আরেকটি বার পর্ব-১০+১১

0
779

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১০
#Esrat_Ety

উর্বী বসে আছে। বাইরে সবাই খুব হৈ হুল্লোড় করছে। বহুদিন পরে সবাই সবাইকে পেয়েছে। তাছাড়া এ বাড়িতে আজমেরীর ছোটো ননদের বিয়ে। রুমা আর তার পরিবারও এসেছে। আত্মীয় স্বজনে গমগম করছে পুরো বাড়ি।

উর্বী আর রাওনাফের জন্য দেওয়া হয়েছে দোতলার সবথেকে কোনার দিকের একটি ঘর। বাড়িটা কিছুটা পুরনো দিনের জমিদার বাড়ির মতো,অনেক বড়। আজমেরীর স্বামী হাফিজুরেরা একান্নবর্তী পরিবার। উর্বীর এই ঘরটি অনেক পছন্দ হয়েছে। বিশাল বড় জানালা আর বড় একটা টানা বারান্দা তাও আবার দক্ষিনমূখী। উর্বী খাটের উপর চুপ বসে আছে। আঙিনায় সবাই হেসে হেসে উচ্চস্বরে কথা বলছে। সে ভেবে পাচ্ছে না তার সেখানে যাওয়া উচিৎ হবে কিনা।

উর্বীর ঘরের দরজার বাইরে থেকে গ্রামের কিছু মহিলা আর বাচ্চারা উকি দিচ্ছে বারবার। তারা উর্বীকে দেখছে, ডাক্তার সা’বের নতুন বৌকে দেখছে।
উর্বীর ভিষন অস্বস্তি হচ্ছে। আজমেরী এসে মহিলাদের সরিয়ে দেয়,”আরে আপনারা এখানে! যান গিয়ে আগে পান-মিষ্টি খান! যান,যান!”
সবাই তাদের কৌতুহল সাময়িক ভাবে দমিয়ে নিয়ে চলে যায়। আজমেরী ভেতরে ঢুকে উর্বীকে বলে,”এখানে বসে আছো কেনো। চলো সবাই কত মজা করছে। চলো চলো!”

-না আপা আমি এখানেই ঠিক আছি।
নিচু স্বরে বলে ওঠে উর্বী।

-নাবিলের জন্য যাচ্ছো না? ও নেই, আমার কিছু চাচাতো দেবর আছে ওর সমবয়সী তাদের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে। তুমি চলো।আমার আত্মীয়রা এসেছে তোমাকে দেখবে বলে, তাদের আর কতক্ষন অপেক্ষা করাবো !

উর্বী আঁচল টেনে উঠে দাঁড়ায়। তার যেতে এতটুকুও ইচ্ছ করছে না।

***
এ বাড়িতে আজ হাফিজুরের ছোটো বোন চিত্রার গাঁয়ে হলুদ। ছেলের বাড়ি তাদের ঠিক পাশের বাড়িই। প্রেমের বিয়ে।
দুবাড়ির লোক মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে একই প্যান্ডেলের নিচে দু বাড়ির অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। গাঁয়ে হলুদও হবে একই সাথে।‌ সবাই যখন বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। উর্বী তখন জমিদার বাড়ির মতো বিশাল এই বাড়ির দোতলার সবগুলো ঘর পরিদর্শন করতে ব্যস্ত। দু বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই বিয়ে বাড়ীর প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। সাউন্ড বক্সে নব্বই দশকের হিন্দি গান বাজছে। হাফিজুরদের বাড়ি পুরো ফাঁকা। সবাই গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছে। বাড়িতে শুধু রয়ে গিয়েছে রাওনাফ আর উর্বী। উর্বী নিজের মনে ফাঁকা বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রাওনাফকে দেখে এসেছে একটার পর একটা ফোনকল রিসিভ করে কথা বলতে। হসপিটালের ফোন।

হঠাৎ দোতলার সিঁড়ি ভে’ঙে উপরে উঠতে থাকে হাফিজুরের আরেক বোন লতা। বয়স আজমেরীর কাছাকাছি। তার পেছনে রয়েছে এই বাড়ির কিছু বৌ, যারা সবসময় ঘোমটার আড়ালে থাকে। কিন্তু এরা একে অন্যের সাথে সবসময় অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে মজা করে। উর্বী বিকেলে গোসল করেছিলো, উর্বীর চুল ভেজা দেখে ঘোমটার নিচ থেকে লাজুক একটা মুখ বলে ওঠে,”ডাক্তার দেখছি তোমাকে তিন বেলা গোসল করাচ্ছে নতুন ভাবী।”

উর্বী হা হয়ে মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মহিলা কথাটি বলেই তার এক জা’য়ের গাঁয়ে হাসতে হাসতে হু’মরি খেয়ে পরেছে। উর্বী এখানে আসার পর থেকেই একটু এড়িয়ে চলে আজমেরীর জা’গুলোকে,সাথে আজমেরীর ননদ লতাকেও।

উর্বীকে অবাক করে দিয়ে লতা মহিলা গুলোকে নিয়ে হুরমুর করে পশ্চিমের ঘরটাতে প্রবেশ করে। উর্বী বুঝতে পারছে না তারা কিভাবে জানলো উর্বী ঠিক এই ঘরেই আছে, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই লতা এসে উর্বীর হাত ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে বেড় করে। উর্বী অবাক হয়ে বলে,”কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে আপনারা?”

_ডাক্তারের কাছে।
হাসতে হাসতে জবাব দেয় লতা।

_কেন?

_ওষুধ দেবে ডাক্তার।

উর্বীকে কিছু বলতে না দিয়ে সবাই উর্বীকে টেনে রাওনাফের ঘরে ঢোকায়। রাওনাফ এই মাত্র ডক্টর কিশোরের সাথে কনফারেন্স কল শেষ করে ল্যাপটপ চার্জে বসিয়েছে। উর্বী আর লতাদের দেখে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। লতা বলে,”প্যান্ডেলে যেতে হবে।”

_মানে!
রাওনাফ হতভম্ব হয়ে বলে। পর পর বলে,
_দেখো,আমি হাফিজুরকে বলেছি লতা তোমরা আনন্দ করো,আমার কল আসছে একটার পর একটা হসপিটাল থেকে!

লতা এগিয়ে গিয়ে বলে,”ওসব কিছু শুনতে চাই না। চিত্রা আর সাকিবের গাঁয়ে হলুদের সাথে সাথে আরো অনেকের গায়ে হলুদ হচ্ছে সেখানে, সামিউল আর অন্তরারও হচ্ছে। আপনার আর নতুন ভাবীর টা বাদ থাকবে কেন? চলেন। এক্ষুনি চলেন।”

রাওনাফ অস্বস্তি নিয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লতা বলে ওঠে,”নতুন ভাবীকে কোলে তুলুন।”

উর্বী হতভম্ব হয়ে লতার দিকে তাকায়। রাওনাফ বলে ওঠে,”হোয়াট!”

_হোয়াট ফোয়াট আবার কি? এ বাড়ির বিয়ে কি প্রথম দেখছেন? বর বৌকে কোলে করে নিয়ে যাবে। নিন, তাড়াতাড়ি ভাবীকে কোলে তুলুন।

রাওনাফ ধমক দিয়ে কথা বলতে জানেনা, নয়তো অনেক বড় সর একটা ধ’ম’ক দিতো লতাকে আজ। সে শুধু ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে,”তোমরা গিয়ে আনন্দ করো লতা। আমার ফোন এসেছে হসপিটাল থেকে।”

উর্বী ঘর থেকে প্রায় ছুটে বের হতে চাইলে অন্যান্য মহিলারা উর্বীর হাত ধরে ফেলে। লতা রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,”আমরা আমরাই তো বেয়াই! অসুবিধা কি? বিয়ে করতে পেরেছেন এখন ল’জ্জা পাচ্ছেন কেন!”

রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে,”আমার বাচ্চারা রয়েছে লতা। এসব বন্ধ করো!”

_তাই নাকি! তাহলে বাচ্চাদের সামনে ভাবীকে নিয়ে ঘরের দরজার সিটকিনি কিভাবে লাগান!

উর্বীর কান গ’রম হয়ে গিয়েছে। রাওনাফ থতমত খেয়ে লতার দিকে তাকিয়ে আছে। লতার পেছন আজমেরী লতাকে ধ’ম’কে ওঠে,”লতা! কি হচ্ছে এসব!”

লতা মাথা ঘুরিয়ে তার ভাবীর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের বলে,”বেয়াই সা’বের সাথে মস্করা করছি! তুমি নাক গলাতে এসো না!”

আজমেরী ঘরে ঢুকে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইজান মোল্লা বাড়ি থেকে মোর্শেদ চাচা আর ওনার ওয়াইফ এসেছে,তুমি চেনো। তোমাকে পাঁচ বছর আগে দেখেছে। চলো ওনাদের সাথে কথা বলবে।”

রাওনাফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এই লতার খপ্পরে পরলে আজ মান সম্মানের বারোটা বেজেই যেতো। মনে মনে সে আজমেরীকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয়।

আজমেরী আর রাওনাফ চলে যায়। উর্বী চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে, লতা বলে,”পারলাম নাহ!”
তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এমনিতে কোলে তোলে তো অসুখ সারানোর বাহানায়?”

লতার পাশে দাঁড়ানো ভাবী দুজন উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। উর্বী নিচু স্বরে বলে ওঠে,”আমি নিচে যাচ্ছি।”

_হ্যা যাও। তোমার স্বামী ওদিকেই গিয়েছে!

হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে লতা এবং বাকি মহিলারা। উর্বী দ্রুত পা ফেলতে থাকে।
দূরের প্যান্ডেল থেকে গান ভেসে আসছে,”আজ ব্লু হ্যা পানি পানি!” এটা নিশ্চয়ই শর্মী আর তার দলবলের কাজ!

***
আজ সকাল টা বেশ চমৎকার! কোনো গাড়ির হর্নের শব্দ নেই বরং চারিদিকে শুধু পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ।
উর্বী ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নেয়। রাওনাফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাল রাওনাফ, হাফিজুর, শাফিউল, রুমার স্বামী সোহেল আর হাফিজুরের ভাইয়েরা মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছে। রাওনাফ রাতে কখন ঘরে এসেছে তা উর্বী জানে না তবে সম্ভবত ফজরের আজান যখন দিয়েছে তখন রাওনাফ মসজিদে গিয়েছিলো টুপি হাতে,ঘুম ঘুম চোখে দেছিলো উর্বী,একটু একটু মনে আসছে!

শরীরটা খুব কাহিল লাগছে ইদানিং,বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছে করে না। একজন গাইনোকলজিস্টের সাথে কি কথা বলে নেবে উর্বী !

দরজায় টোকা পরে হঠাৎ। উর্বী দরজা খুলে দেখে অন্তরা দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী বলে,”কিছু বলবে?”
-বড় আপা দেখতে বলেছে আপনারা উঠেছেন কি না। তাহলে যেনো খাবার ঘরে যেতে বলে দেই।

-তোমরা কখন উঠেছো?

-আমরা খুব ভোরেই উঠেছি।

এই বলে অন্তরা চলে যায়। উর্বী খাবার ঘরের দিকে না গিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। সেখান থেকে আজমেরীর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে,মোহনা এবং বাকি মহিলারাও রয়েছে এ বাড়ির। উর্বী রান্না ঘরে ঢুকতেই আজমেরীর বড় জা রুকাইয়া বলে,”আরে এই যে আসল লোক এসে গিয়েছে। কিগো নতুন বউ ঘুম ভালো হয়েছে?”

উর্বী হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। আজমেরী একথালা পিঠা ভেজে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে খাবার ঘরের দিকে যায়। রুকাইয়া উর্বীর কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,”চোখের নিচে কালি কেন? রাওনাফ ভাইয়া ঘুমাতে দেয়না ঠিকঠাক মতো?”
উর্বী হতবাক হয়ে তাকায়। সে বুঝতে পারে না এ ধরনের মশকরায় কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ। এ বাড়িতে মেয়েলী আলাপ যেদিক থেকেই শুরু হোক না কেনো তা শেষ হয় উর্বী রাওনাফের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে। যেনো আর কোনো প্রসঙ্গ নেই কথা বলার। অথচ অন্যান্যদের নিয়ে এতটা রসালো মশকরা কেউ করে না।

উর্বী চোখে মুখে এক রাশ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মোহনা বুঝতে পেরে বলে,”উর্বী মানে ভাবী দেখো তো রুমার মেয়ে মিশফা কোথায়। ও সকাল থেকে বড়মামী বড়মামী বলে তোমায় খুজেছে ।”

উর্বী যেনো হাফ ছেড়ে বাচে। সে এক প্রকার পালিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে।

***
বিয়ে বাড়ির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। এ বাড়ির মেয়েকে পাশের বাড়িতে অর্থাৎ তার শশুর বাড়ীতে তুলে নেওয়া হয়েছে। বাড়িতে এখনও রাজ্যের মেহমান। সারাক্ষণ হৈ হুল্লোড় লেগেই থাকে। উর্বীর এতো হৈ হুল্লোড় ভালো লাগে না তবে রাওনাফ করিম খানের তিনটা গোমরামুখো ছানা এখানে এসে আনন্দে মেতে আছে। উর্বীর এই ব্যাপারটা দেখতে ভালোই লাগছে।

দোতলার বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে উর্বী দাঁড়িয়ে পরে। মাথাটা ভীষণ ভার হয়ে আছে। জ্বর আসার আগে যেরকম অনুভূতি হয় ঠিক সেরকম। আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি। শীতকালের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর সর্দি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উর্বী বৃষ্টিতেও ভেজেনি। এমনিতেও উর্বীকে অসুখ বিসুখ চট জলদি কাবু করে ফেলে ইদানীং। বাইরে বৃষ্টি এখনও থামেনি। রাওনাফের আজ ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো। সে কোনো কারণে যেতে পারেনি। উর্বীর সাথে সকাল থেকেই তার কথা হয়নি। দোতলার রেলিং ধরে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পায় ডক্টর রাওনাফ করিম খান তার তিন ছানাকে ধমকে শীতের পোশাক পরাচ্ছেন। উর্বী সেদিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। শর্মী তার পাপাকে জরিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আহ্লাদী কন্ঠে বলছে,”সোয়েটার পরে নিতে পারি যদি তুমি আমাদের রেখে ঢাকা না চলে যাও তো।”

বায়না করছে পাপার কাছে। রাওনাফের মুখ হাসি হাসি। সে খুবই নিচু স্বরে তার ছেলে মেয়েদের কিছু একটা বলছে। দোতলা থেকে উর্বী শুনতে পাচ্ছে না সেসব কথা। সে শুধু রাওনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কতটা সুখী একজন মানুষ। যার খুবই সরল একটা জীবন,যার জীবনটা সরল রেখায় চলে। ফজরের আজান হলেই উঠে মসজিদে যায়। মসজিদ থেকে ফিরে নিয়ম করে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে হালকা কিছু খেয়ে ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের খাইয়ে হসপিটালে চলে যায়,সেখান থেকে চেম্বার, বাড়িতে ফিরে পরিবারকে সময় দেয়। ইনি হচ্ছেন পৃথিবীর সবথেকে ব্যস্ততম সুখী মানুষ। কত সরল জীবন তার, উর্বী নামের জটিলতার সাথে শুধু শুধু জরিয়ে ফেলেছে নিজেকে।
রাওনাফ একজন সুখী মানুষ, উর্বী একজন দুঃখী মানুষ। রাওনাফ একজন সরল মানুষ, উর্বী একজন জটিল মানুষ। রাওনাফ একজন আশীর্বাদ প্রাপ্ত মানুষ,উর্বী একজন অভিশপ্ত মানুষ। কিছুর মিল নেই, কিচ্ছুটির নেই।
না বয়স, না চিন্তা ভাবনার, না অবস্থানের, সবকিছুর অমিল। পরিস্থিতি এসে বলেছে,”তুমি তোমার জীবনের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্যের একটা জীবন জরিয়ে ফেলতে চলেছো, বলো,কবুল, কবুল, কবুল।”

আর দুজন বোকা মেরুদণ্ডহীন প্রানী, রাওনাফ করিম খান এবং মৃদুলা উর্বী বলে ফেলেছে, কবুল।

এতো অমিল অথচ একটা রে’জি’স্ট্রেশন পেপারে দুজনের স্বাক্ষর খুব যত্নে আলমারিতে পরে আছে।

উর্বী বাবা ছেলে মেয়েদের খুনসুটি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরে। বাচ্চাগুলো একেবারেই রাওনাফের মতো হয়েছে। চেহারার গঠন তাই বলে। তিনটা বাচ্চাই চমৎকার দেখতে। উর্বীর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে বাচ্চাগুলোর নাক টিপে দিতে।
দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উর্বী রাওনাফের হাতের দিকে তাকায়। ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা লোকটার। আজ দুপুরে এ বাড়ির পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে গিয়েছিলো এ বাড়ির বড় পুকুরে। ছিপে একটা মাছ না গাথলেও রাওনাফের হাতে ঠিকই গেঁথেছে হুকটা। কেমন অদ্ভুত লোক! বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ক্ষ’ত হয়েছে।

উর্বী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ইচ্ছে করছে বিছানার সাথে মিশে যেতে। তবে সে নিশ্চিত, এখন বিছানা নিলেই তিনদিনের জন্য পরে থাকবে সে। শরীর তাই বলছে। ধীরপায়ে হেঁটে সে ঘরে ঢোকে। তাদের যে ঘরটিতে থাকতে দেওয়া হয়েছে সে ঘরটিতে একটা বিশাল বড় বইয়ের আলমারি আছে। বই দেখে প্রথমে উর্বী অনেক খুশি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আলমারি খুলে দেখে সব কিশোর সংকলন।
উর্বী ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফোনটাতে চার্জ নেই। ভুল করে সে চার্জার টা ফেলে রেখে এসেছে। কারো কাছ থেকে চেয়ে আনারও প্রয়োজন বোধ করেনি সে,তার ফোনে বিশেষ কোনো কাজ নেই।

দরজা ঠেলে রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। উর্বী ঘা’ড় ঘুরিয়ে তাকায়। রাওনাফের হাতের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফ নিজের ব্যাগ গোছাতে তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দেয়। উর্বী বলে ওঠে,”আপনি চলে যাচ্ছেন?”

রাওনাফ তার ব্যাগ এনে বিছানার উপরে রেখে বলে,”হু।”

এক হাত দিয়ে ব্যাগের চেইন খুলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। উর্বী বলে,”হেল্প করবো?”

রাওনাফ ম্লান হেসে বলে,”পারবো।”

কথাটি বলতে না বলতে ব্যান্ডেজ করা হাতের সার্জিক্যাল গজ কাপড়ের সাথে চেইনের হুক আটকে যায়,রাওনাফ খেয়াল না করেই বাম হাত দিয়ে চেইন ধরে টান দিতেই ডান হাতে ব্যাথা পায়। টান লেগে যাওয়ায় হাত দিয়ে গলগল করে র’ক্ত ঝ’রতে থাকে। রাওনাফ দাঁতে দাঁত চেপে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
কয়েক মুহূর্তের ঘটনায় উর্বী হতভম্ব। সে বেড সাইডের টেবিল থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে রাওনাফের মুখোমুখি বসে। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”আমাকে বললেই হতো।”

রাওনাফ কিছু না বলে র’ক্তা’ক্ত ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলে। উর্বী রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বলে,”জ’খম টা মারাত্মক। কাউকে ব্যাগ গুছিয়ে দিতে বললেই তাকে জোর করা হয়না,তাকে অ’ত্যা’চার করা হয় না। বলতে পারতেন আমাকে।”

রাওনাফ চুপ করে থেকে উর্বীর দিকে একপলক তাকায়। উর্বী নতুন করে তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলে,”আপনি বসুন। আমি রুমা আপাকে ডেকে আনছি ‌। আপনার ব্যাগ গুছিয়ে দেবে।”

***
রাওনাফের ঢাকা যাওয়া হয়নি। শর্মী পাপাকে যেতে দেবে না তাই গাড়ির চাবি লুকিয়ে রেখেছে।

সন্ধ্যার পর থেকে উর্বীর শরীর টা খারাপ হতে শুরু করে। রাওনাফ নিচ তলায় গিয়েছে। উর্বী ঘরে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।

বাইরে থেকে রুমা উকি দিয়ে ডাকে,”ভাবী বের হও না। সন্ধ্যা বেলায় কি শুয়ে আছো! নিচে সবাই গানের কলি খেলছে। মালাই চা আর আলুর চপ আছে সাথে।”

-আমার শরীর টা ঠিক লাগছে না আপা। তোমরা আনন্দ করো।

-সে কি! কি হয়েছে!
রুমা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে।

-মনে হচ্ছে গায়ে জ্বর আসতে চলেছে। মাথা টা ভারি হয়ে আসছে।

রুমা এসে উর্বীর কপালে হাত দেয়।
-তাইতো! তোমার গা তো বেশ গরম হয়ে আছে। হঠাত এমন হলো কেনো!

-মাঝেমাঝে আমার সাথে এমন হয়। আমি অভ্যস্ত এতে।

-দাড়াও ভাইয়াকে ডাকি।

রুমা উঠে যেতে চাইলে উর্বী তার হাত টেনে ধরে। আস্তে করে বলে,”তোমার ভাইয়াকে ডাকতে হবে না আপা,কিছু হলে আমি ওষুধ খেয়ে নেবো।”
রুমা উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে,”আমি ভাইয়াকে ডাকতে যাচ্ছিলাম কারন সে একজন ডাক্তার। এই সময় যদি তোমাকে জ্বর পেয়ে বসে তাহলে সবার আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি চাও না ভাইয়া আসুক,এসে তোমাকে দেখুক।”

-না আসলে এই সামান্য ব্যাপারে তাকে ডাকার, তাছাড়া তার হাতে ব্যা’থা।

রুমা উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”বুঝেছি। ডাকবো না আমি। কোনো অসুবিধে হলে আমায় ডেকে নিও।”

রুমা চলে যায়। উর্বী এক দৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।

***
রাওনাফ রুমে ঢুকে দেখে উর্বী ঘুমিয়ে আছে। রাতে সে খেতেও যায়নি। রুমা ঘরে খাবার দিয়ে গিয়েছিলো। খাবারটা ঠিক সেভাবেই পরে আছে।
রাওনাফ গিয়ে বিছানার অন্যপাশে শুয়ে পরে। হাতের ব্যাথাটা কিছুটা কমেছে।

কিছুক্ষন পরে রাওনাফ খেয়াল করে উর্বী কি যেনো বিড়বিড় করছে।

রাওনাফ বুঝতে পারে না কিছু। সে উঠে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে উর্বী কাঁপছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রাওনাফ ডাকে,”উর্বী!কোনো সমস্যা!”

উর্বী উত্তর দেয় না। সে জ্বরে প্র’লাপ বকছে। রাওনাফ শুনতে পায় উর্বী “মা মা” বলে কিসব বলছে। যেটুকু বলছে খুবই অস্পষ্ট!

রাওনাফ বুঝতে পারছে না সে কি করবে, কাউকে কি ডাকবে! সে অনেকটা সংকোচ নিয়ে উর্বীর কপালে হাত রাখে। কপালে হাত রাখতেই সে চ’মকে ওঠে। উর্বীর শরীর জ্বরে পু’ড়ে যাচ্ছে। রাওনাফ উঠে দ্রুত তার ব্যাগ থেকে থার্মোমিটার বের করে নিয়ে আসে। উর্বীর কপালে ধরতেই সে দেখতে পায় তাপমাত্রা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অথচ সন্ধ্যায় যখন দেখা হয়েছিলো তখন দেখে মনে হয়নি মেয়েটা অসুস্থ!
রাওনাফ চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হয়ে রুমাদের ঘরের কাছে যায়। রুমার দরজায় ধাক্কা দেওয়ার পরে রুমা ঘুম চোখে বের হয়ে আসে,”কি হয়েছে ভাইয়া?”

-তুই একটু আমার রুমে আয় তো।
রুমা অবাক হয়ে রাওনাফের পিছু পিছু যায়।

ঘরে ঢুকেই রাওনাফ বলে,”বুঝতে পারছি না কি করা যায় বলতো।এতো জ্বর উঠেছে। ডাকলে সারাও দিচ্ছে না।”

রুমা দ্রুত উর্বীকে গিয়ে ধরে,”ও ভাবী। শুনতে পাচ্ছো কথা আমার!”
উর্বী কোনো কথা বলতে পারে না। কাঁ’পতে থাকে।

রাওনাফ বলে,”ইমেডিয়েটলি আমাদের জ্বর নামাতে হবে। তুই একটা বালতিতে পানি আর একটা মগ নিয়ে আয়।”
রুমা দৌরে আজমেরীকে ডেকে তোলে। তারপর একটা মগ আর পানি ভর্তি বালতি নিয়ে আসে।
উর্বীর কাঁপুনি থামছেই না।

আজমেরী উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘরে ঢুকে বলা শুরু করে,”রাতে বললো ওষুধ খেয়েছে। বললাম ভাইজানকে বলি, বললো জ্বর হলে কি ওষুধ খেতে হয় তা আমি জানি। তোমার ভাইয়াকে বলতে হবে না। আজ তো আমরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজেছি। ভাবী তো ভেজেনি! হঠাৎ এমন জ্বর উঠবে কেন!”

রাওনাফ বলে,”ঠান্ডা থেকে এই জ্বর হয়নি। দেখেই তো মনে হচ্ছে ইমিউনিটি কম। মাথায় পানি ঢালতে থাক।”
রুমা উর্বীর মাথায় পানি ঢালতে থাকে। রাওনাফ আজমেরী কে বলে,”তুই যা, গিয়ে ঘুমা। বিয়ে বাড়ির ধকল গিয়েছে তোর উপর দিয়ে। রুমা আছে,ও দেখবে।”

আজমেরী আরো কিছু সময় থেকে রাওনাফের জোরাজুরিতে চলে যায়।
দীর্ঘ সময় ধরে রুমা উর্বীর মাথায় পানি ঢালে, তাপমাত্রা একটু কমে আসতে শুরু করেছে।
হঠাত রুমার মেয়ে মিশফা কেঁদে ওঠে। রাওনাফ বলে,”তুইও যা।আর পানি ঢালার প্রয়োজন নেই। আমি দেখছি।”

-তুমি পারবে?
রুমা অবাক হয়ে জিগ্যেস করে।

-হ্যা। তুই যা।
রুমা চলে যায়। রাওনাফ বিছানার একপাশে চুপচাপ বসে পরে।

উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”উর্বী।”
উর্বী কোনো সা’ড়া দেয়না। রাওনাফের চোখ চলে যায় উর্বীর হাতের দিকে। ডান হাতের কব্জির কাছটাতে বিরাট ক্ষ’ত। এটা সে সেদিন খেয়াল করেছে পালস রেট চেক করতে গিয়ে। রাওনাফ ম্লান হাসে। সে একটা জিনিস খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছে তার ডাক্তারি জীবনে,তার কাছে এ পর্যন্ত সতেরো-ত্রিশ বছর বয়সী যতগুলো মেয়ে পেশেন্ট এসেছে,তাদের মধ্যে ৭০% মেয়েদের হাতে, কব্জিতে কাটার চিহ্ন। বাংলাদেশের এই স্টেজের মেয়েরা চারিত্রিক ভাবে খুব আবেগী থাকে। শিমালার কথা মনে পরে যায় রাওনাফের। শিমালার বাবা মা যখন জেনে গিয়েছিল রাওনাফের সাথে শিমালার সম্পর্ক রয়েছে তখন মেয়েটাকে প্রচুর মা’রধর করেছিলো। রাগে, দুঃখে, রাওনাফকে না পাওয়ার যন্ত্র’না’য় হাতের শিরা কাঁটার চেষ্টা করেছিলো শিমালা।
উর্বীও কি ঐ আবেগী কাতারের মেয়ে? দেখে তো মনে হয় না! এই মেয়েটিও কারো জন্য হাত কেটেছিল তরুণী বয়সে! ক্ষ’তটা দেখে মনে হচ্ছে কয়েক বছরের পুরনো।
হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকায় রাওনাফ। শিমালার সাথে এই মেয়েটির চেহারার কোনো মিল নেই কিন্তু এই মেয়েটির থুতনিতে টোল আছে, যেটা শিমালারও ছিলো।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাওনাফ আবার ডাকে,”উর্বী!”

উর্বী কিছুটা সময় নিয়ে “হু” বলে সারা দেয়। রাওনাফ বলে বলে, “কি কি ওষুধ খেয়েছিলে রাতে? নাম বলো।”

উর্বী আবারো “হু” বলে। রাওনাফ বুঝতে পারে উর্বী ঠিক নেই। সে উঠে দরজার সিটকিনি তুলে দেয়। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”মৃদুলা উর্বী। তুমি দেখছি দিনকে দিন আমাকে তোমার পার্সোনাল ডক্টর বানিয়ে ফেলছো। কি অদ্ভুত!”

চলমান…..

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১১
#Esrat_Ety

উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে বসে আছে। সে তার গায়ে একটা কালো রঙের শাল জরিয়ে রেখেছে। কাল রাতে তার জন্য কতগুলো মানুষের ঘুম ন’ষ্ট হয়েছে। এটা ভেবেই তার সুপ্ত অপরাধবোধ হচ্ছে। মোহনার কাছ থেকে সে জানতে পেরেছে সব। কাল রাতের পর আর জ্বর আসেনি। তবে শরীরটা অস্বাভাবিক ক্লান্ত। বিছানা থেকে উঠে সে বারান্দায় হাটতে থাকে। সামিউল এদিকেই আসছিলো। উর্বীকে বারান্দায় দেখে দাঁড়িয়ে পরে। উর্বীর সামনে পরলেই তার ভিষন লজ্জা লাগে। সহজে সে উর্বীর সামনে পরে না। জড়তা কাটিয়ে সে উর্বীকে বলে,”আপনার জ্বর সেরেছে…….ভাবী?”

উর্বী হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায়। এই লোকটাকে কোনো এক কারণে উর্বী বেশ পছন্দ করে। স্বভাবে ভীতু শ্রেনীর পুরুষ হলেও অন্তরার প্রতি সামিউলের ভালোবাসা দেখেই সামিউলকে ভালো লাগে উর্বীর।

সামিউল চলে যায়। যে পথ দিয়ে সামিউল গিয়েছে সে পথ দিয়ে রাওনাফকে আসতে দেখা যায়। উর্বী মানুষটার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়, বিয়ের পর থেকে সমঝোতা হচ্ছে নাকি হচ্ছে না উর্বী বুঝতে পারছে না,তবে উর্বীর জন্য রাওনাফ নামের এই লোকটার ভোগান্তি বেড়েই চলছে। অবশ্য এসব তো উর্বী জানতোই। রাওনাফ উর্বীকে দেখে বলে,”এখন কি অবস্থা! হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিয়েছো দেখছি!”

-আমি ঠিক আছি। জ্বর আর ওঠেনি।
নিচু স্বরে বলে ওঠে উর্বী।

-বেশ ভালো। তাহলে জ্বরের ওষুধ টা স্কিপ করে যেও। ওটা জ্বর থাকলেই খেয়ো। আর এভাবে জ্বর উঠলে আন্দাজে কোনো ওষুধ খাওয়া উচিৎ না।

উর্বী মুচকি হাসে। বাইরে থেকে সকালের মিষ্টি রোদ উর্বীর মুখের উপরে পরায় উর্বীকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। তার চুলগুলী এলোমেলো হয়ে আছে, চুলে বিনুনি করা ছিলো।
উর্বী বলে ওঠে,”কাল রাতে আপনাদের অনেক বিরক্ত করেছি!আসলে আমার এরকম হয় মাঝে মাঝে।”

-হুম বুঝতে পেরেছি। এভাবে হঠাত করে জ্বর আসা আবার হঠাত করে চলে যাওয়া স্বাভাবিক কোনো বিষয় না।

-এরকম আমার ছোটোবেলা থেকেই হয়।

-তোমার জ্বরের মুড সুইং হয় সম্ভবত।

উর্বী হাসে। রাওনাফের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আপনার হাতের ব্যাথা সেরেছে?”

রাওনাফ নিজের হাত উল্টে পাল্টে বলে,”হাতে ব্যাথা পেয়েছি কিনা সেটাই মনে পরছে না। যাও গিয়ে রেস্ট নাও। আমরা বিকেলে চলে যাবো।”

***
শর্মী উর্বীর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী বলে, “এসো এদিকে এসো। কিছু লাগবে?”

-আমীরুন খালামনিকে দেখেছেন?
-আমীরুন আপা তো বাইরে গিয়েছেন। কি দরকার আমায় বলো।আমি ফ্রি আছি।

-আসলে আমার চুল বেধে দেয় আমীরুন খালামনি। আমি ভাইয়া আপির সাথে বের হবো।

-এজন্য আমীরুন আপাকে ডাকতে হবে? এসো আমি বেধে দিচ্ছি।

শর্মী এদিক ওদিক তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ঘরে ঢোকে। আপি ভাইয়া যদি দেখতে পায় এই মেয়েটা তার চুল বাধছে তাহলে নির্ঘাত ব’ক’বে।

তবুও শর্মী ঘরে ঢোকে, শর্মী বড়দের ফিরিয়ে দিতে পারে না কখনোই। ঘরে ঢুকে উর্বীর কাছে এসে বসে সে।
নিচু স্বরে বলে,
-আপনার জ্বর সেরেছে?

-হ্যা। দেখি মাথা টা সোজা করো। দুটো বেনী করবো না একটা?

-দুটো। আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

-হ্যা অবশ্যই বলো।

-না থাক। কি দেখে হাসছিলেন ফোনে?

-একটা খুবই মজার কমেডী শো। তুমি দেখবে?

শর্মী কিছু বলার আগেই উর্বী তার ফোন টা শর্মীর হাতে দেয়।
শর্মী একটু পরপর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। উর্বী শর্মীর ছেলেমানুষি দেখে খুবই মজা পাচ্ছে। এমন সময় শায়মী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শর্মী কে ডাকে।

উর্বী বলে,”এসো ভেতরে এসো। ”

-এটা আমার পাপার ঘর।‌ আপনার আমাকে আসতে বলার প্রয়োজন নেই।
এতো বড় কড়া কথাটি শায়মী খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে।

উর্বী চুপ করে থাকে। শর্মী মোবাইল টা রেখে উঠে দাঁড়ায়।

নাবিল শর্মীর দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। শর্মী বুঝতে পারছে না ভাইয়া এমন করছে কেনো!

-আজকাল নতুন মায়ের সাথে বেশ ভাব জমিয়েছিস তাইনা শর্মী!
দাঁত খিচিয়ে বলে ওঠে নাবিল।

-আমিতো শুধু চুল বাধতে গিয়েছিলাম ভাইয়া।

-ওহহ। আপনি চুল বাধতে গিয়ে নতুন মায়ের কোলে উঠে হাসাহাসি করছিলেন?

শর্মীর মন খারাপ হয়ে যায়। ভাইয়া তাকে খুবই কড়া করে কথাগুলি বলছে।

“উনি কিন্তু অতটাও খারাপ না ভাইয়া।” শর্মি খুব ভয়ে ভয়ে বলে ওঠে কথাটি।

নাবিল কয়েক মূহুর্ত শর্মীর দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,
-শায়মী ওকে চুপ থাকতে বল নয়তো গাড়ি থেকে ওকে ছু’ড়ে বাইরে ফেলে দেবো।

শর্মী নাবিলের কথা শুনে চুপ করে বসে থাকে।

***
শাফিউলের কলেজ থেকে ট্রান্সফার লেটার এসেছে। তাকে চট্টগ্রামের একটি স্বনামধন্য কলেজে ট্রান্সফার করা হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে যেতে হবে সেখানে। রওশান আরা মোহনাকেও সাথে যাওয়ার আদেশ দিয়েছেন। মোহনা বুঝতে পারছে না এতো বড় সংসার ছেড়ে কিভাবে সে অন্যখানে গিয়ে থাকবে।
রওশান আরা তার শাশুড়িকে বলে,”মা,আমি গেলে এদিকটা কে সামলাবে?”
-কেনো! আমার বড় ছেলের বৌ। এখন থেকে সে সব সামলাবে।

মোহনা উর্বীর দিকে তাকায়। রওশান আরা মোহনাকে বলে,”এটা তোমার সংসার না, স্বামীর সাথে যেখানে থাকবে সেটাই তোমার সংসার। একটা মেয়ের কাছে তার স্বামীই সবকিছু।”

রওশান আরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে মোহনাকে বলে,”আমার বড় বৌমার উপরে আমার আস্থা রয়েছে। তুমি নিশ্চিন্তে শাফিউলের সাথে যাও মেজো বৌমা।”

দু একদিনের মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে মোহনা আর শাফিউল চলে যায়। বাড়িতে দু দুজন মানুষের অনুপস্থিতি বেশ উপলব্ধি করা যাচ্ছে।

মোহনা প্রতিদিন ফোন করে বাড়ির সবার সাথে কথা বলে। তারা দুজন সেখানে বেশ ভালোই আছে নিজেদের ছোট্ট সংসার নিয়ে।

শর্মীর ফাইনাল পরিক্ষা শুরু হতে চলেছে। তাকে সবসময় তার পড়ার টেবিলেই পাওয়া যায়।
শায়মী আর শান্তর মাধ্যমিকের নির্বাচনী পরিক্ষার রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে। তারা দুজনেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। এখন দুজনেই মন লাগিয়ে মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অন্তরা খুবই যত্নের সাথে তার দুই রুমের সংসার টাকে সাজাচ্ছে। সামিউলের একটা বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে। খুবই ভালো বেতন। তারাও বেশ সুখে আছে। তবে রওশান আরা এখনও তাদের মেনে নেন নি।

***
আগামী কাল থেকে উর্বীর অফিস শুরু। কিছু জরুরী কাগজপত্র দেখে উর্বী ফাইলে ঢুকিয়ে রাখে।

শর্মী এসে বারবার বাইরে থেকে উকি দিচ্ছে। উর্বী অনেক আগেই তা খেয়াল করেছে। সে ঠান্ডা গলায় ডাকে, “শর্মী! এদিকে এসো।”

শর্মী ঘরে ঢোকে। তার হাতে অংক বই। উর্বী তাকে বলে,”কিছু বলবে?”
-পাপার কাছে এসেছিলাম।
ঝটপট উত্তর দেয় শর্মী।

-কিন্তু তোমার পাপা তো তোমার দাদুর ঘরে। তোমার দাদুর প্রেশার চেক করতে গিয়েছেন। মা অসুস্থ বোধ করছেন হঠাৎ।

-ও আচ্ছা।
শুকনো গলায় বলে শর্মী চলে যেতে গেলে উর্বী বলে ওঠে,

-অংক নিয়ে কোনো প্রবলেম হলে আমায় বলতে পারো। আমি অংক ভালোই বুঝি।

শর্মী উর্বীর দিকে ফিরে তাকায়। তার জ্যামিতি চ্যাপ্টারে একটু সমস্যা হয়েছে। এটা কাল সন্ধ্যায় তার টিচার আর রাতে তার পাপাও বুঝিয়ে দিয়েছিলো। এখন আবার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। নাবিল আর শায়মী কেউ বাসায় নেই নয়তো সে তাদের কাছেই যেতো। শর্মী ভাবে, তার পাপাকে জিজ্ঞেস করলে যদি পাপা বিরক্ত হয়। তার চেয়ে উর্বীর থেকে বুঝে নেওয়া যাক।
শর্মী বিছানার একপাশে বসে তার অংকের বইটা উর্বীর দিকে এগিয়ে দেয়।
উর্বী বইটা হাতে নিয়ে বলে,”ওহ এইটা। এইটা তো পানির মতো সহজ। এদিকে এগিয়ে বসো। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
শর্মী এগিয়ে বসে।

রাওনাফ এসে দরজার বাইরে থেকে দেখে অবাক হয়ে যায়। শর্মী চোখ বড় বড় করে উর্বীরর দিকে তাকিয়ে উর্বীর কথা শুনছে।

রাওনাফ ঘরে ঢোকে না, সেখান থেকে সরে যায়।

***
রওশান আরা চোখ বন্ধ করে তার আরাম কেদারায় শুয়ে আছেন। উর্বী এসে তাকে ডাকে,”মা আমায় ডেকেছিলেন?”

-হু। এদিকে এসো। বসো।

উর্বী রওশান আরার কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে। রওশান আরা উর্বীকে দেখে,কি সুন্দর মুখশ্রী! দেখলেই রওশান আরা এক অদ্ভুত টান অনুভব করে। প্রথম দিন থেকেই।

রওশান আরা বলেন,”রাওনাফ এসেছে?”

-না,এখনো ফেরেননি।

-আচ্ছা। আজ তোমার ভাইয়া ফোন দিয়েছিলো। তুমি নাকি ওবাড়িতে যেতে চাচ্ছো না। কোনো সমস্যা?

-না মা আসলে নতুন চাকরি,এখনি ছুটিছাটা নিতে চাচ্ছি না।

-বুঝলাম। কিন্তু তাই বলে নতুন বিয়ে হয়েছে সেই মেয়ে আর মেয়ে জামাই তাদের বাড়িতে যায়নি,বিয়ের দেড় মাস হয়ে গিয়েছে। এটা তো ভালো দেখায় না মা। সবচেয়ে বড় কথা তোমার ছোটো বোনের বিয়ে।

উর্বী চুপ করে থাকে। রওশান আরা বলে,”রাওনাফ কি যেতে চাচ্ছে না? এরকম কিছু?”
-না মা,সেরকম টা না।
-তাহলে আমি রেজাউল কে ফোন করে বলছি তোমরা সামনের সপ্তাহে যাবে। রাওনাফ আসলে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিও। এখন তুমি যাও।

উর্বী উঠতে যাবে অমনি রাওনাফ এসে রুমে ঢোকে। রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে,”মা আমিরুনকে কোথাও দেখছি না!”

-আমিরুন একটু দেশের বাড়ি গিয়েছে। তার বাবা অসুস্থ।
-ও আচ্ছা।
-তুই কখন এলি। আর আমিরুনকে ডাকছিলি কেনো।

-এই তো এইমাত্র এসেছি,আমিরুনকে ডাকছিলাম একটু কফির জন্য।

-সব সময় আমিরুন আমিরুন করিস কেনো। কিছু লাগলে বৌমাকে তো বলতে পারিস।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়।
রওশান আরা বলেন,”বৌমা তুমি রাওনাফ আর আমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এসো। আর রাওনাফ তুই বোস, তোর সাথে আমার কথা আছে।”

***
অফিস থেকে বেরিয়ে গেইটের কাছে এসে উর্বী দাঁড়িয়ে পরে। রাওনাফের গাড়ি ঠিক অফিস ছুটির টাইমেই এসে গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফের নির্দেশে আব্দুল ভাই প্রতিদিন উর্বীকে অফিসে দিয়ে আসে,নিয়ে যায়।
গাড়ির দরজা খুলে উর্বী দেখে ভেতরে শর্মী বসে আছে। উর্বী কিছুটা অবাক হয়ে বলে,”তুমি!”

শর্মী তার হাতের ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”বেস্ট ফ্রেন্ডের বাড়িতে গিয়েছিলাম।”

উর্বী উঠে বসে। আব্দুল ভাই গাড়ি স্টার্ট করে। শর্মী আবারও ফোনে মনোযোগ দেয়। উর্বী শর্মীর হাতের ফোনটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আবার দেখছো এটা! কতবার দেখবে এটা?”

শর্মী লাজুক হেসে বলে,”আমার খুব পছন্দের মুভি।”

উর্বী শর্মীর দিকে তাকায়। দিনকে দিন মেয়েটা তার সাথে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করছে। সে ঠান্ডা গলায় বলে,”এই মুভিটার নাম কি?”

শর্মী উৎফুল্ল হয়ে বলে,”বিউটি এ্যান্ড দ্যা বিস্ট।”

_এটা ফেইরি টেইল? আমি আসলে দেখিনি। আমরা ছোটো থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সিসিমপুর,মিনা রাজু,মনের কথা,এসব দেখে বড় হয়েছি। এগুলো সম্পর্কে ধারণা নেই। আচ্ছা এই লোকটা এমন দেখতে কেনো? পশুর মতো দেখতে, রাজকুমারীর সাথে এমন ব্যবহার করছে কেনো? এর রাজকুমার কোথায়?

_এটাই রাজকুমার। ও শুরুতে অভিশপ্ত থাকে। কিন্তু খুব ভালো। নায়িকাকে পরে ভালোবাসে।
শর্মী খুব আন্তরিকতার সাথে বলতে থাকে উর্বীকে।

উর্বী হেসে বলে,”তুমি ভালোবাসা বোঝো?”

শর্মীর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে তো কিছু কিছু বোঝে। উর্বী বলে,”এই হিরো কি এভাবেই থাকবে? এমন পশুর মতো দেখতে থাকবে?”

_না না,ও তো মানুষই। রাজকুমার ও। পশুর রূপ নিয়ে আছে এখন।

উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ম্লান হেসে বলে,”এসব ফেইরি টেলেই সম্ভব। রাজকুমার বিস্টের বেশে থাকে। বাস্তবে কি হয় জানো? উল্টো হয়। বাস্তবে রাজকুমারের বেশে একটা বিস্ট আসে, একটা পশু থাকে রাজকুমার সেজে। তারা রাজকুমারীদের কষ্ট দেয় শুধু।”

শর্মী অবাক হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী কথাটা বলে নিজেই চ’ম’কে ওঠে! এতটুকু বাচ্চা মেয়ের সাথে কিসব কথা বলছে সে!
প্রসঙ্গ পালটে বলে,”ফুচকা খাবে?”

ফুচকার কথা শুনেই শর্মীর জিভে পানি চলে আসে। কিন্তু সে আমতা আমতা করে বলে,”পাপা!”

_তোমার পাপা জানবে না। আমি বলবো না, আব্দুল ভাই আপনি বলবেন?”

আব্দুল হেসে মাথা নাড়ায়। সেও বলবে না।

উর্বী বলে,”ঠিকাছে তবে গাড়ি থামান।”

সেদিন বিকেলটা উর্বী শর্মী নামের সরল কিশোরীর সাথে দারুন উপভোগ করেছে। দুজন একসাথে ফুচকা খেয়েছে, কিছু কেনাকাটা করেছে।
রওশান মঞ্জিলে ফিরে হাসিহাসি মুখ করে শর্মী উর্বীর দিকে তাকায়। কোনো এক অজানা কারনে শর্মীর এই মহিলাকে ভয় লাগছে না,খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে কিছুটা। কিছুটা নয়। বেশ ভালো লাগছে।

সদর দরজা খুলে দেয় আমীরুন। হাতের শপিং ব্যাগপত্র নিয়ে উর্বী আর শর্মী ভেতরে ঢোকে। নিচতলার লিভিং রুমে শায়মী আর নাবিল চুপচাপ বসেছিলো। শর্মীকে উর্বীর সাথে দেখে নাবিল ক’ট’ম’ট দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। শর্মী ভাইয়ার দৃষ্টি দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে উর্বীর থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে দোতলায় চলে যায়।

***
রাওনাফকে ঘরে ঢুকতে দেখে উর্বী উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ নিচুগলায় বলে ওঠে,”কফি খেয়ে এসেছি। আনতে হবে না।”

উর্বী ম্লান হেসে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তারা হচ্ছে কফি কাপল। সম্পর্কটা কফি দেওয়া নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। রোজ চব্বিশ ঘন্টায় স্বামীর প্রতি কেবল মাত্র এই একটা দায়িত্ব এসে বর্তায় উর্বীর ঘাড়ে। আজ তাতেও ছুটি!

হাতের ব্যাগটা আলমারিতে তুলে রেখে রাওনাফ হাত ঘড়ি খুলে রাখে। আড়চোখে উর্বীকে একপলক দেখে স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”অফিসে কেমন কাটছে তোমার!”

_ভালো।
উর্বী একশব্দে জবাব দেয়। রাওনাফ আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। আলমারি খুলে সে দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো আলমারি ভর্তি উর্বীর শাড়ি! তার জামাকাপড় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। না চাইতেও উর্বীর শাড়ি গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে সে নিজের পোশাক খুঁজতে থাকে। উর্বী বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে বলে,”আপনার জামাকাপড় নিচের সাড়িতে। আমীরুন এসে গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছে। দাঁড়ান আমি বের করে দিচ্ছি।”

কথাটি বলে উর্বী সামনে এগোয়,রাওনাফ পেছনে এগোতেই উর্বীর সাথে ধাক্কা লেগে উর্বী পরে যেতে নেয় ঠিক তখনই রাওনাফ শক্ত করে উর্বীকে ধরে ফেলে। দু’জনে বিব্রত হয়ে কয়েক মূহুর্ত একে অপরকে দেখে। উর্বীর লতানো কোমর থেকে রাওনাফের হাতের বাঁধন আলগা হতেই উর্বী লাফিয়ে দুকদম ডানে সরে দাঁড়ায়। রাওনাফের চোখে মুখে অস্বস্তি। উর্বী ঝটপট করে রাওনাফের ঘরে পরার পোশাক বের করে তার হাতে দিয়ে বারান্দায় চলে যায়।
রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে চলে যায় ছেলেমেয়েদের খোঁজ নিতে।

রাওনাফ করিম খানের তিন ছানা নিচতলার লিভিং রুমে বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আমীরুন দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। রাওনাফ গম্ভীর কন্ঠে তার ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,”আজ আমি একটু আগে ভাগে চলে আসায় খুব অসুবিধা হয়ে গেলো তোমাদের তাই না? ভেবেছিলে দুধ না খেয়েই চুপচাপ কেটে পরবে।”

তিন ছানার কেউ কোনো কথা বলে না। রাওনাফ আমীরুনকে বলে,”শাস্তিস্বরূপ ওদের দু গ্লাস দুধ খাইয়ে ছাড়বি আজ।”

_জে,আইচ্ছা ভাইজান!
হাসতে হাসতে জবাব দেয় আমীরুন। রাওনাফ গম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকে,”একটু নাইট ওয়াকে বেড়োবো। আমার ঘরেও এক গ্লাস দুধ দিয়ে আয়। বলবি খেয়ে নিতে।”

আমীরুন মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়। রাওনাফ গ্রে কালারের জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

বারান্দায় কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে উর্বী রুমে ঢোকে। বিছানা ঠিক করে আয়নার সামনে গিয়ে চুল আঁচড়ে নেয়। তখনই দরজায় টোকা পরে,বাইরে থেকে আমীরুন নিচু গলায় বলে ওঠে,”আসবো ভাবী?”

_এসো।

আমীরুন ঘরে ঢোকে। তার হাতে একটা দুধের গ্লাস। উর্বী গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে এটা কে পাঠিয়েছে। তবুও আমীরুন গলার স্বর উঁচু করে আহ্লাদী গলায় বলে ওঠে,”ভাইজান পাঠাইলো ভাবী।”

উর্বী জানে এখন শুরু হবে আমীরুনের কন্ঠে তার বড় ভাইজানকে নিয়ে রাঙিয়ে চাঙিয়ে কথা। সে স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”ঠিকাছে! ওটা ওখানে রেখে দাও।”

আমীরুন তার ঠোঁট নাড়াতে শুরু করে,”না না। এইটা আপনি এখন আমার সামনে দাড়ায়া থাইকা খাইবেন। বড় ভাইজান তো বারবার করে বলে দিছে, “আমীরুন,তোর বড় ভাবীকে না খাইয়ে আসবি না খবরদার।”

উর্বীর বেশ হাসি পাচ্ছে আমীরুনের মিথ্যা কথা গুলো শুনে। রাওনাফ কখনোই এভাবে বলেই নি। কিন্তু আমীরুন তার বড় ভাইজানকে উর্বীর সামনে অত্যন্ত ভালো ডেডিকেটেড স্বামী প্রমাণ করেই ছাড়বে।

***
পরপর দু’টো অপারেশন শেষ করে আধাঘণ্টার জন্য নিজের কেবিনে ঢুকে সার্জিক্যাল এপ্রোন টা খুলে ফেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয় রাওনাফ। কপালে ডানহাত টা রেখে চোখ বন্ধ করে থাকে দীর্ঘসময়। বাইরে থেকে ডক্টর কিশোর উঁকি দিয়ে বলে,”মে আই কাম ইন?”

_হ্যা।
রাওনাফ চোখ মেলে তাকায় । কিশোর ভেতরে ঢুকে বলে,”ওপেন হার্ট সার্জারির পেশেন্টের কাছ থেকে দশহাজার টাকা বিল কম রাখার নির্দেশ তুমি দিয়েছো?”

_হ্যা। সো হোয়াট?
রাওনাফ বলে ওঠে।

_না, কিছুই হয়নি। তবে আমরা কেউ জানি না তো!

_প্রয়োজন মনে করিনি। অসুবিধা হলে আমার প্রফিট থেকে দশ হাজার কেটে রেখো।

_ভুল ভাবছো রাওনাফ। এমন কিছু মিন করিনি। বাই দ্যা ওয়ে, নেক্সট ওটি কটায় তোমার?

_দু ঘন্টা পরে।

কিশোর তথ্যটা জেনে চলে যায়।

ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে রাওনাফ সেদিকে তাকায়। হাত বাড়িয়ে যন্ত্রটাকে তুলে নিয়ে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে শর্মীর ইংলিশ ম্যাম রাবিয়া রহমান বলে ওঠে,”আমি কি ডক্টর রাওনাফ করিমের সাথে কথা বলছি?”

_ইয়েস!

_আমি শর্মীর ইংলিশ টিচার রাবিয়া রহমান বলছি।

রাওনাফের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। জিজ্ঞেস করে,”ম্যাম আপনি হঠাৎ! ইজ এভরিথিং ফাইন?”

_নট এ্যাট অল । শর্মী হঠাৎ খুবই অসুস্থ হয়ে পরেছে।

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। উদ্বিগ্নতার সাথে চেঁচিয়ে ওঠে,”মানে! কি হয়েছে!”

_পেটে ব্যাথা।

_ঠিক আছে! আমি আসছি। ওকে বিশ মিনিট দেখে রাখুন। আমি এক্ষুনি আসছি।

ফোন কেটে রাওনাফ তাড়াহুড়ো করে পোশাক পাল্টে নিতে থাকে। দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় ডক্টর লামিয়া, স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ,সিটি মেডিকেয়ার হসপিটালের। রাওনাফকে দেখে বলে,”কোথাও যাচ্ছো তুমি? তোমার তো ও.টি. আছে দুই ঘণ্টা পরে।”

_শর্মী সামহোয়াট সিক! স্কুল থেকে ফোন দিয়েছে।

_ও গড! আচ্ছা যাও যাও!
লামিয়া দরজা থেকে সরে কেবিনে ঢোকে। রাওনাফ বলে,”কিছু বলবে?”

_হ্যা,ওই আমার একটু পরে ও.টি. আছে। আমি এ্যানেস্থেসিয়া স্পেশালিস্ট খাইরুল ইসলামকে কল করতে চাচ্ছি। মাহবুব আউট অব দ্যা সিটি যেহেতু। তুমি যদি পারমিশন দাও।

রাওনাফ অবাক হয়ে বলে,”ডেকে নাও। খাইরুলের সাথে তো আমার শত্রুতা নেই যে আপত্তি করবো!”

_না,তবুও। তুমিও তো একজন মালিক এই হসপিটালের।

রাওনাফ বলে,”ডেকে নাও।”
তারপর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।

***
উর্বীর হাতে আজ তেমন কোনো কাজ নেই। অবশ্য অফিস জয়েনিং-এর পর থেকে কখনই কাজের ব্যাস্ততা ছিলো না তার। টুকটাক প্রজেক্ট নিয়ে ফিল্ড ম্যানেজারদের সাথে মিটিং আর কিছু ফাইলে সাইন। কাজ বলতে এতটুকুই। উর্বীদের এনজিওটা বহুমুখী কাজ করে থাকে।
হাত ঘড়িতে বারবার সময় দেখছে সে। চেহারায়ও নেমে এসেছে বিরক্তির ছাপ। তার কারণ আজ উর্বী একটু অসুস্থ। সকাল থেকেই ব্লাড প্রেশার অস্বাভাবিক লো মনে হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে রওশান আরা ফোন দিয়েছিলেন প্রায় ঘন্টাখানেক আগে। উর্বী খেয়ালই করলো না! উর্বী কল ব্যাক করে কথা বলে নেয়। কোনো এক অদ্ভুত কারনে রওশান আরা নামের বৃদ্ধা মহিলাটির উর্বীর প্রতি ঢেলে দেওয়া অস্বাভাবিক মমতা উর্বী উপেক্ষা করতে পারে না। অবশ্য ভালোবাসা,মায়া জিনিসটা উর্বী কখনোই উপেক্ষা করতে পারেনি। যারা উপেক্ষা করতে পারে তারা বেঁচে যায়,যারা পারে না তারা জরিয়ে যায়, নিজেদের তুলে দেয় সর্বনাশের মুঠোয়।

দরজায় এসে দাঁড়ায় উর্বীর কলিগ মনিরুল ইসলাম। উর্বী বলে ওঠে,”আরে মনির ভাই! ভেতরে আসুন। ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?”

মনিরুল হেসে বলে,”আপা আমাদের নতুন অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট জয়েন করেছে। তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো আপনাকে। তাকে নিয়ে এসেছি।”

উর্বী উঠে দাঁড়ায়,”হ্যা নিশ্চয়ই! ওনাকে নিয়ে আসুন।”

মনিরের পিছু পিছু একজন সাতাশ-আঠাশ বছরের ছেলে উর্বীর কেবিনে ঢোকে। ছেলেটি উর্বীকে বিনয়ের সাথে সালাম দেয়। উর্বী ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি দিয়ে সালামের উত্তর দেয়। মনিরুল ইসলাম উর্বীর সাথে ছেলেটির পরিচয় করিয়ে দিতে বলে ওঠে,”আপা ওর নাম হচ্ছে উচ্ছাস! ও এখন থেকে আমাদের অফিস এ্যাসিস্ট্যান্ট!”

উর্বী যেনো কেঁ’পে ওঠে উচ্ছাস নামটি কানে যেতেই। মুখভঙ্গি মুহুর্তেই বদলে যায় পুরোপুরি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ঠোঁট কাঁপছে তার।
উচ্ছাস নামের ছেলেটি উর্বীর দিকে বিনয়ী হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। উর্বী তার দিকে তাকায়। সেই পরিচিত ব্যাথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মস্তিষ্কে।
মনিরুল ইসলাম বলতে থাকে,”উচ্ছাস! ইনি হচ্ছেন তোমার সিনিয়র। মৃদুলা উর্বী।”

***
শর্মীর দিকে তাকিয়ে থেকে রাওনাফ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। শর্মী পেটে হাত চেপে কাতরাচ্ছিলো, নরম গলায় বলে ওঠে,”ভীষণ পেটে ব্যাথা করছে আমার পাপা।”

_চলো, বাড়িতে চলো। মেডিসিন দিয়ে দেবো। সেরে যাবে।

মেয়েকে পাঁজাকোলা করে স্কুলের কমনরুম থেকে বের হয়ে গেইটের কাছে যায়। গেইটের বাইরে রাওনাফের গাড়িটা রাখা। আব্দুল দরজা খুলে দিতেই শর্মীকে বসিয়ে নিজেও বসে। আব্দুলকে বলে,”বাড়িতে চলো। ওকে বাড়িতে রেখে আমি হসপিটাল যাবো।

শর্মীকে বাড়িতে রেখে মেডিসিন খাইয়ে দিয়ে আমীরুনকে সব বুঝিয়ে দিয়ে রাওনাফ গাড়িতে এসে বসে। আব্দুল গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগেই রাওনাফের ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটা নারী কন্ঠ বলে ওঠে,”আমি কি ডক্টর রাওনাফ করিম খানের সঙ্গে কথা বলছি?”

_ইয়েস,হু’স দিজ?

_স্যার,আমি দিগন্তের রিসিপশনিস্ট আঁখি বলছি।

রাওনাফ বলে ওঠে,”হ্যা বলুন!”

_স্যার,মৃদুলা ম্যাম হঠাৎ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। আপনাকে আসতে হবে!

চলমান………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে