#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২০
#Esrat_Ety
একটা পরিচিত অনুভূতি ঘিরে ধরে রেখেছে উর্বীকে আপাদমস্তক।সে তাকিয়ে আছে, তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। যে এসেছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। আর আজকের এই আসাটা? এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কি?
রাওনাফ ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে । উর্বী মোমবাতি হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ কাঁপছে, ফরসা রঙের পরিনত মুখটা ঠান্ডায় জমে নীলাভ হয়ে গিয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে উর্বীর চোখে চোখ রেখে বলে,”কি?”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”কি?”
_আমি তো সেটাই বলছি, কি? আরে ভেতরে আসতে দেবে না আমাকে? দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছো তুমি!
উর্বী লজ্জা পেয়ে সরে দাঁড়ায়। বাইরে যে মানুষটা ভিজছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেইনি এতক্ষন। দরজার পাশে সরে দাঁড়িয়ে মোমবাতিটা কিছুটা নিচু করে হাতে ধরে রাখে। রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। সে অনবরত কাঁ’প’ছে।
উর্বী দরজা লাগিয়ে দেয়। রাওনাফ উর্বীকে একপলক দেখে, সে ঠকঠক করে কাঁপলেও কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”এখন আমার ইচ্ছা করছে একটা সিগারেট খেতে।”
উর্বী দরজা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় রাওনাফকে বলে,”আমার ভাইয়া সিগারেট খায়। তার প্যাকেট থেকে একটা এনে দেবো?”
রাওনাফ কাঁপতে কাঁপতেই হেসে ফেলে,
_না থাক। তুমি আমাকে এক কাপ চা দাও। ইটস এ্যান ইমার্জেন্সি।
কথাটি বলেই রাওনাফ উর্বীর ঘরের দিকে যাওয়া শুরু করে।
উর্বী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে রাওনাফকে। রাওনাফকে দেখে তার মনে হচ্ছে সে বহুবার এবাড়িতে এসেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে সে সোজা উর্বীর শোবার ঘরে ঢোকে।
উর্বী কয়েক মুহূর্ত দাড়িয়ে থেকে তার পিছু পিছু যায়।
রাওনাফ রীতিমতো হাঁচি দিতে শুরু করেছে। উর্বী আলমারি থেকে একটা পরিষ্কার তোয়ালে বের করে রাওনাফের দিকে এগিয়ে দেয়।
“নিন,মাথাটা মুছে ফেলুন। সর্দি লেগে যাবে।”
রাওনাফ নিশ্চুপ হাসি দিয়ে তোয়ালে টা নিয়ে মাথা মুছতে থাকে।
উর্বী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। তার হাতে কিছু কাপড়।
রাওনাফ তোয়ালে রেখে তাকায়, বলে,”কি ওগুলো?”
_ভাইয়ার ধোয়া পাজামা আর পাঞ্জাবী। সব তো ভিজিয়ে ফেলেছেন। এখন এভাবে থাকবেন? নিন,এটা পরে নিন। আপনার ফিট হয়ে যাবে। আমি চা নিয়ে আসছি।
রাওনাফ হাত বাড়িয়ে কাপড় গুলো নিয়ে নেয়।
উর্বী চা বানিয়ে নিয়ে এসে দরজায় টোকা দেয়,”আসবো?”
_হ্যা এসো।
উর্বী ভেতরে ঢোকে। চায়ের কাপটা রাওনাফের দিকে এগিয়ে দেয়। রাওনাফ চায়ের কাপটা নিতে নিতে বলে,”একটু লেবু হলে ভালো হতো।”
উর্বী অবাক হয়। এ আজ এতো স্বামীদের মতো আবদার করছে কেনো !
কয়েক মুহূর্ত রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে উর্বী লেবু আনতে রান্নাঘরে যায়।
রাওনাফ হাতে চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসে থাকে।
লেবু চিপে রাওনাফের কাপে দিতে দিতে উর্বী বলে,”আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আমি তো আপনাকে মেসেজ দিয়েছি। পড়েননি ঠিকভাবে?”
রাওনাফ কাপে চুমুক দিয়ে গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,”হ্যা পড়েছি। আমি এখানে,এই কাছেই এসেছিলাম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে, ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। অন্যায় করে ফেললাম?
উর্বী মাথা নিচু করে মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,
_না।
তারপর আবারও থেমে থেমে জিজ্ঞেস করে,”কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনার এখানে?”
রাওনাফ চা শেষ করে, তারপর নিচুগলায় বলে,
_বলবো, তার আগে আমাকে কিছু খেতে দাও। খিদেয় আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে।
উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। মানুষ টা এতদূর থেকে এলো,তার উপরে এই অবস্থা। উর্বীর শুরুতেই মাথায় রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু এই রাতে রাওনাফকে কি খেতে দেবে সে। অলসতার জন্য উর্বী নিজের জন্য কিছুই রান্না করেনি রাতে।
সে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমাকে বিশ মিনিট সময় দিন,আমি আসছি।”
রাওনাফ মাথা ঝাঁকায় , উর্বী দৌড়ে রান্না ঘরে যায়। তাকে ঝটপট কিছু বানাতে হবে। কিন্তু কি করবে সে ! টেবিলে দুপুরের কিছু শুকনো ভাত ছাড়া তো আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তখনি তার মাথায় একটা উপায় আসে। সে পেঁয়াজ,ক্যাপসিকাম কুচি করে কাটতে থাকে। তার হাতের গতি তীব্র।
হঠাৎ রাওনাফ রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়, উর্বীর পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি শর্মীর ফোন ধরছিলে না কেনো?”
“মাগো!”
উর্বী আচমকা ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। সে বুঝতেই পারেনি রাওনাফ এখানে এসেছে। বুকে থুথুরি দিয়ে সে রাওনাফকে বলে,”আপনি এখানে এসেছেন কেনো?”
রাওনাফ হতভম্ব হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে উর্বী ভয় পেয়ে যাবে সে বোঝেনি। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,”এখানে কোথাও তো লেখা নেই আমি আসতে পারবো না ! তাই চলে এসেছি!”
_পুরুষ মানুষের রান্নাঘরে ঢোকা আমার একেবারে পছন্দ না। আপনি রুমে গিয়ে বসে থাকুন। আমি আসছি।
রাওনাফ উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা কি করছো?”
_ভাত ভাজি করছি।
_সেটা আবার কি?
_ফ্রাইড রাইসের বাংলা ভার্সন ! ছোটবেলায় মা ঝটপট করে বানিয়ে দিতো স্কুলে যাওয়ার আগে।
_ওও আচ্ছা। ইন্টারেস্টিং। খেয়ে দেখতে হয় তবে। আচ্ছা তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না, শর্মীর ফোন ধোরছো না কেনো?
উর্বী হাতের কাজ থামিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
_আপনাকে তো মেসেজে বললাম। আমি একটু স্পেস চাই। সবাই যেনো আমাকে ফোন না দেয়। তাহলে আমি কারো ফোন কেনো ধরবো?
রাওনাফের দৃষ্টি উর্বীর নিচু করে রাখা মাথার চুলের সিঁথিতে নিবদ্ধ। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,
_তাহলে আমীরুনকে বারেবারে ফোন দিয়ে শর্মী কি করছে, স্কুলে টিফিন ঠিকঠাক মতো নেয় কিনা, মা ওষুধ খায় কিনা, আমি হসপিটাল থেকে ফিরেছি কিনা, অন্তরার শরীর খারাপ করে কিনা, নাবিল-শায়মীর রেজাল্ট কবে দেবে এসব কেনো জানতে চাও? তখন স্পেস নিতে অসুবিধা হয়না তোমার মৃদুলা উর্বী?
উর্বী ধাক্কার মতো খায়। চ’ম’কে উঠে মাথা তুলে তাকিয়ে হাত থেকে ছু’ড়ি ফেলে দেয়। আমীরুন সব বলে দিয়েছে ! কি অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার। উর্বীর চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুহুর্তেই। এমনটা উর্বীর অপ্রত্যাশিত ছিলো! আমীরুনের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে উর্বীর।
উর্বী ঘামতে থাকে। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে,তার মুখ ভাবলেশহীন! উর্বী তোতলাতে তোতলাতে বলে,”এমনিই। আমার আর পাঁচ মিনিট লাগবে। আপনি কি এই রান্নাঘরে বসে খাবেন? নাকি রুমে যাবেন?”
_যাচ্ছি।
অস্ফুট স্বরে বলে রাওনাফ চলে যায়। উর্বী ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
রাওনাফ খাচ্ছে। উর্বী রাওনাফের সামনে বসে ছিলো। মোমবাতির টিমটিমে আলোয় তাকে কিছুক্ষণ দেখে উর্বী উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফের ভেজা কাপড় গুলো মেলে দিতে হবে । তাই সে বেলকোনিতে চলে যায়। কাপড় গুলো মেলে দিয়ে নিজের এহেন কান্ডে সে যারপরনাই অবাক হয়! এমন কাজ সে কখনোই করেনি। আজ করলো কেন! কেন একজন স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার মতো এই সহজাত আচরণ টা করে ফেললো অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে! কোনো সংকোচ ছাড়াই!
কাপড় মেলে দিয়ে উর্বী ধীরপায়ে রাওনাফের দিকে এগিয়ে আসে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চম’কাচ্ছে।
রাওনাফ চামচ দিয়ে খাচ্ছে। খেতে খেতে বলে,”আসলেই বেশ ভালো খেতে এটা।”
_তেমন ভালো নয় তবে আপনার পেটে খিদে ছিলো তাই বেশি ভালো লাগছে।
উর্বী নিচুস্বরে বলে। মানুষটাকে খেতে দেখতে তার ভালো লাগছে খুব। আরো ভালো কিছু খাওয়াতে না পেরে একটা সূক্ষ্ম অ’প’রা’ধবোধ হচ্ছে মনে, কিন্তু সময় যে খুবই অল্প। তাই ঝটপট করে যা পেরেছে করেছে।
খাওয়া শেষ করে রাওনাফ তার হাত থেকে ঘড়িটা খুলে রেখে দেয়।
উর্বী বলে,”এবার বলুন, এখানে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে এসেছিলেন আপনি হাসপাতাল,ডাক্তারি রেখে?”
হঠাৎ ধপপ করে আওয়াজ হয়। শব্দটা বাইরের আঙিনা থেকে এসেছে। রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। উর্বী বলে,”বাড়ির কয়েকটা ঘরের রেনোভেশনের কাজ চলছে। বাইরের স্টোর ঘরে ভাইয়া কিছু সিমেন্টের বস্তা রাখিয়েছিলেন,সেখানের টিনের আলগা ছাউনি সম্ভবত খুলে পরে গিয়েছে ঝড়ো বাতাসে। আমি যাই, ঠিক করে দিয়ে আসি নয়তো বস্তাগুলো সব ভিজে যাবে।”
“কিন্তু তুমি ভিজে যাবে যে….”
রাওনাফের কথা শেষ হবার আগেই উর্বী হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। রাওনাফ উর্বীর যাওয়া দেখে বিছানার একপাশে চুপচাপ বসে থাকে।
টিনের ছাউনি তুলে ধরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে উর্বী। ঠিক যায়গা মতো সেট করতে পারছে না। কিন্তু বৃষ্টি তাকে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিয়েছে। পায়ের কাছে স্তুপ করে রাখা বালি ভিজে যা তা অবস্থা। সবকিছুই রেনোভেশনের জন্য কিনে রেখেছিলো রেজাউল কবির। ঘন ঘন বিদ্যুত চম’কাচ্ছে। উর্বীর এবার বেশ ভয় ভয় করছে!
বৃষ্টির পানি অসম্ভব ঠান্ডা, এখন বোঝা যাচ্ছে কেন রাওনাফ ওভাবে ঠকঠক করে কাঁপছিল।
ছাউনি ঠিক করে দেওয়ার আগেই খুব নিকটে বিকট আওয়াজে পরপর দু’টো বাজ পরে।
রাওনাফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। দ্রুতপায়ে হেঁটে সদর দরজা পেরিয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করে আঙিনায় চলে যায় স্টোর ঘরের কাছে। উর্বী আ’ত’ঙ্কি’ত মুখে কান চে’পে ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছিলো। কয়েক মুহূর্ত আগে তার শরীর থেকে প্রানটা বেরিয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। রাওনাফ বৃষ্টি গায়ে মাখিয়ে এগিয়ে যায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”আর ইউ ওকে!”
উর্বী নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,”ঠিক আছি। আপনি এলেন কেনো। ভিজে গেলেন যে!”
কথাটা বলে উর্বী পুনরায় টিনের ছাউনি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে, রাওনাফ পেছন থেকে বলে,”মে আই হেল্প ইউ!”
_না,তার দরকার……
বাকিটা বলার আগেই ধপ করে উর্বী ছাউনিটা হাত থেকে ফেলে দেয়। ঝড়ো হাওয়া ছাউনিটাকে খানিকটা সামনে উড়িয়ে নিতেই উর্বী ধরতে গেলে পা পিছলে পরে যায়।
রাওনাফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উর্বীর চঞ্চলতা অবলোকন করছিলো। কাজটা যতটা সহজ ভাবে করা যেতো এই মেয়ে জটিল করছে!
উর্বীকে বালির স্তুপে মুখ থুবড়ে পরতে দেখে সেও ছুট লাগায় উর্বীকে টেনে তোলার জন্য। হাত বাড়িয়ে দিতেই উর্বী নির্দ্বিধায় রাওনাফের হাতে হাত রাখে। রাওনাফ টেনে তোলে। বালি-পানিতে পুরো মাখামাখি অবস্থা। উর্বীর গা গুলিয়ে উঠছে।
রাওনাফ উর্বীর দিকে এক পলক তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। ছাউনিটা তুলে এনে যায়গা মতো রেখে কয়েকটা ইট দিয়ে প্রাথমিক ভাবে চাপা দিয়ে দেয়। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি, সিমেন্ট ভর্তি বস্তাগুলো ভিজে গিয়েছে ইতিমধ্যে। তবে বাকিটা রাত আর ভিজবে না। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। অবশ্য বিদ্যুৎ চমকানো কমেছে। রাওনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এই হালকা ছাউনি টা ঠিক করে দিতে পারছিলে না এতক্ষণ ধরে?”
_আমি আপনার মতো লম্বা নই! তাই বেগ পেতে হচ্ছিল।
নিচুস্বরে জবাব দেয় উর্বী।
রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে। চলো ভেতরে। তোমাকে একটা হাসের ছানার মতো লাগছে। মনে হচ্ছে এই মাত্র কাদাপানিতে সাঁতার কেটে ডাঙায় এসেছো।”
কথাটা বলে রাওনাফ ঘুরে হাঁটতে থাকে। উর্বী লাজুক হাসি হাসে,কয়েক মুহূর্ত লজ্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে রাওনাফের পিছু পিছু যায়।
ঘরে ঢুকে উর্বী রেজাউল কবিরের আরেক সেট পাজামা পাঞ্জাবী রাওনাফকে বের করে দিয়ে নিজে ফ্রেশ হতে চলে যায়। দীর্ঘসময় নিয়ে সে গোসল করে বেরিয়ে আসে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে। কিন্তু তার মন এখনও খুঁতখুঁত করছে। মনে হচ্ছে শরীরের কোথাও না কোথাও বালিকণা থেকেই গিয়েছে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে উর্বী রাওনাফকে জায়নামাজে আবিষ্কার করে। এশার সালাত আদায় করে মোনাজাত ধরেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। তারপর চোখ সরিয়ে নেয়।
সালাত আদায় করে রাওনাফ জায়নামাজ যথাস্থানে রেখে, হাতে ফোনটা নিয়ে নেয়। ফোনটা পুরো সুইচ অফ হয়ে আছে। শর্মীকে জানানো হয়নি। এখানে এমন লোড শেডিং থাকবে কে জানতো!
উর্বী তোয়ালেটা হাত থেকে যায়গা মতো রেখে রাওনাফের দিকে ঘুরে তাকায়। গায়ে তার বেগুনী রঙের একটা সুতি শাড়ি। ভেজা চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে তার। ফরসা গাল দুটো ঠান্ডায় গোলাপী আভা ধারণ করেছে। গভীর এবং সরল ঐ বাদামী চোখের চাহনি।
রাওনাফ চোখ সরিয়ে নিয়ে চোখ নামিয়ে রাখে। উর্বী অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলে,”বলুন! কি কাজ ছিলো এই মফস্বলে? কোনো সেমিনার?”
রাওনাফ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিভু নিভু জ্বলতে থাকা মোমবাতির দিকে তাকায়, সেও অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলে,
_মা বলেছে এখান থেকে তার পুত্রবধূ কে নিয়ে কাল সকালেই ঢাকায় ফিরে যেতে। তাই এলাম।
উর্বী তাকিয়ে আছে। রাওনাফের দৃষ্টি মোমবাতির দিকে। উর্বী একদৃষ্টে তাকিয়েই থাকে রাওনাফের দিকে। সামান্য একটা বাক্য শুনে তার এমন দুর্বল লাগছে কেনো, হাত পা কাঁপছে কেনো!
নিজের অনূভুতিকে পাত্তা না দিয়ে সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,”আপনাকে তো বলেই এসেছি, কিছুদিন স্পেস চাই। তা জানা স্বত্তেও এলেন কেনো?”
রাওনাফ এবার উর্বীর দিকে তাকায়। স্বাভাবিক এবং স্পষ্টভাবে বলে,
_বলেছো স্পেস চাও, দেবো। ডি’ভোর্স চাইলেও পাবে। তবে তার জন্য ঢাকা তোমাকে ফিরতেই হবে। এভাবে হুট করে তো কিছু হয়না মৃদুলা উর্বী তাইনা? আর তাছাড়া তোমাকে না নিয়ে গেলে আমাকে মেলা ঝামেলা পোহাতে হবে,তা তো নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো এতদিনে তাই না?
উর্বী ম্লান হাসে, একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
_ওওও তার মানে, যাতে আপনাকে কোনো ঝামেলা পোহাতে না হয় সেজন্য আপনি এসেছেন নিতে আমায়?
রাওনাফ এবার সরাসরি উর্বীর চোখের দিকে তাকায়, গলার স্বর যথেষ্ট নমনীয় রেখে প্রশ্ন করে,”কেনো তুমি কি আশা করো আমার আসার পেছনে অন্য কোনো কারন থাকুক? বিশেষ কোনো,ব্যক্তিগত কোনো কারন থাকুক?
উর্বী চোখ সরিয়ে নেয়। নামিয়ে নেয় চোখ। হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে শক্ত করে।
রাওনাফ ডাকে,”মৃদুলা উর্বী!”
_বলুন।
অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে বলে উর্বী।
_এদিকে তাকাও।
উর্বী তাকায় না। রাওনাফ বলে,”এতো দোটানায় কেনো ভুগছো উর্বী? তুমি কি বুঝতে পারছো না তুমি কি চাও?”
উর্বী চুপ করেই থাকে, হঠাৎ তার চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো দুফোটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে।
রাওনাফ সেদিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে হাত বাড়িয়ে সেই পানির ফোটা সে ছোঁয়। উর্বী নড়েচড়ে ওঠে।
রাওনাফ বলে,”চোখের পানি যদি কোনো কাজে লাগতো,যেমন ধরো কোনো ওষুধ বানাতে কাজে লাগতো তাহলে তুমি এতদিনে কোটিপতি হয়ে যেতে মৃদুলা উর্বী।”
উর্বী কিছু বলে না।
রাওনাফ বলতে থাকে,”ডি’ভো’র্স চাও? দিয়ে দেবো। তাতে কাঁ’দতে হয় এভাবে প্রতিদিন? দু’জনে বসে আলোচনা করার বিষয় এটা। একা একা রাতে ফুঁপিয়ে কাঁদার বিষয় না।”
উর্বী চেঁচিয়ে ওঠে,”আপনাকে আমি বলেছি আমি ডি’ভো’র্স চাই? আমি ডিভোর্সের জন্য কাঁদি? কেনো একই কথা বারবার বলছেন।!”
_আচ্ছা আচ্ছা। রিল্যাক্স! শান্ত হও। ডি’ভোর্স চাওনা। তার মানে সংসার করতে চাও তাইতো?
উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,
_কি জ্বালা। বলবে তো! হয় ডিভোর্স,নয় সংসার। যেকোনো একটা তো চাইতে হবে উর্বী!
উর্বী নিরবতা ভেঙে ফুঁপিয়ে ওঠে।
রাওনাফ মৃদু স্বরে বলে,”উর্বী। আমি বুঝতে পারছি তুমি কোথাও আটকে গিয়েছো। কোনো সমস্যা হচ্ছে তোমার। কোনো ভয়াবহ সমস্যা। যা থেকে তুমি ছাড়া পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছো। যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে হলে অবশ্যই কারো সাহায্য দরকার হয়। আমি কি তোমার সেই উপকারী বন্ধুটি হতে পারি? যার সাথে যেকোনো সমস্যা মন খুলে বলা যায়? সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে আমি নিয়মিত কথা বলি উর্বী। তুমি নিজে না চাইলে এই সমস্যা থেকে বের হতেই পারবে না।”
রাওনাফ ক্রন্দনরত উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে কথা গুলো বলে।
উর্বী কান্না থামিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। তারপর ধরা গলায় বলে,”আমি যদি বলি আমি আপনার সাথে সংসার করতে চাই। ওই বাড়িতে ফিরতে চাই তাহলে আপনি কি করবেন?”
_আমি তোমায় কাল সকালেই নিয়ে যাবো।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় রাওনাফ।
_আর যদি আপনি জানতে পারেন আপনি যাকে নিজে হাতে ধরে আপনার সংসারের ঘরনী করে নিয়ে গেছেন সে একটা অতি ফালতু,দুশ্চরিত্রা, ন’ষ্টা মেয়ে মানুষ তাহলে আপনি সেদিন কি করবেন?
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে কথাটি শুনে। উর্বী বলে ওঠে,
“কি হলো! চুপ হয়ে গেলেন কেনো! বলুন কি করবেন? তখনো কি নিজের জীবনের সাথে আপনি আমাকে জড়াতে চাইবেন? বলুন?”
রাওনাফ ম্লান হাসে, ঠান্ডা গলায় বলে,”আমার মনে হয় আজ থেকে পাঁচ মাস ১৩ দিন আগেই আমি একজন অতি ফালতু,ন’ষ্টা,দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে নিজের জীবন অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে জরিয়ে ফেলেছি, দ্বিতীয়বার আবার কিভাবে জড়াবো?”
উর্বী তাচ্ছিল্যর হাসি হাসে,”মজা ভাবছেন আপনি তাই না? আপনি যদি আমার অতীত জানতে পারেন তাহলে ভুলেও চাইবেন না আমায়। শুধুই ঘৃনা করবেন আমায়। থুতু ফেলবেন আমার নামে।”
রাওনাফ দীর্ঘসময় উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে ওঠে,
_আচ্ছা বলো তো তোমার অতীত। কখনো কাউকে ঘৃণা করিনি। এই ঘৃণার টেস্ট কি রকমের? স্বাদ নিতে চাচ্ছি আমি!
বলতে বলতে রাওনাফ বিছানায় দুহাত মাথার পেছনে দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে পরে। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
_ওও আরেকটা কথা। আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দাও প্লিজ। এটা তো ফুরিয়ে গেলো। অন্ধকারে তোমার অতীত শুনতে ভালো লাগবে না।
উর্বী কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখছে সে তার সামনে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে থাকা পুরুষটিকে।
চলমান……
#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২১
#Esrat_Ety
হু হু করে বাতাস বইছে বাইরে। অসময়ের বৃষ্টি বেশ গুছিয়েই তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিতে।
উর্বী একটা মোমবাতি জালিয়ে রাওনাফের কাছে, বিছানার পাশের টেবিলে রেখে দেয়। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে।
মোমবাতির আলোয় কাছে থেকে উর্বীর ফরসা গোল মুখটা সোনালী বর্ণের দেখাচ্ছে।
রাওনাফ একটা বালিশ টেনে নেয় নিজের হাতের নিচে, বেশ গুছিয়ে বসে আছে সে, তাকিয়ে আছে উর্বীর চোখের দিকে।
উর্বী রাওনাফের থেকে একটু দূরেই, মুখোমুখি হয়ে বসে।
তাকে অনেকটা শান্ত লাগছে। চোখ মুখ স্বাভাবিক। বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে।
উর্বী নীরাবতা ভেঙে বলা শুরু করে, “বিয়ের আগে আমার একজনের সাথে সম্পর্ক ছিলো। বহু বছরের সম্পর্ক। আমার কলেজ জীবনের শুরু থেকে। সিনিয়র ছিলো সে আমার। অপজিশন পার্টির একজন ফরমার মিনিস্টারের ছেলে। এজন্য তার অনেক ঠাট বাট ছিলো শহরে।
প্রনয় অত্যন্ত গভীর ছিলো। সময় যতো যেতে থাকলো, সম্পর্ক যতো পুরনো হতে থাকলো আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম সে একটু অস্বাভাবিক। আমাকে নিয়ে অতিরিক্ত ছিলো সবকিছু তার। প্রথম প্রথম বিষয়টা প্রেমিকের পাগলামি ভেবে মানিয়ে নিতাম, কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু অতিরিক্ত হয়ে উঠলো। সে স্বভাবে ছিলো বদরাগী,জেদী। এতটুকুই দোষ চোখে পরেছিলো শুরুতে। মানিয়ে নিয়েই অনুভূতি দেওয়া নেওয়া করেছি। কিন্তু একটা সময় আবিষ্কার করলাম মানুষটা খুবই ত্রুটিপূর্ণ। বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলের যত বদ গুণ থাকতে পারে প্রায় সবগুলো গুণই তার মধ্যে ছিলো। গুন্ডামি, নেশা করা, মারামারি। সবকিছুই করতো সে।
আমি সব মেনে নিয়েছিলাম। ভাবতাম সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, দিন দিন সে আরো উচ্ছন্নে যেতে থাকে। তার সাথে বাড়তে থাকে আমার প্রতি তার মানসিক অত্যাচার। প্রচুর পাগলামি করতো আমায় নিয়ে, ভালোবাসার নামে গলার কাটা হয়ে বিঁধে যাচ্ছিলো সে। যাকে উপড়ানোর ক্ষমতা আমার ছিলো না। না ছিলো মানিয়ে নেওয়ার।
ভাইয়া সব জানতে পেরে আমার ওপর ভীষণ ক্ষে’পে গেলেন। ভাইয়া ওকে শুরু থেকেই জানতো, ওর স্বভাব সম্পর্কে সবাই জানতো শুধু আমি অন্ধ ছিলাম। নিজের জীবনে অমানিশা নামিয়ে আনবার জন্যই আমি অন্ধ ছিলাম। একদিকে ওকে শোধরাতে পারিনি,অন্যদিকে ভাইয়া আমার জন্য ছেলে দেখতে লাগলেন।
একটা সময় আমি পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়লাম ওর মানসিক টর্চার নিতে না পেরে। আমার স্বাধীনতা একেবারে কব্জা করে নিয়ে বসেছিলো।
তারপর অনেক ভেবে ওর সাথে বিচ্ছেদ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। স্নিগ্ধ একটা শুরু থেকে তিক্ত একটা বিচ্ছেদ। অনেকটা মানসিক শক্তি যোগার করে সিদ্ধান্তটা নিলাম। ওকে বললাম , ভালো করে বুঝিয়ে বললাম আমি এই সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছি না। ও খুবই ঠাণ্ডা মাথায় শুনলো। আমাকে বললো আমার সাথে দেখা করতে চায়। একটা সুযোগ চায় আলোচনা করার।
এবং…..”
এই পর্যন্ত এসে উর্বীর গলা কাঁপতে শুরু করে।
রাওনাফ উর্বীর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। সে দেখছে উর্বী কান্না আটকে রাখার কঠিন প্রচেষ্টা করছে।
উর্বী একটা নিঃশ্বাস নিয়ে কান্নাটা দমিয়ে ফেলে,তারপর বলতে শুরু করে,”সে তো আমাকে ছাড়বে না। ভালোবাসা নামে জেদ ছিলাম তো আমি তার। যখন দেখলো কিছুতেই কিছু হবে না, আমি বিচ্ছেদ ঘটাবোই,তারপর সে আমাকে আঁটকে রাখার একটা অভিনব উপায় বের করলো। হি টাচড্ মি উইদাউট মাই কনসেন্ট!”
উর্বী তুমুল প্রচেষ্টা করছে না কাঁদার। থেমে থেমে বলতে থাকে,”শত পাগলামি করলেও কখনো আমার গাঁয়ে হাত না দেওয়া ছেলেটা আমাকে আটকে রাখতে তার নিকৃষ্ট রুপটা দেখালো। তার মনে হয়েছিল,মন না আটকাতে পারলে কি হবে! শরীর আটকে দেবো!
এ্যান্ড হি রেইপড মি!”
উর্বী ফুঁপিয়ে ওঠে। রাওনাফ একই ভাবে দেখছে উর্বীকে। উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়। চোখের পানি গড়িয়ে পরতেই বলতে থাকে,”এবং সে আমাকে বললো,”এখন কিভাবে আমাকে ছাড়িস আমি দেখবো!”
চার বছরের ভালোবাসা হিংস্রতা হয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে বলেছিলো এই কথাটা জানেন।”
বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেও যখন পারলো না তখন হাল ছেড়ে দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ করতে থাকে কিছুক্ষণ। অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে বলতে থাকে,”তারপর আমাকে বললো, তৈরি থাকতে। বিয়ে করবে আমাকে। কিন্তু আমি তো একজন রে’পিস্টকে বিয়ে করবো না। সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম।
মানসিক ভাবে ভেঙে পরলেও কাউকে কিছু বুঝতে দিইনি বাড়ির। ভাইয়া আমার জন্য ছেলে দেখতে লাগলেন। দিন যায়, ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম আমি সন্তানসম্ভবা।”
উর্বী থামে। হাপাচ্ছে সে। মাথা নিচু করে রেখেছে সে এখন। কাঁদছে না, কিন্তু কথাগুলো বলছে খুবই কষ্টে। কন্ঠনালী থেকে যেনো বেরোতে চাইছে না।
রাওনাফ ঐ মুখটার দিকে কোনো এক অজানা কারনে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ সরিয়ে উর্বীর হাতের দিকে তাকায়, হাত দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে রেখেছে উর্বী।
“পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিলো যেন। কি করবো! কি হবে! কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তারপর নিজের মনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাধ্য হয়ে, নিরুপায় হয়ে ঐ হীন মানুষটার কাছে বলতে গিয়েছিলাম “আমাকে বিয়ে করো।”
কিন্তু নিয়তি আমার সাথে এখানেও তামাশা করলো। খবর পেলাম তাকে পুলিশ এ্যারেস্ট করেছে। তার নামে জোরা খুন মামলা সহ মোট তিনটা চার্জ লাগানো হয়েছে।
আমি অসহায়ের মতো তরপাতে থাকি।
হাজতে গিয়েছিলাম তার সাথে দেখা করতে। দেখা করতে পারি নি।
বাড়িতে যখন জানালাম আমার কথা। মা ঘে’ন্নায় সু’ই’সাইড করতে গেলো। ভাইয়া নিশ্চুপ হয়ে রইলো। গোটা পৃথিবী আমার কাছে মিথ্যে মনে হতে লাগলো। জানেন সবসময়ই আমার ইচ্ছে করতো আমি ম’রে যাই, কিন্তু আমার অত সাহস নেই। আমি ভীতু। আমি ম’রতে ভীষণ ভ’য় পাই।
খবর পেলাম তাকে কেরানীগঞ্জ শিফট করেছে। সাথে দশ বছরের জেল। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হলো আমার কিছু আত্মীয় স্বজন, জীবনটা আমার ন’রক করে ফেলেছিলো। কোনোভাবে আমার প্রেগ’ন্যা’ন্সির খবরটা ছড়িয়ে গেলো। বাড়ির কেউ কোথাও বেরোতে পারতো না।
তখন আমি ঠান্ডা মাথায় পৃথিবীর সবথেকে নি’কৃষ্ট কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এ্যা’বর্শন করে ফেললাম। মে’রে দিলাম আমি।”
শেষের বাক্যটা বলে উর্বী কান্নায় ভেঙে পড়ে। শরীর কাঁপিয়ে কাঁদছে সে। বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে অদ্ভুত শোনাচ্ছে সে কান্না।
রাওনাফ ফ্যালফ্যাল করে দেখছে উর্বীকে। একবার ভাবলো সে বলবে,”বুঝেছি পুরোটা। আর বলতে হবে না!”
কিন্তু সে বললো না।
উর্বী হু হু করে কাঁদছে। মোমবাতির আলোয় তার সে চোখের পানি চিকচিক করছে।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”জানেন। আমি না চাইনি আমার এই নষ্ট জীবনটা কোনো ভালো, নিষ্পাপ জীবনের সাথে জ’ড়াতে। একেবারেই চাইনি। একা একা বেশ চলে যেতো জীবনটা। আমি শুরু থেকেই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু বাড়ির মানুষগুলো ! তারা আর মানলো কই। তার ওপর উপমার বয়স বেড়ে যাচ্ছিলো! পাত্রপক্ষের কাছে উপমার চরিত্রের চাইতে আমার বিয়ে নিয়ে বেশি মাথাব্যথা ছিলো। উপমার সব গুণ ছাপিয়ে যেতে থাকলো আমার কলঙ্কের দোষে। জেদ করে ঠেলতে ঠেলতে ত্রিশের কোঠায় এনেছিলাম ধূসর রঙের এই জীবনটাকে। আর পারিনি। ভাবলাম আবার একটু নিজের জীবনটাকে নিয়ে খেলে দেখি।
যখন সামিউলের সাথে বিয়ের দিন বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। আমি তখন খুব হেসেছি। এটা ভেবে যে,কারো জীবন নষ্ট হবে না। কিন্তু দেখুন, শেষমেষ আপনি জরিয়ে গেলেন।”
উর্বী থেমে যায়, তার গাল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পরছে,ধীর গতিতে, যেনো তার কান্নাগুলোও এখন ক্লান্ত। সে একহাত দিয়ে বিছানার চাদর খামছে ধরে বসে আছে।
খানিক বাদে আবারও বলতে শুরু করে,” এই পাঁচ মাসে বিয়েটা আপনার কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত, চাপিয়ে দেওয়াই রয়ে গিয়েছে কি না জানি না। তবে আমার কাছে না থাকেনি জানেন? জানিনা কি অদৃশ্য শক্তি রয়েছে ঐ একটা কাগজের। যে কিনা মানুষের অনূভুতি প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। রোজ আপনি এলে আপনাকে এক কাপ কফি এগিয়ে দেওয়া, আমি ঘুমিয়ে থাকলে আমার গায়ে আপনার চাদর টেনে দেওয়া,প্রতিদিন সময় করে আমীরুনকে দিয়ে আমার জন্য একগ্লাস দুধ পাঠানোর নিয়ম, কিংবা আপনার বাচ্চাদের জন্য আগ বাড়িয়ে আমার কনসার্ন দেখানো। এগুলো আমার কাছে,আমার চোখে শুধুমাত্র দায়বদ্ধতা হয়েই থাকেনি। অন্যকিছু হয়ে গিয়েছে।
বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আপনার সাথে কাটানো আমার সব মুহুর্ত আমার কাছে বিশুদ্ধ স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমি খুব শান্তি পেয়েছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। স্বামী স্ত্রী না হতে পারলেও আমি এটা ভেবে শান্তি পাবো যে আমি একজন অতি ভালো লোকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। যার যোগ্য আমি না।
ওই বাড়িটা আমায় খুব শান্তি দিয়েছে,ওবাড়ির প্রতিটা ইট আমায় খুব শান্তি দিয়েছে। আমি চির কৃতজ্ঞ।
উর্বী মুখে আঁচল গুজে কাঁদছে। রাওনাফ এক মনে উর্বীকে কাঁদতে দেখছে। তার কোনো ভাবান্তর নেই।
পুনরায় দম নিয়ে উর্বী বলে, “আপনি কাল চলে যান,দয়া করে চলে যান। মায়ের সাথে ফোনে আমি কথা বলে নেবো। করবে না বকাবকি আপনাকে। আপনি ভাবতেও পারবেন না আমার কতটা শান্তি লাগছে এখন আপনাকে সবটা বলে। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ এখানে আসার জন্য।”
এবার হাঁটুতে মাথা রেখে উর্বী কাঁদতে থাকে। কেঁদে কেঁদেই বলে,”আমি ওবাড়ির প্রত্যেকটা লোককে মিস করবো। আপনাকে সবথেকে বেশি মিস করবো ডক্টর খান।”
উর্বীর খুবই দুর্বল লাগছে এখন, শরীর ভেঙে আসছে, সে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার এতো খারাপ লাগছে কেনো। সে কি মরে যাচ্ছে!
রাওনাফ উর্বীর অদ্ভুত সেসব আচরন দেখতে থাকে। গলাকাটা মুরগির মতো তড়পাচ্ছে।
“ধীরে ধীরে কিভাবে কিভাবে যেনো আমি আপনার মায়ায় পরে যাচ্ছিলাম। মনের ভীতর একটা সুপ্ত বাসনা জেগে উঠলো আপনার সাথে সংসার করার। কিন্তু তা আর হলো না, আমি এসব থেকে কখনোই বের হতেই পারবো না,বরং আপনার জীবনটা ও নোংরা করে দেবো।”
একটু থেমে উর্বী আবারও বলে ওঠে,”সবার মতো আপনিও প্লিজ এখন আমাকে এই প্রশ্ন করবেন না যে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ছিলো,আমি কোন সাহসে,কোন ভরসাতে একটা পুরুষের কাছে গিয়েছিলাম বোকার মতো। না গেলে তো এত বড় সর্বনাশ হতোই না আমার। করবেন না এমন প্রশ্ন। এর ব্যখ্যা তেইশের উর্বী দিতে পারেনি,ত্রিশের উর্বীও দিতে পারবে না। আমি শুধু জানি আমার সর্বনাশ হয়েছে। এটুকুই জানি।”
উর্বী থেমে যায়, তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রাওনাফ এবার উঠে আসে।
“উর্বী কি হয়েছে? তোমার কি হয়েছে?”
উর্বী তার জবাব দেয়না, বিড়বিড় করে বলতে থাকে,”আপনি চলে যান, এখান থেকে প্লিজ চলে যান। আমি আর দুর্বল হতে চাই না।”
“আচ্ছা সেটা দেখা যাবে। তুমি ওঠো। ঠিক হয়ে শুয়ে পরো। এখন ঘুমাও।”
উর্বী ওঠে না। কাঁদছে।
রাওনাফ উর্বীর হাত ধরে তাকে উঠানোর জন্য। উর্বী রাওনাফের হাত সরিয়ে দেয়,”আমাকে ধরবেন না দয়া করে। আপনার হাত নোংরা হবে।”
রাওনাফ উর্বীকে বলে,”আচ্ছা ধরবো না। শান্ত হও।”
উর্বী শান্ত হয়না। কাঁদতে থাকে। উন্মাদের মতো কাঁদতে থাকে বিছানার চাদর খামচে ধরে। রাওনাফ তাকে দেখতে থাকে অপলক।
দীর্ঘসময় পরে চুপচাপ হয়ে যায় উর্বী। সে না চাইতেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই হিং’স্রতার দৃশ্যটি। উর্বী ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। সে মনে করতে চায়না। দেখতেই চায়না সেই দৃশ্যটা আবারও। কিন্তু সে দেখে ফেলে।
“উচ্ছাস চুপচাপ পায়ের ওপর পা তুলে ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি উর্বীর মুখের দিকে। উচ্ছাসের চোখ দেখে উর্বী আজ কিছুই পড়তে পারছে না। শীতল দৃষ্টি। ঐ দু’চোখে না আছে রাগ,না আছে অন্যকোনো অনুভূতি। কেমন শান্ত হয়ে বসে আছে। অথচ যে উচ্ছাসকে উর্বী চেনে,এতক্ষণে সবকিছু ভাঙচুর করে ফেলার কথা।
উর্বী মাথা নিচু করে বলে,”সম্ভব না আর সম্পর্ক কনটিনিউ করা। তুমি তো কখনও শোধরাবে না। তারচেয়ে তুমি তোমার মতো থাকো। আমি মুক্তি চাই।”
উচ্ছাস ম্লান হাসে উর্বীর কথা শুনে, নীরবতা ভেঙে বলে,”মুক্তি চাও?”
_হ্যা। ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করো।
_কিন্তু উচ্ছাস তো ভুলের শা’স্তি দেয়! ক্ষমা নয়।
উর্বী মাথা তুলে তাকায়। উচ্ছাস বলতে থাকে,”আমাকে ভালোবেসেই ভুল করেছো। মাফ করেছি । আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েও ভুল করেছো। মাফ করেছি। তবে এখন যেটা করতে চাইছো,মানে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বললে। এজন্য তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে! কোনো মাফ হবে না।”
উর্বী অবাক চোখে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। উচ্ছাস উঠে দাঁড়ায়। দরজা বন্ধ করে উর্বীর দিকে তাকায়, তার চোখ মুখ ভাবলেশহীন। উর্বী তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে,কাঁপা গলায় বলে,”দরজা আটকালে কেনো!”
উচ্ছাস কোনো কথার জবাব না দিয়ে উর্বীর সামনে এসে দাঁড়ায়। এক টানে উর্বীর ওড়না ফেলে দিয়ে উর্বীকে ধাক্কা দিয়ে ডিভানে ফেলে দেয়। হতভম্ব,আহত, শংকিত উর্বী নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই উচ্ছাস এসে উর্বীকে চেপে ধরে ডিভানের সাথে। উর্বীর গলা থেকে আর্তনাদের মতো আওয়াজ বের হওয়ার আগেই উচ্ছাস তার মুখ চেপে ধরে। উর্বী কাঁদছে। উচ্ছাস দীর্ঘসময় উর্বীর সে কান্না দেখতে থাকে, তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে না পাখি, আমার সহ্য হয়না।”
উর্বী তড়পাতে থাকে। শরীরটা ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে যেতে শুরু করে। উর্বীর মনে হচ্ছিলো উর্বী মরে যাচ্ছে,তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।”
আর কিছু কল্পনা করতে পারে না উর্বী। শুধু নিশ্চুপ কেঁদে যায়। রাওনাফকেও সে কিছু বলে না আর ।
কাঁদতে কাঁদতে একসময় উর্বী ঘুমিয়ে পরে। চোখের পানি গালে শুকিয়ে লেপ্টে আছে। মোমবাতি ফুরিয়ে যাচ্ছে। মোমবাতির সে ক্ষীণ আলোয় উর্বীর মুখটা চিনামাটির একটি বিবর্ণ পুতুলের মতো লাগছে।
রাওনাফ উঠে উর্বীর গায়ে চাদর টেনে দিয়ে আরেকটা মোমবাতি জ্বেলে নেয়। তারপর চুপচাপ জেগে বসে থাকে যতক্ষন ঐ মোমবাতিটা আলো দিচ্ছিলো ততক্ষন। কাছের মসজিদে ফজরের আযান দিয়ে দেয়।
উঠে ওযু করে সালাত আদায় করে সেও বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেয়, পরপর রাওনাফের চোখ দুটোও লেগে যায়।
সদর দরজার বাইরে থেকে রেজাউল কবির আর তহুরা দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। নুরুন্নাহারের বাড়ি থেকে শুধুমাত্র সে, তহুরা আর লুৎফুন্নাহার ফিরে এসেছে সকাল সকাল। বাকিরা বিকেলে আসবে। কিন্তু উর্বী দরজা খুলছে না দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পরে রেজাউল। তহুরার দিকে তাকিয়ে বলে,”জ্ঞান হারিয়ে ফেললো নাকি আবার! পেছনের দরজা বাইরে থেকে লক করা ছিলো না? যাও গিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে দাও।”
তহুরা মাথা নাড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বাড়ির পেছনের দরজার কাছে চলে যায়।
রাওনাফের ঘুম ভাঙ্গে রেজাউলের গলা পেয়ে। তহুরা অনবরত উর্বীর রুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে।
“এই উর্বী। দরজা খোল। বেলা এগারোটা বেজে গেছে। এতবেলা অবধি ঘুমাচ্ছিস কেনো! এই উর্বী।”
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। নিজে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
লুৎফুন্নাহার চমকে ওঠেন তাঁর মেয়ে জামাইকে দেখে।
তহুরা আর রেজাউল একে অপরের দিকে তাকায়।
রাওনাফ তাদের তাকিয়ে থাকার ধরন দেখে বিব্রত বোধ করতে থাকে,কয়েকমুহুর্ত পরে হাসি দিয়ে তাদের সালাম দেয়,”আসসালামুয়ালাইকুম। আপনারা ভালো আছেন?”
লুৎফুন্নাহার প্রচন্ড খুশি হয়ে যান। তার মেয়ে জামাই মেয়ের কাছে এসেছে,এটা তার কাছে অনেক আনন্দের একটি ব্যাপার।
উর্বী তখনো ঘুমাচ্ছে।
***
হাসাহাসির শব্দে উর্বীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। বসার ঘর থেকে আসছে। রেজাউল কবিরের গলা। ভাইয়া কার সাথে হাসছে?
উর্বী উঠে বসতে যেয়ে টের পায় তার মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। কাদলেই তার এমন হয়। অসহ্য যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম,তবু সে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়ায়। রাওনাফকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। টেবিলের ওপর তার ফোন,ওয়ালেট আর ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মানে সে চলে যায়নি।
উর্বী ধীরপায়ে হেটে বসার ঘরে যায়। রাওনাফ তার ভাইয়ার সাথে হেসে হেসে গল্প করছে। উর্বী অবাক হয়ে যায়। রাওনাফকে সে এভাবে কথা বলতে কখনোই দেখেনি। আড্ডা বেশ জমে গেছে মনে হচ্ছে।
উর্বীকে দেখে তার ভাইয়া বলে,”তুই উঠেছিস। যা হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যা। দেখ তোর ভাবীর নাস্তা বানানো হয়েছে কি না।”
উর্বী রাওনাফের দিকে চায়। রাওনাফ তার দিকে তাকায় না,সে মাথা নিচু করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
রান্নাঘরে তহুরা পরোটা বেলছে , চুলোয় বসিয়েছে মুরগী ভুনা। লুৎফুন্নাহার পিঠা বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ তাকে খুবই আনন্দিত দেখাচ্ছে। তার মেয়ে জামাই এসেছে। এর থেকে আনন্দের বিষয় তার কাছে আর কি হতে পারে !
উর্বী গিয়ে তহুরার পাশে দাঁড়ায় । তহুরা মাথা ঘুরিয়ে উর্বীকে দেখে বলে,”মাংসটা একটু নেড়ে দে তো,তলায় লেগে যাবে।”
উর্বী মাংস নেড়ে তার দিকে তাকায়। বলে,
“কি ব্যাপার! খুশি চোখ মুখ থেকে ফেটে পরছে যে!”
_পরবে না? তুই কি বুঝবি!
উর্বী শুকনো হাসি হাসে।
লুৎফুন্নাহার বলে,”আমি তো ভেবেছিলাম জামাইটা গোমরা মুখো পেয়েছি। কথাই বলতে জানে না। কিন্তু আমার ধারনা ভুল। কি সুন্দর গল্প করছে রেজাউলের সাথে! মন ভরে যায় দেখে। ”
উর্বী তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে,তার মা খুশিতে বাচ্চা বাচ্চা গলায় কথা বলছে।
লুৎফুন্নাহার বলতে থাকে,”কতটা বিনয়ী, সভ্য শান্ত। এতো সম্মান করে আমাদের,ভাবা যায় ! তোর উচ্ছাসের মতো বেয়াদব আর উশৃঙ্খল নয়,এর পায়ের নখের যোগ্যও নয় ওই কু’লাঙ্গার।”
উর্বী তার মায়ের দিকে তাকায়। লুৎফুন্নাহার নিজের জিভ কাটে। মুখ ফসকে এসব কেনো বলতে গেলো মেয়েকে!
সে দ্রুত প্রসঙ্গ পালটে বলে,”জামাই রাতে কটায় এসেছে রে?”
_সারে দশটা নাগাদ ।
_কি দিয়েছিলি খেতে?
_ডিম দিয়ে ভাত ভেজে।
লুৎফুন্নাহার মুখ দিয়ে “ওহহহ” বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এতো বড় একজন ডাক্তার,এতো টাকা যার। সে নতুন শশুরবাড়িতে এসে বাসি ভাত ভাজা খেয়েছে! এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে।
লুৎফুন্নাহারের লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।
উর্বী মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,” বড়লোক জামাইকে ভাত ভাজি খাইয়েছি দেখে লজ্জা পাচ্ছো? উনি তেমন মানুষ নয়। বাদ দাও।”
_জানি তো, জামাইটা পেয়েছি সেরা! ওবাড়ির সবাই সেরা। কপাল তোর বুঝলি। হ্যা রে! ছেলেমেয়ে তিনটা তোকে পছন্দ করে? জালায় না তো তোকে?
_নাহ,ওরাও ওদের বাবার মতো।
লুৎফুন্নাহার খুব খুশি হয়। বলে,”হ্যা। দেখেছি তো। ছোটো টা খুব মিষ্টি। ওকে আমার ভালোবাসা দিস গিয়ে। আচ্ছা ভালো কথা, আমি কি পিঠা বানিয়ে দেবো কিছু? ঝাল পিঠা? যাওয়ার সময় নিয়ে যাবি ওবাড়ির জন্য?
_কোথায় যাবো আমি?
উর্বী মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
তহুরা অবাক হয়ে তার ননদের দিকে তাকায়, বলে,”তোর বাড়িতে, আবার কোথায়?”
_আমি কোথাও যাচ্ছি না ভাবী। আর তোমার রাওনাফ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখো সে পিঠা নিয়ে যাবে কি না।
কথাটি বলে উর্বী রান্নাঘর থেকে বের হয়। তহুরা আর লুৎফুন্নাহার একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ।
***
নাস্তা সেরে রাওনাফ রুমে ঢোকে। উর্বী তার দিকে একবার তাকিয়ে বলে,”আপনার জামা কাপড় শুকিয়ে ইস্ত্রি করে দিয়েছি।”
রাওনাফ কিছু না বলে ফোনটা উর্বীর দিকে দিয়ে বলে,”মা ! কথা বলো।”
উর্বী কি করবে বুঝতে পারে না । সে ফোনটা নেয়। ভিডিও কলে রওশান আরা। রওশান আরা কটমট দৃষ্টি দিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী সালাম দেয়। রওশান আরা সালামের জবাব দিয়ে বলে,
” আগের বার যে তেঁতুল নিয়ে এসেছিলে ও বাড়ি থেকে সেটা ফুরিয়ে গেছে। তোমার ছোটো জা,পোয়াতি মানুষ খেতে চাইছে খুব। নিয়ে এসো । আর হ্যা শোনো, বেয়ানকে বলো শুটকি দিয়ে দিতে আমার জন্য। আর পিঠাও নিয়ে এসো। আর হ্যা, রাওনাফের আবার রাজশাহী যেতে হবে,ওর সাথে পারলে আজই ফিরে আসো। তোমার ননদেরাও এসেছে। বাপের বাড়ি বেরাতে এসে এখন কি তারা রান্না করে খাবে?”
উর্বী চুপ করে তাকিয়ে থাকে।
রওশান আরা বলে,”তোমার শর্মী খুব ক্ষেপে আছে তোমার উপরে। কিভাবে তার রাগ ভাঙাবে জানি না। এখন রাখো,আমার ছেলের যেনো কোনো অযত্ন না হয়।”
রওশান আরা ফোন কেটে দেয়। উর্বীর খুব হাসি পায় তার শাশুড়ির রাগী রাগী হওয়ার ভান দেখলে।
রাওনাফ উর্বীর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলে, ” আমরা তাহলে দুপুরে খেয়েই রওনা দেই! কি বলো!”
উর্বী অবাক হয়ে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে নিশ্চুপ।
রাওনাফ উর্বীর দিকে একটু এগিয়ে আসে।
“কিছু বোলছো না যে!
উর্বী বলে,”আপনি কিন্তু জেনে শুনে ভুল করছেন,আমি বারবার বলছি আপনাকে!”
রাওনাফ ঘুরে উর্বীর বিছানায় বসে পরে।
উর্বী বলে,”ভুল করছেন আপনি”
রাওনাফ বলতে থাকে,”সমস্যা কোথায়? কেনো নিজেকে নিচু করে দেখছো? দ্যা প্রবলেম ইজ,ইউ আর নট ভার্জিন, রাইট? সো হোয়্যাট! আমিও তো ভার্জিন নই। তিনটা বাচ্চার বাবা আমি!”
উর্বী ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে,”মজা করছেন আপনি?”
_না।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় রাওনাফ। তারপর বলে ওঠে,”শরীর কখনো নোংরা হয়না মৃদুলা উর্বী। যেটা হয় সেটা আমাদের মন আর মস্তিষ্ক। তোমার কি মনে হয়? আমি গতকাল রাতে তোমার অতীত জানবার জন্য তোমার অতীত জানতে চেয়েছি? না, আমি তোমার অতীত জানতে চেয়েছি যাতে তুমি বলতে পারো। আমার যা জানার, বোঝার, আমি আমীরুনের থেকে জেনে নিয়েছি।
উর্বী চুপ। রাওনাফ আবার বলে ওঠে,”গুছিয়ে নাও। ঐ বাড়ির কিছু মানুষ তোমাকে মিস করছে। ঐ বাড়ির ইট গুলো, যারা তোমাকে স্বস্তি দিয়েছে তারা তোমাকে মিস করছে, হয়তোবা তোমাকে ওদের প্রয়োজন।”
_আর আপনার?
উর্বী তাকিয়ে আছে রাওনাফের দিকে উত্তরের অপেক্ষায়।
রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ধীরে তবে স্পষ্ট করে বলে,”হয়তোবা আমারো তোমাকে প্রয়োজন মৃদুলা উর্বী। হয়তোবা সম্পর্ক টা কেবল কফির কাপ এগিয়ে দেওয়া,গায়ে চাদর টেনে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।”
উর্বী কিছুক্ষণ রাওনাফের মুখপানে চেয়ে থেকে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাওনাফ শুয়ে পরে। তার দু’চোখ ঘুমে জরিয়ে যাচ্ছে। কাল রাত ঘুম হয়নি তাই।
উর্বী দৌড়ে সোজা কলঘরে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে সে কাঁদতে থাকে।
পেছন থেকে তহুরা উর্বীর কাঁধে হাত রাখে।
উর্বী তাকায়।
তহুরা চিন্তিত হয়ে বলে,”কাঁদছিস কেনো?”
উর্বী নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”শুটকি বানিয়েছিলে না? দিয়ে দিও। আমার শাশুড়ি খেতে চেয়েছেন। আর ভাইয়াকে বলো গাছ থেকে লোক খাটিয়ে পাকা তেঁতুল তুলে আনতে। ছোটো জা’য়ের জন্য নেবো। আমাদের বড় মোরগটা জবাই করে রান্না করে দিও ভাবী। আমার ননদদের বাচ্চাদের জন্য নিয়ে যাবো। আর হ্যা, ভাইয়াকে বলো লোকজন দিয়ে পুকুর থেকে গলদা চিংড়ি ধরতে, তোমার রাওনাফ ভাইয়ের খুব পছন্দ শুনেছি। দুপুরে খেয়ে যাবো আমরা।”
তহুরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তহুরাকে জরিয়ে ধরে,”আমি, আমি ওনার সাথে যেতে চাই ভাবী। ভাবী আমি ওনার সাথে থাকতে চাই, সংসার করতে চাই ওনার সাথে।”
তহুরা উর্বীর মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সে মনে মনে আল্লাহকে বলে,”আল্লাহ! তুমি এই মেয়েটাকে খুব সুখী রাখো,খুব সুখী!”
চলমান….