#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৬
#Esrat_Ety
উর্বী বুঝতে পারছে না সে কোথায়। হাত দিয়ে চোখ ডলছে সে। পরক্ষনেই মনে পরলো সে তো সেন্টমার্টিনের একটা রিসোর্টের রুমে আছে। বাইরে থেকে মিষ্টি রোদ জানালার সাদা রঙের পাতলা পর্দা ভেদ করে রুমের ভিতর উঁকি দিচ্ছে। তাদের ঘরটা বেশ বড়ো। গোটা রিসোর্টটাই অনেক বড়। উর্বী গা থেকে চাদর সরিয়ে মেঝেতে পা রাখে। রাওনাফকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। কোথাও বেরিয়েছে নাকি!
সে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। এতো বেলা অব্দি সে ঘুমোয় না। কিন্তু গতকাল রাতে জার্নি করে সে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো। উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার দিকে তাকায়। রাওনাফের ব্যবহৃত চাদরটা একেবারে গুছিয়ে ভাজ করে রাখা। এই মানুষটি খুবই গোছালো, এতো গোছালো পুরুষ উর্বী দেখেনি।
বিছানার সাথে লাগোয়া টেবিলটায় একটা কফি মেকার আর কিছু ইন্সট্যান্ট কফির পাতা দেখতে পায় সে। দেখেই উর্বীর কফি খেতে ইচ্ছে করছে। সে নিজের জন্য এক মগ কফি বানিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দায় গিয়ে সে চ’ম’কে যায়। এখান থেকে সমুদ্র সৈকতের চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করা যাচ্ছে। উর্বীদের ঘরটি চারতলায়। রিসোর্টের বাগানে প্রচুর লোকজন, সবাই যে যার মতো আনন্দ করছে। হঠাৎ রাওনাফের দিকে তার চোখ যায়। পুল সাইডের পাশে একটা টেবিলে তারা বন্ধুরা মিলে হৈ হৈ করে গল্প করছে।
রাওনাফকেও বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। রাওনাফের বন্ধুদের বৌয়েরা ব্যস্ত সেলফি নিতে। উর্বী কফিটা শেষ করে। সে এখন কি করবে ! রাওনাফকে ফোন দেবে?
রাওনাফকে ফোন দিতে হয় না, রাওনাফই তাকে ফোন দেয়। উর্বী কানে ফোন চেপে ধরে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে।
_হ্যা তুমি উঠেছো?
_হ্যা এইতো কিছুক্ষণ হলো।
_আমরা সবাই এখন ব্রেকফাস্ট করবো,তুমি ফ্রেশ হয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসতে পারবে? নাকি আমি আসবো?
_না,আমি পারবো আপনার আসতে হবে না।
রাওনাফ ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দেয়। সে হাত নেড়ে নেড়ে পুনরায় বন্ধুদের সাথে গল্প করতে শুরু করে। উর্বী দুমিনিট তার দিকে তাকিয়ে থেকে রেডি হতে যায়।
***
উর্বীকে আজ উর্বীর চোখেই ভীষণ সুন্দর লাগছে। সে আকাশী রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি পরেছে। মুখে একটু পাউডার লাগিয়েছে। একটু লিপস্টিকও কি দেবে? কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে থেকে লিপস্টিক না লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে। যা সেজেছে সেটাই ঢের। সাজবেই বা কেন উর্বী! নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে পার্স টা হাতে তুলে নেয়। তারপর পা বাড়ায় রুমের বাইরে।
উর্বী রুম লক করে ঘুরে দাঁড়াতেই চ’ম’কে ওঠে। তাদের রুমের বিপরীতে রুম নাম্বার টু ওয়ান টুতে একজন লোক ঢুকলো। পেছন থেকে এক ঝলক দেখলো উর্বী। লোকটির অবয়ব এমন চেনা চেনা মনে হলো কেনো?
“দাঁড়িয়ে আছো কেনো? যাবে না?”
উর্বী ঘুরে তাকায়। রাওনাফ দাঁড়িয়ে আছে।
“আপনি এলেন কেনো? আমিই যেতাম।”
_তোমার দেড়ি হচ্ছিলো দেখে ভাবলাম কোনো অসুবিধে হয়েছে। মানে ওরা পাঠিয়েছে।
উর্বী মনে মনে হাসে। রাওনাফ করিম খানকে সবসময় সবাই জোর করে।
মুখে বলে,”আমি কি ছোটো বাচ্চা?”
_তা ঠিক না, চলো সবাই অপেক্ষা করছে।
উর্বী রাওনাফের পিছু পিছু যেতে থাকে। কিছুক্ষণ বাদেই টু ওয়ান টু থেকে বেরিয়ে আসে উচ্ছাস। বেরিয়ে সে মুখে মাস্ক লাগিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে থাকে।
খাওয়ার সময়ও সেলফি! এবার উর্বীর খুবই বিরক্ত লাগছে।
জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মিতা বলে,”আরে সবাই মিলে একটা সেলফি তুলি চলো! সবাই তাকাও।”
সবাই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। যে যার বৌয়ের কাঁধে হাত রেখেছে। হঠাৎ উর্বীর কাছে দৃশটা খুবই ভালো লাগে।
জুনায়েদের স্ত্রী রাবেয়া বলে ওঠে,”আরে রাওনাফ ভাই! আপনিও ভাবীকে ধরে রাখুন না।”
উর্বী হকচকিয়ে ওঠে। রাওনাফও ভীষণ বিব্রত হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। মৌমিতা বলে ওঠে,”আরে বাদ দাও না। লজ্জা পাচ্ছে এরা। তোমরাও না!”
লামিয়া পাশ থেকে মৃদু হেসে বলে ওঠে,”চলো এবার সবাই তাকাও। তখন থেকে সেল্ফি স্টিক তুলে বসে আছি। তাকাও!”
তারা ছবি তুলছে। লামিয়া মাথা ঘুরিয়ে উর্বীকে নিচু স্বরে বলে,”হাসো!”
উর্বী হাসার চেষ্টা করে।
দূরের টেবিলে বসে আছে উচ্ছাস। সে অপলক দৃষ্টিতে উর্বীকে দেখছে।
***
নাবিল স্যান্ডউইচ নিয়ে খুটছে শুধু, খাচ্ছে না। শায়মী আর শর্মী দুজন মিলে অতি উৎসাহের সাথে পরিকল্পনা করছে খালামনিদের বাড়িতে গিয়ে কি কি করবে। খাবার টেবিলে তারা পাঁচজন। শর্মী,শায়মী,নাবিল আর সামিউল-অন্তরা।
কিছুক্ষণ পরে নাবিল শর্মীদের ধমক দিয়ে বলে,”চুপ করবি তোরা! আমার বিরক্ত লাগছে এসব শুনতে!”
সবাই মাথা তুলে নাবিলের দিকে তাকায়। শায়মী কড়া গলায় বলে,”গতকাল থেকে খিটখিটে করেই যাচ্ছিস! দিস ইজ ঠু মাচ নাবিল!”
নাবিল চুপ করে থাকে। শায়মী ক্ষনবাদে বলে ওঠে,”পাপা তার ওয়াইফকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছে।”
সামিউল শায়মীর কথা শুনে নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিলের মেজাজ এজন্য চটে আছে!
নাবিল চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”কাল বুঝেছি, পাপা ওয়ার্ল্ডস বেস্ট পাপা হলেও কখনো বেস্ট হাজবেন্ড ছিলোই না। মাম্মাকে কখনও পাপা ভালোবাসেনি।”
সামিউল পাশ থেকে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”ভালো না বাসলে তোরা পৃথিবীতে টপকালি কিভাবে!”
অন্তরা সামিউলকে খোঁচা মেরে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”থামবে তুমি! ওরা বাচ্চা!”
শায়মী নাবিলের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”নাবিল! প্লিজ পাপাকে এভাবে জাজ করিস না!”
_চাই না তো! হয়ে যায়!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে নাবিল।
***
দুপুরে সবাই মিলে সমুদ্র স্নানে বের হয়েছে। উর্বীর একদমই যেতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু সবাই মিলে তাকে টেনে নিয়ে যায় । সে শাড়ি পরে আছে। মেরুন রঙের সাধারণ সুতি শাড়ি।
রাওনাফ চুপচাপ হাঁটছে।
উর্বীর কাছে এসে মিতা বলে,”কি ব্যাপার উর্বী! তুমি এভাবে রাওনাফ ভাইয়ের থেকে আলাদা হয়ে থাকো কেনো? আরে লজ্জা কিসের? আমরা আমরাই তো।”
উর্বী কি বলবে বুঝতে পারছে না। জবাবে সে শুধু মুচকি হাসে।
“রাওনাফ ভাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি রাতে?”
পেছন থেকে আশিকের স্ত্রী জান্নাত বলে ওঠে।
_না তো, ঝগড়া কেনো হবে?
_তাহলে তার কাছে যাও।
কথাটি বলেই জান্নাত উর্বীকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে রাওনাফের দিকে পাঠিয়ে দেয়। রাওনাফের চোখে উর্বীর চোখ পরে। সে চোখ নামিয়ে হাটতে থাকে।
উর্বীর এখন একটু শান্তি লাগছে। বীচে এসে এখন কেউ আর তাদের নিয়ে পরে নেই। যে যার স্বামীর সাথে সমুদ্রস্নান করছে। এদের দেখে উর্বীর সত্যি সত্যি অবাক লাগে। এদের ছেলেমেয়েরা নাকি আবার স্কুলে পরে। তবে উর্বীর খুব ভালো লাগে এদের স্বামী-স্ত্রীতে খুনসুটি গুলো।
সৈকতে একা একা হাঁটতে থাকে সে। মৃদুমন্দ বাতাসে তার খোলা চুলগুলো উড়ছে। উর্বী চুলে কোনোমতে একটা খোঁপা বেঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। কিছু ঝিনুক তার পায়ে লাগে। সে ঝিনুকটা উঠিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে। বাহ বেশ সুন্দর তো!
উর্বী দুমিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ঝিনুক কুঁড়াতে শুরু করে।
“কি করছো?”
পেছন থেকে বলে রাওনাফ।
উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”ঝিনুক কুড়োচ্ছি।”
_এগুলো দিয়ে কি হবে?
অবাক হয়ে উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
_এগুলো খুবই সুন্দর। শর্মী নিতে বলেছিলো। ও কি একটা ক্রাফ্ট বানিয়ে নেবে বলছিলো ওর চারুকলা ক্লাসে।
রাওনাফ হাসে। উর্বীকে তার এখন শর্মীর মতোই একটা বাচ্চা মনে হচ্ছে।
উর্বী কথা না বাড়িয়ে ঝিনুক কুঁড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরে। রাওনাফ কিছুক্ষণ তাকে দেখে। খানিক বাদে সেও তার পায়ের কাছ থেকে একটা ঝিনুক উঠিয়ে উর্বীকে এগিয়ে দেয়। উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তার হাতের দিকে তাকায়, তারপর মুচকি হাসি দিয়ে সেটি নেয়।
“এই দেখো দেখো ওদিকে দেখো।”
মিতার কথায় সবাই দূরে রাওনাফ আর উর্বীর দিকে তাকায়। দুজনে পাল্লা দিয়ে ঝিনুক কুড়িয়ে জড়ো করছে।
জুনায়েদ বলে,”আমাদের সামনে এমন ভাব করে যেনো ভাজা মাছ টা উলটে খেতে পারে না এরা দুজন। গলায় গলায় কত ভাব দেখেছো?”
” দাঁড়াও এখনই ধরছি দুটোকে।”
মৌমিতা এগিয়ে যেতে নেয়।
সবাই হো হো করে হাসতে থাকে। লামিয়া তাকে বাধা দিয়ে বলে,”মৌমিতা প্লিজ যাসনা। ওরা ওদের মতো থাকুক। আমাদের ওদেরকে নিজেদের মতো করে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।”
“ঠিক বলেছো।”
জাহাঙ্গীর লামিয়ার কথার পিঠে বলে।
দূর থেকে উচ্ছাস উর্বী আর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। সে দীর্ঘসময় আগে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলো,কিন্তু সেটি তার হাতেই পুড়ছে। ওড়াচ্ছে না সে ধোয়া।
***
“পুরুষ দের আর পছন্দ কি। শেষ মেষ তো তোমরা তোমাদের পছন্দ অনুযায়ীই সব কিনবে। আমরা কয় বন্ধু এখানে বসে কফি খেতে খেতে আড্ডা দেই। তোমরা ঘুরেফিরে কেনাকাটা করো।”
আশিক বলে কথাটি। তারা সবাই সন্ধ্যায় শপিং করতে বেরিয়েছে। উর্বী চুপচাপ বসে আছে। তাকে অন্যরা টানাটানি করছে। শেষমেষ বাধ্য হয়ে সে উঠলো।
মহিলারা সবাই বিভিন্ন জিনিস দেখছে। দরদাম করছে। উর্বী সব ঘুরেফিরে দেখছে। সেন্টমার্টিনের সবথেকে বড় লোকাল মার্কেট এটি।
উর্বী ঘুরেফিরে একটা চাদরে হাত দেয়। এগুলো পার্বত্য এলাকার মানুষের বুননকৃত শাল। তার মা আর শাশুড়ি রওশান আরার জন্য পছন্দ হয়েছে চাদরটি। সে বেছে বেছে দু’টো নিয়ে নেয় দু’জনের জন্য।
অন্য ভাবিরাও ঘুরতে ঘুরতে তার কাছে চলে আসে।
লামিয়া উৎসাহী হয়ে উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”বেশ সুন্দর তো! কার জন্য নিলে?”
_মা আর শাশুড়ি।
লামিয়া মৃদু হাসে। উর্বীর মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠতেই লামিয়া এসে ধরে ফেলে। মিতা চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”আরে ওকে কেউ বসিয়ে দাও।”
লামিয়া উর্বীকে বসিয়ে দেয়। মিতা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,”নাও এটা খাও।”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”ঠিক আছি আমি।”
মিতা বলে,”কি হয়েছে? মাথা ঘুরছে?”
_আসলে আজ অনেক বেশি ঘোরাঘুরি হয়ে গিয়েছে। একদিনে এত বেশি স্ট্রেস নিতে পারি না আমি।
রাবেয়া সাথে সাথে বলে ওঠে,”আমি ভেবেছি সুখবর আছে বোধহয় কোনো।”
সবাই উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। উর্বী বসে বসে নিজেকে ধাতস্থ করে। বাকিদের মশকরায় তার কোনো হেলদোল নেই। মৌমিতা বলে ওঠে,”তা উর্বী! প্লানিং করেছো কোনো?”
_কিসের প্ল্যানিং?
_ফ্যামিলি প্ল্যানিং!
সবাই দ্বিতীয় দফায় হাসতে থাকে।
উর্বী নিশ্চুপ। লামিয়া হাসতে হাসতে বলে ওঠে,” রাওনাফ কখনো করতে পেরেছে ফ্যামিলি প্ল্যানিং? ও কখনো প্ল্যান করে বাচ্চা নিতে পারেনি, শিমালাই পিল খেতে ভুলে যেতো। সবসময় হেসেছি আমরা বন্ধুরা এটা নিয়ে। কিন্তু রাওনাফ বরাবর সবকিছু খুবই দায়িত্বের সাথে সামলেছে। শিমালা প্রথম যখন কনসিভ করেছে তখন রাওনাফ স্টুডেন্ট ছিলো, শিমালা একবার চেয়েছিলো এ’ব’র’শ’ন করাতে। তখন রাওনাফ কি রাগটাই না করেছিলো শিমালার উপরে! সপ্তাহখানেক তো শিমালার সাথে রেগে কথাই বলেনি। রাওনাফ প্লান না করলেও তার পিতৃত্ব নিয়ে বরাবর এক্সাইটেড ছিলো। নাবিল শায়মীর পরে শিমালা একটা লম্বা গ্যাপ দিতে চেয়েছিলো। কারন নাবিল শায়মী জমজ ছিলো। কিন্তু বেশি গ্যাপ দিতে পারেনি, শর্মীর বেলায়ও শিমালা পিল খেতে ভুলে গিয়েছিলো। রাওনাফ সেবারও খুবই খুবই এক্সাইটেড ছিলো। রাওনাফ বরাবর বেস্ট ফাদার নামে স্বীকৃত আমাদের কাছে।”
উর্বী লামিয়ার কথা শুনে নিচু স্বরে বলে,”এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?”
লামিয়া হেসে ফেলে। রাবেয়া বলে,”লামিয়া এটা বলেছে তোমাকে বোঝাতে, প্ল্যান করার দরকার নেই অতশত। ইচ্ছে হলে বাচ্চা নিয়ে নাও। রাওনাফ ভাই খুবই চমৎকার একজন বাবা হবে! তোমার চিন্তা নেই!”
মিতা হাসছে। লামিয়া রাবেয়াকে থামিয়ে উর্বীর চোখে চোখ রেখে বলে,”অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বাচ্চা কিংবা বিয়ে। রাওনাফ খুবই দায়িত্বের সাথে সামলাতে জানে মৃদুলা উর্বী। এটাই বোঝাতে চেয়েছি।”
উর্বী লামিয়ার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”আমি উঠছি! রিসোর্টে ফিরবো।”
***
রাতের ডিনার শেষে যে যার রুমে ঢুকবে। উর্বী লবিতে একা দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফ সবার সাথে আগামী কালকের স্কেজিওল নিয়ে কথা বলছে। কাল তারা একটা পিকনিকের আয়োজন করেছে রিসোর্টে।
উর্বী একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেয়ালে পেইন্টিং দেখছে। তার শপিং ব্যাগ গুলো রাওনাফের হাতে। বাড়ির সবার জন্যই টুকটাক কিনেছে অনেক কিছু।
উর্বীকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উচ্ছাস। সে এই সুযোগটাই খুঁজছিলো। আশেপাশে কেউ নেই। বেয়াদপটাকে ঘা’ড় ধরে রুমে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে উচ্ছাসের। সে হাত মুঠো করে তার রা’গ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। উর্বী উচ্ছাসের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল।উচ্ছাস উর্বীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ রাওনাফ উর্বীর কাছে চলে আসে।
উচ্ছাস দাঁড়িয়ে পরে।
উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে রাওনাফকে বলে,”কথা শেষ হয়েছে আপনাদের?”
“হ্যা।”
রাওনাফ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে।
***
রাওনাফ দেখছে তার দিকে একজন ২৯-৩০ বছরের রুপবতী নারী এগিয়ে আসছে। পরনে তার বাসন্তী-লাল রঙের জামদানি শাড়ি। উর্বীর উচ্চতা কম। ছোটোখাটো আনন। আজ খানিকটা বেশি লম্বা দেখাচ্ছে। হাই হিল পরেছে হয়তো।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকাতেই সে বিব্রত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। খোপায় আবার গাজরা লাগিয়েছে। অতি সাধারণ বাঙালি মেয়েদের সাজ। অথচ উর্বীকে দেখে এতটা স্নিগ্ধ লাগছে! উর্বী খুব কাছে চলে আসে। রাওনাফ বন্ধুদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পরে।
উর্বীকে আসতে দেখে রাবেয়া বলে ওঠে,”এইযে এসে গিয়েছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি। যার জন্য এতো আয়োজন! ”
সবাই উর্বীর দিকে তাকায়।
উর্বীর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। সে যে বাড়তি সাজ হিসেবে চুলে এই গাজরা টা লাগিয়েছে এটা কি বেশি হয়ে গিয়েছে!
পার্টিতে অনেক অপরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছে। উর্বী এদের চেনে না। এখানে,এই অচেনা যায়গায় এতো অতিথি এরা পেলো কোথায় !
মিতা এসে উর্বীর হাত ধরে টেনে রাওনাফের কাছে নিয়ে যায়।
“সাজতে সাজতে এতো সময় লাগিয়ে দিলে এখন স্বামীর সাথে কেক কাটবে এসো।”
_কেক কেনো কাটবো?
অবাক হয়ে জানতে চায় উর্বী।
_আরে এই পিকনিক থুড়ি পার্টিটা তোমাদের অনারে রেখেছি আমরা। তোমাদের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা। এখন কেক কেটে একটু আমাদের উদ্ধার করুন আপনারা দুজন।
_এতো অতিথি! এরা কারা?
_এরা এই রিসোর্টের গেইস্ট। সবাই ইনভাইটেড আজ।
উর্বী অবাক হয়ে যায়। তাদের জন্য এতো আয়োজনের কি আছে! এখানে কি রাওনাফ আর উর্বীর বিয়ে হচ্ছে নাকি!
উচ্ছাস অনেকটা দূরে একটি চেয়ার পেতে বসে ড্রিংকস খাচ্ছে। তার শীতল দৃষ্টি উর্বীর দিকে। এতো সাজ,এতো জেল্লা মুখে ! সব স্বামীর জন্য। একটা নীরব পৈশাচিক হাসিতে উচ্ছাসের ঠোট প্রশস্ত হয়ে যায়।
রাওনাফের বন্ধুরা পার্টিতে আসা প্রত্যেক গেইস্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পার্টির আরম্ভ ঘোষণা করে দিয়েছে।
“কি হলো! কেইক কাটো।!”
মিতা ধমকের সুরে বলে ওদের। উর্বী ছুড়িটা কেকের উপর বসায় তখনই মৌমিতা রাওনাফকে বলে,”তুই এভাবে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? বৌয়ের সাথে কেক কাট!”
রাওনাফ ছুড়িটা ধরতে গিয়ে উর্বীর হাতের উপর হাত রেখে ফেলে। রাওনাফ খানিকটা বিব্রত বোধ করছে। উর্বীর কোনো ভাবান্তর নেই। সে নির্লিপ্ত হয়েই কেক কাটতে থাকে।
উচ্ছাস তাদের দেখছে। সে উর্বী আর রাওনাফের মুখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাদের হাতের দিকে তাকায়। একটা কাজ করলে কেমন হয়! ওই ছুড়িটা দিয়ে উর্বীর স্বামীর গ’লাটা কেটে দেবে সে?
***
মামুন বসে আছে। তার সাগরেদ রানা এসে তার সামনে দাঁড়ায়, “ভাই হারামজাদা নিচে পা’র্টি করছে।”
_কিসের পা’র্টি?
_জানি না,হোটেলের কোন মালদার গেস্ট আয়োজন করেছে। বিবাহোত্তর সংবর্ধনা। আমাদেরও দাওয়াত ছিলো।
_ওহহ। ওর সাথে ওই নেংটি ইঁদুর টা, সজীব না যেনো কি নাম। সে কোথায়?
_ওই কু’ত্তাকে আজ দেখছি না, হয়তো কোথাও ঘাপটি মেরে আছে।
_ আচ্ছা ওটাকে পরে দেখে নেবো,শোন,সময় সুযোগ বুঝে ওকে শেষ করবি। কাজ শেষে আনোয়ার আর রউফকে ঝাউবনের ওদিকটায় থাকতে বলবি। লা’শ’টাকে ওখান থেকে ভাসিয়ে দিবি।
রানা মাথা নাড়ায়। সে তার বসের কথামতোই সব কাজ করবে।
***
পার্টিতে সবাই মুগ্ধ হয়ে জাহাঙ্গীরের গান শুনছে। উর্বী অবাক হচ্ছে। এই লোক এতো সুন্দর গান জানেন! আচ্ছা রাওনাফের বন্ধুদের এক একজন এক এক গুনের অধিকারী। রাওনাফের ডাক্তারি করা ছাড়া আর কোন গুন আছে? মায়ের আদেশ পালন আর কিউট কিউট বাচ্চা তিনটাকে পড়াশোনার জন্য সবসময় বকাঝকা করা ?
কথাটা ভেবেই উর্বী নিজেই নিজেকে ধমকায়,”ছিঃ মৃদুলা উর্বী। একজন ভদ্রলোককে সবসময় এভাবে খোঁচা মারতে পারো না তুমি!”
গান শেষে সবাই কড়জোরে হাততালি দিচ্ছে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফও হাততালি দিতে দিতে উর্বীর দিকে তাকাতেই উর্বী অন্যদিকে চোখ ফেরায়।
সবাই এবার যে যার পার্টনারের সাথে হালকা মিউজিকের তালে তালে নাচছে । উর্বী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না,তার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।
উচ্ছাস আর অপেক্ষা করে না। একটা বাকা হাসি হেসে সে উঠে দাঁড়ায়। একটা গ্লাস হাতে উর্বীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরপায়ে। তার চোখে চশমা এবং মুখে মাস্ক।
উর্বী মিতা ভাবির সাথে কথা বলছে,”ভাবি আমি কিছু সময় নিড়িবিলি থাকতে পারি? আমার ভীষণ মাথাব্যথা করছে!”
_সেকি ! মাত্র তো পার্টি শুরু হলো।
_ভাবি শুধু ত্রিশ মিনিট!
উচ্ছাস ভিড়ের মধ্যে উর্বীর গা ঘেঁষে হেটে যাওয়ার সময় উর্বীকে ধাক্কা দিয়ে তার হাতের গ্লাসের শরবত টুকু উর্বীর গায়ে ফেলে দেয়।
_সরি ম্যাম সরি। আমি দেখতে পাইনি।
কন্ঠ যথাসাধ্য চাপিয়ে কথাটি বলে উচ্ছাস। রাওনাফ সেদিকে তাকায়।
উর্বী শাড়ি সামলাতে সামলাতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে চোখের আড়াল হয়ে যায়। পার্টির ঘোলাটে লাইটিং-এর জন্য আশেপাশে তাকিয়ে কিছু ঠাহর করতে পারছে না সে।
রাওনাফ এসে বলে,”কি হয়েছে উর্বী? তোমার শাড়ীটা তো নষ্ট হয়ে গেলো!”
_একজনের সাথে ধাক্কা লেগেছিলো। তার গ্লাস থেকে পরেছে।
কথাটি বলে উর্বী এদিক ওদিক তাকাতে থাকে।
_কি দেখছো?
_ জানেন লোকটাকে কেমন অদ্ভুত লাগলো, মুখে মাস্ক পরা।
_মুখে মাস্ক পরলেই অদ্ভুত! তার তো সর্দি কাশি থাকতে পারে। সেজন্য পরেছে।
_চশমা ছিলো! রাতেও সানগ্লাস!
_আই ইনফেকশন থাকতে পারে!
রাওনাফের কথায় উর্বী স্বস্তি পায়না। উর্বীর মন খুতখুত করছে।
লামিয়া বলে,”যাহ! হয়ে গেলো। আচ্ছা উর্বী যাও,তুমি শাড়ীটাও চেইঞ্জ করে এসো আর কিছুক্ষণ রেস্টও নিয়ে এসো। আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আজ অনেক রাত অবধি জাগবো।”
উর্বী মাথা নাড়ায়।
পাশ থেকে মৌমিতা বলে ওঠে,
_ডাক্তারকে পাঠাবো সাথে? না মানে ওষুধ দিতে আরকি! তোমার না মাথা ব্যাথা করছে?
হাসতে হাসতে কথাটি বলে সে।
উর্বী আস্তে করে বলে,”তার দরকার নেই।”
***
উর্বীর মনে হচ্ছে কে যেনো তার পিছু নিয়েছে। রিসোর্টের সবাই পার্টিতে। পুরো দালান নিশ্চুপ হয়ে আছে। পার্টি হচ্ছে রিসোর্টের বাগানে। এখান থেকে খানিকটা দূরেই বলা যায়। উর্বীর বেশ ভয় ভয় করছে। তবু সে তার রুমের দিকে এগোয়। রুমে ঢুকেই দরজা লক করে দেয় উর্বী।
শাড়িটা পাল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। একটু আরাম লাগছে এখন। দু’চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে।
দুমিনিট পরে তার রুমের দরজায় কেউ ধাক্কা দিতে থাকে।
কে আসতে পারে! নিশ্চয়ই ভাবীরা রাওনাফকে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়েছে। তাদেরও কাজ নেই কোনো।
উর্বী উঠে গিয়ে দরজা খোলে। দরজা খুলে সামনে তাকাতেই তার পুরো পৃথিবী ওলটপালট হতে শুরু করে, বুকের পাঁজর টনটন করে ওঠে। তার শরীর টা এতো কাপছে কেনো!
উচ্ছাস শীতল চোখে উর্বীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে রুমে প্রবেশ করেই উর্বীকে আগলে ধরেই দরজা লাগিয়ে দেয়। উর্বী কিছু বলতে পারছে না। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে শুধু। সে তার অনূভুতি বুঝতে পারছে না। তার শরীরে কি প্রান নেই!
উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী একটা কাঁপুনি দিয়ে ওঠে,ভেতর থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসতেই দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে,”মার্ডারার! রেপিস্ট!”
চলমান…..
#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৭
#Esrat_Ety
“মার্ডারার, রেপিস্ট।”
শব্দ দুটি উচ্চারণ করে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে উর্বী।
উচ্ছাস উর্বীর গালদুটো হাত দিয়ে আগলে ধরে নরম গলায় বলে,”পালাতে চাও আমার থেকে?”
উর্বী নিজের হুশ ফিরে পায়।
সে দুহাত দিয়ে উচ্ছাসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু উচ্ছাসের শক্তির কাছে সে অপারগ।
সে কাঁদছে, বাঁধভাঙা কান্না। উচ্ছাস উর্বীর কান্না উপেক্ষা করে বলতে থাকে,”ত্রিশের উর্বীকে ঠিক তেইশের উর্বীই লাগছে। একটুও বদলায়নি তোমার সৌন্দর্য।”
উর্বী কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে ওঠে,উচ্ছাসকে কাঁপা গলায় বলে,”আমাকে ছেড়ে দাও তুমি দয়া করে। চলে যাও তুমি এখান থেকে। আমার জীবন থেকে।”
উচ্ছাস উর্বীর কথা শুনতেই সজোরে একটা থাপ্পড় মারে উর্বীর গালে, উর্বী চ’ড়ের ধাক্কা সইতে না পেরে মেঝেতে পরে যায়। সে সেখানেই চুপ করে পরে থাকে। তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে।
উচ্ছাস গিয়ে উর্বীর চুল মুঠি করে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”টাকা চিনেছিস তুই! ফালতু মেয়ে, গোল্ড ডিগার। ছলনাময়ী।”
উর্বী কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,”হ্যা আমি তাই। তুমি চলে যাও এখান থেকে। আমাকে আমার মতো বাঁচতে দাও।”
উচ্ছাস এবার উর্বীর চুল ধরে টেনে তোলে। তারপর আরেকটা চ’ড় মে’রে দেয় উর্বীকে। উর্বী টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় পরে।
উচ্ছাস এসে উর্বীকে বিছানার সাথে চে’পে ধরে।
“নিজের মতো বাচবি? তোর স্বামীকে নিয়ে? সে আর এজন্মে হচ্ছে না। তোর স্বামী ভেবে তোর দেবরকে ছু’ড়ি মেরেছিলাম জানিস? এবার তোর স্বামীকেই মা’রবো।”
উর্বী অবাক হয়ে দেখছে উচ্ছাসকে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, এটাই কি সেই উচ্ছাস! এসব কি শুনছে সে!
নিজেকে উচ্ছাসের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলতে থাকে,”ছিহঃ তুমি এত্তো নিচ! ছাড়ো আমাকে,ছেরে দাও তুমি। আমার ঘেন্না লাগছে তোমাকে। ঘেন্না করি তোমাকে আমি।”
উচ্ছাস হাসতে হাসতে বলে,
“ছেরে দেবো?
উর্বী দম নিতে পারছে না। গাল বেয়ে তার অঝোরে পানি ঝরছে।
উচ্ছাস নিশ্চুপ উর্বীকে কাঁদতে দেখে। এই মেয়েটার ওপর সে এতটা ক’ঠিন কি করে হচ্ছে! সে দুর্বল হয়ে পরতে চায়, কিন্তু না,তাকে দুর্বল হলে চলবে না।
উর্বী বলতে থাকে,”ঘৃণা করি তোমাকে শুধু। এটুকু কেন মেনে নিতে পারছো না।”
উচ্ছাস উর্বীর সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে তার কপালে চুমু দিতে উদ্যত হয়। উর্বী তাকে বাধা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে,কেঁদে বলে ওঠে,”উচ্ছাস দোহাই লাগে তোমার,আমি এখন অন্য কারো স্ত্রী। এতটুকু বোঝার চেষ্টা করো।”
উচ্ছাস থেমে যায়, কিছুসময় উর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে বসে। উর্বী একই ভাবে পরে থাকে নিস্তেজ হয়ে। উচ্ছাস নরম গলায় বলতে থাকে,”ওটা কোনো বিয়ে না। ভুল করেছো। মাফ করেছি। এবার সব চুকিয়ে ফেলবে।”
“কি চুকিয়ে ফেলবো আমি?”
উর্বী চেঁ’চি’য়ে ওঠে।
_তালাক দেবে স্বামীকে।
_তোমার কথায়?
_হ্যা।
উর্বী উঠে বসে। চোখের পানি মুছে উচ্ছাসের দিকে তাকায়। মুহুর্তেই তার চোখে মুখে কাঠিন্যতা ছেয়ে যায়। কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,”দেবো না। কি করবে তুমি?”
উচ্ছাস হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে চুপ হয়ে যায়। কোনো উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করে না সে।
_আমার স্বামীর কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা তুমি করবে না উচ্ছাস।
তেজী কন্ঠে বলে উর্বী।
উচ্ছাস আবারও হাসে, হাসি থামিয়ে বলে, “খুউব প্রেম না? খুউউউব প্রেম? বুড়ো স্বামী একেবারে মন ভরিয়ে দিয়েছে দেখছি!!”
উর্বী দুচোখ বন্ধ করে বলে,”ছিহ! কি চাও তুমি?”
_তোমার স্বামীকে তালাক দিয়ে আমার কাছে চলে আসবে। ব্যস এটুকুই।
_অসম্ভব!
উর্বী চেঁচিয়ে ওঠে।
_আমি কোনো রে’পি’স্ট,খুনীর কাছে ফিরবো না। ম’রে গেলেও না।
উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উর্বীর সামনে হাটু গেড়ে বসে উর্বীর চোখে চোখ রাখে। নরম কন্ঠে বলে,”রে’পিস্ট? উর্বী একটা ইন্সিডেন্ট দিয়ে তুমি আমার গোটা অনূভুতিকে জাজ করে ফেললে।”
উর্বী চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”উচ্ছাস আটটা বছর ন’র’কযন্ত্রণা ভোগ করেছি। ম’রতে চেয়েও পারিনি ভীতু বলে। কিন্তু জানো,বর্তমানে কেন জানি খুব জীবনের প্রতি টান অনুভব করতে শুরু করেছি। এখন আমি একটু বাঁচতে চাই, তোমার থেকে বাঁচতে চাই। আমাকে একটু বাঁচতে দাও।”
উচ্ছাস উর্বীর পা ধরে,”এই উর্বী তুমি আমায় একটু দয়া করো উর্বী। মাফ করো আমায়। জানো আমার না কেউ নেই। জানো তো?”
উর্বী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে।
উচ্ছাস উর্বীর কোলে মাথা রাখে। বাচ্চাদের মতো নরম গলায় বলে,”আমি আর তোমাকে জালাতন করবো না উর্বী। তুমি যেভাবে চলতে বলবে আমি সেভাবে চলবো। একটা চাকরি নেবো। দুজনে সুন্দর একটা সংসার সাজাবো উর্বী। যা হয়েছে ভুলে যাও একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে। তুমি ছাড়া আমাকে কেউ বোঝে না উর্বী। তুমিও যদি আমায় না বোঝো। আমি বড্ড অসহায়। আমাকে একটু শান্তি দাও না উর্বী। তোমার কাছে আমি ভিক্ষা চাইছি।”
উর্বী উচ্ছাসের মাথার দিকে তাকায়। তারপর বিছানার চাদর খামছে ধরে বসে থাকে।
***
মামুন বুঝতে পারছে না এতক্ষন ধরে উচ্ছাস ২০৪ নাম্বার রুমে কি করছে ! যাই হোক। গোটা রিসোর্ট ফাঁকা। টপকালে এখনই টপকাতে হবে।
রাওনাফ চুপচাপ বসে আছে। জাহাঙ্গীর এসে পাশে বসে। রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিরে। ভাবির খোজ নিয়েছিস ? মাথা ব্যাথা কমেছে?
_না,ফোন দিইনি। ঘুমাচ্ছে বোধ হয়,ঘুমাক।
জাহাঙ্গীর খুকখুক করে কাশে। রাওনাফ সেদিকে তাকায়, বলে,
“কি কিছু বলবি?”
_না মানে, সত্যি করে বলতো আমায়, ভাবীর সাথে তোর তেমন কোনো ইন্টিমেসি গড়ে ওঠেনি তাইনা?
রাওনাফ রেগে যায়,”আচ্ছা তোরা কি আমাদের দুজনকে নিয়ে গবেষণা করতেই এখানে এসেছিস? নিজেদের নিয়ে থাক না! যা গিয়ে ভাবীকে সময় দে।”
জাহাঙ্গীর ভয় পাওয়া গলায় বলে,”আচ্ছা এই বাদ দিলাম। প্লিজ রেগে যাস না। আমাদের চিন্তা হয় তো।”
রাওনাফ কিছু বলে না,ফোনের দিকে তাকায়। আধা ঘন্টার বেশি হয়ে গিয়েছে। উর্বী কি ঘুমাচ্ছে! ঘুমাচ্ছেই বোধ হয়। থাক ফোন দিয়ে কাজ নেই। রুমে আছে রুমে থাকুক। এখানে এলেই তো সবাই মিলে আবার বিরক্ত করা শুরু করবে।
***
উর্বী নীরব। উচ্ছাস তার কোল থেকে মাথা উঠিয়ে তার পাশে বসে, হাত দিয়ে উর্বীর দুই গাল ধরে বলে,”তুমি বলো,আমার কথা শুনবে না?।”
এক ঝটকায় উচ্ছাসের হাত সরিয়ে দেয়,”তুমি এই মুহুর্তে এখান থেকে চলে যাও। এক্ষুনি।”
উর্বীর ফোন বেজে উঠছে। রাওনাফ ফোন দিয়েছে। উর্বী ফোনটা রিসিভ করতে যায় কিন্তু উচ্ছাস ছিনিয়ে নেয় ফোন। চেঁচিয়ে উঠে উর্বীকে বলে, “তুমি আমাকে কঠিন হতে বাধ্য কোরো না উর্বী। বলো তুমি তোমার স্বামীকে তালাক দিয়ে আমার কাছে ফিরবে। তাহলে কিন্তু তোমার স্বামীরও কোনো ক্ষতি আমি করবো না।”
উর্বী চেঁচিয়ে ওঠে,”শর্ত দিচ্ছো তুমি আমায় ! শর্ত ! তারপর কি হবে? শর্ত অনুযায়ী তোমার সাথে শু’তে হবে? সারাজীবন তোমার রক্ষিতা হয়ে থাকতে হবে? যেমন টা তুমি চেয়েছিলে। কারন তোমার তো বিয়ে করে কাউকে স্বীকৃতি দেওয়ার মুরোদ নেই। আছে শুধু রে’ইপ করার।”
রাওনাফ ফোন দিয়েই যাচ্ছে। উচ্ছাস উর্বীকে ফোন ধরতে দিচ্ছে না। উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“করবো বিয়ে তোমায়। সত্যিই বিয়ে হবে আমাদের। তুমি শুধু একবার রাজি হও।”
_মরে গেলেও না। কারন আমি বিবাহিতা, বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার এবং বিয়ে যদি নাও হতো তবুও একটা রে’পিস্টকে কখনোই বিয়ে করতাম না আমি।
চেঁচিয়ে বলে উর্বী। উচ্ছাস বলে,”রেপিস্ট কে বিয়ে করবে না? বুঝলাম। তবে এটা কোন বিয়েতে আটকে আছো তুমি? চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্ক।
উর্বী হাসে,হাসতে হাসতেই বলে,”কোনটা চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্ক? সজ্ঞানেই কবুল বলেছি আমি। আমি কবুল না বলতে চাইলে আমার ভাইয়ার সাধ্যি ছিলো না আমাকে দিয়ে কবুল বলানোর।
তুমি আমার সাথে বরাবর যা করেছো সেটা চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্ক। আর তুমি ঠিক বলেছো, এই বিয়েটা করা একদিক থেকে ভুলই ছিলো আমার। সত্যিকার অর্থে ভুলটা হলো ঐ ভালো মানুষটাকে আমার এই জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলা। ওটাই একমাত্র ভুল। উচিৎ হয়নি আমার।
উচ্ছাস তাকিয়ে আছে। উর্বী বলতে থাকে,”আমার স্বামী ভুল না। যদিও আমি তাকে চাইনি। হয়তো আল্লাহ চেয়েছেন।”
_স্বামী?
_হ্যা। উনি আমার স্বামী। শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে হয়েছে আমাদের। ঐ অতটুকুই পবিত্রতা,সান্ত্বনা,স্বচ্ছতা আছে আমার জীবনে এখন পর্যন্ত, যে আমি কারো সাথে বৈধ সম্পর্কে আছি। আর কোথাও কোনো পবিত্রতা নেই আমার। তুমি থাকতে দাওনি। এবার অন্তত আমাকে মুক্তি দাও। সব শেষ। তুমি শেষ করেছো, আমি শেষ করেছি। জেল খেটেছো,জামিন পেয়েছো এখন একটা সুন্দর জীবনে ফিরে এসো। আমাকেও এই জীবনে থাকতে দাও যে জীবনে আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। দোহাই তোমার।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে উর্বী থামে, তারপর আবার কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করে,”আর তুমি! তুমি অভিশাপ হয়েই থাকবে আমার জীবনে! যার আমার জীবনে আসার প্রয়োজন ছিলো কেবল আমার শরীর, জীবন নোংরা করতে। অন্য কোনো গুরুত্ব তুমি বহন করো না আমার জীবনে। জেনে নাও তুমি। আর ঐ বাচ্চাটা……”
থেমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে উর্বী। অঝোর ধারায় কাঁদছে সে। শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। একটা গোঙানির মতো শব্দ বের হচ্ছে।
উচ্ছাস নরম গলায় বলে,”উর্বী। লাইফ সবাইকে সেকেন্ড চান্স দেয় না। আমাকে দিয়েছে। খুব একটা দেরি হয়নি। চলো এবার সংসার করি। আমি যা করেছি তার জন্য সত্যিই আমি অনুতপ্ত।”
_কিসের অনুতপ্ত? সেই এক প্রতিহিংসা, সেই আগের মতো আমার চুলের মুঠি ধরা, পাগলা কুত্তার মতো আচরণ করা। এসব তোমার অনুতাপ? একজনকে ছু’ড়ি মে’রে মারতে চেয়েছিলে ওটা অনুতাপ?
_এসব তোমার জন্য উর্বী। তুমি কেন কখনো বুঝতে পারো না।
_না আমি বুঝতে চাই না। কখনোই কিছু বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারলে এসব কিছুই হতো না আমার সাথে। নিজের সাথে যা হয়েছে সবকিছু মেনে নিয়েছি। ওসব হবারই ছিলো। অদৃষ্টকে কেউ বদলাতে পারে না,আর সেটা নিজের দোষে হলে তো কথাই নেই। তবে ঐ উপরে যিনি আছেন তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, উর্বী তুমি যাকে নিজের জন্য পছন্দ করেছো আমি না চাইলে সেটা তোমার জীবন ধ্বংসের কারণই হবে। আমি যে তোমার জন্য অন্য কাউকে বেছে রেখেছি।
উচ্ছাস শীতল চোখে তাকিয়ে ছিলো ,রাগে ক্ষোভে আবারও উর্বীর চুলের মুঠি ধরে,উর্বী নিজেকে ছাড়াতে চায়। পারে না।
“খবরদার আমাকে রাগাস না। খবরদার ! নয়তো এখানে স্বামী স্ত্রী দুটোকে পু’তে রেখে দেবো।”
উর্বী অসহায়ের মতো উচ্ছাসের দিকে চায়।
“বাহহ! এইতো এলে আসল রুপে। এতক্ষন নরম গলায় নাটক করছিলে!”
উচ্ছাস দাঁত কিরমির করে বলে,”বল তালাক দিবি কি না স্বামীকে।”
_না। দেবো না।
তেজী কন্ঠে বলে ওঠে উর্বী।
তক্ষুনি কেউ দরজা ধাক্কাতে থাকে।
উচ্ছাস হেসে বলে,”ওই যে তোমার স্বামী এসেছে। এবার তোমার চোখের সামনেই ওটাকে শেষ করবো। তারপর জেলে যাবো।”
কথাটি বলেই উচ্ছাস প্যান্টের পকেট থেকে এক টান দিয়ে একটা রিভলবার বের করে। উর্বী শিউরে ওঠে। লাফ দিয়ে উচ্ছাসের সামনে দাঁড়ায়। তারপর উচ্ছাসের পা ধরে,”তোমার দোহাই লাগে ওনাকে কিছু করবে না। উচ্ছাস আমি দয়া চাইছি।”
উচ্ছাস নির্বিকার চিত্তে ধাক্কা দিয়ে উর্বীকে সরিয়ে দেয়। উর্বী মেঝেতে পরে গেলেও উঠে দাঁড়ায়। তার বুক থেকে শাড়ীর আঁচল পরে যায়। সে গিয়ে দরজা আটকে দাঁড়ায়,”না! তুমি এটা করতে পারো না উচ্ছাস।”
উচ্ছাস হাসে,”পারি।”
শব্দটা উচ্চারণ করে উচ্ছাস উর্বীর ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তারপর দরজা খুলে দেয়।
***
রাওনাফ হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এতবার কল করে নিজের কাছেই কেমন যেন লাগছে তার। কিন্তু উর্বী ফোন ধরেনি কেন! হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। ঘুমাক।
দরজা খুলেই উচ্ছাস দেখতে পায় মামুন দাঁড়িয়ে আছে তাদের দিকেই একটা রিভলবার তাক করা ।
মামুন একবার উচ্ছাসকে দেখে, একবার উর্বীকে দেখে । উর্বী দ্রুত শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে নেয়।
মামুন বাকা হাসি দিয়ে বলে,”ও এই ব্যাপার! তুই এখানে নটি নিয়ে ফুর্তি করছিস। আমি ভেবেছি কি না কি!”
উচ্ছাস চেঁচিয়ে বলে,”মুখ সামলে কথা বল শু’য়ো’রের বাচ্চা নয়তো এখানেই পু’তে দেবো তোকে।”
_পুতবো তো তোকে আমি আজ। তোর এই নটিকে বল ম’রতে না চাইলে এখান থেকে দশ সেকেন্ডে কেটে পরতে।
উর্বী ভয়ে গুটিয়ে আছে। মামুন উর্বীর দিকে হায়েনার মতো তাকায়, যেনো চোখ দিয়ে গিলে খেতে চাচ্ছে।
উচ্ছাস চেঁচিয়ে ওঠে,”ওর থেকে চোখ নামা। চোখ গেলে দেবো তোর।”
মামুন এবার লাফ দিয়ে উর্বীকে ধরে, তারপর রিভলবার উর্বীর মাথায় ঠেকায়।
উচ্ছাস চেঁচিয়ে ওঠে,”ওর কিছু হলে আমি তোর বাপ মা সহ কবর দিয়ে দেবো তোকে কসম।”
মামুন হাসে,”বাহ! এতো প্রেম। তবে তো এটাকেই আগে মারবো।”
কথাটি মামুন শেষ করতে পারেনা, তার আগেই উচ্ছাসের রিভলবারের গুলি এসে তার গলা ভেদ করে চলে যায়।
মামুন মুখ থুবড়ে মাটি তে পরে যায়।
উর্বী মুখ ঢেকে বিকট চিতকার দিয়ে ওঠে।
পার্টিতে উচ্চ ভলিউমে মিউজিক বাজছে। কেউই শুনতে পায়না গুলির শব্দ, রাওনাফ শুনতে পায়না উর্বীর সে চিতকার।
রিসিপশনিস্ট মেয়েটি ঘাবড়ে যায়, গুলির শব্দ মনে হচ্ছে! সে ভয় পেয়ে রিসিপশনের এলার্ট বেল টিপতে থাকে।
রিসোর্টের কিছু কর্মী বাইরে থেকে ছুটে আসে। এরা সবাই ভয় পেয়েছে। এখন কি করবে ! আওয়াজটা চারতলা থেকে এসেছে। গিয়ে দেখবে? কিন্তু অযথা জীবনের ঝুকি নিয়ে লাভ কি,তারচে বরং পুলিশ কে ফোন দেওয়া যাক। একজন স্টাফ টেলিফোন লাইনের কাছে গিয়ে পুলিশ স্টেশনে ফোন লাগায়।
উর্বী কাঁপছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বিরবির করছে,”মেরে দিলে।”
তার শরীর ভেঙে নিচে পরে যেতে চাইছে।
_আমি না মে’রে দিলে ও তোমাকে মেরে দিতো।
_তাই বলে তুমি!
উর্বী আর কিছু বলতে পারছে না। সে মাটিতে লুটিয়ে পরে।
উচ্ছাস গিয়ে উর্বীর হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে আর বলে,”চলো। সময় নেই। এখানে এখন বিরাট ঝামেলা লেগে যাবে। তার আগে যেতে হবে।”
উর্বীর মাথা বনবন করছে। সে অসহায়ের মতো চারদিকে তাকাতে থাকে।
_কি হলো চলো।
ধ’ম’কে ওঠে উচ্ছাস।
_কোথায় যাবো আমি! একটা খুনীর সাথে কোথায় যাবো? তুমি একটা সাক্ষাৎ পি’শাচ।
_হ্যা আমি তাই।
কথাটি বলে উচ্ছাস উর্বীকে জোর করে তোলার চেষ্টা করছে। উর্বী নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে উচ্ছাসকে আটকাতে চায়।
উচ্ছাস উর্বীর চুলের মুঠি ধরে টেনে হিচরে রুম থেকে বের করার চেষ্টা করছে। উর্বী অনবরত উচ্ছাসের বুকে কিল চড় মারতে থাকে। তাতে উচ্ছাসের কোনো ভাবান্তর হয়না,তার বলিষ্ঠ শরীরে কোনো প্রভাব পরে না। সে উর্বীকে টানছে তো টানছেই।
সজীব দৌড়ে এসে বলে,”ভাই! কি করছেন আপনি!”
তারপর মামুনের লা’শ দেখেই মুখ চেপে ধরে। সে এই ভয়টাই পেয়েছিলো।
সজীব তোতলাতে তোতলাতে বলে,”ভাই, কি করছেন ভাই। ওকে ছাড়েন ভাই। নিচে পুলিশ আসছে হয়তো। আর দুই মিনিট দেরি করলে আপনি আমি দুজনেই শেষ। ওকে ছাড়েন ভাই,ওকে পরে দেখার মেলা সময় পাবেন।”
উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কাজ টা ঠিক করলে না তুমি, একেবারেই ঠিক করলে না। এই জন্মে উচ্ছাসের ছায়া সরাতে পারবে না নিজের শরীর থেকে। আমি মরলে ভিন্ন কথা ”
উর্বী ঘোলাটে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে।
সজীব বলে,”ভাই এদিকে ইমার্জেন্সি এক্সিট আছে একটা। এদিকে আসেন।”
কথাটি বলে সজীব মামুনের লা’শের পকেট থেকে ফোন,মানিব্যাগ এবং আ’ই’ডিকার্ড নিয়ে নেয়।
উচ্ছাস উর্বীর দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকায়,তারপর সজীবের পিছু নেয়।
***
পার্টির মিউজিক অফ হয়ে যায়। এটা কিসের চেঁচামেচি হচ্ছে। সব গেস্টরা কৌতূহলী হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।
রিসোর্টের একজন স্টাফ দৌড়ে আসছে এদিকেই, সে চেঁচিয়ে বলছে,”চারতলায় গুলির আওয়াজ হয়েছে । পুলিশ এসেছে পুলিশ। আপনারা সাবধানে থাকুন সবাই।”
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলছে এ!!
রাওনাফের বন্ধুরা হতবাক হয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর প্রায় দৌড়ে রিসোর্টের দিকে যেতে থাকে। তার এতো ভয়
হচ্ছে কেনো! উর্বীর কথা ভেবে তার বুকে এতো ব্যাথা হচ্ছে কেনো !
বাকিরা সবাই তার পিছু নেয়।
রিসোর্টের লবিতে পুলিশ রাওনাফকে আটকায়।
_আপনি কোথায় যাচ্ছেন। আগে আমাদের দেখতে দিন বিষয়টা।
_উপরে আমার স্ত্রী একা রয়েছে। আমাকে যেতে দিন।
উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে ওঠে রাওনাফ।
_আপনি অপেক্ষা করুন। আমরা দেখছি তো!
রাওনাফের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়,সে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
“বললাম না! আমার স্ত্রী আছে,আমাকে যেতে হবে!”
কনস্টেবল আর কিছু বলে না। রাওনাফ উপরে উঠতে থাকে। তিনজন কনস্টেবল তার পিছু নেয়।
উর্বী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে আছে। চুল এলোমেলো। শরীরে আঘাতের চিহ্ন।
তার পায়ের কাছে পরে আছে মামুনের লা’শ।
রাওনাফ রুমে ঢুকেই সে দৃশ্য দেখে “উর্বী” বলে চেচিয়ে ওঠে।
কনস্টেবল তিনজনও রুমে ঢোকে।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায় না। সে যেনো কারো কথা শুনতে পাচ্ছে না।
কনস্টেবলের মধ্যে একজন বলে ওঠে,”ও মাই গড! লাশ!”
রাওনাফ ছুটে গিয়ে উর্বীর শাড়ির আঁচল উঠিয়ে তার গায়ে জরিয়ে দেয়। উর্বী চুপ হয়ে আছে।
রাওনাফ উর্বীর কাঁধ ধরে ধাক্কা দেয়,”উর্বী! উর্বী!”
উর্বী যেনো আঁতকে উঠে রাওনাফের দিকে তাকায়।
রাওনাফ কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। কিভাবে উর্বীকে স্বাভাবিক করবে সে!
রাওনাফ কিছু বলে ওঠার আগেই উর্বী একটা বিকট চিৎকার দিয়ে রাওনাফকে জরিয়ে ধরে। সে কাঁদছে। ঠিকভাবে নিশ্বাস নিতে পারছে না। রাওনাফ বোকার মতো আশেপাশে তাকাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পরে জড়তা কাটিয়ে উর্বীকে দুহাত দিয়ে আগলে ধরে। ধীরে ধীরে ডান হাত উর্বীর মাথায় রেখে অস্ফুট স্বরে বলে,”কাম ডাউন। সব ঠিক আছে! কিচ্ছু হয়নি।”
উর্বী শান্ত হয়না। সে রাওনাফের শার্ট খামচে ধরে কাঁদতে থাকে।
কনস্টেবল তিনজন কিসব বলাবলি করছে। রাওনাফ তা শোনে না। তার এই মেয়েটির জন্য উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে।
চলমান…..