আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-০৫

0
58

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৫)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৭)
রাজিবুল অত্যন্ত ব্য*থা*য় আরো জোরে জোরে আ*র্ত*না*দ করতে শুরু করেছে। কিন্তু সেসবের কোনো প্রভাব রিজওয়ানের উপর পড়ছে না। রিজওয়ান রাগে হিসহিসিয়ে বললো….

—“তোরা হয়তো ভুলে গিয়েছিস এই বংশের সাথে তোদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। তোরা কেবল নামে মাত্র আমার জন্মদাত্রী বাবার সন্তান। আজ থেকে ১৭ বছর আগে আমার বাবা যদি শ্রদ্ধেয় নাটক*বা*জ সৎ মাকে বিয়ে করে তোদের সমেত এ বাড়িতে না আনতো তাহলে তোদের স্থান এখন রাস্তায় হতো। অন্যের বাসায়, জমিতে কা*ম*লা খেঁ*টে দিন এনে দিন খেয়ে দিন পার করতে হতো। সবেমাত্র মা হারা এই ছেলেটা সেইসময় তোদের নিজের পরিবার বলে মেনে নিয়েছিলো। তোদের মাকে নিজের মায়ের স্থানে বসাতে চেয়েছিলো আর তোদের নিজের বড় ভাইয়ের স্থানে। কিন্তু কথায় আছে পায়ের জুতো সবসময় পায়ে পড়লেই মানায়। পায়ের জুতোকে মাথায় তুলে মাথার তাজ বানাতে চাইলে সেটা অত্যন্ত বেমানান দেখায়। আমি এতো যাবৎ ধরে এই বিষয়টাকে বুঝেও না বোঝার ভান ধরে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এতে তোরা বড্ড পেয়ে বসেছিলি। এই বংশের, এই বাড়ির, এই সব সয়-সম্পত্তির কে আসল উত্তরাধিকারী সেটা তোরা ভুলে গিয়েছিলি। বাবার সামনে দুধে ধোঁয়া তুলসী পাতার মতো স্বচ্ছ ভাবে নিজেদের তুলে ধরিস আর বাবার আড়ালে আমাদের সামনে নিজেদের আসল চেহারা বের করিস। অনেক লুকোচুরি খেলা হয়ে গিয়েছে। এবার সময় এসেছে তোদের আসল রূপ সম্পর্কে বাবার অবগত হওয়ার। খুব শীঘ্রই বাবা দেশে ফিরবেন। তারপর তোদের চোখে আঙুল দিয়ে তোদের আসল জায়গাটা তিনিই দেখিয়ে দিবেন।”

এই বলে রিজওয়ান রাজিবুলের হাত ছেড়ে ওকে স্বজোরে ধা*ক্কা দেয়। আকস্মিক এই ধা*ক্কা*র বেগ সামলাতে না পেরে রাজিবুল মুখ থু*ব*রে মেঝের উপর পড়ে যায়। অতঃপর রিজওয়ান মেহরিনের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজেদের রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। শেফালি ছুটে যায় রাজিবুলের দিকে। রাজিবুল অত্যন্ত রাগে মেঝের উপর বাম হাত দিয়ে কয়েকবার বা*রি দেয়। শেফালি রাজিবুলের থেকে কিছুটা দূরে ভী*ত মুখশ্রী নিয়ে বসে রয়। উপস্থিত বাকিদের মুখে চিন্তা ও হ*ত*ভ*ম্ব*তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। শেহতাজ ঊষার হাত ধরে সেখান থেকে চলে যায় নিজের রুমে। কিয়ৎক্ষণ পুরো পরিবেশ জুড়ে থ*ম*থ*মে ভাব বিরাজ করে। পরক্ষণেই ঊর্মিলা রফিকুলের গা ঘেঁ*ষে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বললো….

—“কি গো এখন কি হবে! খোঁ*চা মে*রে মে*রে ঘুমন্ত সিং*হ কে তো জাগিয়ে দিয়েছি আমরা। এখন তার থা*বা থেকে আমরা নিজেদের বাঁচাবো কি করে?”

রফিকুল ওর প্যন্টের ডান পকেট থেকে সাদা রংয়ের পাতলা রুমালটা বের করে নিজের কপালে জমে আসা বিন্দু বিন্দু ঘামের কনা গুলো মুছতে শুরু করে। পরক্ষণেই সে কোনো প্রতিত্তুর না করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। ঊর্মিলা কেবল ফ্যল ফ্যল চাহুনি নিয়ে রফিকুলকে যেতে দেখে৷

(৮)
মেহরিনকে নিয়ে নিজেদের রুমে আসার পর রিজওয়ান বিছানায় বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। মেহরিন বিছানার পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে রিজওয়ানের মুখোমুখি বসে ওর দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো….

—“এই পানিটুকু খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো।”

রিজওয়ান ওর ভ্রুযুগল কিন্ঞ্চিত কুঁচকে নিয়ে মেহরিনের দিকে তাকায়। মেহরিন ইশারায় আবারও পানিটুকু খেতে বলে রিজওয়ানকে। রিজওয়ান বাধ্য ছেলের মতো মেহরিনের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি শেষ করে। মেহরিন ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে রিজওয়ানের কপালে ও সম্পূর্ণ মুখশ্রীজুড়ে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামের কনাগুলো স্বযত্নে মুছে দিতে শুরু করে। রিজওয়ান একহাতে মেহরিনের কমোর জড়িয়ে ধরে ওকে নিজের একেবারে কাছে টেনে নেয়। রিজওয়ানের আকস্মিক এমন কাজে মেহরিন কিছুটা ভ*র*কে গেলেও পরপরই নিজেকে সামলে নেয় সে। রিজওয়ান মেহরিনের কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বললো…..

—“এতো ভালোবেসো না বউ। আমার যে হিং*সে হবে যখন আমার ভালোবাসার মাঝে কেউ ভাগ বসাবে। তখন নিজেকে সামলাবো কি ভাবে?”

মেহরিন অবাক স্বরে বললো….
—“ও মা…আমি তো তোমাকেই ভালোবাসি। আর সারাজীবন শুধু তোমাকেই ভালোবেসে যাবো। তোমার ভালোবাসায় আবার ভাগ বসাতে যাবে কে শুনি?”

—“দু’দিন পর যখন তোমার আর আমার মাঝে আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে ছোট্ট কয়েকটি প্রাণ আসবে তখন তো তুমি তাদের যত্ন নিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ওরা তো তখন আমার একার জন্য বরাদ্দ করা ভালোবাসার ভিতরেই ভাগ বসাবে। তখন তো আমার হিংসে হবেই বলো!”

রিজওয়ানের এরূপ কথা শুনে লজ্জায় কুঁ*ক*ড়ে যায় মেহরিন। ঠোঁটে লজ্জাজনক হাসি দিয়ে রিজওয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো….

—“সেই চিন্তা তো সমান ভাবে আমারও করা উচিত। আমার একার জন্য তোমার মনে বরাদ্দ করা ভালোবাসায়ও তো তখন ওরা ভাগ বসাবে। তাহলে আমিও হিং*সে করবো কি!”

রিজওয়ান দু’হাতে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বললো….
—“আল্লাহর রহমতে আমাকে বাবা হওয়ার মতো কতো বড় সুখ দিবে তুমি আর তোমার ভালোবাসায় ওদের কি করে ভাগ বসাতে দিবো বলো! তোমার জন্য আমার মনে যে বিশাল জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছে সেই জায়গায় কখনও কেও ভাগ বসাতে পারবে না বউ। ঐ নিষ্পাপ প্রাণ গুলোর জন্য তোমার জায়গার পাশে নতুন করে জায়গা তৈরি করে দিবো কেমন! ওখানেই ওদের জন্য সকল ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া বিরাজ করবে।”

মেহরিন হাসিমুখে বললো….
—“একই কাজ আমিও করবো।”

রিজওয়ান হাসিমুখে বললো….
—“তাহলে তোমাকে আদর দিয়ে মা হতে সাহায্য করার কাজ শুরু করে দি বলো!”

মেহরিন আরো বেশি লজ্জা পেয়ে বললো….
—“ইসসস..তুমি না একটা যা*চ্ছে তাই হয়ে যাচ্ছো দিনকে দিন।”

মেহরিন লজ্জা পেয়েছে বুঝে রিজওয়ান নিঃশব্দে হাসতে শুরু করে।

(৯)
সকাল ১১ টা….
মেহরিনের একমাত্র ননদ রুমি সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে মেহরিনকে ডাকতে ডাকতে বললো….

—“ছোট ভাবী…ও ছোট ভাবী…কোথায় তুমি! আজ আমার রুমে বেড টি দাও নি কেনো? ঘুম থেকে উঠে বিছানায় থাকাকালীন সময়েই গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যাস আমার সে কথা কি তোমার মাথায় নেই নাকি ইচ্ছে করেই আমার সকালটা নষ্ট করার জন্য এমনটা করেছো তুমি! ছোট ভাবী…ও ছোট ভাবী!”

রুমির চেঁচা-মেচি শুনে রিজওয়ান মেহরিনকে নিয়ে নিজেদের রুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ির সাথে থাকা বারান্দায় রেলিং এর ধার ঘেঁ*ষে দাঁড়ায়। রিজওয়ান পূর্বেই মেহরিনকে কোনো কথা বলার জন্য বারণ করে দিয়েছিলো। যা বলার সে নিজেই বলবে রুমিকে। বাড়ির ছোট দুই সদস্য আর রাজিবুল ব্যতিত শেফালি, ঊর্মিলা আর রাহেলাও ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়। ঊর্মিলা শেফালির কানের কাছে নিজের মুখ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো….

—“যা বুঝতেছি দেবর মশাই এবার রুমিকে জ*ব্দ করে ছাড়বে।”

শেফালি কোনো প্রতিত্তুর করলো না। উপরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই রিজওয়ান কিছুটা উচ্চস্বরে বললো….

—“ক’টা বাজে এখন রুমি?”

রুমি চোখ ডলতে ডলতে মাথা তুলে উপরে রিজওয়ানের দিকে একপলক তাকায় ওর পাশেই মেহরিনকেও দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায়। রুমি কিছুটা বি*র*ক্তি*র স্বরে বললো….

—“ক’টা বাজে সেটা ঘড়িতে দেখো। আমি কি ঘড়ি হাতে নিয়ে বসে আছি নাকি যে আমাকে জিজ্ঞাসা করছো! আর ছোট ভাবী..তুমি ওখানে সং*য়ের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো এখনও হ্যা! একে তো আমি বিছানা থেকে উঠার আগে আমার রুমে গ্রিন টি না দিয়ে সকালটাই মাটি করে দিয়েছো তার উপর তোমার সোহাগের স্বামীর আ*জা*ই*রা প্য*চা*লে আমার মাথা ধরে গেলো। আমি রুমে যাচ্ছি। ৫মিনিটের ভিতর যেনো আমার রুমে গ্রিন দিয়ে আসা হয়।”

এই বলে রুমি যেই না ওর রুমের দিকে পা বাড়াতে নিবে সেইসময় রিজওয়ান বারান্দা থেকে সরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বললো….

—“এক পা সামনের দিকে বাড়ালে তোর পা ভে*ঙে আমি তোকে নু*লো বানিয়ে দিবো রুমি।”

রিজওয়ানের এরূপ কথা শুনে রুমি থ*ম*কে গিয়ে অত্যন্ত অবাক দৃষ্টি নিয়ে রিজওয়ানের দিকে তাকায়। রিজওয়ান রুমির সামনে এসে দাঁড়িয়ে শুরুতেই কোনো কথা না বলে স্বজোরে রুমির বাম গালে একবার থা*প্প*ড় দেয়। থা*প্প*ড়*টি যে বেশ জোড়েই পড়েছে রুমির গালে তার জানান উপস্থিত প্রত্যেকের কান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েই দিচ্ছে। ঊর্মিলা একহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। রাহেলা কেবল রাগে ফোঁ*স ফোঁ*স করা ব্যতিত এইমূহূর্তে কিছুই করতে পারছেন না। শেফালিও নিস্তব্ধ, নি*র্বা*ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরিন ওর স্বামীর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিচে আসার মতো সাহস জুগিয়ে উঠতে পারে না বলে উপরেই বারান্দায় রেলিং ঘেঁ*ষেই দাঁড়িয়ে রয়। রিজওয়ান রাগে হি*স*হি*সি*য়ে বললো…..

—“তোর আর আমার বাবা একজনই জন্য তুই আমার রক্তের সম্পর্কের বোন হোস। কোনোদিন আমাকে বড় ভাই হওয়ার খাতিরে নূন্যতম সম্মান দিস নি তুই। এ নিয়ে এতোগুলো বছর ধরে আমি তোকে কিছুই বলি নি। কিন্তু তার মানে এই না তুই আমার বউয়ের সাথেও অ*মানুষের মতো আচারণ করবি আর আমি আজীবন ধরে তা সহ্য করে যাবো। তোর থেকে মেহরিন ৩-৪ বছরের সিনিয়র আর সম্পর্কে তোর ছোট ভাবী হয়। তাকে তুই কাজের মেয়ের মতো হুকুম করিস তোর ঘুম থেকে উঠার আগে তোর রুমে বেড টি দিয়ে আসার জন্য! দু’দিন পর তোর বিয়ে হলে পরের বাড়িতে যাবি। এই হুকুমের গোলাম তখন যদি তুই নিজে হোস তখন তোর কেমন লাগবে? তোর ননদ যদি এভাবেই তোর সাথে নিম্ন আচারণ করে তখন কি তুই নাচতে নাচতে তার সকল হুকুম পালন করবি? হ্যা…!”

রিজওয়ানের বলা প্রতিটি কথা শুনে রুমি কেঁ*পে কে*পে উঠে। ওর দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। রিজওয়ান আবারও বললো….

—“আজ থেকে তোর নিজের যাবতীয় কাজ তুই নিজে করবি। মেহরিন তোকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে যাবে না। বাবা দেশে আসা মাত্র তোর জন্য ছেলের সন্ধান করতে বলবো আমি। আর খুব শীঘ্রই তোকে বিয়ে দিয়ে এ বাড়ি থেকে চিরতরের জন্য বিদায় করে দিবো। পরের বাড়িতে গিয়ে খাঁ*টা*স তোর এই জোর কতো খাঁ*টা*তে পারিস। এখন দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।”

রুমি আর একমুহূর্তে জন্য সেখানে না দাঁড়িয়ে কান্না করতে করতে নিজের রুমে যায়। রিজওয়ান শেফালি, ঊর্মিলা আর রাহেলার দিকে ক্ষি*প্ত দৃষ্টি নিয়ে একপলক দেখে পরপরই দৃষ্টি সরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে আবারও উপরে চলে যায়। রাহেলা দ্রুতপায়ে রুমির রুমের দিকে অগ্রসর হয়। ঊর্মিলাও রাহেলার পিছন পিছন সেদিকে যায়। শেফালি নিজরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে