আলো অন্ধকারে পর্ব-০২

0
388

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ২)

১.
রাজধানীর একটা নামকরা হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে আছেন জাফর খান। মৃদু নাক ডাকছেন। দিলশাদ পাশেই বসে তাকিয়ে ছিল। আজ সাতটা দিন পার হয়ে গেল জাফর এখানে। অত বড়ো একটা দূর্ঘটনার খবর নিতে পারেনি। ডাক্তার বলেছেন বাজে রকমের স্ট্রোক করেছে জাফর। তাতে করে একটা পাশ পুরো অবশ হয়ে গেছে। কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যাচ্ছে। শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন দিলশাদ। একটা রাতের ব্যবধানে পুরো পৃথিবী পালটে গেল। ফ্যাক্টরি পুড়ে শেষ, একটা যন্ত্রপাতিও বাঁচানো যায়নি। আর সেই বড়ো অর্ডারের সব পোলো শার্টগুলো পুড়ে এখন কয়লা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিলশাদ জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। এই ফ্যাক্টরিটাই ছিল ওদের একমাত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জাফর যখন এটা শুরু করল তখন খুব ছোট ছিল। মনে আছে দিলশাদ বিয়ের সব গহনা বিক্রি করে দিয়েছিল এই ফ্যাক্টরিটা দাঁড় করাতে। ওর নামেই নাম রেখেছিল ‘দিলশাদ গার্মেন্টস’। আর ভাগ্য যেন পায়ে এসে ধরা দিয়েছিল। একের পর এক অর্ডার পাচ্ছিল। ব্যবসা ফুলে ফেঁপে বড়ো হচ্ছিল। কিন্তু এখন? এখন যে আর কিছুই নেই। কেন যেন এখন নিজের নামটাকে দূর্ভাগা মনে হয়। জাফর আগে বলত ওর নামটা পয়মন্ত, তাই এত উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওর নামটা অশুভ।

ভাবনার এই পর্যায়ে ফোন আসে। চেয়ে দেখে ফ্যাক্টরি ম্যানেজার মহিবুরের ফোন। ও ধরতেই ওপাশ থেকে সালাম দিয়ে মহিবুর বলে, ‘ম্যাডাম, আমি হাসপাতালে এসেছিলাম। আপনার সাথে দু’টো জরুরি কথা ছিল।’

এই হয়েছে এক জ্বালা। জাফর অসুস্থ, সব এখন ওকে সামলাতে হচ্ছে। এই কোম্পানির ও নামেমাত্র ডিরেক্টর ছিল। যা করার সব জাফরই করত। কিন্তু এখন ওকে দৌড়ুতে হচ্ছে। ফোনে মহিবুরকে নিচের ওয়েটিং রুমে বসতে বলে। তারপর একজন নার্সকে জাফরের দিকে লক্ষ রাখতে বলে ও বেরোয়।

হাসপাতালটা ঝকঝকে পরিস্কার। অন্য হাসপাতালগুলোর মতো না। দেখলে মনে হয় হোটেলে আছে। অবশ্য এর জন্য বেশ মোটা অংকের টাকা গুনতে হয়। টাকার কথা মনে হতেই দিলশাদে বুকের ভেতর একটা অস্থিরতা টের পায়। আগে তো প্রতি মাসে অনেকগুলো টাকা ওর একাউন্টে জমা হতো। কিন্তু এখন থেকে তো এই টাকাটা আসবে না। জাফর অসুস্থ। ও কবে সুস্থ হবে, কবে নতুন করে ফ্যাক্টরি দাঁড় করাবে কে জানে। আদৌ কি সম্ভব হবে কি-না জানা নেই। হঠাৎ করেই শরীরটা কেঁপে ওঠে, যদি সব আগেরমতো ঠিকঠাক না হয়?

দিলশাদ দূর থেকেই মহিবুরকে দেখতে পায়। লম্বা চওড়া একটা মানুষ, সবসময় প্রাণবন্ত। ফ্যাক্টরির সেই শুরু থেকেই আছেন। কত কত ঝামেলা হয়েছে তা এই মহিবুর এক হাতেই সামলেছে। একবার এক শ্রমিক ছাদ থেকে পড়ে মারা গেল। তখন তো গুজব রটানো হলো মালিকপক্ষ মেরে ফেলেছে। সেবার বেশ ঝামেলা হয়েছিল, মহিবুর তখন সেটা দক্ষ হাতেই সামলেছিল। কিন্তু আজ সেই দৃঢ়চেতা মানুষটাকে কেমন যেন ভেঙ পড়া মানুষ মনে হচ্ছে। কেমন মাথা নিচু করে বসে আছেন।

মহিবুর ওকে দেখেই উঠে দাঁড়ায়, বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে বলে, ‘সরি ম্যাডাম, হাসপাতালেই আসতে হলো।’

দিলশাদ মাথা নেড়ে বলে, ‘না সমস্যা নেই। আপনাকে তো আসতেই হবে। আপনার উপর এখন সব। এবার বলুন ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম করেছেন?’

মহিবুর হতাশ গলায় বলে, ‘ম্যাডাম, আমাদের প্রাইমারি ইন্স্যুরেন্স ছিল না। তাতে করে আমরা হয়তো খুব একটা ক্ষতিপূরণ পাব না। আর বায়িং হাউজ জানিয়ে দিয়েছে ওরা ইতোমধ্যে অন্য গার্মেন্টসে আমাদের অর্ডারটা শিফট করে দিয়েছে। বায়াররা সমবেদনা জানিয়েছে কিন্তু ওরা আর দেরি করতে চায়নি।’

দিলশাদ টের পান বুকের ভেতর সেই মনের বাঘটা ওকে গ্রাস করে নিচ্ছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ও মরিয়া গলায় বলে, ‘বিজিএমইএ থেকে কোন কিছু করবে না?’

মহিবুর মাথা নিচু করে বলে, ‘ম্যডাম, আমাদের ক্ষতিটা তো অনেক বড়ো। অল্প কিছু ফান্ড পাওয়া যাবে তা দিয়ে আমাদের গতমাসের ইলেক্ট্রিসিটি বিলটা হয়তো পরিশোধ করতে পারব। কিন্তু এখন যেটা বড়ো সমস্যা সেটা হলো শ্রমিকদের বকেয়া বেতন। সবাই প্রতিদিন ফ্যাক্টরির গেটে এসে ভীড় করছে। এখনও কিছু বলছে না, কিন্তু ক’দিন পরেই এরা আন্দোলনে নামবে।’

দিলশাদ অবিশ্বাসের গলায় বলে, ‘যে মালিক এত বছর ওদের রুটি রুজির ব্যবস্থা করল তার এমন দুর্দিনে ওরা পাশে দাঁড়াবে না?’

মহিবুর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আসলে ম্যাডাম ওদের তো প্রতি মাসের বেতনের টাকায় সংসার চলে। এরা হুট করে এখন কোথাও কাজও পাবে না। তাই এরা এমন করছে।’

দিলশাদ হতাশ গলায় বলে, ‘তাহলে এখন কী করা যায় বলুন তো?’

মহিবুর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় বলে, ‘ম্যাডাম, আমাদের পাশেই আরেকটা গার্মেন্টস আছে। ওরা আমাদের এই পুড়ে যাওয়া গার্মেন্টস কিনে নিতে চায়। যদিও এখন জমি ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই। পুরো বিল্ডিংটা ভেঙে ফেলতে হবে। যে নেবে তাকে নতুন করে করতে হবে। ওরা জমিটার জন্যই নিতে চেয়েছে। আর ভালো অফারও করেছে। আমার মনে হয় ওদের কাছে বিক্রি করে দেওয়াই উচিত।’

দিলশাদ তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর কেটে কেটে বলে, ‘আপনাকে ওরা কত টাকা দিয়েছে এই কথা আমাকে বলার জন্য? নাকি আপনি ইতোমধ্যে ওই গার্মেন্টসে জয়েন করেছেন? এতটা অকৃতজ্ঞ হবেন আশা করিনি। সাতটা দিন পার হয়নি অমনি আপনার আসল চেহারা দেখিয়ে দিলেন? আমার তো এখন মনে হচ্ছে আপনিই শ্রমিকদের খেপিয়ে তুলছেন।’

মহিবুর রাগ করে না। ম্যাডাম এমনিতে খুব ভালো মানুষ। কতবার ফ্যাক্টরিতে এসেছেন। সবার সাথে গল্প করেছেন। এমনিতেই খুব সুন্দর, তার উপর সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন মানুষটার মাথা ঠিক নেই। আর থাকার কথাও না। এত বড়ো বিপদ যে আসেনি আগে।

মহিবুর নরম গলায় বলে, ‘ম্যাডাম, আমাদের ব্যাংক লোন আছে প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকার মতো। স্যার এই বড়ো অর্ডারটা ডেলিভারি দিতে অনেক লোন করে ফেলেছিলেন। ব্যাংকে প্রতি মাসে আমাদের বড়ো একটা অংক কিস্তি দিতে হয়। এ মাস থেকে সেটা আর দেওয়া যাবে না। কিস্তি না দিতে পারলে একটা সময় ব্যাংক পুরো সম্পত্তি নিলামে তুলবে। আমি যতদূর জানি আমাদের ফ্যাক্টরিটাও মর্টগেজ রাখা। তাই বলছিলাম আমাদের দেরি করা উচিত না। সবার আগে ঋণগুলো পরিশোধ করে হাতে নগদ কিছু টাকা রাখা। স্যার সুস্থ হোক, আমরা তখন আবার নতুন করে শুরু করব।’

শেষ কথাটা তেমন জোরালো শোনায় না। দিলশাদ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকেন। এই রুঢ় সত্যটা জানা ছিল না। মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘আমাকে একটু ভাবার সময় দিন।’

মহিবুর উঠে দাঁড়ায়, ‘আচ্ছা ম্যাডাম। তবে খুব বেশিদিন সময় নেবেন না। বিপদের সময় মানুষের পেছনে শত্রু আরও বেশি করে লাগে। আমি একটু এখন বিজিএমইএ এর অফিসে যাব। আপনাকে জানাব কিছু হলো কি-না।’

মহিবুর চলে যায়। দিলশাদ শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্রাজ্য এক রাতেই এমন করে পুড়ে ছাই হয়ে গেল! সব বেচে দিতে হবে!?

২.
জাফর খান শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে বাম হাতটা তোলার চেষ্টা করেন, পারেন না। একটা অক্ষম রাগ টের পান। বাম পা টাও একই অবস্থা। হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে বেডরুমের জানালার কাছে এসে বাইরে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেন। শীতের সকাল, বাইরে এখনও হালকা কুয়াশা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করেই মনে হয় ওর জীবনে হঠাৎ করেই কুয়াশায় ঢেকে গেল।

এমন সময় পেছন থেকে দিলশাদ নরম গলায় ডাকে, ‘জানালার কাছ থেকে সরে এসো, ঠান্ডা লেগে যাবে। চা দিচ্ছি, একটু চুমুক দাও।’

জাফর ওর দিকে ব্যথিত চোখে তাকায়।

দিলশাদ চায়ের কাপটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘ধরে রাখতে পারবে তো? নাকি আমি খাইয়ে দেব?’

জাফর মাথা নেড়ে একটু জড়ানো গলায় বলেন, ‘না, আমি পারব।’

কাঁপা হাতে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেন, ‘দিলশাদ, আমি ফ্যাক্টরিতে যাব। আমি নিজের চোখে একটু দেখতে চাই।’

গত ক’টা দিন এই একটা কথা বার বার বলছে জাফর। কিন্তু ডাক্তারের কড়া নিষেধ উত্তেজনা হতে পারে এমন কিছু না করা। পুড়ে যাওয়া ফ্যাক্টরির ছবি জাফর কিছুতেই সইতে পারবে না। উলটো ভীষণ একটা ক্ষতি হয়ে যাবে।

ও আলতো গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, যাবে তো। আরেকটু সুস্থ হয়ে নাও। ডাক্তার বলেছেন মাস ছয়েকের মধ্যে তুমি আবার আগেরমতো হাঁটা চলা করতে পারবে। শুধু নিয়ম করে ফিজিওথেরাপি নিতে হবে। আর এই সফট বলটা ওই হাতে নিয়ে বার বার মুঠোবন্ধ করে প্রাকটিস করো। তাতে করে হাতটা সচল হবে।’

জাফর মাথা নাড়েন। বুঝতে পারেন ওকে ফ্যাক্টরি দেখতে নিয়ে যাবে না এরা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘মহিবুরকে কাল একটু সব হিসাবপত্র নিয়ে আসতে বলো তো। অনেক টাকা ঋণ আছে।’

দিলশাদের বুকটা চলকে ওঠে। ক’টা দিন ধরে ঘুমোতে পারেন না। ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা চেপে ধরে। একটা মাস প্রায় চলে গেল কোথাও থেকে কোনো সুখবর নেই। বিজিএমইএ কিছু টাকা দিয়েছে। তাই দিয়ে গ্যাস বিল, ইলেকট্রিসিটি বিল মেটানো হয়েছে। শ্রমিকরা এর মধ্যেই এক দু’বার মিছিলও করেছে বকেয়া বেতনের দাবিতে। ফ্যাক্টরি বিক্রির ব্যাপারে জাফরের সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু এই ক’টা দিন সাহস হয়নি। আজ বলতেই হবে।

দিলশাদ পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘জাফর, আমাদের যা ক্ষতি হয়ে গেছে তা তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। বর্তমান নিয়ে একটু ভাবতে হবে। তুমি তো নিজেও বললে অনেক টাকা ঋণ আছে। আর এদিকে আমাদের আয় রোজগারের পথ একদম বন্ধ। সব কিছু বাদ দিলেও সংসার খরচ আছে মাসে লাখ পাঁচেকের মতো। তার উপর তোমার চিকিৎসার ব্যয়। এখন জমা টাকা ভেঙে খাচ্ছি। একটা বছর পর কী হবে ভাবতেই বুক কেঁপে উঠছে। তাই ভাবছি একটা কাজ করলে কেমন হয়।’

জাফরের মুখের একটা পাশ কাঁপতে থাকে। জিভটা কেমন অবাধ্য হয়ে জড়িয়ে যায়। কষ্ট করে বলেন, ‘কী করতে চাও তুমি?’

দিলশাদ এবার ওকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ফ্যাক্টরিটা বেচে দেই। তাতে করে ব্যাংকের ঋণগুলো শোধ হবে আর হাতেও কিছু নগদ টাকা থাকবে। সেটা ব্যাংকে রেখে ইন্টারেস্টের টাকায় আমাদের বেশ ভালোভাবেই চলে যাবে।’

জাফর বুকের ভেতর সূক্ষ্ম একটা ব্যথা টের পান। ধীরে ধীরে মুখ লালচে হয়ে ওঠে। চোখমুখ শক্ত করে বলেন, ‘আমি ফ্যাক্টরি বেচব না। আমি সুস্থ হয়ে নিই, তারপর সব ঠিক করে ফেলব।’

দিলশাদ থমকায়। জাফরের ভেতরের কষ্টটা টের পায়। কেমন বাচ্চাদের মতো জেদ করে কথাটা বলল। ও নিজেও হয়তো জানে আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব। তাও কিছুটা হয়তো হতো যদি ও সুস্থ থাকত।

ঠিক এই সময় নিচের গেটে একটা হইহল্লা শোনা যায়। দিলশাদ জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই বুক হিম হয়ে যায়। প্রায় শ’খানেক লোক গেটের বাইরে চিৎকার চেচামেচি করছে। গেট ধরে ধাক্কাচ্ছে। এরা কারা?

এই সময় নিচ থেকে ইন্টারকমে ফোন আসে। দিলশাদ ফোনটা ধরতেই নিচের সিকিউরিটি কাশেম মোল্লা আতংকিত গলায় বলে, ‘ম্যাডাম, পুলিশে খবর দেন। গার্মেন্টসের শ্রমিকরা বাইরে হট্টগোল করতেছে। এরা মনে হয় গেট ভাইঙা ফেলাইব।’

দিলশাদ বিপদ টের পান। শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে বাসায় চলে এসেছে? মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে। এদেরকে কতক্ষণ আটকে রাখতে পারবে ওরা? হাতে সময় নেই। দ্রুত ও ৯৯৯ এ ফোন দেয়। তারপর যতটুকু সম্ভব বুঝিয়ে বলে সাহায্য চায়।

জাফর চোখ বড়ো বড়ো করে ওর কথা শুনছিল। ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগে। তারপর দ্রুত ও হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে জানালার কাছে এসে উঁকি দিতেই বিস্ফারিত চোখে নিচে গেটের ওপাশে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

দিলশাদ ফোন রেখে একটানে ওকে জানাল থেকে সরিয়ে আনে। তারপর ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘জাফর, এরা মনে হয় বাসায় ঢুকে পড়বে। আমি বাসার দরজা বন্ধ করে আসি।’

দিলশাদ দ্রুত কয়েকটা কাজ করে। বাসার মূল দরজাটা ভালো করে লক করে। তারপর চিৎকার করে আরুশ আর নওরিনকে ডেকে বাবার রুমে যেতে বলে।

নওরিন বিরক্ত গলায় বিলে, ‘কী হয়েছে আম্মু, অমন করে ডাকছ কেন?’

দিলশাদ কোনো কথার উত্তর দেন না। দ্রুত হাতে বেডরুমের দরজা বন্ধ করেন। আরুশ অবাক চোখে জানাল দিয়ে বাইরে দেখছিল। ও হঠাৎ আতংকিত গলায় বলে, ‘আম্মু, দারোয়ান আংকেলকে মারছে কারা যেন। আর আমাদের গেট ভেঙে ফেলেছে।’

দিলশাদ ঝট করে ওর দিকে ফেরেন। নওরিন ততক্ষণে জানালার কাছে চলে গেছে। ও আতংক নিয়ে তাকিয়ে দেখে অনেকগুলো মানুষ ওদের বাড়ির ভেতর ঢুকছে। সবার চোখমুখ হিংস্র।

দিলশাদ চিৎকার করে ওঠেন, ‘জানালা থেকে সরে এসো।’

কথাটা শেষ হয় না, তার আগেই বড়ো একটা ইটের টুকরো এসে জানালার কাচে আঘাত হানে। নওরিন আর্ত চিৎকার করে আরুশকে জড়িয়ে ধরে মেঝেতে শুয়ে পড়ে।

দিলশাদের মনে হয় জ্ঞান হারাবেন। জাফর তোতলানো গলায় কিছু বলতে চায়, পারে না।

দিলশাদ পাগলের মতো দৌড়ে ওদের কাছে যান। টেনে হিঁচড়ে ওদের এপাশটায় নিয়ে আসেন। আরুশের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘তুই ঠিক আছিস তো বাবা?’

আরুশ ভয় পাওয়া গলায় বলে, ‘আম্মু, আপুর কপালে রক্ত।’

দিলশাদ ঝট করে মেয়ের দিকে তাকাতেই বুকটা অবশ হয়ে যায়। দ্রুত ওর মুখটা তুলে ধরেন। তারপর নিশ্বাস চেপে ছোট্ট একটা কাচের টুকরো টেনে বের করে নিয়ে আসেন। নওরিন ‘উফ’ বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

দিলশাদ এবার একটা টিস্যু দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরেন। রক্তে সাদা টিস্যুটা লাল হয়ে যেতে থাকে। ওদিকে বাইরের দরজায় ধড়াম ধড়াম করে শব্দ হচ্ছে। পুলিশ কখন আসবে? যদি তার আগেই এরা দরজা ভেঙে বাসায় ঢুকে পড়ে?

আরুশ, নওরিন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। জাফর শুধু চোখ বড়ো বড়ো করে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কেমন দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে ওর। দিলশাদ দুই ছেলেমেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আতংকিত হয়ে পুলিশ আসবার অপেক্ষা করতে থাকে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে