#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১২
#Esrat_Ety
রাওনাফ একদৃষ্টে উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। লামিয়া হালকা কেশে রাওনাফের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করে,রাওনাফ বিব্রত ভঙ্গিতে চোখ সরিয়ে লামিয়ার দিকে তাকায়। লামিয়া নিচু স্বরে বলে ওঠে,”পুরুষ বিয়ে করে বৌ আনে,তুমি পেশেন্ট এনেছো। তোমার পার্মানেন্ট পেশেন্ট।”
রাওনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও উর্বীকে দেখে। লামিয়ার কথার জবাব না দিয়ে বলে,”টেস্ট গুলো করাতে হবে।”
_হুম।
মৃদু আওয়াজ করে লামিয়া উর্বীকে মিনিট দুয়েক পর্যবেক্ষণ করে রাওনাফকে বলে ওঠে,”তবে একটা কথা বলতেই হয় রাওনাফ। তোমার বৌ ভাগ্য কিন্তু চমৎকার! শিমালাও সুন্দরী ছিলো,আর উর্বীও।”
রাওনাফ কপাল কুঁ’চ’কে লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা মজা করার সময়?”
লামিয়া হেসে ফেলে,মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,”অবশ্যই না। তবে এভাবে তোমার বৌয়ের মুখ দেখবো ভাবিনি। কলিগের বৌয়ের মুখ অচেতন অবস্থায় দেখে কি উপহার দেবো সেটাই বুঝতে পারছি না! আচ্ছা এর এক্সাক্ট বয়স কত? বললে ত্রিশ! আমার আরো কম মনে হচ্ছে! হয়তো রোগা বলে! নয়তো মেইনটেইন করে নিজেকে!”
রাওনাফ হাতের ফাইল গুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। একটু পরে তার ও.টি. , পেশেন্টের রিপোর্ট গুলোতে চোখ বোলাতে বোলাতে আবারও উর্বীর দিকে তাকায়। কেনো তাকালো তা রাওনাফ জানে না। লামিয়া বলতে থাকে,”এত এত পাত্রী দেখলাম আমরা ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই তোমার জন্য। রাজি হলে না। শেষ মেষ ছোটো ভাইয়ের জন্য পছন্দ করা পাত্রীকে মায়ের কথায় বিয়ে করে নিলে। এর পেছনে সলিড একটা যুক্তি দেখাতে পারছো না!”
রাওনাফ লামিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে হাতের ফাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে খুবই শান্ত ভাবে বলে,”যুক্তি নেই। মায়ের খামখেয়ালিপনা ছিলো। আর ক্লিন ইমেজের রাওনাফ করিম খানকে আজীবন সবাই পচাবে তার জন্য একটা সলিড রিজনের প্রয়োজন ছিলো।”
লামিয়া হেসে ফেলে, বলে,”মোটেও পচাইনি তোমাকে। আমি খুশি। ইনফ্যাক্ট আমরা বন্ধুমহলের সবাই খুশি হবো। তুমি শুধু শুধু জাহাঙ্গীরদের জানাতে দিচ্ছো না।”
_দেশে ফিরুক! এলেই দেখতে পারবে।
লামিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে থেকে বলে ওঠে,”যে ফিলোসফি টা আমি সবসময় আওরাই সেটা আমি এখনও আওরাবো,”Everything that happens in this world has a strong reason.”
হাতের রিপোর্ট টা হেড নার্সের হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাওনাফ পেশেন্টকে ও.টি. তে ঢোকানোর নির্দেশ দেয়।
তারপর রাওনাফ লামিয়াকে বলে,”হু। ঐ যে বললাম আমাকে সবাই পচাবে। তার একটা রাস্তা তৈরি করে দিলাম! এজন্যই সবকিছু ঘটেছে!”
নার্স চলে গেলে রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। জ্ঞান ফেরেনি এখনও। স্যালাইন চলছে। লামিয়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে আড়চোখে রাওনাফকে দেখে বলে,”আমি আছি এখানে। কিছু হবে না তোমার বৌয়ের। তুমি যাও, ও.টি. শেষ করে এসো! বরাবর বৌ পাগলা রয়ে গেলে!”
রাওনাফ লামিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,”তোমার কি মনে হয় না বয়স বাড়ার সাথে সাথে তুমি একটু বেশিই ফাজিল হচ্ছো?”
লামিয়া মাথা নেড়ে কাট কাট বলে ওঠে,”না।”
রাওনাফ কিছু না বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। লামিয়া মাথা ঘুরিয়ে উর্বীকে দেখে। তার পাশে দুজন এ্যাসিস্ট্যান্ট নার্স দাঁড়িয়ে। নিচু স্বরে লামিয়া তাদের বলে,”তোমাদের স্যারের ওয়াইফকে কেমন লাগছে? মানিয়েছে না স্যারের পাশে?”
_জি ম্যাম। খুব মানিয়েছে।
প্রফুল্ল চিত্তে নার্স দুজন জবাব দেয় লামিয়ার প্রশ্নের।
****
চেতনা ফিরে পেতেই নাকে কড়া মেডিসিনের গন্ধ এসে লাগে। চোখ খুলে তাকানোর আগেই সে বুঝে যায় তার অবস্থান। অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা চারদিকে। অলসতার কারনে চোখ মেলে তাকায়না। কিংবা তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনা।
“মনে হচ্ছে তোমার এই চাকরি টাও বেশিদিন টিকবে না মৃদুলা উর্বী!”
রাওনাফের গম্ভীর কন্ঠস্বর কানে যেতেই উর্বী চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে। প্রথম বার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় বার সফল হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায় রাওনাফ কেবিনের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। দৃষ্টি জানালার বাইরে নিবদ্ধ। উর্বী নড়েচড়ে উঠে বসতে গিয়ে ডান হাতের পিঠে সুক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। তার হাতে ক্যানুলা লাগানো ছিলো। মুখে “আহ” উচ্চারিত হতেই রাওনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় উর্বীর দিকে। কফির মগ রেখে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে উর্বীর হাত থেকে ক্যানুলা সরিয়ে দেয়।
একপলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”আমরা খুব ভালো হাসবেন্ড ওয়াইফ হতে পারবো কিনা তা তো জানি না মৃদুলা উর্বী, তবে আমরা কখনওই খুব ভালো ডক্টর এ্যান্ড পেশেন্ট হতে পারবো না যদি না তুমি কো-অপারেট করো। চলো ওঠো, কিছু টেস্ট করাতে হবে তোমার।”
উর্বী তার সামনে বসে থাকা শান্ত স্বভাবের মানুষটাকে কিছু সময় দেখে। তারপর ধীরে ধীরে বেড থেকে নেমে পরে বাধ্য মেয়ের মতো। সে টের পেলো তার শরীরে আর কোনো দুর্বলতা অনুভব করছে না সে। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”নার্স ডাকবো? আমার তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে একাই যেতে পারবে তুমি।”
_জি পারবো। আ’ম ফাইন!
_বেশ, চলো।
ইমেজিং রুমে পুরোটা সময় রাওনাফ উর্বীর পাশেই ছিলো। উর্বী মাঝে মাঝে আড়চোখে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ রেডিওলজি বিভাগের প্রধানের সাথে কথা বলছে। কি বলছে উর্বী তা শুনতে পাচ্ছে না। ভেতর থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস বেরিয়ে যায় উর্বীর। তার ম্যারমেরে জীবনে রাওনাফ নামের লোকটির ভূমিকা কি হতে চলেছে? বুঝতে পারছে না সে।
***
“সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা
রঙ ছিল ফাল্গুনি হাওয়াতে
সব ভালো লাগছিল চন্দ্রিমায়
খুব কাছে তোমাকে পাওয়াতে”
উর্বী মাথা তুলে তাকায়। তার ঘরের সোজাসুজি কোনো ঘর থেকে গানটির আওয়াজ ভেসে আসছে। সম্ভবত সামিউল আর অন্তরা গান শুনছে। এ বাড়িতে তারা ব্যতীত এসব গান শোনার মতো কেউ নেই। উর্বী ম্লান হেসে হাতের বই রেখে উঠে দাঁড়ায়। তার ভালোই লাগে অন্তরা-সামিউল জুটিটাকে। টোনাটুনি জুটি। উর্বী সিদ্ধান্ত নিয়েছে রওশান আরাকে আবারও সে অনুরোধ করবে যাতে সে অন্তরাকে মেনে নেয়। এভাবে একই বাড়িতে আলাদা সংসার পেতে খাচ্ছে,এটা মোটেও ভালো লাগছে না উর্বীর। কোনো অপরাধ তো তাদের নেই। দোষ যা ছিলো সব রওশান আরার। তিনি ছেলের মতিগতি না জেনেই বিয়ে ঠিক করেছিলেন অজ্ঞ মানুষের মতো, জোর জবরদস্তি করেছেন, যেটা সম্পূর্ণ অনুচিত। এটা ঐ বৃদ্ধা মহিলাকে কে বোঝাবে!
উর্বী উঠে দাঁড়ায়। শরীর যতটা খারাপ থাকার কথা ততটা খারাপ নেই। বরং বেশ ভালো ঠেকছে তার। আলগা হয়ে যাওয়া খোঁপা খুলে নতুন করে খোপা বেঁধে নিয়ে নিচতলায় যায়।
খাবার টেবিলে রাওনাফ করিম খানের মাতা এবং তিন ছানা বসে রাতের খাবার খাচ্ছে। উর্বীকে দেখে রওশান আরা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে ওঠে,”একি! তুমি নেমে এলে কেনো? খাবার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম মা।”
উর্বী ম্লান হেসে বলে ওঠে,”আমি পুরোপুরি সুস্থ মা। চিন্তা করবেন না।”
কথাটি বলে উর্বী শায়মী আর নাবিলের দিকে তাকায়। দু’জনে কপাল কুঁ’চ’কে খাচ্ছে। শুধু শর্মীই উর্বীকে দেখে মুখ হাসি হাসি করে রেখেছে। রওশান আরার খাওয়া প্রায় শেষ। উর্বী তার পাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমীরুন আপা,তুমি মাকে ধরে ধরে উপরে দিয়ে এসো। আমি মায়ের গরম পানি করছি।”
আমীরুন মাথা নেড়ে রওশান আরাকে ধরে। শর্মীও খাওয়া হয়ে গেলে চলে যায়। উর্বী রান্নাঘরে চলে যায়, শাশুড়ির জন্য গরম পানি করে আনতে।
নাবিল খুব দ্রুত খাবার টা খাওয়ার চেষ্টা করছে। এখান থেকে সে দ্রুত চলে যেতে চায়। হঠাৎ চাঁপা আর্তনাদের আওয়াজে শায়মী আর নাবিল মাথা তুলে তাকায়।
রান্নাঘরে উর্বী বাম হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে রেখে চোখ বন্ধ করে আর্তনাদ করে যাচ্ছে। হাতে টগবগে ফুটন্ত গরম পানি পরেছে তার।
শায়মী আর নাবিল উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ছুটে যায় উর্বীর কাছে। একটা বাটিতে আইসকিউব নিয়ে এসে উর্বীর হাত ডুবিয়ে দেয় তাতে শায়মী। নাবিল গিয়ে একটা মলম নিয়ে এসে শায়মীর হাতে দেয়।
ঘটনা গুলো এতো দ্রুত ঘটছে যে ঘটনার আকস্মিকতায় উর্বী আর্তনাদ থামিয়ে শায়মী আর নাবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী টের পেলো সে এইমাত্র রাওনাফ করিম খানের গোমরামুখো বড় ছানা দুটোকে পছন্দ করে ফেলেছে।
নিজের হাতের যন্ত্রনা ভুলে সে মুচকি মুচকি হাসছে। ভালো মানুষ রাওনাফ করিম খানের গোমরামুখো বড় ছানা দু’টো নিজেদের ভালোমানুষী লুকিয়ে রাখতে পারলো না শেষমেশ।
উর্বীর হাতে মলম লাগিয়ে দিয়ে নাবিল ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। শায়মী তাকে হেল্প করছে। হঠাৎ উর্বীর চোখে চোখ পরতেই দু’জনেই আবার কপাল কুঁ’চ’কে ফেলে। উর্বী চোখ সরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,”থ্যাংকস!”
নাবিল আর শায়মী কিছু না বলে মুখ গোমড়া করে সেখান থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে চলে যায়। উর্বী দাঁড়িয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে!
রাওনাফ ঘরে ঢুকেই থ’ম’কে দাঁড়িয়ে যায়। একবার উর্বীর দিকে, একবার তার হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”না মানে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছো সবসময় পেশেন্ট হয়েই ঘুরবে?”
উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে বলে,”গরম পানি পরেছে! চামড়া উঠেছে কিছুটা!”
রাওনাফ উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”প্রপার ড্রেসিং হয়েছে?”
উর্বী সেই কথার জবাব না দিয়ে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বলে,”আপনার তিনটা ছানাই চমৎকার!”
রাওনাফ উর্বীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলে,”ছানা?”
উর্বী থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে ওঠে,”না মানে! আম…মানে আপনার বাচ্চা গুলো চমৎকার। ওরাই ড্রেসিং করে দিয়েছে।”
রাওনাফ উর্বীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হাতের ফাইলটা বিছানায় রেখে বলে,”তোমার রিপোর্ট গুলো দেখলাম। কোনো কম্প্লিকেসি নেই।”
উর্বী নিশ্চুপ। রাওনাফ কিছুটা জড়তা নিয়ে বলে,”ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড একটা কথা বলতে চাই।”
_বলুন।
অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় উর্বী।
_ওয়ান অফ মাই কলিগস রেকমেন্ডেড মি আ সাইক্রিয়াটিস্ট ফর ইউ। আই থিংক ইউ শ্যুড গো ফর…
উর্বী রাওনাফের চোখের দিকে তাকায়। রাওনাফ আমতা আমতা করে বলে,”ডিড ইউ মাইন্ড?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। খুবই নিচু স্বরে বলে,”আমাকে কার্ড দিয়েন। আমি যেতে চাচ্ছি।”
রাওনাফ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তোমাদের বাড়ি থেকে আসার পরে যেও। ও বাড়ি থেকে ফোন দিচ্ছে বারবার। উপমার শশুর বাড়ি থেকে লোক আসবে বিয়ের কথা পাকা করে যেতে!”
***
সকালবেলা বাজার থেকে বেছে বেছে টাটকা দুটো বড় ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছেন রেজাউল কবির। তহুরা পিঠা বানাচ্ছে। পাচ রকমের পিঠা। এই প্রথম উর্বী-রাওনাফ বাড়িতে আসবে, এটুকু আয়োজন তো করতেই হবে।
রেজাউল কবির রান্না ঘরে একটা মোড়া পেতে বসে বলে,”মাংসটা সিদ্ধ হতে কতক্ষন লাগবে? ওরা তো এসে পরবে”
-এইতো হয়ে গিয়েছে। তুমি এখানে বসে আছো কেনো। বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। একটু এগিয়ে নিয়ে আসবে না?
-এই তো যাচ্ছি,তাছাড়া ওরা তো গাড়ি নিয়েই আসবে।
-তবুও রাস্তার মাথায় গিয়ে দাড়াও। যা বলছি তা করো।
রেজাউল কবির মিনমিন করে বলে,” আচ্ছা আত্মীয় স্বজনদের একটু জানালে ভালো হতো না? জামাইকে দেখবে না তারা? উর্বীর স্বামীকে?”
তহুরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে,”বোনকে ভালো থাকতে দিতে চাচ্ছো না তাই না? এমনিতেও উপমার শশুর বাড়ী থেকে ঐ অশিক্ষিত লোক গুলো এসে রাওনাফ ভাইয়ের সামনে উল্টো পাল্টা বেফাঁস কথা বলে ফেললে কিভাবে সামাল দেবো সেটাই বুঝতে পারছি না।”
-ঠিকাছে। বলবো না।
_যাও গিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকো।
অত্যন্ত কঠিন স্বরে বলে তহুরা। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার সবটা সামাল দিতে গিয়ে।
রেজাউল আর কোনো কথা বলে না। সে চলে যায় উর্বীদের এগিয়ে নিয়ে আসতে।
****
“কোথায় তুমি? ফিরবে কবে?”
লামিয়ার কন্ঠস্বর। রাওনাফ নিচুস্বরে বলে,”শশুরবাড়ি।”
_পুরনো নাকি নতুন?
_নতুন।
লামিয়া হাসতে থাকে। রাওনাফ ধমকের মতো করে বলে,”শাট আপ লামিয়া! আহসান কে বলবো তোমাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে।”
লামিয়া হাসি থামিয়ে বলে,”না শোনো রাওনাফ। তৌফিকের সাথে কিছুক্ষণ আগে কথা হলো। ও বলছিলো যে ও এখনও একটা শশুরবাড়ির মুখ দেখতে পারলো না আর তুমি দুইটা শশুরবাড়ি গেলে।”
রাওনাফ বলে ওঠে,”ওর কি অবস্থা?”
_ডেট করছে একটা তেইশ বছরের ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে! হাউ ডিস্টার্বিং!
রাওনাফ হেসে বলে,”শা’লার চরিত্র বরাবর একই রকম রয়ে গেল!”
উর্বী ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়ে পরে রাওনাফের মুখে “শালা” শব্দটা শুনে। রাওনাফ থতমত খেয়ে ফোন রেখে উর্বীকে বলে,”স্যরি! বন্ধু বান্ধবের সাথে কথা বার্তা একটু ইনফরমাল ওয়েতে বলা হয়!”
উর্বীর বেশ হাসি পাচ্ছে। সে স্বাভাবিক গলায় বলে,”সমস্যা নেই! আমি এর থেকেও ভয়ানক গালি দেই!”
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”রিয়েলি!”
_হুম! মনে মনে!
রাওনাফ হেসে ফেলে! উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তার হাসি দেখে। তারপর বলে,”আপনাকে ভাইয়া ডেকেছে। উপমার শশুর বাড়ী থেকে লোক এসেছে। কথাবার্তা বলবে!”
****
সজীব এসে উচ্ছাসের পেছনে দাঁড়ায়। উচ্ছাস চুপ করে বসে থাকে। সজীব আমতা আমতা করে বলে ওঠে,”কাকা পয়ত্রিশ হাজারের বেশী একটাকাও দিতে পারবে না বলে দিয়েছে!”
_প্রয়োজন নেই! খরচ হচ্ছে কোথায়!
সজীব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”কাকা দশ বারো দিন আপনাকে এখান থেকে বের হতে নিষেধ করেছে। মামুনের সাথে থানার নতুন ওসির খুব ভাব। ও আবার আপনাকে কেস খাওয়াবে।”
উচ্ছাস নিশ্চুপ। সজীব জানে, এসব কথায় উচ্ছাসের কোনো আগ্রহ নেই। সে জানতে চায় শুধু উর্বীর কথা। সজীব বলতে থাকে,”উর্বী স্বামীকে নিয়ে ও বাড়িতে গিয়েছে!”
উচ্ছাস নীরবতা ভাঙে, ঠান্ডা গলায় বলে,”বেয়াদব টাকে সামনে পেলে আমি কি করবো আমি নিজেও জানি না!”
সজীব চুপ করে থাকে। উচ্ছাস বলে,”যা এখান থেকে। মাকে বলবি ভালো আছি।”
সজীব তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চলে যায়। উচ্ছাস ফোনটা হাতে নিয়ে উর্বীর নাম্বারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নাম্বার টা ডায়াল করে।
উর্বী ঘুমিয়েছিলো। হঠাত তার ফোন বেজে ওঠে। আওয়াজে উর্বী ধরফরিয়ে উঠে বসে। ঘুমঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে কেউ কোনো আওয়াজ দিচ্ছে না। উর্বী ঘুম ঘুম গলায় বলে,”হ্যালো। কে বলছেন?”
বিপরীত পাশের মানুষটা চুপ করে থাকে। উর্বী “অদ্ভুত” বলে ফোনটা কেটে দিতে যাবে অমনি একটা নিচু গলায় উচ্ছাস বলে ওঠে,”উর্বী”
উর্বীর দুনিয়া থেমে যায়। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নিঃশ্বাস টা হঠাৎ করে আটকে গিয়েছে যেন। তার হাত থেকে ফোনটা পরে যায়।
দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে সে। সমস্ত শরীর কাপছে তার।
মাঝ রাতে রাওনাফের ঘুম ভেঙে যায়। উঠে ওয়াশরুমে যাবে তখন সে দেখতে পায় উর্বী তার যায়গায় নেই। ওয়াশরুমেও কেউ নেই।ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। রাওনাফ কি মনে করে বারান্দার দিকে যায়। সে খুব সন্তর্পণে দরজা ঠেলে দেখে উর্বী বারান্দার মেঝেতে হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। তার শরীর একটু পরপর কেপে কেপে উঠছে।
রাওনাফ দরজা টেনে ভেতরে আসে। সে বুঝতে পারছে না এই মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেনো।
***
উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে তহুরা ধাক্কার মতো খায়। চোখ ফুলে গিয়েছে। স্পষ্ট মনে হচ্ছে কেঁদেছে খুব। উর্বী দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার দৃষ্টি তহুরার হাতের দিকে নিবদ্ধ। তহুরা হাতের কাপটা উর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”রাওনাফ ভাই মসজিদ থেকে ফিরেছেন। এক্ষুনি রুমে ঢুকবেন হয়তো। ভাবলাম শহুরে মানুষ,ঘুম থেকে উঠেই চা কফি খাওয়ার অভ্যাস। নে ধর।”
উর্বী কফির কাপটা নেয়না। ধীরে ধীরে তহুরার দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”ও জামিন পেয়েছে!”
কথাটা শুনেই তহুরার হাত থেকে কাপটা পরে যায়। উর্বী তহুরার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ওয়াশ রুমে ঢোকে। তহুরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে শক্ত হয়ে।
***
দেয়ালে জয়নুল আবেদীনের একটা পেইন্টিং। এছাড়া পুরো কামড়ায় তেমন কোনো সাজসজ্জা নেই চোখে পড়ার মতো। উর্বী হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। অফিসের সময় পেরিয়ে গিয়েছে আধাঘণ্টা আগেই। আজ আধাবেলা লিভ নিয়েছে উর্বী। ম্যানেজারকে অনেক কষ্টে মানিয়েছে সে। রাওনাফ সেদিন ঠিকই বলেছিলো,উর্বীর এই চাকরীটাও বেশিদিন টিকবে না।
উর্বী-রাওনাফ ওবাড়ি থেকে ফিরেছে দু’দিন আগে। উপমার রেজিস্ট্রি হয়েছে শুধু। ছেলের বাবা হজ্ব করে ফিরলেই তাকে শশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে।
“মৃদুলা উর্বী?”
রিসিপশনিস্টের ডাকে উর্বী মাথা তুলে তাকিয়ে বলে,”জি!”
_আপনাকে স্যার ভেতরে ডেকেছেন।
উর্বী ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কেবিনের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একজন চল্লিশোর্ধ ভদ্রলোক বলে ওঠে,”বসুন।”
উর্বী চেয়ারে বসতে বসতে লোকটিকে দেখে। বয়স খুব একটা বেশি না হলেও মাথা পুরো ফাঁকা। লোকটাকে সাইক্রিয়াটিস্ট কম মিষ্টির দোকানের ময়রা বেশি লাগছে।
কথাটা ভাবতেই উর্বী নিজেই নিজেকে শাসায় মনে মনে,”ছিহ উর্বী! অভদ্রমহিলা!”
পুরো নাম আক্তারুজ্জামান বাবুল। নেইম প্লেটে লেখা, A.J.B.!
আক্তারুজ্জামান উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”মৃদুলা উর্বী নামের অর্থ কি?”
***
জাহাঙ্গীর রাওনাফের সামনে বসে আছে। রাওনাফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,”চোখ নামা! এবার ভয় লাগছে আমার!”
জাহাঙ্গীর নিশ্চুপ।
রাওনাফ নরম সুরে বলে,দোস্ত প্লিজ রাগ করিস না। আসলে সবকিছু একটা এক্সিডেন্টের মতো হয়ে গেলো যে কাউকে জানাতে পারি নি।আর পরে ভাবলাম দেশে ফিরে জানবি না হয়! প্লিজ রাগ করিস না।
-এক্সিডেন্ট? বিয়েটা না হয় হুট করে করেছিস,বিয়ের পরে দু মাস চলে গেলো এখনো তো সময় হয়নি জানানোর। লামিয়ার থেকে জানতে হয় আমাদের!
রাওনাফ খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে বসে থাকে।
জাহাঙ্গীর বলে,”যা করেছিস সেটা ক্ষমার যোগ্য না। তোর শাস্তি হওয়া দরকার। সবাই খেপে আছে তোর উপরে। জুনায়েদ, আশিক, মৌমিতা। সবাই।”
রাওনাফ হেসে বলে,”কি শাস্তি!”
ভাবীর হাতের রান্না খাওয়াতে হবে। আমি মেন্যু বলে দেবো,আমাদের সব বন্ধুকে দাওয়াত করে খাওয়াবি।
রাওনাফ হাসতে হাসতে বলে,”জো হুকুম মেরে আকাহ!”
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে রাওনাফের। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন নারীকন্ঠ বলে ওঠে,”স্যার আমি দিগন্তের রিসিপশনিস্ট!”
রাওনাফ সাথে সাথে বলে ওঠে,”আবার কি হয়েছে! অসুস্থ হয়ে পরেছে মৃদুলা উর্বী?”
_আরেহ,না না স্যার। তেমন কিছু না! ম্যাম আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।
উর্বী রিসিপশনিস্টের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিচু স্বরে বলে,”আসলে আমার ফোনটা ডেড হয়ে পরে আছে। আপনি একটু মাকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন আজ আমার ফিরতে দেরী হবে? উনি দুশ্চিন্তা করবেন। সেজন্যই ফোন দেওয়া আপনাকে!”
রাওনাফ নিচু স্বরে বলে ওঠে,”ঠিকাছে। বলে দিচ্ছি।”
উর্বী ফোন কেটে দেয়।
জাহাঙ্গীর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আচ্ছা! তোদের মধ্যে Understanding হয়েছে?”
রাওনাফ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে! অস্ফুট স্বরে বলে,”এইতোহ!”
***
“স্যার ডক্টর রাওনাফ এসেছে!”
আক্তারুজ্জামান মাথা তুলে তাকায়। এ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”বসিয়ে রেখেছো ? স্টুপিড। নিয়ে এসো!”
রাওনাফ নিজেই কেবিনে ঢোকে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,”খুব অল্প সময় নিয়ে এসেছি হাতে! ঘন্টাখানেক বাদেই ও.টি. । বলুন। কি কথা!”
আক্তারুজ্জামান হাতের ফাইল উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলে,” আপনার ওয়াইফ এসেছিলেন আজ। দেখলাম তাকে।”
রাওনাফ তাকিয়ে আছে। আক্তারুজ্জামান বলতে থাকে,”কথা হলো দীর্ঘসময়। পেশেন্টের সাথে কনভারসেশন রিভিল করা নীতি বিরুদ্ধ কাজ। শুধু বলতে চাই, আপনার স্ত্রী কনভার্সন ডিজঅর্ডারে ভুগছেন ডক্টর খান।”
রাওনাফ একদৃষ্টে আক্তারুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপর বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”As I guessed!”
চলমান……
#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৩
#Esrat_Ety
অন্তরা শুয়ে ছিলো। ইদানীং তার শরীর টা ভালো নেই। অনেক দুর্বল লাগে এবং মাথা ঘুরতে থাকে।
রওশান আরা তার ঘরে ঢুকে সামিউলকে ডাকতে থাকে।
অন্তরা উঠে বসে। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
_সামিউল তো নেই মা। অফিসে গিয়েছে।
_ওও।
রওশান আরা অন্তরার ঘর দেখতে থাকে। ঘরটা অন্তরা বেশ চমৎকার করেই সাজিয়েছে।
অন্তরা তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
রওশান আরা অন্তরার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”শুনলাম শরীর নাকি ভালো নেই তোমার। আমীরুন আছে,কোনো দরকার লাগলে ওকে ডেকে নিও। কিছু হলে তো আবার আমার দুর্নাম হবে।”
রওশান আরা চলে যায়। অন্তরা সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
সামিউল বিকেলে বাড়ি এসে দেখে অন্তরা কাঁদছে। সামিউল অন্তরাকে ধরে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে? মা কিছু বলেছে?”
অন্তরা বলে,”মা এসে আমার খোজ নিয়েছে। দেখতে এসেছিলো আমি কেমন আছি।”
সামিউল হাসে। এতে কান্না করার কি হলো সে বুঝতে পারে না।মেয়েদের এই একটা ব্যাপার তার মাথায় ঢোকে না। যেখানে খুশি হওয়ার কথা সেখানে কাদে।
***
“ভাবি, রাওনাফের একটা কাহিনী বলি আপনাকে, রাওনাফ বোধ হয় আপনাকে বলে নি। আমরা বন্ধুরা সবাই নেপাল গিয়েছিলাম। কারো ফ্যামিলি সাথে নেইনি, প্লেনে…..”
-আহ,কি হচ্ছে জাহাঙ্গীর। খেতে বসে এতো কথা বলছিস কেনো।
জাহাঙ্গীর কে থামিয়ে দেয় রাওনাফ। পাশ থেকেই আশিক বলে,”এই তোর ডাক্তার না হয়ে প্রফেসর হওয়া উচিৎ ছিলো। সব ব্যাপারে সবাইকে কথা শুনাতে থাকিস। ভাবি পুরো গল্প আমি বলছি। প্লেনে সবাই এক মন্ত্রীর আশেপাশেই বসেছিলাম,মন্ত্রীর নাম বলবো না। সে রাওনাফকে দেখে,ওর সাথে কথা বলে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে যায় যে সে সরাসরি প্লেনেই রাওনাফকে তার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেয়। রাওনাফ তখন তাকে বললো সে বিবাহিত। সে মানলোই না। দেশে ফিরেই সে রাওনাফের বাড়িতে আসে দেখার জন্য রাওনাফ সত্যিই বিবাহিত কি না। এসে দেখে রাওনাফ শুধু বিবাহিতই না,তার দুই জমজ ছেলে মেয়েও আছে। শায়মী নাবিলের তখন তিন বছর বয়স।”
খাবার টেবিলে বসা অন্যরা হো হো করে হাসতে থাকে।
রাওনাফ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। উর্বী রাওনাফের আরেক বন্ধু জুনায়েদের পাতে মাংস তুলে দিতে যাবে তখন জুনায়েদ উর্বীকে বলে,”আপনারা কোথাও ঘুরতে যাননি ভাবি? এই শীতে তো সবাই ইচ্ছে মতো ট্যুর দিচ্ছে।”
জুনায়েদের স্ত্রী রাবেয়া বলে,”তোমার মনে হয় তোমার বন্ধু কোথাও নিয়ে যাবে ঘুরতে? সে তো তোমাদেরই বন্ধু।”
-কেনো ভাবি? এরকম বলছেন কেনো? আমরা কি করলাম। আমরা আমাদের স্ত্রীদের নিয়ে ঘুরি না?
জাহাঙ্গীর উত্তর দেয়।
জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মিতা ব্যঙ্গ করে বলে,”তুমি শেষ কবে আমাদের নিয়ে ঘুরেছো সে তো আমার মনেই নেই। কখনো নিয়ে গিয়েছিলে কোথাও?
-আচ্ছা তাহলে এই কথা। বেশ এবার তাহলে আমরা সবাই মিলে একটা ট্যুর দেই চলো। শুধু স্বামী স্ত্রী যাবো। কোনো বাচ্চা কাচ্চা নেবো না।
আশিক সম্মতি দিয়ে বলে,”হ্যা হ্যা। তুনার মাও কয়েকদিন ধরে খুব বলছিলো। চল তাহলে এবার একটা ট্যুর দেওয়া যাক।”
সবাই তার কথায় সম্মতি জানায়।
রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি ব্যস্ত। এমনিতেই বেশ কয়েকবার ছুটি নিয়েছি। একজন ডাক্তার হয়ে এরকম আমি করতে পারি না।”
“একজন ডাক্তার হয়ে আমি এমন করতে পারি না! কোথাকার কোন মহাপুরুষ এসেছেন।”
ব্যঙ্গ কেটে জবাব দেয় জাহাঙ্গীর। রাওনাফ রেগে বলে,”তোদের দেখে মনে হয় না তোদের বয়স হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা সব স্কুলে পড়ছে। খুবই হাস্যকর।”
-এই বয়সে তুই বিয়ে করতে পারলে আমরা একটু ঘুরতে পারবো না?
মৌমিতা রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কথাটি বলে। রাওনাফ চুপ হয়ে যায়।
সবাই উচ্চশব্দে হাসতে থাকে।
উর্বীর ইচ্ছে করছে সেখান থেকে চলে যেতে।
-আমরা অত কথা শুনতে চাই না রাওনাফ ভাই। আমরা যাচ্ছিই।আর আপনিও যাচ্ছেন নতুন ভাবীকে নিয়ে আমাদের সাথে। সেটা যদি না হয় এটাই আমাদের শেষ আসা আপনাদের বাড়িতে।
বলে রাবেয়া।
-হ্যা হ্যা ঠিক তাই।
লামিয়া বলে ওঠে। জাহাঙ্গীর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”শোন রাওনাফ। এখন নয়। শায়মী নাবিলের এক্সামের শেষে। তখন তোর কোনো কথা আমরা শুনছি না!”
তার সাথে তাল মিলিয়ে বলে অন্যরাও।
***
বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কেউ বারবার ফোন দিচ্ছে। উর্বী নিচে যায়। গিয়ে কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে একজন ভদ্রমহিলা সালাম দেয়। উর্বী সালামের উত্তর দেয়।
ভদ্রমহিলা বলে,”আমি শায়মীর স্কুল থেকে বাংলা শিক্ষিকা বলছি আমি কি শায়মীর বাড়ির কারো সাথে কথা বলছি?”
-জ্বী বলছেন। বলুন কি দরকার!
-আপনি শায়মীর কি হন?
উর্বী ইতস্তত করে বলে,”আপনি বলুন না কি দরকার!”
-আপনাদের বাড়ি থেকে এখনি কাউকে স্কুলে এসে আমার সাথে দেখা করতে হবে।
-কেনো কি হয়েছে জানতে পারি?
-সেটা আসলেই বুঝতে পারবেন।
ভদ্রমহিলা ফোন রেখে দেয়। উর্বী তার ফোন দিয়ে রাওনাফের নাম্বারে বারবার ফোন দিচ্ছে। ফোনটা বন্ধ। উর্বী চিন্তায় পরে যায়। এখন কি করবে সে!
উর্বীর আজ অফ ডে ছিলো। উর্বীকে তৈরি হতে দেখে রওশান আরা জিজ্ঞেস করে,”কোথাও যাচ্ছো মা?”
-হ্যা মা একটু বের হচ্ছি। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। আপনি মনে করে দুপুরের ওষুধ টা খেয়ে নিবেন।
শায়মীদের স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা আদুরী ইয়াসমিনকে টিচার্স রুমে পাওয়া গেলো। শায়মী একটা চেয়ারে বসে আছে, সে কাঁদছে।
উর্বী কক্ষে ঢুকে দেখে শায়মী কাঁদছে। আদুরী ইয়াসমিন উর্বীকে জিজ্ঞেস করে,”আপনি কে?”
-আমি শায়মীর বাড়ি থেকে এসেছি।
-ওহ,আপনার সাথেই কথা হয়েছিলো আমার? আপনি শায়মীর কি হন?
উর্বী বলে,”এটা জানা টা কি খুবই জরুরি?
-অবশ্যই।
-আমি সম্পর্কে ওর মা হই।
শব্দগুলো খুবই স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করে উর্বী।
আদুরী ইয়াসমিন অবাক হয়ে তাকায়।
-আপনি শায়মীর মা?
-জি।
-বয়স কতো আপনার?
-ত্রিশ বছর।
-একজন ত্রিশ বছরের মায়ের ষোলো বছরের মেয়ে? এর ব্যাখ্যা কি? ওয়েট! রাওনাফ করিম খানের ব্যাপারে যা শুনেছি তা সত্যি তাহলে!
-আপনি দয়া করে বলবেন কি হয়েছে? আমার মেয়ে কাঁদছে কেনো?
উর্বী কাট কাট বলে ওঠে।
-শায়মী ক্লাসের টাইমে তার ছেলেবন্ধুর সাথে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। আপনারা জানেন সেটা?
উর্বী হতবাক হয়ে যায়। সে শায়মীর মুখের দিকে তাকায়। শায়মী কাঁদছে, সে উর্বীকে বলে,”আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করুন।”
উর্বী শায়মীকে বলে,”তুমি শান্ত হও। আমি দেখছি।”
আদুরী ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে উর্বী বলে,”আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। শায়মী এমনটা করবে না।”
-দেখুন। আমাদের কোথাও ভুল হয়নি। আমাদের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হাসান সাহেব নিজে তাদের একটি রেস্তোরায় হাতে নাতে ধরেছে। ছেলেটি ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র। সামনে ওর এক্সাম! কত ব্রাইট স্টুডেন্ট ও। ডক্টর রাওনাফের মেয়ে ও।
ব্যাপারটা আমি এবং হাসান সাহেবের মধ্যেই আছে। শায়মী খুবই ভালো ছাত্রী। আমরা ওর ভালো চাই। তাই বিষয়টা আপনাদের জানানো হয়েছে। ওকে নিয়ে বাড়ি যান,ওকে বোঝাবেন।
উর্বী শায়মীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শায়মী কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আপনি প্লিজ পাপাকে কিছু বলবেন না,আমি আর এরকম কিছু করবো না কখনো। আপনি প্লিজ পাপাকে বলবেন না। পাপা আমাকে মেরেই ফেলবে!”
উর্বী শায়মীর গালে হাত রেখে বলে,”আমি কাউকেই কিছু বলছি না।তুমি চোখ মোছো। বাড়ি যেতে হবে আমাদের।”
***
রাওনাফ শুকনো মুখ নিয়ে ঘরে ঢোকে। উর্বী বইয়ে মুখ গুজেছিলো রাওনাফের আওয়াজ পেয়ে সে সেদিকে তাকায়, তাকিয়ে বলে,”আপনি অসুস্থ?”
-কই। নাতো।
-সেরকমই দেখাচ্ছে।
-ওহ তেমন কিছু না। আই এ্যাম অলরাইট।
তারপর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।
উর্বী বই রেখে উঠে পরে। রাওনাফ ওয়াশরুম থেকে বের হলে তাকে বলে,”আপনার খাবার টেবিলে দিয়ে দেবো?”
– নাহ। পরে খাবো। আজ শায়মীর স্কুলে গিয়েছিলে? মা বললো।
উর্বী থতমত খেয়ে বলে,”হ্যা। ওর বাংলা টিচার ফোন করে বললো ওর শরীরটা নাকি ভালো লাগছে না। তাই গিয়ে নিয়ে এসেছি। আপনি অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন তখন, আপনার নাম্বার বন্ধ ছিলো। জানাতে পারিনি।”
-সে কি! তারপরে তো কেউ জানাতে পারতে। আশ্চর্য!
-শায়মী এখন ঠিক আছে। মনে হচ্ছে লো ব্লাড প্রেশার ওর।
-তা তো হবেই। কিচ্ছু মুখে দেয় সারাদিন!
রাওনাফ একটু থেমে বলে,”তুমি না চাইতেও আমার পরিবারের সমস্যাগুলি সামলাতে হচ্ছে তোমাকে!”
উর্বী কিছু একটা বলতে যাবে তখনই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আমিরুন ডাকে,”ভাবি খাইতে আসেন। খাবার দিয়া দিছি।”
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়।
-তুমি এখনো খাওনি?
-মা বললেন আপনি একা একা খান,তাই আমি যেনো আপনার সাথে খাই।
-মা বললেই সেটা করতে হবে? আশ্চর্য!
কন্ঠে বিরক্তিভাব রাওনাফের।
উর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে তাকে। এতো রেগে যাওয়ার কি হলো! তার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না। বিয়েটা মায়ের কথায় করতে পেরেছে! এখন নাটক করছে! ভারি অদ্ভুত লোক!
শায়মী ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। রাওনাফ বাইরে থেকে ডাক দেয়,”মামনী! ”
শায়মী উঠে বসে। তার ভিষন ভয় করছে। ওই মেয়েটা পাপাকে সব বলে দিয়েছে কি?
রাওনাফ ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বলে,”এই সময়ে ঘর অন্ধকার করে বসে আছো কেনো?”
-না মানে এমনিই পাপা।
-শর্মী কোথায়?
-দাদীর ঘরে গিয়েছে।
– তোমার কি অবস্থা। এরকম হলে চলবে কি করে? সামনে পরীক্ষা!
শায়মী কিছুই বুঝতে পারছে না। তার বুক ধুকপুক করছে। তার পাপা যদি সব জেনে যায় তাহলে কি পাপা তাকে চ’ড় মারবে যেমন মাহজাবীনের পাপা মাহজাবীনকে মেরেছিল!
রাওনাফ বলে,”আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ডাক্তারি ছেড়ে তোমাদের তিন ভাই বোনকে সময় দেই। তোমরা যে যার মতো করে থাকো। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছো।”
শায়মী শীতেও ঘামতে থাকে। রাওনাফ বলতে,”আজ শরীর বেশি খারাপ করেছিলো মামনী?”
শায়মী এবার বুঝতে পারে,তার পাপার কাছে ওই মেয়েটা তার অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়েছে। সে কিছুটা স্বস্তি পায়।
মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে জবাব দেয়,”একটু খারাপ করেছিলো পাপা!”
***
দরজার ওপাশ থেকে উর্বী উঁকি দিয়ে বলে ওঠে,”ইন্সট্যান্ট স্ন্যাকস বানিয়েছি শর্মী। খাবে তুমি?”
শর্মীর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়না। সে বিছানায় উপুড় হয়ে পেটে হাত দিয়ে কাতরাচ্ছে। শায়মী বই থেকে মাথা তুলে তাকায়। উর্বী ঘরের ভেতরে ঢুকে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”কি হয়েছে শর্মী?”
_পেটে ব্যাথা আন্টি!
উর্বী বলে,”পিরিয়ড হয়েছে? গরম পানি এনে দেবো?”
শর্মী মাথা নাড়ায়।
উর্বী বিছানার একপাশে বসে বলে,”কি হয়েছে! খুলে বলো।”
কাঁতরাতে কাঁতরাতে বলে,”চটপটি খেয়ে এসেছি স্কুল থেকে। আপনি প্লিজ পাপাকে বলবেন না।”
উর্বী হেসে ফেলে। তারপর বলে,”সিক্রেট রাখবো?”
শায়মী উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী শায়মীর চোখে চোখ রেখে শর্মীকে বলতে থাকে,” তোমাদের এতো এতো সিক্রেট পেটে রাখতে রাখতে আমার পেট তো রীতিমত ফুলে যাচ্ছে! এর বিনিময়ে আমি কি পাবো!”
শায়মী মাথা নিচু করে হাসে। তারপর নিচু স্বরে বলে ওঠে,”থ্যাংকস আন্টি! পাপাকে কিছু না বলার জন্য।”
***
উর্বী ব্যাগ গোছাচ্ছিলো। রাওনাফ এসে মাথা থেকে টুপি খুলে আলমারিতে তুলে রেখে ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। সে এই মাত্র জুম্মার নামাজ আদায় করে ফিরেছে। পরনে তার ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি। উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ নিচু স্বরে বলে,”আমি দুঃখিত, তোমার মা অসুস্থ। আমি যেতে পারছি না। ওনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী!”
উর্বী ম্লান হেসে বলে,”এভাবে বলার কিছু নেই। আর তাছাড়া মা অসুস্থ নয়। আমাকে দেখতে চাইছেন বলে মিথ্যা বলেছে। এমনিতে তো আমি যেতাম না।”
রাওনাফ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
রওশান আরা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে তার বড়ছেলের উপর।
উর্বীকে এভাবে একা কেনো ছাড়া হচ্ছে তাই।
রাওনাফ বারবার তার মাকে বুঝিয়েছে তার অনেক কাজ আছে। তবুও চেঁচামেচি কমছেই না।
কিছু সময় বাদে রওশান আরা মুখ ভার করে পায়চারি করছে।
উর্বী তার ব্যাগ রেখে রওশান আরার ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়।
“মা।”
রওশান আরা তাকায়।
_মা আমি তবে এবার রওনা দিলাম। আপনি ভালো থাকবেন, ওষুধ ঠিকঠাক মতো খাবেন।
রওশান আরা বলে,”দু’দিন কিন্তু। দেরী করবে না। মনে থাকে যেন।”
উর্বী হেসে মাথা নাড়ায়।
রওশান আরার কাছে সে হাসি বড্ড মধুর লাগে।
উর্বী বলে,”দুদিনের বেশি থাকতেও পারবো না মা। আমার অফিস আছে।”
_তবুও। বাপের বাড়ি গেলে মেয়েদের পা আটকে যায় কি না।
মজার ছলে বলে ওঠে রওশান আরা।
_ঠিকাছে। আপনি আমাকে একটা কথা দিন এবার।
_কি কথা?
কৌতুহলী হয়ে রওশান আরা জানতে চায়। উর্বী বলে,”অন্তরার উপর চেঁচামেচি করবেন না। সেদিন যেমন আদর করেছিলেন,তেমন করেই আদর করবেন!”
অন্তরার ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। সে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তার শরীরটা বেজায় খারাপ।
উর্বী ঢুকে বিছানায় বসে। অন্তরা উঠে বসতে চায়। উর্বী বাঁধা দেয়।
“আপনি রওনা দিচ্ছেন ভাবি?”
_হু,এইতো এখন দেবো।
_একটু যে নিচে নামবো তাও পারছি না। মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছি না।
_তোমার নামতে হবে না। তুমি বিশ্রাম করো। যেকোনো সমস্যার কথা আমীরুনকে জানিও। ও সব করে দেবে। তাছাড়া তোমার মেজো ভাবিও দু একদিনের মধ্যে এসে পরবে।
অন্তরা মাথা নাড়ায়।
_আপনি না থাকলে বাড়িটা অন্যরকম হয়ে যাবে ভাবি। ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যাবে।
উর্বী হাসে। অন্তরা বলতে থাকে,”হাসবেন না ভাবী। আপনাকে যে কতটা পছন্দ করে ফেলেছি আপনি জানেন না।”
শর্মীকে বলে উর্বী গাড়িতে ওঠে। শর্মীর বলতে ইচ্ছা করছে সে আন্টিকে মিস করবে কিন্তু পাশেই নাবিল দাঁড়িয়ে। তাই সে চুপ করে থাকে।
উর্বী গাড়িতে উঠে বসে জানালা দিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায় । রাওনাফ ফোনে কথা বলছে। উর্বী কেন এমনটা করলো উর্বী জানে না। সে কেনো তাকালো রাওনাফের দিকে!
ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়। নাবিল বিড়বিড় করে বলে,”থাক দুটো দিন শান্তিতে থাকতে পারবো।”
শায়মী আর শর্মী কপাল কুঁ’চ’কে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
তহুরা একটা পেয়ালায় কিছু কাঠবাদাম নিয়ে এসে উর্বীর সামনে রাখে। তারপর উর্বীর পাশে বসে।
উর্বী মাথা তুলে ভাবীর দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলে,”মায়ের মিছিমিছি অসুস্থতার কথা বলা উচিৎ হয়নি। এমনি বললেই চলে আসতাম।”
তহুরা তার জবাব না দিয়ে বলে,
“নে বাদাম খা। ভাত খাবি এখন? ভাত বেড়ে দেই?”
_না। পরে।
_হ্যারে, জামাইয়ের সাথে কথা হয়?
পাশ থেকে লুৎফুন্নাহার বলে ওঠে।
_কেনো মা?
_না,সারাদিনে একবার ও দেখলাম না ফোন দিতে।
_মা সে একজন ডাক্তার, তার কত কাজ জানো?
_তা বুঝলাম,রাতে তো দিতে পারে। তুইও তো দিতে পারিস।
উর্বী হাসে,বলে,” আমার দরকার হলে আমি দেবো। তুমি এত চিন্তা করছো কেনো?”
_ চিন্তা করবো না? ওবাড়ির সবার সাথে কথা বলিস অথচ যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার সাথেই কথা বলিস না। চিন্তা করবো না আমি?
_না করবে না।
লুৎফুন্নাহার চুপ হয়ে যায়, কিছু সময় পরে বলতে থাকে,”এতো শিক্ষিত না হয়ে ভালোই করেছি। বাবা মা যার সাথে বিয়ে দিয়েছে। চুপচাপ মেনে নিয়েছি। সুখে থেকেছি।”
“আর কিছু বলবে?”
জিজ্ঞেস করে উর্বী।
_নাহ।
লুৎফুন্নাহার চলে যায়। তহুরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,”তুই কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো উর্বী?”
_হ্যা। করো।
_রাওনাফ ভাই আর তুই, তোরা এক বিছানায় ঘুমাস তো?
উর্বী হাসে, পাগলের মতো গা দুলিয়ে হাসে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলে,”হ্যা, একেবারে একবিছানায়, পাশাপাশি, কাছাকাছি ঘুমাই। যাও তুমি। ভাত খাবো ভাবী।”
তহুরা বসে থাকে উর্বীর দিকে তাকিয়ে। আল্লাহ যেনো তার ননদ ননদাইকে ভালো রাখে, সে সেই দোয়া করতে থাকে মনে মনে। সে উর্বীর জীবনে আর কোনো ঝামেলা চায়না।
উর্বী ফোনের দিকে তাকায়। সত্যিই তো। এতগুলো ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে, তার শাশুড়ি ফোন দিয়েছে,তার জা দুজন ফোন দিয়েছে,শর্মীও ফোন দিয়েছে। শুধু রাওনাফ দেয়নি। রাওনাফের কি ফোন দেওয়া উচিত ছিলো? স্ত্রী হিসেবে সামনা সামনি এতোটা কনসার্ন দেখায় উর্বীর প্রতি। এই সম্পর্কের সমীকরণ উর্বী বুঝতে পারছে না। পাজেলড হয়ে আছে সে। অবশ্য এটা ঐ জীবনের থেকে বেটার। যেটা উর্বীর অতীত ছিলো। যেটুকু সম্মান পাচ্ছে তাই সই! একজীবনে সব পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই!
হুট করে হাতে ফোনটা তুলে নেয় সে। সামনের সপ্তাহে আক্তারুজ্জামানের কাছে কাউন্সিলিং-এর জন্য যেতে হবে। উর্বী একমনে হাসতে থাকে। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”পাগলের ডাক্তার তোমাকে সারাতে পারবে উর্বী?”
***
অন্তরা ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে আছে । তার সামনে সামিউল দাঁড়িয়ে। স্ত্রীর জন্য তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখা যাচ্ছে।
লামিয়া বলে ওঠে,
“হুম বাচ্চার অবস্থা স্বাভাবিক একেবারে। ভয়ের কিছুই নেই। এই সময়ে একটু শরীর খারাপ লাগবেই। ভয়ের কিছুই নেই। আমি কিছু মেডিসিন প্রেস্ক্রাইব করে দিচ্ছি। বেশি অসুবিধা মনে হলে আমাকে জানাবে।”
অন্তরা উঠে বসে। দুজন নার্স তাকে সাহায্য করে। তার সমস্ত শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা।
রাওনাফ ডক্টর লামিয়ার কেবিনের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। লামিয়া বলে,”রাওনাফ শোনো, তোমার ভাইয়ের বৌয়ের পাশাপাশি তোমার ভাইয়ের খেয়াল রেখো। বৌয়ের চিন্তায় চিন্তায় আবার কি না কি হয়।”
সামিউল লজ্জা পায়। রাওনাফ মৃদু হাসে। বলে,”অন্তরাকে নিয়ে আমার কেবিনে যা। আমি লামিয়ার সাথে কথা বলে আসছি।”
ওরা চলে যায়। রাওনাফ বলে,”কোনো অসুবিধা নেই তো? ”
_নো ম্যান,অল ইজ ওয়েল।
_যেভাবে দূর্বল হয়ে পরছে। সামিউল খুব চিন্তা করছিলো। আচ্ছা আমি যাই। আমার একটা ও.টি. আছে আধ ঘন্টা পর।
_রাওনাফ শোনো।
রাওনাফ লামিয়ার দিকে তাকায়।
_তোমার বৌ আসবে কবে?
_আগামীকাল হয়তোবা। কেনো!
_জাহাঙ্গীর একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করছে রিভানায়।
রাওনাফ কিছু বলে না,মুচকি হেসে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়।
নিজের কেবিনের দিকে যেতে যেতে সে হাতের ফোনটার দিকে একপলক তাকায়। তার কি একবার উর্বীকে ফোন করা উচিত? উর্বী কি কিছু মনে করবে? সবসময় আগ বাড়িয়ে সবকিছু তো রাওনাফই করে। না, ফোন দিয়ে কাজ নেই। যদি বাড়াবাড়ি ভাবে!
***
নাবিল তার গিটারে সুর তুলছিল। শায়মী এসে পাশে বসে। নাবিল বলে,”নতুন গানটা শোন আমার। শর্মী কোথায়? ওকে ডাক।”
_শর্মী বিজি।
_কি করছে পড়ছে?
_না আন্টির সাথে কথা বলছে। ফোনে।
_বাহঃ চমৎকার! তা তুই আন্টি আন্টি করছিস কেনো? ছোটো মা বল!
তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে নাবিল।
শায়মী নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাবিল বলে ওঠে,
_শুনলাম রাফিকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ধরা খেয়েছিস হাসান স্যারের কাছে।
শায়মী ভয় পেয়ে বলে,”তুই জানলি কিভাবে?”
_আকিব বলেছে। আর এগোস না, বেয়াদব একটা। তোর নামে আজেবাজে কথা বলে বন্ধুমহলে। ওকে ব্লক করে দে।
শায়মী মুখ কালো করে বসে থাকে। নাবিলের মুখে সে এই বিষয়ে কোনো কথা শুনতে প্রস্তুত ছিলো না।
কিছু সময় পরে বলে,
_জানিস পাপার কাছে আন্টি কিছুই বলেনি এ ব্যাপারে। আমি তো অবাক হচ্ছি।
_আমি মোটেও হচ্ছি না।
_কেনো বলতো?
_খুব সিম্পল। এটা হচ্ছে ওনার চাল। শর্মীকে হাত করেছে। এখন তোকেও হাত করতে চাচ্ছে। তারপর আমাকে করবে।
শায়মী চুপ করে নাবিলের কথা শোনে। বিড়বিড় করে বলে,”উনি অমন মহিলা নন নাবিল, আমার মনে হয়।”
_যেমন হোক। আমি আমার মাম্মার যায়গা কাউকে দেবো না।
কঠিন গলায় বলে নাবিল ।
দোতলা থেকে শর্মীর খিক খিক হাসির শব্দ আসছে। সে উর্বীর সাথে কথা বলছে।
নাবিল মুখে চ কারন্ত শব্দ করে উঠে দাঁড়ায়। শায়মী বলে,”কোথায় যাচ্ছিস?”
_যাই গিয়ে ওকে কানের গোড়ায় একটা চ’ড় মেরে আসি।
শায়মী অবাক হয়ে তার ভাইয়ের কর্মকাণ্ড দেখে।
***
উর্বী হাটছে। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। সে দু হাত দিয়ে হাতরে পথ খুঁজতে থাকে। তার ভয় ভয় করছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পায়ের কাছ দিয়ে একটা সাপ চলে যায়। উর্বী জোরে চিৎকার দেয়। রাওনাফ এসে উর্বীকে ধরে। উর্বী ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।
রাওনাফ বলে,”কিছু হবে না। ভয় পেয়ো না। আমি আছি।”
উর্বী শান্ত হতে চেষ্টা করে। হঠাৎ পায়ে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব করতে থাকে। নিচে তাকিয়ে দেখে আরেকটা সাপ।
উর্বী জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে। সে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো তবে।
শর্মী খিকখিক করে হাসছে।
“কি আন্টি? পায়ে কেমন ঠান্ডা দিলাম বলো?”
উর্বী জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। সে বিষয়টা বুঝতে দুমিনিট সময় নেয়।
শর্মী বলে,”আন্টি তোমাকে সালোয়ার কামিজে একেবারে বাজে লাগছে। যাও গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে শাড়ি পরো।”
উর্বী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই শর্মী তো এটা?
_আরে আন্টি এভাবে ভয় পাচ্ছো কেনো। সত্যিই এটা আমি শর্মী। তোমায় নিতে এসেছি দাদুর সাথে।
উর্বী এবার বুঝতে পারে।
“আচ্ছা আন্টি! তোমার রুমটা এতো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখো কিভাবে?”
শর্মী ঘরের আশেপাশে দেখতে দেখতে বলে।
_তোমরা কখন এলে? মা কোথায়?
_দাদু তোমার আম্মু আর ভাবীর সাথে তোমাদের রান্নাঘরে। আমরা এসেছি ফজরের পরে। রাত তিনটায় রওনা দিয়েছি আমরা।
_রাত তিনটায়?
_হ্যা। দাদু বললো,ভোরে এসেই খেজুরের রস খাবে। তাই এতো তাড়াতাড়ি এলাম।
_আর কে কে এসেছে?
_আর কেউ না।
উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”তোমার পাপা আসেনি?”
_ওমা। পাপা কিভাবে আসবে? পাপা তো রাজশাহী গিয়েছে। তুমি জানো না আন্টি?
উর্বী অবাক হয়ে বলে,”না। রাজশাহী কি?”
_সেখানে আমাদের হসপিটালের একটা শাখা খোলা হয়েছে। সেটা দেখতেই গিয়েছে। আজ বিকেলে ফিরতে পারে।
উর্বী কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢোকে। তার হঠাৎ করে এমন অদ্ভুত লাগছে কেনো। তার অবচেতন মন কি চাইতো রাওনাফ আসুক?
চলমান………