#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৯)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)
(১৮)
রাতের বেলা…
রাহেলা বেগম এর রুমে একত্র হয়েছে তার দুই ছেলে-বউমা ও মেয়ে রুমি। ঊর্মিলা রাগী স্বরে বললো….
—“আম্মা..আপনারা তো জানেন-ই না আজ সন্ধ্যার একটু আগে আপনার সৎ ছেলে-বউমাকে কারা যেনো বিশালাকার চার চাকার গাড়ি করে বাড়ির মূল দরজার সামনে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে আমি আর ভাবী ওদের প্রশ্নও করেছিলাম। কিন্তু রিজওয়ানের প্রতিত্তুরে কেবল অ*প*মা*নিত বোধ-ই হয়েছে আমাদের। এসব তো আর সহ্য করা যাচ্ছে না। কি ভাবে ওদের দমন করা যায় সেটা বলুন।”
শেফালি বললো…..
—“এবার ওদের ঠিক এমন ভাবে দমন করতে হবে যেনো এ বাড়ি থেকে ওদের চিরতরের জন্য বের হয়ে যেতে হয়। গলা উঁচিয়ে রিজওয়ানের নিজেকে এবাড়ির বংশধর হিসেবে দাবি করা ঘুঁ*চে যাবে।”
রাজিবুল রাগে ফোঁ*স ফোঁ*স করতে করতে বললো….
—“সকালের অ*প*মা*ন আমি এখনও ভুলি নি আম্মা। আমার সর্বশরীরের র*ক্ত ট*গ-ব*গ করে ফুঁ*ট*তে*ছে। ঐ রিজওয়ানকে মা*র*তে মা*র*তে এ বাড়ি ছাড়া না করা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না।”
রুমি বললো….
—“এই ১৭ বছর বয়সে তুমি বা আমার ভাইয়েরা কখনও আমার শরীরে একটা ফুল দিয়েও টোকা দাও নি আর তোমার সৎ ছেলে সকলের সামনে আমাকে থা*প্প*ড় দিয়েছিলো আম্মা। ছোট-বড় অনেক অ*প*মা*ন মূলক কথাও শুনিয়েছিলো। তখন তো তোমার সৎ ছেলে-বউকে শা*য়ে*স্তা করার কথা বলে আমাকে শান্তনা দিয়েছিলে তাহলে এখনও চুপচাপ বসে আছো কেন তুমি আম্মা! কিভাবে আমাদের সবার র*ক্ত শীতল করবে তুমি শুনি।”
রফিকুল ব্যতিত ওদের সকলের বলা কথা গুলো শোনার কিয়ৎক্ষণ পর রাহেলা বেগম বললেন….
—“রিজওয়ান কিছু করার পূর্বেই আমি তোদের বাবাকে দেশে আসতে বলবো ভাবছি। তারপর নিজেদের মতো করে সামনা-সামনি তাঁর কান রিজওয়ান আর বউয়ের বিরুদ্ধে বি*ষ মন্ত্র ভরে দিবো৷ কাজটা এমন ভাবে সম্পন্ন করবো যেনো শরীফ সাহেব আমাদের কথা বিশ্বাস করতে দু’বার না ভাবেন।”
রফিকুল ভাবুক স্বরে বললো….
—“কিন্তু তুমি বাবাকে কি বলে দেশে আসার জন্য বাধ্য করবে আম্মা!”
রাহেলা বাঁকা হেসে বললেন….
—“সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাক তোরা। যা করার আমি একাই করবো।”
(১৯)
সকালবেলা…….
রাহেলা নিজরুম থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই দেখলেন মেহরিন উনুনের পাশে বসে রুটি বেলতেছে। রাহেলা ভ্রু কিন্ঞ্চিত কুঁচকে নিয়ে রান্নাঘরের ভিতরে প্রবেশ করে মেহরিনের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন….
—“আমার অনুমতি না নিয়েই সকাল সকাল উনুন বন্ধ করে রুটি বানানোর সাহস কি করে হলো তোমার? তোমার মনে হচ্ছে না কি তুমি আর তোমার স্বামী অনেক বেশিই বাড়াবাড়ি করতেছো সব বিষয়ে!”
রাহেলার এরূপ কথাগুলো মেহরিনের উপর যে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারলো না তা মেহরিনের হাতের কাজ বন্ধ করতে না দেখেই বুঝতে পেরেছেন রাহেলা। মেহরিনের এই শান্তরূপ রাহেলার রাগের পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় যেনো। পরক্ষণেই রাহেলা রাগ নিয়ে মেহরিনের সামনে কিছুটা ঝুঁকে পিড়ার উপর থাকা রুটিটা ধরতে নিলে মেহরিন রাহেলার হাত ধরে বাঁধা প্রদান করে। অতঃপর রাহেলার দিকে তাকিয়ে মেহরিন শান্ত স্বরে বললো….
—“সকাল সকাল সামান্য বিষয়কে কেনো টেনে বড় করার চেষ্টা করছেন আপনি আম্মা! আমার স্বামী আলুর পরোটা খেতে চেয়েছে তাই শুধু ওর জন্যই অল্প পরিমাণে তৈরি করছি আমি। এতে তো আপনার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আর রইলো আপনার থেকে অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করার বিষয়! আচ্ছা আপনার থেকে আমাকে অনুমতি নিতে হবেই বা কেনো? আপনি যেমন এই সংসারের বউ আমিও তো তেমনই এই সংসারের বউ। আপনার অধিকারের জায়গার পরিমাণ যতোটুকু আমারও ততোটুকুই। আমার স্বামীকে আপনি হয়তো আপনার বাকি ছেলের মতো আপন ভাবেন না কিন্তু এ বাড়ির মূল কর্তা আমার শ্বশুড় মশাই তো ভাবেন! তার দেওয়া অর্থ দিয়েই তো সংসারের সব খরচ মিটে। তাহলে এই টাকা দিয়ে আপনার বাকি দুই ছেলে-বউমা’রা নিজেদের মর্জি মতো খরচ করে চলতে পারলে আমি আর আমার স্বামী কেনো পারবো না! এখন থেকে নিজের হাত ও মুখ নিয়ন্ত্রণে রেখে চলতে শিখুন। নয়তো হাত-মুখ তাদের নিজ নিজ জায়গায় নাও থাকতে পারে।”
এই বলে মেহরিন ঝা*ট*কা মে*রে রাহেলার হাত ছেড়ে দিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোনিবেশ করে। মেহরিনের বলা প্রতিটা শব্দ যেনো রাহেলার মস্তিষ্কে গিয়ে সূচের মতো ফুঁ*টে*ছে। যেই মেয়ে দু’দিন আগেও চোখ তুলে তাকানোর সাহস করতো না আজ সেই মেয়েই মুখ বন্ধ করে দেওয়ার মতো কঠিন জবাব দিলো। রাহেলার সম্পূর্ণ মুখশ্রী অ*প*মা*নে থমথমে হয়ে গিয়েছে। তিনি আর কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। বিয়ের পর এই প্রথম শ্বাশুড়ির মুখের উপর প্রতিবাদ মূলক প্রতিত্তুর করার পর মেহরিনের বুকের ভিতরটা যেনো অনেকটা হালকা হয়ে যায়। কাজ করতে করতেই মেহরিনের রিজওয়ানের কথা মনে পড়ে। রিজওয়ান-ই মেহরিনকে বলেছিলো ওর আড়ালে অ*ন্যা*য় হলে যেনো মেহরিন তা মুখ বুঁজে তা সহ্য না করে। প্রতিবাদ করার সাহস যখন রিজওয়ান নিজে দেখাতে একবার শুরু করেছে তখন তার স্ত্রী হিসেবে মেহরিনকেও নিজের ভিতর সেই সমপরিমাণ সাহস রাখতে হবে। মেহরিন আজ ওর স্বামীর কথা রাখতে পেরেছে।
.
.
.
.
অফিসের পোশাক পরিধান করে রাজিবুল ও রফিকুল ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। এছাড়াও মেহরিন আর রিজওয়ান ব্যতিত বাকিরাও উপস্থিত আছে। রাজিবুল নিজের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে একপলক তাকাতেই দেখলো ঘড়িতে তখন সময় ৮টা বেজে ৩০ মিনিট। রাজিবুল উচ্চস্বরে শেফালি আর ঊর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“এখনও রান্না শেষ হলো না তোমাদের! আজ কি অফিসে ৯টার জায়গায় ১২ টার সময় যাবো আমি শেফালি!”
রাজিবুলের তালে তাল মিলিয়ে রফিকুল ও বললো….
—“ঊর্মিলা আমারও অফিসের জন্য দেড়ি হয়ে যাচ্ছে তো। রান্না যতোটুকু শেষ করতে পেরেছো তা-ই নিয়ে এসো।”
শেহতাজ ঊষার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো…
—“আমি তো চাচ্ছি মা’য়ের আর বড় মা’য়ের রান্না শেষ হতে আরো বেশি সময় লাগুক। তাহলে আজ আর আমাকে কষ্ট করে স্কুলেও যেতে হবে না আর পরীক্ষাও দিতে হবে না।”
ছোট্ট ঊষা শেহতাজের বলা পুরো কথাগুলোর মানে বুঝতে না পেরে চোখের আকৃতি বড় বড় রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মাত্র। রুমি রাহেলাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“মা..আজ কলেজে আমার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। ভাবীরা রান্না শেষ করতে এতো সময় লাগালে আমার বাস-ই মিস হয়ে যাবে। তখন আমি কলেজ এই তো যেতে পারবো না।”
রাহেলা ওদের সবার কথা আর অস্থিরতা নিতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। রাহেলা রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই শেফালি আর ঊর্মিলাকে কথা কাটাকাটি করতে দেখে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন। রান্নাঘরে মাটির একটাই চুলো বসানো রয়েছে। একসাথে কেবল একটা কিছুই রান্না করা সম্ভব সেখানে। আর শেফালি ঊর্মিলাকে বলছে ‘সে আগে নিজের স্বামী-সন্তানের জন্য রান্না শেষ করবে’ আর ঊর্মিলাও শেফালিকে একই কথার পুনরাবৃত্তি করে শুনাচ্ছে। রাহেলা নিজের শাড়ির কুঁচি গুলো একহাতে জড়ো করে ধরে লম্বা কদম ফেলে শেফালি আর ঊর্মিলার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ধমকের স্বরে বললেন…..
—“থামো তোমরা।”
রাহেলা বেগমের ধমকে ওরা দু’জনেই চুপ হয়ে যায়। পরক্ষণেই রাহেলা লক্ষ্য করলেন উনুন এখনও ধরানোই হয় নি আর মেঝের উপরেও দু’টো বড় বোলে কাঁচা সবজি গুলো অসমান ভাবে কেটে রাখা রয়েছে। এমনটা দেখে রাহেলা বুঝতে পারলেন এখন পর্যন্ত তার দুই বউমা রান্নার ‘র’ ও শুরু করে নি। অতঃপর রাহেলা ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পি*ষে বললেন….
—“দেড় ঘন্টা হলো তোমরা দু’জনে রান্নাঘরে প্রবেশ করেছিলে আর এখনও পর্যন্ত একটা কিছুও রান্না করতে পারো নি! ওদিকে আমার ছেলেরা, নাতী-নাতনী, মেয়েটা তাদের কাজের স্থানে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে আর তোমরা একে-অপরের সাথে সমান তালে ঝগড়া করছো?”
ঊর্মিলা কিছুটা ন্যকা ভাব নিয়ে বললো….
—“আম্মা..এখানে আমার কোনো দো*ষ নেই। আমি সবজি সব কা*টা-কা*টি শেষ করে যেই মাত্র রান্না উঠাতে যাবো ঠিক করলাম ওমনি সময় ভাবী উনুনের সামনে বসে নিজের কা*টা-কা*টি করে যেতে লেগেছিলেন। আমি তাকে সরতে বললে তিনি বললেন তিনি-ই আগে রান্না করবেন তারপর আমি করার সুযোগ পাবো। আর এতোসময় আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।”
ঊর্মিলার এরূপ কথা শুনে শেফালি রাগী স্বরে বললো….
—“ছোট..তুমি তো দেখছি ভাড়ি কু*চু*টে মনের মানুষ। নয়তো নিজের করা কাজের ভাড় কি এভাবে অবলিলায় আমার উপর চাপাতে পারতে!”
শেফালির এরূপ কথা শুনে ঊর্মিলার মুখ কিছুটা শুকনো বর্ণ ধারণ করে বটে তবুও সে আমতা স্বরে বললো….
—“দেখো ভাবী…এখন মায়ের সামনে একদম ভালো সাজার চেষ্টা করো না তুমি৷”
—“ভালো সাজার চেষ্টা আমি না তুমি নিজে করছো। সবজি কাটা-কাটি প্রথমে আমার শেষ হয়েছিলো আর উনুন বন্ধ করে তুমি সেখানে বসেছিলে।”
ঊর্মিলা আবারও কিছু বলতে নিবে সেইসময় রাহেলা অত্যন্ত রাগ নিয়ে ধমকের স্বরে ওদের দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“চুপ…একদম চুপ। আর একটা শব্দ ও যদি তোমরা দু’জনে একে-অপরের মুখ থেকে করেছো তবে তোমাদের মুখ আমি সুঁই-সুতো দিয়ে সারাজীবনের জন্য সেলাই করে দিবো বলে দিলাম।”
এবার শেফালি আর ঊর্মিলা কিছুটা ভ*য় পেয়ে একেবারেই নিরব হয়ে যায়। রাহেলা আবারও বললেন…
—“বিয়ে হয়ে দু’জনে এ বাড়িতে এসেছো পর থেকে নিজেদের আরাম-আয়েশ এর কথা চিন্তা করে স্বামীর রোজগার কম জেনেও শ্বশুড়ের টাকায় কাজের মেয়ে রেখেছিলে। তাদের দিয়েই সংসারের যাবতীয় কাজ করিয়ে নিতে। এরপর যখন রিজওয়ান বউ নিয়ে আসলো তখন সব কাজের লোকদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে ওর একার উপরেই সংসারের যাবতীয় কাজ সামলানোর দায়ভার বর্তে দিয়েছিলে। দু’দিন হলো না রিজওয়ান নিজের বউকে সংসারের বাড়তি কাজ-কর্ম থেকে গুটিয়ে নিয়েছে আর তোমরা যাদের কিনা সারাক্ষণ গলায় গলায় ভাব থাকে তারা একবেলার রান্না করতে এসে এ আগে করবে তো ও পরে করবে করে করে তর্ক-ঝগড়া করছো! এ বাড়িতে কখনও আমার পরিবারের কোনো সদস্যকে বাহিরে যাওয়ার সময় খালি পেটে যেতে হয় নি। আজ শুধু মাত্র তোমাদের দু’জনের জন্য বাড়ির পুরুষ সদস্যরা, বাচ্চারা, আমার মেয়েটাকেও না খেয়ে বাহিরে যেতে হবে। নিজের স্বামী-সন্তান আর বাড়ির দু’জন সদস্যের জন্য একবেলার খাবার রান্না করতে পারো না সংসারের কেমন বউ তোমরা একটাবার চিন্তা করে দেখো।”
এই বলে রাহেলা রাগে হনহনিয়ে স্থান ত্যগ করলেন। শেফালি আর ঊর্মিলা একে-অপরের মুখশ্রী পানে একপলক তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। রাহেলা আবার ডাইনিং রুমে আসতেই দেখলেন সেখানে কেউ ই নেই। ওরা সকলেই যে আর অপেক্ষা করতে না পেরে বি*র*ক্তি নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছে তা বুঝতে রাহেলার আর বাকি থাকে না।
#চলবে ইনশাআল্লাহ……….