আরেকটি বার পর্ব-৩০

0
729

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩০
#Esrat_Ety

নাবিল এসে দরজার বাইরে দাঁড়ায়। সে প্রচন্ড দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে। তারপর খানিকটা সময় নিয়ে নিচু স্বরে বলে,”আসবো আন্টি!”

উর্বী অবাক হয়ে ঘুরে তাকায়। দরজার বাইরে নাবিলকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,”এসো।”

নাবিল ভেতরে ঢোকে। নাবিলের পিছু পিছু ঢোকে শায়মী। উর্বী দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। উর্বীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিনয়ী সুরে বলে ওঠে,”থ্যাংকস আন্টি!”

উর্বী কিছু বুঝতে পারছে না। সে বোকার মতো শায়মীর দিকে তাকায়। শায়মী এসে উর্বীকে জরিয়ে ধরে কেঁদে ফেলে,উর্বী উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”এই মেয়ে! কি হয়েছে! কাঁদছো কেন!”

শায়মী মুখ তুলে উর্বীর দিকে তাকায়। ফোপাতে ফোপাতে বলে,”লামু আন্টিকে ফোন দিয়েছিলাম আমি আর নাবিল। বলেছে লামু আন্টি! তোমার জন্য নাকি পাপার প্রবলেম সলভ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আন্টি বলেনি তুমি কি করেছো।”

অস্বস্তিতে উর্বীর মুখ ছেয়ে যায়। বাচ্চাগুলো কিভাবে টের পেলো এসব! উর্বী কিছু বলে ওঠার আগেই নাবিল বলে,”অনেক থ্যাংকস আন্টি!”

উর্বী নাবিলের দিকে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে,”তোমরা…”

নাবিল মাথা নিচু করে ফেলে, তারপর বলে,”সকালে পাপা আর আপনার কথাগুলো আমি আর শায়মী শুনে ফেলেছিলাম।”

উর্বী চ’ম’কে ওঠে। চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে,”শর্মী!”

_ও কিছু জানে না। আর জানবেও না।

উর্বী ঘামছে! কি বিশ্রী একটা ব্যাপার ঘটে গেলো। মানুষটা যদি জানতে পারে এসব তাহলে খুব দুঃখ পাবে!

নাবিল বলে ওঠে,”আপনাকে থ্যাংকস জানাতে এসেছিলাম আন্টি। আপনি প্লিজ পাপাকে জানাবেন না আমরা জেনে গিয়েছি। প্লিজ আন্টি।”

শায়মী এগিয়ে এসে উর্বীর হাত ধরে বলে,”প্লিজ আন্টি! প্রমিজ করো।”

উর্বী কিছুক্ষণ বাচ্চাদুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে। তারপর বলে ওঠে,”আরো একটা সিক্রেট? তোমাদের তিন ভাইবোনের এতো এতো সিক্রেট পেটে জমা রাখতে রাখতে আমার পেটটা ফুলে গিয়েছে,আমি তো একদিন পেট ফে’টে ম’রে যাবো।”

নাবিল হেসে ফেলে। শায়মীও চোখের পানি মুছে উর্বীর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
তিনজনই হাসতে থাকে। এমন সময় রাওনাফ ঘরে ঢোকে। নাবিলকে উর্বী-শায়মীর সাথে হাসতে দেখে রাওনাফ রীতিমতো অবাক !

পাপাকে দেখে নাবিল শায়মী চুপ হয়ে যায়। তারপর “গুড নাইট পাপা” বলে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাওনাফ সেদিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে বলে,”কি নিয়ে হাসছিলে ওদের সাথে?”

উর্বী বলে,”কিছুনা,শর্মীকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো দুজন। আপনি কোথায় ছিলেন?”

_শর্মীর রুমে,ওর পড়া ধরতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সে তুলতুলের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। রীতিমতো ধমকাচ্ছে পাখিটাকে। ওকে শর্মী না ডেকে এখনও উর্বী কেন ডাকা হচ্ছে সেজন্য রাগ দেখাচ্ছে।

উর্বী হাসে। রাওনাফ বলে,”হাতে পায়ে বড় হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু একেবারে সেই ছোটো অবুঝ শর্মীই রয়ে গিয়েছে।”

উর্বী বলে,”দেখবেন আমাদের শর্মী অনেক ভালো মনের একটা মানুষ হবে। একেবারেই আলাদা হবে ও।”

রাওনাফ তাকায় উর্বীর দিকে। উর্বীর মুখে “আমাদের শর্মী” শব্দটা শুনে অদ্ভুত ভালোলাগায় মন ভরে যায় তার। এতো মায়া মায়া “আমাদের শর্মী” বলার ধরণটা! সত্যিই একমাত্র মেয়ে মানুষই পারে এভাবে মায়ায় জড়াতে।

উর্বী ঘরের জানালা বন্ধ করে দিতে দিতে বলে,”কিশোরের কি ব্যবস্থা করবেন? স্টেপ নিচ্ছেন না কেনো এখনও?”

রাওনাফ বলে,”হসপিটাল থেকে বের করা হয়েছে। আইনি পদক্ষেপ নিইনি কোনো।”

_ব্যস? এটুকুই?

রাওনাফ নিচুস্বরে বলে,”ওর ওয়াইফ অনা। আমরা একই ফ্রেন্ড সার্কেলের। সন্ধ্যায় আসলো। আমার পায়ে ধরা বাকি রেখেছে অনা মেয়েটা। আমি পারিনি কঠোর হতে উর্বী!”

উর্বী হাসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলে,”জানতাম আমি। এরপর থেকে একটু কঠোর হবেন ডাক্তার! আজ তো শুনে এলাম হসপিটালে, আপনার নরম স্বভাবের ফায়দা ওঠায় অনেকেই। এই স্বভাবের জন্য আবার না কোনো বিপদে পরেন!”

রাওনাফ ম্লান হাসে। মজার ছলে বলে,”তুমি আছো যে। পরবো না।”

উর্বী আয়নায় রাওনাফের প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। রাওনাফ এগিয়ে যায়। পেছন থেকে উর্বীকে আগলে ধরে আয়নায় উর্বীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। উর্বী শিহরিত হয়,প্রজাপতিরা ডানা ঝাপটায়। রাওনাফ সন্তর্পনে উর্বীর নরম গালের সাথে নিজের রুক্ষ পুরুষালি গাল চেপে ধরে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”হাঁসের ছানা।”

উর্বীর প্রজাপতি গুলো উড়তে শুরু করে। উর্বী মুখ ফুটে বলে না,কিন্তু রাওনাফের এই ডাকটা উর্বীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্নিগ্ধ অনুভূতির সাগরে। রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ খুব ঘা’ব’ড়ে গিয়েছিলাম।”

উর্বী নরম গলায় বলে,”কিন্তু আমি ঘাবড়ে যাইনি। ভেবেছি হসপিটালে গিয়ে মেয়েটাকে চ’ড় থাপ্পড় মেরে সত্যিটা বের করবো কিন্তু হঠাৎ চোখে এ্যাপয়েনমেন্ট লেটার টা পরতেই মাথায় একটা অন্য প্ল্যান আসে। আমি একটুও ঘাবড়াইনি জানেন!”

রাওনাফ এক হাত দিয়ে উর্বীর ডান গাল আলতো করে ছুঁয়ে বলে,”আমি ভেবেছি স্ট্রেস নিতে না পেরে আবার তুমি জ্ঞান হারাও!”

কথাটি বলে রাওনাফ হাসে। উর্বীও হেসে ফেলে। উর্বী বলে,”হারালেও অসুবিধা নেই। ডাক্তার আছে যে।”

রাওনাফ উর্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”হ্যাঁ। একজন পেশেন্ট এনে দিয়েছে রওশান আরা।”

_শুধু পেশেন্ট?
উর্বী নরম গলায় জানতে চায়। রাওনাফ মাথা নাড়ায়, উর্বীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”একজন মৃদুলা উর্বী। মায়া মায়া। বড্ড আদুরে। হাঁসের ছানা।”

উর্বী চোখ বন্ধ করে ফেলে। রাওনাফ উর্বীর কোমর জড়িয়ে গালে চুমু খায় দীর্ঘসময় ধরে। উর্বী চোখ খোলে না। দু’জনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস গভীর হয়। খানিক বাদে রাওনাফ বলে ওঠে,”মৃদুলা উর্বী। যাকে আমি পেয়েছি, ভুল করে। যে আমার কাছে আছে,এই উর্বী আর কারো কাছে নেই, কেউ পায়নি।”

উর্বী স্বামীকে আকরে ধরে তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বলে,”আর আমি ভাগ্যবতী, আরেকটি বার জীবনটা রঙিন হলো যার তার নয়, একজন শুদ্ধ পুরুষের স্পর্শে। যার স্পর্শে আমি শুদ্ধ হই। তখন আমার মনে হয়না কোনো কলঙ্ক আদৌও ছিলো এই শরীরে জানেন! মনে হয় জীবনটা এমনই ছিলো। এমনই। একটা পরিবার, মায়ের মতো একজন শাশুড়ি, নাবিল,শর্মী,শায়মীর মতো তিনটা চমৎকার ফুল যাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু ওরা আমার জীবনে বিরাট ভূমিকা রাখছে যা অনস্বীকার্য। ওরা ভীষণ মায়া মায়া। আর আপনার মতো জীবনসঙ্গী,এতো যত্ন,একটু সময়,একটু আদর! জীবনটা খুব উপভোগ করছি আমি শর্মীর পাপা। সময়টা এখানেই থেমে যাক না। থেমে যাক! গোটা একটা জীবন উপভোগ করা বাকি আমার।”

রাওনাফ বলে ওঠে,”সময় থেমে যাবে বলছো? কি সর্বনাশ! আমার পেশেন্ট গুলোর কি হবে তাহলে!”

উর্বী হেসে ফেলে, তারপর বলে,”আমি আছি তো। আপনার পেশেন্ট।”

_হ্যা। যে কখনো কোনো ভিজিট দেয়না আমাকে।
মজার ছলে বলে রাওনাফ।

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। বলে,”কি ভিজিট দেবো আপনাকে? আপনিই তো আমাকে শুধু দিয়েছেন। আমি কি দেবো?”

_কি দিয়েছি আমি?

_স্বীকৃতি, পবিত্রতা, আর তিনটা ফুল। যাদের সুগন্ধে আমার জীবন পরিপূর্ণতা পাচ্ছে। জানেন আমার না মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা আমারই, তেমন অধিকারবোধ দেখিয়ে ফেলি। আমি কি খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছি? স্বার্থপরতা করছি? অন্যায় করছি নাবিলের মাম্মার সাথে? তার স্বামীর ভাগ নিয়েছি এখন তার বাচ্চাগুলোর ভাগও পেতে চাচ্ছি,বেশি করে ফেলছি আমি? আমি খুব লোভী?

রাওনাফ কিছু বলে না। উর্বীকে জরিয়ে ধরে। উর্বী আর কথা বাড়ায় না, কিছুসময় পরে রাওনাফ বলে ওঠে,”তুমি লোভী নও। তুমি মায়াবী। মায়ায় বেঁধে ফেলছো সবাইকে।”

উর্বী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অনুভূতি দেওয়া নেওয়ার চূড়ান্ত সময়ে উর্বীর খুব ইচ্ছে করলো রাওনাফকে বলতে,সে মা হতে চায়। সে চায় রাওনাফ-উর্বীর ভালোবাসার চিহ্ন পৃথিবীতে আসুক। উর্বীর পরিপূর্ণ জীবনটা আরো পরিপূর্ণতা পাক। কিন্তু উর্বী পারলো না বলতে,কিছু একটা তাকে আটকে দিলো। দ্বিধা হলো তার,সব দ্বিধা কাটিয়ে ওঠা যায়না। উর্বী ভাবলো,উর্বী হ্যাংলার মতো চাইবে না। না চাইতেও সব পাচ্ছে উর্বী। উর্বী চায় এই কথাটা রাওনাফই আগে বলুক। এমন যদি হয় রাওনাফ নিজেই চায় উর্বীর থেকে একটা বাচ্চা! সেদিন উর্বী ভীষণ খুশি হবে। উর্বী অপেক্ষা করতে চায়। উর্বী চায় সব অপ্রত্যাশিত সুখের মতো ঐ সুখটাও তার জীবনে আসুক।

ভাবতে ভাবতেই উর্বী টের পায় রাওনাফ তার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। উর্বী কিছু বলে ওঠার আগেই রাওনাফ অস্থির নিঃশ্বাস ফেলে নিচু স্বরে বলে,”সরি ইফ আই ইমব্যারেসড ইউ!”

উর্বী বিছানার চাদর খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে আটকে আটকে বলে ওঠে,”মোটেও না। এই ছোঁয়া আমাকে শুদ্ধ করে,স্বস্তি দেয়, অস্বস্তি কিংবা গ্লানি নয়। আপনি আমায় আদর করুন, শুদ্ধ করুন আমায় শর্মীর পাপা।”

****
চমৎকার প্রতিটা মুহূর্ত, চমৎকার প্রতিটা দিন, চমৎকার প্রতিটা সূর্যদয়, চমৎকার প্রতিটা সূর্যাস্ত। উর্বীর জীবনে যা ঘটছে সবকিছুই চমৎকার। এখানে কোনো গ্লানি নেই। আছে শুধু স্বস্তি,শান্তি,মায়া আর আদর।
প্রতিটা দিন উর্বী পরিপূর্ণ হয়,প্রতিটা দিন কাটে ভালোবাসায়, প্রাপ্তিতে।
সকাল বেলা রাওনাফের স্নেহমাখা পরশে ঘুম ভাঙে,ঘুমিয়ে পরে তারই আশ্লেষে-আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে, ডিপ্রেশনে ডোববার সুযোগ নেই তার,সে ডুবে থাকে রাওনাফের উন্মুক্ত বুকের মাঝে,রোজ রাতে। মাঝখানে সারাটাদিন কাটে ব্যস্ততায়। এই সংসার, রাওনাফ করীম খান নামের স্বচ্ছ ,যত্নশীল একজন লোক এবং তার তিনটা মিষ্টি ছানা। এদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকে উর্বী। উর্বী যেমন রাওনাফ কিংবা তার তিনছানার কাছ থেকে মায়া পাচ্ছে। উর্বীও তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে সেগুলোর ঋণ শোধ করতে ।

কে’টে যায় দুমাস। এই দুই মাসে উর্বী আরো লোভী হয়ে উঠেছে। রাওনাফের তিনছানার প্রতি দিনকে দিন আরো দুর্বল হয়ে পরেছে। এই সুযোগটা অবশ্য ওরাই করে দিচ্ছে। নাবিল আগের মতো আর উর্বীকে এড়িয়ে চলে না,বেশ আন্তরিক। যেটুকু কথা বলে, খুবই বিনয়ী হয়ে বলে। একবার তো উর্বীর সাথে উর্বীর বাপের বাড়িতেও ঘুরে এসেছে ওরা তিন ভাইবোন।

উর্বী লোভী হচ্ছে সংসারের প্রতিও। প্রত্যেকটা জিনিস, আসবাবপত্র, দেওয়ালের ইটকে মায়ায় বেঁধে ফেলছে তার। সে চায় সবাই ওর মায়ায় পরুক।

রাওনাফ ইদানিং বেশ ব্যস্ত হয়ে পরেছে। রাত টুকু শুধু বাড়িতে কাটায়। সপ্তাহে এক রাত তো রাজশাহী যায়। সেখানে সামিউল অন্তরার জমজমাট সংসার, গুছিয়ে নিয়েছে সব, চট্টগ্রামে মোহনা-শাফিউলও ভীষণ ব্যস্ত নিজেদের সংসার নিয়ে। উর্বী ব্যস্ত তার জীবন নিয়ে, কাটাচ্ছে দিন এভাবে,আনন্দে।

আজ সকালটা উর্বীর জন্য খুব স্পেশাল। আজ রাওনাফ খানিকটা ফ্রি, অন্তত সকাল দশটা পর্যন্ত বাড়িতে থাকবে। একটু কথা বলা যাবে। এই সপ্তাহে রাওনাফ ভীষণ ব্যস্ত ছিলো। ঠিকঠাক ভাবে বসে দুটো কথা বলাই হয়ে ওঠে না। কাল রাতে উর্বী ঘুমিয়ে পরেছিলো তখন রাওনাফ এসেছে। সকালে রাওনাফই ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে তুলেছে উর্বীকে। ব্যস,কথা শুধু এটুকুই হচ্ছে।
বাইরের বাগানে রাওনাফ করীম খান এবং তার ছানাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। উর্বী তাদের রুমের বারান্দায় গিয়ে দৃষ্টি দেয় নিচে। এখন সকাল সাতটা, রাওনাফ আর তার বাচ্চারা বাগানে হাঁটাহাঁটি করছে,ঠিক হাঁটাহাঁটি নয়। কিছুক্ষণ ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে বাগানে চা বিলাস করছে। উর্বী দাড়িয়ে দাড়িয়ে তাদের দেখছে। এদের বাবা-ছানাদের বন্ডিং-টা উর্বী খুব উপভোগ করে। যখন তারা একসাথে থাকে,উর্বী খুব কম সময়ই ঢুকে পরে এদের মাঝে।

সবাই কোনো একটা বিষয় নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে। উর্বী চেঁ’চি’য়ে মজা করে বলে ওঠে,”ক্যান আই জয়েন?”

সবাই দোতলার বারান্দার দিকে তাকায়। শর্মী শায়মী চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”ইয়েস ইউ ক্যান! কাম!”

উর্বী হাসে। হাত নেড়ে বলে,”না। আমি কিচেনে যাচ্ছি। তোমরা এসো। খাবে।”

চুলে খোঁপা বেঁধে নিয়ে নিচতলায় নামতে থাকে উর্বী। হঠাৎ সে টের পায় তার মাথাটা সেই আগের মতো চক্কর দিয়ে উঠছে। এটা এই প্রথম না। পাঁচ-ছয়দিন ধরে বেশ খেয়াল করছে উর্বী। আগে যেমনটা হতো ঠিক সেরকম। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘোরা।

রওশান আরা খাবার টেবিলে বসে চা খাচ্ছে। উর্বী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ব্রেকফাস্ট তৈরি করে টেবিল সাজাতে না সাজাতেই রাওনাফেরা চলে আসে।

সবাইকে পরিবেশন করে দিয়ে উর্বী আবারও কিচেনে যায় একটু পায়েশ বেড়ে আনতে। আজ সে খুব শখ করে রেধেছিলো পায়েশ।

বাটিতে তুলে তাড়াহুড়ো করে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসছিলো উর্বী।
হঠাৎ ঝনঝন শব্দ হতেই রাওনাফ মাথা তুলে তাকায়। পায়েশের বাটি ফ্লোরে টু’করো টু’করো হয়ে পরে আছে,পাশেই অচেতন অবস্থায় পরে আছে উর্বী।

রাওনাফ “উর্বী” বলে চেচিয়ে ওঠে,ছুটে যায় তার কাছে। শর্মী,শায়মী,নাবিলও ছুটে যায়।

****
উর্বীর জ্ঞান ফেরে খানিক বাদেই। টের পায় কেউ তার গাল স্পর্শ করে রেখেছে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় সে। পুরো শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে।
রাওনাফ তার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। ব্লাড প্রেশার চেক করে বলে,”খুবই খারাপ! খাওয়া দাওয়া করছো না ঠিকভাবে।”

ঘরের মধ্যে রওশান আরা,শর্মী,শায়মী, নাবিল, আমীরুন সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবার চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট। উর্বী খানিকটা অস্বস্তি বোধ করে। রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ঠিক আছি আমি এখন। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিলো। চিন্তা করবেন না। আপনি হসপিটালে যান।”

তারপর শর্মী শায়মী আর নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমাদের তো ক্লাসের টাইম হয়ে এসেছে। যাও।”

সবাই চলে যায়। রওশান আরা বসে আছে। উর্বী বলে,”মা আপনিও যান। নাস্তা করে নিন। যান।”

রওশান আরা চলে যায়। গিয়ে আমীরুনকে দিয়ে এক গ্লাস কমলার জুস পাঠিয়ে দেয়। আমীরুন রাওনাফের হাতে গ্লাসটা দিয়ে চলে যায়।

রাওনাফ উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। গ্লাসটা উর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”খেয়ে নাও!”

উর্বী গ্লাসটার দিকে তাকায়। তার রীতিমতো বমি পাচ্ছে। এমন অনুভূতি তার আরো একবার হয়েছিল। বহু আগে।

এ মাসের পিরিয়ড এখনও হয়নি। অবশ্য এটা উর্বীর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার, তার পিরিয়ড অনিয়মিত। এ্যাবর্শনের পর থেকেই এমন হয়ে এসেছে। এজন্য অনেক গাইনী ডাক্তার দেখিয়েছে, কোনো লাভ হয়নি। রাওনাফকে বলে দেখবে? কিন্তু তারা তো এখনও কোনো প্ল্যান করেনি বেবির! রাওনাফই কখনও বেবির প্রসঙ্গ তোলেনি।

আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই রাওনাফ উর্বীর দু কাধ ধরে বলে ওঠে,”উর্বী!”

উর্বী তাকায়। রাওনাফ বলে,”আগামীকাল থেকে রোজা। এই শরীরে পারবে?”

উর্বী অবাক হয়ে বলে,”কেন পারবো না! আপনার কি আমাকে বাচ্চা মনে হয়!”

রাওনাফ হাসে,বলে,”মাঝে মাঝে মনে হয়। আচ্ছা আমি উঠছি। আজও ফিরতে দেরী হবে। সেমিনার আছে আমার। তারপর হসপিটালে যাবো। তবে সেহরির আগে ফিরবো। একসাথে সেহরি খাবো।”

উর্বী হাসে। রাওনাফ এগিয়ে উর্বীর গালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,”টেইক কেয়ার।”

রাওনাফ তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। উর্বী তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। এমন সময় তার ফোন বেজে ওঠে। যান্ত্রিক শব্দটা উর্বীকে বরাবর আতংকিত করে দেয়। কিন্তু যেহেতু এটা সম্পূর্ণ নতুন সিমকার্ড এবং রাওনাফ ব্যতীত অন্য কেউ নাম্বার টা জানে না তাই নিশ্চিন্তে রিসিভ করে অচেনা নাম্বারটা। কিন্তু ওপাশের পুরুষ কন্ঠটা তাকে মুহুর্তেই আতংকিত করে দেয়,উর্বী কাপা হাতে ফোনটা রেখে দিতে যাবে তখনই উচ্ছাস বলে ওঠে,”ফোন কাটবে না।”

উর্বী চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”তোমার লজ্জা নেই তাইনা? উচ্ছাস! আমি কিন্তু এবার আইনের সহায়তা নিতে বাধ্য হবো। সাবধান করে দিলাম তোমাকে!”

উচ্ছাস হাসে,হাসি থামিয়ে বলে,”বাপরে ছোটো পাখিটার দেখি খুব সাহস বেড়েছে! আইনের সহায়তা নেবে তুমি? কেস করবে আমার নামে? কি বলবে? আমি মার্ডারার,তোমাকে বিরক্ত করি! তারপর? তারপর কি হবে? উর্বী পৃথিবীর মানুষ যে জেনে যাবে , তোমার এক কুখ্যাত মার্ডারের সাথে সম্পর্ক ছিলো। শুধু সম্পর্ক না, গভীর সম্পর্ক! এতোটা গভীর যে তার বাচ্চা পর্যন্ত তোমার পেটে এসেছিলো। তখন কি হবে উর্বী সোনা? এলাকায় সবাই বলে বেরায় উর্বী রাজরানী হয়েছে। উর্বীর শশুরবাড়ির লোক খুব ভালোবাসে উর্বীকে। এসব শুনলে তো তারা তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে উর্বী! তাতে তো আমারই ভালো। কিছুদিন জেল খেটে বেরিয়ে তোমাকে বিয়ে করে নেবো, কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে উর্বী। প্লিজ আমার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নাও,প্লিজ উর্বী।”

উর্বী চুপ করে থাকে,উচ্ছাস গলার স্বর পাল্টে বলে,”চরিত্রহীনা মেয়ে মানুষ। নতুন নতুন পুরুষ চাই না তোর? এজন্যই সেদিন আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করেছিলি তাইনা? তোকে একবার বিয়ে করে নিই। তারপর দেখাবো তোকে অ’স’ভ্য মেয়ে। ”

_তুমি শুধু জঘন্য না। তুমি একটা কীট! একটা কীট তুমি।
চেঁ’চি’য়ে বলে উর্বী।

উচ্ছাস হাসছে। উর্বী ফোনটা কেটে সিমকার্ড বের করে ফোনটাকে দূরে ছুড়ে মারে। দেয়ালের সাথে বারি খেয়ে ফোনটা মেঝেতে পরে গিয়ে চুড়মার হয়ে যায়। এক দৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উর্বী উঠে দাঁড়ায়,সাথে সাথে মাথায় আবারও চক্কর দিয়ে ওঠে তার। ধপ করে বিছানার একপাশে বসে হাঁপাতে থাকে সে। তারপর ছুটে যায় বেসিনের কাছে।

****
দীর্ঘক্ষণ ধরে লামিয়ার কেবিনে বসে আছে উর্বী। রিপোর্ট গুলো নিয়ে লামিয়া এখনও ফেরেনি। উর্বীর খুবই অস্থির লাগছে। সকালে যখন প্রেগ’ন্যা’ন্সি টেস্ট কিট এনে টেস্ট করেছিলো তখন রিপোর্ট টা ব্লাইন্ড ছিলো, পজিটিভ নাকি নেগেটিভ উর্বী বুঝতে পারেনি। চলে এসেছে লামিয়ার কাছে।

কিছুক্ষণ পরে লামিয়া রিপোর্ট গুলো নিয়ে কেবিনে ঢোকে। উর্বী উঠে দাঁড়ায় তৎক্ষণাৎ। সে ভীষণ উত্তেজিত। লামিয়া হেসে বলে,”আরে বসো বসো।”

উর্বী বসে পরে, লামিয়া প্রফুল্ল চিত্তে বলে,”কংগ্রাচুলেশন ম্যাডাম! নতুন সদস্য আসছে খান বাড়িতে।”

উর্বীর কয়েক মুহূর্ত লাগলো প্রতিক্রিয়া দেখাতে। সে আনমনে তার পেটে হাত রাখে। এই অনুভূতি সে একা সামলাতে পারছে না। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে রাওনাফকে জরিয়ে ধরতে।

লামিয়া বলতে থাকে,”রাওনাফ মহাখালী গিয়েছে সেমিনারে। দাঁড়াও ওকে ফোন করি।”

উর্বী লামিয়ার হাত ধরে। লামিয়া উর্বীর দিকে তাকায়। হেসে বলে,”কি? তুমি বলবে?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। লামিয়া বলে,”সারপ্রাইজ?”

উর্বী মাথা নেড়ে হ্যা বলে। লামিয়া হেসে বলে,”হুম! ডাক্তারের বৌ আমার কাছে এসেছে প্রেগ’ন্যা’ন্সি টেস্ট করাতে তখনই বুঝেছি। ”

উর্বী চুপ করে থাকে, লামিয়া বলে,”ডিড ইউ প্ল্যানড্ ফর ইট?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। লামিয়া হাসতে থাকে। উর্বী বলে,”হাসছেন কেন আপা?”

_হাসছি রাওনাফের কথা ভেবে। একটা বেবিও ও প্ল্যান করে নিতে পারলো না। হুট হাট হয়ে গেলো। আমার তো হাসিই থামছে না।

উর্বী মাথা নিচু করে বসে আছে‌। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। কিভাবে কি হয়ে গেলো সে তো নিজেই জানে না!

লামিয়া হাসছে তো হাসছেই। উর্বী বলে,”আমিই ভুল করেছি হয়তো আপা।”

লামিয়া হাসি থামিয়ে বলে,”বেশ করেছো। তোমার এই ভুলটাকে আমি সাপোর্ট করছি। ইউ নো, তোমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে আর আফটার থার্টি প্রেগ’ন্যা’ন্সি পিরিয়ডটা মেয়েদের জন্য বেশ রিস্কি আজকাল। খুব ভালো করেছো। ”

উর্বী চুপ করে থাকে। লামিয়া বলতে থাকে,”সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছো। অবশ্যই সারপ্রাইজ দেবে। ফার্স্ট বেবি নিয়ে মেয়েদের ইমোশন থাকে,আমি জানি। রাওনাফের এটা ফার্স্ট বেবি না হতে পারে,তোমার তো ফার্স্ট বেবি। তুমি তোমার ইচ্ছে মতো সেলিব্রেট করো।”

উর্বীর চোখ মুখ হঠাৎ বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। লামিয়া বলে,”এই মেয়ে! কি হয়েছে?”

_আপা উনি কখনোই বেবির প্রসঙ্গ তোলেনি। কখনোই না। হতে পারে ওনার বেবি আছে তাই আর আগ্রহ নেই এসবে। যদি এমন টা হয় তাহলে আমি ভীষণ কষ্ট পাবো!

লামিয়া বিরক্ত হয়, বিরক্তি নিয়েই বলে,”এসব কোন ধরণের কথা? তুমি জানো রাওনাফকে? ও ভীষণ খুশি হবে! শিমালার বেলায় দেখেছি তো। পারলে তো ও বেবি গুলোকে নিজের ভেতর ক্যারি করতো নয় মাস।”

উর্বী ভাবে,শিমালা আর সে তো এক না! তাই ওরকম রিয়্যাক্ট কিভাবে আশা করে উর্বী। যেখানে কখনো রাওনাফ উর্বীকে বলেওনি সে উর্বীর থেকে বাচ্চা চায়। যদি এমনটা হয়,যে রাওনাফের বাচ্চা আছে বলে উর্বীর থেকে আর বাচ্চা চাইনা তার তাহলে সেদিন উর্বী চরম অসম্মানিত হবে। বাবা হবার খবর শুনলে রাওনাফ নিশ্চয়ই খুশি হবে,তবে উর্বী দেখবে রাওনাফের প্রতিক্রিয়ায় ধরণ। যদি উর্বী বিন্দুমাত্র টের পায় রাওনাফের আদৌও কোনো আগ্রহ ছিলো না তাহলে উর্বী ভীষণ কষ্ট পাবে ভীষণ!

চলমান…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে