#আলতো_বাঁধন
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১
বড়ো বোনকে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ ছোট বোনকে পছন্দের কথা জানাতেই রিমির গাল গড়িয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এটা আজকে নতুন নয়, এ নিয়ে সতেরোবার। সতেরোটি সম্বন্ধ এসেছিল—সব ফিরে গেছে। কারণ একটাই,সে কালো।
“আসলে আমরা ছোট মেয়েটাকেই বেশি পছন্দ করলাম। তাকেই পুত্রবধূ হিসেবে নিয়ে যেতে চাই।”
দ্বিতীয়বার একই শব্দগুলো যেন অদৃশ্য তীর হয়ে বিঁধলো রিমির বুকের গভীরে। রিমি তাকালো না কারো দিকে। মনের গহীন থেকে একটা চাপা নিঃশব্দ শ্বাস বেরিয়ে এলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোঁটা অশ্রু। খুব চেনা এই অনুভূতি। নতুন নয় একটুও।
এইবারের সম্বন্ধটার কাছ থেকেও রিমি বেশি-কিছু আশা করেনি। সে জানতো এমন কিছুই হবে কিন্তু পাত্র ভীষণ ভালো, সরকারি চাকুরীজীবি তাই রিমির বাবার জোর-জবরদস্তির উপর হেরে গিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে এসেছিল। তাও আগেরই মতো ফল পেলো। তবে এবারের ফল একটু ভিন্ন।
রিমি ড্রয়ইং রুমের সবার মাঝখানে থেকে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল, “আমি একটু আসছি।”
তারপর নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
বাড়ির পরিসর ছোট, নিজের ঘরটাও আজ মেহমানদের দখলে। একটুকু নিঃসঙ্গ হবার, একফালি কাঁদার জায়গাটুকুও যেন কেড়ে নিয়েছে ভাগ্য।
ছাদ ছিল রিমির শেষ আশ্রয়। সেই পুরোনো রেলিং আর চেনা আকাশটাই আজ যেন একমাত্র সাক্ষী তার ভাঙাচোরা মনের।
উঠেই এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। প্রথমে ঠোঁট কাঁপলো, তারপর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। পরক্ষণেই এক বুক কান্না চেপে ধরে ডুকরে উঠল—হঠাৎ করেই, বিনা শব্দে, যেন বুকের ভেতর জমে থাকা ব্যথাটা নিজেই মুখ খুঁজে নিয়েছে।
আজ তো তার কাঁদার কথা ছিল না। আজকের দিনটা যে বাবা খুব আশা নিয়ে শুরু করেছিলেন।
যখন বাবার মুখে শুনেছিল,
“ছেলেটা খুব ভালো রে রিমি, সরকারি চাকরি করে। এইবার হয়তো তোর ভাগ্য ফিরবে।”
বাবা যখন খুশি খুশি মনে সম্বন্ধটা রিমির সামনে এসে বলেছিল তখন বাবার উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সে না বলতে পারলো না। শেষবারের মতো আবারো অপমান হবে জেনেও সম্বন্ধের সামনে যেতে রাজি হয়েছিল।
নিচের ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে আসছে প্রাণখোলা হাসির শব্দ। শব্দগুলো যেন রিমির বুকের গভীরে ঢুকে বিষ ছড়াচ্ছে। হাসির সাথে তাল মিলিয়ে যেন তার কান্নার বেগও বাড়ছে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে।
সে তো এসব দৃশ্যের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই।
তবুও আজ কেন এমন কান্না পাচ্ছে তার?
কেন এই অজানা ভার বুকের ওপরে চেপে বসেছে?
——-
ছাদের এক কোণে, ধরা ছোঁয়ার বাইরের একান্ত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল অনুভব। হাতে ধরা সিগারেটটার ধোয়ার আবরণে নিজেকে আড়াল করে নিচ্ছে সে।
এইসব পাত্রপক্ষের আনাগোনা, মেয়ে দেখা, পছন্দ অপছন্দ—সবই অনুভবের চোখে বড্ড নিচু মানসিকতার পরিচয়। তার কাছে এসব কিছুই একরকম পণ্য বাছাইয়ের মতো মনে হয়—যেখানে মেয়ের মুখের হাসি, চোখের জলের কোনো দাম থাকে না।
সবাই মিলে একসাথে হুট করে হাজির হয়ে মেয়ের পরিবারকে অস্বস্তিতে ফেলা, তাকে যেন অপমানিত করে ফেলে ভেতর থেকে। সে জানে,আজ সে নিজেও সেই একই অন্যায়ের অংশ।
সে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো চারপাশে। এই বাড়িতে পা রাখার পর থেকেই তাদের উদ্দেশ্যে করা এতসব আয়োজন দেখে অস্বস্তিতে ভুগছে সে। তাই তো আসার সাথে সাথে নিজেকে জায়গা দিতে সোজা ছাদে চলে এসেছে।
এইসব লোকজন, আত্মীয়স্বজনের ঠেলাঠেলি, বাহারি পোশাকে হাসিমুখে সাজানো মেয়ে দেখা,সবই তার কাছে বিরক্তির এক প্রবল উৎস। তবুও আজ কেন যেন নিজেকে মানানো যায়নি। হয়ত অভিমানে ছোট ভাইয়ের অভিমানে মোড়ানো কথাটার জন্যই আর না করতে পারেনি সে।
“তুমি না গেলে আমার দিনটাই মাটি হয়ে যাবে ভাই!”
—সেই কণ্ঠের আবদার ফেলতে পারেনি অনুভব। যায় হোক না কেন,সে বুঝতে পারছে—আজ তার আসাটা ছিল একটা ভুল। একেবারে চরম ভুল।
——-
রিমি নিজেকে থামাতে চাইল। বারবার আপনমনেই আওড়ালো,এই কান্না অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন।
কিন্তু কান্না থামে না, বরং আরও বেশি তীব্র হয়ে ফিরে আসে যেন। হঠাৎই মনে হলো—এই কান্নার পেছনে কি অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে আছে? নাহয়, এরূপ পরিস্থিতিতে তো সে অভ্যস্ত ছিল! তবু কেন আজ ব্যতিক্রম হচ্ছে!
পাত্র তো এসেছিল তাকে দেখতে… এখন সে হয়তো ছোটবোনের সঙ্গে বিয়ের কথা বলছে। তার জন্যই কি কান্নার বেগ বাড়ছে! এই ভেবেই তার বুকটা ধক করে উঠল।
তাহলে কি সে… সে তার ছোটবোনকে হিংসা করছে?
ভাবনাটা মাথায় আসতেই রিমি চমকে উঠল। আপন বোন! যার জন্য সবসময় নিজের চেয়ে ভালো কিছু চেয়েছে–তার প্রতি এমন ভাবনা!
নিজেকেই ধিক্কার দিল সে।
“ছি রিমি! এ কী ভাবছিস তুই!”
নিজেকে বুঝ দিতে চাইল—ছোটবোন তো রূপে, গুণে, আচরণে তার চেয়ে অনেক এগিয়ে। ওর এমন একটা পরিবারে বিয়ে হওয়া মানেই তো স্বপ্নপূরণ। এই তো, রিমি সবসময় চেয়েছিল ছোটবোনটা যেন ভালো ঘরে যায়, সুখী হয়।
বাবার আনা শখের প্রস্তাবটা তাকে দিয়ে পূরণ নাহলেও তার রূপবতী ছোট আদরের বোনকে দিয়ে পূরণ হচ্ছে, এই তো সুখ! নিজের এই দ্বন্দ্বময় ভাবনার মাঝে এই ভেবে একটুখানি প্রশান্তির আশ্রয় খুঁজে পায় রিমি।
ড্রয়ইং রুম থেকে আরো একবার হাসির আওয়াজ এলো।হয়ত-বা মা ছোট বোনের সাথে বিয়ের কথা পাকা-পোক্ত করে ফেলেছে। আর করবে না বা কেন! এতো ভালো একটা পরিবার, ছেলে- মেয়ের বিয়ের জন্য সাধারণত সবাই এমনই তো পরিবার খুঁজে। তবু খারাপ লাগলো এই ভেবে যে,রিমি ওখান থেকে চলে আসাতে কারো কিছু যাই আসেনি। তবু সে এতসবের মাঝে ছোটবোনের ভালো ঘরে বিয়ের কথা হওয়াতে প্রশান্তি খুঁজে নিল।
——
অনুভব সিগারেট শেষ করে শেষ অংশটা পা দিয়ে পিষে ফেলল। এই জিনিসটা সে নিজের উপর ক্ষোভ হলে খায়।হাতেগুনা একদম। যদিও পরিবারের কেউ তার এই বিষয়টা জানে না।
অনুভব আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো। ছাদটা ছোট হলেও পরিপাটি। বাঁদিকে টিনের কিনারে সারি দিয়ে রাখা কয়েকটা ফুলের টব—মালতী, জবা, আর এক কোণে একটা অচেনা গাছ। কার হাতের ছোঁয়ায় এত যত্নে গড়া এই সবুজের সারি?
অনুভবের চোখে ভেসে উঠলো এক অদেখা মায়া-মাখা মুখ। যে করেছে সে নিশ্চই খুব যত্ন করে গাছগুলোকে। যে গাছকে যত্ন করে, সে নিশ্চই ভালো মনের। অনুভবের ইচ্ছে আছে, তার খোলামেলা বারান্দায় একদিন কেউ একজন এসে এভাবে গাছ দিয়ে সতেজ বাতাস করে দিবে। পরমুহূর্তে নিজের ভাবনার অদ্ভুততায় আবারও মুচকি হেসে নিল অনুভব। কাজ না থাকলে যা হয়! এখন কোনো কাজ নেই তাই গাছগুলোর পেছনের মালকিনের কথাও তার মাথায় আসছে।
সিগারেটের প্যাকেটটা পকেটে গুঁজে ঘুরে দাঁড়ালো অনুভব। নেমে যাবার জন্য পা বাড়িয়েই ছিল, ঠিক তখনই এক টানা হেঁচকির শব্দ তার কানে এলো। অস্পষ্ট, ভাঙা ভাঙা কান্নার মতো—যেমনটা হয় অনেকক্ষণ ধরে কেউ নিজেকে চেপে ধরে রাখার পর হঠাৎ ভেঙে পড়লে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখে পড়লো—ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। এলোমেলো শাড়ির আঁচল বাতাসে ওড়ছে, মুখটা আড়ালে, কিন্তু কাঁধের কাঁপনে কান্না লুকানো যাচ্ছে না।
অনুভব থমকে গেল। ছাদে ওঠার সময় তো এমন কাউকে দেখেনি সে। হয়ত তখন মেয়েটি দেয়ালের পাশে বসে ছিল, অথবা সেও তার মতোই ভিড় এড়িয়ে এক কোণে গা ঢাকা দিয়েছিল।
এক পা এগিয়ে আবার থেমে গেল অনুভব। আপনমনেই বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“কেন যাব আমি? ওর কান্না থামানোর দায়িত্ব তো আমার না। যার মন চাই কাঁদুক, মরুক—আমার কী!”
অন্য কেউ হলে হয়তো দৌড়ে গিয়ে বলত,
“কাঁদছেন কেন আপনি?”
কিংবা পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ একটা সান্ত্বনার হাত রাখত কাঁধে। কিন্তু অনুভব দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল,
“ওর কান্নার পেছনের কারণ জানার দরকার তো আমার নেই।”
তার এই নিষ্ঠুর প্রশ্নটাই হয়ত তার পরিবারকে বারবার বলে উঠতে বাধ্য করে—
“তুই একটা পাথর।”
সে জানে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা এই কাঁদতে থাকা মেয়েটির কান্না আজ হয়ত কাউকে স্পর্শ করছে না। নয়তো নিচ থেকে এমন হাসির আওয়াজ ভেসে আসতো না। পাষান হৃদয়ের অনুভব চলে আসতে নিলেও থেমে গেল। একটা ক্ষীণ অনুভব তাকে ছুঁয়ে গেল—সে পিছু ফিরে আরেকবার তাকালো। তবুও সে এগিয়ে গেল না। কোনো প্রশ্ন না করে, কোনো উত্তর না খুঁজে অনুভব সামনে ফিরে সিঁড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।
পায়ের ধাপে ধাপে তার ভেতরে যেন একটা অচেনা অপরাধবোধ জমে উঠলো, তবুও মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ানোর মতো মন গললো না তার। এভাবে ছাদে কেউ অসহায়ের মতো কাঁদল, আর অনুভব শুধু দূর থেকে দেখে ফিরে গেল—নিজের মতো করেই, নির্লিপ্ত, নিঃসঙ্গ, আর একফোঁটা হালকা হাওয়া হয়ে।
চলবে।