিং বেজে বেজে কেটে যায়। আবার ফোন দেয় ও। এবার ওর ঘুম জড়ানো গলা পাওয়া যায়, ‘কী রে, এত সকালে ফোন দিয়েছিস কেন?’
নওরিন অবাক হয়ে খেয়াল করে আহনাফ টেস্টের কথা ভুলে গেছে। ও একটা ঢোঁক গিলে বলে, ‘আহনাফ, আমি প্রেগন্যান্ট।’
আহনাফ এসি ছেড়ে পাতলা একটা কাঁথা গায়ে ঘুমিয়েছিল। নওরিনের কথায় ওর ঘুম ছুটে যায়। ও চিৎকার করে বলে, ‘কী বললা! তুমি প্রেগন্যান্ট!’
ওর গলার স্বর ভীষণ কর্কশ শোনায়। নওরিন লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক শুনেছ। সেদিন অমন জোর করে আদর করলে, আমি কত বার না করেছি। এখন বলো আমি কী করব?’
আহনাফের তলপেট কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। ও তোতলানো গলায় বলে, ‘একবারেই কেউ এমন করে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়?’
নওরিন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তার মানে তুমি কী বলতে চাচ্ছ? আমি অন্য কারও সাথে শুয়েছি? এর দায় তোমার। বাসায় সবাইকে বলো, আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে।’
আহনাফ এবার ভয় পায়। বিপদটা যে ওর দিকে ঘুরে আসতে পারে সেটা বুঝতে পারে। ও বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, ‘নওরিন, এখন বাসায় বিয়ের কথা বললে বাবা ঘাড় ধরে বাসা থেকে বের করে দেবে। আর তুমি কি ভুলে গেলে আমি আর তুমি বিদেশে পড়ার জন্য এপ্লিকেশন করলাম, তাতে লেখা ছিল আমরা অবিবাহিত। এখন বিয়ে করলে তো ঝামেলা।’
নওরিন দিশেহারা গলায় বলে, ‘আমি কিছু বুঝি না। তুমি বিয়ে না করলে আমি আত্মহত্যা করব।’
আহনাফ আতংকিত গলায় বলে, ‘এসব কী বলছ তুমি! একটু মাথা ঠান্ডা করো। আমি তোমাকেই বিয়ে করব। কিন্তু তুমিও ভালো করে ভেবে দেখো এই বাচ্চা তুমি রাখতে চাও কি-না? আমাদের এখন ফূর্তি করার বয়স। এখন কি তুমি বাচ্চা নিয়ে ক্যালাসের মতো বসে থাকবা?’
নওরিন থমকায়। আহনাফ ঠিক কথা বলেছে। ও ভাবতেই পারে না একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ও বসে আছে। জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘তাহলে কী করব?’
আহনাফ একটু ভেবে বলে, ‘আমি শুনেছি এবরশনের ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এটা খেলেই নাকি সব আবার আগেরমতো ঠিক হয়ে যায়। দাঁড়াও, আমি আজকেই ওষুধের দোকানে কথা বলে নেই। তুমি বিকেলে আমাদের সেই রেস্টুরেন্টে একবার আসো। আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেব।’
বিকেলে নওরিন যখন ওদের প্রিয় রেস্টুরেন্টে পৌঁছে ততক্ষণে আহনাফ চলে এসেছে। ওকে দেখেই কাছে এগিয়ে একটা হাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘লাভ ইউ বেবি। তুমি একদম ভেব না। আমি ওষুধ নিয়ে এসেছি। ওরা বলল এটা নাকি খুব নিরাপদ। আর তোমার তো মাত্র ক’টা দিন হয়েছে। এটা খেলেই তুমি একদম ক্লিন হয়ে যাবে।’
নওরিন বসতে বসতে বলে, ‘সত্যি? আমার কিছু হবে না তো আবার?’
আহনাফ জোর গলায় বলে, ‘কিচ্ছু হবে না। আর আমি আছি তো তোমার পাশে। আমি তোমাকে ভালোবাসি নওরিন। কিন্তু এখন আমরা বাবা মা হলে আমাদের নিজের জীবনটা এনজয় করতে পারব না।’
নওরিন মাথা নিচু করে বসে থাকে। স্যুপ আসে, সাথে অন্থন। আহনাফ নিজে একটা বাটিতে স্যুপ বেড়ে দেয়। নওরিন অস্ফুটে বলে, ‘আহনাফ, চলো না বিয়ে করে ফেলি। আমাদের প্রথম বাবুটাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে না।’
আহনাফ একটু থমকায়। বিরক্ত গলায় বলে, ‘কেন শুধু শুধু জটিল করছ? ওষুধ খাবে, ব্যাপারটা ক্লিন হয়ে যাবে। আমাদের এখনও পড়াশোনা শেষ হয়নি। অনেক পথ যাওয়া বাকি। আর বাবা মা কেউই এটা মেনে নেবেন না।’
নওরিনের চোখ ভিজে যায়। কেন ও এমন করল। মা জানতে পারলে কী করবে ওকে? আর বাবা? ওদের এমন দুর্দিনে ও এমন একটা কাজ করতে পারল? এটা জানলে উলটো আরও অশান্তি হবে। বাবা হয়তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার চেয়ে চুপিচুপি ওষুধটা খেয়ে ফেলাই ভালো।
নওরিন চোখ মুছে বলে, ‘আচ্ছা, খাওয়ার নিয়মটা আমাকে বুঝিয়ে দাও।’
আহনাফ এবার আগ্রহের সাথে বুঝিয়ে দিতে থাকে। নওরিনের মনে হয় ওকে মৃত্যুর পথ বাতলে দিচ্ছে আহনাফ।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নওরিন ওষুধটা খায়। তারপর টেনশন নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। অনেকক্ষণ কিছু ঘটে না। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সেদিন নওরিনের ঘুম ভাঙে শেষ রাতে, তলপেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে। আর সেই সাথে টের পায় বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ও দ্রুত উঠে বসতেই মাথাটা কেমন ঘুরিয়ে বিছানায় পড়ে যায়। সারা শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে সেই সাথে তীব্র একটা কাঁপুনি। নওরিন বিছানা হাতড়ে একটা কাঁথা গায়ে দেয়। নাহ, তাও ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু রক্ত বন্ধ হচ্ছে না কেন? ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। দুটো প্যাড পরতে হতো। কিন্তু কিছুতেই ও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। ও কি মরে যাচ্ছে? আম্মু, বাবা আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদের খারাপ সন্তান। ছোট্ট আরুশ, ভাইটা আমার ক্ষমা করে দিস।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর