#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৭
#Esrat_Ety
“তোদের জাংকুক আসবে সামনের ২৫ তারিখ বাংলাদেশে! জানিস তুই শর্মী?”
শর্মীর চোখ খুশিতে চকচক করে ওঠে। পরক্ষনেই অবিশ্বাসের নজরে নাবিলের দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে ধিমি আওয়াজে বলে,”যাও তো! বিরক্ত করো না। এমনিই আমার মুড ভালো নেই!”
নাবিল বলে,”সত্যি বলছি। পাপা তো তোর আর শায়মীর জন্য কনসার্টের টিকিট এনেছে রে! তোরা কি লাকি রে! অনেকেই পায়নি টিকিট!”
নাবিলের বলার ধরনে শর্মী একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করলো যেনো। নাবিল শর্মীর দিকে তাকিয়ে চুকচুক শব্দ করে আফসোস প্রকাশ করে বলে,”লাভ কি! তুই তো ন্যাড়া! এই বেল মাথা নিয়ে নিশ্চয়ই জাংকুকের কনসার্ট দেখতে যেতে পারবি না! জাংকুক ন্যাড়া আর্মি কনসার্টে এলাউ করবে না তার।”
কথাটা বলেই নাবিল খিকখিক করে হাসতে থাকে। শর্মী ক্ষেপে গিয়ে বলে,”জানতাম তুমি মিথ্যা বলছো। যাও তো এখান থেকে ভাইয়া। বিরক্ত করো না।”
নাবিল হাসি থামায় না। বলতে থাকে,”তোকে এখন কেমন লাগছে জানিস? থাক বললাম না।”
_আমাকে যেমন লাগুক। ফাবিয়া আপুকে ভালো লাগলেই হলো। যাও এখান থেকে!
ফাবিয়ার কথা শুনে নাবিল দমে যায়। উর্বী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দুই ভাইবোনের খুনশুটিময় আলাপ শুনছিলো। নাবিলকে দেখে আর সে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে না। উর্বীর ছায়ামূর্তি কেবিনের ভেতরে দৃশ্যমান। শর্মীর চোখ পরতেই নিচু গলায় ডাকে,”কে ওখানে। কে!”
উর্বী কয়েকমূহুর্ত দাঁড়িয়ে থেকে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করে। নাবিল ঘুরে তাকায়। শর্মী উর্বীকে দেখেই চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”আন্টি তুমি এসেছো! আল্লাহ আমি কত বলেছি পাপাকে, কেনো আসোনি আন্টি এতদিন। একটা ফোন দাওনি, আমি সবাইকে কত করে বলেছি আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই ,আমি….”
“ব্যস ব্যস। থামো,এতো কথা বলো না তুমি।”
উর্বী গিয়ে শর্মীর এক হাত আকরে ধরে আরেক হাত শর্মীর মাথায় রাখে।
শর্মী বলতে থাকে,”তুমি ঠিক আছো তো আন্টি!”
উর্বী মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”একেবারেই ঠিক আছি আম্মু।”
নাবিল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। একপলক উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। তারপর কপাল কুঁচকে নিচুস্বরে বলে,”আপনি বসুন।”
সংবেদনশীল বাবার সংবেদনশীল ছেলে বলে কথা। নিজের রাগ আর ক্ষোভকে পাশে রেখে খুবই বিনয়ী হয়েছে উর্বীর প্রতি।
নাবিল চেয়ারটা উর্বীর দিকে ঠেলে দেয়। উর্বী নাবিলের মুখের দিকে তাকায়, তারপর বসে চেয়ারটায়।
শর্মী উর্বীর থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে উর্বীর হাত আগলে ধরতেই দেখে উর্বীর হাতে ব্যান্ডেজ। সাথে সাথে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”আন্টি ঐ লোকটা করেছে তাই না! ঐ লোকটা করেছে এমন..”
উর্বী মাথা নাড়ায়। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে তার। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,”কিচ্ছু হয়নি মা।”
শর্মী কেঁদে ফেলে,মায়া মায়া ফরসা মুখটা রক্তিম হয়ে ওঠে মুহুর্তেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে থাকে,”বাজে লোক! একটা জঘন্য লোক!তোমাকে কোথাও নিয়ে যায়নি তো? যেতে পারেনি তো?”
ছোটোখাটো আদুরে শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে উর্বী কপালে চুমু খেতে থাকে। মাঝখানে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”কোথাও নিতে পারেনি!”
_আর মেরেছিলো খুব আরো?
_নাহ মা।
উর্বী কেঁদে ফেলে।
_তবে এই ব্যান্ডেজ! কি করেছে? কে’টে দিয়েছে!
উর্বী কিছু না বলে শর্মীকে জরিয়ে ধরে ফোপাতে থাকে। শর্মী বলতে থাকে,”পাপা বলেছে। লোকটাকে ছাড়বে না। আর কোনো ভয় নেই।”
উর্বী কাঁদছেই। কোথায় সে চতুর্দশী মেয়েটাকে অভয় দেবে, উল্টো মেয়েটা তাকে অভয় দিচ্ছে। নিজের এতোটা মর্মান্তিক মুহুর্তেও শুধু উর্বীর ক্ষ’তি হওয়া নিয়ে ছটফটাচ্ছে। এই প্রগাঢ় ভালোবাসা সে কেন আরো আগে অনুভব করলো না! কেনো অনুভব করলো না তার জীবনের অংশীদার এই মেয়েটিকে! সে তার জীবনের একক দাবিদার ছিলোনা, অংশীদার ছিলো এই মেয়েটিও যার সাথে উর্বীর কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। মরে গেলে এসব তো কখনও জানা হতো না উর্বীর! জানা হতো না।
নাবিল উর্বী আর শর্মীর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর কেবিনের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
শর্মী উর্বীর শাড়ি খামচে ধরে কাঁদতে থাকে, উর্বী শায়মীর চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। আদুরে গলায় বলে,”আর কোনো ভয় নেই তো! আমি জানি তো! আমার শর্মী আছে। সে আমাকে প্রটেক্ট করবে! এতো শক্তি কোথায় পেলে সেদিন শর্মী? তোমার পাপার বানানো অরেঞ্জ জুস খেয়ে?”
শর্মী হেসে ফেলে। উর্বী আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শর্মীকে। মেয়েটাকে জরিয়ে ধরতে গিয়ে সে টের পেলো গত দিনগুলোর ঝক্কি,গ্লানি সব কর্পুরের মতো উবে যাচ্ছে। শর্মী নিজেকে আরো আরো মিশিয়ে দিচ্ছে উর্বীর গায়ে। বাচ্চাদের মতো আদুরে গলায় বলে,”আমি তোমার একটা সিক্রেট জানি আন্টি।”
উর্বী অবাক হবার মতো করে বলে,”কি সিক্রেট! আমি তো পড়া বাদ দিয়ে জাংকুকের লা’ইভ দেখিনি!”
শর্মী দুহাতে মুখ চেপে হাসছে উর্বীর কথায়। উর্বী বলতে থাকে,”গেটের বাইরে ফুচকার গাড়ি থামিয়ে চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে ফুচকা খাইনি। আমি তো রেজাল্ট কার্ড পাপাকে দেখাবো না তাই আন্টিকে দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সাইন করাইনি! আমি তো ডায়েরীতে জাংকুকের স্টিকার লাগিয়ে রাখিনি। আমার আবার কি সিক্রেট?”
শর্মী খিলখিলিয়ে হাসছে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নাবিল নির্লিপ্ত হয়ে শর্মী আর উর্বীর কথোপকথন শুনছে।
শর্মী লজ্জায় মুখটা লাল লাল করে বলে ওঠে,”তোমার বাবু হবে আন্টি।”
উর্বী দারুণ ল’জ্জা পেয়ে চমকে ওঠে। অস্বস্তিতে ছেয়ে যায় তার চেহারা। মেয়েটা বড় হলেও উর্বীর কাছে বাচ্চাই মনে হয়। তাই অস্বস্তি একটু বেশি।
শর্মী লাল হতেই থাকে লজ্জায়, নিচুস্বরে বলতে থাকে,”লামু আন্টি বলেছে।”
উর্বী চুপ করে থাকে। শর্মী বলতে থাকে,”আরেকটা সিক্রেট বলি আন্টি?”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”কি?”
শর্মী কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,
_আমার ছোটো বাবু খুব খুব পছন্দ।
উর্বীর ইচ্ছে করছে ছুটে কেবিন থেকে পালিয়ে যেতে। লজ্জা হচ্ছে খুব কিন্তু লজ্জা তো কাটিয়ে উঠতেই হবে। সে বলে,”অনেক পছন্দ?”
শর্মী মাথা নাড়ায়। নিচুস্বরে বলতে থাকে,”আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম অন্তরা চাচীর বেবীটা নিয়ে।”
উর্বী নীরব থাকে,শর্মী বলে ওঠে,”আরেকটা সিক্রেট বলবো?”
উর্বী বলে,”কি?”
শর্মী বলে,”আমার ভাই বাবু খুব পছন্দ। ভাই বাবু হলে বেশি ভালোবাসবো।”
উর্বী জ’ড়তা কাটিয়ে শর্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”বোন বাবু পছন্দ নয় কেন?”
_বোন তো আছে আমার।
_ভাইও তো আছে তোমার।
উর্বী বলে।
_ও ভালো না, আমাকে অনেক বিরক্ত করে। একটা ভালো ভাই লাগবে।
উর্বী হেসে ফেলে। শর্মীও হাসতে থাকে। বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেসব কথা শুনছে নাবিল। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শর্মী তাদের থেকেও বেশি উর্বীর ক্লোজ এটা নাবিল টের পাচ্ছে।
পুরো মুখে অস্বস্তি ছেয়ে আছে তার। চোখের সামনে স্বপ্নের সেই দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। পাপা ছোটো বাচ্চাটিকে পরম আদরে কোলে তুলে চুমু খায়,নাবিলের ডাক তার পাপা শুনতে পায়না। গতকাল রাতেও সে স্বপ্নটা দেখেছে। একটা দুঃস্বপ্ন। যেটা খুব শিগগিরই বাস্তব হতে চলেছে। পাপা পুরোপুরি দূরে সরে যাবে তাদের কাছ থেকে, পুরোপুরি। যেটা আবেগী আর মাথামোটা শর্মী বুঝতে পারছে না। নাবিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে,যদি এমন কিছু হয় তাহলে সে অনেক দূরে চলে যাবে। অনেক দূরে।
শর্মী হাসতে হাসতে একপর্যায়ে মুখটা শুকনো করে ফেলে। তার হাত চলে যায় মাথায়। কন্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে বলতে থাকে,”আগামী পরশু ঈদ আন্টি। আমি ন্যাড়া মাথা নিয়ে কিভাবে ঈদ করবো! ওরা এটা কিভাবে করে দিলো।”
উর্বী হেসে শর্মীর দিকে তাকায়, শর্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”এবারের ঈদটা একটু খারাপ হোক। সামনের ঈদে চুলগুলো লম্বা হয়ে যাবে।”
_আন্টি আমাকে ঈদের আগে বাড়িতে নেবে না? আমার ঈদ কি এই হসপিটালে হবে?
উর্বীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই বিষয়ে সে তো ভালো বলতে পারবে না,ডক্টররা জানেন। বাড়িটা শর্মীকে ছাড়া বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
সে শর্মীকে আগলে রেখে বলতে থাকে,”তোমার ঈদ যদি হসপিটালে হয়,খান বাড়ির সবার ঈদ হসপিটালেই হবে।”
****
আজ ঈদের দিন। সকাল বেলাটা শর্মীর কাছে তার জীবনের সবথেকে বিদঘুটে সকাল বেলা। একরাশ বিরক্তি এবং হতাশা নিয়ে কেবিনে বেডে আধশোয়া হয়ে আছে সে। তার বেডের পাশেই একটা বাটিতে ভেজিটেবল স্যুপ আর অরেঞ্জ জুস রাখা। একরাশ অনিহা নিয়ে কয়েক চামচ স্যুপ খেয়ে নিয়েছে সে। নার্স এসে দু’টো ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গিয়েছে। শর্মীর মনটা ক্রমে ক্রমে খারাপ হচ্ছে। আজ ঈদের দিন,সবাই বাড়িতে আর সে এই হসপিটালের কেবিনের মধ্যে থেকে ছ’ট’ফ’ট করছে। রাতে পাপা থাকেনি তার কাছে। না থেকেছে আন্টি,না বাড়ির অন্য কেউ।
পাপা,আন্টি,ভাইয়া,আপু,চাচ্চু-চাচীরা, খালামনিরা কেউ এখন অবধি আসেইনি। অন্যদিন গুলোতে কেউ না কেউ তার সাথে থাকতো। অথচ আজ সে সম্পূর্ণ একা। গায়ে একটা হসপিটালের আকাশী রঙের পোশাক,আকাশী শর্মীর সবথেকে অপছন্দের রং।
মুখ ভার করে বসে আছে সে। আজ যেই আসুক,সে কারো সাথেই কথা বলবে না। সবাই আনন্দ করুক। শর্মীর কথা কারো ভাবতেই হবে না।
ক্ষোভ প্রকাশের মাঝেই দরজার পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় উর্বী। শর্মীর চোখে চোখ পড়তেই শর্মী চোখ সরিয়ে নেয়। উর্বী ভেতরে ঢোকে। তার গাঁয়ে একটা নতুন শাড়ি শর্মী খেয়াল করেছে, তার পেছনে ভেতরে ঢোকে রাওনাফ। রাওনাফের গায়ে একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে মাথায় রাওনাফ পাগড়ি ধরনের একটা বস্তু লাগিয়ে রেখেছে। শর্মী বিষয়টা খেয়াল করলেও পাত্তা দেয় না। রাওনাফের হাতে একটা টিফিন কেরিয়ার আর একটা শপিং ব্যাগ। সে সেগুলো কেবিনের মধ্যে থাকা একটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে শর্মীর দিকে তাকায়। শর্মী মুখ ভার করে রেখেছে। স্বাভাবিক। সকালে ঈদের নামাজ আদায় করে তারপর এসেছে হসপিটালে তারা। একটু দেরীই হয়েছে সবকিছুর আয়োজন করতে গিয়ে।
আজ খানবাড়ির সবাই সিটি মেডিকেয়ারে ঈদ উদযাপন করবে বলে এসেছে। বাড়ির সবাই অন্য ওয়ার্ড গুলোতে ঈদের ফিরনি বিলি করছে,সাথে নানারকম খাবার। হসপিটালে ডিউটিরত নার্স গুলো তাদের সাহায্য করছে।
রাওনাফ শর্মী আর উর্বীর দিকে এক পলক তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
উর্বী ঘুরে শর্মীর দিকে তাকায়। গাল টেনে দিয়ে বলে,”রেগে আছো!”
_আমি ভেবেছি আমার কথা ভুলেই বসে আছো সবাই।
উর্বী হাসে। শপিং ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে শপিং ব্যাগ থেকে একটা ড্রেস বের করে শর্মীর সামনে ধরে। মুখ হাঁসি হাঁসি করে বলে,”তোমার পাপা কিনেছে কাল তোমার জন্য।”
শর্মী ড্রেসটা দেখে ভীষণ খুশি হয়। সে এক্সাক্টলি এই ড্রেসটাই পছন্দ করেছিলো কিন্তু স্টক আউট হয়েছিলো বলে অর্ডার করতে পারেনি। খুশি হয়ে ড্রেসটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে, তারপর নিজের গায়ে রেখে ঘুরে কেবিনের আয়নার দিকে তাকাতেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।
ন্যারা মাথা, মাথায় একপাশে ব্যান্ডেজ। নিজেকে কুশ্রী হিসেবে ভাবার জন্য এই দৃশ্যটিই যথেষ্ট।
উর্বী তা খেয়াল করে। এগিয়ে এসে শর্মীর ড্রেস টা তার হাত থেকে নিয়ে শর্মীকে বেডে বসায়। শর্মীর শুকনো মুখটা উঁচু করে তুলে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শর্মীকে রেডি করিয়ে দিতে থাকে। জামা পাল্টে দিয়ে,হাত মুখ ধুইয়ে গালে ময়েশ্চারাইজার ক্রিম লাগিয়ে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে দেয়। শর্মী চুপচাপ দেখছে,তার একটুও ভালো লাগছে না। উর্বী শর্মীর অনিহা পাত্তা না দিয়ে শর্মীর চোখে আইলাইনার লাগিয়ে দেয়, নখে নেইলপলিশ লাগিয়ে দেয়। সবশেষে উর্বী শর্মীর কপালে একটা টিপ পরিয়ে দেয়। তারপর শর্মীকে ঘুরিয়ে আয়নার সামনে দাড় করায়। শর্মী আয়নার দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে,”টয় স্টোরির মিসেস পটেটো লাগছে আমাকে।”
উর্বী হেসে বলে,”আমার কাছে শর্মীই লাগছে।”
সাজিয়ে দিয়ে শর্মীকে বসিয়ে,তাকে ঈদের ফিরনি খাইয়ে দিতে দিতে উর্বী বলে,”আজ সবাই হসপিটালে ঈদ করবে। আমাদের শর্মীর সাথে। সবাই এসেছে। হসপিটালের ডক্টরস রুম ফাঁকা করে সেটাকে একটা ছোটোখাটো মুভি থিয়েটার বানানো হয়েছে। সবাই মুভি দেখবে ঈদের দিন দুপুরটা।”
শর্মী অবাক হয়ে যায়। উর্বী বলে,”এতো বড় হা করো না মেয়ে। আরো অবাক হওয়া বাকি!”
রাওনাফ এর মাঝে দরজায় নক করে,উর্বী গিয়ে দরজা খুলে দেয়। রাওনাফ এসে শর্মীর সামনে দাঁড়ায়। শর্মী তার পাপার মাথার দিকে তাকিয়ে বলে,”পাগড়ির মতো ঐ বস্তুটা পরে আছো কেনো পাপা! তোমাকে অদ্ভুত লাগছে।”
উর্বী মুচকি মুচকি হাসছে। রাওনাফও হাসে। এর মাঝে কেবিনে ঢোকে শাফিউল আর সামিউল। তাদের পিছু পিছু নাবিল। শর্মী খেয়াল করে সবার মাথাতেই একই ধরণের পাগড়ি। শর্মী যারপরনাই অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকায়।
রাওনাফ ওঠে,”সারপ্রাইজ। ঈদ মোবারক মামনি!”
কথাটা বলেই রাওনাফ এক টানে পাগড়িটা খুলে ফেলে। শর্মী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তার পাপার দিকে। একে একে সবাই নিজেদের মাথার পাগড়ির মতো বস্তুটা খুলে ফেলে। শর্মী বোকার মতো উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী মুখে শাড়ির আঁচল চে’পে ধরে হাসছে।
শর্মী বলে ওঠে,”এসব কি!”
রাওনাফ নিজের ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,”আমরা সবাই শর্মী সেজেছি!”
শর্মীর হতভম্ব ভাব কাটছে না,সে রাগে গজগজ করতে থাকে,”কেনো করেছো এটা। তোমাকে অদ্ভুত লাগছে পাপা।”
রাওনাফ হাসে। মেয়েকে কাছে টেনে জরিয়ে ধরে বলে,”আমার মামনির জন্য করেছি।”
শর্মী কেঁদে ফেলে, তারপর পাপা,চাচাদের ও ভাইকে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পরে সবার দিকে তাকিয়ে শর্মী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে,হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়। তার এখন আর নিজেকে কুশ্রী লাগছে না। উর্বী কেবিনের একপাশে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে সবাইকে। সবার এই সামান্য স্যাক্রিফাইস টুকু শর্মীকে আনন্দ দিচ্ছে। শর্মীর সেই আনন্দ, আনন্দ দিচ্ছে উর্বীকে।
রাওনাফ মেয়েকে ঈদ সালামি দেয়। শর্মী খপ করে টাকাটা নিয়ে পাপাকে জরিয়ে ধরে বলে,”এটা আমার লাইফের সবথেকে বেস্ট ঈদ পাপা। সবথেকে বেস্ট ঈদ।”
এটা সত্যিই অন্যরকম একটি ঈদ ছিলো শর্মীর জীবনে,খান বাড়ির সবার জীবনে। বিগত কয়েকদিনের ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে একটা প্রশান্তিদায়ক ঈদের সকাল।
হসপিটালে দায়িত্বরত নার্স এবং ডক্টররা যারা নিজেদের দায়িত্বপালনের পাশাপাশি ঈদটাকেও উপভোগ করতে পারছে। মোটামুটি সুস্থ রোগীদের ভীষণ উচ্ছসিত লাগছে। একঘেয়েমি ভাব কেটে গেছে সবার।
ডক্টরস রুমে ঈদের দুপুরে সিনেমা দেখার আয়োজন করা হয়েছে। যেটা শর্মীর জন্য ছিলো আরো একটা সারপ্রাইজ। তার মতো অনেক রোগীই এসেছে সিনেমা দেখতে। যারা হাঁটতে পারেন এবং মোটামুটি সুস্থ। রাওনাফের ঘোর আপত্তি থাকলেও পেশেন্টদের বিনোদনের আর্জি জানিয়ে উর্বী এই ব্যবস্থা করেছে।
সবাই পপকর্ন নিয়ে বসে গিয়েছে মুভি দেখতে। সবাই দেখছে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত টেলিফিল্ম “নয় নাম্বার বিপদ সংকেত।”
দুজন ব্লগার এসে সিটি মেডিকেয়ারের ঈদ উপলক্ষে এই আয়োজন পুরোটা ভিডিও করে নিয়ে গিয়েছে।
সবাই খুব আনন্দিত। সবথেকে বেশি আনন্দিত উর্বী। শুধু শরীর নয়,মনটাও তার আগের থেকে বেশ ভালো লাগছে। সে প্রায় ছোটাছুটি করে সব আয়োজন করছে।
রাওনাফ আড়চোখে উর্বীকে দেখে। আগের মতো প্রানচঞ্চলতা খুঁজে পেয়েছে মেয়েটা তা রাওনাফের দৃষ্টিগোচর হয়নি।
মুভি দেখতে দেখতে সবাই মাঝে মাঝে বেশ শব্দ করে হেসে উঠছে। হাসছে শর্মীও। রাওনাফ শর্মীকে বলে,”এতো জোরে হেসো না মামনি। তুমি পুরোপুরি সেরে ওঠোনি।”
শর্মী মাথা নেড়ে মুভিতে মনোযোগ দেয়। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। দু’জনের চোখাচোখি হতেই রাওনাফ চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর খানিকবাদে উর্বীকে বলে ওঠে,”আনন্দ করছো করো। এই শরীরে এতো লম্ফঝম্প করার তো কিছু নেই।”
উর্বী মুচকি মুচকি হাসছে। রাওনাফ অবাক হয়ে বলে,”হাসার কি বললাম?”
উর্বী গলা খাঁকারি দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”না মানে,কেউ একজন বলেছিলো স্বামী হিসেবে সে কোনো অধিকারবোধ দেখাবে না, কিন্তু সে বেখেয়ালে তার কথা রাখতে পারলো না। তাই হাসি পাচ্ছে আমার।”
কথাটা বলে উর্বী নকল হাই তোলার ভান করে। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর কিছুসময় পরে অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”আমার বেবীর জন্য বলেছি। অধিকারবোধ দেখাইনি। আমি আমার বেবির প্রতি কনসার্ন।”
উর্বী আহত হয়, বিরক্ত হয়,রেগে যায়। রাওনাফ পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হসপিটালে ঈদ উপলক্ষে একটা মিলের আয়োজন করা হয়েছে দুপুরে,তার তদারকি করতে যেতে হবে। উর্বী ঠায় বসে থাকে শুকনো মুখে, এখনও হয়নি ডাক্তারের শাস্তি শাস্তি খেলা, এখনও পরেনি ডাক্তারের রাগ। আমীরুন ঠিক বলেছিলো সেদিন, তার ভাইজান আসলেই একটা জিনিস। উপরে উপরে দেখা যায়না। একজন ঠান্ডা মাথার খুনী।
উর্বী চুপচাপ বসে থাকে বিষন্ন ভঙ্গিতে। বিরবির করে বলে,”হৃদয়হীন ডাক্তার।”
চলমান…….