#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৯
#Esrat_Ety
“সকাল সকাল চলে এলে যে!”
তহুরার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে উর্বী। তার কন্ঠস্বর শুনে আন্দাজ করা যাচ্ছে তার অসুস্থতার পরিমাণ। তহুরা ননদের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,”ননদের শশুর বাড়িতে সকাল সকাল আসতে নেই বুঝি?”
_হুট করে কুটুম বাড়িতে আসতে নেই।
নিচু স্বরে বলে দেয় উর্বী।
_তুই অ’সু’স্থ তাই এলাম। রাওনাফ ভাই ফোন দিয়েছিলেন রাতে। উনিই আসতে বলেছেন। আমরা আসলে নাকি তোর ভালো লাগবে।
_কিন্তু আমার তো ভালো লাগছে না।
স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে উর্বী।
তহুরা কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে প্রসঙ্গ পালটে বলে ওঠে,”এখন কেমন আছিস? কোনো অসুবিধে?”
_নাহ, একেবারে ঠিকঠাক।
তহুরা আর কথা না বাড়িয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বিয়ের পরে বয়স আরো কম কম মনে হচ্ছে মেয়েটার। মনে হচ্ছে বয়স বাইশ -তেইশের সেই উর্বী। যে লাফাতো, খিলখিল করে হাসতো, কতটা চঞ্চল ছিলো মেয়েটা !
উর্বী বলে ওঠে,”শুধু ভাইয়া আর তুমিই এসেছো?”
_হু।
_উপমার বিয়ে কবে?
_কথাবার্তা চলছে। তোর শশুরবাড়ি এসে দাওয়াত দিয়ে যাবো।
_আমি গেলে উপমার বিয়ে হবে?
কাটকাট বলে ওঠে উর্বী।
তহুরা উদাসী দুটি চোখে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি তোকে আর আমার নিজের বোনকে কখনো আলাদা চোখে দেখিনি এটা জানিস তো? তাই তোর প্রতি ভাবী হিসেবে নয় বড় বোন হিসেবে অনুরোধ থাকবে যেটুকু ভালো সৃষ্টিকর্তা রাখতে চাইবেন, ততটুকু সুযোগ নিজেকে দিবি।”
উর্বী তহুরার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তো তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ভালো থাকতে চাচ্ছি না? আমি তো ভালোই আছি। না না,আমি আনন্দিত আসলে। হিন্দিতে একটা কথা আছে না,”উপর ওয়ালা যব ভি দেতা,দেতা ছাপ্পড় ফাড়কে।” আমার জীবনের সাথে এমনটাই হয়েছে। দেখো একসময় এমন পরিস্থিতি ছিলো আমার বিয়ে দিতে পারবে না কোথাও,আর এখন দেখো স্বামী, বাচ্চা কাচ্চা,ভরা সংসার সব একসাথে পেয়ে গিয়েছি। তোমার কি মনে হচ্ছে আমি উদাসীন আমার সংসারের প্রতি? মোটেও না। রোজ স্বামী বাড়িতে ফিরলে তার কাছে কফি নিয়ে ছুটে যাই, শাশুড়ি ওষুধ খেলো কিনা খোজ নিই। আমার চাবির গোছা দেখবে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”
কন্ঠে কিছুটা বিদ্রুপ উর্বীর, সে অসুস্থ শরীর নিয়ে খাট থেকে নামতে যায় তখনই রাওনাফ ঘরে ঢুকে স্বাভাবিক গলায় বলে,”নামছো কেনো!”
উর্বী বসে পরে। রাওনাফের পিছন পিছন ঘরে ঢোকে রেজাউল কবির। সে বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে তহুরাকে বলে,”চলো,আমাদের বেড়োতে হবে। গিয়ে অফিসে যাবো। হাফ বেলার লিভ নিয়েছিলাম।”
রাওনাফ রেজাউল কবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,”যদি কিছু মনে না করতেন তাহলে আমার গাড়ি আপনাদের পৌঁছে দিতো।”
রেজাউল কবির আপত্তি না জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়। যাওয়ার আগে সে আরো একবার উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী অন্যদিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।
রেজাউল কবির আর তহুরাকে বিদায় দিয়ে রাওনাফ ঘরে ঢুকে উর্বীর দিকে একপলক তাকিয়ে জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দেয়। সকালের কড়া মিষ্টি রোদ এসে ঘরটাতে ছড়িয়ে যায়। উর্বী মাথা ঘুরিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ বলতে থাকে,”এই রকমের না’জুক অবস্থা শরীরের, চাকুরী কিভাবে করতে? অদ্ভুত!”
_মাসের মধ্যে দশদিন অ’সুস্থ থাকতাম। এজন্য দু’টো চাকুরী খুইয়েছি।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় উর্বী। রাওনাফ বলতে থাকে,”তোমার এ্যাপ’য়েন’মেন্ট লেটার এসেছে। ঘুমে ছিলে তাই আমি সাইন করে রেখে দিয়েছি। এক তারিখে জয়েনিং। পারবে?”
_পারবো না কেনো?
রাওনাফের দিকে তাকায় উর্বী।
রাওনাফ সেকথার জবাব না দিয়ে বলে,
_আমার সাথে আজ হসপিটালে যেতে হবে তোমার। কিছু টেস্ট করাবো।
_প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি। কোনো প্রয়োজন নেই।
নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে উর্বী।
_আমি কেউ না, আমি একজন ডক্টর। অসুবিধার কথা খুলে বললে আমার বুঝতে সুবিধা হতো। আর মহিলা গাইনোকলজিস্ট দেখাতে চাইলে লামিয়া আছে,আমার ফ্রেন্ড। ও খুব ভালো। ওর কাছে নিয়ে যেতে পারি!
_ধন্যবাদ। তেমন কোনো অসুবিধা নেই। হলে আপনাকে জানাবো।
একঢালা উত্তর শুনে রাওনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে উর্বীর একপলক তাকায়, তারপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিচে চলে যায়।
***
নাবিল মুখ ভার করে ব্রেডে মাখন লাগিয়ে যাচ্ছে। রাওনাফ নাবিলের হাত থেকে ব্রেড আর ছু’ড়ি টা নিয়ে নেয়, তারপর নিজে মাখন লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,”এতো বড় হয়েছো। এখনো পারফেক্ট ভাবে পারছো না!”
নাবিল চুপচাপ পাপার হাত থেকে ব্রেড টা নিয়ে খাচ্ছে। শর্মী চুপচাপ উঠে পরতে গেলে রাওনাফ ডেকে ওঠে,”শর্মী!”
শর্মী এই ভয়টাই পেয়েছিলো। সে আসলে পালাতে চাইছিলো। আ’ত’ঙ্কিত মুখ নিয়ে পাপার দিকে তাকায়। রাওনাফ কফির কাপে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,”জুস টা খাও।”
_পাপা প্লিজ!
আপত্তি জানায় শর্মী!
রাওনাফ বলতে থাকে,”গাছের কমলা। গাছগুলো তোমাদের জন্য লাগিয়েছি। আমি নিশ্চয়ই বাজারে বিক্রি করার জন্য ফলের গাছ লাগাইনা।”
শর্মী নাক চোখ কুঁচকে জুসের গ্লাসটা হাতে তুলে নেয়। রাওনাফ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”বন্ধুদের সাথে কোল্ডড্রিংকস কিনে খাওয়ার সময় কোনো অলসতা দেখি না। পকেটমানি কমিয়ে দেবো একেবারে!”
_খাচ্ছি তো!
অভিমানী গলায় বলে ওঠে শর্মী। রাওনাফ রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”রাতের ওষুধ নিয়েছিলে?”
রওশান আরা অপরাধী গলায় বলে,”মনে ছিলো না।”
_কেনো?
_তুই মনে করিয়ে দিসনি।
রাওনাফ মায়ের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ওঠে,”তোমরা সবাই আমার উপরে নির্ভরশীল কেনো থাকো সবসময়।”
রওশান আরা মুচকি হাসে। আমীরুন একটা ট্রেতে কিছু খাবার নিয়ে নেয় উর্বীকে দিয়ে আসবে বলে। রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”দাড়া।”
আমীরুন দাঁড়িয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ ঠান্ডা গলায়
বলে ওঠে,”জুস টা নিয়ে যা। বাড়ির সবার জন্য বানিয়েছি।”
আমীরুন একটা গ্লাস হাতে তুলে নেয়। নাবিল তার বাবার দিকে একপলক তাকায়। রাওনাফ হাতে এপ্রোন,স্টেথোস্কোপ আর ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর তার তিন ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই যে তোমরা তিনজন! আজ সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকবো। ফোন দিতে পারবো না। প্রত্যেকে আজ কোথায় কোথায় যাবে তার আপডেট আমাকে মেসেজে জানাবে। আমার অবগতির বাইরে কিছু করেছো সেটা পরে টের পেলে প্রত্যেকের ল্যাপটপ আর সেলফোন বাজেয়াপ্ত করা হবে।”
আমীরুন খাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢোকে। উর্বী চুলে খোঁপা বেঁধে নিতে নিতে বলে,”আনলে কেনো? আমি তো ঠিক আছি এখন! নিচে গিয়ে খেয়ে নিতাম।”
আমীরুন দাঁত বের করে বলে,”ভাইজান পাঠাইলো।”
উর্বী চুপ করে থাকে।
আমীরুন বলতে থাকে,”ভাইজান তো বারবার বলে দিয়েছে আমারে,আমীরুন, তোর ভাবীর দিকে খেয়াল রাখবি! সে যেনো আজ সারাদিনে নিচে না নামে। তার যা যা লাগবে সব দিয়ে আসবি ঘরে।”
উর্বী বিব্রত হয় খুব। রাওনাফ কি সত্যিই এমন ভাবে বলেছে নাকি আমীরুন একটু রাঙিয়ে বলছে! আমীরুনকে সে যতটা চিনেছে মেয়েটা প্রচুর বানিয়ে কথা বলে,বাড়িয়ে কথা বলে। রাওনাফের প্রসঙ্গ উঠলে তো আরো বেশি বেশি করে বলে।
উর্বীর নীরবতা দেখে আমীরুন নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,”মানুষ একটা আমার বড় ভাইজান। সবদিকে খেয়াল। পোলা,মাইয়া,মা,বৌ,রোগী সবার জন্য হের যত্নের কমতি নাই।”
***
“আরে কি করছো ঝুমুর! তুমি তো সেই বাচ্চাই রয়ে গেলে দেখছি!”
ঝুমুর রাওনাফের চুল টেনে দিয়ে বলে,”দেখছিলাম এগুলো নকল কি না দুলাভাই। এতো বছরেও এতো ঘন চুল।”
রাওনাফ হাসে শিমালার ছোটো বোন ঝুমুরের কথায়। সুমনা পাশ থেকে বলে ওঠে,”তা আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসলেন না কেনো? ভালো লাগতো আমাদের!”
_সত্যিই কি ভালো লাগতো?
রাওনাফ সুমনাকে কথাগুলো বলে হেসে ফেলে। সুমনা বলে,”কাম অন দুলাভাই! আমরা নাবিল নই। যাই হোক, কেমন আছে আপনার ওয়াইফ?”
_ভালো। তোমাদের খবর বলো। তোমার হাজব্যান্ড দেশে কবে ফিরবে?
_সামনের মাসে হয়তোবা।
_আমাদের বাড়িতে যাওয়া ভুলেই গিয়েছো দেখছি!
সুমনা হেসে ফেলে, বলে,”তেমন কিছু না দুলাভাই। সবাই সংসার নিয়ে এতোটা ব্যস্ত হয়ে পরেছি!”
_তাই বোনের স্বামী,ছেলে,মেয়েদের ভুলে গিয়েছি তাইতো? কিন্তু আমি তোমাদের ভুলিনি। তোমরা আমার কাছে সেই সুমনা, ঝুমুর। শিমালার আদরের ছোটো দুই বোন। সময় পেলে যাবে আমার বাড়িতে, তোমার বোনের বাড়িতে। মা সবসময় তোমাদের কথা বলে!
রাওনাফ কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। ঝুমুর বলে ওঠে,”আমরা আসলে আগে থেকেই চাইতাম আপনি একটা বিয়ে করেন। সাহস করে বলে উঠতে পারিনি কখনো।”
রাওনাফ ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে।
***
ঘরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে রাওনাফ। উর্বী বিছানায় চুপচাপ একটা বই নিয়ে বসে আছে। রোজকার খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য। রাওনাফ জানে এরপর কি কি হবে, রাওনাফ ওয়াশ রুমে ঢুকবে,বের হয়ে দেখবে উর্বী ঘরে নেই। একটু পর হাতে এক মগ কফি এনে রোবটের মতো বলবে,”আপনার কফি!”
রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়ে দেখে উর্বী ঘরে নেই। বিছানার ওপর একটা বই রাখা। রাওনাফ ম্লান হেসে নিজের ওয়ালেট থেকে কিছু ক্যাশ টাকা বের করে বইটার নিচে রাখে।
খানিক বাদে উর্বী কফি হাতে ঘরে ঢুকে কফিটা রাওনাফকে দেয়। রাওনাফ হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,”থ্যাংক ইউ।”
উর্বী ম্লান হাসে। তারপর বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে বইটা তুলে হাতে নিতেই বইয়ের নিচে ক্যাশ টাকা গুলো দেখে অবাক হয় যায়। তারপর রাওনাফের দিকে তাকায়।
রাওনাফের দৃষ্টি মোবাইলে নিবদ্ধ। কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে ওঠে,”কাল মোহনা শপিং-এ যাবে। শীতের পোশাক কিনবে, মা আর বাচ্চাদের শপিং ও করে এবাড়ির। তোমাকে নিয়ে যাবে। তোমার জন্য কিছু শীতবস্ত্র কিনে নিও। শীত পরছে বেশ।”
উর্বী কিছু বলে না । চুপচাপ হাতের টাকা গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
আশপাশটা কেমন ধোঁয়াশা হয়ে আছে। রাওনাফ হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। নাবিল ভাবলো তার পাপা তাকেই ডাকছে। সে এগিয়ে যায়। কিন্তু না। রাওনাফ তাকে ডাকছে না। রাওনাফ ছোটো একটা বাচ্চা ছেলেকে ডাকছে। ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে “পাপা” বলে চিৎকার দিয়ে রাওনাফের কোলে ওঠে। রাওনাফ তার কপালে চুমু খায়। নাবিল চেঁচিয়ে ওঠে,”পাপা! ও কে! ও কেনো তোমাকে পাপা ডাকছে!”
রাওনাফ কপাল কুঁ’চ’কে নাবিলের দিকে তাকায়। রাওনাফের কোলের ছেলেটি বলে ওঠে,”এটা আমার পাপা! তোমার পাপা না!”
নাবিল চ’ম’কে ওঠে। উর্বী নামের ভদ্রমহিলা এসে রাওনাফের হাত ধরে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে উর্বী নাবিলের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কঠিন করে ফেলে বলে,”এটা আমার ছেলের পাপা। তুমি কেউ না! তুমি যাও।”
নাবিল অসহায়ের মতো তার পাপার দিকে তাকায়। রাওনাফ নাবিলের দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উর্বীর হাত ধরে,বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে চলে যায়। নাবিল পেছন থেকে গলা ফাটিয়ে ডাকতে থাকে রাওনাফকে। রাওনাফ শোনেনা তার ডাক।
লাফিয়ে উঠে হাঁফাতে থাকে নাবিল। স্বপ্ন আর বাস্তবতার পার্থক্য বুঝতে সে দুই মিনিট খানেক সময় নেয় সে।
রাওনাফ জানালা বন্ধ করে দিতে দিতে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে ওঠে,”কি হয়েছে বাবা! দুঃস্বপ্ন দেখেছো!”
নাবিল কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে তার বাবার দিকে। রাওনাফ মশা মারার মেশিন অন করে দিতে দিতে বলে,”এভাবে অগোছালো হয়ে ঘুমাচ্ছো কেনো! জানালা খোলা রেখে। গায়ে কম্ফোর্টার ছিলোনা। ঠান্ডা বাঁধিয়ে ফেলবে দেখছি!”
নাবিল তখনও চুপ। রাওনাফ নাবিলকে এক গ্লাস পানি খাইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে যায়। দোতলায় উঠে সে শায়মী আর শর্মীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে এখানেও সেই একই অবস্থা। কারো গায়ে কম্ফোর্টার নেই। অথচ গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে শীতে। রাওনাফ দু’জনের গায়ে কম্ফোর্টার চাপিয়ে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যায়। ঘরে ঢুকে সে রীতিমতো তাজ্জব বনে যায়। এখানের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। উর্বী শুধুমাত্র গা থেকে কম্ফোর্টার সরিয়েই ফেলেনি, বরং লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। অথচ শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে শীতে কাঁপছে মেয়েটা। রাওনাফ মনে মনে ভাবে, এই মেয়েকে কাল বলবে ঘুমানোর আগে কম্ফোর্টার গায়ে চাপিয়ে কম্ফোর্টারের চারকোনায় চারটা পেরেক মেরে নিতে বিছানার সাথে, যাতে গা থেকে সরে না যায়!
রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উর্বীর গাঁয়ে কম্ফোর্টার টেনে দিয়ে নিজেও শুয়ে পরে। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত, আর চলছে না! বাবা মা’রা যাওয়ার পরে আঠেরো বছর বয়স থেকে শুধু দায়িত্ব আর দায়িত্ব। একটার পর একটা দায়িত্ব এসে বর্তাচ্ছে রাওনাফের ওপর। নতুন দায়িত্বের নাম মৃদুলা উর্বী। ওয়াইফ অব রাওনাফ করিম খান। বয়স ত্রিশ উচ্চতা পাঁচ ফুট দেড় কি দুই ইঞ্চি, যে ভদ্রমহিলা ঠিকঠাক ভাবে ঘুমাতে অবধি শেখেনি এতো বছর বয়সেও!
এক পলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে শিমালার ফটোফ্রেম টা হাতে নিয়ে ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে ওঠে,”হাসছো নাকি রা’গ করছো!”
***
হাফিজুর রহমান ড্রয়িং রুমে বসে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ। সে খুবই উৎফুল্লের সাথে তার শাশুড়ি রওশান আরার সাথে গল্প করছে।সে এসেছে এবাড়ির সবাইকে নিতে।
বাড়ির সবাই নিজেদের জামাকাপড় গোছাতে ব্যস্ত। সবার মুখ হাসি হাসি। বিশেষ করে শর্মীর। কদিন তার পড়তে বসতে হবে না এটা ভেবেই তার খুব আনন্দ হচ্ছে।
রাওনাফ এসে সামিউলের রুমের সামনে দাঁড়ায়। বাইরে থেকে ডাকে,”সামিউল তোদের সব কিছু গোছানো হয়েছে?”
সামিউল বাইরে আসে। রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
-ভাইয়া আমাদের যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
-কেনো ঠিক হবে না? তুই তোর বোনের শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস! তোরা তো এবাড়ির ই লোক। আর তাছাড়া হাফিজ বারবার তোদের কথা উল্লেখ করেছেন।
-মা যদি কিছু বলে?
-মা কিছুই বলবে না। আজমেরী তোর বোন। আর মা আমাদের সাথে যাচ্ছেন না।
-মা বাড়িতে একা থাকবে?
-আমিরুন থাকবে। তিনটা দিনেরই তো ব্যাপার। আমি আগেই চলে আসতে পারি। তোরা রেডি হ। আমি আর ডাকতে আসবো না।
রাওনাফ চলে যায়। সামিউল অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে কি কি নিবে প্যাক করো।
উর্বী তার ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে বসে আছে। রাওনাফের ব্যাগ গোছানো হয়নি। তাকে কোথাও দেখাও যাচ্ছে না।
রাওনাফ গিয়েছিলো শর্মীদের ঘরে। শর্মী আর শায়মীর ব্যাগ গোছানো হয়েছে কিনা দেখতে।
কিছুক্ষণ সেখানে থেকে সে রুমে ঢুকেই নিজের ব্যাগ গোছাতে তাড়াহুড়া লাগিয়ে দেয়। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি হেল্প করবো?”
-লাগবে না। থ্যাংক ইউ।
রাওনাফ বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে। উর্বী চুপ করে বসে থাকে। লোকটা তার প্রতি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে চেষ্টা করে। উর্বীও চেষ্টা করলো কিছুটা শোধ করে দেওয়ার। তাদের এই নামমাত্র সম্পর্কটা একপ্রকার শোধ শোধ খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা দুজন প্লেয়ার।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উর্বী সংকোচের সাথে জিজ্ঞেস করে,”নাবিল যেতে রাজি হয়েছে?”
-হু,রাজি হবে না কেনো।
-আমি ভেবেছি আমি যাচ্ছি বলে রাজি হবে না।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়, কিছু বলে না। নিজের ব্যাগ গোছাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে।
আমিরুনকে সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সবাই বাড়ি থেকে বের হয়। খান পরিবারের সবাইকেই খুবই খুশিখুশি দেখা যাচ্ছে। দু’টো গাড়ির একটাতে বসেছে সামিউল, শাফিউল, হাফিজুর,শর্মী,শায়মী। এই গাড়িটা ড্রাইভ করবে শাফিউল। অন্য গাড়িতে বসেছে মোহনা,অন্তরা,রাওনাফ। রাওনাফ গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। উর্বী পেছনের একটা সিটে বসতে গেলে মোহনা বলে ওঠে,”ভাবী সামনের সিটে বসুন।”
উর্বী রোবটের মতো সামনের সিটের দরজা খুলতেই পেছন থেকে নাবিল বলে ওঠে,”আমি পাপার পাশে বসবো।”
উর্বী ঘুরে নাবিলের দিকে তাকায়। তারপর একটা ম্লান হাসি দিয়ে বলে,”শিওর।”
রাওনাফ চুপচাপ বসে থাকে। উর্বী গিয়ে পেছনের সিটে বসে।
***
হাত থেকে “কনফেশন অফ আ মা’র্ডা’রার” বইটা নামিয়ে রেখে উচ্ছাস বাইকের চাবি হাতে নেয়। সজীব আর মাহমুদ উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে আছে। সজীব অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে বলে ওঠে,”কোথাও যাবেন ভাই?”
_হু। অসীমের সাথে জরুরি বৈঠক আছে।
_ভাই মামুনের বাচ্চা বেশি ফাল পারতেছে।
_ওকে পরে দেখবো। উর্বী ছাড়া অন্যকিছু মাথায় আনতে চাচ্ছি না আপাতত।
সজীব বিরস মুখে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে দিনকে দিন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। সারাটা দিন শুধু উর্বী উর্বী উর্বী! যদি কোনো অপ্সরা হতো তাহলে না হয় মানা যেতো। মোটামুটি ধরনের চেহারা। উচ্ছাস ভাই চাইলে হাত বাড়ালেই দশ গুণ সুন্দরী মেয়ে পেতে পারে এখনও। তা না করে ঐ মেয়েটার জন্য ম’র’ন খেলায় মেতেছে।
উচ্ছাস বইটা সেলফে তুলে রেখে বলে,”উর্বীকে মনে মনে গালাগাল দিচ্ছিস? খবরদার না। ওকে ভালোবাসা, গালাগাল দেওয়া, সবকিছুর অধিকার শুধু আমার।”
সজীব সাহস যোগার করে বলে,”যার জন্য এখনও এতো পাগলামি করছেন সে কি করেছে? সারাদিন আপনাকে বিয়ে করো বিয়ে করো বলে প্যারা দিতো সে এখন তো দিব্যি অন্যের ঘর করছে।”
উচ্ছাস তার কথার জবাব না দিয়ে বলে,”হানিমুনে গিয়েছে নাকি আত্মীয়ের বাড়িতে!”
_ওর শশুরবাড়ির দিকে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি।
উচ্ছাস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”একটার পর একটা ভুল করেই যাচ্ছে মেয়েটা। প্রথম ভুল আমাকে ভালোবাসা, দ্বিতীয় ভুল আমার মতো পশুকে ভালোবাসতে শেখানো, তৃতীয় ভুল আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা বলা, প্রথম তিনটা ভুলের শা’স্তি দিয়েছি আমি।
চতুর্থ ভুল আমাকে ভুলে অন্যকাউকে গ্রহণ করা। এটার শাস্তিও খুব শিগগিরই পাবে। শাস্তি দিয়ে তারপর ওকে বিয়ে করবো। কিছু ক্যাশ নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। ছোটো সংসার পাতবো ওকে নিয়ে।”
_ভাই! ও তো আর আপনাকে চায় না। এখনো এসব করার মানে আছে কোনো!
উচ্ছাস সজীবের দিকে তাকায়।
_চায় না মানে! চাইতে হবে! চাইতে হবেই! এখনো এসব করার মানে আছে মানে? যেদিন ম’র’বো সেদিন ঐ উর্বী ওর থেকে পিছু ছাড়াতে পারবে আমার। তার আগে না। কখনোই না।
চলমান……