আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-১০

0
228

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১০)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(২০)
মেহরিন রিজওয়ানের শার্টের কলার্ট ঠিক করে দিতে দিতে বললো….

—“সাবধানে যেও। অপরিচিত জায়গা, অপরিচিত মানুষজন সবাই। ভয় পাবে না একদম। এসব বড় জায়গায় নিজেকে নিশ্চিন্ত ও আত্মবিশ্বাসী হিসেবে তুলে ধরতে হয় সবসময়।”

রিজওয়ান মেহরিনের দুই কাঁধের উপর দুইহাত রেখে ওর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললো….

—“আমার বউ যে এতোকিছু জানে আর এতো সুন্দর ভাবে বুঝাতে পারে তা তো আমার আগে জানা ছিলো না।”

মেহরিন হাসিমুখে বললো….
—“হয়েছে এখন বউয়ের প্রশংসায় পন্ঞ্চমুখ হয়ে থাকলে আজ আর কাজে যাওয়া হবে না।”

—“একটাই তো বউ আমার তার প্রশংসায় পন্ঞ্চমুখ না হয়ে কি পারা যায়!”

মেহরিন বললো…
—“এই সরো তো তুমি। আর যাও এখন কাজের উদ্দেশ্যে।”

রিজওয়ান মেহরিনের এমন কথায় কিছুটা অভিমানী স্বরে বললো…
—“কাজ হতে না হতেই বউ তুমি আমাকে পর করে দিচ্ছো!”

মেহরিন চোখ ছোট ছোট করে রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো…
—“তুমি যাবে এখন!”

রিজওয়ান মেহরিনের কাছে থেকে সরে এসে বিছানার উপর থেকে নিজের সার্টিফিকেট রাখা ব্যগটা কাঁধে নিয়ে যেই না যেতে নিবে ওমনি সময় মেহরিন পিছন থেকে রিজওয়ানের হাত ধরে ওকে থামিয়ে দেয়। রিজওয়ান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই বললো…

—“কি হলো এখন আবার আটকাচ্ছো কেনো? এই তো যাওয়ার জন্য ভিষণ তাড়া দিচ্ছিলে।”

মেহরিন রিজওয়ানের অভিমানের স্বরে বলা কথার ভাঁজ বুঝতে পেরে রিজওয়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওর দু’গালে দু’হাত রেখে পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে নিজের উচ্চতা খানিকটুকু বাড়িয়ে রিজওয়ানের কপালে একবার ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। মেহরিনের এরূপ কাজে রিজওয়ানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। রিজওয়ান একহাতে মেহরিনের কমোর জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে ওকে মিশিয়ে নিয়ে অন্যহাত দিয়ে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বললো…..

—“এখানে দাও নচেৎ এই অভিমানের মেঘ মনের আকাশ থেকে বিদায় নিবে না।”

রিজওয়ানের এরূপ কথায় মেহরিন লজ্জায় নুইয়ে যায়। রিজওয়ান মেহরিনকে লজ্জায় নুইয়ে যেতে দেখে বললো….

—“এভাবে লজ্জা পেলে তো আজ সত্যি সত্যিই আমার কাজে যাওয়া হবে না বউ।”

মেহরিন আরো কিছুটা লজ্জা পেয়ে রিজওয়ানের বুকে আলতো ধা*ক্কা প্রয়োগ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো….

—“ছাড়ো আমায়, দেড়ি হয়ে যাচ্ছে তো তোমার।”

—“একটু দেড়ি তুমি করিয়েছো আরেকটু দেড়ি আমি স্বইচ্ছায় করবো। দো*ষের কিছু নেই এতে।”

এই বলে রিজওয়ান মেহরিনের থুতনি স্পর্শ করে ওর নুইয়ে থাকা মুখশ্রী কিছুটা তুলে ধরে ওর ঠোঁটের ভাঁজে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। মেহরিন রিজওয়ানের আকস্মিক এমন কাজে দু’চোখ শক্ত ভাবে বুঁজে ফেলে। কিয়ৎক্ষণ ওরা দু’জনে একে-অপরের মাঝে ডুবে থাকার পর রিজওয়ান হাসিমুখে মেহরিনকে ছেড়ে দেয়। মেহরিন রিজওয়ানের সামনে থেকে সরে এসে বিছানার এক পার্শের স্ট্যন্ড ধরে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক এর থেকে কিছুটা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। মেহরিনের ঠোঁটে লজ্জামিশ্রিত হাসির রেখা ফুটে আছে। রিজওয়ান হাসিমুখে দরজার দিকে যেতে যেতে বললো….

—“বউয়ের ভালোবাসায় মনে অফুরন্ত শান্তি নিয়ে কেবল ভাগ্যবান পুরুষরাই ঘরের বাহিরে যেতে পারে। আজ নিজেকেও সেই ভাগ্যবান পুরুষদের মাঝে একজন বলে মনে হচ্ছে।”

রিজওয়ানের এরূপ কথা বলা শেষ হওয়া মাত্র মেহরিন ঘুরে দরজার দিকে তাকাতেই দেখে রিজওয়ান ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে। মেহরিন দ্রুত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই দেখে রিজওয়ান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। অতঃপর মেহরিন রুম থেকে বেড়িয়ে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ায়। বিয়ের পর আজই প্রথম মেহরিনের হয়তো পুরো একটা দিন-ই রিজওয়ানকে না দেখে তার সাথে কথা না বলে কাটবে। রিজওয়ান সিঁড়ি বেয়ে নেমে মূল দরজা পেরিয়ে বাহিরে চলে যায়। রিজওয়ান চোখের আড়াল হলে মেহরিন নিজেই নিজের মনকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে, এখন তো এই সামান্য সময়ের দুরত্বের সাথে তাঁকে মানিয়ে নিতে হবেই। এই দুরত্বই খুব শীঘ্রই তাদের জীবনে ভালো সময় ডেকে আনবে।

(২১)
দুপুর ১টা…..
ঊর্মিলা ঊষাকে নিয়ে ঢলতে ঢলতে গরমে হাস-ফাঁস করতে করতে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। ঊষা দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। ঊর্মিলা কোনোরকমে হেঁটে ডাইনিং রুমে এসে চেয়ারের সাথে শরীর এলিয়ে বসে পরে। সকালে জায়ে জায়ে ঝ*গড়া বি*বাদ করায় রান্নাও শেষ করতে পারে নি দু’জনের একজনও। সকাল থেকে খালি পেটে থাকায় শরীর আরো বেশি দূর্বল লাগছে ঊর্মিলার। এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়ার মতো শক্তি যেনো ওর হচ্ছে না। কিন্তু পানি খাওয়ার প্রয়োজন মনে করছে খুব। পরিবেশ পরিস্থিতি এখন আর আগের মতো নেই যে যেকোনো কাজের জন্য মেহরিনকে হুকুম করতে পারবে নির্দ্বিধায়। ঊর্মিলার ভাবনায় ছেদ ঘটে ডাইনিং এ রুমির আগমনে। ঊর্মিলা ওভাবেই বসে থেকে বললো…

—“রুমি…আমাকে একটু লেবুর শরবত করে দাও তো। ভিষণ পিপাসা পেয়েছে। আর ক্লান্তও লাগছে।”

ঊর্মিলার এরূপ কথা শুনে রুমি তেজী স্বরে বললো….
—“আমাকে কি তোমার ব্যক্তিগত কাজের মেয়ে মনে করো নাকি যে এভাবে হুকুম করছো!”

রুমির এরূপ কথায় ঊর্মিলার ক্লান্ত ভাব মুহূর্তেই যেনো বিরক্তি ভাবে রূপ নিলো। ঊর্মিলা বিরক্তির স্বরে বললো..

—“যদি তোমাকে আমি আমার ব্যক্তিগত কাজের মেয়েই ভাবতাম তাহলে শুধু লেবুর শরবত করে দিতে বলতাম না। পাশাপাশি আমার হাত-পা ও টিপে দেওয়ার হুকুম দিতাম।”

রুমি উচ্চস্বরে বললো…
—“সকালে তো সামান্য রান্না করতে বলা হয়েছিলো তোমাদের দুই বউকে। সেই কাজটুকুও তো করতে পারো নি। সকাল সকাল সকলকে না খেয়ে বাহিরে যেতে হয়েছে। এখন কি সামান্য কাজ করে বাহির থেকে এসেছো তাতেই আমাকে হুকুম করছো শরবত বানিয়ে দেওয়ার জন্য! যত্তোসব বড়লোকি চাল-চলন। চলো তো আমার বাবার টাকায়। নিজের স্বামীর এতো মুরদ আছে নাকি যে নিজের টাকায় তোমার জন্য কাজের মেয়ের খরচ বহন করতে পারবে!”

রুমির এরূপ কথায় ঊর্মিলার রাগে সর্বশরীর জ্বলে উঠে যেনো। ঊর্মিলা অত্যন্ত রাগ নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমির সম্মুখপানে এসে দাঁড়িয়ে যেই না রুমিকে থা*প্প*ড় দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছে সেইসময় রাহেলার কন্ঠে ‘মেজো বউমা’ শব্দটি শোনামাত্র সে থেমে যায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য পুরো পরিবেশে থমথমে ভাব বিরাজমান হয়। ঊর্মিলা অনেক কষ্টে নিজের রাগকে দ*মি*য়ে হাত নামিয়ে নেয়। রাহেলা দ্রুত কদমে ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রাগী দৃষ্টি নিয়ে একবার রুমিকে দেখে পরপরই নিজের দৃষ্টি ঊর্মিলার উপর স্থির করে বললেন….

—“তোমার এতো বড় সাহস তুমি আমার মেয়ের শরীরে হাত উঠানোর জন্য উদ্যত হয়েছো!”

রাহেলাকে ঊর্মিলার উপর রেগে যেতে দেখে সেই রাগের আগুনের মাত্রা বাড়াতে রুমি নিজের মুখ দিয়ে ঘি এর গোলার মতো কথা ছুঁ*ড়ার নিয়ত নিয়ে বললো….

—“দেখো আম্মা দেখো, তোমার গোছানো সংসারের এ কেমন হাল হয়েছো দেখো। একবার তোমার সৎ ছেলে আমাকে মারলো এখন আবার তোমার নিজের ছেলের বউও আমাকে মা*রার জন্য উদ্যত হলো। এ বাড়িতে যে আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে তা সবাই আমাকে খুব ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছে। তুমি আমার জন্য ছেলে দেখা শুরু করো মা। এ বাড়িতে আমার বিন্দুমাত্র সম্মান অবিশিষ্ট নেই। আমি আর থাকতে চাই না এ বাড়িতে।”

এই বলে রুমি ন্যকা স্বরে কাঁদতে শুরু করে। ঊর্মিলা রুমির এমন কাজে অবাক না হয়ে পারে না। সামান্য লেবুর শরবত করতে বলায় সেই সামান্য বিষয়টাকে টেনে কতোই না বিশাল বানাচ্ছে সে। ঊর্মিলা কিছু বলতে নিবে সেইসময় রাহেলা অত্যন্ত রাগ নিয়ে ঊর্মিলার গালে একটা থা*প্প*ড় দিয়ে বসেন। রাহেলার আকস্মিক এমন কাজে ঊর্মিলা স্তব্ধ হয়ে যায়। থা*প্প*ড় খাওয়া গালের উপর একহাত রেখে নিজের দৃষ্টি মেঝের উপর স্থির করে রাখে সে। রাহেলা রাগী স্বরে বললেন….

—“যে প্রাণী যেই ভাষায় কথা বললে বুঝে তার জন্য সেই ভাষাই প্রয়োগ করা উচিত। পর কখনও আপন হয় না। এই কথাটা চিরন্তন সত্য। ছেলের বউরা কখনও নিজের মেয়ের জায়গা নিতে পারে না। তোমাকে আর শেফালিকে আমি রুমির থেকে কম আপন মনে করি নি কখনও। কিন্তু তোমরা যে আসলে আপন হওয়ার যোগ্য-ই নও তা খুব ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছো। আর কখনও যদি তোমার বা শেফালির জন্য আমার মেয়ের চোখে পানি এসেছে তখন তোমাদের আমি আমার সংসার থেকে চিরতরের জন্য আলাদা করে দিবো। কথাটা ভালোভাবে মাথায় ঢুকিয়ে নাও।”

এই বলে রাহেলা দ্রুত কদমে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলেন। রুমি ও মায়ের পিছন পিছন যেতে যেতে ঘাড় বাঁকিয়ে ঊর্মিলার নিস্তব্ধ মুখশ্রী দেখে একহাতে নিজের চোখের কর্নিশে মাত্র জমা অশ্রুকণাগুলো মুছো ঠোঁটে বাঁকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে। ওরা দু’জনে চলে যাওয়ার পরও কিয়ৎক্ষণ ধরে ঊর্মিলা আগের ন্যয় ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। অতিরিক্ত গরম, না খেয়ে অর্ধেক বেলা পার করার পাশাপাশি রাহেলার দেওয়া থা*প্প*ড়ে*র রেশ উর্মিলা নিতে পারে না। মেহরিন নিজরুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো। সেইসময় সে ঊর্মিলাকে ধপ করে মেঝের উপর পরে যেতে দেখে। মেহরিন ‘মেজো ভাবী’ বলে উচ্চস্বরে ডেকে দ্রুত কদমে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে ঊর্মিলার পাশে বসে পরে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে