আরেকটি বার পর্ব-২৬+২৭

0
866

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৬
#Esrat_Ety

উর্বী ঘুমন্ত রাওনাফকে দেখছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেই তখন থেকে। চোখ ফেরায় না সে।

লোকটা কেমন বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে ঘুমায়। ঘুমালে কি নিষ্পাপ দেখতে লাগে! ঘুমন্ত রাওনাফকে দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো স্বপ্ন দেখছে। আচ্ছা কি স্বপ্ন দেখছে এই লোক? নিশ্চয়ই কোনো রোমান্টিক স্বপ্ন নয়। হয়তো দেখছে কারো অ’পারেশন করছে! অ’পারেশন থিয়েটারে নার্সদের ধমকা ধমকি করছে,”সিস্টার গজ কোথায়? স্টুপিড সিস্টার নাইফ কোথায়? আহাম্মক সিস্টার ব্লে’ড কোথায়?”
নিশ্চয়ই এসবই দেখছে,কপালটা কিরকম কুঁ’চ’কে আছে, স্বপ্নে সিস্টার আর ইনটার্ন ডক্টরদের ধমকাচ্ছে বলেই কুঁ’চ’কে আছে কপাল। দীর্ঘসময় পরে ধীরে ধীরে রাওনাফের কপালের সে রেখা বিলীন হয়। উর্বী ভাবে, অ’পারেশন নিশ্চয়ই সাকসেসফুল হয়েছে স্বপ্নে তাই কপাল আর কুঁ’চ’কে নেই!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে উর্বীর হাসি পেয়ে যায়।

দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাওনাফের গাঁয়ের দিকে তাকায় উর্বী। তাকাতেই লজ্জায় মিইয়ে যায় সে। গাঁয়ের চাদরটা কিছুটা সরে গিয়েছে, ফরসা, চওড়া, পুরুষালি উদাম লোমশ বুকের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। উর্বী হাত বাড়িয়ে চাদরটা গলা অবধি টেনে দেয় ভালো করে। সে খেয়াল করলো এখন তার মধ্যে বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই। নেই কোনো জড়তা। কেনোই বা থাকবে!
রাওনাফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। উর্বীর একটু মানুষটার গালে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো হঠাৎ। ছুঁয়ে দেবে নাকি? না থাক। যদি রাওনাফের ঘুম ভেঙ্গে যায়!

তার হাত নিশপিশ করছে। সে ছুঁয়েই দেয়। আলতো করে গালে হাত রাখে। রাওনাফ মৃদু নড়তেই সে দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। রাতের সেই মধুর দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে পুনরায় দৃশ্যায়িত হয়, পুনরায় লজ্জায় গুটিয়ে যায় সে। রাওনাফের থেকে কিছুটা চাদর নিজের দিকে টেনে নিয়ে ঢেকে নেয় নিজের আলুথালু বেশ। এরপর অন্যপাশে ফিরে শোয়। চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে জানালার দিকে দৃষ্টি দিয়ে। জানালাটা কাল রাতে বন্ধ করা হয়নি। পর্দাটাও একপাশে সরিয়ে রাখা। সকালের মিষ্টি কড়া রোদ এসে ঘরের ভেতর বেহায়ার মতো ঢুকে পরছে। অনুমতি নেয়না রাওনাফ-উর্বী দম্পতির।

রাওনাফের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে উর্বী যখন তার গালে হাত রেখেছে তখনই। উর্বী ওদিক ফিরে শুতেই সে চোখ খুলে তাকায়। তারপর উর্বীর পিঠের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

কিছুসময় পরে উর্বী উঠে বসে। রাওনাফ চোখ বন্ধ করে নেয়। বিছানায় অগোছালো হয়ে পরে থাকা উর্বীর বেগুনী রঙের সুতি শাড়ির আঁচল উঠিয়ে সে ভালো করে জরিয়ে নেয় নিজের শরীর। একটা মৃদু হাই তুলে অলস ভঙ্গিতে খোলা চুলগুলো খোঁপা করে নেয়। তারপর ঘুরে রাওনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামে। ঘরে পরার চপ্পলে পা ঢুকিয়ে আলমারির কাছে যায়,বেছে নেয় একটা পছন্দের শাড়ি।

কিচেনে হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। উর্বী দোতলা থেকে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। বাড়িতে তো মহিলা বলতে শুধু রওশান আরাই রয়েছেন। আমীরুনও বাড়িতে নেই। কারা কথা বলছে তবে!

উর্বী তাড়াহুড়ো করে সিড়ি ভেঙ্গে নামছে। ইতিমধ্যে সকাল সাড়ে নয়টা বেজে গিয়েছে। রাওনাফ আজ এগারোটায় চেম্বারে বসবে, রান্নাঘরের কি অবস্থা কে জানে! আমীরুন নেই,কাল উর্বীও বিকেল থেকে ঘরেই বন্দী হয়ে ছিলো। বাইরে এসে একটাবার দেখেওনি কেউ রাতে খেয়েছে কি না। শর্মীর আজ স্কুল ছুটি তাই তাকে টিফিন করে দেওয়ার ঝামেলা নেই তবে ছেলেমেয়েগুলো এতো সকাল অবধি না খেয়ে আছে ভেবেই কেমন অপরাধবোধ হতে থাকে উর্বীর। এখন ঝটপট করে সব করে নিতে হবে তার!

কিচেনের দিকে এগিয়ে যেতেই উর্বী দাড়িয়ে যায়। তার ননদেরা জায়েরা চারজনই রান্নাঘরে। উর্বী কিছুটা অবাক হয়ে তাকায় সবার দিকে। অন্তরা কিচেনে শুকনো মুখ করে একটা চেয়ারে বসে ছিলো। বাকি তিনজন কাজ করছে। উর্বীকে দেখে রুমা পাত্তা না দেওয়ার মতো করে বলে ওঠে,”উঠেছো ভাবী! তুমি আজ গ্রিলড পমফ্রেট করবে। সেদিন খেয়েছিলাম। কি যে ভালো করো ওটা!”

উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”তোমরা?”

_ভাবছো আমরা কোত্থেকে উদয় হলাম তাইনা? আমি উদয় হয়েছি আমার শশুর বাড়ি থেকে,বড় আপা তার শশুরবাড়ি থেকে আর মেজো ভাবী আর অন্তরা চট্টগ্রাম থেকে উদয় হয়েছে। ভোর ভোর এসে পৌঁছালাম সবাই।

এক নাগাড়ে জবাব দেয় রুমা। উর্বী অন্তরার দিকে তাকায়। খুব মায়া লাগে ঐ মুখটা দেখলে। এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”কেমন আছো? তোমার স্বামী আসেনি?”

অন্তরা মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”এসেছে। রেস্ট নিয়ে বাজারে গিয়েছে।”

উর্বী সবার দিকে তাকায়। মোহনা বলে,”শাফিউলের কলেজ থেকে ছুটি পায়নি। আমি কতদিন সবাইকে দেখিনা। অন্তরাও বারবার বলছে বাড়ি আসতে চায়, তাই জন্য এলাম হুট করে সবাই। ভাইয়া তোমায় কিছু বলেনি?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। সে এসবের কিছুই শোনেনি। মোহনা উর্বীর দিকে এগিয়ে আসে। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে উর্বীকে দেখে মিটিমিটি হাসে। তারপর বলে,”তোমাকে কি সুন্দর লাগছে ভাবী! একেবারেই স্নিগ্ধ লাগছে। আমার দাদী বলেন ভেজা চুলে রমনী যখন সুপ্রভাতে রান্নাঘরে পা রাখে,তখন রমনীর সেই স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে রান্নাঘরের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়।”

উর্বী মোহনার কথা প্রায় এড়িয়ে গিয়ে থালাবাটি নাড়াচাড়া করতে থাকে। মোহনা হাসছে, মোহনার সাথে পাল্লা দিয়ে হাসছে রুমা। দু’জনেই প্রায় সমবয়সী কিনা।

আজমেরী চুলা থেকে চায়ের পাতিল নামিয়ে উর্বীকে উদ্দেশ্য করে বলে,”উর্বী…. দুঃখিত, ভাবী, তুমি যাও। আমরা এদিকটা দেখবো।তুমি গিয়ে দেখো ভাইজানের কি লাগবে,তার তো আজ চেম্বার আছে।”

মোহনা হাসতে হাসতে বলে ওঠে,”ভাইয়ার আবার কি লাগবে, ভাইয়ার যা লাগবে তা কাল….”

উর্বী মুখ চেপে ধরে মোহনার। আশেপাশে তাকিয়ে কন্ঠস্বর নিচু করে অনুরোধের সুরে বলে,”প্লিজ মোহনা, ওরা তিন ভাইবোন লিভিং রুমে পায়চারি করছে।”

সবাই চুপচাপ হয়ে যায়। উর্বী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দোতলায় উঠতে থাকে। আজ ঘর থেকে বেরোবেই না সে।

ঘরের দরজার সামনে এসে উর্বী দাঁড়িয়ে যায়। ভেতরে আর পা রাখে না সে। অস্বস্তিতে পুরো মুখ ছেয়ে গেছে তার। ঘরের ভেতরে পা রাখবে কি রাখবে না তাই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে বিছানায় একপাশে চুপচাপ বসে আছে। তার হাতে শিমালার ছবিটা। একদৃষ্টে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা নিচু করে রেখেছে বলে উর্বী তার দৃষ্টি পড়তে পারছে না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দরজার বাইরে, এই সময়ে ঘরে ঢুকে ঐ মানুষটাকে অস্বস্তিতে ফেলতে সে ইচ্ছুক নয়, একেবারেই নয়।

“আন্টি ! এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো!”
শর্মীর ডাকে উর্বী ঘুরে তাকায়। রাওনাফ মাথা তুলে তাকায়। উর্বী নিচুগলায় শর্মীকে বলে,”এমনিই দাঁড়িয়ে আছি। কিছু বলবে?”

_হ্যা। আজ বিকেলে আমি আর আপু শাড়ি পরবো। তুমি পরিয়ে দেবে?

উর্বী হেসে মাথা নাড়ায়। শর্মী চলে যায় নিজেদের ঘরের দিকে। রাওনাফ শিমালার ছবিটা রেখে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের বাইরে এসে উর্বীর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”কি হয়েছে? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

উর্বী নিচুগলায় বলে,”এইতো ঘরেই ঢুকছিলাম।”

রাওনাফ চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে উর্বীর হাত ধরে। তারপর ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। উর্বী তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে খেয়াল করেছে,এই মানুষটা তাকে ছুলেই সে নতুন করে তার অস্তিত্ব টের পায়। উর্বীর অস্তিত্বহীনতার জটিলতা কে’টে যায় এই মানুষটার স্পর্শে। সম্মোহিত হয়ে থাকে উর্বী।

ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে রাওনাফ উর্বীর হাত ছেড়ে দেয়। তারপর টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ এনে উর্বীর হাতে দেয়। উর্বী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়, অস্ফুট স্বরে জানতে চায়,”কি এটা?”

_তোমাকে ডেকেছে এলজিডি থেকে, ইন্টারভিউয়ের জন্য!

_জব? কিন্তু আমি তো এপ্লাই করিনি! আগেরটাই তো স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম!

_আমি দিয়েছিলাম তোমার সিভি জমা।

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”চাকরি বাকরি করতে চাচ্ছি না আমি আর!”

_কিন্তু কেনো? কোয়ালিফিকেশন আছে, এক্সপেরিয়েন্স আছে। তুমি তো নিজেও চাইতে। হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত?

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ তাকিয়ে আছে তার দিকে। উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বলে,”অনেক আত্মনির্ভরশীল আত্মনির্ভরশীল খেলা খেলেছি। এখন আমি পুরোপুরি আপনার ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাই। আমার স্বামীর ওপর। এই সংসার ছাড়া আর কিছুতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”

কথাগুলো বলে উর্বী বারান্দায় চলে যায়। গিয়ে রাওনাফের কবুতরগুলোকে খাবার দেয়। খোলা দরজা দিয়ে তাকে দেখতে থাকে রাওনাফ।

****
উচ্ছাস গিয়ে চুপচাপ শাখাওয়াত চৌধুরীর পাশে বসে। শাখাওয়াত চৌধুরী নিউজপেপার থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে একপলক তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”হেয়ারস্টাইল চেঞ্জ করেছো! দেখতে ভালো লাগছে। এখন কিছুটা সভ্য লাগছে!”

উচ্ছাস বাঁকা হাসি হাসে। বাবার কথার জবাবে বলে ওঠে,”কেনো ডেকেছো?”

_আসার পর থেকে ঘরে ঢুকে বসে আছো। সারাদিন ল্যাপটপ আর গিটার। সমস্যা কি তোমার?

_আর কি করবো তবে? খু’ন করবো?

উচ্ছাস বলতে বলতে হেসে ফেলে।‌ শাখাওয়াত চৌধুরী ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,”সেন্টমার্টিন কেনো গিয়েছিলে বলো!”

_হাওয়া খেতে।
ঠান্ডা গলায় বলে উচ্ছাস।

_এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো না।

উচ্ছাস আগের চাইতেও দৃঢ় গলায় বলে,”তাহলে শোনো। ওখানে গিয়েছিলাম একটা মা’র্ডা’র করতে। মেরে বালি চাপা দিয়ে এসেছি!”

শাখাওয়াত চৌধুরী একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তোমার মেজো চাচার ছেলে তোমার বয়সী। সে বিয়ে করে বৌ বাচ্চা নিয়ে বাবার ব্যাবসা সামলাচ্ছে। আর আমিই এক হতভাগ্য পিতা যে কিনা ছেলে জেল থেকে ছুটবে কবে তার অপেক্ষায় এতদিন হেদিয়ে ম’রেছি। কি পাপ করেছিলাম কে জানে।”

উচ্ছাস চুপ। শাখাওয়াত বলতে থাকে,”তখন তোমার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনলাম সজীবের কাছে জানতে চাইছো উর্বীর খবর। কি চাইছো কি তুমি। উর্বী এখন বিবাহিতা উচ্ছাস।”

উচ্ছাস বাবার কথায় পাত্তা না দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়, শাখাওয়াত সেদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”বাবার সামনে সিগারেট খাচ্ছো!”

উচ্ছাস কিছুক্ষণ হাসে। হেসে বলে,”তুমি যেখানে জানো আমি এসব খাই সেখানে তোমাকে লুকিয়ে এসব খাওয়াটা ন্যাকামী। এসব ন্যাকামী উচ্ছাসের চরিত্রের সাথে যায়না।”

শাখাওয়াত চৌধুরী ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। উচ্ছাস সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে বলে,”কি? রিহ্যাবে দিতে চাচ্ছো আবার? দুইবার পাঠালে। ঠিক তো হলাম না!”

শাখাওয়াত চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”রিহ্যাবে পাঠাবো না আর, সামনের মাসে ফ্রান্স চলে যাবে তুমি, ছেলে ভালো হবে এই আশা আমি আর করি না, ছেলে বেঁচে থাকুক শুধু এটুকুই চাই।”

****
ঘর গোছাতে গোছাতে একবার রাওনাফের দিকে আড়চোখে দেখে উর্বী। রেডি হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পরেছে। উর্বী কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করেনা। শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে বিছানার চাদর ঠিক করে দেয়। রাওনাফ মাথা তুলে একপলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”ব্যস্ত নাকি!”

_না কিছু বলবেন?

_আমার ওয়ালেট থেকে আ’ই’ডিকার্ড টা দাও। একটু দরকার।

উর্বী হাত থেকে বালিশ রেখে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে রাওনাফের ওয়ালেট তুলে নেয়। ওয়ালেট থেকে রাওনাফের আ’ই’ডিকার্ড বের করতে গিয়ে দেখতে পায় ওয়ালেটে শিমালার বহু আগের একটা ছবি। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী একদৃষ্টে রাওনাফের ওয়ালেটের দিকে তাকিয়ে আছে,অন্যদিকে কোনো খেয়াল নেই তার।
রাওনাফ ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়ায়। উর্বীকে ঘুরিয়ে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তার হাত থেকে ওয়ালেট টা নিয়ে আ’ই’ডিকার্ড টা বের করে নেয়। উর্বীর দিকে একপলক তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”স্বভাবে একটু নেইভ ছিলো। চঞ্চল। সবসময় বলতো আমি কেন ওর ছবি ওয়ালেটে রাখি না। আক্ষেপ ছিলো ওর এটা নিয়ে। এই সব ব্যপার তখন আমার কাছে খুব কৃত্রিম লাগতো। এই ছবিটা ওর মৃত্যুর পর রেখেছি। ও দেখে যেতে পারেনি।”

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”বেশ তো। আমি হুট করে মরে গেলে আমার ছবিটাও এভাবে রেখে দেবেন।”

রাওনাফ চ’ম’কে ওঠে। উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপাল কুঁ’চ’কে ফেলে, দৃঢ় কিন্তু নিচু স্বরে বলে,”সবকিছু নিয়ে মজা করতে হয়না উর্বী।”

_আমি মজা করিনি। ম’রতেই তো পারি তাই না? মৃত্যু কি আমার হাতে? ওপর ওয়ালার ইচ্ছে হলে আজই….

উর্বী থেমে যায় রাওনাফের কঠিন দৃষ্টি দেখে। তারপর প্রসঙ্গ পালটে বলে,”ওনার মৃত্যু হয়েছে কিভাবে? এ’ক্সি’ডেন্টে শুনেছি। কিভাবে হলো?”

_ট্রাকের সাথে গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ। ও নাবিল শায়মীকে স্কুলে দিয়ে আমার হসপিটালে যাচ্ছিলো শর্মীকে নিয়ে, শর্মীর বয়স তখন তিন বছর। ড্রাইভার সেখানেই মারা যায়।
আমি তখন একটা ও.টি. তে ছিলাম। বের হয়ে দেখি সব শেষ। একটু সময় দিলো না আমাকে,একটু কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো না আমাকে। বোকার মতো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম আমার সাথে সবাই হয়তোবা মজা করছে। মানুষটা সকালে আমার সামনে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ালো,আমাকে জরিয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকলো, আমার টিফিন করে দিলো। তার নিথর দেহটা আমি তখন সত্যি মেনে নিতেই পারছিলাম না। খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে ছোটো শর্মী সম্পূর্ণ অক্ষত ছিলো। সবথেকে কষ্টের বিষয় কি জানো উর্বী? আমি একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম ওর সাথে। আমি ও.টিতে না থাকলে সম্ভবত সুযোগ পেতাম। আমার এই আফসোস কোনোদিনও মিটবে না। এই গ্লানি কখনও ঘুচবে না আমার।

কথাগুলো বলতে বলতে রাওনাফ আবেগতাড়িত হয়ে পরে। যেনো ভেঙেচুরে যাচ্ছে সে,আর কিছু বলার ক্ষমতা নেই। উর্বী অস্বস্তিতে পরে যায়,কেনো যে সে এই প্রসঙ্গটা টানলো!

খানিক বাদে রাওনাফ নিজেকে নিজে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,”আমি আসছি। টেইক কেয়ার!”
কথাটা বলে রাওনাফ উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায়। উর্বী একদৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর রাওনাফ যেখানে স্পর্শ করে দিয়ে গিয়েছে সেখানে হাত রাখে।

****
“সোজা হয়ে দাড়াও মেয়ে।”

শর্মী খিকখিক করে হাসছিলো আর নড়ছিলো। উর্বী শাড়ির কুচিগুলো ঠিকঠাক ভাবে দিতে পারছিলো না। উর্বীর ধ’ম’কে শর্মী চুপ হয়ে যায়।
শায়মী পাশে শুধু মাত্র পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে আছে। শর্মীকে শাড়ী পরানো হয়ে গেলে উর্বী তাকে পরিয়ে দেবে।

খানিক বাদে উর্বী বলে ওঠে,”তোমার চাচীরা আর ফুপিরা কোথায়? কোথাও বেরিয়েছে?”

_না তো। বাড়িতেই আছে। তারা নিচতলার লিভিং রুমে। ওখানে এক প্রতিবেশী দাদী এসেছে। আমরা বলি প্যাকপ্যাক দাদী। সারাদিন কথা বলে, ননস্টপ।

উর্বী হাসে। শায়মী বলতে থাকে,”তোমাকে একটা সাজেশন দিই আন্টি। নিচ থেকে যদি কেউ ডাকতে আসে তাহলে ভুলেও যাবে না। এই মাত্র দেখে এলাম অন্তরা আর মোহনা চাচীর মাথা ধরিয়ে দিয়েছে জ্ঞান দিতে দিতে।”

শর্মী সাথে সাথে বলে ওঠে,”আমাদের দাদী প্যাকপ্যাক দাদীর কাছে কিছুই না। এত্তো কথা বলে!”

উর্বী ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”ছিঃ শর্মী! দাদুর নামে এভাবে বলতে হয়? বৃদ্ধারা একটু কথা বলে।”

শর্মী খিকখিক করে হাসছে। তারপর উর্বীকে হাসানোর জন্য অবিকল রওশান আরাকে নকল করে বলে ওঠে,”বড় বৌমা! আমার বড় খোকা এসেছে কি না দেখো তো!”

উর্বী শর্মীর শাড়ির কুচিগুলো কোমোরে গুজে দিয়ে অবাক হয়ে শর্মীর দিকে তাকায়। শায়মী আর শর্মী পেটে হাত চেপে হাসছে। শায়মী নাকি সুরে দাদীকে নকল করে বলে ওঠে,”বৌমা! তুমি এখন খেও না। আমার বড় খোকার সাথেই খেও।”

উর্বী দুই বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শর্মী পুনরায় বলে ওঠে,”বৌমা আমার বড় খোকার ঠান্ডা লেগেছে তার সর্দি মুছে দাও!”

উর্বী কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে উচ্চশব্দে হেসে ফেলে। দুই বোনের মুখ ঝলমল করছে তৃপ্তিতে,উর্বীকে হাসাতে পেরে। উর্বী শর্মীর মাথায় গাট্টা মেরে বলে,”আমি তোমাদের দুটোকে ভুল বুঝেছিলাম। তোমরা আস্ত ফাজিল।”

শর্মী বলে,”আমি তোমারও মিমিক্রি করতে পারি। দেখবে আন্টি?”

_দেখাও।

শর্মী গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”মা! আপনি ওষুধ খেয়ে নিন মা। মা আপনি চেচাবেন না মা। মা আপনি মিষ্টি খাবেন না মা,আপনার বারণ আছে।”

উর্বী হাসতে থাকে,শর্মী বলে,”এবার পাপার মিমিক্রি করবো।”

শায়মী বলে,”শর্মী পাপারটা আমি করবো প্লিজ।”

_আচ্ছা কর আপু।

শায়মী গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”তুমি যা বলবে তাই হবে মা!
শর্মী আই ডিডন্ট এক্সপেক্ট দিস ফ্রম ইউ! যাও অংক বই নিয়ে এসো!
শায়মী তোমার ফোন আমার কাছে দাও,আর গিয়ে পড়তে বসো।
নাবিল জেদ করবে না! আমার কথা শোনো।
মা তুমি শান্ত হও,আমি তোমার কথা শুনবো মা!”

উর্বী মুখে শাড়ির আঁচল চে’পে ধরে হাসছে। শর্মী বলতে থাকে,”এবার ভাইয়াকে নকল করবো………”

কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে শর্মী বলে ওঠে,”আমাকে কেউ ভালোবাসে না। পাপা ভালোবাসে না,দাদু ভালোবাসে না,তোরা ভালোবাসিস না। কেউ ভালো বাসে না। কেউ না কেউ না কেউ না।”
নাবিলের বাচনভঙ্গি অবিকল নকল করে শর্মী বলে।

উর্বী মেয়ে দুটোর দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে। শায়মীকে শাড়ি পরিয়ে দিতে দিতে বলে,”আরো নকল করে দেখাও।”

শায়মী বলে,”ছোটো চাচ্চুকে করি?”

_করো।

শায়মী বলে ওঠে,”অন্তু! অন্তু আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি অন্তু।”

উর্বী হেসে বলে,”আর অন্তরা কি করে?”

শায়মী অন্তরাকে নকল করে বলে,”সামিউল! আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি সামিউল।”

উর্বীর হাসি থামছেই না। শায়মী বলতে থাকে,”ছোটো চাচ্চু আর ছোটো চাচী সারাদিন এই একটা বাক্য ছাড়া আর কিছু বলে না। তাই আর কি নকল করবো?”

উর্বী বলে,”আমার উচিৎ ছিলো এসব ভিডিও করে রাখা। তোমরা যে কি বিচ্ছু! সবাইকে দেখানো উচিত।”

শায়মী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। উর্বী বলে,”এবার আমি মিমিক্রি করি তোমাদের?”

দুই বোন উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী শর্মীর দিকে তাকিয়ে শর্মীকে নকল করে বলে,”আন্টি! আমার খুব হিসি চেপেছে। কিন্তু আমার খুব ভয় করছে। তুমি একটু ওয়াশরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে?”

এরপর উর্বী শায়মীর দিকে তাকাতেই শায়মী উর্বীর মুখ চেপে ধরে বলে,”প্লিজ আন্টি আমাকে রোস্ট করবে না।”

উর্বী শায়মীর হাত নামিয়ে হাসতে হাসতে বলে,”ঠিকাছে। করবো না।”

শায়মী উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি শাড়ি পরবে না আন্টি?”

_আমি তো শাড়ি পরেই আছি।

_আরে এটা না। পাপা যেটা দিয়েছিলো সেটা। আমরা তো আজ পাপাকে দেখাবো বলে পরেছি। তুমি দেখাবে না?

উর্বীর মুখ ছেয়ে যায় লজ্জায়। দুই কিশোরী সেই লজ্জার গভীরতা বুঝতে পারেনা। তারা নিজেরা নিজেরা কথা বলছে। শর্মী বলতে থাকে,”আমাদের তিনজনের শাড়িই সবুজ রঙের দেখেছো আন্টি,দেখে মনে হচ্ছে আমরা বাংলাদেশের পতাকা।”

উর্বী হাসছে। শর্মী বলে,”স্বাধীনতা দিবসের প্রোগ্রামে এই শাড়িটা পরে নাচবো, পাপা সেজন্যই এনেছে সম্ভবত এই রঙটা। পাপা খুব দেশপ্রেমী।

“একাত্তরের মা জননী! কোথায় তোমার মুক্তি সেনার দল!”

গানের লাইনটা বলে শর্মী হাত দিয়ে মিছিল দেওয়ার মতো মুদ্রা করে দেখাতে থাকে। উর্বী দেখতে থাকে সহজ সরল কিশোরী দুটোকে। কত চঞ্চল! কত স্নিগ্ধ ! উর্বী ভাবে তার জীবনের পরিপূর্ণতায় এই কিশোরী মেয়ে দুটির অবদানও অনস্বীকার্য!

****
“স্যার রিপোর্ট গুলো এনেছি!”

_রেখে যাও।

নার্স টেবিলের ওপর রিপোর্ট গুলো রেখে চলে যায়। রাওনাফ ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত এগারোটা বেজে গিয়েছে। আজ কথা ছিলো বাড়ির সবার সাথে ডিনার করবে কিন্তু ব্যস্ততার জন্য পারেনি। আজমেরী,শায়মী ফোন দিয়েছিলো। তারপর ফোন দিয়েছে শর্মী,বলেছে তার জন্য সারপ্রাইজ আছে। কিন্তু রাওনাফ যেতে পারেনি। রেগে গিয়েছে দু’টো মেয়ে‌।

মেসেজের টুং টাং আওয়াজে রাওনাফ ফোনটা হাতে তুলে নেয়। উর্বীর মেসেজ,”আপনার কি দেরী হবে? শর্মী শায়মী আপনাকে দেখাবে বলে শাড়ি পরেছিলো। এখন রাগ করে খুলে ফেলেছে।”

রাওনাফ ম্লান হাসে, একদৃষ্টে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। প্রকৃতিতে সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তার জীবনে হচ্ছে।
পুরনো দিনগুলো নতুন করে,নতুনরুপে ফিরে আসছে তার জীবনে। ২০১৪ সালের কথা। শিমালাও এভাবে বার্তা পাঠিয়ে দিতো হুট হাট। ছেলে মেয়ে গুলোর কথা জানানোর অযুহাতে। রাওনাফ উত্তরে লিখতো,”আর তাদের মাম্মা কি করছে?”
সবকিছু কেমন রিপিট হচ্ছে। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একই ভাবে একটা উত্তর লিখে দেয়,”আর তাদের আন্টি কি করছে?”

মেসেজ টা পাঠিয়ে রাওনাফ বসে থাকে। খানিক বাদে উর্বীর থেকে রিপ্লাই আসে। রাওনাফ রিপোর্ট দেখতে দেখতে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেয়,উর্বীর জবাব,”তাদের আন্টি পানি খাচ্ছে।”

রাওনাফ হাসে। অতীতের পুনরাবৃত্তি দেখে হাসে। দুজন রমনী একই রকমের। চঞ্চল,স্বভাবে রয়েছে বাচ্চামো, খুনশুটি কিন্তু আদুরে।

হসপিটালে নিজের কেবিনে গা এলিয়ে দিয়ে মেসেজ দেখে হাসছে রাওনাফ। আর তার গৃহে,তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের পাঠানো মেসেজটার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে উর্বী।

চলমান……

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৭
#Esrat_Ety

বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে ছিলো সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় রাত প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে। ডাক্তার এখনও ফেরেননি। তবে খুব সম্ভবত কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবেন।
উর্বী অলসতা কাটিয়ে উঠে বসে। ধীরপায়ে হেটে সে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আলমারি খুলে রাওনাফের দেওয়া শাড়িটা বের করে হাতে নেয়। শায়মী বিকেলে যখন বলছিলো শাড়িটা পরতে উর্বীর তখনই শাড়িটা পরে নিতে মন চাচ্ছিলো কিন্তু তার দস্যি ননদ আর জা’দের জালাতনের কথা কল্পনা করে তখন পরেনি। তবে এই রাতে,যখন সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে তখন তো একটু সাজাই যায়!

উর্বী শাড়িটাতে হাত বোলাতে বোলাতে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। কি লাভ! ডাক্তার থোরাই তাকে খেয়াল করে দেখবে! শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে বলবে,”আনারের জুস খেয়েছিলে? দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
দেখবে কি! সে হয়তোবা ভুলেই গিয়েছে এই শাড়িটা সে কিনেছিলো উর্বীর জন্য পছন্দ করে।

উর্বী তবুও শাড়িটা পরবে। সে ডাক্তারকে দেখানোর জন্য পরছে না। সে পরছে নিজের জন্য। তার স্বামীর দেওয়া প্রথম উপহার সে গায়ে জরিয়ে রাখবে।

****
রাওনাফ বুঝতে পারছে না সে কি করবে। তার পা ধরে বসে থাকা তরুণী তাকে ছাড়ছে না। রাওনাফ নিজের পা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। একসময় সে ধ’ম’কে ওঠে।
“স্টপ রুপা। পা ছাড়ো বলছি। যা বলার ওখানে বসে বলো। ”

রুপা উঠে বসে। রাওনাফ খুবই বিব্রত বোধ করছে। রুপা নামের মেয়েটি নিজের চোখের পানি মুছে ফেলে, বলে,”স্যার আমি চাকরি টা হারাতে চাই না। আমি শেষ হয়ে যাবো স্যার। আমার ফ্যামিলি শেষ হয়ে যাবে। ”

_দেখো এখন তো আমি কিছু করতে পারবো না রুপা। তোমার জন্য আজ দুজন রোগীর জীবন যেতে বসেছিলো। রোগীর ফ্যামিলি রীতিমতো মামলা করতে গিয়েছিলো হসপিটালের নামে। এটা আমার হসপিটালের ইমেজের ব্যাপার রুপা।

মেয়েটি কাঁদতে থাকে। রাওনাফ বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিৎ।
মেয়েটি ফোপাতে থাকে। “স্যার আমি এই ভুল আর দ্বিতীয়বার করবো না। আমার চাকরি টা আমি চাই। প্লিজ আমাকে বের করে দিবেন না।”

রাওনাফ চুপ করে আছে।
মেয়েটি বলে,”আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। বলুন কি করতে হবে। প্রয়োজনে আপনার সাথে রাত কাটাতেও আমি রাজি কিন্তু দয়া করে আমার চাকরি টা আপনি কেড়ে নেবেন না স্যার।”

রাওনাফ রুপা মেয়েটির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।‌ মুহুর্তেই দাঁতে দাঁত চেপে সে টেবিলে সজোরে একটি চাপর দেয়।

রুপা লাফিয়ে ওঠে।
রাওনাফ ধ’ম’কে বলে,”আউট! যাস্ট গেট লস্ট। আই সেইড আউট!!”

রুপা কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে যায়।

রাওনাফ কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে থেকে দু হাত দিয়ে চুল গুলো পেছনে ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ১৬ বছরের ডাক্তারি জীবনে এই জ’ঘন্য অভিজ্ঞতা তার কখনোই হয়নি।

****
উর্বী শাড়ির আঁচল গায়ে তুলে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আয়নায়। সব ঠিকঠাক। তবে সমস্যা হচ্ছে তার গাঁয়ের ব্লাউজটা লাল রঙের। সবুজ রঙের শাড়ি,সাথে লাল রঙের ব্লাউজ। উর্বীর কাছে নিজেকে বাংলাদেশের পতাকা লাগছে,যেমনটা শর্মী বলেছিলো। কিন্তু তার কাছে সবুজ রঙের ব্লাউজ নেই। এই শাড়ির সাথে আর কোন রঙটা যাবে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে উর্বী কপাল কুঁ’চ’কে চলে যায় কাবার্ডের কাছে,কাবার্ড খুলে সে এবার বেছে বেছে একটা সাদা রঙের ব্লাউজ বের করে। তার হঠাৎ মনে হলো সাদা রঙটা সব একরঙা শাড়ির সাথেই মানায়। ব্লাউজ পাল্টে সে শাড়ির আঁচল ঠিক করে আবারও আয়নায় নিজেকে দেখে। কিন্তু এইবার সে নিজেকে দেখে রীতিমত হতাশ! সাদা-সবুজের সংমিশ্রণে এখন তাকে একটা পাকিস্তানের পতাকার মতো লাগছে। উর্বী প্রচন্ড বিরক্ত হয়। সে দ্রুত গিয়ে সাদা রঙের ব্লাউজ পাল্টে লাল রঙের ব্লাউজটাই পরে নেয়। পাকিস্তানের পতাকা হওয়ার চাইতে বাংলাদেশের পতাকা হওয়া ভালো। উর্বী দেশপ্রেমী!
এসব করতে করতেই উর্বীর আধাঘণ্টা কেটে যায়। তখন ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে বারোটা।

বাইরে রাওনাফের গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। উর্বী দোতলার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, তারপর গিয়ে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকে। এতো রাতে ডাক্তার যদি দেখে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নটাঙ্কি করছে সেটা উর্বীর কাছে খুবই লজ্জার। তবে সে খুব করে চাচ্ছে রাওনাফের দেওয়া শাড়িটাতে রাওনাফ তাকে দেখুক,খেয়াল করুক, সে তো আর নিজে নিজে বেহায়াদের মতো বলতে পারবে না,”শুনছেন? আমাকে কেমন লাগছে!”

রাওনাফ ক্লান্ত মুখ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই উর্বী বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ চোখ তুলে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বীর ঠোঁটে ছেয়ে আছে স্বামীর প্রতি আন্তরিক হাসি। রাওনাফ হঠাৎ টের পেলো ঐ হাসিতে তার সারাদিনের ক্লান্তি,গ্লানি,বিরক্তিভাব হঠাৎ কোথায় যেন মিলিয়ে গেলে। কেমন স্বস্তি লাগছে খুব। চারপাশটা অদ্ভুত প্রশান্তিদায়ক ঠেকছে। ঐ যে কথায় বলেনা? “ইটস্ মাই প্লেস!” সেরকম প্রশান্তিদায়ক ঠেকছে এই চারদেয়ালের কামড়াটা। যেটা দীর্ঘ দশ বছর তাকে খুব একটা স্বস্তি দিতো না। দিনের শেষে বাধ্য হয়ে ঢুকতো এখানে। হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নির্ঘুম রাত্রি যাপন করতো। বিছানাটাকে,এই ঘরটাকে তার কাছে একটা অন্ধকার মরুভূমি মনে হতো,যেখানে সে পরে থাকতো একটা বিন্দুর মতো।

রাওনাফ এগোনোর আগেই উর্বী গিয়ে তার হাত থেকে ব্যাগ আর এপ্রোন নিয়ে নেয়। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী রাওনাফের দৃষ্টি ধরতে না পেরে বোকার মতো বলে ওঠে,”কি দেখছেন! আমি আনারের জুস খেয়েছি কিছুক্ষণ আগে!”

রাওনাফ হেসে ফেলে তারপর হাই তোলার ভান করে বলে,”শাড়িটাতে ভালো লাগছে তোমাকে। মোটেও গাছের মতো লাগছে না।”

উর্বী ঘুরে দাঁড়ায়। তার ঠোঁট প্রশ্বস্ত হয় হাসিতে। মানুষটা তাহলে খেয়াল করেছে!

রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে বের হয়। ওয়ারড্রব থেকে টুপি বের করে। উর্বী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাওনাফকে দেখে বলে ওঠে,”মুড অফ আপনার?”

_না তো! একটু স্ট্রেসড্ !

আজ জামাতে এশার সালাত আদায় করতে পারেনি। দেরী হয়ে গেছে অনেক। উর্বী বিছানায় বসে বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সালাত আদায় করে উঠে দাঁড়াতেই উর্বী বলে,”কিছু খাননি তো বোধ হয়।”

_হু,সময় পাইনি। আজ মেন্যুতে কি কি ছিলো?

_গ্রিলড পমফ্রেট, ভেজিটেবল চিকেন, চিকেন রোস্ট আর বিফ।

_এতোকিছু! কে রেঁধেছে? তুমি?

_হ্যা।

রাওনাফ হাসে। বলে,”ওরা তোমাকে দিয়ে বড্ড খাটায় তাই না?”

উর্বী মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”আমার খাটতে ভালো লাগে।”

রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে। এতো রাতে আমি কিছু খাবো না আর। এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পরবো। আর তুমিও রোজ রোজ এতো রাত অবধি জেগে থেকো না। যাও শুয়ে পরো।”

_আমি আপনার জন্য ডাব চিংড়ি করেছিলাম।
আটকে আটকে কথাটা বলে উর্বী।

রাওনাফ প্রথমে শুনতে না পেয়ে বলে,”কি?”

_ডাব চিংড়ি।
নিচুস্বরে বলে উর্বী।

রাওনাফ কিছুক্ষণ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আচার আচরণ, কথাবার্তা, সবকিছুতে তরুণী বধুদের মতো সংসারের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায়, এই আগ্রহ টুকু উপেক্ষা করা কোন পুরুষের সাধ্যি?

তারপর একটা নির্মল হাসি দিয়ে বলে,”চলো। তবে ভাত খাবো না। শুধু মাছটা খাবো।”

উর্বী মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়।

খাবার টেবিলে রাওনাফকে খাবার বেড়ে দিয়ে পাশের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। রাওনাফ খেতে খেতে বলতে থাকে,”তুমি আজ স্বামীকে ফেলে খেয়ে নিলে, তোমার শাশুড়ি মা কিছু বলেনি?”

কথাটা বলে রাওনাফ হাসে। উর্বী হেসে জবাব দেয়,”মা নিজেই আজ জোরাজুরি করেছে সবার সাথে খেতে।”

রাওনাফ বলতে থাকে,”এতো বাধ্যতা। এতো জোরাজুরি। হাঁপিয়ে ওঠো না?”

উর্বী মাথা নেড়ে জবাব দেয়,”আমার বাধ্য হতে আপত্তি নেই যদি বাধ্য করার মানুষ গুলো এমন হয়!”

রাওনাফ হাসে। মুখে কিছুই বলে না । উর্বী উঠে কিচেনে চলে যায়। টেবিলের ওপর ঢেকে রাখা সব খাবারের বাটি গুলো ফ্রিজে তুলে রাখে।

রাওনাফ খেতে খেতে উর্বীর সাথে টুকটাক কথা চালিয়ে যেতে থাকে। উর্বীর এই জিনিসটা খুব ভালো লাগে ইদানিং। লোকটা এমন ভাবে অতি সাধারণ টপিক গুলো নিয়ে উর্বীর সাথে কথা বলবে যেন মনে হয় উর্বী গুরুত্বপূর্ণ কেউ, উর্বীর সাথে এই জিনিস গুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত ।

রাওনাফ কথা বলছে। উর্বী যদিও হু হা তে উত্তর দিচ্ছে কিন্তু সে মনে মনে হাসে। বাচ্চাগুলো একেবারেই লোকটার মতো হয়েছে। এতো কথা জানে অথচ প্রথমে মনে হতো বোমা পরলেও একটা কথা বেরোয় না মুখ থেকে।

“শর্মীর আপডেট কি!”

রাওনাফের প্রশ্নে ঘোর কাটে উর্বীর। তারপর বলে,”ক্লাস টেস্টে ইয়া বড় বড় দুইটা জিরো পেয়েছে। আপনাকে দেখাবে না তাই আমাকে দিয়ে সাইন করিয়ে নিয়েছে টেস্ট পেপারে আর তুলতুল এখনও শর্মীকে উর্বী বলে কেন ডাকে সেটা নিয়ে তার আফসোসের শেষ নেই।”

রাওনাফ হাসে। উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে টিস্যু পেপারে ভেজা হাত টা মুছে নিয়ে উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে বলে,”ময়দা দিয়ে কি হবে!”

উর্বী ময়দা দিয়ে ডো বানাচ্ছিলো। মৃদু স্বরে বলে,”ডো বানিয়ে রেখে দেবো। একটা নাস্তা বানাবো সকালে।”

রাওনাফ খুবই মনযোগী হয়ে দেখতে থাকে। উর্বীর মাথায় হঠাৎ করে দুষ্টু বুদ্ধি চাপে,সে আড়চোখে রাওনাফকে একপলক দেখে পাশের বক্স থেকে এক মুঠো ময়দা নিয়ে রাওনাফের মাথায় দিয়ে দেয়।

রাওনাফ হতভম্ব হয়ে যায় পুরো। উর্বী কিশোরী মেয়েদের মতো খিলখিলিয়ে হাসছে। রাওনাফ হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে মাথা ঝাড়া দিয়ে আবারও উর্বীর দিকে তাকায়। সে রীতিমতো অবাক ত্রিশোর্ধ ভদ্রমহিলার এমন কিশোরীসুলভ আচরণে!

নাবিল পানি খাওয়ার জন্য উঠেছিলো। দরজা খুলে সে উর্বী আর রাওনাফকে একসাথে দেখে। উর্বীর এমন কান্ড দেখে নাবিল খেয়াল করলো নাবিলের বিরক্ত লাগছে না, তার বরং হাসি পাচ্ছে। সে কয়েক মূহুর্ত দু’জনকে দেখে ঘরের দরজাটা আবারও লাগিয়ে দেয়।

দরজা লাগানোর শব্দে রাওনাফ আর উর্বী চ’ম’কে ওঠে। তারপর যে যার নিজেদের কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পরে!

***
রাত দুইটা তেরো মিনিট। পুরো এরিয়া ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু রওশান মঞ্জিলের দোতলার উত্তরপাশের ঘরটিতে বাতি জ্বলছে।

রাওনাফ সেই তখন থেকে হাঁচি দিচ্ছে। এতো রাতে শ্যাম্পু করে গোসল করার ফলে রীতিমতো হাঁচি দিতে শুরু করেছে। তার পাশেই অ’প’রা’ধীর মতো তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে উর্বী। একটু পরপর সে তোয়ালে দিয়ে রাওনাফের মাথা মোছাতে উদ্যত হয় আর কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,”ভুল হয়েছে। আ’ম সরি!”

রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকায়। বলে,”আনবিলিভেবল তোমার বয়স ত্রিশ। আচরণে মনে হচ্ছে বাইশ-তেইশের কোনো তরুণী। যে নিজেও জানে না সে কি করতে যাচ্ছে।”

উর্বী তোয়ালে ফেলে রাওনাফের পাশে বসে পরে। তারপর বিষন্ন ভঙ্গিতে বলে,”আমি বাইশ-তেইশের সেই উর্বীই। মাঝখানের আট বছর নেই। আমার জীবনটা ওখানেই আঁটকে ছিলো,এখন চলতে শুরু করেছে!”

রাওনাফ তাকায় উর্বীর দিকে। উর্বী আবারও হেসে ফেলে । খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। রাওনাফ মুগ্ধ হয়ে সে হাসি দেখে বলে ওঠে,”ইউ ডিজার্ভ বেটার মৃদুলা উর্বী!”

উর্বী হাসি থামিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফের কথার মানে সে বুঝতে পারে না। রাওনাফ উর্বীর একটা হাত নিজের হাতে বন্দী করে বলতে থাকে,”মানে দেখতেও তোমাকে বাইশ-তেইশের কোনো মেয়েই লাগে। তোমার পাশে আমাকে মানাচ্ছে না। ইউ ডিজার্ভ বেটার! কোন হ্যান্ডসাম ইয়াং…।”

উর্বী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ হাসি চেপে রেখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী আয়নায় সামনে গিয়ে হাতে ট্যালকম পাউডারের কৌটা নিয়ে পাউডার বের করে নিজের মাথায় লাগিয়ে সামনের চুলগুলো সাদা সাদা করে ফেললো। রাওনাফ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে উর্বীর দিকে। উর্বী ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”হ্যা। আপনি বুড়ো। কি আর করা,আপনার বয়সটা তো আর কমাতে পারবো না। তাই নিজের বয়সটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দু’জনকে মানানসই করে নিলাম। দেখুন এখন ঠিকাছে না?”

রাওনাফ হেসে ফেলে। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ উঠে এসে উর্বীর সামনে দাঁড়ায়। তারপর উর্বীর চুল পরিষ্কার করে মুছিয়ে দিয়ে উর্বীর কপালে চুমু খেয়ে বলে,”না। এই চঞ্চল উর্বীই ঠিকাছে।”

উর্বী নরম গলায় বলে,”ইউ ডিজার্ভ বেটার। আমিই আপনার যোগ্য নই…..”

রাওনাফ উর্বীর ঠোঁটে আঙুল রেখে উর্বীকে চুপ করিয়ে দেয়। উর্বী চুপ হয়ে দেখে মানুষটাকে। সে ধীরে ধীরে নিজের কোমরে রাওনাফের বা হাতের স্পর্শ টের পায়। সে এই স্পর্শে কোনো মলিনতা খুঁজে পায়না। অত্যন্ত প্রশান্তিদায়ক ঠেকছে এই স্পর্শ। রাওনাফ উর্বীকে ঘুরিয়ে নিয়ে আলতো করে তার কাঁধ থেকে চুল গুলো সরিয়ে উন্মুক্ত কাঁধে চুমু খায়। উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। রাওনাফ উর্বীর কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে,”তুমি বেটার নও,কিন্তু একজন বিধ্বস্ত রাওনাফ করীমের জন্য যথেষ্ট মৃদুলা উর্বী।”

সামান্য কথা! সামান্য স্বীকারোক্তি! তবুও উর্বী শিহরিত হয়। পুলকিত হয়। অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পরে তার শিরা উপশিরায়। চোখ বন্ধ রেখেই ঘুরে রাওনাফের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে।
রাওনাফ আগলে নেয় উর্বীকে। তার পিঠের কাছের টি-শার্ট খামচে ধরে রেখেছে উর্বী। ছাড়ছেই না। খানিকবাদে অনুভূতির সাথে চুক্তি করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিচু স্বরে বলে,”আর আপনি যথেষ্ট নন, আপনি আমার কাছে তার থেকেও বেশি শর্মীর পাপা। আপনি আমার ন’ষ্ট জীবনের ভজন শুনে কান না পচিয়ে ফেলা লোক।”

উর্বীকে নিজের থেকে আলগা করে হাত ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়। উর্বী সম্মোহিত দৃষ্টিতে শান্ত,গোছালো, দায়িত্ববান, কেয়ারিং মানুষটাকে দেখতে থাকে।
রাওনাফ বিছানায় শুয়ে উর্বীর গায়ে চাদর টেনে দেয়। উর্বী সব সংকোচ সরিয়ে নির্দ্বিধায় রাওনাফের বুকে মাথা রাখে। যেন এটা তার বহু বছরের অভ্যাস।
বুক থেকে মাথা না তুলে নিচু স্বরে বলতে থাকে,”আপনি আমার ক্ষ’ত ভুলিয়ে দেওয়া স্বস্তি।”

রাওনাফ ম্লান হেসে দুহাতে উর্বীকে আগলে নেয়। নিজের বাহুবন্ধনে উর্বীকে পুরোপুরি আবদ্ধ করে নিয়ে বলে ওঠে,”আর তুমি একটা আদুরে হাঁসের ছানা।”

উর্বী হেসে ফেলে। হাসতে থাকে রাওনাফও। নির্মল, স্নিগ্ধ হাসি। রাত তখন তিনটা প্রায়। শেষ রাতের পাখিটাও ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে, তখন কোনো দম্পতি “বেচারা” দু’টো মন নিয়ে রচনা করে যাচ্ছে মহা-মিলনের এক অদ্ভুত সুন্দর গাথা। তারা ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত। একে অপরের মাঝে খুঁজে পেতে ব্যস্ত-আশ্রয়,নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা,ভরসা, ভালোবাসা,সুখ আর আরেকটিবার নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার অনুপ্রেরণা।

ভালোবাসা-বাসির এই সময়টিতে উর্বীর এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়নি সে রাওনাফের জীবনে বাড়তি কেউ। বরং সে আপ্লুত হচ্ছে এটা টের পেয়ে , সে একটা বিশেষ স্থান পেয়েছে ঐ মনে। ঐ হৃদস্পন্দন,ঐ স্পর্শ,ঐ ব্যকুলতা তাকে জানান দিচ্ছে এসব শুধু শরীরী টান নয় বরং এটা সমর্পণ। এই পরম স্পর্শে শরীর থেকে সেই যন্ত্রনাদায়ক স্পর্শের চিহ্ন যেন মিলিয়ে যাচ্ছে,একটু একটু করে,উর্বী শুদ্ধ হচ্ছে। আবেশে চোখ বন্ধ করে উর্বী। আবেগ গড়িয়ে পরে তার বন্ধ দু’চোখ থেকে। যা রাওনাফের দৃষ্টিগোচর হয়না। সযত্নে,পরম স্নেহে,অতি সাবধানতার সাথে মুছিয়ে দেয় সেই আবেগ। যেন উর্বী নামের এই ভাঙাচোরা মেয়েটির স্ত্রী সত্তা অসম্মানিত না হয়।

দু’হাতে দুই গাল আগলে ধরে উর্বীর চোখে চোখ রেখে ঘোর লাগা কন্ঠে রাওনাফ বলে,”হাঁসের ছানা!”
উর্বী কেঁদে ফেলে, নিজেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ,দামী কেউ আবিষ্কার করতে পারার খুশিতে। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে,ফোপাতে ফোপাতে রাওনাফের হাতের ওপর একটা হাত আলতো করে রেখে দেয়,রাখে না! একপ্রকার আঁকড়ে ধরে রাওনাফের হাত। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”আমাকে আপনি আগলে রাখুন। আমার খুব দরকার আপনাকে। প্লিজ আগলে রাখুন আমায় শর্মীর পাপা।”

চলমান…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে