আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-০৭

0
45

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৭)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(১৩)
রিজওয়ান আর মেহরিন ছুটে সেই বৃদ্ধলোকটির পাশে এসে দাঁড়াতেই দেখলো লোকটি নিজের বুকের বাম পার্শে একহাত চেপে ধরে চোখ বুঁজে মৃদু ভাবে কাঁপছেন আর জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর অন্যহাত দিয়ে এখনও নিজের নাতনীর হাত ধরে রেখেছেন। ছোট্ট বাচ্চাটি ‘দাদু দাদু’ বলে কান্না করে যাচ্ছে কেবল। মেহরিন আর রিজওয়ান বৃদ্ধলোকটির হাতের দু’পাশে আলগা হয়ে বসতেই মেহরিন দ্রুততার স্বরে বললো….

—“শুনো..তুমি তোমার দু’হাত চাচার বুকের উপর রেখে জোড়ে জোড়ে চাপ দাও। আমার মনে হচ্ছে চাচার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এভাবে চাপ প্রয়োগ করলে তার বুকের ভিতরটা হালকা হয়ে আসবে আশা করা যায়।”

রিজওয়ান অবাক দৃষ্টি নিয়ে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরিন রিজওয়ানকে এখনও বসে থাকতে দেখে বললো…

—“কি হলো! চাপ দাও।”

রিজওয়ান আর দেড়ি না করে মেহরিনের কথা অনুযায়ী বৃদ্ধ লোকটির বুকের উপর পর পর কয়েকবার চাপ প্রয়োগ করে। মেহরিন আবারও বললো….

—“থেমে যাও ৫ বার হয়েছে। ৫ বার করে চাপ প্রয়োগ করে কিছুসময়ের জন্য থেমে যেতে হবে। তারপর আবার ৫ বার চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ততোক্ষণ করতে হবে যতোক্ষণ পর্যন্ত না চাচার নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা স্বাভাবিক হচ্ছে।”

রিজওয়ান মেহরিনের কথা অনুযায়ী কাজ করতে থাকে। এভাবে মিনিট ২ করার পর বৃদ্ধ লোকটি একবার লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে জোরে জোরে কাঁশতে শুরু করেন। মেহরিন বললো….

—“শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের চেষ্টা সফল হয়েছে। আর কিছু করতে হবে না তোমাকে। চাচা একটুপরই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আসার সময় পার্কের বাহিরে একটা ছোট্ট ভাতের হোটেল দেখেছিলাম। সেখানে থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। চাচাকে একটু পানি খাওয়াতে হবে।”

রিজওয়ান তৎক্ষণাৎ বসা অবস্থা থেকে উঠে পানি আনার জন্য পার্কের ভিতরে ও বাহিরে যায় সেই মূল দরজার দিকে যেতে শুরু করে। মেহরিন বৃদ্ধ লোকটি ধরে বসতে সাহায্য করে। নিজের দাদুকে আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যেতে দেখে বাচ্চা মেয়েটিও কান্না থামিয়ে দেয়। বৃদ্ধ লোকটি চোখ মেলে তাকাতেই নিজের একপার্শে নাতনিকে আর অন্যপার্শে মেহরিনকে বসে থাকতে দেখে বললেন….

—“কে তুমি মা! আমার এই দু*র্সময়ে এভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়ালে। তুমি না থাকলে আজ আমার হয়তো আর জিবীত অবস্থায় বাসায় ফেরা হতো না।”

মেহরিন স্মিত হাসি দিয়ে বললো….
—“আমার নাম মেহরিন চাচা। আমি অতি সাধারণ একজন মেয়ে। এভাবে বলবেন না আপনি। প্রাণীকূলের হায়াত-মউত ঠিক করা সবই আল্লাহর উপর। আমি আর আমার স্বামী আপনার কাছে আজ উছিলা হয়ে এসেছিলাম মাত্র। তাই সৃষ্টিকর্তা ও রহমত বর্ষণ কারী ঐ আল্লাহ তায়ালার শুকুর আদায় করুন।”

—“হ্যা হ্যা তা সঠিক বলেছো তুমি মা। তোমার স্বামীকে তো দেখছি না। কোথায় সে?”

—“আপনার জন্য পানি আনতে পার্কের বাহিরে গিয়েছে। এসে পড়বে এক্ষুণি।”

মেহরিনের কথা শেষ হতে না হতেই ওরা লক্ষ্য করে সামনে থেকক ওদের দিকে বিশাল দেহের কালো পোশাকধারী ও হাতে একটা করে বিশালাকার ব*ন্দু*ক নিয়ে কয়েকজন গার্ডস দৌড়ে আসছে। মেহরিন তাদের চিনতে না পারায় বৃদ্ধ লোকটি ও বাচ্চা মেয়েটির সামনে এসে দু’হাতে পিছন থেকে তাদের ঘিরে ধরে বললো….

—“চাচা, আপনি ভ*য় পাবেন না আমি থাকতে এই গু*ন্ডা গুলো আপনাদের কোনো ক্ষ*তি করতে পারবে না।”

মেহরিনের কথা শেষ হতেই গার্ডসরা মেহরিনের সম্মুখপানে এসে দাঁড়িয়ে পরে। মেহরিন গার্ডসদের উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বললো….

—“লজ্জা করে না আপনাদের একজন বৃদ্ধ লোক ও তার সাথে একজন ছোট বাচ্চা এবং একজন মেয়ে মানুষকে দেখে তাদের উপর হা*ম*লা করতে! কা*পুরুষের দলেরা। শরীর স্বাস্থ্য তো যথেষ্ট ভালো। গু*ন্ডা*মি না করে, ব*ন্দু*ক দেখিয়ে সাধারাণ মানুষদের ভ*য় না দেখিয়ে ভালো কোথাও গিয়ে নিজেদের শ্রম ব্যয় করে টাকা রোজগার করলেই তো পারেন।”

মেহরিনের মুখে এরূপ কথা গুলো শুনে গার্ডসরা আ*হা*ম্ম*কি দৃষ্টি নিয়ে একে-অপরকে দেখে কেবল। মেহরিনের পিছন থেকে বৃদ্ধ লোকটি আর বাচ্চা মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গেই শব্দ করে হেসে উঠে। ওদের হাসির শব্দ শুনে মেহরিন ওদের সামনে থেকে সরে একপার্শে এসে বসে অবাক দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়। বৃদ্ধ লোকটি হাসিমুখে বললেন….

—“ভ*য় পেও না ওরা। ওরা কেও খা*রা*প লোক কিংবা গু*ন্ডা না। ওদের সবাইকে আমাকে আর আমার নাতনিকে সমস্ত বি*প*দ-আ*প*দ থেকে রক্ষা করার জন্য গার্ডস হিসেবে নিয়োজিত করেছে আমার বড় ছেলে। পার্কে প্রবেশ করার পূর্বে ওদের পার্কের বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি আমার নাতনীকে নিয়ে ভিতরে এসেছিলাম। অনেক সময় হয়ে গেলো আমরা না ফেরায় ওরা চি*ন্তি*ত হয়েই এখানে চলে এসেছে।”

বৃদ্ধ লোকটির এরূপ কথা শুনে মেহরিন নিজের আচারণ ও কথার ধরণের জন্য কিছুটা লজ্জাবোধ করে। গার্ডসরা বৃদ্ধ লোকটিকে ধরে সেখানেই বসার জায়গায় বসিয়ে দেয়। সেইসময় রিজওয়ান একটা কাঁচের গ্লাসে করে পানি নিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। গার্ডসদের দেখে সেও কয়েক সেকেন্ডের জন্য অবাক হয়। মেহরিন রিজওয়ানের হাত থেকে পানির গ্লাসটি নিয়ে বৃদ্ধ লোকটিকে দিলে তিনি হাসিমুখে গ্লাসে থাকা সবটুকু পানি পান করে নেন। পরক্ষণেই বৃদ্ধ লোকটি বললেন…

—“ও-ই তাহলে তোমার স্বামী মেহরিন মা!”

—“জ্বি চাচা।”

—“নাম কি তোমার বাবা! কি কাজ করো?”

রিজওয়ান একপলক মেহরিনের দিকে তাকিয়ে পরপরই নিজের দৃষ্টি বৃদ্ধ লোকটির উপর স্থির করে বললো….

—“আমার নাম রিজওয়ান ইয়াসীর। আমি আপাতত বেকার, চাচা।”

রিজওয়ানের মুখে ‘বেকার’ শব্দটি শুনে বৃদ্ধ লোকটির ভ্রু কিন্ঞ্চিত কুঁ*চ*কে আসে। পরক্ষণেই তিনি শান্ত স্বরে গার্ডসদের উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“তোমরা আপাতত আমাদের থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়াও। কোনো প্রয়োজন হলে আমি ডেকে নিবো।”

অতঃপর গার্ডসরাও বিনাবাক্যে ওদের থেকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ে। বৃদ্ধ লোকটি রিজওয়ানের উদ্দেশ্যে বললেন…

—“মেহরিন মা’য়ের পাশে বসো তুমি বাবা।”

রিজওয়ান ও নিঃশব্দে মেহরিনের পাশে বসে পড়ে। বৃদ্ধ লোকটি আবারও বললেন….

—“আমার নাম আমজাদ চৌধুরী। এই শহরের সবথেকে বড় কোম্পানি চৌধুরী গ্রুপ অফ লিমিটেড এর প্রতিষ্ঠাতা আমি। তবে এখন কোম্পানি সামলানোর সব দায়িত্ব আমার একমাত্র ছেলে আরহাম চৌধুরীর উপর দিয়ে আমি অবসর নিয়েছি। ও আমার একমাত্র নাতনী আরফা। আরফার মা সানজিদ ওকে জন্ম দেওয়ার পর পরই আল্লাহর ইচ্ছেতে জান্নাতে চলে গিয়েছেন দীর্ঘ ৫বছর হলো। এরপর-ই আরহাম অনেকটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। বউমার স্মৃতি মনে করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে ২৪ ঘন্টার ভিতর ১৮ঘন্টার বেশি সময় ধরে নিজেকে বাহ্যিক কাজের মাঝে ব্যস্ত রাখতে শুরু করে। বাবা হওয়ার খাতিরে আরফার ২৪ ঘন্টা দেখাশোনার জন্য কয়েকজন মহিলা সার্ভেন্ট রেখেছে মাত্র। কিন্তু আরহাম যে এখনও আরফাকে মন থেকে গ্রহন করে নি তা বুঝতে আমার বাকি নেই। শত ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে রেখে আরফার হক থেকে ওকে বন্ঞ্চিত করে এসেছে বিগত বছর গুলো ধরে। ও মনে করে সানজিদের মৃ*ত্যু*র জন্য আমার নিষ্পাপ নাতনী আরফা দায়ী। যতোবার আরহামের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম প্রতিবারই ও আমাকে এক বুক হতাশা দিয়েছে মাত্র। জানি না ওর ভিতরে কাজ করা এই ভু*ল ধারণা কবে ভা*ঙ*বে। বাহ্যিক কাজ থেকে অবসরে আসার পর নাতনীর পিছনেই পুরো সময় ব্যয় করি আমি। প্রায় সময়ই এই পার্কে হাঁটতে আসি আরফার সাথে। আজও এসেছিলাম৷ এরপর যা হলো তা নিয়ে আর কি বলবো! সবকিছুর পরে আমাকে কেবল একটা বিষয়-ই ভাবায়, তা হলো ‘আমার অবর্তমানে আমার নাতনীটার কি হবে!’ বাবার অ*ব*হে*লায় বড় হতে হতে নিজেকে একলা মনে করতে শুরু করবে হয়তো!”

এই বলে আমজাদ একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আরফা ফ্যল ফ্যল দৃষ্টি নিয়ে নিজের দাদুর মুখশ্রী পানে চেয়ে আছে। দাদুর বলা এই কঠিন কথাগুলোর বেশিরভাগ কথার মানেই হয়তো সে বুঝে উঠতে পারে নি। আরফার এই চাহুনি মেহরিনের হৃদয়ে গিয়ে ধাঁ*রা*লো সুঁ*চে*র মতো বিঁ*ধে। কিয়ৎক্ষণ পর আমজাদ আবারও বললেন…..

—“আল্লাহর রহমতের জন্য ও আমাকে এই কঠিন বি*প*দ থেকে রক্ষা করার জন্য তোমাদের দু’জনকে আমার নিকট উছিলা হিসেবে পাঠানোর জন্য আমি তার লক্ষ্য-কোটি শুকরিয়া আদায় করছি। তোমাদের এই উপকারের মূল্য আমি কোনো কিছুর বিনিময়েই শোধ করতে পারবো না জানি তবুও আমি আমার সাধ্যের ভিতর থাকা এমন কিছু করে তোমাদের দুঃসময়ে তোমাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। এ নিয়ে আমি তোমাদের থেকে দ্বিমত শুনবো না।”

রিজওয়ান আর মেহরিন অবাক দৃষ্টি নিয়ে আমজাদের মুখশ্রী পানে তাকিয়ে রয়। আমজাদ শান্ত স্বরে বললেন….

—“আমি জানি মধ্যবিত্ত পরিবারে একজন প্রাপ্ত বয়সের বেকার ছেলে থাকলে তার উপর দিয়ে কতোটা মানসিক ধ*ক*ল যায়। পরিবার, সমাজ দুই-ই তাঁকে ছোট নজরে দেখে সবসময়। এর উপর তুমি বিবাহিত। তোমার উপর মেহরিন মা’য়ের সম্পূর্ণ দায়ভার ব*র্তে*ছে৷ হয়তো এখনও তোমার বাবা কিংবা ভাই তোমাদের খরচ বহন করছেন কিন্তু তারা তো আজীবন তোমাদের খরচ বহন করবেন না। এই সময়টা তোমাদের দু’জনের জন্যই দুঃসময়। তাই আগামীকাল সকাল ১০ টার ভিতর তোমার সি.ভি নিয়ে চৌধুরী গ্রুপ অফ লিমিটেড এ উপস্থিত হবে তুমি রিজওয়ান। আমিও থাকবো সেখানে আগামীকাল। রিসেপশনে তোমার কথা আমি পূর্ব থেকেই বলে রাখবো। তুমি শুধু তোমার নামটা বলবে তাহলেই তারা তোমাকে আমার নিকট পৌঁছাতে সহযোগিতা করবে। তারপর তোমার যোগ্যতা যাচাই করে তোমাকে আমি আমার কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিবো ইনশাআল্লাহ।”

আমজাদের এরূপ কথা শুনে মেহরিনের দু’চোখ খুশির নোনাজলে টইটম্বুর হয়ে উঠে। উপকারের এতো বড় প্রতিদান যে তারা পাবে এমনটা কল্পনাও করে নি ওরা। রিজওয়ান মাথা নুইয়ে রেখেছে। প্রতিত্তুরে কিছু বলার ভাষা যেনো ওরা হারিয়ে ফেলেছে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে