#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৮
#Esrat_Ety
সাব ইন্সপেক্টর রাওনাফকে বলছে, “আপনার স্ত্রীকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। একটা খু’ন হয়ে গিয়েছে। আমাদের সাথে কোঅপারেট করুন।”
রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে উর্বীকে দেখে। একটা বেঞ্চিতে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সে পরে আছে নিস্তেজ হয়ে। লামিয়া তাকে ধরে রেখেছে। সাব ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে রাওনাফ বলে,”আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমরা অন্য রিসোর্টে শিফট হচ্ছি। আমার স্ত্রীর মানসিক অবস্থা আপনাদের বুঝতে হবে।”
_তা বুঝতে পেরেছি কিন্তু আপনার স্ত্রীর স্টেটমেন্ট না নিয়ে এই কেসে আগানো সম্ভব না। আমরা পুরো হোটেল তন্যতন্য করে খুঁজেছি কোথাও কোনো প্রাথমিক এভিডেন্স নেই। লা’শেরও কোনো প্রাথমিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।
_আমার স্ত্রীকে আগে কিছু সময় দিন। আমার নাম্বার রাখুন, আমি নিজে আপনাদের কাছে আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাবো।
অফিসার রাওনাফের থেকে তার নাম্বার নিয়ে নেয়।
লামিয়া উর্বীকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। সবাই উর্বীর দিকে দরদ মাখা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। উর্বী গাড়িতে উঠেই চোখ বন্ধ করে থাকে। তার চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে। রাওনাফ বারবার উর্বীর দিকে তাকায়।
সবার উর্বীর জন্য খারাপ লাগছে। জাহাঙ্গীর নিচু স্বরে বলে ওঠে,”ধূরর! এই সেন্টমার্টিনে আসাটা একেবারেই উচিৎ হয়নি!”
মিতা উর্বীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”একটু পানি খাবে উর্বী?”
উর্বী কোনো কথা বলে না। আশিক বলে ওঠে,”আহা ভাবি। থাক।বেচারী আগে একটু ঠিক হয়ে নিক।”
রাত তিনটায় তারা কাছেই অন্য হোটেলে শিফট করে। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে উর্বী দেখলো উর্বীর শরীরে কোনো জোর নেই। সে দাঁড়াতে পারছে না। এক পা মাটিতে দিতেই সে মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়। সবার আগে রাওনাফ গিয়ে উর্বীকে ধরে। তারপর ধরে ধরে উর্বীকে নিয়ে হোটেলে ঢোকে।
রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে সবাই যে যার ঘরে চলে যায়।
রুমে ঢুকে রাওনাফ উর্বীকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। রুমবয় তাদের লাগেজ রুমে দিয়ে চলে যায়।
রাওনাফ দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর উর্বীর সামনে এসে বসে বলে,”খিদে পেয়েছে উর্বী? খাবার আনিয়ে দেবো?”
উর্বী কোনো কথা বলে না।
রাওনাফ বলে,”কোনো ভয় নেই। আমরা খুব শিগগিরই বাড়ি যাবো।”
উর্বী বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত। রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
_ঠিকাছে। খেতে হবে না। তুমি ঘুমোও।
রাওনাফ উর্বীর বালিশ ঠিক করে দিয়ে উর্বীকে ঘুমাতে বলে। উর্বী একইভাবে চুপচাপ বসে আছে।
এবার রাওনাফ উর্বীর মুখের দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে জড়তা কাটিয়ে উর্বীকে ধরে শুইয়ে দেয়।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ উর্বীর গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বলে,”ভয়ের কিছুই নেই। এটা অন্য হোটেল। আমি আছি। আমি জেগেই আছি। তুমি ঘুমাও।”
কথাটি বলে রাওনাফ চলে যেতে নিলে উর্বী রাওনাফের একটা হাত ধরে ফেলে।
রাওনাফ অবাক হয়ে ঘুরে তাকায়, উর্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”কিছু বলবে?”
উর্বী অস্পষ্ট স্বরে বলে,”আপনি দূরে যাবেন না প্লিজ। এখানেই বসে থাকুন।”
রাওনাফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বসে পরে।
***
উর্বী চোখ মেলে দেখে রাওনাফ তার পাশেই বিছানায় বসে আছে। বসে বসে খাটে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
উর্বী নড়েচড়ে উঠতে চায়। মাথাটা অসহ্য যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।
রাওনাফ উর্বীর অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ মেলে তাকায়। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“উঠে গিয়েছো তুমি !”
উর্বী মাথায় হাত চেপে বসে থাকে।
“কি হয়েছে,মাথা ব্যাথা করছে?”
রাওনাফ উর্বীকে তাকিয়ে দেখছে।
উর্বী উত্তর না দিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। তার মুখে কথা নেই।
রাওনাফ উর্বীর হাত ছুঁয়ে ডাকে,”মৃদুলা উর্বী!”
উর্বী তাকায়।
রাওনাফ বলে,”মুখ হাত ধুয়ে নাও। আমি খাবার অর্ডার দিচ্ছি। খেয়ে মাথা ব্যাথার ঔষধ খেয়ে নেবে।”
উর্বী গাঁয়ের চাদর সরিয়ে ধীরে ধীরে খাট থেকে নামতে যায়। তার শরীরে একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই। কাল দুপুরের পর থেকে তো কিছুই মুখে দেয়নি।
রাওনাফও উঠে দাঁড়ায়। উর্বী বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পরে যায়। রাওনাফ এসে ধরে।
উর্বীর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে রাওনাফ বলে,”তোমাকে তো একেবারেই দুর্বল লাগছে! ”
_আমি ঠিক আছি ! শুধু মাথাটা চ’ক্কর দিয়েছে।
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে উর্বী।
_এসো তোমাকে ওয়াশ রুম পর্যন্ত এগিয়ে দেই।
_লাগবে না।আমি পারবো।
_পারবে না। এসো।
রাওনাফ উর্বীকে জোর করে ওয়াশ রুম পর্যন্ত দিয়ে আসে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে সে আর রাওনাফ যেনো সাধারণ কোনো দম্পতি যাদের মধ্যে ভালোবাসার কোনো ঘাটতি নেই।
নাস্তা করে উর্বী একটু শক্তি ফিরে পায়। রাওনাফ একটা ওষুধ উর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা খাও,মাথা ব্যাথা থাকবে না !”
উর্বী ওষুধটা নিয়ে খায়।
রাওনাফ তাকিয়ে আছে। উর্বী ওষুধ খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
রাওনাফ খাবারের প্লেট সরিয়ে উর্বীর গায়ে একটা চাদর টেনে দেয়। তারপর জানালার পর্দা টেনে দিয়ে সে রুমের বাইরে চলে যায়। উর্বী অপলক দৃষ্টিতে রাওনাফের যাওয়া দেখে ।
কিছুক্ষণ পরে রাওনাফ ফিরে আসে। তার হাতে একটা রাবিং বামের কৌটো। রুমে ঢুকে সে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয় আবার। উর্বী চোখ বন্ধ করে ছিলো,সে উর্বীর দিকে তাকিয়ে ডাকে,
“উর্বী!”
উর্বী “হু” বলে মৃদু আওয়াজ করে।
_ঘুমাচ্ছো?
_না, কিছু বলবেন?
_এটা কপালে লাগিয়ে নিলে খুব ভালো হতো। একটু উঠে লাগিয়ে নেবে কষ্ট করে?
_কি?
_রাবিং বাম।
উর্বী উঠে বসে।
রাওনাফ বলে,”উর্বী!”
_বলুন।
_আজ বিকেলে পুলিশ আসবে তোমায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। তারা বলেছে তুমি ঠিক হলে ফোন দিতে তাদের।
উর্বী চুপ করে থেকে বলে, “কি বলবো?”
_যা হয়েছে,তুমি যা যা দেখেছো তাই বলবে। কোনো প্যানিক হবার কিছু নেই। তুমি একজন ভিকটিম,পুলিশের সাসপেক্ট নও।
উর্বী কপালে রাবিং বাম লাগিয়ে আবারও ওদিকে ফিরে শুয়ে পরে। দু’চোখ বন্ধ বলে,” আপনি এখুনি তাদের আসতে বলুন। আমরা বিকেলেই চলে যাবো। আমি এখানে আর থাকতে চাই না।
***
“তো এখন বলুন। গতকাল রাতে ঠিক কি হয়েছিলো।”
সাব-ইন্সপেক্টর লোকটি প্রশ্নটি করে উর্বীকে।
উর্বীর চোখ মুখ স্বাভাবিক। যেনো কিছুই হয়নি। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সাব ইন্সপেক্টর আবারো জিগ্যেস করে,”কাল রাতে যে খু’ন হয়েছিলো,২০৪ নাম্বার রুমে। যেটা কিনা আপনাদের ছিলো। সেই খু’ন হওয়া ব্যক্তিকে আপনি চেনেন?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। সে চেনে না।
_কি বলছেন,আপনি চেনেননা জানেন না কিন্তু একটা লোক আপনার রুমে ঢুকে খু’ন হয়ে গেলো? এরকম কথা শুনেছেন আপনি কখনো?
রাওনাফ সাব ইন্সপেক্টরকে কে বলে,”দেখুন আপনি আমার স্ত্রীকে এভাবে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন না। আমার স্ত্রী অসুস্থ।”
উর্বী রাওনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”আমি বলছি। আমাকে বলতে দিন।”
কথাটা বলে উর্বী একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়, তারপর বলতে শুরু করে,
_কাল সন্ধ্যায় আমি পার্টি থেকে রুমে চলে যাই আমার ভীষণ মাথা ব্যথা হচ্ছিলো তাই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভাবলাম পার্টিতে ফিরবো তাই দরজা খুলতে যাই। তখন দেখি এই লোককে কোনো সন্ত্রাসী তাঁরা করছে। সে দৌড়ে আমার রুমে ঢোকে প্রান বাঁচাতে, আমার রুমের দরজা খোলা পেয়ে। তার পিছনে সেই সন্ত্রাসীও ঢুকে পরে। দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। আর দুর্ঘটনা বসত গু’লি বের হয়ে যায় পিস্তল থেকে। তারপর হত্যাকারী পালিয়ে যায়।”
উর্বী থেমে যায়। সে একনাগাড়ে কথাগুলো বললো। যেনো আগে থেকে মু’খস্থ করে রেখেছিলো।
পুলিশের লোক দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সাব ইন্সপেক্টর উর্বীকে বলে,”ব্যাস এটুকুই?”
তার মানে হত্যাকারী বা ভিক্টিম, কারো সাথেই আপনার কোনো পুর্ব সম্পর্ক নেই?
রাওনাফ রে’গে যায়।
“কিসব বলছেন আপনি। আপনি কিন্তু আমার স্ত্রীকে অ’পমান করছেন।”
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যর হাসি হাসে। তার মতো একটা তুচ্ছ মেয়ের হয়ে বারবার এই লোক ডিফেন্ড করছে। কেন !সে যদি সত্যিটা জানে তাহলে সে কি করবে?
পুলিশের লোকটা বলে,”আপনি এভাবে বারবার জিজ্ঞাসাবাদের মাঝে ঢুকে পরতে পারেন না। দেখুন এটা আমাদের কাজ,আমাদের উদ্দেশ্য আপনার স্ত্রীকে অপমান করা নয়।”
তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”আচ্ছা কাল দেখলাম আপনি খুবই বিদ্ধস্ত অবস্থায় ছিলেন। সন্ত্রাসী কি আপনার উপর এটাক করেছিলো?”
_না,ওদের ধস্তাধস্তিতে ভয় পেয়ে আমি নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে হোঁ’চট খেয়ে পরে যাই।
_আচ্ছা বুঝলাম।
সাব ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়ায়। সে কিছু বুঝতে পারছে না। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলেছে সে। এই সিজনটা বেশ আরামে কাটছিলো। কি এক উটকো ঝামেলা হাতে এলো! ম’রতে এরা এই দ্বীপে কেন আসে কে জানে!
রাওনাফের দিকে তাকিয়ে পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর বলে,”শুনুন আমরা যাচ্ছি। তবে যদি কখনও দরকার পরে তাহলে কোঅপারেট করবেন!”
রাওনাফ মাথা নেড়ে সাব ইন্সপেক্টরের দিকে তার একটা কার্ড এগিয়ে দেয়।
পুলিশের লোক গুলো চলে যেতেই সবাই নড়েচড়ে বসে। মিতা বলে ওঠে,”কেনো যে এলাম এখানে! রক্ষা করো আল্লাহ!”
উর্বী মিতার দিকে তাকায়। লামিয়া এসে উর্বীকে ধরে বসে থাকে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“সবাইকে বলুন। আমরা রওনা দেবো ঢাকায়।”
***
নাবিল ছাদে এসে দেখে উর্বী ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল ছাদে এসেছিলো একটু হাওয়া খেতে।
উর্বীকে দেখে সে দ্বিধায় পরে যায়। সে কি চলে যাবে ?
উর্বী নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিল অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। কিন্তু সে এগিয়ে আসে।
“কিছু বলবে?” উর্বী নিস্তেজ কন্ঠে বলে।
“আপনার কি শরীর খারাপ?”
_কেনো বলো তো!
_না মানে সেন্টমার্টিন থেকে আসার পর থেকে দেখছি চুপচাপ। কারো ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে মাতব্বরি করতে যাচ্ছেন না।
উর্বী মৃদু হেসে বলে,”আমি মাতব্বরি না করলেই খুশি থাকো?”
নাবিল কি বলবে ভেবে পায়না। সে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে কোনো উল্টোপাল্টা কথা না বলার। সে বেয়াদব ছেলে না।
উর্বী উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে।
নাবিল বলে,”কেউ না চাইলে তার ব্যাপারে মাতব্বরি না করাটাই তো ভালো তাইনা?”
_আচ্ছা,আর কখনো করবো না। নিশ্চিন্তে থাকো।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় উর্বী।
নাবিল অবাক হচ্ছে। এর আবার কি হলো !
সে বললো,
“নিচে দেখলাম পাপা আপনাকে খুঁজছে।”
উর্বী কিছু না বলেই সাথে সাথে রোবটের মতো হেটে চলে যায়।
নাবিল আরো অবাক হয়ে যায়।
****
“ছাদে গিয়েছিলে?”
“হু”
রাওনাফের প্রশ্নে জবাব দেয় উর্বী।
“মা ফোন দিয়েছে। তোমাকে ফোনে পাচ্ছে না। কথা বলে নিও। আজকাল তো মা আমার থেকে তোমার নামই বেশি জপ করে। জাদু করেছো নাকি মাকে!”
কথাটি বলে রাওনাফ নিজেই লজ্জা পায়। সে এতো হালকা মজা করছে কেনো উর্বীর সাথে!
উর্বী কোনো উত্তর না দিয়ে তার শাশুড়িকে ফোন দেয়। রওশান আরা তার ছোটো মেয়ে রুমার বাড়িতে গিয়েছে। ছোটোজামাই এসে নিয়ে গিয়েছে দুদিন হলো।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী তার শাশুড়ির সাথে কথা বলছে। তার চোখ মুখ শুকনো।
উর্বী কথা শেষ করে বলে,”আপনি ডিউটিতে যাবেন? কফি দেবো?”
_না,লাগবে না। তুমি কি অসুস্থ?
_না
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে কিছু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,”এরকম বহু দুর্ঘটনা মানুষের সাথে ঘটছে। প্রতিদিন যে ঘটতে থাকবে এমন তো কোনো কথা নেই।”
উর্বী নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাওনাফ বলে,”অফিস যাওনি কেন?”
_রেজিগনেশন লেটার দিয়ে দিয়েছি। চাকরিটা করছি না আমি।
রাওনাফ অবাক হয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
_এনি প্রবলেম?
_না
কথাটি বলেই রাওনাফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উর্বী ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । রাওনাফ তাকিয়ে থাকে।
উর্বী তাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে কেনো !
***
অন্তরা লিভিং রুমে হাঁটছে। সামিউল বসে তার ল্যাপটপে কাজ করছে।
উর্বীকে নিচে নামতে দেখে অন্তরা দাঁড়িয়ে পরে।
উর্বী অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলে,”সাবধানে হাটো। চারপাশ টা দেখে।”
অন্তরা হাসে। সামিউল ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে উর্বীকে দেখে।
উর্বী বলে,”কিছু খাবে? বানিয়ে দেই?”
অন্তরা মাথা নাড়ায়,”খুব হাসফাস লাগছে ভাবি ! মনে হচ্ছে দমটা বেরিয়ে যাবে।”
উর্বী অন্তরাকে দেখে। কি সুন্দর মুখশ্রীর কি হাল হয়েছে। একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে আছে।
উর্বী নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”কয় মাস হয়েছে?”
_এইতোহ চারমাস হলো।
উর্বী বলে,”তুমি ঘরে যাও। আমি ফল কেটে পাঠাচ্ছি।”
সামিউল উঠে অন্তরাকে ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠাতে থাকে।
উর্বী সে দৃশ্য দেখতে থাকে। তার মুখ ভাবলেশহীন।
শর্মী পেছন থেকে উর্বীর চোখ চেপে ধরে।
উর্বী বলে,”শর্মী !”
শর্মী হাত সরিয়ে বলে,”আন্টি তুমি বোঝো কিভাবে বলোতো!”
উর্বী নিচুস্বরে বলে,”বোকার মতো কথা বলে এই মেয়ে। এ বাড়িতে তুমি ছাড়া আমার সাথে এমন টা কে করবে? নাবিল শায়মী? নাকি আমার শাশুড়ি?”
শর্মী হাসতে হাসতে বলে,”তাই তোহ।”
উর্বী শর্মীকে দেখতে থাকে। এই মেয়েটার প্রতি এতো মায়া জমেছে তার। কেনো জমেছে !
***
রাওনাফ ঘরে ঢুকে দেখে ঘর অন্ধকার। উর্বী ঘুমিয়ে পরেছে। ফ্রেশ হয়ে সেও গিয়ে শুয়ে পরে। তার ঘুম আসছে না। কিছুসময় এপাশ ওপাশ করতে থাকে। একসময় সেও প্রায় ঘুমিয়ে পরে।
উর্বী ঘুমোয়নি। সে জেগে আছে। রাওনাফের জন্য চিন্তা তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। উচ্ছাস যখন বলেছে তখন সেই কাজ, কিংবা কোনো চেষ্টা সে করবেই। উর্বী জেনেশুনে রাওনাফকে বিপদে ফেলে দেবে? এই মানুষটির জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের জীবন। রাওনাফের কি দোষ? কোনো দোষ নেই। দোষ নেই এবাড়ির কারো। দোষ কি উর্বীর তবে? উর্বী তো ধারনাই করতে পারেনি উচ্ছাস এভাবে ফিরে আসতে পারে!
এখন উর্বীর কি করা উচিত! উর্বীর জন্য উপমার বিয়েটা আটকে ছিলো। এখন উপমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তার কি রাওনাফের সাথে ছাড়াছাড়ি করা উচিত রাওনাফের ভালোর জন্য! কিন্তু তার এতো খারাপ লাগছে কেনো? রাওনাফের সাথে ছাড়াছাড়ি করলে তার তো এতো কষ্ট হবার কথা না। এটা তো অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ে ছিলো!
উর্বীর দুচোখ বেয়ে পানি পরে। একসময় একটা চাপা কষ্ট তার গলা টি’পে ধরে। সে ফুঁপিয়ে ওঠে। সে কি করবে এখন? এমন একটা জালে সে জরিয়ে গিয়েছে, কার ধৈর্য্য হবে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার!
রাওনাফ চোখ খোলে। দু’জনে দুদিকে ফিরে শুয়ে আছে। উর্বী কি কাঁদছে? সে এভাবে কাঁদছে কেনো? তার কি হয়েছে !
***
“স্যার আপনার রাউন্ডের সময় এখন।”
_তুমি যাও,আমি আসছি।
নার্সের কথায় জবাব দেয় রাওনাফ। টুং টুং আওয়াজ করে হঠাৎ তার ফোনে একটি নোটিফিকেশন আসে। মেসেজটা উর্বীর থেকে এসেছে। রাওনাফ খুবই আগ্রহী হয়ে ওঠে মেসেজটি পড়ার জন্য।
এই সময়ে হঠাৎ উর্বী মেসেজ দিয়েছে কেনো। সে মেসেজটি ওপেন করে।
“আমি ও বাড়ি চলে যাচ্ছি। আই নিড সাম স্পেস। মাকে এবং শর্মীকে বোঝাবেন। ভালো থাকবেন।”
রাওনাফ একদৃষ্টে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এসব কি! উর্বী কি মজা করছে!
রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উর্বীর নাম্বারে ফোন দিতে থাকে । উর্বী ফোন ধরে না। রাওনাফের মেজাজ বিগড়ে যায়।
স্পেস চাই মানে ! নিক স্পেস। সেটা এভাবে বলতে হবে?,মেসেজ দিয়ে? সামনাসামনি বলা যেতো না? সে কি উর্বীকে বেঁধে রাখতো? আটকে রাখতো বাড়িতে?
রাওনাফ অবাক হচ্ছে,তার এতো রা’গ হচ্ছে কেনো! উর্বী যাচ্ছে যাক,ওর জীবন। স্পেস চাইলে নেবে। তাকে বলার কি আছে! কিন্তু তাতে তার এতো রা’গ হচ্ছে কেনো !
ফোনটা রেখে রাওনাফ বসে থাকে। তার রাউন্ডে যাওয়ার কথা মনে নেই। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।
একবার সামনাসামনি কথা বললে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো! কিভাবে এমন করে গেলো উর্বী। সে কি কিছুই না? যত যাই হোক, কাগজে কলমে স্বা’মী তো!
শর্মী লিভিং রুমে বসে ছিলো। রাওনাফকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে সে তার কাছে আসে। তার চোখ মুখ বিষন্ন।
“পাপা আন্টির সাথে তোমার কথা হয়েছে?”
_না।
রাওনাফ বলে।
_আন্টি তার বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছে। কবে ফিরবে?
রাওনাফ শান্ত ভাবে বলে,”আমি জানিনা শর্মী।”
শর্মী চুপ হয়ে যায়,রাওনাফ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠে। এখন তার নিজের উপর নিজেরই রা’গ হচ্ছে। বারবার উর্বীর কথা মনে পরছে কেনো তার। অদ্ভুত!
সে রাওনাফের সাথে সামনাসামনি বলার প্রয়োজন মনে করেনি, বলেনি। ব্যস!
স্পেস চাইছে,স্পেস নিক। মন ভরে নিক। রাওনাফের বয়েই গিয়েছে তাকে বিরক্ত করতে। আর কখনোই কল বা মেসেজ দিবে না রাওনাফ উর্বীকে,যদি না সে দেয়।
চলমান….
#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৯
#Esrat_Ety
উচ্ছাস খবর পেয়েছে উর্বী ও বাড়ি চলে গিয়েছে। এতো বড়ো একটা সুযোগ। অথচ শহরে ঢোকাই যাবে না। রাগে উচ্ছাসের মাথার দুই পাশের রগ দপদপ করছে।
সজীব আড়চোখে উচ্ছাসকে দেখছে। একটা খু’ন করে পালিয়েছে তাঁতে কোনো হেলদোল নেই! এখনও এই লোকের মাথায় ঐ মেয়েটার চিন্তা। এই অর্ধ উন্মাদের সাথে থাকতে থাকতে একদিন সজীব মারা পরবে নির্ঘাত!
সজীব ভাইব্রেশনের শব্দে হাতের ফোনটার দিকে তাকায় তারপর ফোনটা উচ্ছাসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”ভাই কাকা ফোন দিচ্ছে!”
উচ্ছাস বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোনটা হাতে নিয়ে কানে চেপে ধরে, ওপাশ থেকে শাখাওয়াত চৌধুরীর কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে,”সেন্টমার্টিন গিয়েছিলে কেন?”
উচ্ছাস নিশ্চুপ। শাখাওয়াত চৌধুরী চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”জবাব দাও সেন্টমার্টিন গিয়েছিলে কেনো?”
_ঘুরতে।
এক শব্দে জবাব দেয় উচ্ছাস।
_ঘোরাঘুরি করার ছেলে তো তুমি নও! কি অঘটন ঘটিয়ে এসেছো? আবার কি খেসারত দিতে হবে আমার? বলো!
উচ্ছাস জবাব দেয় না। সজীব উচ্ছাসকে দেখছে। বড়লোকের শিক্ষিত ছেলে, সুদর্শন। ক্ষমতাবান মানুষের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করে,কত লাক্সারিয়াস লাইফ কাটায়। আর এই ছেলে সেকেন্ড চান্স পেয়েও হত্যে দিয়ে শুধু ঐ মেয়েটার পেছনেই পরে আছে, যে কি না এখন প্রায় ত্রিশের বুড়ি। কি হাস্যকর একটা ব্যাপার। ঐ মেয়ের চাইতে হাজার গুণ সুন্দরী মেয়ে বাগিয়ে নিতে পারে এখনও। আজব!
উচ্ছাস নিশ্চুপ দেখে শাখাওয়াত চৌধুরী বলতে থাকে,”নির্বাচন টা গেলে ফ্রান্স পাঠাবো তোমায়। ততদিন দয়া করে একটু সমঝে চলো। আর হ্যা, ঐ মেয়েটার পেছনে লেগো না। ওর বিয়ে হয়েছে, আমি আমার ছেলে খুনি মানতে পারবো, আমার ছেলে পরস্ত্রীর দিকে নজর দিচ্ছে এটা মানতে আমার রুচিতে বাঁধবে। সব ঠিকঠাক হলে ওর থেকেও সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে দেবো তোমার। এর মাঝে আর কোনো ঝামেলা বাধিও না যাতে করে আবার তোমায় জেলে যেতে হয়।
শেফালী স্বামীর হাত থেকে ফোন নিয়ে কানে চেপে ধরে উচ্ছাসকে বলে,”বাবা।”
উচ্ছাস জবাব না দিয়ে ফোন কে’টে দেয়। শেফালী অশ্রুসিক্ত চোখে হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
উচ্ছাস স্বাভাবিক গলায় সজীবকে বলে,”ঝামেলা হয়েছিলো কোনো। চেক আউট তো আগেই করে নিয়েছিলি তাই না?”
_হ।
সজীব উত্তর দেয়। উচ্ছাস বলতে থাকে,”আচ্ছা যা। আমি কিছুক্ষণ একা থাকবো!”
উর্বী চুপচাপ বসে আছে।
লুৎফুন্নাহার চিন্তিত হয়ে মেয়েকে দেখছেন। এভাবে হঠাৎ করে চলে এলো কেনো উর্বী! জামাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে! কিছু বলছেও না।
সে উর্বীর কাঁধে হাত দেয়,” হ্যা রে।ওদিকে সব ভালো? ”
_হু,সব ভালো।
_তাহলে হঠাৎ এলি যে !
উর্বী রে’গে যায়,”কি এসেছি পর থেকে একই কথা বলে যাচ্ছো। এসেছি খুশি হওনি নাকি! ঠিকাছে চলে যাবো।”
উর্বী উঠে গিয়ে রুমে ঢুকে ধপাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
লুৎফুন্নাহার চুপ করে বসে আছে। তহুরা আর তার স্বামী রেজাউল কবির একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
রওশান আরা নিজ বাড়িতে ফিরেছেন। বাড়ি ফিরেই তিনি লিভিং রুমের সোফাতে আ’রাম করে বসে প্রথম যে কথাটি বললেন তা হলো,”বড় বৌমা ! আমাকে একটু পানি খাওয়াও তো !”
উর্বী পানি নিয়ে আসে না। পানি আনে আমীরুন।
“তুই এনেছিস কেনো? তোর কাছে চেয়েছি আমি?”
আমিরুন থতমত খেয়ে বলে,”ভাবি তো বাড়িতে নাই আম্মা।”
_কোথাও বেরিয়েছে? রাওনাফ কোথায়? হসপিটালে?
_ভাবী হের বাপের বাড়ি চইলা গেছে আম্মা।
রওশান আরা আমীরুনের দিকে তাকায়, রাগী কন্ঠে বলে, “বাপের বাড়ি গিয়েছে মা’নে? কখন? ফিরবে কখন? আশ্চর্য আমাকে ফোন দিয়ে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না একবারো? ”
আমীরুন ভয় পেয়ে যায়। রওশান আরা খে’পে গিয়েছেন। এখন একে কিভাবে থামাবে সে?
_রাওনাফ কই। ও তো আমায় কিছু বললো না।
_ভাইজান হাসপাতাল আম্মা। ভাবি ভাইজানরেও কিছু বলে নাই। একা একা চইলা গেছে।
রওশান আরা অবাক হয়, উর্বী একা একা চলে গিয়েছে! কেনো!
_ফিরবে কবে জানিস কিছু? জানিয়েছে?
_না আম্মা। কি হইতেছে তাই বুঝতে পারতেছি না।
_রাওনাফের সাথে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়েছিলো?
_তা আমি কেমনে কমু আম্মা।
রওশান আরা রাগে দাঁত কিরমির করতে থাকে। সামিউল সিড়ি দিয়ে নিচে নামছে।
রওশান আরা সামিউলকে দেখে বলে,”তোর বৌ কোথায়?”
_ছাদে মা,কেনো?
_বাহ। একটা পোয়াতি মেয়ে মাগরিবের ওয়াক্তে ছাদে গিয়ে ঢ্যাংঢ্যাং করছে আর বাড়ির বড় বৌ কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছে। চমৎকার। তোর মনে হচ্ছে না এ বাড়ির বৌদের শাসনে না রাখার ফল এটা?
সামিউল বলে,”মা অন্তরা একটু হাওয়া খাচ্ছে। আর ভাবি বাপের বাড়িতেই তো গিয়েছে। চলে আসবে। এতো হাইপার হচ্ছো কেনো?
_রাগ উঠবে না আমার ? দুটোতে মিলমিশ করাতে আমার জান বেড়িয়ে যাচ্ছে। উর্বী তো এভাবে চলে যাওয়ার মেয়ে নয়। নিশ্চয়ই আমার বড়ছেলের অবদান আছে এতে।
“তা থাকতে পারে। ভাইজান তো ভাবীরে পাত্তাই দেয়না,খালি হাসপাতাল হাসপাতাল কইরা শেষ হইয়া যায়।”
আমিরুন রওশান আরাকে সম্মতি জানিয়ে বলে।
সামিউল আমীরুনকে চোখ রাঙানি দেয়। আমীরুন চুপ হয়ে যায়।
রওশান আরা সামিউলকে বলে,”তুই ওকে চোখ রাঙাচ্ছিস কেনো? ও কি ভুল বলেছে? আমি দেখি না? আমার চোখ নেই? সাতদিনের জন্য পাঠিয়েছিলাম ঘুরতে। তারা তিনদিনেই ফিরে এসেছে। নিশ্চয়ই হাসপাতালের দোহাই দিয়ে এসেছে তোর বড় ভাই। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। রাওনাফের সাথে রাগারাগি করেই উর্বী চলে গিয়েছে। কত সংসারী একটা মেয়ে,তোর বড় ভাই একটু বুঝবে না?
_মা সেটা ভাইয়ার সাথে উর্বীর বিয়েটা দেওয়ার আগে তোমার মাথায় আনা উচিত ছিলো। তুমি আর নুরুন্নাহার খালা। তোমরা দু’জনে দায়ী।
রওশান আরা রে’গে সামিউলের দিকে চায়,”পুরনো কথা টেনে আনছিস তুই?”
সামিউল ভয় পেয়ে যায়,মনে মনে বলে,”এইরে। মাকে খেপিয়ে দিলাম!”
রওশান আরা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
_যা গিয়ে তোর বৌয়ের ঘা’ড় ধরে ছাদ থেকে নিয়ে আয়। মাগরীবের আজান দিয়ে দেবে। হাওয়া খেতে গিয়েছে ! এহহহ,আমরা যেনো বাচ্চা হওয়াইনি।”
সামিউল বুঝতে পারে,তার মা ভীষণ খেপেছে। তার এখান থেকে কে’টে পরাই ভালো। সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে আ’ছাড় খায়। তারপর আবার উঠে দৌড়াতে থাকে।
রওশান আরা বিরবির করে বলে,”ছাগল একটা!”
আমীরুন ফিক করে হেসে দেয়।
রওশান আরা রাগী দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়,বলে,”তুই হাসছিস কেনো? যা আমার চোখের সামনে থেকে। তো শ্রদ্ধেও বড় ভাইজান এলে বলবি আমার সাথে যেনো দেখা করে। আমি আমার ঘরে গেলাম। কেউ বিরক্ত করবি না।”
***
শর্মী উর্বীকে ফোন দিচ্ছে।
নাবিল পেছন থেকে বলে,”কাকে ফোন দিচ্ছিস?”
শর্মী হঠাৎ করে ভয় পেয়ে হাত থেকে ফোন ফেলে দেয়,
তারপর বুকে থুথুরি দিয়ে বলে,”তুমি আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছো ভাইয়া!’
_আচ্ছা সরি। কাকে ফোন দিচ্ছিলি?
কথাটি বলে নাবিল মেঝে থেকে শর্মীর ফোন উঠিয়ে দিতে গিয়ে দেখে উর্বীর নাম্বার।
নাবিল হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”ও তোর মাকে। তা আন্টি লিখে রেখেছিস কেনো? বোকা মেয়ে। মা কে কি কেউ আন্টি বলে?”
শায়মী এসে নাবিলের পেছনে দাঁড়ায়,বলে,”নাবিল তোর কোনো কাজ নেই? যা এখান থেকে। ওকে খেপাচ্ছিস কেনো?”
নাবিল মুখ ভেঙচিয়ে বলে,”ওওওও আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।তোরও তো মা।”
শায়মী রেগে নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাবিল হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হয়। যাওয়ার সময় দরজার বাইরে থেকে বলে,”তোদের মা তো গেলো। এখন কার কোলে শুয়ে ফিটু খাবি শর্মী?”
শর্মী রেগে গিয়ে কিছু বলতে এগিয়ে যায়। শায়মী শর্মীর হাত ধরে আটকায়,”ছাড় তো ওর কথা। তোকে খেপাচ্ছে। আন্টিকে ফোনে পেলি?”
_ ধরছে না আপু।
_কি হলো বলতো?
শর্মী তাকিয়ে আছে। আন্টি এরকম কেনো করছে? আন্টি তার সাথে কথা বলতে চায় না?
***
আমিরুন সদর দরজা খুলে দেয়, রাওনাফ ঘরের ভেতরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা রাখতেই আমীরুন বলে ওঠে,”আপনেরে আম্মা হের কথা শুনতে বলছে ভাইজান।”
“মা আসবো!”
রওশান আরা একটা ইসলামিক বই পড়ছিলো। রাওনাফের কথায় তার দিকে না তাকিয়েই বলে,”আয়।”
রাওনাফ সরাসরি রওশান আরার ঘরে এসেছে। তার হাতে এপ্রোন, স্টেথোস্কোপ।
রওশান আরা বলে,”বোস।”
_তুমি বলো কি জন্য ডেকেছিলে।
_বৌমা কেন গিয়েছে?
রাওনাফ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। রওশান আরা বলতে থাকে,”কি করেছিস তুই?”
_আমি কি করেছি মানে? মা তোমার কি মনে হয়না তুমি….
_মেয়েটাকে তো দেখেছি আমি। কতটা সংসারী হয়ে উঠেছিলো। তোর অবদান ছাড়া এভাবে হুট করে চলে যেতে পারে না।
রাওনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে রওশান আরা।
_স্টপ মা! নাউ প্লিজ স্টপ! বরাবর নিজের মতামত, নিজের ধারণা দিয়ে তুমি সব বলো। মা তুমি জানো তুমি কতটা ভুল?
রওশান আরা ছেলের ধ’ম’ক শুনে অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকায়।
রাওনাফ বলতে থাকে,”কি বলেছিলে, পাত্রী রাজি। কারন তার বড়ভাই,খালা বলেছে পাত্রী রাজি। আমাকে একটু সময় অব্দি দিলে না। পুরো দুনিয়ার কাছে একটা উপহাসের পাত্র বানিয়ে ছেড়ে দিলে। সবাই আঙুল তুলছে আমার দিকে। আমার ব্যক্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এই একটা যায়গায় এসে। তুমি আর তোমার এই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং। এগুলো বন্ধ করো এখন। প্লিজ! আমি পাজেলড হয়ে আছি মা।”
রওশান আরা অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে,”তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস? তুই? বেশ করেছি! যা করেছি বেশ করেছি। দে আমাকে ফাঁসি দে সবাই। দে।”
রাওনাফ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি শোধরাবে না তাই না?”
কথাটি বলে রাওনাফ হন্তদন্ত হয়ে ঘরের দিকে যায়। রওশান আরা দরজার দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে।
***
ঘরে ঢুকে রাওনাফ এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে ধপ করে বিছানার একপাশে বসে পরে। টাইয়ের নট আলগা করে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে থাকে চুপচাপ। দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়। মাথা তুলে রাওনাফ ধীরে ধীরে বেড সাইডের টেবিলের ওপর রাখা শিমালার ফটোফ্রেমটির দিকে তাকায়। অস্বাভাবিক দুর্বল লাগছে হঠাৎ নিজেকে। কাঁপা কাঁপা হাতে শিমালার ফটোফ্রেমটি তুলে নিয়ে দেখতে থাকে ছবিটা। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”প্লিজ কনসোল মি শিমালা!”
দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায় আমীরুন। নিচু গলায় ডাকে,”ভাইজান আসবো?”
রাওনাফ ফটোফ্রেমটা যায়গামতো রেখে বলে ওঠ,” আয়! ”
আমীরুন ঘরে ঢোকে। রাওনাফ বলে,”কিছু বলবি?”
_আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো ভাইজান।
রাওনাফ অবাক হয়ে আমীরুনের দিকে তাকিয়ে থাকে,”কথা? কি,বল!”
***
“এসেছিস কেন?”
প্রশ্নটি করে উর্বীর খালা নুরুন্নাহার উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি তার মেয়ের ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উর্বীদের বাড়ির সবাইকে নিয়ে যেতে এসেছে। উর্বী নির্বিকার চিত্তে তার শাড়ি গুলো ভাজ করে আলমারিতে তুলে রাখতে থাকে।
তারপর বলে,”আমার বাপের বাড়ি আসবো না?”
_জামাই ছাড়া আসবি না। জামাই নিয়ে বছরে দুই ঈদে বেড়াতে আসবি তাও দুদিনের জন্য।
_এটা বাংলাদেশের কোন সংবিধানে লেখা?
_নেই এমন কোনো নিয়ম,এই নিয়ম শুধুমাত্র তোর জন্য।
উর্বী চুপ করে থাকে। নুরুন্নাহার বলতে থাকে,”কি? কথা বলছিস না কেনো?”
উর্বী চুপ করেই থাকে। নুরুন্নাহার বলতে থাকে,”যাই হোক! গুছিয়ে নে সবকিছু। এখানেই আছিস যখন,তুইও চল আমাদের বাড়িতে!”
****
গাড়ী এখানেই থামাতে হচ্ছে। এই গাড়ী নিয়ে উর্বীদের পাড়ার সরু রাস্তায় ঢোকা মুশকিল। রাওনাফ চিন্তিত হয়ে বসে আছে। গাড়ি না হয় এখানে থাকবে কিন্তু সে কি করবে? এই ঝুম বৃষ্টিতে বাইরে পা দেবে কিভাবে? আধাঘণ্টা ধরে সে একই ভাবে বসে আছে। রাতও অনেক হয়েছে। রাত দশটা যদিও তেমন বেশি রাত না তবে উর্বীদের এলাকা শুনশান হয়ে আছে। বৃষ্টির জন্যও হতে পারে।
রাওনাফ রওনা দিয়েছে সন্ধ্যা নাগাদ। হসপিটাল থেকেই রওনা দিয়েছে। এখানে পৌছেই বৃষ্টি তাকে পেয়ে বসলো। এখন রাওনাফ কি করবে! এভাবে তো বসে থাকা যায়না। মেইন রোড থেকে সাত আট মিনিটের রাস্তা। রাওনাফ হেটে যাবে? এই বৃষ্টিতে?
উর্বীর মন মেজাজ বি’গড়ে আছে। সন্ধ্যে থেকে লোডশেডিং , মোমবাতির টিমটিমে আলো আর তার উপরে মশার উপদ্রব।
মোবাইল টা অফ হয়ে আছে। শর্মীর কথা মনে পরছে খুব উর্বীর। উর্বী শর্মীর ফোন ধরেনি তার জন্য খুব অনুশোচনা হচ্ছে। মেয়েটার সাথে একটু কথা বলে নিলে খুব তো ক্ষতি হয়ে যেতো না তার!
সে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলো,মাথা তুলে তহুরাকে ডাকে,” ভাবী । আরেকটা কয়েল জালিয়ে দাও না। আগেরটা শেষ হয়ে গেলো যে।”
তারপর তার মনে পরে সে বাড়িতে একা। জেদ করে যায়নি সবার সাথে।
বাইরে ঝমঝম শব্দ করে বৃষ্টি পরছে। উর্বীর বেশ শীত লাগছে। সে একটা কয়েল জালিয়ে নিজের ঘরে যেতে নেয় তখনি দরজায় কেউ ধাক্কা দেয়। উর্বী দাঁড়িয়ে পরে। এতো রাতে কে এলো! বাড়ির সবাই নয়তো? কিন্তু তাদের তো আজ আসার কথা না! উর্বীর হঠাৎ খুব ভয় হতে শুরু করে। প্রতিবেশীর বাড়িও তাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। খুব ভয় করছে তার।
উর্বী কয়েল রেখে মোমবাতি নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজার এপাশ থেকে বলে,”কে?”
রাওনাফ শীতে কাপছে। সে কাঁপতে কাঁপতেই জবাব দেয়,”উর্বী আমি রাওনাফ! দরজা খোলো।”
উর্বী চ’ম’কে ওঠে। কার গলা শুনছে সে! কে এসেছে! এই ভারি পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে তার বুক চিনচিনিয়ে উঠলো কেনো। এমন অনুভূতি তখন হয় যখন কেউ কারো অপেক্ষা করতে করতে একসময় তার সান্নিধ্য পায়। তবে কি সে রাওনাফের জন্য অপেক্ষা করছিলো? সে জানতো না, নিজেও মানতো না,ভাবে নি রাওনাফ আসবে। রাওনাফের আসার তো কথা না। তবে তার অবচেতন মন চাইতো রাওনাফ আসুক? এমনটা নাকি? এমনটাই কি?
উর্বী কিছুই বুঝতে পারছে না। সত্যিই কি রাওনাফ? নাকি তার ভ্রম। নিশ্চিত হবার জন্য সে কাঁপা গলায় আবারও বলে,”কে?”
ওপাশ থেকে রাওনাফ বলে,”আরে আমি রাওনাফ উর্বী। দরজাটা খুলে দাও তাড়াতাড়ি।”
উর্বী একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে হাতটা বাড়িয়ে দেয়। সিটকিনি তুলে দরজা খুলে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। ক্লান্ত কিন্তু অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখতে থাকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বাটে, ছিমছাম গড়নের, গভীর চাহনির, শান্ত , গোছালো, মধ্যবয়সী পুরুষটিকে।
চলমান……