আরেকটি বার পর্ব-২৯

0
704

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৯
#Esrat_Ety

অনবরত হাঁচি দিয়েই যাচ্ছে উর্বী। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে রাওনাফ করীম খানের তিন ছানা এখনও ঠিকঠাক আছে অথচ তার মতো একটা ধেরে মহিলা বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই হাঁচি দিতে শুরু করেছে। উর্বী প্রচন্ড বিরক্ত। ভেজা শাড়ি পাল্টে কাবার্ড থেকে একটা কম্ফোর্টার বের করে গাঁয়ে জরিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। রীতিমতো কাঁপছে সে। আজ ডাক্তার তাকে এভাবে দেখলে শাস্তি হিসেবে ঘর থেকে বের করে দেবে নির্ঘাত। রাত তখন ক’টা উর্বী জানে না। রাওনাফ ফোন ধরেনি এবং এখনও ফেরেনি দেখে খানিকটা বিচলিতও উর্বী।

কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থাকার পর হুট করে সে শুয়ে পরতে চাইলো তখনই বাইরে থেকে রাওনাফের গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। বৃষ্টির শব্দেও স্পষ্ট শুনতে পেলো উর্বী।

উর্বী দুমিনিট বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। চেষ্টা করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার। রাওনাফের সামনে হাঁচি দেওয়া যাবে না।

রাওনাফ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীরটা নিয়ে ধীরপায়ে ঘরে ঢোকে। তার পুরো শরীর ভেজা।
উর্বী ঘুরে রাওনাফের দিকে তাকাতেই ধাক্কার মতো খায়। রাওনাফের বিধ্বস্ত মুখটা দেখে মুহূর্তেই অস্থিরতায় ছেয়ে যায় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। এগিয়ে যায় সে,কন্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”ভিজেছেন কিভাবে গাড়ি থাকতে? এতো রাত হলো কেন?”

রাওনাফ একপলক উর্বীর চোখের দিকে তাকায়। উর্বীর কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে। উর্বী একটা তোয়ালে এনে রাওনাফের মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,”বললেন না বৃষ্টিতে ভিজলেন কিভাবে? বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছিলো তাহলে আমাদের সাথে জয়েন করতেন।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী মাথা মোছানো থামিয়ে দিয়ে রাওনাফের চোখে চোখ রাখে। তারপর বলে,”কি হলো! কথা বলছেন না কেন? এতো দেরি হলো কেনো বলুন!”

এবার মুখ খোলে রাওনাফ, অস্ফুট স্বরে বলে,”হসপিটাল থেকে বেরিয়ে নাবিলের দাদা বাড়ি গিয়েছিলাম একটু।”

উর্বী অবাক হয়ে বলে,”সেখানে কি? হঠাৎ নাবিলের দাদাবাড়ি কি মনে করে?”

_সেখানে নাবিলের মাম্মার কবর।

রাওনাফের কথায় উর্বী রাওনাফের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। সে টের পেলো মানুষটা ঠিক নেই,হয় মানুষটা অসুস্থ নয়তো মন খারাপ। আরো একটা ব্যাপার ঘটতে পারে। আত্মগ্লানিতে ভুগতে পারে লোকটা।
আত্মগ্লানির কথাটা ভেবে উর্বীর মনটা হঠাৎ বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। যতোই নিজেকে নিজে বোঝাক,উর্বী এটা কখনো মানতেই পারবে না তার আর রাওনাফের সম্পর্কটা নিয়ে রাওনাফ এখনও মাঝে মাঝে গ্লানিতে ভোগে। কারন যেখানে উর্বীই প্রচন্ড শ্রদ্ধা করে শিমালাকে, রাওনাফ শিমালার সম্পর্ককে। উর্বী তো শিমালার স্থান নয়, চায় রাওনাফের জীবনে আলাদা তার স্থান। যেটা সে টের পায়, রাওনাফ দিয়েছে। তবে এখন কেন মনে হচ্ছে রাওনাফ আত্মগ্লানিতে ভুগছে!

উর্বী সরাসরি জানতে চেয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”পোশাক পাল্টে নিন। আমি বিছানা ঠিক করছি।”

রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে বের হয়। উর্বীর মন খচখচ করছে। সে কিছু বলার আগেই রাওনাফ বিছানার ওপর ধপ করে বসে পরে। উর্বীর ভালো লাগছে না। শান্ত মানুষটাকে কেমন অস্থির লাগছে। সে এগিয়ে যায়। রাওনাফের সামনে দাঁড়ায়। রাওনাফ মুখ তুলে তাকায়। উর্বী বলে ওঠে,”বলবেন না তো কি হয়েছে?”

রাওনাফ ধীরে ধীরে উর্বীর একটা হাত ধরে। তারপর বলে,”তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না তো উর্বী।”

উর্বী অবাক হয়, অবাক ভঙ্গিতেই বলে,”ওমা কিসব বোকার মতো কথা এগুলো। ভুল বুঝবো কেন!”

রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বলে,”আমার নামে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ তুলেছে আমার হসপিটালের এক জুনিয়র নার্স। কাল তদন্ত হবে।”

উর্বীর মনে হলো সে এইমাত্র তার জীবনের সবচেয়ে কুৎসিত কথাটা শুনে ফেলেছে। তার কান ঝাঝিয়ে উঠেছে,পুরো শরীর ঝিমঝিম করছে। তার ইচ্ছে করছে সামনের লোকটাকে অনেক বাজে কথা শুনিয়ে দিতে তার সাথে এমন জঘন্য একটা মজা করার জন্য। সে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,”ছিঃ এসব কোন ধরনের মজা!”

রাওনাফ উর্বীর দু’টো হাত আগলে ধরে, মাথা নিচু করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”সত্যি উর্বী। উর্বী আমি শেষ। আমার নামের পাশে চরিত্রহীন ট্যাগ লেগে গেছে। আমি চরিত্রহীন নই।”

উর্বী বোকার মতো রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ বসে থেকেই নিজের মাথা ঠেকিয়ে দেয় উর্বীর গায়ে। উর্বী আগলে ধরে রাওনাফকে,যদিও তার নিজের শরীর কাঁপছে। রাওনাফের চুলের মধ্যে উর্বীর হাতের আঙুল বিচরণ করছে,আলতো করে মাথাটা ধরে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। রাওনাফ বাচ্চাদের মতো গুটি পাকিয়ে বসে থাকে। বলতে থাকে,”খুব বাজে ভাবে আহত আমি উর্বী। আমি অমন নই। নই আমি অমন।”

“চুপ করবেন আপনি।”
চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে উর্বী। রাওনাফ চুপ হয়ে যায়। উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”একটা লোক,যে কোনো বৈধ দাবি নিয়েও আমাকে ছুঁয়ে দেখেনি দীর্ঘ সময়, নিজের পুরুষ মনের চাহিদাকে প্রশ্রয় দেয়নি‌। তার চরিত্রের স্বচ্ছতা নিয়ে আমার অন্তত কোন সন্দেহ নেই।”

_উর্বী আজকের পর সবার সন্দেহ থাকবে। আমি নির্দোষ প্রমাণিত হবার আগেই মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে এটা সবার উর্বী। রাওনাফ করীম খান হয়তোবা চরিত্রহীন। নয়তো একটা মেয়ে শুধু শুধু মিথ্যা বলবে কেন!

_চুপ আমি আর কিছু শুনতে চাচ্ছি না,পারছি না আমি শুনতে।

উর্বী রাওনাফকে নিজের থেকে আলগা করে ধীরে ধীরে তার রুক্ষ পুরুষালি দুই গাল নিজের নরম দু’টো হাতে আগলে ধরে বলে,”ঘুমিয়ে পরুন আপনি। ঐ উপরে যিনি রয়েছেন তার ওপরে ভরসা আছে আমার। তিনি আর যাই করুক,এই মানুষটাকে অন্তত লাঞ্চিত করবে না, আর কারো কথা জানি না, তবে রাওনাফ করীম নামের স্বচ্ছ একজন পুরুষকে নিয়ে তার অন্তত এই পরিকল্পনা নেই! আপনি ভেঙে পরবেন না।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী এদিক ওদিক এলোমেলো দৃষ্টি দিচ্ছে। যে মানুষটা সবসময় উর্বীর হৃদয় প্রশান্ত করা কথা বলে আজ তার বিক্ষিপ্ত হৃদয় কিভাবে প্রশান্ত করবে উর্বী? কিভাবে শোধ করবে সে ঋণ?

উর্বী জোর করে রাওনাফকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। জোর করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্য এক উর্বীকে। উর্বী পাশে শুয়ে খামখেয়ালি নিজের মাথাটা রাওনাফের বুকে রাখে। রাওনাফ নির্লিপ্ত হয়ে শুয়ে থাকে, খানিকবাদে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”ছেলে মেয়ে গুলো বড় হচ্ছে উর্বী! আমি কিভাবে ওদের ফেস করবো! লোকজন,সবাই হাসবে উর্বী!”

উর্বী রাওনাফের একটা হাত আকরে ধরে নরম গলায় বলে,”সেদিন রাতে আপনি আমায় কি বলেছিলেন? বলেছিলেন,”উর্বী পুরো পৃথিবীর কাছে নিজেকে স্বচ্ছ প্রমান করার দায় তোমার নেই! যদি তোমার কাছের মানুষগুলো তোমাকে নিয়ে খুশি থাকে, তোমার ওপর বিশ্বাস থাকে!”
এটাই বলেছিলেন না? তো হোক জানাজানি! আপনার কোনো দায় নেই প্রমান করার নিজেকে। আমি জানি আপনি কে, নাবিলের মা জেনে গিয়েছে আপনি কি, আপনার মা জানেন আপনি কি, আপনার ছেলেমেয়েরা জানে আপনি কি!”

রাওনাফ কোনো জবাব দেয়না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয় শুধু। উর্বী বুঝে যায় এসব কথায় এই মানুষটার মন শান্ত হবে না। সে চুপ হয়ে যায়। দু’চোখের কার্নিশ ভিজে ওঠে তার। তার জীবনেই একটার পর একটা ঝ’ড় উঠছে! এর শেষ কখন হবে!

রাওনাফকে আকরে ধরে উর্বী। আলিঙ্গন দৃঢ় হয়। কোমল কন্ঠে বলে ওঠে,”কিছুই হবে না কাল! আপনি আমায় খুলে বলুন তো, কোন মেয়েটা? ঐ মেয়েটা যাকে আপনি চাকরি দিতে যাচ্ছিলেন?”

রাওনাফ মৃদু আওয়াজে বলে,”হু।”

_চাকরী দিতে যাচ্ছিলেন কেন!

_উর্বী সেদিন রাতে মেয়েটি এমনভাবে ভেঙে পরেছিলো,আমাকে বললো প্রয়োজনে আমার সাথে রাত কাটাতে রাজি তবু যেন ওকে চাকরি থেকে বের না করি। আমার খুব মায়া হলো, ভাবলাম কতটা অসহায় হলে এমন কথা ভাবতে পারে একটি মেয়ে!

উর্বী চুপ হয়ে যায়। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”অন্তত এই ব্যাপারে গোটা পৃথিবীকে ফেস করার মতো মানসিক শক্তি আমার নেই উর্বী! সত্যিই নেই!”

সে রাতে দুজনের একজনও দু’চোখের পাতা এক করেনি। শুধু ফেলে গেছে দীর্ঘশ্বাস। রাওনাফের অস্থিরতা স্থির থাকতে দেয়নি উর্বীকে। ছটফট করেছে সে সারারাত। মানুষটার এই ভঙ্গুর দশা উর্বীর কাম্য নয়। সে জেনে এসেছে অন্য রাওনাফকে, সে চায় অন্য রাওনাফকে,যে রাওনাফ উর্বীর অস্থিরতা কমিয়ে দেয়, দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

ফজরের আজান দিলে উর্বী সাথে সাথে উঠে বসে। এ কদিনে রাওনাফ উর্বীর অভ্যাস বদলে দিয়েছে। হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দেয়, কখনো বা আগলে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,”উঠবে না হাসের ছানা?” উর্বী অলস হয়ে পরে থাকেনা ফজরের ওয়াক্তে। উঠে নামাজ আদায় করে নেয়।

আজ উঠে সে রাওনাফের দিকে তাকায়। আজ যেনো রাওনাফ নির্লিপ্ত। উর্বী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার হাতের ওপর হাত রেখে মৃদু আওয়াজে বলে,”আজান দিয়েছে শর্মীর পাপা!”

রাওনাফ তার দিকে তাকায়। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে কন্ঠে আক্ষেপ নিয়ে বলে,”আমি এভাবে লাঞ্চিত হতে পারবোনা উর্বী।”

_আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছেন। আপনি উঠুন। দয়া করুন।

***
ব্রেকফাস্ট টেবিলে নাবিল,শর্মী,শায়মী বেশ অবাক হয়ে আশেপাশে তাকায়। শর্মী উর্বীকে বলে,”পাপা কোথায় আন্টি! মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরেনি এখনও?”

উর্বী শুকনো গলায় জবাব দেয়,”উনি ঘরেই আছেন। তোমরা খেয়ে নাও।”

কথাটা বলেই উর্বী রাওনাফের জন্য একটা প্লেটে একটা স্যান্ডউইচ,একমগ কফি নিয়ে দোতলায় চলে যায়। নাবিল শায়মী মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কিছুই বুঝতে পারছে না তারা।

রাওনাফ অগোছালো হয়ে বিছানার একপাশে বসে আছে। গাঁয়ের পোলো টি-শার্ট এলোমেলো হয়ে আছে কলারের দিকটা। দুহাত মুঠি করে কপালে ঠেকিয়ে বসে আছে সে। উর্বীর পায়ের অস্তিত্ব টের পেয়ে রাওনাফ মাথা তুলে তাকায়। উর্বী ধীরপায়ে এগিয়ে আসে। রাওনাফের পাশে বসে রাওনাফের দিকে তাকায়। খাবারের প্লেট টা একপাশে সন্তর্পনে রেখে ঘুরে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তার অগোছালো চুল হাত দিয়ে ঠিক করে দেয়,ঠিক করে দেয় তার পোলো টি-শার্টের কলার। রাওনাফ ঘামছে,গলার এড্যাম’স এপেল বেগতিক ওঠানামা করছে।
উর্বী স্যান্ডউইচ টা তুলে রাওনাফের মুখের সামনে ধরে, খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে,”আপনি কোনো বাচ্চা নন। আপনি আমাদের অভিভাবক। প্লিজ সেরকম থাকুন।”

রাওনাফ স্যান্ডউইচ টা খেয়ে নেয় চুপচাপ। উর্বী বলে,”আপনার সহধর্মিণী সবসময় শ্রদ্ধার সাথেই আপনার বুকে মাথা রাখবে। এটুকু অন্তত জেনে রাখুন।”

রাওনাফ নেতিয়ে পরে,নরম গলায় বলে ওঠে,”ছেলে মেয়ে তিনটা বড় হয়ে গিয়েছে উর্বী ‌। ওরা সব বোঝে। ওরা যদি জানতে পারে ওদের পাপার নামে সে’ক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ উঠেছে তাহলে? তাহলে কি হবে উর্বী? কিভাবে ফেস করবো আমি বাচ্চাগুলোকে! এর চেয়ে তো আমার মরাও ভালো!”

উর্বী রাওনাফের মুখের ওপর হাত রেখে দেয় আলতো করে। এর বেশি তার কান শুনতে পারবে না কিছু।

হাত থেকে কলেজের এডমিশনের কাগজগুলো ফেলে দিয়ে মুখ চেপে ধরে শায়মী। এইমাত্র সে যা শুনলো তাতে তার ইচ্ছা করছে দৌড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু আশ্চর্য সে নড়তে পারছে না। নাবিল বোকার মতো একবার শায়মীকে একবার ঘরের ভেতরে থাকা রাওনাফ উর্বীকে দেখছে। রাওনাফ উর্বী ওদিক ফিরে বসেছিলো বলে তখনও খেয়াল করেনি নাবিল শায়মীকে।
নাবিল মেঝে থেকে এডমিশনের কাগজগুলো তুলে নেয়। তারা এসেছিলো রাওনাফের থেকে সাইন করিয়ে নিতে। কাগজগুলো তুলে নিয়ে নিঃশব্দে শায়মীর হাত ধরে টানতে টানতে শায়মীদের ঘরে নিয়ে যায়।
শায়মী ডুকরে কেঁদে ওঠে। নাবিল বলে,”চুপ চুপ!”

শায়মী কাঁদতে কাঁদতে বলে,”এসব আমি কি শুনলাম নাবিল!”

_আমাদের পাপা গ্রেট,হি ইজ ইনোসেন্ট।

শায়মী চোখের পানি মুছে নেয়। ধরা গলায় বলে,”জানি তো! কিন্তু নাবিল এখন কি হবে! পাপা খুব কষ্ট পাচ্ছে নাবিল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!”

“চুপ একেবারে শায়মী। পাপা যদি টের পায় আমরা জেনে গিয়েছি পাপা আরো কষ্ট পাবে। ভীষণ কষ্ট পাবে। প্লিজ চুপ কর।”

শায়মী ফোপাচ্ছে। শর্মী হুরমুর করে ঘরে ঢুকতেই দুজন চুপ হয়ে যায়। শায়মী চোখের পানি মুছে ফেলে। শর্মী ভাইয়া আপুর মুখের দিকে তাকায়। নাবিল ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”দেখছিস কি! স্কুলে যা! ভাগ!”

****
উর্বীর হাত পা কাঁপছে। রাওনাফ এই মাত্র বেরিয়েছে। আজ যদি কোনো অঘটন ঘটে ! ঐ ধরনের মেয়েকে দু’টো চ’ড় থাপ্পড় মারলেই সত্যিটা উগ্রে দেবে ঠিক,কিন্তু এতে তো রটনা হয়ে যাবে হয়তো ক্ষমতার বলে রাওনাফ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করেছে। ভি’ক্টিমকে ভয় দেখিয়ে।
উর্বীর শরীরটা অস্বাভাবিক দুর্বল লাগছে। তার ভীষণ ভ’য় করছে। এটা যেই সেই অভিযোগ নয়, যৌন হয়রানি। এই অপবাদ কিভাবে সইবে ঐ লোকটা! ইতিমধ্যে কতটা ভেঙে পরেছে সে! উর্বীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।

উর্বী তার বিছানায় বসে আছে।‌ রওশান আরা ঘরে ঢোকে,”বৌমা। কিছু খাবে না।”

উর্বী তার শাশুড়ির দিকে তাকায়। শুকনো গলায় বলে,
“কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”

রওশান আরা ঘরে ঢুকে বসে,”দেখে তো শরীর খারাপ লাগছে তোমার! কিছু কি হয়েছে?”

উর্বীর চোখ যায় টেবিলের ওপর রাখা কাগজটাতে। সে কাগজটা উঠিয়ে দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর উর্বী হুট করে বলে ওঠে,”মা আমি হসপিটালে যেতে চাই।”

রওশান আরা অবাক হয়ে বলে,”বৌমা তুমি এই শরীরে…”

_আমি ঠিক আছি মা। আপনি মনে করে দুপুরের ওষুধ টা খেয়ে নেবেন।

রওশান আরা কিছু বলে না।

উর্বী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার খোলা চুলগুলো খোঁপায় বেঁধে নেয়।

নাবিল এসে ঘরের বাইরে দাঁড়ায়। অনেকটা সংকোচ নিয়ে বলে,”আন্টি!”

উর্বী অবাক হয়ে ঘুরে তাকায়। তাকে নাবিল সচারচর আন্টিও ডাকে না। সে ঠান্ডা গলায় বলে,”কিছু বলবে?”

_পাপা কোথায় বেরিয়েছে?

_হসপিটালে! জরুরি কোনো দরকার? সকাল থেকে দেখছি ওনার খোঁজ করছো ‌!

নাবিল ইতস্তত করে বলে,”না মানে, এডমিশনের পেপার্স গুলোতে সাইন দরকার পাপার।”

উর্বী কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”এখনি দরকার? আমি সাইন করে দিলে হবে?”

নাবিল কিছু বলে না, তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। উর্বী পার্স ব্যাগ তুলে নিয়ে বলে,”দুপুরে ফিরবে তোমার পাপা।”

নাবিল বলে,”আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

_হসপিটালে।

শায়মী এসে ঘরের বাইরে দাঁড়ায়। উর্বী বেরিয়ে যায়। নাবিল শায়মী দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

****
ম্যানেজমেন্ট রুমে মিটিং বসেছে। হসপিটালের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সব স্টাফ এবং ডক্টর রাও রয়েছেন। রয়েছেন আরো পাঁচজন সার্জন যাদের সাথে রাওনাফ এই হসপিটালের মালিকানা শেয়ার করে। ডক্টর মাহমুদউল্লাহ রুপার দিকে তাকিয়ে বলে “তো তুমি সেই অভিযোগকারীনি?”

রুপা মাথা নিচু করে বসে আছে। রাওনাফ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুপার সাহস নেই বড় স্যারের দিকে তাকানোর।

সে মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে ডক্টর মাহমুদউল্লাহকে বলে,”জ্বি।”

মাহমুদুল্লাহ রাওনাফের দিকে তাকায়। বয়সে সে রাওনাফের জুনিয়র তাই স্যার বলে সম্বোধন করে,”স্যার সবই শুনলাম। আপনার কি বলার আছে?”

_আমি নির্দোষ। এসব মিথ্যা।
দৃঢ় ভাবে বলে রাওনাফ।

_কি প্রমান আছে?

_আমি যে দোষী তারও তো কোনো প্রমান নেই। শুধুমাত্র মৌখিক অভিযোগ!
ঠান্ডা গলায় বলে রাওনাফ।

মাহমুদুল্লাহ বলে,”পয়েন্ট। সেজন্যই তো আমরা তদন্ত করতে এসেছি।”
এরপর সে রুপার দিকে তাকিয়ে বলে,”বলো সেদিন রাতে কি হয়েছিলো, বড় স্যার তোমাকে কি বলেছিলো।”

রুপা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তার হাত পা কাঁপছে। কি করতে যাচ্ছে এটা সে! কেনো জরিয়ে গেলো এসবে! নিজেকে ধাতস্থ করে বলতে থাকে,”সেদিন রাতে আমি বড় স্যারের…….”

রুপার কথার মধ্যেই একজন ওয়ার্ড বয় ঢুকে রাওনাফকে বলে,”স্যার ম্যাডাম এসেছে।”

রাওনাফ হতবাক হয়ে লামিয়ার দিকে তাকায়। লামিয়া দরজার দিকে চায়। উর্বী ম্যানেজমেন্ট রুমে ঢোকে। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী তার দিকে না তাকিয়ে কোনায় একটি চেয়ারে বসে।

রাওনাফ ঘামছে। উর্বী কেনো আসতে গেলো! সহ্য করতে পারবে এই হিউমিলিয়েশন!

উর্বীকে দেখে রুপা থেমে যায়। অস্বস্তিতে তার মন আর মস্তিষ্ক ছেয়ে যায়। উর্বী তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে।

ডক্টর মাহমুদউল্লাহ রুপাকে বলে,”থামলে কেনো বলো।”

রুপা হালকা কেশে বলে,”আমি তো আমার বক্তব্য লিখেই দিয়েছি,আমাকে বারবার কেনো এসব জিজ্ঞেস করা হচ্ছে?”

_কেনো? বলতে অসুবিধা টা কোথায়? আমাদের তো জানতে হবে তোমার লিখিত স্টেটমেন্ট আর মুখের কথা এক কিনা। তুমি মিথ্যা বলছো কি না।”

_আমি মিথ্যা বলছি না। আচ্ছা বলছি, সেদিন রাতে স্যার আমাকে তার রুমে ডাকে। পরে আমাকে জানায় আমার চাকরি থাকবে না। কারন তার আগের দিনই আমার হাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। তো আমি স্যারের পায়ে পরি,তখন স্যার আমার সাথে খারাপ আচরণ শুরু করে। এক পর্যায়ে সে জানায় আমার চাকরি পেতে হলে তার সাথে……”

উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে সে রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ব্যাস এটুকুই?”

রুমের সবাই উর্বীর দিকে তাকায়। রাওনাফ আর লামিয়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

উর্বী আবারো বলে,”তারপর কিছু হয়নি?”

ডক্টর মাহমুদুল্লাহ বলে,”আপনি কে?”

_আমি কে সেটা জানা জরুরী না। জরুরী হচ্ছে এখন এই মেয়ের কথাগুলো শোনা। বিস্তারিত। তো বলো মেয়ে, তারপর আর কিছু হয়নি?”
রুপার দিকে তাকিয়ে ধ’ম’কে ওঠে উর্বী।

রুপা থতমত খেয়ে বলে ,”না, এটুকুই!”

_কিন্তু আমার তো তা মনে হয় না। তুমি সেদিন তোমার স্যারের সাথে রাত কাটাতে রাজি হয়েছিলে। হওনি? বলো!

রাওনাফ হতবাক হয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী কিসব বলছে!

ডক্টররা হা হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশের একজন ডক্টর মাহমুদউল্লাহর কানে ফিসফিসিয়ে বলে,”ইনি হচ্ছেন বড় স্যারের স্ত্রী।”
মাহমুদুল্লাহ অবাক হয়।

উর্বী রুপাকে বলে,”বলো। আমি যা বলছি তা কি ঠিক না? তোমার বড় স্যার তোমাকে বাজে প্রস্তাব দিয়েছে এবং তুমি রাজি হয়েছো। রাত কাটিয়েছো তার সাথে।”

রুপা ক্ষে’পে যায়,”মিথ্যা কথা। এসব কিছুই হয়নি।”

_হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে। তুমি তোমার স্যারের ডাকে সাড়া দিয়েছো। আমি নিশ্চিত। যা হয়েছে সব তোমার সম্মতিতেই হয়েছে।

রুপার চোখের কোনায় পানি।
“না, মিথ্যা বলছেন আপনি। এসব বানোয়াট। আমি এসব কিচ্ছু করি নি।”

আরেকজন ডক্টর,যার নাম মেহেদী হাসান সে জিজ্ঞেস করে উর্বীকে,”আপনি কিভাবে এতো জোর দিয়ে বলছেন? আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে?”

_প্রমান আছে দেখেই বলছি।

উর্বী তার পার্স থেকে একটা কাগজ বের করে মেহেদী হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়।
“এই যে নিন। এটা এই মেয়ের এপয়েনমেন্ট লেটার। ও সেদিন ওর স্যারকে খুশি করেছিলো বিধায় সেদিন রাতেই ওর স্যার ওকে অন্যত্র চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে,তাও আবার বেশি বেতনে। আর এটা ভুয়া কাগজ নয়,চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।”

রুপা পুলিশের হাতের কাগজটির দিকে তাকায়। সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে,”মিথ্যা কথা। আমি এমন কিছুই করি নি। স্যারের সাথে আমার কিছুই হয়নি।”

_হয়েছে তো অবশ্যই। তোমার স্যারকে তো আমি পরে বুঝে নেবো, আমি আগে তোমায় দেখে নিতে চাই। তোমার স্যার এবং তুমি, তোমাদের দুজনের নামে আমি প্রতারনার কেস করবো।

রুপা কাঁদছে,”ম্যাম বিশ্বাস করুন। আমি এমন কিছুই করি নি। আমি ওই ধরনের মেয়ে নই।”

_করেছো করেছো , তোমার স্যার তোমাকে প্রস্তাব দিয়েছে এটা অর্ধেক সত্যি, তুমিও নষ্টা মেয়েদের মতো রাজি হয়েছো,এটা পুরো সত্যি।

রুপা চেঁচিয়ে ওঠে,”না রাজি হইনি। আমি কিছু করিনি।”

_তাহলে এই কাগজটি কিসের? তোমার স্যার তোমার প্রতি খুশি না হলে এতো উপকার কেনো করতে যাবে তোমার ? বাজারি মেয়ে কোথাকার বড়োলোক দেখলেই শুয়ে পরতে ইচ্ছে করে?

রুপা কেঁদে ফেলে,”না এমনটা কিছুই হয়নি। আমি খারাপ মেয়ে না। স্যারের সাথে আমার কিছুই হয়নি। আমি রাত কাটাইনি স্যারের সাথে!”
_বিশ্বাস করি না। আমি উঠছি। ডক্টর রাওনাফ করীম খান এবং তুমি। দু’জনেই পানিশমেন্টের জন্য তৈরি হও। তোমাকে আমি একটুও ছাড় দেবো না বিশ্বাস করো।

রাওনাফ বাকরুদ্ধ হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। লামিয়া রাওনাফের পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলে,”রিল্যাক্স রাওনাফ। দেখতে দাও আমাকে।

উর্বী রুপাকে বলতে থাকে,”বাজারি মেয়ে। আত্মসম্মান নেই, প্রস্তাব দিলেই শুয়ে পরতে হবে তাইনা? বল কার কার সাথে শুয়েছিস এ পর্যন্ত? এই হসপিটালের সব ডাক্তারদের সাথে শুয়েছিস?

রুপা কান চেপে ধরে চেঁ’চি’য়ে বলে,
_ম্যাম,স্যারের সাথে আমার কিছুই হয়নি।

_কেন হয়নি ?
আরো চেঁ’চি’য়ে বলে উর্বী,

_কারন স্যার আমাকে কোনো বাজে প্রস্তাব দেয়ই নি।

রুমের সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রুপা কেঁদেই যাচ্ছে।

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বীর মুখ হাসি হাসি।

সবার ঘোর কেটে গেলে উর্বী রুপার উদ্দেশ্য বলে,”অন্যের চরিত্রে দাগ লাগনো খুবই সহজ, কিন্তু সেটা যদি ঘুরে নিজের দিকেই আসে তখন খুব কষ্ট হয় তাই না?”

মাহমুদুল্লাহর মুখ থেকে,”ও মাই গুডনেস” বাক্যটি বের হয়।

উর্বী রুপার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি তোমার খুব করুণ দশা করে ছাড়বো রুপা!”

সবাই উর্বীকে দেখতে থাকে। উর্বীর চোখ মুখে আগুন জ্বলছে।

কয়েকজন নার্স তখন সাহস করে বলে ওঠে,”আমরা বছরের পর বছর স্যারকে দেখছি। রাত দুটো হোক,তিনটে হোক নির্দ্বিধায় স্যারের কেবিনে গিয়েছি। একা একা। আমরা তো স্যারকে এমন ভাবতেই পারি না।

ডক্টর মেহেদী হাসান রুপাকে বলে,”তুমি তাহলে স্যারের নামে মিথ্যা অভিযোগ….”

উর্বী তাকে থামিয়ে রুপা কে বলে,”তোমার স্যার আমাকে বলেছে তার আর তোমার মধ্যে কি কথোপকথন হয়েছে। আমি তোমার সম্পর্কে খোজ খবর নিয়ে দেখেছি। তোমার বাবা তো আরেকটি বিয়ে করে তোমাদের আর দেখেন না। ভাই বোনকে নিয়ে তোমার সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। সেদিন তুমি তোমার স্যারের কেবিন থেকে চলে যাওয়ার পরে তোমার স্যার কি করেছে জানো, তোমাকে তার রাজশাহীর হসপিটালে নিয়োগ দিয়েছে, তোমার প্রতি তার মায়া হয়েছে। আর তুমি কি করলে? অকৃতজ্ঞ। তুমি তো চাইতে তোমার মা আর ভাইবোনকে নিয়ে না খেয়ে যেন মরতে না হয়। কিন্তু আমি তোমাকে তোমার পরিবার সহ রাস্তায় নিয়ে ফেলবো।”

উর্বী রাগে ফেটে পরে। কেউ কিছু বলছে না। রাওনাফ শুধু উর্বীকে দেখছে।

রুপা কাঁদতে থাকে,তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে,সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”সরি ম্যাম।”

উর্বী খানিকটা দম নিয়ে বলে,”তোমার মতো একজন ছাপোষা নার্সের এতো সাহস হবার কথা না, নিশ্চয়ই কেউ ইন্ধন দিয়েছে তোমাকে! যদি তোমায় এ ব্যাপারে কেউ উষ্কে থাকে তুমি নামটা বলো। যদি তোমার বিন্দুমাত্র লজ্জা হয়ে থাকে তুমি নামটা বলে দাও।”

রুপা কাঁদছে। দীর্ঘক্ষণ কেঁদে সে চোখের পানি মুছে ডক্টর কিশোরের দিকে তাকায়। রুমের সবাই তা খেয়াল করে। রাওনাফ হতবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিশোর মাথা নিচু করে বসে আছে।

মাহমুদুল্লাহ বলে,”আমাদের মনে হয় আমাদের কিছু করার নেই এখানে।”
তারপর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”তবে স্যার আপনি চাইলে আমরা একশন নিতে পারি এখনই।”

রাওনাফ স্বাভাবিক ভাবে বলে,”তার আর দরকার নেই। আপনারা আসুন। ধন্যবাদ।”

ম্যানেজমেন্ট কমিটির সবাই চলে যায় । একে একে রুম থেকে সবাই বের হয়। রুমে থাকে শুধু রাওনাফ,উর্বী,লামিয়া,রুপা এবং ডক্টর কিশোর ‌।

রাওনাফ কাতর কন্ঠে ডক্টর কিশোরকে বলে,”কেনো কিশোর? আমার কি কোনো ভুল ছিলো? কখনো তোমার সাথে কোনো অন্যায় করেছি?”

কিশোর মাথা নিচু করে রাখে।

রুপা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। লামিয়া ধ’ম’কে বলে,”তুমি এখান থেকে এই মুহূর্তে বের হয়ে যাও। নয়তো পুলিশ ডাকবো!”

রুপা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় উর্বীর চোখে চোখ পরে রুপার। উর্বী চোখ ফিরিয়ে নেয়।

কিশোর নীরবতা ভেঙে রাওনাফকে বলে,”আমি আর তুমি একই অবস্থানে, দুজনেই ভালো ডাক্তার। তবু সবাই তোমাকে নিয়ে মাতামাতি করে, তোমার সুনাম বেশি। কারন তুমি হসপিটালের একজন মালিক….. এছাড়া তোমার কোনো বিশেষত্ব নেই রাওনাফ।”

রাওনাফ বলে,”শুধুমাত্র এই কারনে? আউট অফ জেলাসি? এই কারনে তুমি এমন ঘৃণ্য একটা চাল চেলেছো! আমাদের বন্ধুত্বের কোনো দাম নেই?”

লামিয়া বলে ওঠে,”তোমার বিরুদ্ধে এ্যাকশন নেওয়া হবে কিশোর। তুমি চিন্তা করো না, তোমার কর্মের উপযুক্ত ফল পাবে তুমি!”

কিশোর চুপ করে থাকে।

রাওনাফ চুপচাপ উঠে চলে যায়। উর্বীও উঠে রাওনাফের পিছু পিছু যায়।

লামিয়া বসে আছে,সে কিশোরকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ছিঃ কিশোর। ছিঃ”

****
রাওনাফ কেবিনে এসে গায়ের ব্লেজার খুলে চেয়ারের উপর সজোরে ছুঁ’ড়ে মারে। হাত মুঠো করে টেবিলে সজোরে ঘুষি দেয়।
উর্বী এসে রাওনাফের হাত ধরে,”কি করছেন,ব্যা’থা পাবেন তো।”

রাওনাফ উর্বীকে ধরে,”মানুষ এতো অদ্ভুত কেনো উর্বী বলোতো? আমি তো বিশ্বাস করতে চাই না। আমি ভুলতে চাই। আমি কিশোরকে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ই ভাবতে চাই।”

উর্বী বলে,”আপনার কিছু ভাবতে হবে না। আপনি আমার সাথে বাড়িতে চলুন। সকাল থেকে ঐ স্যান্ডউইচ ছাড়া কিছুই খাননি। আমিও খেতে পারিনি। ”

লামিয়া দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাশি দেয়। রাওনাফ আর উর্বী সেদিকে তাকায়। লামিয়ার সাথে আরো ডাক্তার এবং নার্স এসেছে। সবাই রাওনাফের সাথে কথা বলতে চায়।

লামিয়া বলে,”তোমার বৌয়ের প্রশংসায় তো থাকাই যাচ্ছে না রাওনাফ।”

রাওনাফ ম্লান হাসে।
লামিয়া বলে,”সি ইজ ব্রিলিয়ান্ট!”

রাওনাফ সবাইকে বলে,”তোমাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তোমাদের সাপোর্ট আমাকে অনেকটা শক্ত রেখেছে।”

লামিয়া বলে,”কিশোর কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না রাওনাফ।”

রাওনাফ চুপ করে থাকে, লামিয়া বলতে থাকে,”এর আগে ও এই হসপিটালে যত সিন্ডিকেট করেছে তখনই তোমার উচিত ছিলো স্টেপ নেওয়া।”

_বাদ দাও লামিয়া,আমি আর ভাবতে চাচ্ছি না এসব কথা!

_ওর ব্যাপারে কি ব্যাবস্থা নেবে তুমি? কেস করো।

_পরে দেখা যাবে। পুরো ব্যাপারটা আমি আগে হজম করে নিই!

রাওনাফের সাথে তার সব কলিগরা কথা বলে চলে যায়। সবাই চলে যেতেই রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়।
“এভাবে এখানে আসতে গেলে কেনো?”

উর্বী রাওনাফের ডান হাত টেনে দুহাতে আগলে ধরে চুমু খায়। নরম গলায় বলে,”যে মানুষটা আমার কলঙ্কগুলোকে আগলে নিয়েছে। তার চরিত্রে কোনো মিথ্যা কলঙ্ক লাগুক,আমি মানতেই পারতাম না শর্মীর পাপা। কতটা ছ’ট’ফ’ট করছিলাম জানেন। এমতাবস্থায় আমি বাড়িতে বসে থাকতাম? আপনার মনে হয়?”

রাওনাফ তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। উর্বীর ডান গালে হাত রেখে নিচু স্বরে বলতে থাকে,”শরীর ঠিক আছে তোমার?”

উর্বী মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”এখন ঠিক আছি।”

উর্বীকে টেনে রাওনাফ আগলে নেয়। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলে,”কে বলেছে এই উর্বী বোকা? এই উর্বী মোটেও বোকা উর্বী নয়!”

চলমান…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে