আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-০৬

0
53

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৬)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(১০)
নিজের রুমে এসে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে রুমি শব্দ করে কান্না করছে। সেইসময় রাহেলা আর ঊর্মিলা রুমির রুমে প্রবেশ করে রুমির পাশে এসে বসেন। রাহেলা বললেন…

—“রুমি..মা আমার, এভাবে কান্না করিস না। শরীর খারাপ করবে তোর।”

রুমি কান্না করতে করতে বললো…
—“তুমি আর ভাবীরা তো ওখানে উপস্থিত ছিলেই মা। যখন তোমার সতীনের ছেলে আমাকে থা*প্প*ড় দিলো আবার এতো বড় বড় কথা শুনালো তখন কিছু বললে না তো? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে অ*প*মা*নিত হতে দেখেছো তোমরা। আর এখন এসেছো শান্তনামূলক বাক্য শুনাতে! দরকার নেই আমার তোমাদের কোনো শান্তনার। চলে যাও তোমরা আমার রুম থেকে। আমাকে একা থাকতে দাও তোমরা। চলে যাও।”

রাহেলা রাগে ক্ষি*প্ত হয়ে বললেন….
—“আমার ফুলের মতো সুন্দর মেয়ের শরীরে হাত উঠিয়েছে ঐ জা*লি*ম। সকালে আমার কলিজার টুকরা বড় ছেলেকে আ*ঘা*ত করেছিলো। আবার বড় বড় কথাও শুনিয়েছিলো আমাদের সবাইকে। এই সবকিছু যে আমরা এমনি এমনিই মুখ বুঝে সহ্য করবো এমনটা তুই ভাবিস না মা। রিজওয়ান আর ওর বউয়ের হঠাৎ উদয় হওয়া এই সাহসিকতার আর চাপার জোড়ের ফল যে ওদের জন্য কতোটা ভ*য়া*বহ হতে চলেছে তা ওরা কল্পনাও করতে পারবে না। আজ তোর মেজো ভাইয়াকে বাসায় ফিরতে দে। বড় খোকার মন-মানসিকতাও একটু ভালো হোক। তারপর সবাই মিলে একত্রে বসবো আমরা এর একটা উপযুক্ত বি*হী*ত করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে।”

রুমি শোয়া অবস্থা থেকে উঠে নিজের মা’কে জড়িয়ে ধরে।

(১১)
মেহরিনের কোলের উপর মাথা রেখে চোখ বুঁজে শুয়ে আছে রিজওয়ান। মেহরিন রিজওয়ানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো…

—“বাবা কি সত্যিই দেশে ফিরবেন?”

রিজওয়ান চোখ মেলে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বললো…
—“হুম আসতে তো হবেই বাবাকে দেশে। কিন্তু তার আগে যে ভাবেই হোক আমাকে একটা চাকরিতে যোগদান করতে হবে। দেখি আরো নতুন কয়েক জায়গায় আবেদন করার জন্য বের হবো আগামীকাল।”

—“আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। অ*ন্যা*য়ের প্রতিবাদ করার মতো সাহস যেমন তিনি জুগিয়ে দিয়েছেন তেমনি তোমার কোনো না কোনো জায়গায় চাকরিই মিলিয়ে দিবেন তিনি।”

—“ফি আমানিল্লাহ….বউ।”

—“আজ আমাকে নিয়ে একটু বাহিরে যাবে!”

—“কেনো?”

—“বাড়ি থেকে কিছুটা সামনে নাকি একটা ছোট্ট পার্ক আছে শেহতাজের থেকে শুনেছিলাম। ওখানে গিয়ে তুমি আমি হাত ধরে কিছুসময় হাঁটাহাঁটি করবো। বেন্ঞ্চে বসে থাকবো। আমার কোলে এভাবে মাথা রেখে শুয়ে থেকো তুমি। আমি তোমার সাথে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই কিছুসময়।”

রিজওয়ান হাসিমুখে বললো….
—“ঠিক আছে, বিকেলবেলা তুমি আর আমি মিলে যাবো সেখানে।”

বিকেলবেলা….
ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছেন রাহেলা, ঊর্মিলা আর শেফালি। সেইসময় রিজওয়ান আর মেহরিন সুন্দর, মার্জিত পোশাক পড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসতে দেখে ওদের তিনজনের ভ্রু কিন্ঞ্চিত কুঁ*চ*কে যায়। ওরা নিচে আসতেই ঊর্মিলা বললো….

—“দুপুরের রোদ পড়তে না পড়তেই কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি!”

রিজওয়ান শান্ত স্বরে বললো….
—“বাহিরের পোশাক পড়ে আছি দু’জনেই মানে বাহিরেই যাবো। এতোটুকু বিষয় বুঝতে তো সমস্যা হওয়ার কথা না তোমার মেজো ভাবী!”

ঊর্মিলা দাঁতে দাঁত চেপে রিজওয়ানের ত্য*ড়া জবাব হজম করে নেয়। শেফালি বললো….

—“সংসারের কাজ করা থেকে নিজের বউকে ছাড়িয়ে নিলে ভালো কথা। কিন্তু তোমার বউ যে প্রতিদিন বিকাল করে আমার ছেলে আর ঊর্মিলার মেয়েকে পড়াশোনা করায় সে কথা কি সে ভুলে গিয়েছে! নাকি ওদের পড়ানোও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও ছেড়ে দিতে বলেছো তুমি তোমার বউকে?”

রিজওয়ান শেফালির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিয়ে বললো…
—“শেহতাজ আর ঊষা আমার ভাতিজা-ভাতিজি হয়। ঐ নিষ্পাপ প্রাণ দু’টো কখনও আমাকে বা আমার স্ত্রীকে ক*ষ্ট দেয় নি। নিজেদের ছোট্ট মন খুলে যতোটুকু পেরেছে প্রকৃত, স্বা*র্থ*হীন ভালোবাসা উজার করে দিয়েছে। মেহরিন আগেও যেমন ওদের পড়াশোনা করাতো ভবিষ্যতেও করাবে৷ আজ একটু সময়ের অনিয়ম হয়ে যাবে। আমরা যেহেতু বাহিরে যাচ্ছি তাই বাহির থেকে আসার পর সন্ধ্যায় ওদের পড়াতে যাবে মেহরিন।”

শেফালি তেজি স্বরে বললো….
—“তোমাদের বাহিরে গিয়ে ফু*র্তী করার জন্য আমাদের ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার সময়ের অনিয়ম করাতে হবে নাকি? ওসব তো হবে না। প্রতিদিন বিকেল বেলা তোমার বউ আমাদের ছেলে-মেয়েকে যেমন পড়াতো আজও তেমনই পড়াবে। দরকার পড়লে তোমরা রাতে বাহিরে যাবে।”

রিজওয়ান শান্ত স্বরেই বললো….
—“তোমরা তোমাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করানোর জন্য তোমরা আমার স্ত্রীকে বেতন দাও না যে তোমাদের হুকুম পালন করতে সে বাধ্য থাকবে। তাই প্রতিটা কথা বলার পূর্বে ভেবে-চিন্তে কথা বলিও।”

এই বলে রিজওয়ান ওদের আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মেহরিনের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। ঊর্মিলা বললো….

—“দেখেছেন মা দেখেছেন! কেমন বার বেড়েছে এরা দু’জনে। বিশেষ করে রিজওয়ান। ওর চাপার জোড়েই ওর বউ ও সাহস পাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি এদের একটা উপযুক্ত ব্যবস্থা না করলে চলবে না। হুট করেই যদি রিজওয়ানের কথায় বাবা দেশে চলে আসেন আর তার কানে রিজওয়ান আমাদের করা যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কথা তুলে দেয় তাহলে তো সব শেষ হয়ে যাবে। এ বাড়িতে আমাদের রাজত্বের দিন ফুরিয়ে যাবে। রিজওয়ানই যে এ বাড়ির আসল বংশধর এ কথা তো মি*থ্যে না। তাই ওর জোর আমাদের থেকে যথেষ্ট বেশি।”

রাহেলা বললেন….
—“এসব ভেবে দু*শ্চি*ন্তা করো না মেজো বউমা। রিজওয়ান যতোই এ বাড়ির আসল বংশধর হোক না কেনো আগে যেমন এ বাড়িতে আমাদের রাজত্ব চলতো ভবিষ্যতেও তেমন চলবে। ওদের অতিরিক্ত বারের জন্য ওদের পিঠে গজানো পাখা জোড়া কে*টে ফেলবো খুব তাড়াতাড়ি।”

(১২)
বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর রিজওয়ান আর মেহরিন একে-অপরের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেই পার্কের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। এখানে ঢোকার জন্য টাকা ব্যয় করে টিকিট নিতে হয় না। যার যার যখন ইচ্ছে সে সে তখন অনায়াসেই ভিতরে প্রবেশ করতে ও বের হতে পারে। পার্কের মূল দরজা দিয়ে অনেকটা দূর পর্যন্ত সরু একটা পাঁকা রাস্তা চলে গিয়েছে৷ রাস্তার দুই ধারে ইট-পাথর দিয়ে বিভিন্ন জ্ঞানী, মহাপুরুষদের মূর্তি বানিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও পুরো পার্ক জুড়ে সুগন্ধী ছড়ানোর জন্য ও সৌন্দর্যে ভরপুর রাখার জন্য নানান ধরনের রং-বেরঙের ফুল-ফলের গাছ লাগানো রয়েছে। পার্কটির জায়গায় জায়গায় মানুষজনদের বসার ব্যবস্থা করা রয়েছে। এছাড়াও ছোট বাচ্চাদের আনন্দের সহিত সময় পার করার জন্য দোলনা, স্লিপার সহ নানান ধরনের জিনিস পত্র রয়েছে। মেহরিন চারপাশটা খুব মনোযোগী ও মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে দেখছে। আর রিজওয়ান নিজের দৃষ্টি কেবল মেহরিনের মুখশ্রী পানেই স্থির রেখেছে। বেশকিছুসময় ধরে পুরো পার্কের ভিতরে চারপাশ হাঁটাহাঁটি করার পর মেহরিন আর রিজওয়ান একটা বসার স্থানে এসে বসে। রিজওয়ান একমুহূর্তও দেড়ি না করে মেহরিনের কোলের উপর মাথা রেখে আদুরে স্বরে বললো…

—“এবার আমার চুলে হাত বুলিয়ে দাও তো বউ। আমি কিছুসময় চোখ বুঁজে আরাম করি।”

মেহরিন হাসিমুখে রিজওয়ানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে আর যে স্থানে বসেছে সেখানে পিঠ ঠেকিয়ে খোলা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। বিয়ের পর কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে মেহরিন পুরোপুরি ভাবে বাড়িবন্দীনি হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন ধরে সংসারের যাবতীয় কাজ করার পর ক্লান্ত শরীরটাকে কোনোরকমে বিছানায় এলিয়ে দিতে পেরেছিলো ছিলো। প্রতিদিন এর রুটিন হয়ে গিয়েছিলো এটাই। এই প্রথম মেহরিন রিজওয়ানের সাথে এমন খোলামেলা পরিবেশে এসেছে। তাই আজকে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে মেহরিন। মেহরিনের মাঝে এখন যে প্রশান্তি কাজ করছে তা সে কাওকে ভাষায় বলে প্রকাশ করতে পারবে না হয়তো।

এভাবেই যে কতোসময় পেরিয়ে যায় তা মেহরিন বা রিজওয়ান খেয়াল করে উঠতে পারে না। কিয়ৎক্ষণ পর মেহরিন একজন মধ্যবয়সের লোককে একটা মিষ্টি ৪-৫ বছরের মেয়ে বাচ্চার হাত ধরে পার্কের ভিতর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখে। তারা মেহরিন আর রিজওয়ান বসার স্থানের সম্মুখপানের রাস্তা দিয়ে হাঁটা চলা করছে। এমন দৃশ্য দেখে মেহরিনের ওর বাবা আর মামার কথা মনে পড়ে। ছোটবেলায় মেহরিনের বাবা বেঁচে থাকাকালীন সেও ওর বাবার হাত এভাবে ধরে বিভিন্ন জায়গায় হাঁটাচলা করতো। সেসব স্মৃতি আবছা ভাবে মনে আছে মেহরিনের। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মেহরিন ওর মামার সাথেও বিভিন্ন জায়গায় হাঁটাহাঁটি করেছে। সেসব স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে মেহরিনের। ভাবতে ভাবতেই ওর দু’চোখের কোণে অশ্রুরা জমে আসে। মেহরিন একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো….

—“মামা-মামী কতোদিন তো তোমাদের দেখি না। ভিষণ মনে পড়ছে তোমাদের কথা। জানি না কেমন আছো তোমরা!”

মেহরিনের ভাবনায় ছেঁদ ঘটে ওদের পিছন থেকে ভেসে আসা কোনো বাচ্চার ‘দাদু ভাই, দাদু ভাই’ বলে বলে কান্না করার শব্দে। রিজওয়ান ও মেহরিনের কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসে। মেহরিন আর রিজওয়ান পিছন ফিরে তাকাকেই দেখে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে মেহরিন যেই মধ্যবয়সের লোকটিকে ছোট বাচ্চা নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছিলো সেই লোকটি রাস্তা উপর পড়ে আছে আর তার মাথার কাছে বসে বাচ্চা মেয়েটি কান্না করছে। এমন দৃশ্য দেখে রিজওয়ান আর মেহরিন বসা অবস্থা থেকে উঠে ওদের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে