#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২২
#Esrat_Ety
গাঁয়ের ওপর দুই তিনটা শাড়ি ধরে রেখে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে উর্বী। সে বুঝতে পারছে না কোনটাতে তাকে মানাবে। গোলাপী নাকি লাল? কোনটা যাবে তার সাথে আজ!
তহুরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলেও থ’ম’কে যায়, উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কি? রেডি হোসনি? ওদিকে রাওনাফ ভাই তা’ড়া দিচ্ছে!”
উর্বী তহুরার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। কিশোরীদের মতো উচ্ছসিত ভঙ্গিতে বলে,”কোনটা পরবো ভাবী? একটু বলে দাও না।”
তহুরা হাসে,উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”লাল টা পর।”
লাল শাড়ি গাঁয়ে জরিয়ে উর্বী নিজেকে দেখে আয়নায়। তহুরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে উর্বীকে। উর্বী বলে ওঠে,”আমাকে কেমন লাগছে ভাবী?”
_ভালো লাগছে।
_বৌয়ের মতো লাগছে?
তহুরা মাথা নাড়িয়ে বলে,”না।”
উর্বী কিছুটা অবাক হয়ে বলে,”কেনো?”
তহুরা কাছে এসে উর্বীর মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বলে,”এটা দিসনি বলে।”
উর্বী বলে ওঠে,”ঘোমটা? আমি ওনার সামনে কখনো ঘোমটা দিইনি!”
কথাটি বলে উর্বী ঘোমটা নামিয়ে দিতে চায় তহুরা উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে পুনরায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বলে,”আজ দে!”
***
রাওনাফ অবাক হয়ে নিজের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তার গাড়িটাকে ছোটখাটো একটা মালবাহী ট্রাক মনে হচ্ছে তার কাছে এখন, খাবারদাবার থেকে শুরু করে উর্বীদের বাড়ির গাছের নারকেল। সবকিছু দিয়ে বোঝাই করে দিয়েছে পুরো গাড়ি। শুধু সামনের সিট দু’টো ফাকা। উর্বীর মা তো তিনটা জ্যান্ত রাজহাঁসই দিতে চেয়েছিলেন তার বেয়ান আর রাওনাফের তিন ছানার জন্য। রেজাউল বাজারে গিয়ে রাজহাঁস তিনটা জবাই,প্রসেসিং, ফ্রিজিং করিয়ে প্যাক করে দেয়। পিঠা, রান্নাকরা বিভিন্ন আইটেম, গাছের ফল, ফ্রিজিং করে রাখা পুকুরের চিংড়ি,চিতল,কোড়াল, এক টিন ভর্তি খই ভাজা কি নেই সেখানে। রাওনাফ এতো নিষেধ করছে, কে শুনছে কার কথা! যে যা পারছে গাড়িতে ঠেসেঠুসে রেখে যাচ্ছে।
অবশেষে হার মেনে রাওনাফ চুপচাপ দেখতে থাকে।
সবচেয়ে অবাক হয়ে যেটা দেখছে রাওনাফ, সেটা হলো খাবারদাবারের সাথে একটা খাঁচা সহ ময়না পাখিও দেওয়া হয়েছে গাড়িতে, এটা নাকি উর্বীর পাখি।
উর্বী ধীরপায়ে হেঁটে রেজাউল কবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রেজাউল তাকিয়ে দেখতে থাকে তার বোনকে। উর্বী ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,”আসছি।”
_আবার আসবি।
_কবে?
_ঈদে। তবে দাওয়াত দিলে তবেই আসবি,স্বামীকে নিয়ে। হুট হাট করে আসবি না।
উর্বী তাকিয়ে আছে তার ভাইয়ের দিকে। রেজাউল কবিরের চোখে পানি। উর্বী বলে,”ছিহ! পুরুষ মানুষ কাঁদে?”
রেজাউল কবির মাথা নাড়ায়। নিচু গলায় বলে,”ভাইয়েরা কাঁদে।”
উর্বী সাথে সাথে ভাইকে জরিয়ে ধরে। রেজাউল কবির বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”যা বলেছি মনে রাখবি। এলে স্বামীকে নিয়েই আসবি!”
উর্বী কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দেয়,”আচ্ছা।”
***
ড্রাইভ করতে করতে রাওনাফ একপলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”ঘোমটা দিয়েছো কেনো?”
উর্বী সাথে সাথে টেনে ঘোমটা নামিয়ে দেয়। নিচুগলায় বলে,”রোদের জন্য।”
রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে পেছনের সিটের দিকে একপলক তাকিয়ে উর্বীকে আবারও বলে,”এটা তোমার পাখি?”
_হ্যা।
_কথা বলতে পারে?
_দুয়েকটা শব্দ। আর আমার নাম।
_নিয়ে যাওনি কেন সাথে করে?
_ইচ্ছে হয়নি।
_এখন কেন নিয়ে যাচ্ছো?
_একজনের মান ভাঙাতে।
_শর্মী?
_হু।
রাওনাফ হাসে। তারপর বলে,”ও তোমাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে।”
_আমিও।
উর্বী জবাব দেয়।
রাওনাফ বলতে থাকে,”তোমার এই পাখি এতো চুপচাপ হয়ে আছে কেনো? কিছুই তো বলছে না। কেমন মনমরা।”
_মন খারাপ হয়তো ওর। নয়তো কিছু বলতো!
রাওনাফ হাসে, হাসতে হাসতেই বলে,”ডিপ্রেসড? কেনো ওরও কি কোনো পাস্ট আছে? যে ডিপ্রেসড থাকে! সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে?”
উর্বী হেসে ফেলে, রাওনাফ তার দিকে তাকায়। উর্বী চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”শর্মীর পাপা!”
রাওনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে ব্রেক কষে দেয়। একটা কুকুর এসে পরেছিলো তাদের গাড়ির সামনে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছে কুকুরটা।
মৃদু আর্তনাদের আওয়াজ হয়। উর্বী কপালে হাত চেপে কা’তরাচ্ছে। সিটবেল্ট পরেনি বিধায় হুট করে ব্রেক কষে দেওয়ায় আঘাত পেয়েছে কপালে।
রাওনাফ হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উর্বীর কপাল থেকে হাত সরিয়ে চ’ম’কে ওঠে। কে’টে গিয়েছে কিছুটা। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”সিট বেল্ট বাঁধতে বললাম তখন!”
_কিচ্ছু হয়নি। সামান্য কেটে গিয়েছে।
কোকিয়ে উঠে জবাব দেয় উর্বী।
***
রওশান আরা লিভিং রুমের সোফাতেই বসে ছিলো। রাওনাফ ঘরে ঢোকে, উর্বী তার পিছু পিছু ঘরে ঢোকে। রাওনাফ আবদুলকে ডেকে বলে গাড়ি থেকে মালামাল নামাতে।
উর্বীকে দেখে রওশান আরা দাঁড়িয়ে যায়। সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে থাকে উর্বীর দিকে। রওশান আরা প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলে,”বৌমার কপালে কি হয়েছে?”
উর্বীর কপালে ব্যান্ডেজ। উর্বী শাশুড়িকে শান্ত করতে কিছু বলতে যাবে তার আগে সামিউল বলে ওঠে,”ভাইয়া, মা তোমাকে ভাবীকে নিয়ে আসতে বলেছে বলে মা’রধোর করে নিয়ে এসেছো নাকি! না মানে,তুমি তো খুব মা ভক্ত তাই!”
রওশান আরা ক’ট’ম’ট দৃষ্টি দিয়ে সামিউলের দিকে তাকায়। সামিউল ঘা’ব’ড়ে গিয়ে বলে,”হেহে! যাস্ট কিডিং মা! ক্ষেপছো কেনো!”
অন্তরা কনুই দিয়ে সামিউলকে খোঁচা মেরে ফিসফিসিয়ে বলে,”একটু চুপ করো না! মায়ের ধ’ম’ক না শুনলে তোমার ভাত হজম হয়না নাকি?”
উর্বী হাঁসি চাপিয়ে রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলে,”পরে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। সামান্য চো’ট।”
রাওনাফ রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে,”হয়েছে এখন?”
রওশান আরা মাথা নাড়ায়। তারপর রাওনাফ রুমা আর আজমেরীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোদের হয়েছে?”
তারা দুজনেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,”হয়েছে।”
রাওনাফ দোতলায় চলে যায়। উর্বী দাঁড়িয়ে থাকে।
বাড়ির সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার চোখে মুখে চাপা আনন্দ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সবাই ভান করছে যেনো উর্বী এলো কি না এলো তাতে তাদের অতো মাথা ব্যাথা নেই।
রওশান আরা উর্বীকে বলে,”এসেছো! হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যাও। দেখো রাতে কি রাঁধবে। তোমার ননদাই রা খাবে।”
উর্বী তার ননদদের দিকে তাকায়। আজমেরী,রুমা দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী বলে,
“আপনারা কেমন আছেন আপা?”
_জি ভালো নতুন বড় ভাবী, আপনি কেমন আছেন?
দুজনেই একসাথে, হাসিমুখে বলে।
উর্বী লজ্জা পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। ওদের তিন ভাইবোনকে দেখা যাচ্ছে না। আর কেউ না থাকলেও শর্মীর তো থাকার কথা এখানে।
আজমেরী বলে,”কাকে খুজছো? শর্মীকে? সে তার রুমে। ভুলেও যেও না সেখানে। গিয়ে লাভ নেই। ডাক্তার রাওনাফ করিম খানের ছোটো মেয়ে, রেগে আছে প্রচুর তোমার ওপরে। নিজে থেকে রাগ না কমলে তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। শুধু শুধু গিয়ে কাজ নেই।”
উর্বী হেসে বলে,”আচ্ছা তাই! দেখি পারি কি না।”
উর্বী সিঁড়ির দিকে যেতে নিলে আমীরুনের সামনে পরে। আমীরুন মুচকি হাসি দিয়ে বলে,”শইলডা ভালা ভাবি?”
উর্বী ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”তোমাকে আমি পরে দেখে নেবো আমীরুন আপা। ওয়াদা করে সেটা ভঙ্গ করলে। তোমার পাপ হয়েছে তুমি জানো?”
আমীরুন দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, “জে না। সব ওয়াদা না রাখলে পাপ হয় না। কিছু কিছু ওয়াদা ভাঙলে বিরাট সওয়াব হয় ভাবী।”
উর্বী বলে,”তোমাকে পরে দেখে নিচ্ছি। আগে শর্মীর সাথে দেখা করে আসি।”
পেছন থেকে রওশান আরা গম্ভীর কন্ঠে বলে,”দেখাদেখি হয়ে গেলে শাড়ী পাল্টে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে এসো।”
_আচ্ছা মা।
উর্বী দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। রুমা আজমেরী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে।
রুমা বলে,”মা তোমার দজ্জাল শাশুড়ির অভিনয়টা একেবারে নিখুঁত হচ্ছে। তুমি চালিয়ে যাও।”
রওশান আরা মুচকি হেসে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। আজ বহুদিন পরে সে রান্নাঘরে ঢুকেছে। একটু পায়েস রান্না করছে বাড়ির সবার জন্য।
***
শর্মী বেলকোনীতে দাঁড়িয়ে আছে।
উর্বী গিয়ে পেছন থেকে শর্মীর চোখ চেপে ধরে। শর্মী কিছু বলে না। চুপ করে আছে।
উর্বী চোখ ছেড়ে দিয়ে শর্মীর সামনে দাঁড়ায়।
দুহাত দিয়ে গাল দুটো টিপে দিয়ে বলে,”খুব রাগ করেছে আমার উপর তাই না?”
শর্মী কথা বলে না। উর্বীকে সরিয়ে দিয়ে রুমে ঢুকে বিছানায় বসে। উর্বী পিছু পিছু যায়।
শর্মীর হাত দুটো ধরে বলে,”কথা বলবে না? ”
শর্মী অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
উর্বী বলে, “আচ্ছা আমি কি করলে শর্মীর রা’গ পরে যাবে জানতে পারি? কানে ধরবো?”
শর্মী চুপ। উর্বী চুপ করে শর্মীর পাশে বসে থাকে, কিছুক্ষণ পরে বলে “আমি যদি এই কাজ আর দ্বিতীয় বার কখনো করি,তুমি আর আমার সাথে কথা বোলো না কিন্তু এবারের মতো মাফ করে দাও!”
অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলে উর্বী।
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে শর্মী!”
কিছুক্ষণ থেমে বলে ওঠে উর্বী।
শর্মী মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“বুঝেছি। নিজের মা নই তাই তুমি এভাবে কথা না বলে থাকতে পারছো শর্মী তাইনা?”
উর্বীর কথায় শর্মী মুখ তুলে তাকায়। তারপর নরম গলায় বলে ওঠে,”আমিও তোমার নিজের মেয়ে নই তাই এভাবে আমাকে অবহেলা করতে পেরেছো তাই না আন্টি?”
উর্বী করুণ দৃষ্টিতে বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটা প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে তার আচরণে। তার নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।
সে শর্মীকে টেনে নিজের কাছে নেয়।
শর্মী বলে,”তুমি চলে যাও আন্টি।”
_আচ্ছা যাবো। তার আগে একটা জিনিস দেখবে?
_কি?
_তোমার জন্য সারপ্রাইজ।
_আমার কোনো সারপ্রাইজ চাই না।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে শর্মী।
উর্বী জোর করে শর্মীর চোখ চেপে ধরে আবারও।
_কি কোরছো, কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়!
শর্মী বলে।
_আগে চলোই না। শর্মীকে এনে দোতলার খোলা বারান্দায় দাড় করায় উর্বী। তারপর তার চোখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়।
শর্মী তাকিয়ে আছে। তার সামনে একটা ময়না পাখি। খাঁচায় রাখা। সেবার উর্বীদের বাড়িতে গিয়ে এটা পছন্দ করে ফেলেছিলো শর্মী।
শর্মীর চোখ চকচক করছে খুশিতে।
উর্বী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”এটা নেবে না?”
শর্মী চেঁচিয়ে ওঠে।
“আন্টি এটা তুমি আমাকে দিচ্ছো? সত্যিই?”
_হ্যা। তিন সত্যি।
শর্মী খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। সে বলে,” আন্টি এটা আমি আমার ঘরে নিয়ে যাই?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। শর্মী একটুও দেড়ি করে না। খাচাটা ছো মেরে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যায়।
উর্বী দাঁড়িয়ে আছে। রুমা পেছন থেকে বলে,”এতো তাড়াতাড়ি রাগ ভেঙ্গে গেলো? তোমার তো এলেম আছে ভাবি।”
উর্বী ম্লান হেসে বলে,”বয়সের তুলনায় ও যে বড্ড সরল।”
কথাটা বলে উর্বী সেখান থেকে চলে যায়। তাকে রান্নাঘরে যেতে হবে। হাতে রাজ্যর কাজ।
****
উর্বীকে দেখে আজমেরী মুচকি হাসে। রওশান আরার মুখ গম্ভীর।
উর্বী নিচুস্বরে তার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে,”মা কি কি রাধবো? দুলাভাইরা কি খাবেন?”
রওশান আরা বলে,”সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে?”
উর্বী কিচেনের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। টেবিলের ওপর অনেকগুলো ঢেকে রাখা বাটি। সে ঢাকনা উঠিয়ে দেখে নানা রকমের রান্না। উর্বী আজমেরীর দিকে তাকায়। আজমেরী হো হো করে হাসতে থাকে,বলে,
“তুমি কি ভেবেছিলে আমরা সত্যিই তোমাকে দিয়ে রান্না করাবো আজ? রান্না তো তোমাকে আজীবন করতে হবে এ সংসারের। আজ না হয় একটু আরাম করো।”
উর্বী তার শাশুড়ির দিকে তাকায়। রওশান আরা বলে,”বোকার মতো তাকিয়ে আছো কেনো? দুটো বাটি আর দুটো চামচ বের করো।”
উর্বী তাই করে।
“এবার টেবিলের ওপর পায়েশ রাখা আছে। বাটি গুলোতে পরিবেশন করো।”
উর্বী পায়েশ বাটিতে পরিবেশন করে তার শাশুড়িকে বলে,”কাকে দেবো মা?”
_নিয়ে আমার বড়ছেলের কাছে যাও। দুজনে খাও। তারপর ওর জামাকাপড় গুছিয়ে দাও। ও রাজশাহী যাবে।
উর্বীর দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। আমীরুন, আজমেরী, রুমা। সবার মুখে চাপা হাসি।
উর্বী যেনো পালিয়ে গেলে বাঁচে।
***
শেফালী ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একপলক উঁকি দিয়ে চলে যেতে নিলেও দাঁড়িয়ে পরে। খুব ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পরে স্বামীর আরাম কেদারার পেছনে।
শাখাওয়াত চৌধুরী বুঝতে পেরে অত্যন্ত নরম গলায় বলে,”কিছু বলবে!”
শেফালী অবাক হয় স্বামীর এহেন নরম রূপ দেখে। শাখাওয়াত চৌধুরী বলতে থাকে,”মন খারাপ কেনো প্রশ্ন করবে? উত্তর তো তুমি জানো।”
শেফালী চুপ থাকে। শাখাওয়াত বলতে থাকে,”আমি অনেক কঠিন, খারাপ হতে পারি। কিন্তু আমি একজন বাবা শেফালী। ছেলের জন্য কষ্ট আমারও হয়। কিসের অভাব ছিলো ওর বলো তো?”
_সব দোষ ঐ মেয়েটার। রূপ দেখিয়ে ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছিলো। ছাড়বে যখন সম্পর্কে জরিয়েছিলো কেনো?
_একদম বাইরের মেয়েকে দোষ দেবেনা শেফালী। তোমার ছেলে কারো জীবন সঙ্গী হবার যোগ্য ছিলো? আর ঐ মা’র্ডার দুটো? ঐ মেয়েটা বলেছিলো মা’র্ডার দু’টো করতে?
_নেশার ঘোরে ছিলো, আর করেছে তো ঐ মেয়েটার জন্য। বাবুর বন্ধুরা ঐ মেয়েকে নিয়ে বাজে কথা না বললে তো রাগের মাথায় বাবু এহেন কান্ড ঘটাতো না। তুমি মানো বা না মানো ঐ মেয়ে আমার ছেলের জীবনের অভিশাপ। এখন আবার যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তার জীবনটা ঠিক থাকলে হয়।
_ঠিক থাকবে, যদি তোমার গুনধর ছেলে নাক না গলায়। আগে বাঁধা দিতাম। এখন আমিই অনুমতি দিলাম তোমায়। ছেলেটাকে ফোন করে একটু একটু বোঝাও শেফালী। আমি আমার ছেলেটাকে আর হারাতে চাই না।
***
পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। বাড়িতে এখন তারা তিনজন। উর্বী, নাবিল এবং শর্মী।
রওশান আরাকে নিয়ে আজমেরী আর রুমা রুমার শশুর বাড়িতে গিয়েছে, রুমার শাশুড়ি হুট করে অসুস্থ হয়ে পরেছেন। আমীরুন গিয়েছে দেশের বাড়িতে। সামিউল অন্তরা সিলেট। শায়মী তার খালামনিদের বাড়িতে। রাওনাফ হসপিটালে। তার রাজশাহী যাওয়া ক্যানসেল হয়েছে। হসপিটালে পরপর চারটা অপারেশন করতে হবে। রাত দুইটা-তিনটার আগে ফিরবে না।
নাবিল নিচতলায় নিজের ঘরে। শর্মীও নিজের ঘরে বসে পড়ছে। উর্বী শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে ঘর গোছাতে ব্যস্ত। তার ঘর। প্রত্যেকটা জিনিস ধরতে গিয়ে উর্বী টের পাচ্ছে তার মনে একটা অদ্ভুত জোর চলে এসেছে। অদ্ভুত ভালোলাগা ঘিরে ধরছে তাকে।
রাওনাফের জামাকাপড়, নিজের পোশাক খুব যত্ন করে গুছিয়ে রাখছে আলমারিতে। রাওনাফের গাছ গুলোর পরিচর্যা করে,পোষা কবুতর গুলোকে খাবার দিয়ে, রাওনাফের যত মেডিকেলের বই সবকিছু গুছিয়ে বেড সাইডের টেবিলের কাছে আসতেই সে দাঁড়িয়ে যায়।
টেবিলের ওপর শিমালার ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে কিছুক্ষণ। হাত বাড়িয়ে শিমালার ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে ছবিটা মুছে দিয়ে আবারও যায়গামতো রেখে দেয়।
ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে উর্বীর অন্যমনস্ক ভাব কেটে যায়। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই ফোনের স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে সে থ’ম’কে যায়।
দুবার রিং হয়। কেউ ধরছে না। তৃতীয় বারের বার উর্বী ফোন ধরে, ভীত কন্ঠে বলে।
“হ্যালো কে?”
উচ্ছাস চোখ বন্ধ করে উর্বীর গলার আওয়াজ শোনে।
“হ্যালো!!”
দ্বিতীয়বার বলে উর্বী।
“তোমার গলার আওয়াজ টা আমাকে যা শান্তি দেয় পাখি! তুমি কিছুক্ষণ এভাবেই হ্যালো হ্যালো করতে থাকো।”
উর্বীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়।
“তুমি? তুমি কেনো ফোন দিয়েছো আমায়? কি চাচ্ছো তুমি?কেনো পিছু ছাড়ছো না আমার?
_আমি মরলেও তোমার পিছু ছাড়বো না পাখি।
উচ্ছাস হাসছে। তার কথা জরিয়ে যাচ্ছে। সে আজ নেশা করেছে।
উর্বী বলে,”লজ্জা করে না তোমার? একটা খু’নী হয়ে এখনোও একটুও অনুশোচনা নেই তোমার? তোমার ভাগ্য ভালো আমি সেদিন পুলিশ কে কিছু বলি নি। আমার জীবনে আমি আর কন্ট্রোভার্সি চাচ্ছি না তাই বলিনি। প্লিজ এবার নিজেকে শোধরাও উচ্ছাস। প্লিজ।”
উচ্ছাস হাসে,”তার মানে বুঝতে পারছো এখনো তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো? আমার কোনো ক্ষতি হোক তুমি চাওনা উর্বী। কেনো এখনো চলে আসছো না উর্বী আমার কাছে?”
বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী গলায় বলে উচ্ছাস।
উর্বী ধমকে ওঠে,”বাসিনা। বাসিনা ভালো তোমায় উচ্ছাস। তুমি আমার অতীত। আমাকে তুমি প্লিজ বাঁচতে দাও। উচ্ছাস লাইফ তোমাকে যেমন সেকেন্ড চান্স দিয়েছে। আমাকেও দিয়েছে। আমি আরেকটি বার শুরু করেছি সব। কেউ আমাকে আগলে নিয়েছে, আরেকটি বার স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করছে!
_চোপ!! কে অতীত? তোর অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ সব আমিই। এটা তুই মাথায় ঢুকিয়ে নে।
_তুমিও মাথায় ঢুকিয়ে নাও। আমি বিবাহিতা। আমি অন্য কারো স্ত্রী। এবং তার সাথেই আমি বাকি জীবন টা কাটাবো।
উচ্ছাসের রাগ উঠে যায়,সে উর্বীকে কুতসিত একটা গালি দেয়।
উর্বী চুপ করে থাকে। উচ্ছাস বলতে থাকে,
“তোর সংসার করা একেবারে ঘুচিয়ে দেবো। তোর স্বামীর ফোন নাম্বার কিন্তু আমার কাছে আছে। তাকে ফোন দিয়ে বলবো তোর নাভীর নিচেই একটা তিল আছে? বলবো?
বেশি ফরফরাচ্ছিস তুই। বলে দেই?”
ঘৃণায় উর্বীর চোখ বেয়ে পানি পরে।
উচ্ছাস বলতে থাকে,”ভয় পাস না। তোর স্বামীকে আমি মারবো না। আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছি। তিন বাচ্চার বাপকে মেরে বাচ্চা তিনটাকে এতিম করবো আমি? আমি এতোটাও খারাপ নই। তোকে আদায় করার অন্য কৌশল আমার জানা আছে।”
কথাটি বলেই উচ্ছাস কথার সুর পাল্টে ফেলে। আবার নরম গলায় বলে ওঠে,”এই দেখো পাখি। আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করে ফেললাম। কত খারাপ আমি। তুমি প্লিজ রাগ করো না। আচ্ছা শোনো তুমি আমার গান শুনতে চাও না বলো? আমি গান গাইবো। তুমি আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবে।”
উর্বী ফোন কে’টে দিতে চায়। উচ্ছাস বলে,”ফোন কাটবি না ছলনাময়ী।”
উর্বী থামে। উচ্ছাস হেসে ফেলে বলে,”এই দেখো। আবার তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেললাম। সরি পাখি। আচ্ছা শোনো। আর কখনও আমি এমন করবো না, আমি এ্যাংগার ম্যানেজমেন্ট ক্লাসে যাবো প্রমিজ। ধ’ম’কাবো না তোমায়, গালি দেবো না।”
“উচ্ছাস আমাকে বাঁচতে দাও।”
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে উর্বী। উচ্ছাস আবারও চেঁ’চি’য়ে ওঠে,” তুই কেনো বুঝতে পারিস না আমি তোকে ভালোবাসি। গোল্ড ডিগার বি’চ। নতুন পুরুষ পেয়ে একেবারে…..”
ফোন কাটার শব্দ হয়। উর্বী ফোন কে’টে দু’চোখ ভর্তি পানি নিয়ে বসে থাকে।
উচ্ছাস দুলতে থাকে। নেশার ঘোরে সে উর্বীকে কি বলেছে সে নিজেই জানে না।
একটা ও.টি. সামলে এসে সার্জিক্যাল ক্যাপ খুলে এই মাত্র বসেছে সে। এ্যাসিস্ট্যান্ট এসে এক কাপ কড়া ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায়।
নার্স এসে দরজার বাইরে থেকে ডাকে,”স্যার!”
_হ্যা রুপা। রিপোর্ট এসেছে?
_জি স্যার। ইম্প্রেশন নরমাল ফাইন্ডিংস।
_ওহ ওকে। রিপোর্ট টা পাঠিয়ে দাও। আর সাজিয়া নামের রোগীর বাড়ির লোককে বলো লামিয়া আসছে। টেনশন না করতে।
নার্স রুপা মাথা নেড়ে চলে যায়।
রাওনাফের ফোন বেজে ওঠে। উর্বী ফোন দিয়েছে। ম্লান হেসে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে উর্বীর বিষন্ন কন্ঠস্বর।
“কি করছেন?”
_কিছু না? তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ?
_না।
_মন?
_না।
_মেজাজ?
উর্বী হেসে ফেলে। রাওনাফ বলে,”কপালের ব্যাথা কমেছে?”
“হু”
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে উর্বী।
রাওনাফ বলতে থাকে,”আক্তারুজ্জামানের এ্যাসিসট্যান্ট তোমাকে ফোনে না পেয়ে আমাকে ফোন দিয়েছে। আজ নাকি তোমার এ্যাপয়েনমেন্ট ছিলো!”
_জানি। আর বোধ হয় ওখানে যাওয়া হবে না আমার।
রাওনাফ অবাক হয়ে বলে,”কেনো?”
_একসাথে দুজন সাইক্রিয়াটিস্টকে এফোর্ড করতে পারবো না আমি।
_দুজন সাইক্রিয়াটিস্ট মানে?
_আরেকজন পেয়ে গিয়েছি আমি। ভাবছি তাকেই দেখাবো এখন থেকে।
_চেইঞ্জ করেছো! আক্তারুজ্জামান তো ভালো ছিলো। সাইক্রিয়াটিস্টের নাম কি? কোথায় বসেন?
উর্বী কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থাকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে।
_নাম ডক্টর রাওনাফ করীম খান।
চলমান……..
#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৩
#Esrat_Ety
রাত কটা বাজে উর্বী জানে না। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে সে। ফোনটাও দূরে কোথাও একটা ফেলে রেখেছে হয়তো।
পাশ ফিরে শোয় উর্বী। বারান্দা থেকে আসা আধো আলোতে দেখতে পায় রাওনাফ এখনও ফেরেনি। দরজা চাপিয়ে রাখা। হাত বাড়িয়ে ফোনটা খুঁজতে থাকে সে।
দরজা ঠেলার শব্দ হতেই উর্বী মাথা তুলে তাকায়। বাইরে থেকে মাথা বাড়িয়ে উঁকি দেয় শর্মী। ঘুমে জড়ানো কন্ঠে বলে ওঠে,”আন্টি আসবো!”
উর্বী উঠে বসে। বেড সাইডের টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এসো।”
শর্মী চোখ ডলতে থাকে,ঢুলতে ঢুলতে বিছানার কাছে এগিয়ে এসে বলে,”আন্টি আমি কি তোমার সাথে ঘুমাতে পারি? আপু নেই। আমার খুব ভয় ভয় করছে।”
উর্বী হেসে হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,”অবশ্যই! এসো।”
শর্মী গিয়ে উর্বীর পাশে শুয়ে পরে। উর্বী শর্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শর্মী বলে,”কেমন আওয়াজ আসছিলো আন্টি। এজন্যই আমি হরর মুভি দেখতে চাইনা। তখন ভাইয়া বললো “আয় দেখে যা। কতো ইন্টারেস্টিং। দেখে যা।” আমার এখন ভয় করছে। আমি তুলতুলকে রুমে ফেলে এসেছি।”
উর্বী বলে,”তুলতুল কে?”
_তোমার ময়না পাখির নাম রেখেছি তুলতুল।
_কিন্তু ওর নাম তো গুপি।
_গুপি কোনো নাম হলো? ওর নাম তুলতুল।
উর্বী হাসে। শর্মী উর্বীর দিকে এগিয়ে আসে। উর্বী শর্মীর গায়ে একটা হাত রেখে শুয়ে পরে।
কিছুক্ষণ পরে শর্মী বলে,”কয়টা বাজে আন্টি?”
উর্বী হাত বাড়িয়ে অনেক খুজে ফোনটা পেয়ে যায়,ফোনটা নিয়ে দেখে ,রাত প্রায় একটার কাছাকাছি।
শর্মী বলতে থাকে,”পাপা কেনো আসছে না।”
_দুইটা তিনটা বেজে যাবে আসতে। আজ কিছু ইমার্জেন্সি কেস রয়েছে হাতে।
_জানো আন্টি। আমার পাপাকে খুব ভয় লাগে মাঝে মাঝে।
_কেন কেন?
উর্বী কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে।
শর্মী বলতে থাকে,”পাপা প্রতিদিন কত লোকের পেট কা’টে। বুক চিঁড়ে হার্ট দেখে। আমার খুব ভয় লাগে এসব কথা মনে পরলেই। ভাইয়া-আপু দু’জনেই ডাক্তার হতে চায় পাপার মতো। আমি হবো না। বাপরে বাপ!”
উর্বী হেসে ফেলে,বলে,”তা কি হবে তুমি?”
_আমি কার্টুনিস্ট হবো।
শর্মী বকবক করছে। উর্বীর ঘুম কে’টে গিয়েছে। সে একমনে শুনতে থাকে শর্মী নামের কিশোরী মেয়েটির গল্প। যেন এই গল্পগুলো শর্মী উর্বীর জন্যই জমিয়ে রেখেছিলো।
“এই আন্টি শুনছো?”
“হু শুনছি, বলো।”
_আচ্ছা আন্টি? পাপা এসে গেলে আমাকে কি ঐ রুমে পাঠিয়ে দেবে আজ? আপু তো নেই!
ভয়ে ভয়ে বলে শর্মী।
উর্বী শর্মীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে। তারপর হাসতে হাসতে বলে,”না , আজ তোমার পাপাকে গেস্টরুমে পাঠাবো।”
শর্মী হাসছে। খিলখিলিয়ে হাসছে। হঠাৎ খটখট আওয়াজ হতেই উর্বী আর শর্মী দুজন চুপ হয়ে যায়।
আওয়াজ টা পশ্চিমের কোনো ঘর থেকে আসছে।
শর্মী উর্বীর দিকে আরো এগিয়ে গিয়ে উর্বীকে শক্ত করে ধরে বলে,”ঐ দেখো আন্টি মিথ্যা বলিনি।”
উর্বী উঠে বসে। একটু থেমে আবারও আওয়াজ হতে থাকে। শর্মী বলে,”কি করবে আন্টি?”
_দেখে আসি। চলো।
_না আন্টি আমার ভয় করছে।
_ঠিকাছে। আমি একাই যাচ্ছি। তুমি থাকো এখানে।
_না। আমি এখানে একা থাকবো না। চলো যাচ্ছি।
শর্মী উঠে বসে। উর্বী শর্মীর হাত ধরে এগিয়ে যায় ধীরপায়ে। আওয়াজ হতেই থাকে। খুব সম্ভবত আওয়াজ টা রওশান আরার ঘর থেকে আসছে। শর্মী ফিসফিসিয়ে বলে উর্বীকে,”আন্টি! কিসের শব্দ ওটা! ভয় করছে তো!”
উর্বীও ফিসফিসিয়ে বলে,”না গেলে তো বুঝতে পারবো না! চলো।”
রওশান আরার ঘরের দরজা চাপিয়ে রাখা। দরজার সামনে এসে উর্বী দম নিয়ে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে।
মুহূর্ত কে’টে যায়। শর্মী ভয়ে ভয়ে উর্বীর পেছন থেকে মাথা বের করে উঁকি দেয় সামনে।
উর্বী হতভম্ব হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। তার সামনেই কয়েক গজ দূরে, রওশান আরার সিন্দুকের কাছে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে একটা শীর্ণকায়,লিকলিকে দেখতে শরীর।
একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
***
রাওনাফকে দেখে সুমনা একটা হাসি দিয়ে বলে,”আমি জানতাম আপনি আসবেন। আমি আর ঝুমুর আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
রাওনাফ ম্লান হাসে, বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,”তোমাদের পিকনিক শেষ?”
_হ্যা। খেয়েদেয়ে সবাই যে যার রুমে ঢুকেছে।
_ঠিকাছে, শায়মীকে ডেকে দাও। বলো,পাপা এসেছে।
সুমনা একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”আমরা ওর খালামনি দুলাভাই। ওর নিরাপত্তা দিতে কি আমরা জানি না?”
রাওনাফ সুমনাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”এই না না! একদম তেমন টা নয় সুমনা।”
_বুঝতে পেরেছি দুলাভাই। আমরা মাইন্ড করিনি।
রাওনাফ বলতে থাকে,”একটু বোঝো আমাকে সুমনা। মেয়ে দু’টো বড় হচ্ছে। ওরা নিজেদের ভালোমন্দ কিছুই বোঝে না। শুধুমাত্র হাতে-পায়েই বড় হয়েছে। এই আজ তোমাদের এই অনুষ্ঠানে রাজ্যের বাইরের লোকজন এসেছে,উঠতি বয়সের ছেলেরা সব। বাবা হিসেবে আমার চিন্তা হয়। মেয়ে দু’টো আমার বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও রাতে থাকলেই আমি ভাবি এই বুঝি কোনো বিপদ ঘটে গেলো। রুমার সাথে ছোটবেলায় খুব ভ’য়ংকর একটা ঘটনা ঘটেছিল,তোমরা শুনেছো। কন্যা সন্তান বড় করা খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার, চোখ কান খোলা রাখতে হয়। গা ছাড়া ভাব করলেই,কোনো না কোনো শ’কু’ন থাবা বসাতে আসে। তোমার মেয়ে বাচ্চা থাকলে বুঝতে। আজ এখানে এতো ছেলেরা আসবে জানতাম। ওরা না আসলে আমি কখনোই তোমাদের বোনঝিকে তোমাদের থেকে নিয়ে যেতাম না। এইতো কিছুদিন আগে এসে তিনদিন থেকে গিয়েছে। তখন আপত্তি করেছি? করিনি তো! আমিও মানি তোমরা ওদের নিরাপত্তা দেবে। তবে আজ নয়, আমার মন মানছে না আজ। আসবে আরেক সময়। তোমার শশুর বাড়ির দিকের আত্মীয়দের ছেলে গুলোকে আমি পছন্দ করি না। সবকটা স্পয়েল্ড চাইল্ড। এদের সাথে আমার সরল মেয়েটি রাতে এক বাড়িতে থাকবে! আমার ভালো লাগবে না! এতে মাইন্ড করলেও আমি হেল্পলেস সুমনা।”
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে রাওনাফ থামে। সুমনা তার দুলাভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝুমুর এক গ্লাস পানি রাওনাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”এই নিন দুলাভাই। পানি খান। ব্যাখ্যা দিতে দিতে আপনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। আরে আমরা কিছুই মনে করিনি। সত্যি বলছি!”
রাওনাফ হেসে ফেলে। সুমনা বলে,”এতো ব্যাখ্যা দিতে জানেন আপনি! সত্যিই আমরা কিছু মনে করিনি।”
রাওনাফ বলে,”আসলে তোমাদের আপার কাছে ব্যাখ্যা, কৈফিয়ত দিতে দিতে আমি এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছি এসবে। মানুষটা তো নেই। কিন্তু তার শিখিয়ে দেওয়া অভ্যাস গুলো থেকে গিয়েছে আমার মধ্যে।”
সুমনা হাসে। ঝুমুর চলে যায় শায়মীকে ডেকে দিতে। সুমনা রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি পারেনও। হসপিটাল থেকে এখানে ছুটে আসলেন। ফোন করে বললেই ঝুমুরকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতাম আপনার মেয়েকে। এতো চাপ নিতে পারেন! অয়নের বাবা তো সবসময় বলে,”রাওনাফ ভাই এতো ফিট কিভাবে থাকে বুঝিনা। আমি তো পানি খেলেও আমার ভুড়ি বেড়ে যায়।”, তখন আমি তাকে বলি,”রাওনাফ ভাই প্রতিদিন যা কাজ করে! তুমি বছরেও তা করো না।”
রাওনাফ হাসে। সুমনা বলে,”কাজ একটু কমিয়ে দিন এখন। নতুন বিয়ে করেছেন। কমবয়সী বৌ। তাকে একটু বেশি বেশি সময় দিন।”
সুমনার কথার পিঠে রাওনাফ কোনো কথা বলে না। শায়মী চোখ ডলতে ডলতে সুমনাদের লিভিং রুমে এসে দাঁড়ায়। তার পাপার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”দিস ইজ নট ফেয়ার পাপা! দিস ইজ ঠু মাচ।”
***
উর্বী ঘামছে। শর্মীকে আগলে নিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে। শর্মী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে সামনের রোগাপটকা লোকটাকে। একটা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট পরে,খালি গাঁয়ে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। জীর্ণ শীর্ণ শরীর, কৃষ্ণবর্ণের গাত্র, গাঁয়ে কোনো তরল মেখেছে সম্ভবত, চিকচিক করছে পুরো শরীর।
শর্মী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আন্টি এটা কে!”
উর্বী গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”চোর।”
চোরটা একবার উর্বীর দিকে তাকায়, একবার শর্মীর দিকে। দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। পালাবার পথ নেই। সে ভাবছে কি করা যায়।
শর্মী ফিসফিসিয়ে বলে,”আন্টি ঐ লোকটা কিভাবে টের পেলো দাদুর সিন্দুকে গয়না আছে!”
উর্বী ফিসফিসিয়ে বলে,”তা আমি কি করে জানবো। ওকে জিজ্ঞাসা করো।”
শর্মী সত্যি সত্যি চোরের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার দাদুর সিন্দুকে গয়না আছে আপনি কিভাবে জানলেন? আমরাও তো জানি না।”
চোরটা হঠাৎ থ্রি-কোয়ার্টারের পকেট থেকে একটা পি’স্তল বের করে উর্বীদের দিকে তাক করে। উর্বী শর্মীকে নিজের পেছনে আড়াল করে নেয়। চোরটা ক্যানক্যানে গলায় ভৌতিক আওয়াজ তুলে বলে,”চিক্কুইর দেবা না। চিক্কুইর দেলে খবর আছে।”
উর্বী ভয়ার্ত কন্ঠে হাত উঠিয়ে বলে,”আচ্ছা আচ্ছা। আপনি আগে ওটা নামান।”
শর্মী উর্বীকে বলে,”চিক্কুইর? আন্টি হোয়্যাট চিক্কুইর? কি বলছে এই লোক!”
উর্বী তাড়াহুড়ো গলায় বলে,”এটা আমাদের বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা। এর মানে চিতকার। শর্মী একটু চুপ করো এখন। আমি তোমায় পরে বুঝিয়ে বলবো।”
তারপর চোরের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”কি চাই?”
চোর সিন্দুকের দিকে আঙুল তাক করে বলে,”এইডায় যা আছে সব নেতে চাই। খুইল্যা দাও। চাবি কই?”
[এটাতে যা আছে,সব নিতে চাই। খুলে দাও। চাবি কোথায়?]
_চাবি আমার শাশুড়ির কোমরে। সে বাড়িতে নেই।
উর্বী স্বাভাবিক গলায় বলে।
চোর বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”ওহ! তাইলে চুপচাপ মুখ বন্ধ কইরা খারাইয়া থাহো। আমি এইডা ভাঙমু!”
[ওহ! তাহলে মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি এটা ভাঙবো]
নাবিল ঘুম থেকে উঠে পরে। কানে হঠাৎ ঠুকঠুক শব্দ আসছিলো। হুট করে ঘুমটা ভেঙে গেল। হাই তুলে বিছানা থেকে নেমে সে সিড়ির দিকে এগিয়ে যায়। শব্দটা দোতলা থেকেই আসছে। সিঁড়ি যত অতিক্রম করছে,শব্দটা তত জোরালো হচ্ছে। একটা উৎকণ্ঠা চেপে বসে নাবিলের চোখে মুখে। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যেতে থাকে।
চোর এক হাত দিয়ে পি’স্তল তাক করে আরেক হাত দিয়ে রডের সাহায্যে প্রহার করে যাচ্ছে মান্ধাতার আমলের সিন্দুকের তালায়। কিছুক্ষণ পরে হাঁপিয়ে উঠে উর্বীকে বলে,”তুমি ভাইঙ্গা দাও। [তুমি ভেঙে দাও]”
শর্মী বলে ওঠে,”আন্টি কেনো ভাঙবে? আন্টি কি চোর? চোর তো তুমি!”
চোর শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এক্কেরে চুপ। বড় লোকের ঢেমশি মাইয়া। পাকনা পাকনা কথা কবা না!”
[একেবারে চুপ। বড়লোকের আহ্লাদী মেয়ে। পাকা পাকা কথা বলবে না]
উর্বী চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে,”খবরদার আমার মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলবেন না।”
চোর ঘুরে উর্বীর দিকে পি’স্তল তাক করে,উর্বী একটা ঢোক গিলে বলে,”আচ্ছা আমি ভাঙছি সিন্দুক। আপনি ওটা নিচে নামান।”
উর্বী সিন্দুক ভাঙার চেষ্টা করতে থাকে। চোর শর্মীর দিকে পি’স্তল তাক করে রাখে। কিছুক্ষণ বাদে শর্মী আবারও বলে ওঠে,”তুমি এটা গায়ে কি মেখেছো?”
-তৈল। খাটি সরিষার তৈল।
_তেল কেন মেখেছো?
_যাতে কেউ জাবরাইয়া ধরলে পিছলা যাইতে পারি। পলাইতে পারি।
[যাতে কেউ জাপটে ধরলে,পিছলে যেতে পারি। পালাতে পারি!]
_হোয়্যাট “জাবরাইয়া” আন্টি?
শর্মী উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে। উর্বী সিন্দুক ভাঙতে ভাঙতে জবাব দেয়,”জাপ্টে ধরা।”
শর্মী নাক চোখ কুঁচকে বলে,”ছিহহ! এই লোককে কে জাপটে ধরবে। গা থেকে কি দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।”
কথাটায় যেনো চোর খুবই অপমানিত হলো। শর্মীর দিকে তাকিয়ে ধ’ম’কে বলে,”চুপ! এক্কেরে চুপ!”
“এসব কি হচ্ছে এখানে!”
নাবিলের গলার আওয়াজে উর্বী প্র’হার থামিয়ে দেয়। চোর চ’ম’কে উঠে নাবিলের দিকে তাকায়। পাপার মতো লম্বা হয়েছে নাবিল তাই যে কেউই তাকে এখনি সুপুরুষ মনে করতে বাধ্য। সেখানে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির শীর্ণকায় চোর ঘা’ব’ড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
নাবিল হতভম্ব হয়ে সবার মুখের দিকে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে,”কেউ আমাকে বলবে হচ্ছে টা কি এখানে!”
উর্বী ঠান্ডা গলায় বলে,”উনি চোর। চুরি করতে এসেছে। আমরা ওনাকে সাহায্য করছি!”
নাবিল হতভম্ব হয়ে বলে,”সাহায্য করছি মানে!”
উর্বী চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”দেখছো না হাতে পি’স্তল। এখন কথা না বলে এসো আমাকে তালাটা ভাঙতে সাহায্য করো।”
নাবিল ক্ষে’পে চোরের দিকে তাকায়। চোর নাবিলের চাহনি দেখে ঘা’বড়ে যায়। নাবিল শার্টের হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে বলে,”কোথা থেকে উদয় হলি ছিচকে চোর ব্যাটা! তোর এই খেলনা বন্দুক সরা!”
উর্বী হতভম্ব হয়ে চোরের হাতের দিকে তাকায়। হতভম্ব হয়েই বলে,”এটা খেলনা বন্দুক?”
নাবিল বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”মাথায় তো শর্মীর ব্রেইন নিয়ে ঘোরেন আপনি। বুঝবেন কি করে কোনটা আসল পি’স্তল আর কোনটা নকল!”
চোর ঘা’ব’ড়ে গিয়ে হাত থেকে নকল পি’স্তল টা ফেলে দেয়। নাবিল হাতা গোটাতে গোটাতে এগিয়ে যায়। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি তুলে চোরটাকে সে আ’ছাড় মারবে।
চোর ত’ড়াক করে লাফিয়ে তিন পা পিছিয়ে গিয়ে পকেট থেকে একটা চাইনিজ চাকু বের করে নাবিলের দিকে তাক করে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব উর্বী নাবিলকে সরিয়ে দেয়।
চোর ওদের দিকে চাকু তাক করে ধরে পৈ’শা’চিক হাসি দিয়ে বলে,”হেহে। এইডা কিন্তু নকল না। মিরপুরের এক মাস্টারের বাড়ি দিয়া চুরি করছি!”
উর্বী আতংকিত গলায় বলে,”তুমি চোর না ডাকাত। আগে নিজের প্রফেশন ক্লিয়ার করো।”
_আগে আল্লাম সার্কাসের বাবুর্চি। মালিক ব্যবসায় লস খাইয়া গেলো। এহন এই ধান্দায় ঢুকছি।
[আগে ছিলাম সার্কাসের বাবুর্চি। মালিক ব্যবসায় লস খেয়ে গেলো। এখন এই কাজ করছি]
_এই ভিআইপি এরিয়ায় তোমার মতো একটা ছিচকে চোর! এতো কিছু কিভাবে জানলে আমাদের বাড়ি সম্পর্কে? আমার শাশুড়ির লকারে গয়না। কিভাবে জানলে?
উর্বীর প্রশ্নে চোর হাসতে হাসতে বলে,”এগুলা মোগো জানতে অয় না। আন্দাজ করতে পারি। আর তোমার হাউরির (শাশুড়ি) ঘরে আন্দাজে ঢুকছি!
[এগুলো আমাদের জানতে হয় না। আন্দাজ করে নিতে পারি। আর তোমার শাশুড়ির ঘরে আন্দাজে ঢুকেছি।]
নাবিল ক্ষে’পে গিয়ে চোরের দিকে দুকদম এগিয়ে যায়। উর্বী পেছন থেকে নাবিলের হাত টেনে ধরে , চেঁ’চি’য়ে উঠে বলে,”চুপ করে দাঁড়াও , ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার!”
চোর চাকুটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,”তালা পরে ভাঙমু । খিদা লাগছে। কিছু খাইতে দাও আগে। আর খবর দার তিড়িং বিড়িং করবা না। এক পোচ দিয়া মাথা আলাদা করমু কিন্তু!”
উর্বী ঘামছে। মনে মনে বলছে,”আপনি এখনও কেনো আসছেন না শর্মীর পাপা!”
***
শায়মী মুখ ভার করে গাড়িতে বসে আছে। রাওনাফ হেসে ড্রাইভ করতে করতে এক হাত দিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শায়মী বলে,”একদম আমার সাথে কথা বলবে না তুমি পাপা।”
রাওনাফ হাসে। নরম গলায় বলে,”সরি মামনি! আরেকদিন খালামনির বাড়িতে রাতে থেকো। আজ নয়।”
_আজ কি সমস্যা? পাপা আমি কি ছোট? তুমি এমন কেন করো! ওরা সবাই হাসাহাসি করছে।
_না তুমি ছোট নও, তুমি বড়। ইয়াং প্রিটি লেডি! সেজন্যই তো ভয়। কোন ড্রাকুলা এসে রাওনাফ করিমের প্রিন্সেস টাকে নিয়ে যায় আবার!
শায়মী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”নেক্সট উইক সিনেপ্লেক্সে নিয়ে যাবো। আমি নিজে। এখন প্লিজ মুড ঠিক করো।”
একহাতে চাকু ওদের তিনজনের দিকে তাক করে আরেক হাত দিয়ে গপাগপ ভাতের লোকমা মুখে ঠুশছে।
উর্বী, নাবিল,শর্মী তিনজন সামনে চুপচাপ বসে আছে। যতবার উর্বী চাকুটার দিকে তাকাচ্ছে ততবার একটা করে ঢোক গিলছে সে। কি ভয়ংকর চাকু!
চোর খেতে খেতে ওদের দিকে তাকায়। শর্মী বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”আপনি এভাবে বিশ্রী ভাবে খাচ্ছেন কেন? ঠিক ভাবে খান। কোনো টেবিল ম্যানার জানেন না নাকি? পাপা এভাবে খেতে দেখলে আপনাকে বকতো।”
চোর বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”এই মাইয়া এতো কথা কয় ক্যা?”
উর্বী ফিসফিসিয়ে শর্মীকে বলে,”চুপ করো না!”
নাবিল বলে,”তোর বয়স কতো?”
চোর মাথা তুলে নাবিলের দিকে তাকায় , ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”তুই তোকারি করবা না! মোর বয়স ছাব্বিশ বছর।”
_নাম কি তোমার?
নাবিল বলে ওঠে।
_পল্টু।
_তোমার শরীর এতো টিঙটিঙে কেন? খেতে পাও না নাকি? এতো চুরি করো,সেসব দিয়ে কি করো?
পল্টু খাওয়া থামিয়ে হাসে, বলে,”আমরা ইচ্ছা কইরাই গতর এই রহমের বানাই। এতে দৌড়াইতে সুবিধা হয়। ধরা পরি না সহজে।”
[আমরা ইচ্ছে করেই শরীর এরকমের বানাই। এতে দৌড়াতে সুবিধা হয়।]
সবাই চুপচাপ। নাবিল সুযোগ খুঁজছে কখন চোর একটু অন্যমনষ্ক হবে আর সে চাকুটা কে’ড়ে নেবে।
পল্টু বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”এইসব কে রানছে?”
উর্বী বলে,”আমি রেধেছি। কেনো?”
_তোমাগো দ্যাশের বাড়ি কোনহানে?
[তোমাদের দেশের বাড়ি কোথায়]
_বরিশাল।
_এই রান্ধন তো বরিশালের না। এক ড্যাগ ঝোল দিয়া থুইছো। এইয়া তো উত্তরবঙ্গের মাইনষে খায়। আইজ খিদা আছিলো বইলা খাইলাম। নয়তো পল্টু এইসব থার্ড কেলাস রান্ধন ছুইয়াও দ্যাহে না। সময় থাকলে তোমারে আইজ রান্ধা শিখাইয়া যাইতাম। আমি সার্কাস দলে আট বছর বাবুর্চির কাম করছি।
[এই রান্না তো বরিশালের না। এক কড়াই ঝোল দিয়ে রেখেছো। এসব তো উত্তরবঙ্গের মানুষ খায়। আজ খিদে ছিলো বলে খেলাম। নয়তো পল্টু এসব থার্ডক্লাস রান্না ছুঁয়েও দেখে না।]
নাবিল পল্টুর অন্যমনষ্ক ভাব দেখে এগিয়ে যায় দু’পা। পল্টু মাথা তুইলা বলে,”মোরে গোঙ্গা মনে হরনের দরকার নাই? ঐ হানে চুপচাপ খাড়াইয়া থাহো।”
নাবিল দাঁড়িয়ে যায়। শর্মী নীরবতা ভেঙে উর্বীকে বলে,”হোয়্যাট “গোঙ্গা” আন্টি?
উর্বী একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে শর্মীর সরল মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”গোঙ্গা মানে বোকা।”
পল্টু বলে,”তোমাগো আমার খুব পছন্দ হইছে। তোমাগো একটা কথা কই। দাড়োয়ানডারে পাল্টাইবা। আসার সময় দ্যাখলাম চেয়ারে বইসা বইসা ঘুমাইতেছে। ওরে বেতন দাও কতো?”
নাবিল বলে,”পাপা জানে।”
_পাপা পাপা করবা না। যত্তোসব। আব্বা বলবা। মুসলমানের বাচ্চা আব্বারে পাপা ডাডি কইলে পাপ অয়।
সবাই চুপ। পল্টু আবারও উর্বীকে বলে ওঠে,”তুমি এই পোলাপান দুইটার কি হও?”
উর্বী কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে নাবিল বলে ওঠে,”উনি আমার পাপার ওয়াইফ।”
_ওয়াইফ কি?
_বৌ।
_তোমার আব্বার বৌ মানে? তোমাগো আম্মা?
উর্বী চুপ করে থাকে, নাবিল মাথা নাড়ায়, বলে,”আমার মা মারা গেছে।”
পল্টু অবাক হয়ে বলে,”ওও তোমগো হোতি মা?”
শর্মী উর্বীকে বলে,”আন্টি হোতি মা কি?”
উর্বী বিব্রত হয়ে নিচুস্বরে বলে,”সৎ মা।”
শর্মী চুপ হয়ে যায়। সৎ মা শব্দটা তার পছন্দ না মোটেই। সে চোরকে বলে,”উনি আমার পাপার ওয়াইফ আর আমার আন্টি। কোনো হোতি মা না। আর আপনি প্লিজ আপনার ভাষা ঠিক করুন। অর্ধেক কথা বুঝতেই পারছি না। বুঝতে না পারলে উত্তর দেবো কি?”
পল্টু শর্মীর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,”হোতি মা সবসময় খারাপ হয়না। তোমগো এই হোতি মারে ভালো মনে হইতেছে আমার। দ্যাখো ক্যামনে তোমগো আগলাইয়া রাখতে আছে। হোতি মা তো আছিলো আমার। ডেইলি মাইর খাইতাম। পাছার উপরে ঠাস ঠাস মারতো। আব্বারে দিয়া মাইর খাওয়াইতো। দশবছর বয়সে রাগে দুঃখে বাড়ি ছাড়লাম।”
কথাগুলো বলতে বলতে পলটু খুবই ইমোশনাল হয়ে পরলো। নাবিল বিরাট সুযোগ হাতে পেলো। অন্যমনষ্ক ভাব দেখে চোখের পলকে একটান মেরে পল্টুর হাতের চাকু টা কে’ড়ে নেয়। পল্টু ত’ড়াক করে লাফিয়ে ওঠে।
উর্বী সাহস পেয়ে ছুটে যায় পল্টুর কাছে। পল্টুর হাত শক্ত করে ধরে শর্মীর দিকে তাকিয়ে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”শর্মী দড়ি আনো, দড়ি আনো। এটাকে বাঁধতে হবে।”
নাবিল চাকু টা দূরে ছুড়ে মেরে পল্টুর দিকে এগিয়ে যায়। অন্যহাত শক্ত করে ধরে। পল্টু ক্যানক্যানে গলায় বলতে থাকে,”ছারো কইলাম! মোরে ছাইরা দ্যাও কইলাম।”
শর্মী ঘুরছে। কি করবে বুঝতে পারছে না সে। উর্বী চেঁচাতে থাকে,”দড়ি কিচেনে তিন নাম্বার কেবিনেটে। গো গার্ল! গো।”
পল্টু এর মাঝে এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। নাবিলের হাতে কা’মড় বসিয়ে এক দৌড় লাগায় সিঁড়ির দিকে। কিন্তু তার আগেই উর্বী গিয়ে তাকে আটকে ফেলে।
***
বৃদ্ধ দাড়োয়ান মজিদ মিয়া চেয়ারে বসে ঝি’মুচ্ছে। রাওনাফ গেইটের কাছে গাড়ি থামিয়ে হর্ণ বাজিয়েই যাচ্ছে। কিছুসময় পরে মজিদ মিয়া ঘুম থেকে উঠে গেইট খুলে দেয়।
রাওনাফ গাড়ি পার্ক করে। শায়মীকে নিয়ে রওশান মঞ্জিলের সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। সদর দরজার কাছে এসেই থমকে যায় রাওনাফ। শায়মী আর রাওনাফ একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বাড়ির ভেতর থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ আসছে সম্ভবত। রাওনাফ কলিং বেল টিপতে গিয়েও টেপে না। ওয়ালেট থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করে দরজা খোলে।
দরজা খুলে রাওনাফ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করা। শায়মী পেছন থেকে তার পাপার শার্ট খামচে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ধীরে ধীরে মাথা বের করে সামনে উঁকি দিতেই সেও স্তব্ধ হয়ে যায়।
পল্টুকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। নাবিল আর শর্মী তার পেছনে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে। উর্বী পাশেই কপালে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। তার কপাল পুনরায় কে’টে গিয়ে রক্ত ঝরছে। পল্টু যখন নাবিলের হাতে কামড় দিয়ে দৌড়াচ্ছিলো। তখন উর্বী গিয়ে পল্টুর সামনে দাঁড়ায়। নাবিল নিজেকে সামলে নিয়ে একটা গ্লাস উঠিয়ে ছুড়ে মারে পল্টুর দিকে। কিন্তু সেটা ভুলবশত লেগে যায় উর্বীর কপালে।
পুরো বাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে আছে। লিভিং রুমের সোফা উল্টিয়ে পরে আছে। মেঝেতে স্থানে স্থানে কাঁচের টুকরো। অনেক ধস্তাধস্তির পরে পল্টুকে বাগে আনতে পেরেছে আহত উর্বী আর রাওনাফ করিমের দুই ছানা।
রাওনাফ সবাইকে অবলোকন করে হতভম্ব গলায় বলে,”হোয়্যাটস গোয়িং অন!!!!”
শর্মী উচ্ছসিত কন্ঠে বলে,”আমরা চোর ধরেছি পাপা। এই দেখো চোর।”
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”কপাল কে’টেছে কিভাবে আবার!”
শর্মী বলে,”ভাইয়া গ্লাস ছুড়ে মে’রেছে।”
রাওনাফ হতভম্ব হয়ে ছেলের দিকে তাকায়। নাবিল বলে,”পাপা আমি চোরকে মা’রতে যাচ্ছিলাম। ভুলে ওনার কপালে গিয়েছে। এক্সট্রিমলি সরি!”
শায়মী তার পাপার পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। উত্তেজিত গলায় বলে,”এটা চোর? তোরা তিনজন ধরেছিস?”
শর্মী বুক ফুলিয়ে বলে,”ইয়েস! আমরা তিনজন। ইট ওয়াজ সো এক্সাইটিং! তুই মিস করে গেলি আপু!”
উর্বী যন্ত্রনা ভুলে রাওনাফ করিমের অবুঝ দুই কন্যার কথোপকথন শোনে।
শায়মী বলে,”ধূর আমি আজ কেনো গেলাম খালামনির বাড়িতে! তোরা কত মজা করলি!”
শায়মীর কথায় উর্বী হাসবে না কাঁদবে কিছু বুঝতে পারছে না!
শায়মী বলতে থাকে,”এই চোর এতো বিশ্রী কেন দেখতে! ঠু ডার্ক এ্যান্ড ডার্টি। ইয়াক!”
নাবিল বলে ওঠে,”তো তুই কি আশা করেছিলি? চোর রিত্তিক রওশানের মতো দেখতে?”
শর্মী হাসতে হাসতে বলে,”না। আপু ভেবেছিলো চোর বিটিএস-এর জাংকুকের মতো দেখতে।”
শর্মীর কথায় হেসে ফেলে নাবিল,হেসে ফেলে উর্বীও। রাওনাফ অবাক হয়ে সবার বাচ্চামো দেখতে থাকে। তারপর বলে ওঠে,”চুপ! চুপ করো এখন সবাই! আই শ্যুড কল দ্যা পুলিশ। আর শায়মী, এভাবে কারো বডি শেমিং করতে হয়? এসব শিখিয়েছি তোমাকে আমি? ওকেও আল্লাহ বানিয়েছেন।”
উর্বী এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ভোলাভালা তিন ছানার ভোলাভালা বাপের কথা শুনে কপাল থেকে হাত সরিয়ে পেট চেপে ধরে হাসতে থাকে সে।
রাওনাফ তার দিকে তাকায়। উর্বী চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে মেঝের দিকে তাকিয়ে সে হাসতে থাকে।
চেয়ারে বসে চোর পল্টু তখনও বিড়বিড় করতে থাকে,”ছাড়ো কইলাম! মোরে ছাড়ো কইলাম!”
***
রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ টহল পুলিশ আসে । রাওনাফের সাথে কথা বলে চোর পল্টুকে নিয়ে চলে যায়।
পুলিশ চলে গেলে রাওনাফ তার ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে,”এখন যার যার রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। সকালে এ নিয়ে কথা হবে। যাও সবাই।”
উর্বী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফের তিন পুত্র কন্যাও দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফ নিচুস্বরে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার ড্রেসিং দরকার। চলো।”
উর্বী ধীরপায়ে এগিয়ে আসতে নিলে দুর্ঘটনাবশত পা রেখে দেয় ভাঙা গ্লাসের টুকরোতে।
ঘটনাটা ঘটতে সময় নিয়েছে চার সেকেন্ড। কিন্তু সবাই হতভম্ব হয়ে মিনিট খানেক উর্বীর দিকে তাকিয়েই রইলো। রাওনাফ হতভম্ব হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিড়বিড় করে মুখ থেকে তার একটা শব্দই বের হয়,”আনবিলিভেবল!”
উর্বী মুখ তুলে রাওনাফের দিকে তাকায়। নাবিল,শর্মী,শায়মী তিনজনই এগিয়ে আসে। নাবিল একটা উল্টানো সোফা ঠিক করে দেয়। শায়মী ধরে ধরে উর্বীকে বসিয়ে দেয়।
রাওনাফ বলতে থাকে,”এটাই বাকি ছিলো! তবে এটা কম হয়ে গেলো মৃদুলা উর্বী! তোমার হাত দু’টো এখনও অক্ষত!”
রাওনাফের কথায় ব্যাথাতুর শরীরেও উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে চায়। রাওনাফ বলে,”দেখেছো মেঝেতে এতো কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে আছে! তবুও আকাশের দিকে তাকিয়ে হাটো।”
নাবিল তার পাপার দিকে তাকায়। তার পাপার কন্ঠে ঐ মেয়েটার জন্য উৎকণ্ঠা!
যন্ত্রনায় উর্বীর চোখ থেকে পানি বের হয়ে যায়। রাওনাফ কিছুক্ষণ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে শার্টের হাতা ফোল্ড করে নেয়। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে তার পদক্ষেপ বোঝার চেষ্টা করছে।
রাওনাফ কোনো সংকোচ ছাড়াই, অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উর্বীকে কোলে তুলে নেয়।
শর্মী পাপার দিকে হা করে একপলক তাকিয়ে সাথে সাথে নিজের চোখ চেপে ধরে। শায়মীও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিটিমিটি হাসছে। শুধুমাত্র নাবিল কপাল কুঁ’চ’কে তাকিয়ে আছে।
বিব্রত, অবাক, লাজুক উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ তার দিকে তাকায় না, খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিড়ি ভা’ঙতে থাকে।
শায়মী এবার মাথা ঘুরিয়ে তার পাপাকে দেখে। শর্মী চোখ চেপে ধরলেও হাতের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে এতক্ষণ ঠিকই দেখেছে পাপা আর আন্টিকে। সে ধীরে ধীরে মুখ থেকে হাত নামিয়ে নেয়। শায়মী এসে আবারও শর্মীর চোখ চেপে ধরে।
নাবিল কপাল কুঁ’চ’কে ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু ধীরে ধীরে তার কপালের ভাঁজের রেখা বিলীন হয়। কোনো এক অজানা কারণে তারও একটু একটু হাসি পাচ্ছে।
***
একটু পর পর উর্বী মৃদু আর্তনাদ করে উঠছে। রাওনাফ তার পা থেকে কাঁচের টুকরো টা বের করে তার দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকায়। তারপর পা ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। রাওনাফ বলতে থাকে,”আনবিলিভেবল, তুমি নাকি ওম্যান অব থার্টি! তোমার থেকে শর্মীও বেশ স্মার্ট!”
উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলে,”ব্যাথা করছে খুব?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে। রাওনাফ বলে,”পেইন কিলার দিয়ে দেবো।”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”পা থেকে হাত সরান।”
রাওনাফ অবাক হয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উর্বীর পা থেকে হাত সরিয়ে বিছানায় তার পাশে বসে। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে উর্বীর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই উর্বী বলে ওঠে,”আবার কি!”
রাওনাফ বিরক্ত হয়ে বলে,”তোমার কপালের ড্রেসিং করতে হবে। পরপর তিনবার কপালে আঘাত পেলে। একবারে কপালটাকে ফাটিয়ে কেনো বসে থাকো না?”
উর্বী বিড়বিড় করে বলে,”ওটা তো এমনিই ফাটা!”
রাওনাফ উর্বীর কথায় পাত্তা না দিয়ে মেডিসিনে চোবানো তুলো উর্বীর কপালে চেপে ধরতেই উর্বী চোখ মুখ খিচিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে রাওনাফের বাম হাত খামচে ধরে।
রাওনাফ চ’ম’কে উঠে নিজের হাতের দিকে তাকায়। উর্বীর আর্তনাদ থেমে গেলেই রাওনাফ একটানে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে উল্টে পাল্টে নিজের হাতটাকে দেখে। নখের দাগ বসে লাল হয়ে গিয়েছে পুরো। উর্বী ধীরে ধীরে চোখ মেলে নিজের কীর্তি উপলব্ধি করতে পেরে লজ্জায় মিইয়ে যায়। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী দ্বিধা কাটিয়ে রাওনাফের হাত আগলে নিয়ে অপরাধী গলায় বলে,”সরি।”
চলমান…..