#গল্প_আরেকটি_বার
#সূচনা_পর্ব
#Esrat_Ety
শাড়ির কুঁচি ধরে খানিকটা উঁচু করে সন্তর্পনে ইট দিয়ে বাঁধানো সরু রাস্তায় পা ফেলে সে। কর্দমাক্ত নরম মাটিতে স্থানে স্থানে ইট দেবে গিয়েছে, হাঁটতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে। শাড়ির নিচের দিকের পাড় কাঁদা পানিতে নোংরা হয়ে যাচ্ছে। যতখানি সম্ভব ততখানি উপরে তুলেছে শাড়ি।
এই শাড়িটা উর্বি তার এক বান্ধবীর কাছ থেকে চেয়ে এনেছে ইন্টারভিউয়ের জন্য,তার এমন শাড়ি নেই। একটা মহিলা সংস্থায় ইন্টারভিউ ছিলো আজ তার। শাড়ির জমিন সাদা,নেভি ব্লু রঙের পাড়। যেকোনো ধরণের এনজিওর চাকুরীর ভাইভার জন্য মানানসই পুরোপুরি। শাড়িটাতে উর্বিকে কেমন লাগছে উর্বি ঠিক জানে না । যে কয়বার আয়নায় নিজেকে দেখেছে ,তার ধারণা হয়েছে তাকে কিছুটা মাদার তেরেসার মতো লাগছে, ত্রিশ বছরের ইয়াং মাদার তেরেসা,যার গাল এখনও কুঁচকে যেতে শুরু করেনি,তবে যাবো যাবো করছে।
উর্বী এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আসন্ন ভূমিকম্পের কথা চিন্তা করে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুমিনিট দাঁড়িয়ে থেকে দরজার কড়া নাড়ে। সে মনে প্রাণে চাইছে দরজাটা যাতে মা অথবা রুহি-রাইসা খোলে,অন্যকেউ নয়।
খট করে ভেতর থেকে দরজার সিটকিনি খোলার শব্দ হয়। উর্বি নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই দরজা খুলে তার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে তার বড় ভাবী তহুরা।
তহুরার দিকে তাকিয়ে উর্বী একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। ভেতর থেকে উর্বীর দুই ভাইজি রুহি-রাইসার পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
তহুরা উর্বীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে কোনো কথা না বলে ভেতরে চলে যায়। ভাবীর এমন শীতল রূপ উর্বী আশা করেনি। সামান্য খটকা তার লেগেছে। ঘরে ঢুকে দরজার সিটকিনি তুলে ঘুরে দাঁড়াতেই সে থ’ম’কে যায়। মুহুর্তেই ফরসা মুখটা আ’ত’ঙ্কে জমে যায় এক প্রকার।
উর্বীর ভাই রেজাউল কবির বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বি ঝটপট কিছু কথা সাজিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু সে জানে,সে সাজানো কথার একটি বাক্যও বলতে পারবে না। এমন কিছু বলে ফেলবে যার দরুন আজ উর্বীর রাতের খাবার খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
“কোথায় গিয়েছিলি?”
গমগম করে ওঠে চল্লিশ বছর বয়সী রেজাউল কবির।
প্রথম প্রশ্নের উত্তর উর্বির সাজানো। নিচু স্বরে কিন্তু দৃঢ় ভাবে বলে ওঠে,”ইন্টারভিউ ছিলো “জেগে ওঠো নারী” সংস্থায়।”
_কিসের ইন্টারভিউ?
_চাকরির। ফিল্ড ম্যানেজার।
রেজাউল কবির বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মূহুর্ত পরে বলে ওঠে,”আগামীকাল যার বিয়ে তার চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এখানে ওখানে অযথা ঘুরে বেড়ালে তোর হবু শশুর বাড়ীর মানুষের কানে উঠবে কথাগুলো।”
উর্বী চুপ করে থাকে। তার মা লুৎফুন্নাহার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
রেজাউল কবির বলে ওঠে,”যা ঘরে যা। কাল ছেলের বাড়ি থেকে কিছু মানুষ এসে বিয়ে পরিয়ে তোকে নিয়ে যাবে চুপচাপ। তাঁরা এখন অনুষ্ঠান করতে চাইছে না, আমারো সামর্থ্য বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। এটাই ভালো হয়েছে।”
উর্বী অনেকটা সাহস যোগার করে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। তারপর বলে ওঠে,”বিয়েটা আমি করবো না ভাইয়া।”
সাথে সাথে রেজাউল কবির উর্বীর গালে এক চ’ড় বসিয়ে দেয়। তহুরা ছুটে এসে স্বামীর হাত ধরে বলে ওঠে,”করছো কি! ত্রিশ বছর বয়সী একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর গায়ে হাত তুলছো! মাথা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে?”
উর্বী গালে হাত চেপে ভাইয়ের দিকে অনূভুতি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”এভাবে কাউকে ঠকানো ঠিক না ভাইয়া। এটা তুমিও জানো।”
বৃদ্ধা লুৎফুন্নাহার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভেতরের ঘর থেকে রুহি- রাইসা গলা ফাটিয়ে বইয়ের পড়া মুখস্থ করে যাচ্ছে।
রেজাউল কবির দ্রুত নিজের ঘরে চলে যায়, দুমিনিট পরে হাতে ছোটো একটা কাগজের টুকরো নিয়ে ফিরে এসে উর্বীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,”নে। এই নে ছেলের নাম্বার। ফোন করে তোর কেচ্ছা- কাহিনী নিজে জানিয়ে দে। যা।”
উর্বী হাতের কাগজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে যায়। তহুরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”শান্ত হও তুমি। শান্ত হও। প্রেশার বেরে যাবে।”
_কি শান্ত হবো? কি শান্ত হবো আমি? ছোটো বোনটার বিয়ের বয়স হয়ে এলো,তাকে বিয়ে দিতে হবে না? ওর ভাইজি দু’টো বড় হচ্ছে তাদের বিয়ে দিতে হবে না? আর কত? আর কত জ্বালাবে ও আমাদের?
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া লুৎফুন্নাহার ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উর্বীর ঘরের দিকে যায়।
রুহি-রাইসা তাদের বাবার চিৎকার চেঁচামেচিতে পড়া থামিয়ে দিয়েছিলো। রেজাউল কবির থেমে যাওয়াতে তারা আবার পড়তে শুরু করে।
উর্বী ঘরে ঢুকে শাড়ি পাল্টে কাগজের টুকরো টা হাতে তুলে নেয়। নাম্বারটা নিজের ফোনে তুলে কাগজটাকে দূরে ছু’ড়ে মা’রে। এমন সময় লুৎফুন্নাহার দরজায় এসে দাঁড়ায়। উর্বী বৃদ্ধা মায়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,”তোমার ছেলে ডান গালে চ’ড় মে’রেছে, গালটা এখনও গ’রম হয়ে আছে। তুমিও আরেকটা চ’ড় মেরে বাম গালটা গ’রম করে দিয়ে যাও।”
লুৎফুন্নাহার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”কাল চুপচাপ কবুল বলে আমাদের উদ্ধার করিস।”
দু’জনের কেউই আর কোনো কথা বারায় না। লুৎফুন্নাহার চলে যায় চুপচাপ।
ঘড়ির কাঁ’টা তার গতিতে ছুটতে থাকে। পুরো ঘর অন্ধকার,কাঠের জানালার কপাট দু’টো খোলা,বাইরে থেকে জোৎস্নার আলো এসে ঘরটাকে একটু আলোকিত করার চেষ্টা করলো। উর্বী পাশ ফিরে শোয়। তার পাশেই শুয়ে আছে তার থেকে চার বছরের ছোট বোন উপমা। ফোন কানে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে তার প্রেমিকের সাথে। উপমা ছোটো বেলা থেকেই একটু সু-স্বাস্থের অধিকারিণী। যার সাথে তার প্রণয় সেই প্রেমিকটিও তার থেকে দ্বিগুণ সু-স্বাস্থের অধিকারী।
উপমা ফোনে ফিসফিসিয়ে এমন ভাবে কথা বলছে শুনে মনে হচ্ছে চিনা হাঁস হিসহিস করে পায়চারি করছে উঠানে। শব্দটা উর্বীর কানে ঠিক সেরকমই লাগছে। এই ধরণের শব্দের জন্য এর থেকে ভালো আর উপযুক্ত বর্ণনা উর্বীর জানা নেই। আচ্ছা উপমাকে বলবে একটু জোরে কথা বলতে? এভাবে হাসের মতো হিসহিস না করতে?
উর্বী আধো অন্ধকারে বোনের কার্যকলাপ কিছুক্ষণ দেখে বিছানা থেকে নামে। বলুক যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে কথা। কত রঙিন দিন দুজনের, দু’চোখ ভর্তি কত স্বপ্ন ঐ সু-স্বাস্থবান প্রেমীযুগলের। স্বপ্নটা সত্যি হতে দেরী নেই, কাল যদি উর্বীর বিয়ে হয়ে যায় তাহলে সব ঝামেলা শেষ।
টেবিলের ওপরে চার্জে লাগানো ফোনটা হাতে নিয়ে “বিয়ের পাত্র” নামে সেইভ করে রাখা নাম্বারটায় ফোন দেয় উর্বী। ফোনটা কানে ধরতেই উপমার হাসির শব্দ শোনা যায়। প্রেমিকের সাথে খিলখিলিয়ে হাসছে।
উর্বীর বড্ড মায়া হয়,সে যদি এখন ফোন করে বিয়েটা ভেস্তে দেয় তবে ঐ হাসি আর শুনতে পাবে সে?
“দ্যা নাম্বার ইউ আর ট্রাইং টু কল ইজ কারেন্টলি সুইচস্টপড।”
রোবটিক নারী কন্ঠটি জানিয়ে দিলো,উর্বী চাইলেও সত্যিটা জানতে চায়না পাত্র। না জেনে শুনে পঁ’চা শামুকে পা কাটবে পাত্র। পাত্রের জন্য উর্বীর বেশ দুঃখ হচ্ছে। বেচারা!
সাত-আটবার চেষ্টা করলো ১০ মিনিটের ব্যাবধান নিয়ে। নাম্বারটা বন্ধ। উর্বী হাল ছেড়ে দিয়ে ফোনটাকে চার্জে বসায় আবারও। ঘাড় ঘুরিয়ে আধো অন্ধকারে উপমার দিকে তাকায়। উপমা সম্ভবত ঘুমিয়ে পরেছে। এখন নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে তার বিয়ে হচ্ছে ঐ আসিফ নামের সু-স্বাস্থবান প্রোমোটারের সাথে।
বিছানায় এসে পুনরায় শুয়ে পরে সে। তাকে এখন ঘুমোতে হবে, কাল তার বিয়ে। কাল সেই দিন। তার জীবনের সাথে জরিয়ে থাকা মানুষগুলোর মহা আনন্দের দিন, স্বস্তির দিন।
***
এটাকে ঠিক বিয়ে বাড়ি বলে কেউ মানতে চাইবে না। বাড়িটাকে উর্বীর কাছে কোনো মৃ’ত ব্যক্তির শোক-বাড়ির মতো মনে হচ্ছে। যার চারদিন আগে মৃ’ত্যু হয়েছে এবং পরিবারের লোকজন শো’কপালন করছে।
উর্বী বিছানায় চুপচাপ বসে ছিলো। তার বিছানার উপরে একটা বড় লাগেজ। এটা পাত্রপক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে। পাত্রপক্ষ বর্তমানে জেলা শহরে উর্বীর খালার বাড়িতে আছে। বিকেলে এসে বিয়ে পরিয়ে নিয়ে যাবে উর্বীকে। সম্বন্ধটা মূলত উর্বীর ছোটো খালা নুরুন্নাহার ঠিক করেছে। তার শশুর বাড়ীর দিকের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয় ছেলের পরিবার।
তহুরা এসে উর্বীকে লাগেজ থেকে একটা শাড়ি বের করে পরে নিতে তা’ড়া দেয়।
উর্বী মাথা ঘুরিয়ে তহুরাকে একপলক দেখে। তারপর লাগেজের দিকে তাকায়।
তহুরা বসার ঘরে তার স্বামী রেজাউল কবিরের কাছে যায়। রেজাউল কবির ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলেন, সম্ভবত কাউকে নিমন্ত্রণ করছিলেন। ফোন কেটে তহুরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে?”
_কাকে দাওয়াত করছো?
_আমার এক কলিগ কে। বিয়েতে মেয়ের বাড়ির কোনো রিলেটিভ না দেখলে পাত্রপক্ষ কিছু মনে করে বসতে পারে।
_তাহলে রিলেটিভকে দাওয়াত করো। জানিয়ে দাও উর্বীর বিয়ে হচ্ছে।
রেজাউল কবির চোখ মুখ শক্ত করে তহুরার দিকে তাকিয়ে বলে,”উর্বির জীবনে তাদের অবদান এমনিতেই অপরিসীম। বিয়েতে থাকার কোনো দরকার নেই আর। আমি চাইনা আমার বোনটা বিয়ের দিনেও দম আটকে কা’দুক।”
তহুরা প্রসঙ্গ পালটে বলে,”পাত্রপক্ষের জন্য কোনো আয়োজন করা হচ্ছে না, এটা কেমন দৃষ্টিকটু না?”
_ছোটোখালা কিছু করতে নিষেধ করেছেন। পাত্রপক্ষ আসবে,বিয়েটা পরাবে তারপর উর্বীকে নিয়ে চলে যাবে।
তহুরা বসার ঘরের জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলে,”পাত্রপক্ষের এতো তাড়াহুড়ো ব্যাপারটা আমার কাছে খ’টকা লাগছে। না মানে তুমি ভাবো,অত বড় বাড়ির ছেলে,তারা এমন মফস্বলের একটি মেয়েকে পছন্দ করলো,তার ওপর উর্বীর বয়স নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। বিষয়টি খ’টকা লাগার মতো নয়কি? আচ্ছা পাত্র ল্যাংড়া-খোড়া নয়তো?”
রেজাউল কবির চুপ করে থেকে বলে,”গিয়ে উর্বীকে সাজাও। পাত্রের খুঁত থাকলেও বিয়েটা এইখানেই হবে। সাজাও ওকে।”
কুঁচি গুলো গুঁজে নিয়ে আঁচল বুকে তুলে আয়নায় নিজেকে একপলক দেখে নেয় উর্বী। মেরুন রঙের বেনারসী,গলায় একটা স্বর্ণের সরু চেইন। সাজসজ্জা এতটুকুই। উর্বী আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তোকে সুন্দর লাগছে বুড়ো পঁচা শামুক।”
উপমা ঘরে ঢুকে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তুমি সারাদিন কত কিছু খাও তবুও তুমি স্লিম। আর আমি একটু পানি খেলেও ফুলে ফেঁপে উঠি।”
উর্বী চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলে ওঠে,”তুই কি সুখী মানুষ?”
_মনে তো হচ্ছে। আপাতত কোনো কষ্ট নেই আমার।
_তাহলে তো ফুলতেই থাকবি। তোর চর্বি খাওয়ার কেউ নেই।
_চর্বি খাওয়ার কেউ নেই মানে?
_মানে দুঃখ মানুষের চর্বি খেয়ে ফেলে। যে যত দুঃখী সে ততো স্লিম।
উপমা বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ওঠে,”পাত্রের মা তোমার সাথে দরজা বন্ধ করে কি বলেছিল সেদিন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।”
_তোর জানার দরকার নেই। তুই যা,তোর গোলোমোলু প্রেমিককে বল তার বাড়ির লোককে জানাতে তোদের ব্যাপারে। আমি বিয়েটা করে নিচ্ছি। ঝামেলা বিদায় হচ্ছে।
***
বাড়ির পরিবেশ কোনো কারনে থমথমে হয়ে আছে। উর্বী কারন টা বুঝতে পারছে না। সে নিজের ঘরের বিছানায় চুপচাপ বসে ছিলো। আসরের নামাজ বাদ ছেলেপক্ষ চলে আসার কথা। তারা এখনও আসেনি। আসলে উর্বীকে জানানো হতো। উর্বীর ঘরের দরজা চাপানো,বাইরে কি হচ্ছে তা স্পষ্ট সে শুনতে পারছে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছে রেজাউল কবির কারো সাথে তর্ক করছে ফোনে।
উর্বী যেভাবে বসেছিলো ঠিক সেভাবেই বসে থাকে, চুপচাপ। হঠাৎ করে রুহি হুরমুর করে ঘরে ঢুকে উর্বীর দিকে তাকায়।
উর্বী কিছু জানতে চাওয়ার আগেই রুহি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে,”তোমার যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা। সে পালিয়েছে ফুঁপি।”
উর্বী রুহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তহুরা এসে ঘরে ঢুকে বলতে থাকে,”পাত্র পালিয়েছে।”
উর্বী স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”আচ্ছা।”
তহুরা উর্বীর কথা শুনে অবাক হয় না। সে জানে উর্বী এই প্রকৃতির মহিলা। আগে অবশ্য ছিলোনা,তবে হয়ে গিয়েছে।
উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে তহুরার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমরা ঘর থেকে বেরিয়ে যাও ভাবী। আমি শাড়িটা চেঞ্জ করবো। গা চুলকাচ্ছে আমার।”
তহুরা রুহিকে নিয়ে চলে গেলে উর্বী গাঁয়ের শাড়িটা পালটে নেয়। শাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছিলো উর্বীর।
হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে শাড়িটা বিছানার উপর রেখে দেয়।
আচ্ছা এটা কেমন হলো? পাত্র জানিয়ে দিলেই পারতো সে বিয়ে করতে চায়না। পালালো কেনো? তাকে কি জোর করে বেঁধে উর্বির সাথে বিয়ে দিতো? কলিজা পঁ’চা লোক সম্ভবত।
তবে বেশ হয়েছে। উর্বীর হঠাৎ কেন জানি খুব হাসি পাচ্ছে।
রেজাউল কবির যদি এখন এসে বলে দেয়,”অনেক হয়েছে! এবার তুই বাড়ি থেকে বের হ। তোর নিজের জীবন তুই বোঝ, তাহলে উর্বীর জীবনের ষোলকলা পূর্ণ হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দু দুটো চাকরি খুইয়ে উর্বীর এবার চাকরি পেতে খুব বেগ পেতে হচ্ছে। এই মূহুর্তে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না। ঘুরে ঘুরে টিউশনি করানোর মতো অ’দম্য মানসিক শক্তি তার নেই। চাকরি একটা পেয়ে গেলেই কিছু একটা ভাবনা চিন্তা করা যাবে।”
বাড়ির পরিস্থিতি এখন খুবই ঠাণ্ডা। অবশ্য কিছুক্ষণ আগে রেজাউল কবির ছোটোখালার ফোন পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। কেনো গিয়েছে তা উর্বী জানে না। সে ঘর থেকেই বের হয়নি।
এশার নামাজের সময় হয়ে গিয়েছে। জানালা থেকে তাকিয়ে ল্যাম্পোস্টের আলোতে দেখা যাচ্ছে মুসল্লিরা সবাই টুপি মাথায় দিয়ে পাড়ার মসজিদে যাচ্ছে।
জানালার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উর্বী জানালা বন্ধ করে দেয়। বাড়িতে, বসার ঘর থেকে আবারও রেজাউল কবিরের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তার সাথে তহুরার তর্কা/তর্কি হচ্ছে। চারঘন্টা বাইরে কাটিয়ে কি করে এসেছে রেজাউল কবির?
উর্বী নিজের বিছানায় চুপ করে বসে থাকে। কি হচ্ছে না হচ্ছে তা দিয়ে তার কি! ফোনটা হাতে নিয়ে আরেকটা এনজিওতে নিজের সিভি পাঠিয়ে দেয়।
ঠিক তখনই রুহি এসে আবারও হুরমুর করে ঘরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”ফুপি ফুপি! তোমার বিয়ে হবে।”
***
উর্বী ভাইয়ের দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। রেজাউল কবির তহুরার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”ওকে শাড়ি পরতে বলো তহুরা। খালাম্মা আর ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পাত্রপক্ষ নিয়ে আসবে। পাত্র,পাত্রের মা,পাত্রের মেজো ভাই আর তার বৌ।”
উর্বী হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,”পাত্র পালিয়েছে বলে তার বিপত্নীক বড়ভাইকে বিয়ে করতে হবে? এতোটাও অসহায় ভাবি না আমি নিজেকে। হাস্যকর।”
রেজাউল কবির বোনের দিকে তে’ড়ে যায়,”কি ভাবিস তুই তাহলে?”
_আমার রুচিতে বাঁধছে ভাইয়া।
_তাই নাকি? আর তোর সত্যিটা জানলে কোনো ছেলের রুচিতে কুলোবেনা তোকে তাও নিশ্চই জানিস।
রেজাউল কবিরের এই একটা কথায় উর্বী চুপ হয়ে যায়। রেজাউল কবির বোনকে অতি জঘন্য কথাটা বলে নিজে নিজেকে মনে মনে ধি’ক্কার দিতে থাকে,কিন্তু সে কঠিন গলায় তহুরাকে বলে,”ওকে তৈরি হতে বলো। পাত্রের বয়স বিয়াল্লিশ বছর। আমাদের মা যদি সতের বছরের ছোটো হয়ে বাবার সাথে সংসার করতে পারে তাহলে ও বারো বছরের পার্থক্য নিয়ে দিব্যি পারবে। ছেলের তিনটা বাচ্চা আছে। এটাও কোনো বিষয় না, খুঁতে খুঁতে কাটা’কাটি হয়ে যাবে। ও নিজে দুধে ধোওয়া তুলসী পাতা হলে চিন্তা করতাম।”
কথাগুলো শেষ করে রেজাউল কবির হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির আঙিনায় চলে যায়। উর্বী মাথা ঘুরিয়ে তার ভাবীর দিকে তাকায়। তহুরা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
***
লম্বা একটা ঘোমটা টেনে উর্বী চুপচাপ বসে আছে। বাড়িতে কিছুক্ষণ আগে পাত্রপক্ষ চলে এসেছে। সবাই সম্ভবত বসার ঘরে বসে আছে।
উর্বী একদৃষ্টে বিছানার চাদরের নকশার দিকে তাকিয়ে আছে। এই চাদরটাকে আগে কখনও দেখেনি। নতুন নিয়েছে নাকি ভাবী! রুহি-রাইসা,উপমা কেউই নেই আশেপাশে।
হুট করে দরজা ঠেলে রেজাউল কবির ঘরে ঢোকে,তার পিছু পিছু কাজী সাহেব।
তহুরা এসে উর্বীর বিছানার সামনে একটা চেয়ার টেনে দেয়। কাজী সাহেব বসে উর্বীর দিকে একপলক তাকিয়ে বলতে থাকে,”পাত্র ঢাকার উত্তরা নিবাসী মোহাম্মদ রাওনাফ করিম খান। পিতা মরহুম তোফায়েল করিম খান। পাত্র তোমাকে নগদ তিন লক্ষ এক টাকা মোহরানা প্রদান করে বিবাহ করতে চায়,তুমি যদি এই বিয়েতে রাজি থাকো তাহলে কবুল বলো মা।”
উর্বীর হঠাৎ করে খুব হাসি পাচ্ছে। সে বহু কষ্টেও হাসি চেপে না রাখতে পেরে হেসে ফেলে।
কাজী খানিকটা ভড়কে যায় উর্বীর এমন অদ্ভুত আচরণে। তহুরা আর রেজাউল কবির একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দীর্ঘক্ষণ হেসে উর্বী চুপ হয়ে যায়, চোখের কোণে দুফোঁটা অশ্রু জড়ো হয়েছে যা মেরুন রঙের বেনারসীর ঘোমটার আড়ালে সবার অগোচরেই থেকে যায়। সে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”কবুল।”
চলমান……..