#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৯
#Esrat_Ety
রাওনাফ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাওনাফ উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। উর্বী আবারও অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আরেকটা দিয়ে যান।”
রাওনাফ নিজের হাত সরিয়ে নিতে গেলে উর্বী হাত ছাড়ে না। ধীরে ধীরে উঠে বসে। রাওনাফের চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে,”চু’মুটা খেয়েছেন কার কপালে?”
রাওনাফ নিশ্চুপ। উর্বী খোঁচা মেরে বলে ওঠে,”আমার কপালে চুমু খাওয়ার সাথে আপনার বাচ্চার সুস্থতার কোনো সম্পর্ক নেই। চু’মুটা খেলেন কেন?”
রাওনাফ আবারও বিছানায় একপাশে বসে পরে। দেখতে থাকে উর্বীকে। উর্বী বলতে থাকে,”এর থেকে আমায় আরো দু’টো চ’ড় মে’রে দিন। তবুও এমন করবেন না আর। ক্ষ’মা চেয়েছি তো! আর দেবো না নিজেকে কষ্ট,দেবো না আপনাকে কষ্ট,করবো না অসম্মান!”
_বুঝতে পেরেছি। ঘুমাও। এতো উত্তেজিত হওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমার বেবির অসুবিধা হবে।
ঠান্ডা গলায় জবাব দিয়ে রাওনাফ পুনরায় উঠে দাঁড়াতেই উর্বী আবারও হাত টেনে ধরে রাওনাফের। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে রাওনাফের দিকে। রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিচুস্বরে উর্বীকে বলে ওঠে,”কি? কেঁদে ফেলবে? কাঁদবে?”
উর্বীর ঠোঁট কাঁপছে। রাওনাফ বলে,”ওয়েট। এখনি কেঁদো না। একটু ওয়েট করো।”
কথাটা বলে রাওনাফ জোর করে উর্বীর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থানরত ট্রি টেবিলের ওপর থেকে টিস্যু বক্স নিয়ে উর্বীর পাশে বসে। উর্বী দেখতে থাকে রাওনাফকে।
রাওনাফ উর্বীর হাতে টিস্যু বক্স ধরিয়ে দিয়ে উর্বীর চোখে চোখ রাখে। স্বাভাবিক গলায় বলতে থাকে,”নাও। এবার শুরু করো। পুরো বক্সটা ইউজ করবে আজ রাতে। দরকার পরলে আরেকটা এনে দেবো।”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”কেনো করছেন!”
_কি করছি!
_কষ্ট দিচ্ছেন!
_আর তুমি কি করেছিলে!
_ক্ষমা চেয়েছি তো।
ব্যাকুলতা উর্বীর কন্ঠে।
_হয়ে গিয়েছে? আপনি ক্ষ’মা চেয়েছেন আর আমি ভুলে যাবো সে বিভীষিকাময় রাত টা! হসপিটালে বাচ্চা মেয়েটা আধমরা হয়ে পরে আছে আর এদিকে স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের জীবন নিয়ে টানাটানি! আশেপাশে,গোটা পৃথিবীতে কেউ ছিলোনা আমাকে সামলানোর জন্য। একা একা সামলেছি নিজেকে। ভুলে যাবো আপনার সামান্য ক্ষ’মা চাওয়াতে?
_শা’স্তি দিচ্ছেন তো,শুধরে নেওয়ার চেষ্টাও তো করছি নিজেকে। আর কি করবো! যা শা’স্তি দেওয়ার একবারে দিয়ে দিন। আমি…আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।
_আমি এটা চাই, আমি ওটা চাই। সবকিছু এখন থেকে আপনার চাওয়াতে হবে না। আমার যখন মনে হবে আপনি পুরোপুরি শুধরেছেন, আপনার মাথায়, মস্তিস্কে কিলবিল করতে থাকা পোকা গুলো নেমে গিয়েছে,যখন বুঝবো আপনার ব্রেইন আসলেই কাজ করতে শুরু করেছে তখন আপনি অবশ্যই আপনার স্বামীকে ফেরত পাবেন। এখন ঘুমান।
উর্বীর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতেই রাওনাফ খামচা মেরে টিস্যু বক্স থেকে একদলা টিস্যু পেপার বের করে উর্বীর গাল মুছিয়ে দেয়। হাই তোলার ভান করে বলতে থাকে,”নিন! আমি উদ্ভোধন করে দিলাম। এখন শুরু করুন আপনার অশ্রু বর্ষণ। আর নিজের টা নিজে মুছে নিন অনুগ্রহ পূর্বক।”
একটু থেমে রাওনাফ বলে ওঠে,”ওয়েট ওয়েট। ব্যাপারটা জমছে না। আরেকটু ইন্টারেস্টিং করতে হবে।”
উর্বী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রাওনাফের কথা শুনে। রাওনাফ হাত বাড়িয়ে বেড সাইডের টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে প্লে লিস্ট থেকে “শ্রাবণের ধারার মতো,পরুক ঝরে।” গানটা ছেড়ে দেয়।
তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”নিন এবার কনটিনিউ করুন কান্না। চোখের সামনে শ্রাবনের ধারার মতো বিরতিহীন অশ্রুবর্ষণের এমন অভূতপূর্ব দৃশ্যের সাথে এই গানটি একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিন নিন শুরু করুন। আরেহ! আপনার চোখের আলগা পানি কোথায়! ফুরিয়ে গিয়েছে নাকি! এতো তাড়াতাড়ি!”
কথাটা বলে রাওনাফ আরেকটা টিস্যু পেপার বের করে উর্বীর হাতে দেয়। উর্বী এক ঝটকায় টিস্যু বক্স টাকে আর ফোনটাকে ঘরের মাঝ বরাবর মেঝেতে ছুড়ে মেরে রাওনাফের দিকে তাকায়। কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”শর্মীর পাপা!”
_জি বলেন!
উর্বী বলতে থাকে,”আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।”
_সময় হলে পাবেন।
উর্বীর ঠোঁট কাঁপছে। ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। নাকের পেশী প্রসারিত আর সংকুচিত হচ্ছে। রাওনাফ একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছে। যদিও তার খুব হাসি পাচ্ছে , কিন্তু সে চেহারায় যথেষ্ট গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,যদি এই মেয়ে কাঁদে তাহলে সে আরো কাঁদিয়ে ছাড়বে। যদি না কাঁদে তাহলে সমস্ত শা’স্তি মওকুফ করে বুকে টেনে নেবে।
উর্বী কিছু বলছে না, নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রানপন চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষমেশ না পেরে কেঁ’দেই দেয়, ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। শাস্তি মওকুফ করা গেলো না এই ভদ্রমহিলার। আজ সারারাত কাদুক।
সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উর্বীর কান্নাকে পাত্তা না দিয়ে ওদিক ফিরে শুয়ে পরে। উর্বী প্রচন্ড আহত হয় রাওনাফের এমন আচরণে।
সাথে সাথে কান্না থামিয়ে দিয়ে সে চোখ মুছে নেয়। চোখ মুখ মুহূর্তেই কঠিন করে সে বিছানা থেকে নামে। রাওনাফ উর্বীর কর্মকাণ্ড আন্দাজ করার চেষ্টা করছে।
উর্বী বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ বলতে থাকে,”ঘরে কোনো ধরণের নাইফ বা ব্লে’ড নেই যেটা দিয়ে নিজেকে আঘাত করা যায়। হাত কে’টে নকশা আঁকা যায়।”
উর্বী কপাল কুঁ’চ’কে ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকা রাওনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে ঘর থেকে বের হবার সিদ্ধান্ত নেয়। রাওনাফ সাথে সাথে উঠে বসে,দ্রুত পা ফেলে উর্বীর কাছে গিয়ে তার হাত টেনে ধরে। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”কোথায় যাচ্ছো!”
_শর্মীদের ঘরে,এখন থেকে ওখানে শোবো।
_ওরা দুবোন একটা বেড শেয়ার করে।
_আমার যায়গা হবে।
_ওদের কষ্ট হবে।
_ঠিকাছে অন্য কোনো রুমে যাচ্ছি তবে।
রাওনাফ উর্বীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে উর্বীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। উর্বী প্রথমে চ’ম’কে উঠলেও সাথে সাথে কেঁ’দে ওঠে। রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,”আবার! এই আমি তোমাকে ছাদের স্টোর রুমে রেখে আসছি বরং।”
কথাটা বলে রাওনাফ ঘরের বাইরে পা রাখতে যাওয়ার আগেই উর্বী দুহাতে রাওনাফের গলা জড়িয়ে ধরে ফোপাতে থাকে। রাওনাফ দাড়িয়ে যায়। উর্বীর চোখের পানিতে তার গ্রীবাদেশ ভিজে যাচ্ছে।
উর্বীকে বিছানায় বসিয়ে দেয় রাওনাফ। কিন্তু উর্বী তার গলা ছাড়ছে না। শক্ত করে জরিয়ে ধরেই কাঁদতে থাকে। রাওনাফ ছাড়াতে চেষ্টা করেও পারেনা। হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে উর্বী।
দু’জনে ওভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকে। কেউ কোনো কথা বলেনা। উর্বী কান্না থামায় না। হঠাৎ রাওনাফের ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট হাঁসি ফুটে ওঠে। ধীরে ধীরে একটা হাত উর্বীর পিঠে এবং আরেকটা হাত উর্বীর মাথায় রাখে।
কিছুক্ষণ উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিচুস্বরে বলে ওঠে,”আর দেবে কষ্ট আমাকে?”
উর্বী জবাব দেয়না। কাঁদতে থাকে। রাওনাফ বলে,”কান্না না থামালে শাস্তির মেয়াদ বারবে।”
উর্বী সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ঝটপট চোখের পানি মোছে। রাওনাফ হেসে ফেলে। উর্বীর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে হাসতে হাসতে বলে ওঠে,”বোকা হাঁসের ছানা।”
উর্বী পুনরায় কেঁদে ওঠে,স্বস্তিতে। রাওনাফ ধ’ম’কের সুরে বলে,”আবার!”
উর্বী কান্না না থামিয়ে আঁটকে আঁটকে বলে ওঠে,
_এই শেষ! আর হবে না!
****
সকাল সকাল নাবিল উঠে গিয়েছে। সে ধীরপায়ে হেঁটে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। গত দু’দিন ধরে হালকা সর্দি জ্বর ছিলো, এখন তার গায়ে একেবারেই জ্বর নেই। কিন্তু জ্বরের থেকেও ভয়ংকর কিছু এসেছে। তার গাল ফুলে গিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা লাগছে। রাওনাফ দেখে বলেছে “মাম্পস”। প্রাথমিক কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ঠিকমতো পরিচর্যা পেলেই সেরে যাবে। নাবিল একদিন যাবত কিছু গিলতে পারছে না। পানি খেতেও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। পানি খাওয়া তো দূর কথা বলতেই তার জান বেড়িয়ে যাচ্ছে।
আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে সে ঘাড়ে একটা মাফলার পেঁচিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি তার টেবিলের ওপর ফটোফ্রেমটার দিকে। এটা খুব ছোটোবেলায় তুলেছিলো তার। তারা তিন ভাইবোন এবং মাম্মা পাপা। শর্মীর বয়স তখন দেড় বছর ছিলো।
ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে নাবিলের ঘোর কাটে। সে ফোনটা তুলে হাতে নেয়। ফ্রেন্ডরা সবাই গ্রুপ কল দিয়েছে। নাবিল কলটা রিসিভ না করে টেক্সট লিখে দেয়,”কান্ট টক! সামহোয়্যাট সিক!”
আমীরুন একবাটি বার্লি নিয়ে নাবিলের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“নাবিল বাবা আসমু ?”
নাবিল মাথা নেড়ে আসতে বলে আমীরুনকে। আমীরুন ঘরে ঢুকে বাটিটা নাবিলের বিছানার পাশের টেবিলে রাখে। নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই বার্লিডা কষ্ট কইরা খাও বাবা। নয়তো শরীরে জোর পাইবা না। এইটা ছাড়া তো অন্যকিছু খাইতেও পারবা না।”
নাবিল মাথা নাড়ায়। তার এখন খাওয়ার ইচ্ছা নেই।
আমীরুন জোর করতে থাকে,”খাও বাবা। ভাইজান শুনলে রাগ করবো!”
নাবিল খাবে না, বাটিটা সরিয়ে দেয়। আমীরুন মুখ ফসকে বলে বসে, “বড়ভাবী অসুস্থ মানুষ কত কষ্ট কইরা বানাইছে শান্ত বাবা,একটু খাইয়া নাও।”
কথাটা বলে আমীরুন জিভ কাটে। উর্বী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কপাল চাপড়াতে থাকে। আমীরুনকে সে যেটা নিষেধ করে দিয়েছে বারংবার,আমীরুন সেটাই করেছে।
নাবিল আমীরুনের কথা শুনেই টেবিলের উপর থেকে বার্লির বাটি উঠিয়ে ফ্লোরে ছুরে মারতে উদ্যত হয়।
“খাবার ওটা। রাগ দেখানোর বস্তু নয়।”
উর্বী কথাটা বলতে বলতে ঘরে ঢোকে। নাবিল থেমে যায়। উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”নিজেকে নিয়ে ভাবুন আপনি। আমার কোনো কাজ করতে হবে না আপনার অসুস্থ শরীর নিয়ে।”
উর্বীর চোখের ইশারায় আমীরুন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। উর্বী গিয়ে বিছানায় একপাশে বসে নাবিলের মুখের দিকে তাকায়। নাবিল নড়চড়ে বসে। উর্বী বলতে থাকে,”তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমার পাপাকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি?”
_দেননি ?
উর্বীর প্রশ্নের সাথে সাথে নাবিল পালটা প্রশ্ন করে কর্কশ কন্ঠে।
উর্বী ম্লান হেসে দৃঢ় ভাবে বলে ওঠে,”না। দিইনি।”
নাবিল উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী বলতে,”আমিতো শুধু তোমার পাপার জীবন থেকে একটু খানি জায়গা নিয়েছি। যেরকম তোমাদের তিন ভাইবোনের জীবন থেকে একটু একটু যায়গা নিতে চাই!”
নাবিল চুপ করে আছে। উর্বী বলতে থাকে,”আমি রাওনাফ করীমের তিন ছানাকে ভয়ংকর পছন্দ করি,স্নেহ করি। কারন দে বিলংস টু রাওনাফ করীম। তাদের দূরে সরিয়ে দেবো?”
কথাটা বলে উর্বী উঠে দাঁড়ায়। বার্লির বাটিটা তুলে নিয়ে নাবিলের একটা হাত ধরে বাটিটা নাবিলের হাতে রাখতে রাখতে বলে,”বাবা,কিছু কিছু সম্পর্কের সমীকরণ কখনও মেলানো যায়না। তোমার আমার সম্পর্কটাও সম্ভবত সেরকম। খেয়ে নাও, নিশ্চিন্ত মনে খাও। তোমাদের পাপা তোমাদেরই আছেন। তিনি একজন শুদ্ধ মানুষ। কারো প্রতি অবিচার করেন না। তোমাদের মাম্মার প্রতিও করেননি। কাল সারারাত তোমাদের পাপা ঘুমাননি। নামাজ আদায় করেছেন, নিভৃতে। তার প্রার্থনায় কে ছিলো তা আমি জানি। তা তুমিও জানো।”
কথাটা বলে উর্বী চলে যায়। নাবিল হাতের বার্লির বাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, একদৃষ্টে।
****
আদালত চত্বরে রাওনাফ গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে এসে দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দেয় উর্বীর দিকে।
উর্বী আতঙ্কিত মুখে তারদিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ তাকে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে বলে,”এসো।”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”শর্মীর পাপা…..”
_আমি আছি।
উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে রাওনাফ বলে। উর্বী রাওনাফের হাতে হাত রেখে গাড়ি থেকে নামে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা পুলিশ ভ্যান এসে আদালত প্রাঙ্গণে থামে। আদালত প্রাঙ্গণে আজ প্রচুর ভিড়। অসংখ্য কেসের শুনানি আজ।
পুলিশ ভ্যানটাকে দেখে উর্বী চ’ম’কে উঠে রাওনাফের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাওনাফ উর্বীর ঘা’ব’ড়ে যাওয়া মুখটা অবলোকন করে পুলিশ ভ্যানের দিকে তাকায়। কনস্টেবল ভ্যান থেকে আসামি নামায়। রাওনাফ নিচু গলায় উর্বীকে বলে,”অন্য কেসের আসামি।”
উর্বী অসহায় ভঙ্গিতে রাওনাফের দিকে তাকায়, রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”মুখোমুখি হতেই হবে।”
কথাটা বলে রাওনাফ উর্বীর হাত ধরে এগিয়ে যায় দালানের দিকে।
এজলাসে প্রায় পঞ্চাশাধিক লোক। গরমে ঘেমে নেয়ে সবাই একাকার। মাথার ওপরে যে ফ্যানগুলো ঘুরছে সেগুলো বাতাস দিচ্ছে কম, আওয়াজ দিচ্ছে বেশি। উর্বীর প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে,ধীরে ধীরে অসুস্থবোধ করছে সে। উচ্ছাসকে এখনও এজালাসে হাজির করা হয়নি । তবে উচ্ছাসের বাবা এসেছে। চুপচাপ নিজের পেছনে দুজন দেহরক্ষী দাড় করিয়ে বসে আছে। মাথা তুলে উর্বীর দিকে এক পলক তাকিয়ে ছিলো,আর তাকায়নি।
বিচারক আসনের মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরছে ঘটরঘটর করে । বিচারক নেই। একাধিক আইনজীবী এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কর্মচারী। বিচারকের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে তাদের আসন। একটি মামলার জন্যই একাধিক আইনজীবী। কে কোন পক্ষের বোঝা মুশকিল। উর্বী কিছুই জানে না। শুধু রাওনাফ একজনের সাথে হ্যান্ডশেক করে কিছুক্ষণ কথা বলেছিলো বিধায় উর্বী বুঝতে পারছে উনি বাদী পক্ষের।
আইনজীবীদের ত্রিপক্ষীয় হট্টগোলে গমগম করছে এজলাস। এমন সময় বিচারক হন্তদন্ত হয়ে এজলাসে প্রবেশ করে নিজ আসন গ্রহণ করে টেবিলে কলম দিয়ে ঠুকঠুক আওয়াজ তুলতেই পুরো এজলাস নিস্তব্ধ হয়ে যায়। দুজন আইনজীবী নিজেরা নিজেরা পরামর্শ করে পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর দীপঙ্করকে ইশারা করে, দীপঙ্কর বেরিয়ে যায় এজলাস থেকে এবং কিছু সময় পরে দু’জন কনস্টেবলকে নিয়ে উচ্ছাসকে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
উর্বী মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে রাওনাফের হাত খামচে ধরে। হঠাৎ উর্বীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে রাওনাফ কাঠগড়ার দিকে তাকাতেই উচ্ছাসকে দেখতে পায়।
রাওনাফের দৃষ্টি শান্ত। সে উচ্ছাসকে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে উর্বীর পিঠে একটা হাত রেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে,”কোনো ভয় নেই।”
উচ্ছাস রাওনাফ আর উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে,চোখের দৃষ্টি কোনো অনূভুতি ব্যক্ত করছে না তার। খুবই শান্ত দু’চোখের চাহনি। পরনে তার সাদা টি-শার্টের ওপরে একটা নেভি ব্লু-শার্ট,বোতাম গুলো একটিও লাগানো নেই। চেহারা দেখে তার ক্লান্তি বোঝার কোনো উপায় নেই, দাঁড়িয়ে আছে টানটান হয়ে।
উর্বী ছ’ট’ফ’ট করছে,সে এখান থেকে যেতে চায়। একটিবারের জন্যও কাঠগড়ার দিকে দৃষ্টি দেয়না সে। রাওনাফ এক হাত দিয়ে আগলে ধরে তাকে।
সকল প্রমানাদি পেশ করা হয়। বিচারক খুবই মনযোগের সাথে ফাইল পড়েন। উচ্ছাসের নামে মোট তিনটি চার্জ ছিলো। হত্যা,হত্যার চেষ্টা এবং নারী নির্যাতন। সকল প্রমানাদি ছানবিন করে বিচারকের রায়ে উচ্ছাসের সর্বমোট ষোলো বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং তার সাথে অর্থ জরিমানা।
উচ্ছাস চুপ চাপ উর্বীর দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাখাওয়াত চৌধুরী দু’চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সাথে সাথে নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে।
হঠাৎ করেই উচ্ছাস এজলাসের সবাইকে ভড়কে দিয়ে হেসে ওঠে পাগলের মতো। বিচারক নিজের কলম সরিয়ে উচ্ছাসের দিকে তাকায়। রাওনাফ চুপচাপ তাকিয়ে আছে উচ্ছাসের দিকে। উচ্ছাস কিছুসময় হেসে জজের দিকে তাকিয়ে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে,”আচ্ছা আপনাদের আইনে বেঈমানের শাস্তি কি? তারা পৃথিবীতে উন্মুক্ত ঘুরে বেড়ায়,সুখী হয় কেন?”
উর্বী মাথা তুলে উচ্ছাসের দিকে তাকায়। উচ্ছাস জজের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে,”বেঈমানের কোনো শাস্তি হয়না?”
উর্বী কাঁপছে। রাওনাফ দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ায়,ভরা এজলাসেই সবার সামনে চেঁ’চি’য়ে উচ্ছাসকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,”জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো স্কা’উন্ড্রেল!”
জজ টেবিলে কলম ঠুকে রাওনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ডক্টর খান এটা কোর্ট! বিহেভ ইওরসেল্ফ!”
রাওনাফ পুনরায় বসে পরে। উর্বী মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচল চে’পে ধরে বসে আছে, তার মাথা ঘুরছে। রাওনাফ উর্বীকে আগলে ধরে। উচ্ছাস পুনরায় বলে ওঠে,”তুমি নিজেও জানো তুমি বেঈমান,তাই চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই তাইনা।”
উর্বী রাওনাফের হাত খামচে ধরে। রাওনাফ আবারও উচ্ছাসের ওপর চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”আফসোস! নিজের অ’সুস্থতা এখন পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারছো না তুমি! আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি নয়তো আমার স্ত্রী কন্যার গাঁয়ে হাত তোলার শা’স্তি আমি নিজে দিতাম!”
জজ রাওনাফকে চুপ করিয়ে দিয়ে কেসের শুনানি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী রাওনাফের বাহুতে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। রাওনাফ তার হাত ধরে আছে।
উচ্ছাস হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে। এজলাসে উপস্থিত সবাই কিছুটা অবাক হয়ে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কনস্টেবল দু’জন এসে উচ্ছাসকে কাঠগড়া থেকে নামিয়ে নেয়। উচ্ছাস বলতে থাকে,”খুব বেশি কষ্ট হয়ে যেতো আমার হয়ে থাকলে উর্বী?”
দীপঙ্কর উঠে গিয়ে উচ্ছাসকে ধরে। টানতে টানতে নিয়ে যায় এজলাসের বাইরে। শাখাওয়াত চৌধুরী উঠে দ্রুত ছেলের কাছে যায়,ছেলের সাথে মুক্ত বাতাসে শেষ সাক্ষাৎ করবে বলে।
উর্বী সেই যে মুখ লুকিয়েছে আর কোনো সাড়াশব্দ করেনি। রাওনাফ ভেবেছে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে তাই সেও ওভাবেই আগলে ধরে রেখেছে।
উচ্ছাসকে এজলাস থেকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে রাওনাফ ধিমি আওয়াজে উর্বীকে ডাকে,”উর্বী।”
উর্বী সাড়া দেয়না। রাওনাফ দুহাতে উর্বীকে নিজের থেকে আলগা করে দুহাতে মুখ আগলে ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে উর্বী অচেতন হয়ে গিয়েছে।
চলমান…….