#আরেকটি_বারন
#পর্বসংখ্যা_৩৩
#Esrat_Ety
উর্বী শর্মীর মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে। রওশান আরা শর্মীর পায়ের কাছে বসে আহাজারি করছে। শর্মীর পুরো শরীরটা এর মাঝে একবার ঝাঁকুনি দিয়ে পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে যায়।
উচ্ছাস কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। সে এটা ইচ্ছে করে করেনি। কয়েক মুহূর্ত নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা লম্বা পা ফেলে নিচে নামতে থাকে সে, হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে, সজীব ফোন দিচ্ছে।
সে ফোনটা রিসিভ না করে উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। উর্বীর হাত টেনে ধরে বলে,”চলো ওঠো।”
উর্বী উচ্ছাসের দিকে তাকায়। ক্রন্দনরত অবস্থায় চেঁ’চি’য়ে বলে ওঠে,”ব্যাথা দিলি। আমার মেয়েটাকে তুই ব্যাথা দিলি জা’নোয়ার।”
উচ্ছাস উর্বীর কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে উর্বীকে টানছে। উর্বী শর্মীকে ছেড়ে উচ্ছাসের দিকে হিংস্র দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। তার চোখ দিয়ে আর পানি বেরোচ্ছে না, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে উঠে ছুটে চলে যায় ডাইনিং টেবিলের কাছে,ফলের ঝুড়ি থেকে ছুড়িটা এনে উচ্ছাসকে আঘাত করার চেষ্টা করতেই উচ্ছাস উর্বীর হাত ধরে ফেলে। একটানে উর্বীকে ঘুরিয়ে হাত থেকে ছুড়িটা ফেলে বলতে থাকে,”এতো বাড়াবাড়ি করো না। তোমার শরীর ঠিক নেই।”
উর্বী উচ্ছাসের হাত কা’মড়ে নিজেকে উচ্ছাসের হাতের বাঁধন থেকে আলগা করার চেষ্টা করেও পারলো না। শরীরে যে আর তার কোনো জোর নেই! উচ্ছাস বলতে থাকে,”যখন মন চাইবে আসবি,যখন মন চাইবে চলে যাবি তাইনা? আজ তোকে না নিতে পারলে তোর লা’শ নেবো আমি। তুই আমার না,তবে তুই কারো না।”
উর্বী অসহায়ের মতো শর্মীর দিকে তাকায়। কিভাবে অচেতন হয়ে পরে আছে মেয়েটা। ওকে হসপিটালে নিতে হবে, এক্ষুনি,এই মুহূর্তে। রওশান আরা নাতনিকে আগলে ধরে কেঁদে যাচ্ছে এখন। উর্বীদের দিকে তার কোনো খেয়াল নেই আর। তিনি নাতনি শোকে কাতর।
উর্বীর নিজের শারীরিক অবস্থাও খুব খারাপ। যেকোনো মুহূর্তে মাথা ঘুরে পরে যেতে পারে তবুও সে শরীরের সবটুকু শক্তি খরচ করে উচ্ছাসের থেকে ছাড়া পেতে চায়।
উচ্ছাস বলতে থাকে,”বারো ভা*তারী কোথাকার! এক পুরুষে হয়না তাইনা ? কেনো ছেড়ে যেতে চেয়েছিলি বল! বেশি ভালবাসতাম সেটা সহ্য হতো না? আমি জেলে যাওয়ার পরে কেন অপেক্ষা করলি না! নতুন পুরুষের স্বাদ নিতে বিয়ে করে নিলি!”
উর্বী কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে এক সময় নিস্তেজ হয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে,উচ্ছাসের পা জরিয়ে ধরে বলতে থাকে,”উচ্ছাস দয়া করো। আমার মেয়েটা ম’রে যাবে। ওকে হসপিটাল নিতে হবে। দয়া করো।”
উচ্ছাস উর্বীকে টেনে দাঁড় করিয়ে চুলের মুঠি ধরে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে,”কেনো দয়া করবো? আমি তো কীট! কোনো দয়া হবে না।”
উর্বীর দম আঁটকে আসছে। তার কাতরতা দেখে উচ্ছাস হঠাৎ অন্যরকম হয়ে যায়,চুলের মুঠি থেকে হাত সরিয়ে নরম গলায় বলে ওঠে,”পাখি দেখো আমি তোমাকে একটুও ব্যাথা দিতে চাই না। তবুও বারবার দিয়ে ফেলি। আমি খারাপ। তুমি আমাকে মারো। মারো আমাকে।”
এই বলে উর্বীর হাত টেনে নিজের গালে নিজে চ’ড় মারতে থাকে উচ্ছাস, মুহূর্তেই মুখটা কঠিন করে ধ’ম’কে বলে ওঠে,”মে’রেছো? হয়েছে শান্তি? এখন চলো।”
উর্বী ঘুরে ছুটে যায় শর্মীর কাছে। পেছন থেকে উচ্ছাস আবারও শাড়ির আঁচল টেনে ধরতেই উর্বীর অর্ধেক শাড়ি খুলে যায়। উর্বী তবুও গিয়ে শর্মীকে ধরে। উচ্ছাস গিয়ে উর্বীর গাঁয়ে শাড়ির আঁচল জরিয়ে দিয়ে উর্বীকে টানছে। রওশান আরা একবার শর্মী একবার উর্বীকে দেখছে। উচ্ছাসের অমনোযোগের সুযোগ নিয়ে সে কোনমতে উঠে পেছন থেকে একটা ফুলদানি দিয়ে বাড়ি দেয় উচ্ছাসের মাথায়। কিন্তু এই দানবের কিছুতেই কিছু হয়না। উল্টো ক্ষে’পে রওশান আরাকে আবারও ধা’ক্কা মেরে ফেলে দেয়। উর্বী শর্মীকে জরিয়ে ধরে রেখেছে, চেঁ’চি’য়ে যাচ্ছে,”আল্লাহ আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে নাও।”
বাইরে তখনও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পায়নি উচ্ছাস।
দুমিনিট পরে একটা গুলির আওয়াজ হয়। উর্বী চ’ম’কে ওঠে। উচ্ছাস ঘুরে সদর দরজার দিকে তাকাতেই পুলিশ ইন্সপেক্টর বলে ওঠে,”চুপ করে দাঁড়াও ওখানে।”
ইতিমধ্যে পুলিশের কিছু কনস্টেবল পুরো লিভিং রুমে ঢুকে উচ্ছাসকে ঘেরাও দিয়ে দাঁড়িয়েছে । উচ্ছাস এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে বাঁকা হাসি হাসে,তারপর প্যান্টের পকেট থেকে একটানে বেরেটা এম নাইন বের করে বলে ওঠে,”শা’লা তোমরা আইনের লোক হয়ে আমায় ভালো থাকতে দাওনা কেন?”
পুলিশ ইন্সপেক্টর কিছু বলার আগেই উচ্ছাস তার ব’লিষ্ঠ হাতে উর্বীর চুলের মুঠি ধরে টেনে উর্বীকে তুলে এক হাত দিয়ে জাপটে ধরে উর্বীর কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে দেয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব পুলিশ ইন্সপেক্টর পিস্তল তাক করে ধরে রেখেই তিন পা পিছিয়ে যায়। উর্বী উচ্ছাসের এহেন কান্ডে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না,সে শুধু নিস্তেজ কন্ঠে বলতে থাকে,”আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে নিন। আপনারা কেউ আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে নিন।”
উচ্ছাস পুলিশ ইন্স’পে’ক্টরের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”যেতে দিন আমাকে ওকে নিয়ে, নয়তো তিনমিনিটের মধ্যে প্রথমে ওকে মা’রবো তারপর নিজে সুই’সা’ইড করবো।”
উচ্ছাসের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো, পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর কিছুটা ঘা’বড়ে যায়। তবুও সে পিস্তল নামায় না। ওভাবেই তাক করে রাখে।
ইন্স’পে’ক্টর বলতে থাকে,”শাখাওয়াত চৌধুরীর ছেলে! কি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনলে তুমি নিজের। সারেন্ডার করো। তোমার চিকিৎসা দরকার। সারেন্ডার করো!”
উচ্ছাস তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রিভলবারটা পুরোপুরি মাথার সাথে চেপে ধরে উর্বীর।
উর্বী নীরবতা ভেঙে উন্মাদের মতো বিরবির করে বলতে থাকে,”মেরে ফেলো আমাকে তুমি। হ্যা সেটাই করো তবে। তুমি আমাকে যা দিয়েছো,তার মধ্যে মৃত্যু হবে সবথেকে সুন্দর কিছু। তবে জেনে নাও উচ্ছাস,তুমি কোনো উর্বীকে মারবে না,মারবে রাওনাফ করীম খানের স্ত্রীকে,তার অনাগত সন্তানের মাকে। পরস্ত্রী আমি। শুনে নাও তুমি। আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি,তোমাকে ঘৃণা করি! মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তোমাকে ঘৃণা করতে পেরেছি,এটাই আমার শান্তি!”
উচ্ছাসের প্রতি সমস্ত ঘৃণা কয়েকটা লাইনে উগ্রে দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নেয় উর্বী। তার নাটকীয়তায় ভরা জীবনের শেষটাও নাটকীয় ভাবে হলো। শুধু আফসোস শর্মীর জন্য। মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে তার জন্য,তার জীবনে চমৎকার সুগন্ধি দেওয়া ফুলটা মেঝেতে পরে কষ্ট পাচ্ছে শুধু মাত্র উর্বীর জন্য। উর্বী দায়ী,উর্বী দোষী,উর্বী পাপী। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দৃষ্টি মেলে তাকানোর আগেই গু’লির আওয়াজ হয়।
****
“ম্যাম সরে যান। ম্যাম।”
নিউরো বিভাগের ল্যাবের সামনে দাঁড়িয়ে নার্স উর্বীকে বলে। উর্বী সরেনা। এক হাত দিয়ে শর্মীর হাত আকরে ধরে রেখেছে। শর্মীকে ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমআরআই আর সিটিস্ক্যানের জন্য।
নার্স মোসারাত উর্বীকে বলে,”প্লিজ ম্যাম ছাড়ুন হাতটা,আপনি এখানেই দাঁড়ান।”
একজন জুনিয়র নার্স এসে উর্বীর হাত থেকে শর্মীর হাত ছাড়িয়ে নেয় জোর করে। তারপর শর্মীকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। উর্বী ল্যাবের বাইরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। উর্বীর সামনে দিয়ে ল্যাবে ঢোকে সিটি মেডিকেয়ারের নিউরো সার্জন শুভাশীস রায়। তার সাথে আরো দুজন বিশেষজ্ঞ।
একজন নার্স ছুটে এসে উর্বীর আঁচল ঠিক করে দিতে দিতে বলে,”একটু আমার সাথে আসবেন ম্যাম? আপনার প্রাথমিক চিকিৎসা দরকার।”
উর্বী উদভ্রান্তের মতো আশেপাশে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আমার শাশুড়ি।”
_তার চিকিৎসা চলছে। স্বাভাবিক সবকিছু।
উর্বী আশেপাশে তাকায়, শায়মী নাবিলের কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে যাচ্ছে। নাবিল বোনকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাদের পাশেই বসে আছে সুমনা ও ঝুমুর। তারাও নিরব অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে।
উর্বী সবার দিকে একে একে তাকিয়ে একটা বেঞ্চিতে ধপ করে বসে পরে।
****
দ্রুত পায়ে শাখাওয়াত চৌধুরী জেনারেল হসপিটালের লবি দিয়ে হেঁটে আসছে,তার দুই পাশে দুজন বডিগার্ড। হসপিটালের বাইরেই তিন তিনটা গাড়ি দাড় করিয়ে এসেছে সে। কেবিনের বাইরে তিনজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো, শাখাওয়াত চৌধুরীকে দেখেই টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। শাখাওয়াত চৌধুরী সালামের উত্তর দিয়ে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করতে গেলেই পুলিশ অফিসার তার পথ আগলে ধরে,বলে,”স্যার আসামী আমাদের জিম্মায় এখন। আপনি দেখতে পারবেন না।”
শাখাওয়াত চৌধুরী আহত চোখে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”ছেলে আমার।”
_স্যার সে আসামী। এটেম্পট টু মা’র্ডা’র কেসের আসামী। উই আর সরি।
শাখাওয়াত চৌধুরী একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়, কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”কোথায় লেগেছে গু’লি?”
_বুকে।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় পুলিশ ইন্সপেক্টর।
শাখাওয়াত চৌধুরীর মনে হলো কেউ তারই বুকে গু’লি মে’রেছে। পুলিশ অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,
_কে মে’রেছে?
_আমি।
পুলিশ অফিসার উত্তর দেয়। শাখাওয়াত চৌধুরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নরম গলায় বলে ওঠে,”দয়া করে ভালো কোনো হসপিটালে নিতে দিন!”
_উই আর সরি। তাকে এখানেই রাখা হবে।
শাখাওয়াত চৌধুরী দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে, তারপর আটকে আটকে বলে ওঠে,”বাঁচবে তো!”
_আশা করা যাচ্ছে।
****
পুরো সিটি মেডিকেয়ার হসপিটাল ভীষণ ব্যস্ত, তারা ভীষণ ব্যস্ত রাওনাফ করীম খানের ছোটো মেয়েকে নিয়ে। যে মেয়েটা রাওনাফ করীম খানের খুব আদরের।
নিউরো বিভাগের সামনে ওয়েটিং রুমে আহাজারি করে যাচ্ছে শর্মীর দুজন ফুপু এবং দুজন খালামনি। এখানে কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।
শায়মী আর নাবিল একে অপরকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে। মনে হচ্ছে প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দুনিয়া বানিয়ে নিয়েছে নিজের জন্য,যেখানে উর্বীর কোনো অস্তিত্ব নেই। উর্বী নিজেই নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায়না। কিছুক্ষণ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে নার্সের বারণ সত্তেও শর্মীকে যে কেবিনে রাখা হয়েছে সেখানে ঢোকে।
আশ্চর্যজনক ভাবে নিজের শারীরিক যন্ত্রণা সে অনুভব করতে পারছে না।
লামিয়া রওশান আরার কেবিন থেকে বের হয়ে দেখে উর্বী শর্মীর কেবিনে ঢুকছে,সে বাঁধা দিতে গিয়েও দেয়না।
নিস্তেজ হয়ে পরে থাকা নরম, আদুরে শরীর, গোলগাল মুখটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে উর্বী। মনে হচ্ছে এখনি ঐ ঠোঁট নেড়ে বলবে,”আন্টি আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাই? আন্টি আমার খুব ভয় করছে, আন্টি আমাকে মিষ্টি কিছু বানিয়ে দাও না! আন্টি পাপার কাছে তুমি প্লিজ এটা বলবে না!”
আশ্চর্য! উর্বীর চোখে এখন পানিও আসছে না। সে শর্মীর নরম হাতটা আকড়ে ধরে রেখেছে।
“স্যার আপনি শান্ত হোন….রাওনাফ ভাই দাড়া….ভেতরে যাসনা… রাওনাফ দাঁড়াও তুমি!”
বাইরে থেকে তিন চারজন ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের গলার আওয়াজ শোনা যায়,উর্বী শর্মীর হাত ছেড়ে কেবিনের একপাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বাইরে সবাই রাওনাফকে আটকাতে চাইছে। রাওনাফ কারো কথা না শুনে ঢুকে পরে কেবিনে।
চোখের পলকেই শর্মীর বেডের কাছে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পরে সে। শর্মীর হাত আগলে ধরে অজস্র চুমু খেতে খেতে কান্নায় ভেঙে পরে রাওনাফ। প্রত্যেকটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে আর্তনাদ করতে থাকে,”আমার মা। আমার মামনি।” বলে।
জাহাঙ্গীর আর লামিয়া রাওনাফকে টানছে। সে তার মেয়ের হাত ছাড়ছে না।
শর্মীকে হসপিটালে আনার দেড় ঘণ্টা পরে রাওনাফ এসেছে। এসেই জানতে পারে তার পুরো পৃথিবী নিস্তেজ হয়ে কেবিন নাম্বার তিনশো চারে পরে আছে।
উর্বী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে বাবা মেয়েকে। সে বুঝতে পারছেনা সে আদৌও জীবিত কিনা। তার কেনো কান্না পাচ্ছে না!
রাওনাফ নিজের মেয়েকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে। ডক্টর মেহেদী হাসান, আজমেরীর স্বামী হাফিজুর তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। রাওনাফ ছোটো বাচ্চাদের মতো কাঁ’দছে। ছেলেমেয়েগুলো তার ঠিক কি সেটা তো কেবল রাওনাফ করীম খানই জানে। ওরাই যে তার অস্তিত্ব। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে ব্যর্থ বাবা মনে হচ্ছে তার এখন। সে কিসের শাস্তি পেলো এটা! কোন দোষের! কোন পাপের!
রাওনাফকে দেখে আত্মীয় স্বজনের আহাজারি যেন বেড়ে গেলো। ডক্টরদের বারণ সত্তেও তিনতলা কাপিয়ে , বাতাস ভারী করে কেঁদে যাচ্ছে সবাই।
কেবিনের মধ্যে ট্রলি নিয়ে ঢোকে তিনজন নার্স এবং তাদের পেছনে ডক্টর শুভাশীষ রায় এবং তারিন মাহমুদা। নিউরো সার্জন। শুভাশীষ এসে রাওনাফের হাত ধরে টানে,কোমল কন্ঠে বলে,”ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। ভেঙে পরো না রাওনাফ।”
রাওনাফ কিভাবে শক্ত থাকবে! সেই মানসিক ক্ষমতা রাওনাফের নেই! সে তার মেয়েকে আকড়ে ধরে রেখেছে। কপালে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে মেয়ের।
সিস্টার দুজন এসে শর্মীকে ট্রলিতে উঠিয়ে নিতে চায়। রাওনাফ হাহাকার করে ওঠে,”কোথায় নিয়ে যাচ্ছো! আমার মামনিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো!”
উঠে দাঁড়ায় রাওনাফ।
শুভাশীষ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে থাকে,”সেরি’ব্রামের নিচের অংশে আঘাত পেয়েছে, সাথে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি। ইমিডিয়েট সার্জারি প্রয়োজন। ডক্টর নাজমুল হুদা এসেছে।”
রাওনাফ ধপপ করে আবারও মেঝেতে বসে পরে। জাহাঙ্গীর আর আশিক এসে তাকে আগলে ধরে। রাওনাফ বোকার মতো শর্মীর মুখের দিকে তাকায়, তাকায় শুভাশীষ রায়ের মুখের দিকে।
উর্বী শুধু কেবিনের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। পেটে হাত চেপে এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে তাকাচ্ছে সে। আশেপাশের সব লোকজনকে দু’বার করে দেখছে সে। হঠাৎ একজন নার্স তার দিকে এগিয়ে আসে, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”ম্যাম আর ইউ ওকে! একটু বসবেন আপনি?”
উর্বী উত্তর দেওয়ার আগেই মেঝেতে লুটিয়ে পরে।
****
চোখ মেলে তাকাতেই দেখে লামিয়া ঝুঁকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী আবারও দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। এবং কয়েক মুহুর্ত ওভাবে থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে। ডান হাতের পিঠে ব্যাথা অনুভব হয় তার, তাকিয়ে দেখে তার হাত ক্যানুলা লাগানো। সে দাঁতে দাঁত চেপে একটানে ক্যানুলা খুলে ফেলে।
লামিয়া বলে ওঠে,”কি করছো!”
উর্বী কোনো জবাব না দিয়ে আশেপাশে তাকায়। লামিয়া বলে ,”তুমি গাইনী বিভাগে। চারতলায়।”
উর্বী বেড থেকে নেমে দাড়ায়। লামিয়া কিছু বলার আগেই দুর্বল শরীর নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।
উচ্ছাসের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে শেফালী দরজার কাচ দিয়ে তাকিয়ে আছে ভেতরে। উদোম, বলিষ্ঠ শরীরটায় বুকের ডানপাশের কিছুটা নিচে ব্যান্ডেজ করা। গুলি বের করা হয়েছে তার। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। বেডের পাশে মনিটরটায় কিছুক্ষণ পরপর যান্ত্রিক আওয়াজ হচ্ছে, যেন শেফালীকে বলছে,”তোমার ছেলে মরে যাবে শেফালী।”
শেফালী শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে অশ্রুবিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে শাখাওয়াত চৌধুরী কাঁধে হাত রাখে। শেফালীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। শাখাওয়াত চৌধুরী স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”ছেলের গায়ে যখন শাসন করার জন্য হাত তুলতাম তখন সহ্য করতে পারতে না,ছেলে আজ গু’লি খেয়ে পরে আছে,এখন কিভাবে সইছো?”
শেফালী ঘুরে স্বামীকে জরিয়ে ধরে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার,স্বামীর বুকে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,”ও প্রাণে বেঁচে গেলে ওকে যেনো কখনো আর জেল থেকে বের না করেন আপনি। কখনো চেষ্টাও করবেন না। কখনো না। কখনো না।”
উর্বী ছুটতে ছুটতে নামছে সিড়ি বেয়ে, অর্থোপেডিক বিভাগ পেরিয়ে তিনতলায় নিউরো বিভাগের ওয়েটিং রুমে এসেই থমকে যায় সে। আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে পুরো কামরা। উর্বী ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। সবাই কিরকম চুপচাপ হয়ে আছে। কিন্তু সবাই নিরবে অশ্রুবিসর্জন বিসর্জন করে যাচ্ছে।
উর্বীর বুকটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে ওপারেশন থিয়েটারের বাতি জ্বলছে।
আরো দুকদম এগিয়ে গিয়ে উর্বী পিছিয়ে যায়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে থাকে সোজাসুজি। রাওনাফ লবির মেঝেতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে এক হাঁটু ভাজ করে। তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। উর্বী সে দৃষ্টি পড়তে পারছে না। শায়মী নাবিল দুজন তাদের পাপার দু’পাশে বসে পাপাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে চুপচাপ। রাওনাফের দু’জন শ্যালিকা,দু বোন, তাদের স্বামী সবাই একপাশে বসে আছে। সামিউল-অন্তরা, শাফিউল-মোহনা সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ইতিমধ্যে।
মৃদু আওয়াজে কাঁদছে আজমেরী। রুমাও কাঁদছে। শায়মী নাবিল দু’জনেই কাঁদছে। সবাই কাঁদছে,শুধু কাঁদতে পারছে না উর্বী । কেনো কাঁদতে পারছে না সে জানেনা। সেও সবার মতো একটু কাঁদতে চায়। শর্মী তারও মেয়ে। সেও কাঁদবে।
থানা থেকে ইন্স’পে’ক্টর দীপঙ্কর সাহা দুজন কনস্টেবল নিয়ে এসেছে। তাকে দেখে আজমেরীর স্বামী হাফিজুর এগিয়ে আসে, এগিয়ে আসে জাহাঙ্গীর। দীপঙ্কর তাদের উদ্দেশ্য করে বলে,”এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। এদিকের কি অবস্থা?”
_সা’র্জারি লাগছে।
নিষ্প্রাণ হয়ে বলে হাফিজুর। দীপঙ্কর বলে,”একটু রাওনাফের সাথে কথা বলবো।”
জাহাঙ্গীর বাঁধা দিয়ে বলে,”বুঝতেই তো পারছো দীপঙ্কর। এখন থাক। তোমরা তোমাদের কাজ চালিয়ে যাও।”
_তবুও।
কথাটা বলে দীপঙ্কর এগিয়ে যায় রাওনাফের দিকে। রাওনাফের সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেও মেঝেতে বসে,তারপর নরম গলায় বলে ওঠে,”তোমার ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই বেড়িয়ে গিয়েছি রাওনাফ। একটুও বিলম্ব করিনি বিশ্বাস করো।”
রাওনাফ চুপ করে থাকে। দীপঙ্কর বলতে থাকে,”শাখাওয়াত চৌধুরীর ছেলে। তুমি চেনো শাখাওয়াত চৌধুরীকে। ছেলেটির নাম শাহরিয়ার উচ্ছাস চৌধুরী। এর আগে খুনের দায়ে দশবছরের জেলও হয়েছিল। ছয়বছর জেলে কাটিয়ে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেয়েছিলো। ভয়ংকর অসুস্থ একটি ছেলে। জানিনা তোমার সাথে কি শত্রুতা ছিলো। তার মা বাবা জবানবন্দি দিয়েছে তোমার ওয়াইফের সাথে ঝামেলা ছিলো বলে এসব ঘটিয়েছে। বাকিটা তোমার ওয়াইফ বলতে পারবে।”
শায়মী পাপার কাঁধে মাথা রেখে কেঁ’দে যাচ্ছে। নাবিল মাথা তুলে দীপঙ্করের দিকে তাকায়। উর্বী তাদের সবাইকে নিশ্চুপ দেখতে থাকে। রাওনাফ মাথা তুলে তাকায় না, না কোনো জবাব দেয় দীপঙ্করের কথায়। সে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে চুপচাপ বসেই থাকে।
চলমান…..