#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৫
#Esrat_Ety
“একটা কথা আপনি একেবারে ঠিক বলেছেন শর্মীর পাপা। আমি বরাবর আমার ভালো থাকাটাকে প্রাধান্য দিয়েছি। বরাবর। আমি যে আপনার মতো স্বার্থহীন মানুষ নই,যে দুহাত ভরে অন্যকে শুধু দিয়েই যায়। আমি শুধু পেতে ভালোবাসি,যতটুকু পেলে একটা জীবন নিয়ে ভালো থাকা যায়। তাই যখন টের পেয়েছি একটা ভুল মানুষের সাথে জরিয়ে গিয়েছি আমি,যার সাথে আর যাই হোক একটা সুস্থ সম্পর্ক আসা করা যায়না। টের পাওয়া মাত্রই তার কাছ থেকে সরে আসতে চেয়েছি। শুধুমাত্র ভালো থাকার জন্যই। তারপর যখন ধ*র্ষিত হলাম, সুই’সা’ইড করার বদলে তখনও আমার মাথায় চলছিলো কিভাবে ভালো থাকা যায়, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ভালো থাকতে। যখন টের পেলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা, তখনও মরার কথা না ভেবে চেষ্টা করেছি ভালো থাকতে। ঐ পরিস্থিতিতে ভালো থাকার মানে ছিলো উচ্ছাসকে বিয়ে করে নেওয়া,বাচ্চাটাকে পিতৃপরিচয় দেওয়া। তাই ভালো থাকতে নিজের আত্মসম্মান দাফন করে একজন রে’পিস্টের কাছে গিয়েছিলাম তাকে বিয়ে করতে। কিন্তু ভালো থাকা তো আমার কপালে লেখা নেই। উচ্ছাসের জেল হলো। আমার উচিৎ ছিলো তখনই আ*ত্মহত্যা করা। কিন্তু আমি যে ভালো থাকার কাঙাল। তাই করলাম কি, পেটের বাচ্চাটাকে মারলাম,অথচ নিজে মরলাম না। কারন আমার ভালো থাকতে হবে। এই ভালো থাকার জন্য কি কি করেছি এই সাতটা বছর আপনি জানেন? আপনাকে বলা হয়নি। কিন্তু থাকিনি ভালো। কত লোকের গঞ্জনা সহ্য করেছি, লাঞ্ছনা সহ্য করেছি দীর্ঘ সাতটা বছর। সাত বছর শর্মীর পাপা। তারপরও আমি হেদিয়ে ম’রেছি একটু ভালো থাকার জন্য। এই পৃথিবীতে কে ভালো থাকতে না চায় বলুন তো? তারপর হঠাৎ করে কিভাবে কিভাবে যেনো একটা জ্যাকপট পেয়ে গেলাম,আমি আপনাকে পেয়ে গেলাম। এতো এতো দিলেন আমায় আপনি। আপনার পরিবার। আরো আরো ভালো থাকার লোভ পেয়ে বসলো আমাকে। এটাও সত্যি যেটুকু আমি সবার জন্য করেছি তাও আমার স্বার্থে, সবকিছুর মধ্যে আমি আমার ভালোথাকা খুজে নিয়েছি। আমি দেখতাম মায়ের যত্ন করলে আমি ভালো থাকছি,তাই মায়ের যত্ন করতাম, দেখতাম শর্মীকে আদর করলে আমি ভালো থাকছি তাই শর্মীকে আদর করতাম,আমি দেখতাম নাবিল শায়মীর মনে নিজের জন্য একটু যায়গা করতে পারলেই আমি ভালো থাকবো,তাই সেই চেষ্টা করতাম। সবকিছুই আমার নিজের ভালোথাকার জন্য। ঠিক বলেছেন আপনি,আমি চাইনি আমার নোংরা অতীত গণহারে সবাই জানুক,তাই উচ্ছাসকে সবার সামনে আসতে দিইনি। লুকিয়ে গিয়েছি। সবটাই ভালো থাকতে। খান বাড়ির সবার চোখে কি পরিমান অযাচিত ভালোবাসা আমি দেখেছি আমার জন্য,ঐ চোখ গুলোতে আমি আমার জন্য ঘৃণা না দেখার চেষ্টা করে গিয়েছি।
আমি চাইনি সাত বছরের ইতিহাসের আমার জীবনে পুনরাবৃত্তি হোক। আবারও দম আটকে রেখে দিন পার করি। ভীষণ দুর্বিষহ ছিলো ঐ দিন গুলো শর্মীর পাপা। গোটা জীবনটাই আমার কে’টেছে কিছু ভুল সিদ্ধান্তে। এখানে অন্য কারো কোনো দোষ নেই। ভুল গুলো করেছি শুধুমাত্র নিজে ভালো থাকতে। নিজের কথাই ভেবেছি শুধু। কিন্তু স্বার্থপরেরা যে ভালো থাকতে পারেনা শর্মীর পাপা।
আপনি ভাবতে পারেন যে চরিত্র ত্রিশেও উন্নত হয়না তার আর কি হবে?
আমার ম’রতে বরাবর ভীষণ ভয় হতো, আজ হঠাৎ নিজেকে খুব সাহসী লাগছে। সাথে আনন্দও হচ্ছে, আমার জীবনের ভুল গুলো আমার জীবনের ফুলগুলোর কষ্টের কারণ হবেনা আর। কারন আমি তো আমি। আমায় ঘৃণা করুন শর্মীর পাপা,আমি চাই আপনি করুন।”
রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে থাকা কাগজটায় চোখ বুলিয়ে রাওনাফ কাগজটা দলা পাকিয়ে হাতের মুঠোয় নেয়। তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। পাশের এরিয়াতে একটা শপিং মল নির্মাণাধীন। নির্মাণ কাজের শব্দে রাওনাফ বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে। তার রীতিমতো মাথা ব্যাথা করছে শব্দে।
“স্যার আসবো?”
রাওনাফ হাতের কাগজটা বিনে ছুঁড়ে ফেলে মাথা ঘুরিয়ে হেড নার্সের দিকে তাকায়,ম্লান হেসে বলে,”এসো।”
আফরিন হাতের ফাইলগুলো রাওনাফের টেবিলের ওপর রেখে বলে,”স্যার রিপোর্ট গুলো।”
রাওনাফ হাত বাড়িয়ে রিপোর্ট গুলো দেখতে থাকে। নার্স আড়চোখে রাওনাফকে দেখছে। তারপর নিচুস্বরে বলে,”স্যার আজ ও.টি. করবেন?”
_হু,কেনো নয়।
রিপোর্টে চোখ বোলাতে বোলাতে বলে রাওনাফ।
_না মানে স্যার,এই পরিস্থিতিতে…
_আফরিন রোগীর জীবন আগে। তারপর সবকিছু।
দৃঢ়ভাবে জবাব দেয় রাওনাফ।
আফরিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,
_আপনার খুব ধৈর্য্য স্যার।
রাওনাফ মৃদু হাসে,বলতে থাকে,”আফরিন জানো,আমার বাচ্চাগুলোকে আমি কখনো ডাক্তারি পড়াবো না। এই পেশাটা একজন মানুষকে মানুষ থাকতে দেয়না,পাথর বানিয়ে দেয়। একটা স্টোন।”
আফরিন চুপ করে থাকে, তারপর বলে ওঠে,”স্যার কফি পাঠাবো?”
_হ্যা,সেটাও জিজ্ঞেস করছো? কড়া করে। যাও নিয়ে এসো।
আফরিন চলে যেতেই লামিয়া ভেতরে ঢোকে। রাওনাফ হেসে বলে,”গুড মর্নিং! কোথা থেকে এলো! আজ তো তোমার ও.টি নেই সকালে।”
লামিয়া বসতে বসতে বলে,”এলাম। তোমার হালচাল দেখতে। হসপিটালটা তো পুরো পারিবারিক হসপিটাল বানিয়ে ফেললে।”
রাওনাফ জবাব দেয়না। লামিয়া বলে,”শর্মীর কেবিন থেকে এলাম। তোমার দুই শ্যালিকার কাছে নালিশ করছে তাকে ন্যাড়া কেনো করা হয়েছে। তার লম্বা লম্বা চুল গুলোর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।”
রাওনাফ হাসে। লামিয়া বলে,”মেয়েটাকে একটু সুস্থ দেখতে কি যে শান্তি লাগছে রাওনাফ। গত পনেরো টা দিন আমি ঘুমাতে পারিনি ঠিকভাবে তুমি জানো!”
রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়, ম্লান হেসে মৃদু স্বরে বলে,”জানি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে আমি চিনি।”
_কোথাও যাচ্ছো তুমি?
লামিয়া রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে। রাওনাফ বলে,”হু। চারশো একে।”
লামিয়া সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। বলে,”আমিও যাবো।”
_না। আমি একাই যেতে চাচ্ছি লামিয়া।
লামিয়া দাঁড়িয়ে যায়। রাওনাফ বলে,”আগে আমার বোঝাপড়া করা দরকার। তোমরা পরে যেও।”
লামিয়া মাথা নাড়ায়। রাওনাফ বলে,”আফরিন এলে তাকে কফি নিয়ে চারশো একে পাঠিয়ে দিও। আমি আসছি।”
****
মেডিসিনের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগছে। গন্ধটা সহ্য করা যাচ্ছে না। উর্বী চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না সে কোথায়। তার কি হয়েছিলো। সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে লম্বা সময়ের একটা ঘুমের মতো লাগছে। সে কি ঘুমিয়েছিলো?
ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দ করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। চোখ খুলে সিলিংয়ের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে এটা তার রুম নয়। তার ঘরের দেয়ালের পেইন্ট ধবধবে সাদা,আকাশী নয়।
উর্বী নড়চড়ে উঠে ডান পাশে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। দেখতে পায় রাওনাফকে। রাওনাফ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ওদিকে ফিরে কফি খাচ্ছে সম্ভবত।
উর্বী চিন্তিত ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকায়। সে কি হসপিটালে? এটা কোন রুম! দরজা খোলা। জানালা থেকে আসা মৃদুমন্দ বাতাসে দরজার সাদা রঙের ফিনফিনে পাতলা পর্দা সমান তালে নড়ছে,উড়ছে।
উর্বী উঠে বসতে যায়। বাম হাতে ভর করে উঠতে গিয়ে হঠাৎ বাম হাতের কব্জিতে প্র’চন্ড ব্যাথা অনুভব করে। তাকিয়ে দেখে তার বাম হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ। তৎক্ষণাৎ উর্বী মাথা ঘুরিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়।
রাওনাফ এক পলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে আবারও ঘুরে জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে কফির মগে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলে ওঠে, “আমি তোমার সাহস দেখে ইম্প্রেসড। সত্যিই মৃদুলা উর্বী,আ’ম রিয়ালি ইম্প্রেসড!
ইউ আর আ জিনিয়াস! না মানে,সুই’সাই’ড করার এতো এতো আরামদায়ক পদ্ধতি থাকতে তুমি র’ক্তার’ক্তির পথ বেঁছে নিলে।
স্লিপিং পিলস খেতে পারতে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ম’রে যেতে। কিন্তু তুমি যে প্রোডাক্টিভ তা বোঝাতে চেয়েছো। আর হাতটাও কেটেছো দারুন ভাবে। একেবারে সোজা করে। আমি স্কেল দিয়ে মেপেছি। দেড় ইঞ্চি। না কম না বেশি! হাউ পারফেক্ট! রিয়ালি ইম্প্রেসিভ!”
উর্বী ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে। রাওনাফ ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নিজের পেটে হাত দেয়।
রাওনাফ সেদিকে তাকিয়ে বলে,”ও ঠিক আছে। আর খবরদার ! ওর কথা তোমার ভাবতে হবে না। ওর জন্য আমি আছি।”
রাওনাফের এই কথাতে উর্বী রাওনাফের মুখের দিকে তাকায়। রাওনাফের এই কথাটিতে তীব্র অভিমান নয়তো ঘৃণা মিশে আছে যা উর্বী টের পাচ্ছে।
উর্বী মাথা নিচু করে বসে থাকে। রাওনাফ দাঁতে দাঁত চেপে ধ’ম’কে বলে ওঠে,”ও আমার বাচ্চা। তোমার কাছে ওর কোনো মূল্য না থাকতে পারে। আমার কাছে আছে।”
উর্বী মাথা তুলে ফুঁপিয়ে ওঠে, আটকে আটকে বলে,”আমি…আমি অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি। আমি আবারও অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি শর্মীর পাপা।”
উর্বীর কান্না রাওনাফকে বিচলিত করে না। সে গিয়ে কেবিনের দরজা ভেতর থেকে লক করে দেয়। তারপর এসে উর্বীর বেডে,উর্বীর মুখোমুখি বসে। উর্বী চোখের পানি মুছে বলে,”ভুল করেছি আমি।”
রাওনাফ উর্বীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,”এখন যে কাজটা করতে চাচ্ছি তাতে পরে অনুশোচনা হয়তো করবো , অ’প’রা’ধ বোধে হয়তো ভুগবো মৃদুলা উর্বী, কিন্তু বর্তমানে আমার মানসিক শান্তির জন্য কাজটা করতেই হচ্ছে আমাকে। তাই আগেই সরি বলে নিচ্ছি।”
উর্বী ঝাপসা চোখে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”কি!”
উর্বী শব্দটা বলে শেষ করার আগেই রাওনাফ সজোরে তার ডান গালে একটা চ’ড় বসিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব উর্বী নিজের ডানগালে হাত চেপে ধরে মাথা ঘুরিয়ে অবাক চোখে রাওনাফের দিকে তাকাতেই রাওনাফ তার বাম গালে আরেকটা চ’ড় মারে, সজোরে।
উর্বী দুইগালে হাত চেপে রাওনাফের চোখের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার গাল দুটো ব্যাথায় টনটন করছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। রাওনাফ ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে,”হাত নামাও গাল থেকে। কিছুই হয়নি তোমার। এতো বড় একটা ব্লান্ডার করেও এখানে নির্লজ্জের মতো বসে আছো জীবিত,সুস্থ শরীরে, তার এই দু’টো থাপ্পড়ে কিছুই হয়নি। হাত নামাও।”
কিছুসময় রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে উর্বী মাথা নিচু করে ফেলে। রাওনাফ চেঁ’চি’য়ে ওঠে,
_ভুল? এটা তোমার কাছে ভুল ছিলো? নি’র্দয় মহিলা!
উর্বী গাল থেকে হাত সরায় না, না রাওনাফের দিকে তাকায়। চোখ বেয়ে আপনা আপনি পানি ঝরছে তার। রাওনাফ এগিয়ে গিয়ে উর্বীর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে তুলে ক্ষ্যাপা কন্ঠে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”স্টপ। আই সেইড স্টপ! এসব ফালতু আবেগ আমার সামনে ঝরিয়ে আর পার পাবে না তুমি! আই সেইড স্টপ।”
উর্বী পুনরায় ফুঁপিয়ে ওঠে, আটকে আটকে বলে,”ভুল করেছি!’
রাওনাফ সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বলতে থাকে,”তুমি স্ত্রী হিসেবে কতটা অযোগ্য তা তো প্রমাণ করেই দিয়েছো। আর আজ প্রমাণ করে দিয়েছো মা হবারও তোমার কোনো যোগ্যতা নেই। তুমি একজন অযোগ্য মানুষ। একটা অপাত্র তুমি। কত বড় সাহস! কত বড় ধৃষ্টতা! তোমার মধ্যে যে আছে সে তোমার একার নয়, আমারও অংশ। কতবড় ধৃষ্টতা তুমি দেখিয়েছো হার্টলেস কোথাকার।”
চেঁচাতে থাকে রাওনাফ।
উর্বী নিজের পেটে হাত রাখে। রাওনাফ উর্বীর হাতটা তার পেট থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে চেঁ’চি’য়ে বলে,”খবরদার বলেছি তো। ওর কথা আর মাথায়ই আনতে হবে না তোমার। তোমার এই ফেক কনসার্ন তুমি ভুলেও আর দেখাবে না। না আমার প্রতি,না আমার বাচ্চার প্রতি। দেখাবে না তোমার এই ফেক কনসার্ন ।”
ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে রাওনাফ বলতে থাকে,”কি শত্রুতা তোমার আমার সাথে? আজ আমাকে একেবারে সন্তান হারাই করে দিতে চাইলে! বলো কি শত্রুতা!”
উর্বী নিস্তেজ কন্ঠে বলতে থাকে,”আমার কি হয়ে গিয়েছিলো আমি জানিনা শর্মীর পাপা….”
_কি হয়ে গিয়েছিলো জানোনা? কচি খুকি তুমি! অথচ ঠান্ডা মাথায় বিশ লাইনের একটা চিঠি লিখে ফেললে!
উর্বী হাপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”শুধু মনে হচ্ছিলো ঐযে দরজার বাইরে পা রেখে চলে গেলেন। ঐ চলে যাওয়াটাই একেবারের জন্য দূরে যাওয়া, আমার থেকে, আমার বাচ্চার থেকে।”
রাওনাফ বেডের একপাশে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পরে,উর্বীর সে কথার উত্তর না দিয়ে বলতে থাকে,”একটা উপকার করবে দয়া করে।”
_কি।
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে। রাওনাফ নিস্তেজ হয়ে বলতে থাকে,”এই বাচ্চাটিকে আমাকে দাও। সে অবধি কষ্ট করে থাকো। তারপর তোমার এই সব “মনে হওয়া” আবেগ অনুভূতি নিয়ে জা’হা’ন্নামে যাও। শুধু দয়া করে আমার বাচ্চাটাকে মেরো না। আমার এটা মনে হয়,আমার ওটা মনে হয়, এসব মনে হওয়া তুমি তোমার কাছেই রেখো!”
উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”কি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম যেদিন হসপিটালে রেডিওলজি বিভাগের প্রধানের থেকে জানলাম আমি বাবা হতে যাচ্ছি আবারও। আমি চাইতাম আমার আর তোমার ভালোবাসায় কেউ জন্মাক। যার কাছ থেকে তুমি মা ডাক শুনতে পারো। একটু সময় নিতে চাচ্ছিলাম যাতে তুমি শারীরিক ভাবে একটু ফিট হও। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছে ছিলো তাই আগেই দিয়েছেন। আল্লাহর এই উপহার আমি অতি সানন্দে গ্রহণ করেছিলাম উর্বী। আর তোমার কাছে সে এতটাই তুচ্ছ হয়ে গেলো!
আরে আমি কাকে কি বলছি! একজন পাষন্ডী নাটকবাজ মহিলাকে,যার কাছে দুনিয়ার লোকজন তাকে কি দিলো, কি বেশি দিলো কি কম দিলো ,সে কার কাছ থেকে কি পেলো শুধু সেটাই ম্যাটার করে আর সে অন্যকে কি দিলো না দিলো তা নিয়ে কখনো ভাবেই না।”
কথাগুলো বলতে বলতে রাওনাফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে, রাওনাফ এবার সরাসরি উর্বীর চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বলে,”দয়া করে বাচ্চাটা জন্মানো পর্যন্ত অপেক্ষা করো কষ্ট করে। তারপর আমি সম্মানের সাথে তোমার সব বর্বরতাকে মেনে নেবো।
তারপর ভুলে যাবো আরেকটিবার আমার জীবনে কেউ এসেছিলো।”
উর্বী রাওনাফকে জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। তার চোখের পানিতে রাওনাফের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে থাকে,”কতটা নিঃস্ব লাগছিলো নিজেকে। আমি তো এই মেয়েটিকে আকরে ধরিনি উর্বী। আমি আকরে ধরেছিলাম কোমল হৃদয়ের একজন নারীকে। এই মেয়েটিকে নয়, যার আমার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। আমাদের বাচ্চার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। যে শুধু নিজের ভালো থাকাটাকে প্রাধান্য দেয়।”
একটু থেমে রাওনাফ আবারও বলে,”একজন স্ত্রীর ভুল হোক বা অন্যায় হোক, একজন স্বামী অভিযোগ তুলবে না? স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এটাও একটা অধিকার! তুমি জানো? তুমি তো আমাকে সেই অধিকারও দিলে না। ভাবতাম তুমি আমাকে সম্মান করোনি,কিন্তু না ভুল আমি। তুমি আমাকে স্বামী বলেই স্বীকার করোনি।”
উর্বী কেঁদে যাচ্ছে। রাওনাফ বলে,”প্রথমে শিমালা এসে চলে গেলো! তারপর তুমি এই স্টেপ নিলে। তোমরা জীবনে আসো কেন বলো তো!”
কথাটা বলতে গিয়ে রাওনাফের গলা কেঁপে ওঠে। উর্বী মাথাটা ঠেকিয়েই রাখে দুহাতে খামচে ধরে মোচরাতে থাকে রাওনাফের শার্ট। রাওনাফ বলতে থাকে,”শর্মী, শুধু বলে যাচ্ছে আন্টি কোথায়। আন্টি কেনো আসছে না। আন্টি ঠিক আছে তো! তুমি একটিবার ওর কথাও ভাবলে না, তোমাকে স্বার্থপর বললেও তো কম বলা হয় উর্বী।”
উর্বী কাঁপছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”আমি বলেছি আমার প্রতিটা সন্তানের সুস্থতা চাই আমি। আর তুমি! কত বড় দুঃসাহস দেখিয়েছো একজন বাবার থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তুমি বি’কৃত মস্তিষ্কের মহিলা। যে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ডিজার্ভই করে না। তোমার উপযুক্ত স্থান পাগলা গারদ।”
উর্বী নিশ্চুপ। রাওনাফ বলে,”ভুল হয়ে গিয়েছে। সত্যিই ভুল হয়ে গিয়েছে। অন্ধের শহরে আয়না বিক্রি করেছি আমি এতদিন। ভুল করেছি। আর তার মাশুল গুনছি আমি।”
একটু থেমে আবারও বলে,”এতটাই ব্যার্থ আমি উর্বী?”
উর্বী রাওনাফের চোখে চোখ রাখে, রাওনাফ কন্ঠে পুনরায় কাঠিন্যতা এনে বলতে থাকে,”কি ভেবেছিলে! আমার সাথে একটার পর একটা অন্যায় করে ভিক্টিম কার্ড প্লে করে পার পেয়ে যাবে? এই ইনোসেন্ট চেহারা,এই চোখের পানি এগুলো দিয়ে কাজ হবেনা উর্বী। আমার তোমার সাথে বোঝাপড়া আছে। তার আগে কোথাও পালাতে পারবে না তুমি। অনেক হয়েছে তোমার ভালো থাকা না থাকার হিসাব। এখন তুমি আমাকে হিসেব দাও। তুমি জীবনে যতটুকু ভালো থাকোনি,তুমি অন্যকে কি রেখেছো? হিসেব দাও আমাকে।”
উর্বী চোখের পানি মোছে। রাওনাফ উর্বীর থুতনি উপরে তুলে বলতে থাকে,”কি চাই তোমার? একটা জীবনে ভালো থাকতে, মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে আর কি চাই? জানি বলতে পারবে না। কারন তুমি পাগল,ব্রেইনলেস মহিলা। তোমার ইনটেনশনই হচ্ছে তুমি তোমার দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটতে থাকবে। কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে গেলে তাকে বলবে,”আরেকটু থাকি!”
তুমি কি চাও তুমি নিজেও জানো না। তবে আমি জানি আমি কি চাই। আমি আমার সন্তান চাই উর্বী। আমি হাতজোড় করছি তোমার কাছে! আমার প্রতি এতোটা নির্দয় হয়ো না।
ওটাই প্রথম,ওটাই শেষ। আর কখনো কোনো অধিকারের ভিত্তিতে তোমার প্রতি অভিযোগ তুলবো না,কথা শোনাবো না, নিজের অনুভূতি জানাবো না, খারাপ লাগা ভালো লাগা শেয়ার করবো না এবং আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে একজন স্বার্থপর স্ত্রীকে তার নিজের মতো করে ছেড়ে দেওয়ার। শুধু বিনিময়ে আমি আমার সন্তানের সুস্থতা চাচ্ছি। একজন বাবা তোমাকে রিকোয়েস্ট করছে,আমার বাচ্চার ক্ষতি করার চেষ্টাও করবে না তুমি।”
চলমান….
#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৬
#Esrat_Ety
দু’জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুসময়ের জন্য পুরো কামরা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। ভেজা গাল দুটো অস্বস্তি দিচ্ছে উর্বীকে।উর্বী হাতের পিঠ দিয়ে গাল মুছে নেয়।
বাইরে থেকে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। রাওনাফ মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। দরজার বাইরে একজন জুনিয়র নার্স দাড়িয়ে,বলে ওঠে,”স্যার ম্যাম….”
“ম্যাম একেবারেই ঠিক আছে আফসানা। তুমি যাও।”
আফসানা রাওনাফের কথায় চলে যায়। কেবিনের বাইরে ইমার্জেন্সি ডেস্কে বসা দুজন নার্স মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। একজন চাপা স্বরে অপরজনকে বলছে,”দরজা বন্ধ করে কি করছেন স্যার!”
আরেকজন নার্স গলা খাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় বলে,”হয়তো স্যার তার ওয়াইফকে জীবনমুখী শিক্ষা দিচ্ছে।”
রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”আমাকে দেখে একটুও অবাক হয়ো না তুমি। এখন আমি হা’র্ট সা’র্জন রাওনাফ করীম খান নই। আমি মৃদুলা উর্বীর স্বামী রাওনাফ করীম খান। এই বন্ধ কামরার ভেতরে আজ কোনো অ’ভিজ্ঞ ডাক্তার কিংবা পে’শেন্ট নয় বরং দুজন স্বামী স্ত্রী আছে উর্বী। কোনো ডাক্তার তোমার সাথে কথা বলছে না,তোমাকে দেখছে না, একজন ডাক্তারের চোখে তুমি সহানুভূতি ডিজার্ভ করো এই অবস্থায়, কিন্তু একজন স্বামী নিজের বিধ্বস্ত অনূভুতি পাশে সরিয়ে রেখে তোমাকে দেখবে না। এতোটা মহান ভেবো না আমাকে। বোঝাপড়া দুজন স্বামী স্ত্রীর হচ্ছে, অনুভূতির দ্বন্দ দুজন স্বামী স্ত্রীর হচ্ছে।”
উর্বী চুপ করে আছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”চলো হিসেব শুরু করি। তুমি গত সাত বছরে অনেক কিছু সহ্য করেছো উর্বী। আমি জানি! যেগুলোর সিকিভাগও আমি সহ্য করিনি জীবনে। গত কয়েকদিনে তোমার ওপর দিয়ে কি বয়ে গিয়েছে আমি সব জানি উর্বী। কোনো কিছুই আমার অবগতি, উপলব্ধির বাইরে নয়।
কিন্তু তুমি জানো না উর্বী,এতো কিছু সহ্য করার পরেও যে মেয়েটা কখনো সুই’সা’ইডের কথা মাথায় আনেনি সে মেয়েটা শুধুমাত্র কিছু ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে,কিছু ভুল ধারণাকে আকরে ধরে নিজের জীবনটা খোয়াতে বসেছিলো। শুধু নিজের জীবন নয়,সাথে আরো একটা প্রাণ।
উর্বী তোমার ধারণা গুলো যদি সত্যি হতো তাহলে আমি বিন্দুমাত্র আফসোস করতাম না,কিন্তু তোমার ধারণা সব ভুল উর্বী। ওটা বিতৃষ্ণা ছিলো না মৃদুলা উর্বী, ওটা একজন স্বামীর অধিকারবোধ ছিলো স্ত্রীর প্রতি। অধিকারবোধ কখনো বিতৃষ্ণা হতে পারে না। আমি তো প্রশ্ন তুলেছিলাম কেনো আমাকে ভরসা করতে পারলে না। সেটা কিভাবে তুমি বিতৃষ্ণা ধরে নিলে? উর্বী আমি একটা রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। আমি যদি তোমার মনের মতো প্রতিক্রিয়াই দিই তবে আমার স্বকীয়তা কোথায়? একজন মানুষ কখনও আরেকজন মানুষের মনের মতো সাডেন রিয়াক্ট চাইলেও করতে পারে না,তবে অপর মানুষটা চাইলেই বোঝার চেষ্টা করতে পারে। যেটা তুমি করোনি।
কি? এখন নিশ্চয়ই এটা বলবে যে আমি কেবল আমার বাচ্চার কথাই ভেবেছি, বাচ্চার কথা ভেবে তোমার জন্য কষ্ট পেয়েছি । কারন আমি শুধু বাচ্চার প্রতিই কনসার্ন দেখাচ্ছি। তোমার এই পরিস্থিতিতেও আমি শুধু বাচ্চা বাচ্চা করছি। বাচ্চাটা না থাকলে এতটা কনসার্ন দেখাতাম না। এটাই বলবে তো তাইনা? বলো ,বলো, ট্রাস্ট মি উর্বী! আমি একটুও অবাক হবো না তুমি এখন এমন বললে। কারন তোমার চরিত্র অনুযায়ীই তো তুমি বলবে।”
উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”হ্যা,এটা যদি তুমি বলো তাহলে ঠিকই বলবে,কারন সত্যিই আমার কনসার্ন শুধু আমার বাচ্চার জন্যই। আমি কোনো মৃদুলা উর্বীকে নিয়ে ভাবিই না। আমি খুব খারাপ একজন স্বামী,যাকে ভরসা করা যায়না।”
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়, নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে,”আমি এমন কিছু ভাবিই নি। আমি তো বললাম, চিঠিতে লিখলাম, আমি বেঁচে থাকলে এমন ভুল হতেই থাকবে, আর আমার জীবনের ফুলগুলো কষ্ট পাবে তাই….”
_আর মরে গেলে? মরে গেলে ফুলগুলো আর কষ্ট পাবে না? অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল। এমন হবে? তাইতো?
উর্বী রাওনাফের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কিছু বলতে যাবে তখনই রাওনাফ উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“শর্মী….উর্বী শর্মীর কষ্ট তোমার জন্য, তোমার ভুলের জন্য হয়েছে কি হয়নি সেই যুক্তিতর্কে যেতে চাচ্ছি না। আমি শুধু জানি শর্মীর এই অবস্থার জন্য মৃদুলা উর্বী কিছুটা হলেও দায়ী থাকলেও একজন মা কখনও দায়ী নয়। উর্বী আমি তো অনেকদিন আগে থেকেই এমন ভেবে ফেলেছি। তুমি ভাবতে বাধ্য করেছো। সেখানে আমি একজন মা উর্বীকে কিভাবে দোষারোপ করবো? এতোটা ধৃষ্টতা আমার নেই! আমি তো অভিযোগ করেছি আমার স্ত্রী উর্বীকে! সেটুকু কি আমার অধিকারের মধ্যে পরেনা উর্বী?”
উর্বীর দু’চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে। মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”পরে।”
_অভিযোগের ধরনটা ভুল ছিলো,নাকি তোমার বোঝাটা ভুল সেগুলো নিয়েও যুক্তিতর্কে যাবো না। কিন্তু উর্বী,তুমি গোটা ব্যাপারটা যাস্ট “আমি আবারও ভুল করেছি শর্মীর পাপা!” বলে শেষ করে দিলে!
তোমার একটা ভুলে,আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো উর্বী। পুরোটা সময় ছ’ট’ফ’ট করেছি,বলেছি উর্বী শুধু আমাকে ভুল বুঝে যেও না। তোমার কাছে আমার অসহায় অনুভূতির সমর্পণকে তুমি আমার বিতৃষ্ণার বহিঃপ্রকাশ ভেবে চলে যেও না। আমি কখনো অভিযোগ তুলবো না,যত ইচ্ছে বোকামি করো!”
উর্বী পুনরায় ফুঁপিয়ে ওঠে। মাথাটা রাওনাফের গায়ে ঠেকিয়ে বলতে থাকে,”ক্ষমা চাচ্ছি।”
রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজের হাতের দিকে তাকায়। তারপর বলে,”একটা সময় মনে হয়েছে তুমি নেই! চলে গিয়েছো। সব শেষ,আমি হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে!”
রাওনাফের সে কথায় উর্বী টের পায়,কি প্রগাঢ় ভালোবাসা উর্বী হারাতে বসেছিলো অভিমানের বসে। পোড়াকপালি। কপাল তো আজীবনেরই পোড়া। সে নিজেই কি না বাকি টা শেষ করে দিচ্ছিলো। তার সাথে যে তার মধ্যে বেড়ে উঠছিলো,তাকেও কি না! আবারো সেই একই মহাপাপ। সে কত জঘ’ন্য!
উর্বী হাউমাউ করে কেঁদে বলতে থাকে,”পাপ করেছি আমি। মহাপাপ।”
রাওনাফ উর্বীর গাল দুটো ধরে,নরম গলায় বলে,”কাঁদতে হবে না। এবার একটু থামো! এটা ছাড়া কি আর কিছুই পারো না তুমি? থামো এবার। থামো! ”
রাওনাফ পুনরায় নিজের হাতের দিকে তাকায়। তারপর অসহায়ের মতো উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর বলে,”আমি কঠোর হয়ে থাকতে পারিনা উর্বী। চাইলেও পারিনা। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি,আর কখনো কোনো ধরণের অধিকারবোধ দেখাবো না,যা তোমাকে অস্বস্তি দেয়। ”
উর্বী বেডের চাদর খামচে ধরে। কন্ঠে আকুতি নিয়ে বলে,
_কেনো দেখাবেন না! একশো বার দেখাবেন! হাজার বার দেখাবেন! আমি ক্ষমা চাইছি তো!
রাওনাফ তাকিয়ে থাকে। উর্বী বলতে থাকে,”ক্ষমা করে দিন আমাকে! ক্ষমা করে দিন না। আমি প্রমিজ করছি, আজকের পর থেকে আমি আর কোনো ভুল করবো না যা আপনাকে কষ্ট দেয়! আমার জীবনের ওপর আপনার,আপনাদের পূর্ণ অধিকার আছে! আপনারাও এই জীবনের দাবিদার। প্রমিজ করছি আপনাদের অনুমতি ব্যাতীত এই জীবনকে আর কষ্ট দেবো না আমি।”
রাওনাফ চোখ সরিয়ে নেয়। অবিশ্বাস আর অভিমানে। উর্বী তা বুঝতে পারে। দু হাতে রাওনাফের গাল আগলে ধরে মুখটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। তারপর কাতর কন্ঠে বলে,”শর্মীর পাপা!”
রাওনাফ হাত মুঠো করে ফেলে। ভেতরটা অনুভূতি তোলপাড় করলেও বাইরে কাঠিন্যতা বজায় রেখে চুপ করে থাকে। উর্বী পুড়ছে। অ’প’রা’ধ বোধ হচ্ছে তার ভীষণ। নরম গলায় বলে,”একজন সুই’সা’ইডের পেশেন্টকে চ’ড় মারা,এখন তার থেকেই মুখ ঘুরিয়ে থাকা। অযোগ্য ডাক্তার ,আপনিও যে খুব হৃদয়হীন। আমার মতো হৃদয়হীনার সাথে পাল্লা দিতে চাচ্ছেন নাকি!”
রাওনাফ নিজের গাল থেকে উর্বীর হাত সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”সাত বছর। সাতবছর তুমি মানুষের গঞ্জনা শুনে কাটিয়েছো উর্বী। আর গত চব্বিশটা ঘন্টা আমি নিজে নিজেকে গঞ্জনা দিয়েছি। ঐ সাত বছর আর এই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই উর্বী!”
উর্বী ঢোক গিলে নেয়। রাওনাফ ধীরে ধীরে নিজের হাতটা উর্বীর গালে রাখে। কাঁপা গলায় বলে,”তুমি মুখে বললেও তুমি এখনও এটাই মানো তুমি তোমার জীবনের একক দাবিদার। সেখানে অন্যকারো কোনো অংশ নেই!”
_না মানি না,যখন আপনি আমাকে চ’ড় মেরেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি আপনার প্রতি করা আমার অবিচারের পরিমাণ উপলদ্ধি করেছি। আমি একটুও নারাজ হইনি ঐ সময়টায়। বরং আমি আমার স্বামীকে অনুভব করতে পেরেছি।
রাওনাফ উর্বীকে কাছে টানে । দু’হাতে আঁকড়ে ধরে দুই গালে অগণিত চু’মু দিতে থাকে। পরম স্পর্শে শিক্ত হয়েও উর্বী স্বস্তি পাচ্ছেনা। মানুষটা তাকে ক্ষমা করতে পেরেছে তো! দু’চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলতে থাকে,”নিজেকে আরেকটি বার শুধরে নিতে আপনার সাহায্য দরকার। কথা দিচ্ছি, নতুন উর্বীকে পাবেন।”
রাওনাফ চু’মু দিয়ে ভরিয়ে দেয় উর্বীর দুই গাল। তারপর উর্বীর দুই গাল হাত দিয়ে আগলে ধরে উর্বীর চোখে চোখ রাখে,বলে,”বাড়িয়ে ছিলাম হাত সাহায্যের জন্য। তুমিই নিলে না। এখন একা একাই করতে হবে তোমাকে।”
উর্বী আহত হয়, রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তবে কেন বলেছিলেন “আমি আছি,আমি থাকবো!”
রাওনাফ বলে,”সেটা এখনও বলছি। বরাবর বলবো,”আমি আছি, আমি থাকবো।” কিন্তু পুরনো উর্বীকে ভাঙতে হবে তোমায় নিজের,গড়তে হবে নিজের।”
উর্বী নিজের অসহায় অনুভূতি ঢাকতে শুকনো হাসি হাসে। মানুষটার এহেন আচরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। উর্বী বুঝতে পারছে উর্বীকে একটা লম্বা জার্নি শেষ করতে হবে উর্বীর জীবনে মানুষটার গুরুত্ব কতখানি এটা মানুষটাকে বোঝাতে। তার জীবনে মানুষটার দাবি আছে,অংশের মালিকানা আছে এটা মানুষটাকে বোঝাতে তাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে।
উর্বী চোখ মোছে। রাওনাফ গাল থেকে হাত সরিয়ে নেয়,উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”এ কদিনে বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন আপনি শর্মীর পাপা।”
রাওনাফ ম্লান হাসে। বলে,”তোমাকেও কোনো তেইশের তরুণী লাগছে না মৃদুলা উর্বী।”
উর্বী হাসে। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে নেয়। বাইরে থেকে আবারও দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। রাওনাফ বলে,”আফসানা তোমাদের ম্যাম ঠিক আছে।”
_স্যার, আপনার মা এসেছে।
রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”সবাইকে তোমার নিজের ফেস করতে হবে। আমার কিছু করার নেই। আমি চাই তুমি অ’প’রা’ধ বোধে ভোগো।”
রাওনাফ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয় কেবিনের। রওশান আরা কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে মোহনা এবং অন্তরা। রাওনাফ তাদের কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
****
রওশান আরা উর্বীর মুখোমুখি বসে আছে। উর্বী মাথা নিচু করে বসে আছে। তার এই মুহূর্তে তার শাশুড়ির দিকে তাকানোর সাহস নেই।
অন্তরা আর মোহনা তাদের শাশুড়ি ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
রওশান আরা উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তরাকে ডাকে,”ছোটো বৌমা।”
অন্তরা দ্রুত উত্তর দেয়,”জ্বী মা।”
“তুমি আজ কালের মধ্যেই সামিউলের ওখানে চলে যাবে। ছেলেটা একা পরে আছে। এখানটা বড় বৌমা দেখবে। সে তো সুস্থ হয়ে গিয়েছে। মেজো বৌমা তুমিও চট্টগ্রাম চলে যাবে। তোমার বড় জা পুরোপুরি সুস্থ।”
অন্তরা তার শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়,”মা ভাবীর এই সময়ে আমি….?”
_এই সময়ে মানে? পোয়াতি হয়েছে। তাতে কি হয়েছে? আমরা বাচ্চা পেটে নিয়ে সংসার দেখিনি? এখনকার যুগের বৌরা আরাম পেয়ে পেয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছো। বেশি আরামে থাকলে অলস মষ্তিস্কে শয়তান বাসা বাধে। তোমার বড় জা এর ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই হয়েছে। তুমি কালই রাজশাহী যাবে। মেজো বৌ চট্টগ্রাম।এদিকটা বড় বৌমা দেখবে।
উর্বী তার শাশুড়ির দিকে তাকায়, নরম গলায় বলে,”মা….”
রওশান আরা তার উত্তর না দিয়ে রাওনাফকে ডাকে।
“এই রাওনাফ,বাড়ি নিবি কখন বৌমাকে। তোর হসপিটালে তো রোগীর চেয়ে তোর ফ্যামিলির লোকজনই আস্তানা গেরে বসে থাকে বারো মাস। এই রাওনাফ,বৌমা কি খাবে ? আমার নাতির তো খাওয়ার সময় হয়েছে নাকি!”
উর্বী আবারও ডাকে,”মা।”
রওশান আরা শুনেও না শোনার ভান করে চুপ করে থাকে। উর্বীর ডাকে সাড়া দেয় না। উর্বী আকুল হয়ে ডাকতে থাকে,”মা। আপনি অন্তত এমন করতে পারেন না।”
_আর তুমি করতে পারো বৌমা?
উর্বীর দিকে সরাসরি তাকিয়ে রওশান আরা বলে। উর্বী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, রওশান আরা বলতে থাকে,”তোমার জন্য আমার কষ্ট হয়েছে ভেবো না। আমার শুধু আমার নাতী-নাতনির জন্য কষ্ট হয়েছে। আমার নিজের জন্য কষ্ট হয়েছে। একদিন তোমাকে এ বাড়িতে এনে আমি যাদের কষ্ট দিয়েছি, তারা আজ আবারও কষ্ট পাচ্ছে তুমি চলে যাচ্ছিলে বলে। আমি সেই নাতনিদের জন্য কষ্ট পাচ্ছি।”
এ পর্যন্ত বলে রওশান আরা থামে। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,”দাদু ভেতরে এসো।”
উর্বী দরজার দিকে তাকায়। দরজার পর্দাটা ধীরে ধীরে সরিয়ে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢোকে শায়মী। ধীরপায়ে হেঁটে এসে সে বেডের সামনে দাঁড়ায়। রওশান আরা উঠে দাঁড়ায়, মোহনা আর অন্তরা শাশুড়িকে ধরে ধরে নিয়ে যায়।
শায়মী মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ তুলে তাকায় না উর্বীর দিকে। উর্বী নরম গলায় বলে,”শায়মী তাকাও।”
শায়মী তবুও দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। উর্বী আবারও বলে,”তাকাও শায়মী।”
শায়মী এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায়। তার দু’চোখ ভর্তি পানি। উর্বী একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শায়মী চোখ বন্ধ করে ফেলে। পানি গড়িয়ে পরে বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে। উর্বী কিছু বলেনা, তার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
কিছুসময় দু’জনেই চুপচাপ, উর্বী বলে,”শাস্তি দেবে পাপা আর দাদুর মতো? মুখ ঘুরিয়ে রেখে আমার থেকে?”
শায়মী ছুটে গিয়ে উর্বীকে জরিয়ে ধরে। ক্লান্ত শরীরে উর্বী শক্তি ফিরে পায়। ডানহাতে আগলে ধরে অভিমানী সপ্তদশীকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। শায়মী কাঁদছে, শব্দহীন কান্না। একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে সে।
****
শেফালী নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়ার্ড বয় এসে উচ্ছাসকে একটা শার্ট পরিয়ে দিয়ে যায়। উচ্ছাস বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে।
শাখাওয়াত চৌধুরী জানালার কাছ থেকে সরে আসে। শেফালী হাতের খাবারটা ছেলের মুখের সামনে তুলে ধরে,বলে,”তোর মনে আছে আমার হাতের হালুয়া খাওয়ার জন্য তুই সবসময় কেমন পাগলামি করতিস!”
উচ্ছাস ম্লান হেসে খাবারটা মুখে নিয়ে খায়। শাখাওয়াত চৌধুরী একটা চেয়ার টেনে উচ্ছাসের সামনে বসে। উচ্ছাস বাবার দিকে তাকায়। শাখাওয়াত চৌধুরী বলতে থাকে,”সামনের সপ্তাহে রায় ঘোষণা হবে।”
উচ্ছাস অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বলে,”ভালো কথা।”
শেফালী আগের মতো হুহু করে কেঁ’দে ওঠে না,খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিজের নিয়তিকে মেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের আদরের ছেলের মুখ মুছিয়ে দিতে থাকে।
শাখাওয়াত চৌধুরী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”কেনো করলে!”
উচ্ছাস বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে, মুহূর্তেই বুকের ডান পাশে যন্ত্রনা অনুভব করে। হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ চেপে ধরে যন্ত্রনাটুকু হজম করে। খানিক বাদে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,”কখনও ভালো ছেলেও হতে পারিনি, না হতে পেরেছি ভালো প্রেমিক। ভাবলাম সেরা খারাপ মানুষ হই।”
উচ্ছাস হাসতে হাসতে হেলান দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। শাখাওয়াত চৌধুরী অসহায়ের মতো ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শেফালী ছুটে কেবিন থেকে বেরিয়ে শাড়ির আঁচল মুখে চে’পে ধরে কাঁদছে।
কেবিনের বাইরে পাহারা দিতে থাকা কনস্টেবল দু’জন তাকে দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে।
***
“ম্যাম আপনি এখানে!”
নার্সের ডাকে উর্বী পিছু ফিরে তাকায়। নার্স মেয়েটা উর্বীর কাছে এগিয়ে এসে বলে,”ম্যাম কোথায় যাচ্ছেন আপনি!”
উর্বী আশেপাশে তাকিয়ে বলে,”তিনতলায়। শর্মীর কাছে।”
_ক্ষেপেছেন ম্যাম? স্যার জানতে পারলে আমি বকা খাবো। আপনি কেবিনে চলুন।
_কিচ্ছু হবে না। তোমার স্যারের সব বকা আমি খেয়ে নেবো। আমি একটু যাই শর্মীর কাছে।
নার্স উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বীর কন্ঠে অনুরোধের সুর।
“এখন কেন যেতে চাইছো!”
রাওনাফের কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে দু’জনেই। রাওনাফ দাড়িয়ে আছে তাদের পেছনেই। উর্বী মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। রাওনাফ নার্সের দিকে একপলক তাকায়। নার্স চলে যায়। মাথা ঘুরিয়ে উর্বীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে রাওনাফ। তারপর বলে,”এখন কেনো শর্মীকে দেখতে যেতে চাইছো!”
উর্বীর অভিমান হয়। টানা একটা দিন কঠিন কঠিন কথা শুনিয়েও মন ভরেনি। এখন রাতদুপুরে এসেছে কথা শোনাতে। উর্বীর ইচ্ছে করলো দুটো কথা শুনিয়ে দিতে, ইচ্ছে করলো বলতে, হার্ট সার্জন আপনার নিজের হার্ট কই? কিন্তু সে বললো না,নিজেকে শুধরে নিয়ে নিজেকে নিজে বললো,”মেনে নে উর্বী। তুই দোষী। এই গোস্বা টুকু মেনে নে।”
চোখ সরিয়ে নিচু গলায় উত্তর দেয়,”মরলে তো সব চুকেই যেতো। যেহেতু মরিনি তাই আমি আমার মেয়ের কাছে যাচ্ছি।”
কথাটা বলেই উর্বী ধীরপায়ে হেঁটে চলে যায়। রাওনাফ দাড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
চলমান…….